Sunday, July 24, 2011

।কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: কেল্লা লালবাগ প্রাসাদ-দুর্গ ।


। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: কেল্লা লালবাগ প্রাসাদ-দুর্গ ।
-রণদীপম বসু

 …
দুর্গ ও দুর্গ প্রাকার:
কেল্লা বা দুর্গ বলতে বোঝায় শক্ত বেষ্টনী প্রাচীরবেষ্টিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। উদ্দেশ্য আক্রমণকারীর হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষা। ফলে দুর্গ স্থাপত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সব সময়ই প্রায় এক রূপ হতে দেখা যায়। যেমন আভ্যন্তরীণ বৃত্তাকার বেষ্টনীপ্রাচীর বহিঃপ্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়, সাথে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিখা দ্বারাও পুনঃবেষ্টিত থাকে। আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই দুর্গের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো সাধারণত দুর্গের প্রবেশফটক ও পার্শ্ব-বুরুজ। তাই প্রবেশফটক এবং প্রতিরক্ষা প্রাচীর বা বুরুজ হয়ে থাকে প্রহরা কক্ষ সংবলিত। বেষ্টনী প্রাচীরের উপরিভাগে চলাচলের জন্য চওড়া পথের ব্যবস্থা থাকে যাতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে আক্রমণকারী শত্রুর আগমন লক্ষ্য করা যায়।


.
.
বাংলায় মুঘল আমলের দুর্গ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অন্যান্য স্থাপত্য ভবনের মতোই সুলতানি স্থাপত্য থেকে উৎস ও স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন রীতির হয়ে থাকে। কেননা সুলতানি আমলে বাংলা ছিলো স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলার সুলতানেরা সার্বক্ষণিক সজাগ থাকতো দিল্লির এবং কখনও কখনও প্রতিবেশী জৌনপুর রাজ্যের আক্রমণের আশঙ্কায়। ফলে সুলতানি দুর্গ ছিলো বিশাল প্রতিরক্ষা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুউচ্চ প্রাকার বেষ্টিত শক্তিশালী ও শৌর্যবীর্যপূর্ণ এবং দুর্গের অন্তপূরবাসীদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা সংবলিত। অন্যদিকে মুঘল আমলে সুবেদারের অধীনে বাংলা একটি প্রাদেশিক ভৌগলিক এলাকায় পরিণত হয়। কেন্দ্রীয় উত্তর ভারতের কেন্দ্রিক সরকার দ্বারা সুবেদার নিয়োজিত হতো। ফলে মুঘল সুবেদারেরা বহিঃআক্রমণের চিন্তা থেকে মুক্ত ছিলো। যদিও মাঝে মধ্যে তাদেরকে মারাঠা, পর্তুগিজ ও আরাকানীয় জলদস্যুদের উৎপাত প্রতিরোধ করতে হতো।
.
.
মারাঠারা স্থলপথে এবং পর্তুগিজরা জলপথে আসতো। শক্তিশালী মুঘল সুবেদারদের কাছে এরা তেমন কোন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী বলে পরিগণিত হয় নি। ফলে মুঘলদের বাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুলতানদের ন্যায় বিশাল দুর্গ স্থাপনার রূপ লাভ করে নি। মুঘলদের দ্বারা দুর্গ স্থাপনায় প্রতিরক্ষার জন্য যেসব বৈশিষ্ট্য বিকশিত হতো তা ছিলো শৈল্পিক ও আকর্ষণীয়। কারণ সুলতানদের তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষার অনিবার্য প্রয়োজন ছিলো, মুঘলদের তা দরকার ছিলো না। বাংলায় মুঘল দুর্গ ছিলো তাদের উত্তর ভারত কেন্দ্রিক রাজকীয় দুর্গের অনুকরণে প্রাসাদ দুর্গ (Palace Fortress)। তাই বিদ্যমান মুঘল দুর্গের অভ্যন্তরে তেমন কোন স্থাপনা বা ভবন দেখা যায় না। প্রাকার বেষ্টিত উন্মুক্ত স্থানে তাবু অথবা বসবাসের ভবন থাকতো যা যথেষ্ট স্থায়ী ছিলো না এবং স্থাপনা হিসেবেও গুরুত্ববাহী নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই মুঘল সুবেদারেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনিক প্রয়োজনে কিছু গ্যারিসন ফোর্ট নির্মাণ করেছিলেন। এগুলো প্রায় সবই ইট ও অন্যান্য ক্ষণস্থায়ী উপাদান দ্বারা নির্মিত হয়েছিলো। বর্তমানের তাদের সবই প্রায় বিলুপ্ত। স্থানীয় কিংবদন্তী ও লোকগাথা থেকে এগুলোর নাম জানা যায়। চট্টগ্রামের আন্দর কিল্লা সেরকমই একটি।
.
বর্তমানে বাংলায় সুলতানি দুর্গের নজির দলিল-দস্তাবেজে উদ্ধৃত থাকলেও বাস্তবে বিলুপ্তপ্রায়। আর মুঘল দুর্গের পরিচয় তুলে ধরার মতো বিদ্যমান দুর্গের সংখ্যাও খুব কম। মুঘল স্থাপত্যের প্রাসাদ দুর্গের (Palace Fortress) মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হচ্ছে ঢাকায় অবস্থিত লালবাগ দুর্গ।
.
.
লালবাগ প্রাসাদ দুর্গ বা কিল্লা আওরঙ্গাবাদ:
লালবাগ দুর্গ (Lalbagh Fort) সেই মুঘল আমল থেকেই ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। এবং বর্তমানে এটিই একমাত্র বিদ্যমান মুঘল দুর্গ যার মাধ্যমে বাংলায় মুঘল দুর্গের প্রকৃতি ও প্রতিরক্ষা বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র যুবরাজ মুহাম্মদ আযম শাহ ঢাকার সুবেদার থাকাকালীন ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গার তীরে এই দুর্গটির নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামে নাম রাখেন ‘কিল্লা আওরঙ্গাবাদ’ (Kella Aorangabad)। কিছুদিন এ নাম কিছু কাগজপত্রে উল্লিখিত হলেও সবাই একে লালবাগ দুর্গ নামেই জানতো। ধারণা করা হয় যে লালবাগ অঞ্চলটির পত্তন হয়েছে মুঘল আমলে ঢাকা রাজধানী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
.
.
সাধারণত আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যেই দুর্গ নির্মিত হলেও লালবাগ দুর্গের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিলো ভিন্ন। যুবরাজ আযম মূলত চেয়েছিলেন বুড়িগঙ্গার তীরে একটি মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করতে এবং সেটি রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিলো প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গ। কিন্তু যুবরাজ আযম দুর্গটি নির্মাণ শুরু করলেও দিল্লি থেকে তাঁর পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে তাঁকে দুর্গের কাজ অসমাপ্ত রেখে পরের বছরই চলে যেতে হয়। তাঁর পরিবর্তে ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলার সুবেদার হয়ে ঢাকায় এসে শায়েস্তা খান ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ দুর্গেই বসবাস করেন। কিন্তু সম্রাট আওরঙ্গজেব এই ‘কিল্লা আওরঙ্গাবাদ’-এর স্বত্ব শায়েস্তা খানকে দান করে দিলেও শায়েস্তা খান এ দুর্গের নির্মাণ শেষ করার দিকে আগ্রহী ছিলেন না। তবে জনশ্রুতি রয়েছে যে, তাঁর কন্যা ইরান দুখত বা বিবি পরীর অকাল মৃত্যুর কারণে শায়েস্তা খান এ দুর্গটিকে অপয়া বিবেচনা করে এর নির্মাণ কাজ শেষ না করেই এখান থেকে চলে যান কিল্লা মুবারাকাবাদে (Kella Mubarakabad), যেটি বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের স্থানে অবস্থিত ছিলো। লালবাগ দুর্গ নির্মাণকালে যুবরাজ মুহাম্মদ আযম শাহও এই কেল্লা মুবারাকাবাদেই বসবাস করতেন।
.
.
বিবি পরীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো যুবরাজ আযমের সঙ্গে। কিন্তু দুর্গ নির্মাণকালেই বিবি পরীর মৃত্যুর কারণে দুর্গটি অপয়া হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। এরকম ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় সম্রাট আকবরের আগ্রা দুর্গ পরিত্যাগের পেছনেও। কেননা এরকম ঘটনা অশনি সংকেত এবং দুর্ভাগ্যের লক্ষণ বলে বিবেচিত হতো। জানা যায় সম্রাট আকবরের যমজ পুত্র হাসান ও হুসাইনের মৃত্যু হলে তিনি সে দুর্গ ত্যাগ করে ফতেপুর সীক্রিতে চলে যান। লালবাগ দুর্গের ক্ষেত্রেও বিষয়টি কাকতালীয় হলেও মুঘল সংস্কারে তা অস্বাভাবিক ছিলো না হয়তো। লালবাগ দুর্গটি সেই থেকে দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক এর দায়িত্বভার গ্রহণ, সংরক্ষণ ও পুনঃসংস্কারের ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
.
.
লালবাগ দুর্গের গঠন বৈশিষ্ট্য:
১৮ একর জমির উপর নির্মিত এই লালবাগ দুর্গ নির্মাণকালীন সময়ে উত্তর দিকে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। বর্তমানে নদীটি দুর্গের নিকট থেকে সরে গিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে। দুর্গ ও নদীর মাঝখানের জায়গায় গড়ে উঠেছে ঘিঞ্জি বাসাবাড়ি। মূলত দুর্গ এলাকাটি আয়তাকৃতির, প্রায় সমচতুর্কেন্দ্রিক। পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় দু’হাজার ফুট লম্বা এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় আটশো ফুট চওড়া। দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি ইটের প্রাচীর। দুর্গের বহিঃপ্রাকারের উচ্চতা ৬.১০ মিটার এবং ১.৩৭ মিটার প্রশস্ত। অভ্যন্তরভাগের উচ্চতা ১৩.৭২ মিটার এবং দেয়াল প্রায় একই মাপে প্রশস্ত। অভ্যন্তর দেয়ালের উপরিভাগে প্রায় সমদূরবর্তী স্থানে প্রবেশ পথের অবস্থান দেখে দেয়ালের সাথে সংযুক্ত চলাচলের পথ ছিলো বলে ধারণা করা হয়। বহিঃপ্রাচীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেবল দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের দেয়ালেই পরিলক্ষিত হয়।
.
সর্বাপেক্ষা বৃহৎ প্রতিরক্ষা বুরুজ দক্ষিণ-পূর্ব দেয়ালের সাথে সংযুক্ত এবং তা ভূগর্ভস্থ কক্ষের সাথে সংযুক্ত হওয়ায় মনে করা হয় যে তা প্রয়োজনের সময় ব্যবহারের জন্যেই নির্মাণ করা হয়েছিলো। এ ধরনের ভূগর্ভস্থ রাস্তা এ দুর্গ থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে টঙ্গী নদীর সাথে সংযুক্ত ছিলো বলে জানা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দ্বিতল প্রতিরক্ষা বুরুজ এবং এর উপরিভাগে রক্ষিত পানির আধার দেখে এ স্থাপনাটিকে ‘হাওয়াখানা’ হিসেবে ধারণা করা হয়।
.
.
লালবাগ দুর্গের প্রবেশতোরণের (Lalbagh Kella Gateway) মধ্যে দুটি তোরণ এখনো টিকে আছে। এদের একটি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। এটি লালবাগের দক্ষিণ সদর ফটক। এবং অন্যটি দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণে, দক্ষিণ সদর ফটকের ঠিক বিপরীত দিকে। দক্ষিণ সদর ফটকটি বেশ জমকালো। তোরণের বহির্ভাগে উদ্গত জানালা এবং অভ্যন্তরে দ্বিতল তোরণটির উপর ও নিচের তলায় কয়েকটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। তবে উপরের তলাগুলি অসমাপ্ত। ইওয়ান রীতির প্রবেশফটক চতুর্কেন্দ্রিক খিলান পথের মাধ্যমে নির্মিত, যা মুঘল স্থাপত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তোরণের গম্ভুজটি খিলান পদ্ধতিতে নির্মিত এবং মৌচাক নক্সায় শোভিত। তোরণের উভয় দিকে কোণের ছাদের শীর্ষে আকর্ষণীয় মিনার রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্ব-উত্তর দিকেও দুর্গের ফটক ছিলো। দক্ষিণ-পশ্চিম ফটকটি বুড়িগঙ্গার গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে।
.
.
লাল সুরকি ও পাতলা ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছে দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীর (kella Defence Wall)। দক্ষিণ প্রতিরক্ষা প্রাচীরে নির্দিষ্ট দূরত্বে পরপর মোট পাঁচটি এবং পশ্চিম প্রাচীরে দুটি উদ্গত তোপমঞ্চ রয়েছে। নদীর দিকে নির্মিত এসব তোপমঞ্চ থেকে নদী পথে অগ্রসরমান আক্রমণকারীদের গোলাবর্ষণের মাধ্যমে প্রতিহত করার জন্যেই এগুলো নির্মিত হয়েছে বুঝা যায়।
.
.
দুর্গের অভ্যন্তরে তিনটি স্থাপনা রয়েছে। পূর্বদিকে অবস্থিত দিওয়ান খানা (Kella Audience Hall)। দ্বিতল এই ইমারতের নিচতলায় হামামখানা ছিলো বলে ইমারতটি হামামখানা (Hammam) নামেই পরিচিত। হামামখানার পূর্বপাশেই একটি ছোট দিঘি (Tank)। সম্ভবত হামামখানায় পানির প্রয়োজন মেটানোর জন্যেই এটি খনন করা হয়েছে। দুর্গের অভ্যন্তরে পশ্চিম দিকে অবস্থিত স্থাপনাটি হচ্ছে একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ (Mosque)। মসজিদে মোট দরজা রয়েছে পাঁচটি। পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে দু’টি। পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজাটি বড়। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব, মাঝের মেহরাবটি বড়।
.
.
হামামখানা ও মসজিদ, এই দুই স্থাপনার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বিবি পরীর সমাধিসৌধ (Pari Bibi’s Tomb)। এই সমাধিসৌধটি নির্মাণের জন্য শায়েস্তা খান রাজমহল থেকে ব্যাসাল্ট, চুনার থেকে বেলে পাথর, জয়পুর থেকে শাদা মার্বেল আনিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সমাধিসৌধে ঢোকার জন্যে চারদিকে চারটি দরজা রয়েছে। তার মধ্যে তিনটি মার্বেল পাথরের ঝালরে আবৃত। দক্ষিণেরটি অলঙ্কৃত চন্দন কাঠ দিয়ে। অবশ্য বর্তমানে দরজাগুলো সেই আদি অলঙ্করণ অবস্থায় নেই। পরিত্যক্ত থাকাকালীন সময়ে সম্ভবত সেগুলো চুরি বা লুট হয়ে গেছে বলে কথিত। সমাধিসৌধটি ন’টি অংশে বিভক্ত। ঠিক মাঝখানেরটিতে সমাহিত আছেন পরীবিবি। এর পাশে আরো দু’টি কবরে শায়িত আছেন শায়েস্তা খানের কথিত এক কন্যা শামসাদ বেগম ও পৌত্র খুদাবন্দ খান বা মীর্জা বাঙালী। এই সৌধের চারকোণায় চারটি অলঙ্কৃত মিনার। ছাদের গম্বুজ আলাদাভাবে তৈরি করে বসানো হয়েছে বলে জানা যায়। গম্বুজটি তামা দিয়ে ঢাকা। আগে এতে সোনালী রংয়ের কাজ ছিলো, যা রোদের আলোয় ঝলমল করতো। বাংলাদেশে গ্লেজ টাইলস, শাদা মার্বেল এবং কালো ব্যাসাল্টের  তৈরি নিদর্শন এই একটিই বর্তমান রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
.
.
লালবাগ দুর্গের পূর্বাপর হালচাল:
শায়েস্তা খান চলে যাওয়ার পর থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কেল্লার মালিকানা নিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, শায়েস্তা খানের ঢাকা ত্যাগের পর রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুঘল সৈন্যরা এই কেল্লা ব্যবহার করতো এবং তারপর তা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিলো। শেষপর্যন্ত লালবাগের প্রাচীর, ভেতরের ইমারতসমূহ জীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ে এবং হামামের পাশে পুকুরটি হয়ে উঠেছিলো দুর্গন্ধময়। আশেপাশের এলাকাও জঙ্গলে আকীর্ণ হয়ে যায়। ১৮৪২ সালে ঢাকা শহর উন্নয়নের জন্য গঠিত ‘ঢাকা কমিটি’, যা মূলত পৌরসভার পূর্বসুরি, শহরের একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে লালবাগ দুর্গের উন্নয়নের প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৮৪৪ সালে দুর্গটি লীজ নিয়ে কাজ শুরু করে এবং ১৮৪৭ সালের মধ্যে তা শেষ করা হয়। এদিকে ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকা অস্বাস্থ্যকর অঞ্চলে পরিণত হলে ১৮৫৩ সালে পুরানা পল্টনে অবস্থিত তৎকালীন সেনানিবাসটি স্থানান্তর করা হয় লালবাগ দুর্গে। আবার ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের পর লালবাগ থেকে সেনানিবাস সরিয়ে নেওয়া হয় এবং পুলিশ রিজার্ভ ফোর্সকে স্থানান্তর করা হয় লালবাগে।
.
.
১৯৪৭-এর আগে লালবাগ দুর্গে থাকতেন গাড়োয়ালী পুলিশরা। ১৯৪৭-এর পর সেখানে ছিলো আই.বি অফিস ও পুলিশ কর্মচারীদের বাসগৃহ। থানা ছিলো উত্তর দিকে। তবে এর বেশ আগেই লালবাগকে সংরক্ষিত কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়ে থাকলেও তা নিয়ে কারো খুব একটা মাথাব্যথা ছিলো না। ১৯৪৮ সালে লালবাগে পুলিশ বিদ্রোহ হলে আতঙ্কিত পাকিস্তানী সরকার লালবাগ থেকে পুলিশ ব্যারাকটি সরিয়ে নেয় এবং দুর্গটি আবারও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অবশেষে সম্পূর্ণ দুর্গটিকে নতুনভাবে সংস্কার করে দুর্গটির নির্মাণকালীন সময়ের সম্ভাব্য অনুকরণে বর্তমান অবস্থায় উন্নীত করে। জনবহুল পুরান ঢাকায় অবস্থিত লালবাগ দুর্গ বর্তমানে দর্শক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

.
তথ্য সহায়তা:
০১) স্থাপত্য / বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-২ / বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
০২)  ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী / মুনতাসীর মামুন।
০৩)  ছবি : রণদীপম বসু।

[ sachalayatan ]  
...

No comments: