| এটাই কি রমজানের পবিত্রতা রক্ষা !
-রণদীপম বসু
…
রমজান (ramadan) মাসে আমাদের দেশে অফিস-আদালতগুলোতে লাঞ্চ-বিরতি হয় না। সে কারণে অফিসের নিজস্ব ক্যান্টিনগুলোও বন্ধ থাকে এই এক মাস। তাতে অবশ্য অমুসলিমদের জন্য খুব একটা সমস্যা হয় না এজন্যে যে, দুপুরের খাবারটা সাথে নিয়ে আসতে পারেন তাঁরা। নামাজের বিরতির সময়টাতে নিরিবিলি লাঞ্চটা সেরে নিতে পারেন। এতে অফিসের কোন আপত্তি থাকে না, বরং অন্য যে-কোন সময়ের চেয়ে অমুসলিমদের প্রতি অফিস সহকর্মিদের সহানুভূতি একটু বেশিই লক্ষ্য করা যায় তখন। পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এটা একটা শুভ লক্ষণ।
.
আর এই শুভবোধকে সম্মান জানিয়েই অমুসলিম সহকর্মিরাও, যাঁরা নিয়মিত কেন্টিনেই লাঞ্চ করতেন বা যাঁরা সাথে খাবার নিয়ে আসতেন, এই রমজান মাসটাতে দেখা যায় এরা দুপুরের খাবার নিয়ে আসেন না, অন্তত আমার অফিসের ক্ষেত্রে যা দেখেছি এবং দেখছি। সহকর্মিদের রোজার আবহের মধ্যে থেকে খাবার গ্রহণে অনেকে হয়তো নিজে নিজে বিব্রতও বোধ করেন। তারচে বরং রমজানের সংক্ষিপ্ত অফিস-টাইম শেষে বিলম্বে হলেও একবারে বাসায় গিয়ে খাওয়ার কথাই ভাবেন এরা। তাই দুপুরের নামাজ-বিরতিতে অফিসের আশেপাশে কোন পর্দাঘেরা দোকানে হালকা নাস্তা করে নেয়াটাই তাঁদের কাছে সাচ্ছন্দ্যের মনে হয়।
.
ঠিক এরকম একটা পরিস্থিতিতে আজ অফিস থেকে বেরিয়ে পাশের টং-দোকানটার দিকে এগিয়ে যেতেই এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো। প্রৌঢ় দোকানদারটির কোন ওজর-আপত্তি না-শুনেই পুলিশ সদস্যটি উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে নাকি ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। দীর্ঘদিনের এই টং-ব্যবসায়ী মিতভাষী লোকটির প্রতি পুলিশের এই রূঢ় আচরণে যারপর নাই বিস্মিত হলাম ! ক’বছর যাবৎ দেখছি তাঁকে। নিজে রোজা রাখেন পুরোপুরি। এই টং-দোকানে চা-পান-বিড়ি-সিগারেট আর রুটি-কলা-বিস্কুট বিক্রিই তাঁর একমাত্র আয়ের উৎস। এর উপর ভিত্তি করেই কুষ্টিয়া থেকে মাইগ্রেট হওয়া লোকটি এই জন-পরিজনহীন ঢাকায় পরিবার নিয়ে বাস করেন। রমজান মাস এলে টং-দোকানটিকে ঘিরে বেশ ক’টি পর্দা ঝুলিয়ে নিরঙ্কুশ আড়াল তৈরি করে আমাদের জন্য চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা রাখেন তিনি। অথচ তাঁকে কখনোই রোজা ভাঙতে দেখিনি আমরা।
.
কিন্তু ঐ দোকানি রোজা রাখলেন কি রাখলেন না, আমার বক্তব্য তা নয়। আমার জানার বিষয় হচ্ছে, এই পুলিশি অ্যাকশান কি রমজানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য ? যদি তা-ই হয়, তাহলে আমি জানতে চাই- রমজানের পবিত্রতা মানে কী ? এই দোকানটির মধ্যে আর যাঁরা নাস্তারত ছিলেন, ঠিক সে অবস্থায় তাঁদেরকে অপ্রস্তুত ও বিব্রত করার অধিকার এই কর্তব্যরত (?) পুলিশকে কে দিলো ? রাষ্ট্র কি এমন কোন এলান জারি করেছে যে, এই রমজান মাসে কোন অমুসলিম নাগরিক কোন পর্দাঘেরা দোকানেও কোন খাবার খেতে পারবে না ? এরকম অভব্য একটি কাজ করার আগে ঐ পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তা কি ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না, ওখানে তখন যাঁরা নাস্তারত ছিলেন, তাঁরা শিক্ষা-দীক্ষায় সম্মানে-পদে-রুচিতে তাঁদের চেয়ে কোন অংশে কম নন, বরং অনেক বেশিই হতে পারেন ? যাঁদের ভাবনায় এই বোধ কাজ করে না, তাঁরা নিজেদেরকে জনগণের সেবক হিসেবে দাবি করার আগে দয়া করে আরেকবার ভেবে দেখবেন কি, কোন্ যোগ্যতায় তাঁরা রাষ্ট্র-প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ পোশাকটি গায়ে চাপাচ্ছেন ?
.
.
অফিস শেষে ফেরার সময় দেখি সেই দোকানটি আবারো যথারীতি চলছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম সেই দোকানির বিষণ্ন মুখ। থানার পবিত্রতা থেকে ঘুরে আসায় এবার রমজানের পবিত্রতাও রক্ষা পেয়ে গেছে মনে হয় !
.
ইসলাম স্বীকৃত সংযমের মাস রমজান এলেই প্রতিবারেই এরকম কিছু হুলুস্থূল কাণ্ড দেখতে হয় খাবারের দোকানগুলো নিয়ে। কোথাও হুজুরদের মিছিল, কোথাও ত্রাহি-ত্রাহি মাইকিং, কোথাও পুলিশের অতি-আগ্রহ ইত্যাদি। রীতিমতো মারমুখি অবস্থা ! রমজান তো নয়, যেন একটা সর্বগ্রাসী যুদ্ধ ! আগুন লেগে যায় বাজারে। সদাই-পত্রে হাত দিলেই মূল্যের আগুনে ফোস্কা পড়ে যায় হাতে। সীমিত আয়ের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে কিভাবে পার করবে এই রমজানের সংযমী মাস। এইসব অরাজকতা রোধ করা, নিয়ন্ত্রণ করা মনে হয় কোন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের রমজানের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। খররৌদ্রে ক্লান্ত অবসন্ন রিক্সাচালক শ্রমিকটি কোথায় কোন্ ঘুপচিতে কিছু খেয়ে ফেলে রমজানের পবিত্রতা নষ্ট করে ফেলছে তা খুঁজে বের করা যে জাতি, গোষ্ঠি বা কর্তৃপক্ষের পবিত্র দায়িত্বের অংশ হয়ে যায়, তাদের যোগ্যতা ও সাবালকত্ব নিয়েই প্রশ্ন জাগে। কারণ সাবালক মানুষকে যে সাবালক ভাবতে পারে না, তাঁর সাবালকত্ব প্রশ্নহীন নয় এটা কি তাঁরা বোঝেন ?
.
এসব দেখেশুনে মনে আসে আমার সেইসব রোজাদার বন্ধুদের কথা, যাঁদের পাশে বসে খাবার খেলেও নির্বিকার তাঁদের সংযমে কোন সমস্যা হয় নি কখনো, এখনো হয় না। তাঁদের কি রোজা পালন হয় না ? মনে পড়ে সব মায়েদের কথা, যাঁরা পরিপূর্ণ রোজাদারী হয়েও নিজ হাতে খাইয়ে দেন তাঁর ছোট্ট সন্তানটিকে, তাঁদের রোজা কি কবুল হবে না ? ইসলাম কী বলে ?
…
…
[ bdnews24blog ]
…
4 comments:
আপনার এই ক্ষোভ স্বাভাবিক। আবার আমরা ভারতীয় মুসলিমরা এত কষ্ট করে রোজা করি অথচ স্কুল কলেজ সব খোলা থাকে। আবার ৫ দিনের দুর্গা পুজায় ৪৫ দিন বন্ধ হয়। আশ্চর্য
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ফরিদ ভাই।
আসলে আমরা চেতনাগতভাবে মনে হয় পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারি নি। আমাদের পরিচয়টা শেষ পর্যন্ত আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি বৌদ্ধ, আমি খ্রিস্টান ইত্যাদিই থেকে যায়। দুঃখ হয় যখন রাষ্ট্রও এই চেতনা থেকে বেরিয়ে নিরপেক্ষ হয়ে না-ওঠে। আপনার কষ্ট আমি উপলব্ধি করছি, যেমন আপনি আমার অনুভবটাকে ধরছেন।
সভ্যতা এতোটা এগিয়ে গেলো। কবে যে আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠবো ! না কি সভ্যতা এগোয় নি একটুও !!
এই এক সমস্যা - বাঁশবাড়ির নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা বললে গুজরাট চলে আসে ।অন্যের অন্যায় দেখিয়ে কি নিজের পাপ জায়েজ হয় ফরিদ সা'ব?
রোজার সময় আমাদের মুসলমানিত্ব হঠাৎ যেভাবে চাগিয়ে ওঠে তা তুলনাহীন ।রাতারাতি ঢাকা যেন মক্কা হয়ে যায়।শুধু কি প্রকাশ্যে খাওয়া -সমস্ত কার্যক্রম বিয়ে থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব বন্ধ ,শুধু বন্ধ হয় না খাওয়া । পুরোরমজান এক ধুন্ধুমার পেট পূজার মহোৎসবের মাস ।এমন হিপোক্র্যাসির তুলনাহীন ।যে কোন মুসলিম পরিবারকে জিঙ্গেস করে দেখুন রোজার মাসে তাদের খরচ বেশী । রোজার মাসে meatless day কেন তুলে নেয়া হয়,কেন বেশী চিনি আটা ময়দা আমদানী করতে হয় ?কেন জিনিষের দাম বাড়ে -কারন এ মাসে মুসলমান বেশী খায়-শুধু খাবার টাইমিংটা বদলে যায় ।
রনদীপম , আমি রোজা রাখিনা ,তাই আপনার সমস্যা বুঝি । শুধু বলি, আপনি একা নন,আমাদের মত বহু মানুষের একই সমস্যা ।
এই অধার্মিক অমানবিক হিপোক্রেটিক ধর্মপালন স্যুডো মুসলিমরা কবে মুক্ত হবে ।
আপনার খুব সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
Post a Comment