Tuesday, August 23, 2011

| লেখক-সম্ভ্রম বনাম লেখক-সম্মানী |


| লেখক-সম্ভ্রম বনাম লেখক-সম্মানী |
-রণদীপম বসু

(১)
বাটনে চাপ দিতেই মোবাইলের ওপাশ থেকে নারী-কণ্ঠের রিনিঝিনি বেজে ওঠলো- দাদা কেমন আছেন ?
জী ভালো। আপনি কেমন আছেন ?
জী আমিও ভালো। তো দাদা, আপনাকে রিং করেছি একটা প্রয়োজনে !
বলেন ?
আপনাকে একটা বিলের চেক পাঠাতে চাচ্ছি।
ও আচ্ছা ! পোস্টাল এড্রোস চাচ্ছেন ?
জী।
লেখেন………..।
চেকটা পেলে কাইন্ডলি একটু জানাবেন দাদা।
ঠিক আছে।


 .
(২)
খুব একটা ফলপ্রসূ না হতে পারে, কিন্তু আমার লেখালেখি জীবনের দৈর্ঘ্য একেবারে খাটো বলি কী করে ! বলা যায় ছাত্র জীবনের সেই মধ্যলগ্ন থেকে। আড়াই দশক আগে ছাত্রত্বই শেষ হয়ে গেছে। আর অনিয়মিতভাবে হলেও পত্র-পত্রিকায় (print media) লেখালেখি তাও দেড় যুগ হবে। কিন্তু আমার এ লেখার উদ্দেশ্য এসব তথ্য জানানোর জন্য নয় মোটেও। মূলত লেখক (writer) জীবনের এক সদ্য অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, এবং তার বিপরীতে কিছু চলমান উপহাসের ব্যবচ্ছেদ করা।
 .
অতএব পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে উপরের ছোট্ট কথোপকথন কোন গল্পের সংলাপ নয়, যদিও আমার কাছে এটা একটা হঠাৎ গল্পের মতোই মনে হয়েছে। কেন এরকম মনে হয়েছে তা পরে বলছি। মোবাইলের ওপাশের নারীকণ্ঠটি একটি দৈনিক পত্রিকার খুব সম্ভবত সাহিত্য সম্পাদকের, যাঁকে আমি আজতক দেখি নি। কারণ লেখালেখিসূত্রে এযাবৎ কোন পত্রিকা অফিসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার নাই বললেই চলে। ২০০৬ এর শেষার্ধ থেকে আমার ঢাকাবাসের কীবোর্ড জীবন শুরু। তার আগে চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বাইরেই ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিয়েছি সতেরটি বছর। এখন গল্পের মতো মনে হলেও এরকম অঞ্চলেও থেকেছি যেখানে আজকের পত্রিকাটি হাতে পেতে অপেক্ষা করতে হতো আগামীকাল সন্ধ্যাতক। আর মোবাইল প্রযুক্তি তো স্বপ্নের মধ্যেও ছিলো না। ফলে সেই কাগজ-কলম আর পোস্টাফিসের খাম নির্ভর সময়টা ছিলো প্রধানত আমার কবিতারই কাল। মনের আনন্দে কবিতায় কষ্ট মিশিয়ে ছেড়ে দিয়েছি ডাকে, এক-দু’সপ্তা বা মাসখানেকের মধ্যে দৈনিকের সাময়িকী পাতা বা ম্যাগাজিনে সে লেখাটি আবিষ্কার করে উদ্বেলিত হয়েছি। মনেও আসে নি কখনো যে, পত্রিকাগুলো লেখককে তাঁর প্রকাশিত লেখার বিপরীতে সম্মানী নামক এক ধরনের বিশেষ শ্রমভাতা দিয়ে থাকে। আর মনে আসলেও দেশের প্রান্তসীমা থেকে আয়োজন করে ঢাকায় এসে পত্রিকা অফিস খুঁজে বের করে সেখান থেকে নগন্য লেখক-সম্মানী চেয়ে আদায় করা, এরকম ভাবতেই নিজেকে কেন যেন ভিক্ষুক ভিক্ষুক মনে হয়। আর যা হোক, লেখা বেঁচে তো আর খেতে হচ্ছে না ! অতএব, লেখা ছাপছে, এতেই উচ্ছ্বাস ! কৃতার্থ ! চলুক না এভাবেই !
 .
এরপর আরো বেশ কতগুলো বছর কেটে গেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি দৈনিক (daily) ও সাপ্তাহিক-পাক্ষিক পত্রিকা আমার লেখার ইতিহাস সমেত বন্ধও হয়ে গেলো। আমিও আরেকটু বয়ষ্ক হয়েছি। মাঠ-জীবনের মতো ঢাকায় তো আর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পেরিয়েও অফিস-টাইমকে টেনে লম্বা করতে হয় না। এখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিনটাও বিশেষ কারণ ছাড়া সত্যিকারের ছুটির দিন হিসেবেই ধরা দেয়। ফলে অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি ও লেখালেখির জন্য প্রকৃতই কিছুটা সময় ব্যয় করা সম্ভব হওয়ায় তথ্য-প্রযুক্তির ঘোড়ায় নিজেকে ইচ্ছেখুশি ছড়িয়ে দেয়ায় আর বাধা রইলো না। হলোও তাই। আগের কুড়ি বছরে যতটা না লেখালেখি করেছি, পরবর্তী ঢাকাবাসের পাঁচটি বছরে হয়েছে তার কয়েকগুন। ছিলাম একমাত্রিক, এখন সামর্থে কুলালে বহুমাত্রিক হতেও বাধা নেই। তথ্য-প্রযুক্তি আর অন্তর্জালের কল্যাণে মিডিয়াগুলো এসে গেলো হাতের নাগালের মধ্যেই। কিন্তু এখন আর কেউ না চাইলে কোথাও লেখা পাঠাই না।  তবু ঐ যে, লেখা বেঁচে খেতে হয় না এখনো, তাই ভিক্ষুকের মতো পত্রিকায় পত্রিকায় ঘুরে লেখক-সম্মানি আদায়ের উঞ্চবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ায় বাধা হয়ে রইলো সুপ্ত থাকা লেখক-সম্ভ্রমটুকুই। কেননা আমার অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা দিয়ে এ যাবৎ এটাই জানতাম যে হাভাতের মতো পত্রিকা অফিসে নক করে করে লেখককে লেখার বিল খুঁজে নিয়ে আসতে হয়। এর বাইরে কিছু হতে পারে, তা ধারণার বাইরে ছিলো। কাউকে কখনো এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করিনি। শুধু মাসিক শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন ‘টইটম্বুর’-এর মানিঅর্ডারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া লেখার বিলকে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবেই ভেবে এসেছি। কিন্তু এ সব অভিজ্ঞতাকে ধাক্কা দিয়ে তালগোল পাকিয়ে দিলো দৈনিক ডেসটিনির (destiny) সাহিত্য-সম্পাদক (যদি নামে ও পদবীতে ভুল না-করে থাকি) শারমিন নাহার (sharmin nahar) তাঁর সম্পাদিত পাতায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের বিল হিসেবে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি একাউন্ট পেয়ী চেক কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়ে।
 .
(৩)
লেখার বিল কতো হওয়া উচিত বা উচিত নয়, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। কেননা লেখার মান বা পরিমাণ নয়, যতটুকু বুঝি, লেখকের বয়স, উচ্চতা (?) ও ক্ষমতার মাত্রাভেদেই লেখক সম্মানী নির্ধারিত হয়। যদি তা না-হয়ে থাকে, তাও আমার সীমাবদ্ধ জানার ত্রুটিই হয়তো। সে বিষয়ে আর না গেলাম। যেখানে মুরগীরই খবর নাই, সেখানে আগে ডিমের খোঁজ নেয়াটা বাতুলতাই। তাই শারমিন নাহারের চেকটি হাতে পেয়ে কতকগুলো জিজ্ঞাসা, যা হয়তো আগেও বোধের ভেতরে ছিলো, এই প্রথম প্রকাশ্যে চুলবুল করে ওঠলো মাথার ভেতরে !
 .
একজন শারমিন নাহার যদি একজন লেখককে তাঁর সম্মানির চেক পোস্টাল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজের উন্নত বিবেচনাবোধের পরিচয় প্রকাশ করে লেখকের কৃতজ্ঞতাভাজন হতে পারেন, তাহলে অন্যান্য পত্রিকা বা বিভাগীয় সম্পাদকরা কেন তা পারেন না ? মেইল বা পোস্টালে যেভাবেই হোক লেখা প্রেরণকারী লেখকরা নিশ্চয়ই ঠিকানাহারা থাকেন না। পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, বড় বড় ডিডি, এমটি, চেক পোস্টালে বা কুরিয়ারে বহনক্ষম হলে পত্রিকা অফিসের নগন্য অংকের চেক কোন্ বিচারে বহন অক্ষম হয় তার ব্যাখ্যা কী দেবেন ? না কি লেখক নামী দামী ক্ষমতাবান হলেই তাঁকে সম্মানি পৌঁছে দেয়া হয়, নইলে সে লেখকের কোন বেইল নেই ! দেশের প্রান্তসীমার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে লেখকটির লেখা প্রকাশিত হলো, তিনি কিভাবে জানবেন যে কবে তাঁর লেখার বিল অনুমোদন হয়েছে ? এবং তাঁর দ্বারা লেখার বিল পাশের খবর জোগাড় করে অতঃপর বিল তুলতে যথাসময়ে ঢাকায় আসা আদৌ কি সম্ভব ? এ যাবৎ কোন পত্রিকা কি তার লেখকদের বিল অনুমোদনের খবর ও উত্তোলনের আহ্বান জানিয়ে ডেড-লাইন দিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ করেছে কখনো ? আর এসব শুভঙ্করে পড়ে যে লেখক তাঁর প্রাপ্য বিলটি নিতে পারেন নি, তাঁর সম্মানিটা শেষপর্যন্ত কী হয়, কোথায় যায়, তা জানার উপায় কী ? সংবাদপত্র (newspaper) হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সমাজে ঘটতে থাকা অন্যায়-অবিচার, বঞ্ছনা, অনিয়মের খবর খুঁজে এনে পাঠকের সামনে পরিবেশন করে থাকে। এ থেকে জাতি দেশ ও দশের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সংবাদপত্র নিজেই যেসব বঞ্ছনার ইতিহাস তৈরি করছে, তার প্রতিকারের উপায় নিয়ে কে কী ভাবছেন জানতে ইচ্ছে করে।
 .
ব্যতিক্রম বাদ দিলে লেখকরা স্বভাবতই ভদ্র ও মার্জিত হয়ে থাকেন। কেউ কেউ হন নিরীহ। ব্যবসাবুদ্ধি কম থাকায় তাঁরা হয়ে থাকেন গরীবও।  এও জানি যে কোন কোন দূরবর্তী লেখক প্রতিনিধি পাঠিয়ে লেখার বিল তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও একজনের বিল যদি অন্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা যায়, তাহলে আরেকজনের বিল অন্য কেউ ভূয়া লেখক সেজে তুলে নেয়া তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ! তাছাড়া একজন লেখক যেমন লেখা পাঠিয়ে দিয়েই খালাশ, তেমনি লেখা প্রকাশিত হলে একজন সম্পাদকেরও অনুমোদনোত্তর লেখক-সম্মানি পাঠিয়ে দেয়াটা মার্জিত রুচিবোধ ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না কি ?  সর্ষের মধ্যে ভুত রেখে অন্যের ভুত তাড়ানোর মন্ত্র আওড়ানোর আগে সমস্ত প্রিন্ট মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, দয়া করে লেখকদের অবহেলাভরে ঠকানোর ছিদ্রপথগুলো বন্ধ করে অন্তত এদিকে একটু আপ-টু-ডেট হওয়া যায় না কি ? লেখকদেরকে আপনাদের জমিদারীর প্রজা না-ভেবে প্রাপ্য যৎসামান্য সম্মানীটুকু সম্মানের সাথে দেয়া গেলে আপনাদের কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়ে যায় তা জানাবেন কি ? এই যে এখন আপনাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে লেখক-অবহেলার অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা কি অমূলক ? এতেও যদি কারো বোধোদয় না হয়, তাহলে এটা তো নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে প্রযুক্তি এগিয়ে গেছে অনেক। মাথায় ঘিলু থাকলে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন লেখকদের দায় পড়েনি যে যেখানে সেখানে প্রিন্ট মিডিয়ার কাছে ধর্না দিতেই হবে ! কেননা লেখক-সম্ভ্রম বিলুপ্ত হলে কেউ আর সৃজনশীল লেখক থাকতে পারেন না।
 .
(৪)
আমি দুঃখিত শারমিন নাহার, লেখায় আপনার নাম উল্লেখ করেছি বলে। আমি ঠিক জানি না, আপনার স্বতঃপ্রণোদিত বিবেচনাবোধের দৃষ্টান্ত টানতে গিয়ে নতুন করে আপনার কোন শত্রু সৃষ্টি করলাম কিনা। কেননা সর্ষেতে ভুতের অস্তিত্ব আদৌ বিলীন হবে কিনা জানি না। অন্তর্জালেই নিজেকে অনেক বেশি ব্যপৃত রাখলেও দেশের অধিকাংশ দৈনিকেই আমি লেখালেখি করেছি, এবং এখনো করি। আপনি এখন যে পাতাটি দেখছেন, আপনার দায়িত্ব গ্রহণের আগেও এ পাতায় এবং একই পত্রিকায় অন্যান্য বিভাগেও আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত বিভাগীয় সম্পাদকও রয়েছেন আপনার পত্রিকায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনিই একজন লেখককে কখনো সামনাসামনি না-দেখেও সম্মান ও গুরুত্ব দেয়ার প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্ষেত্রে। এবং লেখক-সম্মানি, তাও আবার ঘরে বসেই চেক পেয়ে যাওয়ার এ দৃষ্টান্ত আমার লেখক-জীবনেও এই প্রথম। তাই আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি আপনার কাছ থেকে যদি সংবাদপত্র জগতের অন্যান্য সম্পাদকরা নিজ যোগ্যতায় তাঁদের লেখককে যথাযথ সম্মান দেয়ার ক্ষেত্রে শেখার মতো কিছু খুঁজে পান, সে লক্ষ্যেই এই লেখাটির অবতারণা। অন্তত কালের খাতায় লেখা থাক একটি ছোট্ট অথচ আপাত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধি।
(২২-০৮-২০১১)
[ sachalayatan ]

No comments: