Saturday, July 30, 2011

। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: রমনা গেট ।

 । কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: রমনা গেট ।
-রণদীপম বসু
 …
ঢাকার রমনায় তিন নেতার মাজার সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বস্থ, বর্তমান নজরুল এভিনিউ’র প্রবেশ মুখে দোয়েল চত্বরের কাছে, যে ফটকটি দেখা যায় তা-ই মীর জুমলার ফটক (Mir Jumla Gate) বা রমনা গেট (Ramna Gate) হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ এটাকে ঢাকা গেটও বলে থাকেন। রাস্তার দু’ধারে গেটের দু’প্রান্তে কতগুলো গোলাকার উঁচু স্তম্ভ বহিঃপার্শ্বের দিকে ক্রমশ ঢালু পাকা রেলিং দ্বারা সংযুক্ত। এখনকার চেহারায় দু’প্রান্ত থেকে সমদূরবর্তী মধ্যখানে একই ধরনের একটি প্রত্যক্ষ সংযোগহীন একক স্তম্ভ রয়েছে যা বর্তমানে পাকা সড়কের বিভাজক আইল্যান্ডে অবস্থিত। তবে বর্তমান চেহারায় গেটটিকে যতোটা সংক্ষিপ্ত দেখা যায়, ফটক নির্মাণকালীন সময়ে হয়তো তা ছিলো না। ১৯১৭ সালের একটি ছবিতে রমনা গেটটিকে দুপাশে আরো প্রলম্বিত অবস্থায় দেখা যায়।
 .
ধারণা করা হয়, মগ দস্যুদের হাত থেকে ঢাকা শহরকে রক্ষার জন্য মীর জুমলা এই গেটটি তৈরি করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, মীর জুমলার সময় শহরের উত্তর সীমা নির্ধারণের জন্য এ ফটক তৈরি করা হয়েছিলো। তবে প্রচলিত এসব ধারণার সাথে ইতিহাসবিদদের বেশ দ্বিমত রয়েছে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ‘ঢাকা’ গ্রন্থের লেখক আহমদ হাসান দানী স্তম্ভ দু’টি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, মুঘল আমলে এগুলো তৈরি হয় নি। তাছাড়া স্তম্ভ দুটোর গড়ন ইউরোপীয় রীতির।
 .
 
.
ঢাকা কোষ নামে খ্যাত ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থের লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনও দানীর মত সমর্থন করে বলেন, চার্লস ড’স, যিনি ইংরেজ আমলে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, রমনার প্রবেশপথ চিহ্নিত করার জন্য স্তম্ভ দু’টি তৈরি করেছিলেন। মামুন বর্ণিত রমনার ইতিহাস থেকে এই মতের সমর্থনে সহায়ক তথ্য পাওয়া যায়।
 .
 
.
মুঘল আমল (১৬১০) থেকেই বিশেষ অভিজাত এলাকা হিসেবে রমনার ইতিহাস শুরু। ঐ সময় বর্তমান নীলক্ষেত অঞ্চলে মহল্লা চিশতিয়ান এবং মহল্লা শুজাতপুর নামে দুটি আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। শুজাতপুর ছিলো বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। পুরনো রেসকোর্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিলো চিশতিয়া। পুরো এলাকাটি মৌজা শুজাতপুরের অন্তর্গত ছিলো। মৌজা শুজাতপুর নাম হয়েছিলো রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতীর ভাই শুজাত খান চিশতীর নামে। উভয় মহল্লাতে মুঘলরাই বসবাস করতেন। বর্তমানের পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত এলাকায় তখন মুঘলরা বাগান তৈরি করেন, যার নাম ছিলো ‘বাগ-ই-বাদশাহী’ বা ‘বাদশাহী বাগান’।  মহল্লা শুজাতপুর ও মহল্লা চিশতিয়া নামের এ দুটি এলাকা ও বাদশাহী বাগের মাঝখানের জায়গাটুকু, যা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জুড়ে ছিলো সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর। ধারণা করা হয়, মুঘলদের হাতেই এই বিস্তৃত চত্বরের নাম হয়ে গিয়েছিলো রমনা। কেননা ফার্সিতে রমনার অর্থ হচ্ছে সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর, ইংরেজিতে যাকে বলে ল’ন। পরবর্তীকালে শুজাতপুর, চিশতীয়া, বাগ-ই-বাদশাহী নাম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও রমনা নামটি টিকে যায় এবং এ নামেই পুরো এলাকাটি পরিচিত হয়ে উঠেছিলো।
 .
 
.
রমনা পেরিয়ে উত্তরে ছিলো জঙ্গল। আর রমনা এলাকার ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিলো দু’তিনটি ক্যানাল। মুঘল আমলেই পত্তন হয় বর্তমানে পরিচিত হাইকোর্টের মাজারের। সুবাদার মুহম্মদ আজমের আমলে ১৬৭৯ সালে রমনার দক্ষিণে নির্মিত হয়েছিলো হাজী শাহবাজের মসজিদ, বর্তমানে যা তিন নেতার মাজার সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। মুঘল আমলের শেষ দিকে ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে ঢাকার অনেক অঞ্চলই বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। অযত্ন অবহেলায় রমনাও হয়ে পড়ে জঙ্গলাকীর্ণ। এই জঙ্গলের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো পুরনো ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, ভরাট হতে থাকে ক্যানাল। রমনার পাশেই ছিলো নিমতলী কুঠি। লোকজন প্রয়োজন না পড়লে রমনার ধারেকাছে ঘেঁষতো না। ধারণা করা হয়, কোম্পানি আমলেও রমনার বিশাল এলাকা জঙ্গল হিসেবেই পরিত্যক্ত থাকে।
 .
 
.
ইংরেজ আমলে এসে রমনা পুনরুদ্ধারে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড’স। তিনি ঢাকা শহর উন্নয়নের জন্য গঠিত ঢাকা কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন। ১৮২৫ সালে জেলের কয়েদীদের নিয়ে সর্বশক্তিতে রমনার জঙ্গল পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়েন তিনি। তিনমাস পর রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে ডিম্বাকৃতি একটি অংশ বের করা হয়, যার ফলে শহরের উত্তরাঞ্চল পরিচ্ছন্ন হয়ে বায়ু চলাচলের পথ উন্মুক্ত হয়। এর কিছুদিন পর পরিষ্কৃত অংশটিকে কাঠের রেলিং দিয়ে ঘিরে ড’স তৈরি করলেন রেসকোর্স। বলা হয়ে থাকে, মুঘলরা যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে করেছিলেন বাগান, আর ইংরেজরা করেছিলেন রেসকোর্স।
 .
মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য ড’স রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি রাস্তা তৈরি করেন, যার বর্তমান রূপ এখনকার নজরুল এভিনিউ। এর দুধারে মিমোসা বা ক্যাসুরিনা জাতীয় দুষ্প্রাপ্য সব গাছ নেপাল থেকে আনিয়ে লাগিয়েছিলেন তিনি। আর এ রাস্তার প্রবেশমুখে দুটি স্তম্ভ তৈরি করে রমনার প্রবেশমুখ চিহ্নিত করেছিলেন ড’স, যা এখনো অটুট রয়েছে। এটিই বর্তমানের পরিচিত রমনা ফটক।
 .
 
.
চার্লস ড’স ঢাকা ত্যাগ করার পর রমনা আবারো অবহেলিত অঞ্চলে পরিণত হয়। আগাছায় ভরে যায় রমনা অঞ্চল। পরবর্তী বেশ কিছুকাল পর ঢাকার নবাবদের হাতে রমনা আবারো একটু একটু করে তার আভিজাত্য ফিরে পেতে শুরু করে। তবে বঙ্গভঙ্গের পর সত্যিকারভাবে গড়ে উঠতে থাকে রমনা এলাকা।

তথ্য সহায়তা:
০১)  প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য / বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-১ / বাংলাদেশ  এশিয়াটিক সোসাইটি।
০২)  ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী / মুনতাসীর মামুন।
০৩)  ছবি : রণদীপম বসু।

No comments: