Friday, July 29, 2011

। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: নিমতলী কুঠি ।

 
। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: নিমতলী কুঠি ।
-রণদীপম বসু
 …
ঢাকার নিমতলীতে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ ভবনের পেছনে একটি প্রাচীন স্থাপনা দেউড়ি লক্ষ্য করা যায়। তা-ই নিমতলী ফটক বা গেট (Nimtali Gate) হিসেবে পরিচিত। এককালে এখানে একটি প্রাসাদও ছিলো। তাই এটাকে নিমতলী কুঠিও (Nimtali Kuthi) বলা হতো। পরবর্তীতে প্রাসাদটি ভেঙে ফেলা বা বিলুপ্ত হলেও ফটকটি রয়ে গেছে। ১৭৬৬ সালে লে. সুইনটন তড়িঘড়ি করে এই ফটক ও প্রাসাদ নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। ঢাকা বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানি’র মতে ব্রিটিশ আমলে সর্বপ্রথম নিমতলী ফটকে সমান্তরাল ছাদ ব্যবহার করা হয়।
 .
 
.
ইতিহাসের সুলুক-সন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের পর ১৭১৫-১৬ সালে মুর্শিদকুলী খান নিজেই সুবেদার হন। আর পূর্বাঞ্চল শাসন করার জন্য সৃষ্টি করা হয় নায়েব নাজিমের পদ। ১৭১৫/১৬ থেকে ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিওয়ানী লাভ করা পর্যন্ত এই পঞ্চাশ বছর নায়েব নাজিমরা পূর্বাঞ্চল শাসন করেন। তবে অধিকাংশ সময় এই নায়েব নাজিমরা ঢাকায় না থেকে মুর্শিদাবাদে অবস্থান করেই উপ-নায়েব নাজিমের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বাংলা ইংরেজ প্রশাসনের অধীনস্থ হওয়ার পর থেকে নায়েব নাজিমরা প্রত্যক্ষভাবে ঢাকায় অবস্থান করে ঢাকার বাসিন্দা হলেন।
 .
 
.
এ পর্যায়ে ঢাকার নায়েব নাজিম জেসারত বা জসরত খান ঢাকার বড় কাটরায় অবস্থান করেন এবং তার বাসভবন হিসেবে নিমতলীতে একটি প্রাসাদ নির্মিত হলে তিনি বড় কাটরা ছেড়ে নিজ বাসভবনে উঠলেন। সেই থেকে ঢাকার নায়েব নাজিমদের বাসভবন হিসেবে নিমতলী প্রাসাদ ‘নিমতলী কুঠি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। নিমতলী নামের উৎপত্তি জানা না-গেলেও ধারণা করা হয়, এক সময় হয়তো এ এলাকায় নিমগাছের আধিক্য ছিলো। সে কারণেই এ নামকরণ। আর নায়েব নাজিমদের বাসস্থান হিসেবে এলাকাটি বিখ্যাত হয়ে যায় নিমতলী প্রাসাদ বা কুঠির জন্য। যেহেতু নায়েব নাজিমরাই হলেন ঢাকার আদি নবাব, তাই উনিশ শতকে পুরো এলাকাটি পরিচিত হয় নওয়াবী দালান নামে।
 .
 
.
সেকালে দালান বা প্রাসাদের অর্থ ছিলো বিশাল এক চত্বরে বেশ ক’টি আলাদা আলাদা অট্টালিকা, চারপাশে ছিলো বাগান আর বিরাট এক দীঘি। দীঘিটি পরিচিত ছিলো নওয়াবী দীঘি নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পাশে এই নওয়াবী দীঘির একাংশ এখনো বর্তমান। প্রাসাদের দক্ষিণে ছোট্ট একটি মসজিদ ছিলো যা এখনো রয়েছে এবং তা নওয়াবী মসজিদ নামেই পরিচিত। কিন্তু ঢাকার আদি নওয়াব বা নায়েব নাজিমদের সেই প্রাসাদ আজ আর নেই, রয়ে গেছে প্রাসাদের পশ্চিম দিকের সেই দেউড়ি বা ফটকটাই, যাকে এখন আমরা নিমতলী গেট নামে চিনি।
 .
.
পাতলা ইট আর চুন সুরকিতে নির্মিত এই ত্রিতল স্থাপনা-কাঠামোর দেউড়ি বা ফটকটিতে কয়েকটি কক্ষ রয়েছে।  বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির অধিকৃত এই স্থাপনাটির দু’পাশে আধুনিক শৈলীর ঝকঝকে নতুন ভবনগুলোতে বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যক্রম পরিচালিত হলেও তার আগে স্বাধীনতাপূর্বকালে এই দেউড়িটির উপরের কগুলোতেই ছিলো লাইব্রেরি ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড। তবে আঠারো শতকের অমূল্য প্রত্ন-নিদর্শন হিসেবে ফটকটির বর্তমান জীর্ণশীর্ণ বেহাল অবস্থা দেখে মনে হয় যথাযথ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই এ স্থাপনাটি বিলীন হয়ে যাবে, থেকে যাবে কেবল স্মৃতিটাই। কিন্তু বস্তু বিলীন হলে, স্মৃতি আর ধরে রাখা যায় কতোকাল !
.
.
তথ্য সহায়তা:
০১)  প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য / বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-১ / বাংলাদেশ  এশিয়াটিক সোসাইটি।
০২)  স্থাপত্য / বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-২ / বাংলাদেশ  এশিয়াটিক সোসাইটি।
০৩)  ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী / মুনতাসীর মামুন।
০৪)  ছবি : রণদীপম বসু।

No comments: