Sunday, July 31, 2011

। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: রূপলাল হাউস ।


। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: রূপলাল হাউস ।
-রণদীপম বসু

বলা হয়ে থাকে, উনিশ শতকের ঢাকায়, নবাব আবদুল গণির ‘আহসান মঞ্জিলে’র সাথে জাঁকজমকের দিক দিয়ে অন্য যে অট্টালিকাটি পাল্লা দিতে পারতো, সেটি হলো রূপলাল দাসের ‘রূপলাল হাউস’ (Ruplal House)। ঢাকার ফরাশগঞ্জের শ্যামবাজারে বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মিত এই বাড়িটির তুলনা সে নিজেই। বাড়িটির বিশেষত্ব হলো, গ্রীক স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত এর বিশাল ডরিক কলাম, যা ঢাকা শহরে আর কোন বাড়িতে এই রীতির স্থাপনা নেই বা ছিলো না। এবং বাড়ির মাঝখানে চূড়ায় একটা প্রকাণ্ড ঘড়ি ছিলো, যা ঢাকার সম্মুখস্থ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে সহজেই দৃষ্টিগোচর হতো। এর দ্বারা সমস্ত নৌকারোহীরা উপকৃত হতো। কিন্তু ১৮৯৭ সালের তীব্র ভূমিকম্পে বাড়ির চূড়াটি ভেঙে গেলে তা আর মেরামত করা হয় নি।
 .
 
.
মূল বাড়িটির নির্মাণকাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও এটা জানা যায়, মূল বাড়িটি ছিলো ঢাকার বিখ্যাত আর্মেনী জমিদার আরাতুনের। ঢাকার ধনাঢ্য জমিদার রূপলাল দাস আরাতুনের কাছ থেকে ১৮৮০ সালের দিকে বাড়িটি ক্রয় করে কলকাতার বিখ্যাত মার্টিন কোম্পানিকে দিয়ে তা পূননির্মাণ করান। রূপলাল দাসরা ছিলেন তিন ভাই। সনাতন দাস, রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। এই তিনভাই পৃথক হয়ে যাবার পর রূপলাল ও রঘুনাথ ফরাশগঞ্জে নদীর পাড়ে নিজেদের বাড়ি করে সেখানে চলে যান। প্রথমে নির্মিত হয়েছিলো রঘুনাথের বাড়ি, যা পরিচিত ছিলো ‘রঘুবাবুর বাড়ি’ নামে। রঘুবাবুর বাড়ির ঠিক পাশেই হলো রূপলাল হাউস।
 .
 
.
রঘুনাথ ও রূপলালের বাড়িটির মাঝখানের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে দিলে দুটো বাড়িকে একটি একক বাড়ি বলে মনে হবে। তাই সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, পুরো বাড়িটি আরাতুনের কাছ থেকে কিনে দু’ভাই ভাগ করে যার যার অংশ নিজ রুচি অনুসারে সংস্কার করেছিলেন। তবে গ্রীক স্থাপত্যের অনুকরণে পুননির্মিত অট্টালিকাটি যে কোন অংশে আহসান মঞ্জিল থেকে কম ছিলো না, তা বুঝা যায় ঢাকার অভিজাত নাগরিকদের দ্বারা ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিনকে ‘রূপলাল হাউসে’ আপ্যায়নের ভেনু নির্বাচনের ঘটনায়।
 .
 
.
বড়লাট লর্ড ডাফরিন সেবার এক সরকারি সফরে কলকাতা থেকে ঢাকায় এলে ঢাকাস্থ অভিজাত ইংরেজরা তাঁকে আপ্যায়ন করার জন্য এক বল-নাচের আয়োজন করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু বল-নাচের জন্য প্রয়োজনীয় বড় হলঘর বা সুদৃশ্য ভবন ছিলো ঢাকায় কেবল দু’টি, আহসান মঞ্জিল আর রূপলাল হাউস। ঢাকার অভিজাতদের বৈঠকে শেষপর্যন্ত ভোটের মাধ্যমে রূপলাল হাউসকেই ভেনু হিসেবে নির্বাচন করা হয়। মূলত তখন আহসান মঞ্জিল থেকে তুলনামূলক আকর্ষণীয় ছিলো রূপলাল হাউসই। সেবার বড়লাটকে আপ্যায়ন উদ্দেশ্যে আয়োজিত এই বল-নাচের অনুষ্ঠান ঢাকায় তুমুল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছিলো। ইংরেজরা দু’দিনের জন্য ‘রূপলাল হাউস’ দুশো টাকায় ভাড়া নিলেও বাড়িটিকে সে উদ্দেশ্যে সাজাতে রূপলাল বাবুদের সে আমলে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিলো বলে জানা যায়।
 .
 
.
বিশ শতকে এসেই ‘রূপলাল হাউসে’র জৌলুস কমে গিয়েছিলো এবং ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর রূপলালের উত্তরাধিকারীরা বাড়ি বদল করে কলকাতায় চলে যান। এর পর থেকেই ‘রূপলাল হাউস’ সরকারি সম্পত্তির অংশীভূত হয়। তবে বর্তমানে রূপলাল হাউসের বেহাল অবস্থা দেখে দুঃখ হয় এজন্যে যে, এটা যে কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা রক্ষায় গুরুতর অবহেলা তা-ই নয়, হয়তো পরিকল্পিত হীন উদ্দেশ্য নিয়েই এখানে হলুদ মরিচ ইত্যাদির গুদাম তৈরির পাশাপাশি যে যেখানে যেভাবে পারে দখল করে যার যার ব্যবসা নিয়ে বসেছে এবং বাড়িটি ধ্বংসের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করছে। এমনকি বাড়িটির ভেতরেও বিভিন্ন কক্ষে অনেক উটকো পরিবারকে যথেচ্ছ বসবাস করতে দেখা যায়। স্বচক্ষে না দেখলে খোদ রাজধানীতে পরিকল্পিতভাবে প্রত্নতত্ত্ব ধ্বংসের এমন হরিলুট অবস্থা কল্পনা করা চিন্তারও অগম্য হতো নিঃসন্দেহে। কেবল ধিক্কার জানিয়েই কি এ অবস্থার অবসান হবে ?
.
 
.

তথ্য সহায়তা:
০১)  ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী / মুনতাসীর মামুন।
০২)  ছবি : রণদীপম বসু।

[ The Daily Ittefaq: 13-08-2011 ]

No comments: