Friday, August 12, 2011

| মনু’র বৈদিক চোখ : নারীরা মানুষ নয় আদৌ…| শেষপর্ব-০৩/৩ |


| মনু’র বৈদিক চোখ : নারীরা মানুষ নয় আদৌ…| শেষপর্ব-০৩/৩ |
-রণদীপম বসু
[প্রথমদ্বিতীয় পর্বের পর...]
মনুশাস্ত্রে স্ত্রীর কর্তব্য
বিবাহ নামক নারী-সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত যে নারীটিকে শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী পুরুষের ব্যক্তি-মালিকানায় রক্ষিতা বানানো হয়েছে, সেই নারীকে বহুমাত্রিক ভোগ-ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্ণতৃপ্তি বা সন্তোষ না পেলে পুরুষতন্ত্রের সার্থকতা থাকে না। বর্ণ-নির্বিশেষে নারী সামাজিকভাবে শূদ্রধর্মীতার কারণেই শ্রম বা উৎপাদন-যন্ত্রবিশেষ, পুরুষের উপভোগ্য দেহধারণের কারণে নারী ভোগ্যসামগ্রি এবং গর্ভধারণকারী প্রজননযন্ত্রের কারণে নারী সন্তান উৎপাদনকারী জৈবযন্ত্র ইত্যাদি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাই এধরনের যাবতীয় প্রয়োজনের নিরীখে নারী যাতে কিছুতেই অব্যবহার্য না থাকে সে লক্ষ্যে মনুশাস্ত্র সদাসতর্ক থেকেছে সবসময়-


‘অপত্যং ধর্মকার্যাণি শুশ্রূষা রতিরুত্তমা।
দারাধীনস্তুথা স্বর্গঃ পিতৃণামাত্মনশ্চ হ।।’
সন্তানের উৎপাদন, অগ্নিহোত্রাদি ধর্মকর্ম সম্পাদন, পরিচর্যা, উত্তম রতি, পিতৃগণের এবং স্বামীর নিজের সন্তানের মাধ্যমে স্বর্গলাভ- এ সব কাজ পত্নীর দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়। (৯/২৮)।
যেহেতু নারীমাত্রেই জৈবযন্ত্র হিসেবে বিবেচিত, তাই তাকে সর্বদাই সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রাখা উচিত। এজন্যেই মনুর নির্দেশ-
‘অনৃতাবৃতুকালে চ মন্ত্রসংস্কারকৃৎ পতিঃ।
সুখস্য নিত্যং দাতেহ পরলোকে চ যোষিতঃ।।’
পতি মন্ত্রের মাধ্যমে বিবাহ-সংস্কার করেন। তাই তিনি ঋতুকালেই হোক বা ঋতুভিন্ন কালেই হোক, ভার্যাতে গমন করবেন এবং এইভাবে তিনি স্ত্রীর ইহলোকে ও পরলোকে সকল সময়েই তার সুখপ্রদান করেন [যেহেতু পতির সাথেই স্ত্রীর ধর্মকর্ম করার অধিকার, আর তার ফলেই স্বর্গাদি ফল লাভ করা যায়, এই জন্য স্বামীকে স্ত্রীর ‘পরলোকের সুখদাতা’ বলা হয়েছে]। (৫/১৫৩)।

তবে-
‘ঋতুকালাভিগামী স্যাৎ স্বদারনিরতঃ সদা।
পর্ববর্জং ব্রজেচ্চৈনাং তদ্ব্রতো রতিকাম্যয়া।।’
ঋতুকালে অবশ্যই পত্নীর সাথে মিলিত হবে, সকল সময় পত্নীর প্রতি অনুরক্ত থাকবে; পত্নীর রতিকামনা হলে তা পূরণ করার জন্য (অমাবস্যা, অষ্টমী, পৌর্ণমাসী, চতুর্দশী প্রভৃতি) পর্বদিন বাদ দিয়ে ঋতুকাল ছাড়াও অন্য দিনে স্ত্রীর সাথে উপগত হতে পারবে। (৩/৪৫)।
এক্ষেত্রে নারীর স্বাভাবিক ঋতুকালও মনু কর্তৃক চিহ্নিত করা হয়েছে-
‘ঋতুঃ স্বাভাবিকঃ স্ত্রীণাং রাত্রয়ঃ ষোড়শ স্মৃতাঃ।
চতুর্ভিরিতরৈঃ সার্দ্ধমহোভিঃ সদ্বিগর্হিতৈঃ।।’
স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক ঋতুকাল হলো (প্রতিমাসে) ষোল দিনরাত্রিব্যাপী। এগুলির মধ্যে (শোণিত-স্রাব-যুক্ত) চারটি দিন-রাত্রি সজ্জনগণকর্তৃক অতিশয় নিন্দিত। (৩/৪৬)।

‘তাসামাদ্যাশ্চতস্রস্তু নিন্দিতৈকাদশী চ যা।
ত্রয়োদশী চ শেষাস্তু প্রশস্তা দশ রাত্রয়ঃ।।’
ঐ ষোলটি রাত্রির মধ্যে প্রথম চারটি রাত্রি (প্রথম শোণিত দর্শন থেকে চারটি রাত্রি), ষোলটি রাত্রির মধ্যগত একাদশ ও ত্রয়োদশ সংখ্যক রাত্রি- এই ছয়টি রাত্রি ঋতুমতী ভার্যার সাথে সঙ্গম নিন্দিত; এবং এ ছাড়া অবশিষ্ট দশটি রাত্রি প্রশস্ত। (৩/৪৭)।
এখানে প্রশস্ত দশটি রাত্রি চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে, সন্তান উৎপাদনের নিমিত্তেই নারীকে ব্যবহার করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তবে পুত্রসন্তান উৎপাদনই যেহেতু পুরুষের প্রধান আগ্রহ, তাই আরেকটু সুনির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে-
‘যুগ্মাসু পুত্রা জায়ন্তে স্ত্রিয়োহযুগ্মাসু রাত্রিষু।
তস্মাদ্যুগ্মাসু পুত্রার্থী সংবিশেদার্তবে স্ত্রিয়ম্।।’
ঐ দশটি রাত্রির মধ্যে যেগুলি যুগ্মরাত্রি সেগুলিতে অর্থাৎ ষষ্ঠী, অষ্টমী, দশমী, দ্বাদশী, চতুর্দশী ও ষোড়শী এই রাত্রিগুলিতে স্ত্রীগমন করলে পুত্রসন্তান জন্মে। আর পঞ্চমী, সপ্তমী, নবমী প্রভৃতি অযুগ্মরাত্রিগুলিতে স্ত্রীগমন করলে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। অতএব পুত্রলাভেচ্ছু ব্যক্তি ঋতুকালের মধ্যে যুগ্মরাত্রিতেই স্ত্রীর সাথে মিলিত হবে। (৩/৪৮)।

অর্থাৎ পুরুষাধিপত্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে নির্দিষ্ট কতকগুলো দিনে ঘোষিত বিধিবিধান মোতাবেক যৌনক্রিয়ায় বাধ্য করা হচ্ছে তো বটেই, তবুও পুত্রসন্তানের জন্ম না হয়ে যদি কন্যা বা কীব সন্তান জন্মে সেক্ষেত্রে অদ্ভুত কিছু কুযুক্তি আরোপ করে নারীকেই দায়ী করা হচ্ছে-
‘পুমান্ পুংসোহধিকে শুক্রে স্ত্রী ভবত্যধিকে স্ত্রিয়াঃ।
সমেহপুমান্ পুংস্ত্রিয়ৌ বা ক্ষীণেহল্পে চ বিপর্যয়ঃ।।’
মৈথুনকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে স্ত্রীগর্ভে শুক্রনিষেক করার পর পুরুষের রেতঃ ও স্ত্রীর গর্ভস্থ শোণিত (এই দুটিকে অর্থাৎ পুরুষের রেতঃ ও স্ত্রীলোকের গর্ভস্থ শোণিতকে ‘শুক্র’ বা বীর্য বলা হয়) যখন মিশ্রিত হয়ে যায়, তখন পুরুষের বীর্যাধিক্য হলে (শুক্রের আধিক্য কথাটির অর্থ পরিমাণতঃ আধিক্য বা অধিক পরিমাণ নয়, কিন্তু সারতঃ আধিক্য বুঝায়) অযুগ্ম রাত্রিতেও পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। আবার স্ত্রীর বীর্যাধিক্য হলে (অর্থাৎ স্ত্রীর গর্ভস্থ শোণিতভাগ সারতঃ বেশি হলে) যুগ্ম রাত্রিতেও কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। আর যদি উভয়ের বীর্য (শুক্র ও শোণিত) সমান সমান হয় তাহলে অপুমান্ (নপুংসক) জন্মায় অথবা যমজ পুত্র-কন্যা জন্মায়। কিন্তু উভয়েরই বীর্য যদি ক্ষীণ অর্থাৎ অসার বা অল্প হয়, তাহলে বৃথা হয়ে যায়, গর্ভ উৎপন্ন হয় না। (৩/৪৯)।
রতিক্রিয়ায় পুত্র জন্মালে তা পুরুষেরই কৃতিত্ব। অন্যদিকে পুত্র না হয়ে ভিন্ন ফল হলে নারীর শারীরতাত্ত্বিক কুপ্রভাবই দায়ী বলে গণ্য হয়। এতে করে এই পুরুষতান্ত্রিক ভ্রষ্টদর্শনের দায় কাঁধে নিয়ে নারীকেই হীনম্মন্যতায় ভোগে পুরুষের নির্যাতন দণ্ড ভোগ করতে হয়। কেননা পুত্রদর্শনের অনিবার্যতায় শাস্ত্রবিধি পুরুষকে একাধিক দারপরিগ্রহে প্ররোচিত করে। এক্ষেত্রে ল্ক্ষ্যণীয় যে, পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখা শান্ত্রানুমোদিত থাকায় শাস্ত্রবিধির শুভঙ্করী হিসাবে পুরুষ ঘুরে ঘুরে কোন না কোন স্ত্রীর ঋতুকালের যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে গোটা মাসই রতিসুখ লাভ করলেও সর্বোচ্চ গুটিকয় দিন বাদে বাকী সময় একজন নারীর জৈবমানসিক চাহিদা অতৃপ্ত বা অস্বীকৃত থেকে যায়। অর্থাৎ তার যৌনস্বাধীনতাও এক্ষেত্রে বঞ্চিত বা অবহেলিত হয়। এরপরও স্ত্রীলোকের প্রতি মনুর উপদেশ বর্ষণে কার্পণ্য নেই-
‘সদা প্রহৃষ্টয়া ভাব্যং গৃহকার্যেষু দক্ষয়া।
গুসংস্কৃতোপস্করয়া ব্যয়ে চামুক্তহস্তয়া।।’
স্ত্রীলোক সকল সময়েই হৃষ্টচিত্ত হয়ে থাকবে, গৃহের কাজে দক্ষ হবে, গৃহসামগ্রিগুলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে এবং অর্থব্যয়-বিষয়ে মুক্তহস্ত হবে না। (৫/১৫০)।

এবং শুধু স্বামীর মনোরঞ্জন এবং তাঁকে আকৃষ্ট করার জন্যেই স্ত্রীকে সেজেগুজে থাকতে হয়। কেননা-
‘যদি হি স্ত্রী ন রোচেত পুমাংসং ন প্রমোদয়েৎ।
অপ্রমোদাৎ পুনঃ পুংসঃ প্রজনং ন প্রবর্ততে।।’
শোভাজনক বস্ত্র-আভরণাদির দ্বারা যদি নারী দীপ্তিমতি না হয় (বা যদি তার তৃপ্তিবিধান না করা হয়), তাহলে সেই স্ত্রী পতিকে কোনও রকম আনন্দ দিতে পারে না। ফলে, স্ত্রী পতির প্রীতি জন্মাতে না পারলে সন্তানোৎপাদন সম্ভব হয় না। (৩/৬১)।
অর্থাৎ স্বামীর ইহলোক-পরলোকের মোক্ষলাভ করতে সন্তানোৎপাদনের দায়ও শেষপর্যন্ত নারীর উপরই বর্তায়। কেননা সন্তান উৎপাদন না হলে বা স্ত্রীর প্রতি স্বামীকে আকৃষ্ট করতে বা প্রীতি জন্মাতে না পারলে বা রুষ্ট হলে স্বামীটি যৌনতৃপ্তির খোঁজে পুনর্বিবাহ করে আরেকটি যৌনসম্পর্ক স্থাপন করবে।
‘বন্ধ্যাষ্টমেহধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা।
একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্ত¡প্রিয়বাদিনী।।’
নারী বন্ধ্যা হলে আদ্য ঋতুদর্শন থেকে অষ্টম বৎসরে অন্য একটি বিবাহ করবে, মৃতবৎসা হলে দশম বৎসরে, কেবল কন্যাসন্তান প্রসব করতে থাকলে একাদশ বৎসরে এবং অপ্রিয়বাদিনী হলে সদ্য সদ্যই অধিবেদন করবে অর্থাৎ অন্য বিবাহ করবে। (৯/৮১)।

কী সাংঘাতিক কথা ! নারীর এই অপ্রিয়বাদিতা যেহেতু কেবল স্বামী ব্যক্তিটির নিজস্ব রুচি বা মনোবাঞ্ছার উপরই সম্পূর্ণত নির্ভরশীল, তাই নিশ্চিন্তে আশঙ্কামুক্ত হয়ে নারীর মানসিক স্থিরতা পাওয়ার বা দু’দণ্ড বিশ্রামের কোন উপায় নেই। গৃহের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করেও নারীকে সারাক্ষণই স্বামীদেবতার মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলেই যে স্বামী অন্য নারীর খোঁজে বেরিয়ে যাবে-
‘যা রোগিণী স্যাৎ তু হিতা সম্পন্না চৈব শীলতাঃ।
সানুজ্ঞাপ্যাধিবেত্তব্যা নাবমান্যা চ কর্হিচিৎ।।’
স্ত্রী যদি রোগগ্রস্তা হয় অথচ শীলসম্পন্না এবং স্বামীর হিতকারিণী, তা হলে তার অনুমতি নিয়ে স্বামী অন্য বিবাহ করবে, তাকে কোনক্রমেই অপমান করা চলবে না। (৯/৮২)।

কিন্তু নারীর সেরূপ কোন যাবার জায়গা নেই। কেননা-
‘যস্মৈ দদ্যাৎ পিতা ত্বেনাং ভ্রাতা বানুমতে পিতুঃ।
তং শুশ্রূষেত জীবন্তং সংস্থিতং চ ন লঙ্ঘয়েৎ।।’
পিতা নিজে যাকে কন্যা সম্প্রদান করবেন অথবা পিতার অনুমতিক্রমে ভ্রাতা যার হাতে নিজ ভগ্নীকে সম্প্রদান করবে, সেই স্বামী যতদিন জীবিত থাকবে, ততদিন ঐ স্ত্রী তার শুশ্রূষা করবে এবং স্বামী সংস্থিত অর্থাৎ মৃত হলেও সে ব্যভিচারাদির দ্বারা বা শ্রাদ্ধতর্পণাদি না করে সেই স্বামীকে অবহেলা করবে না। (৫/১৫১)।
আবার স্বামী অধিবেদন অর্থাৎ আরেকটি বিয়ে করলেও পূর্ব-স্ত্রীর তা মেনে নেয়া ছাড়াও কোন উপায় থাকে না-

‘অধিবিন্না তু যা নারী নির্গচ্ছেদ্রুষিতা গৃহাৎ।
সা সদ্যঃ সন্নিরোদ্ধব্যা ত্যাজ্যা বা কুলসন্নিধৌ।।’
অধিবেদন করা হয়েছে বলে যে স্ত্রী ক্রোধে গৃহ থেকে চলে যাবে তাকে তখনই গৃহমধ্যে আবদ্ধ করে রাখবে অথবা তার পিতা প্রভৃতি আত্মীয়ের নিকট রেখে আসবে। (৯/৮৩)।

‘সংবৎসরং প্রতীক্ষেত দ্বিষন্তীং যোষিতং পতিঃ।
ঊর্দ্ধং সংবৎসরাত্ত্বেনাং দায়ং হৃত্বা না সংবসেৎ।।’
স্ত্রী যদি পতিদ্বেষিণী হয় তা হলে স্বামী তার জন্য এক বৎসর অপেক্ষা করবে। এক বৎসরের মধ্যে তার দ্বেষভাব বিগত না হলে তার অলঙ্কারাদি কেড়ে নিয়ে তার সাথে আর বসবাস করবে না। (৯/৭৭)।
এই রেখে আসা বা সাথে বসবাস না করার অর্থ এমন নয় যে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। অবহেলায় তাকে পরিত্যক্ত করা হয়েছে, কিন্তু শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী তার মালিকানা স্বামীপ্রভুটিরই থেকে যাচ্ছে। ফলে আত্মীয়দের গলগ্রহ হয়ে থাকলেও নতুন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া তার শাস্ত্রিয় অধিকারে নেই। কেননা-
‘ন নিষ্ক্রয়বিসর্গাভ্যাং ভর্তুর্ভার্যা বিমুচ্যতে।
এবং ধর্মং বিজানমিঃ প্রাক্ প্রজাপতিনির্মিতম্।।’
দান, বিক্রয়, বা পরিত্যাগের দ্বারা ভার্যা স্বামী থেকে সম্বন্ধচ্যুত হতে পারে না। প্রজাপতি-কর্তৃক এইরূপ ধর্মই সৃষ্টিকালে নির্দিষ্ট হয়েছে বলে আমরা জানি। (৯/৪৬)।

ফলে পুরুষতান্ত্রিকতার তীব্র যাতাকলে পরাধীন নারীকে এভাবে প্রতিনিয়ত পর্যুদস্ত হয়েই থাকতে হয়। ফলে যা কিছুই ঘটুক না কেন, স্বামীসেবাই হয়ে যায় আমৃত্যু নারীর পরম ধর্ম-

‘বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈ র্বা পরিবর্জিতঃ।
উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।।’
স্বামী বিশীল (অর্থাৎ জুয়াখেলা প্রভৃতিতে আসক্ত এবং সদাচারশূন্য), কামবৃত্ত (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীতে অনুরক্ত) এবং শাস্ত্রাধ্যায়নাদি ও ধনদানাদি গুণবিহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রীর কর্তব্য হল স্বামীকে দেবতার মতো সেবা করা। (৫/১৫৪)।

এবং সাধ্বী স্ত্রী কাকে বলা হয় তাও মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া আছে-
‘পতিং যা নাভিচরতি মনোবাগ্দেহসংযতা।
সা ভর্তৃলোকানাপ্লোতি সদ্ভিঃ সাধ্বীতি চোচ্যতে।।’
যে স্ত্রী কায়মনোবাক্যে সংযত থেকে পতিকে অতিক্রম করে না, সে ভর্তৃলোকে গমন করে এবং সাধু লোকেরা তাকে ‘সাধ্বী’ বলে প্রশংসা করে। (৫/১৬৫)।
তাই-
‘পাণিগ্রাহস্য সাধ্বী স্ত্রী জীবতো বা মৃতস্য বা।
পতিলোকমভীপ্সন্তী নাচরেৎ কিঞ্চিদপ্রিয়ম্।।’
সাধ্বী স্ত্রী যদি পতিলোক [অর্থাৎ পতির সাথে ধর্মানুষ্ঠান করে যে স্বর্গাদি লোক অর্জন করা যায়, সেই পতিলোক] লাভ করতে ইচ্ছা করে, তাহলে যে ব্যক্তি তার পাণিগ্রহণ করেছে তার জীবিতকালেই হোক বা তার মৃত্যুর পরেই হোক তার কোনও অপ্রিয় কাজ সে করবে না। (৫/১৫৬)।
এখানে হয়তো কূট-প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে যে, স্ত্রী যদি নিতান্তই বর্তমান বিশিল বা কামবৃত্ত পতির প্রতি অনাগ্রহহেতু পতিলোক লাভে ইচ্ছুক না হয় ? এরকম প্রশ্ন বৈদিক সমাজে প্রযোজ্য হওয়ার কোন সুযোগই নেই আসলে। কেননা নারীর নিজস্ব কোন ইচ্ছা থাকতে পারে তা পিতৃতান্ত্রিক মনুশাস্ত্রে সম্পূর্ণতই অস্বীকার করা হয়েছে। পুরুষের অনুগামী হওয়াই নারীর জন্য অনিবার্য ও বাধ্যতামূলক। তবে একজন নারীর জন্য এই অনুগামীতাও কেবল একজন পুরুষের দিকেই, যিনি তার পতি হবেন। সেই পতিদেবটি যদি বিশীল কিংবা সন্তানদানে অক্ষমও হয়, তবুও নারীর তাকে ছেড়ে যাবার উপায় নেই-
‘অপত্যলোভাদ্ যা তু স্ত্রী ভর্তারমতিবর্ততে।
সেহ নিন্দামবাপ্লোতি পতিলোকাচ্চ হীয়তে।।’
যে স্ত্রী সন্তানের লোভে স্বামীর অতিবর্তন করে অর্থাৎ স্বামীকে লঙ্ঘন করে এবং পরপুরুষের সাথে সংসর্গ করে, সে ইহলোকে নিন্দা বা লোকাপবাদ প্রাপ্ত হয় এবং পরলোক থেকেও বঞ্চিত হয় (অর্থাৎ স্বর্গলাভ করতে পারে না)। (৫/১৬১)।
.
‘নান্যোৎপন্না প্রজাস্তীহ ন চাপ্যন্যপরিগ্রহে।
ন দ্বিতীয়শ্চ সাধ্বীনাং ক্বচিদ্ভর্তোপদিশ্যতে।।’
(নিয়োগপ্রথা ব্যতিরেকে) পরপুরুষের দ্বারা উৎপাদিত সন্তান কোনও নারীর নিজসন্তান হতে পারে না; সেইরকম যে নারী নিজের পত্নী নয় তার গর্ভে উৎপাদিত পুত্রও কোনও পুরুষের নিজপুত্র হতে পারে না। সাধ্বী স্ত্রীদের দ্বিতীয় পতিগ্রহণের উপদেশ নেই। (৫/১৬২)।

তাই পতি মারা গেলেও স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে-
‘কামং তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।
ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু।।’
পতি মৃত হলে স্ত্রী বরং পবিত্র ফুল-ফল-মূলাদি অল্পাহারের দ্বারা জীবন ক্ষয় করবে, কিন্তু ব্যভিচারবুদ্ধিতে পরপুরুষের নামোচ্চারণও করবে না। (৫/১৫৭)।

অর্থাৎ নারীর সহজাত মাতৃত্বসত্তার স্বীকার তো দূরের কথা, তার কোন জৈবিক চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, মনুশাস্ত্রে তাও স্বীকৃত হয়নি। কেননা মনুশাস্ত্রে নারীর দ্বিতীয় পতিগ্রহণের উপদেশ নেই। অথচ পুরুষের কামচরিতার্থতার প্রয়োজনকে কিন্তু কোনভাবেই অস্বীকার করা হচ্ছে না। বরং পুরুষের জন্য পবিত্র বিধানও তৈরি করে দেয়া হয়েছে-
‘ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি।
পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ।।’
(সুশীলা-) ভার্যা স্বামীর পূর্বে মারা গেলে তার দাহাদি অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে পুরুষ পুনরায় দারপরিগ্রহ ও অগ্ন্যাধ্যান করবে (যদি ধর্মানুষ্ঠান ও কামচরিতার্থতার প্রয়োজন থাকে, তবেই ঐ স্বামীর পুনরায় দারপরিগ্রহ করা উচিৎ। তা না হলে পত্নী নেই বলে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস অবলম্বন করতে পারে)। (৫/১৬৮)।

‘অনেন বিধিনা নিত্যং পঞ্চযজ্ঞান্ ন হাপয়েৎ।
দ্বিতীয়মায়ুষো ভাগং কৃতদারো গৃহে বসেৎ।।’
পূর্বোক্ত বিধানানুসারে কোনও সময়ে পঞ্চযজ্ঞ পরিত্যাগ করবে না এবং দারপরিগ্রহ করে পরমায়ুর দ্বিতীয়ভাগে গৃহাশ্রমে বাস করবে। (৫/১৬৯)।
আবার বৈদিক সমাজে নারী অত্যন্ত সহজলভ্য বলেই নারীর প্রতি পুরুষতন্ত্র কতোটা অবহেলাপরায়ণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে তার নমুনাও মনুশান্ত্রে বিরল নয়-
‘বিধায় প্রোষিতে বৃত্তিং জীবেন্নিয়মমাস্থিতা।
প্রোষিতে ত্ববিধায়ৈব জীবেচ্ছিল্পৈরগর্হিতৈঃ।।’
স্বামী যদি গ্রাসাচ্ছাদনাদির ব্যবস্থা করে দিয়ে বিদেশে বসবাস করতে যায়, স্ত্রীর কর্তব্য হবে- নিয়ম অবলম্বন করে থাকা [যেমন, স্বামী কাছে থাকলে পরের বাড়ীতে গিয়ে থাকা প্রভৃতি স্ত্রীর পক্ষে নিষিদ্ধ, তেমনি স্বামী প্রোষিত হলেও ঐ সব নিয়ম গ্রহণ করে কালাতিপাত করবে], আর যদি বৃত্তির ব্যবস্থা না করেই স্বামী বিদেশে অবস্থান করে, তাহলে সূতা কাটা প্রভৃতি অনিন্দিত শিল্পকর্মের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবে। (৯/৭৫)।

প্রোষিতো ধর্মকার্যার্থং প্রতীক্ষ্যোহষ্টৌ নরঃ সমাঃ।
বিদ্যার্থং ষড্যশোহর্থং বা কামার্থং ত্রীংস্তু বৎসরান্।।’
স্বামী যদি ধর্মকার্যের জন্য বিদেশে গিয়ে বাস করে তা হলে আট বৎসর, বিদ্যার্জনের জন্য বিদেশে গেলে ছয় বৎসর, যশোলাভের জন্য গেলে ছয় বৎসর এবং কামোপভোগের জন্য বিদেশ গেলে তিন বৎসর স্ত্রী তার জন্য অপেক্ষা করবে। (৯/৭৬)।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপেক্ষা পূর্ণ হবার পর নারীর কর্তব্য কী হবে ? এখানে মনু উত্তরহীন হলেও অন্যত্র এই কর্তব্যবিধান দেয়াই আছে। যেহেতু নারীর পুনর্বিবাহ বৈধ নয়, যেহেতু নারীর পরপুরুষের চিন্তা করাও নিষিদ্ধ এবং যেহেতু নারীর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক গন্তব্য হিসেবে একজন স্বামীই নির্দেশিত, তাই ধরেই নিতে হয় যে একজন স্বামীদেবতার তিলকচিহ্ন ধারণ করে নারীটি আসলে পরিত্যক্তাই। এবং স্পষ্টতই তার গন্তব্য বিধবা-নির্দিষ্ট পথেই। অথচ যে স্বামীটি কর্তৃক এই নারী পরিত্যক্তাবস্থায় নিক্ষিপ্ত হলো, হয়তো সেই  স্বামীদেবতা বিদেশে তখন শাস্ত্রবিধি অনুসারেই আরো একাধিক স্ত্রী নিয়ে লীলায় মত্ত রয়েছে।
 .
মোটকথা মনুশান্ত্রে নারী শুধু ভোগ্য ও ব্যবহার্যই কেবল, কিন্তু কোন ইতিবাচক ফলাফলের অধিকারিণী সে নয়। সেখানে পুরুষই কর্তৃত্বপরায়ণ। আর এই পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রশ্নহীন ও যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যেই নিরূপায় নারী যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাই নারীর পরম ধর্ম ও কর্তব্য হিসেবে কীর্তিত হয়েছে কেবল।
 .
মনুশাস্ত্রে নারীর গুরুত্ব ও ব্যবহার
পুরুষের দৃষ্টিতে যা কিছু নেতি বা নিকৃষ্ট তারই উৎস হিসেবে নারীকে মনুশাস্ত্রে যথেচ্ছভাবে হীন খলচরিত্রে উপস্থাপন ও চিহ্নিত করা হলেও সমাজজীবনে নারীর উপস্থিতির অবশ্যম্ভাবীতার কারণে তাকে গুরুত্ব না-দিয়েও উপায় নেই পুরুষের। কিন্তু তাও হয়েছে পুরুষের অনুকুলে, উদ্দেশ্যমূলক-

‘পতির্ভার্যাং সম্প্রবিশ্য গর্ভো ভূত্বেহ জায়তে।
জায়ায়াস্তদ্ধি জায়াত্বং যদস্যাং জায়তে পুনঃ।।’
পতি শুক্ররূপে ভার্যার গহ্বরমধ্যে প্রবেশ করে এই পৃথিবীতে তার গর্ভ থেকে পুনরায় পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করে। জায়ার (অর্থাৎ ভার্যার) জায়াত্ব এই যে তার মধ্যে পতি পুনর্বার জন্মগ্রহণ করে এবং এই কারণেই ভার্যাকে জায়া বলা হয়। অতএব জায়াকে সর্বতোভাবে রক্ষা করতে হবে। (৯/৮)।

কিন্তু এ কথার আড়ালে মনুর অন্তর্গত পুরুষতান্ত্রিক প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গিটা হচ্ছে একরৈখিক-

‘পৌংশ্চলাচ্চলচিত্তাচ্চ নৈঃস্নেহ্যচ্চ স্বভাবতঃ।
রক্ষিতা যত্নতোহপীহ ভর্তৃষবেতা বিকুর্বতে।।’
যেহেতু স্ত্রীলোক স্বভাবত পুংশ্চলী [যে কোনও পুরুষ মানুষ এদের দৃষ্টি-পথে পড়লে এদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে- ঐ পুরুষের সাথে কিভাবে সম্ভোগ করবো- এই প্রকার যে চিত্তবিকার, তাই পুংশ্চলীত্ব], চঞ্চলচিত্ত [ধর্মকার্যাদি শুভ-বিষয়ে চিত্তের অস্থিরতা দেখা যায়] এবং স্নেহহীন, সেই কারণে এদের যত্নসহকারে রক্ষা করা হলেও এরা স্বামীর প্রতি বিরূপ হয়ে থাকে। (৯/১৫)।
পিতৃতন্ত্র যে প্রকৃতপক্ষেই নারীর মর্যাদা দিতে জানে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য স্ত্রী যেখানে আক্ষরিক অর্থেই শ্রমদাসী বা সেবাদাসী, সেখানে মর্যাদার প্রশ্নও প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়। তাই স্ত্রীকে কখনো বন্ধুভাবাপন্ন ভাবা মনুশাস্ত্রের বিধান নয়, বরং কর্তব্যে অবহেলাজনিত অপরাধ করলে স্পষ্ট করে প্রহাররূপ শাসনের কথাই নির্দেশ করা হয়েছে-
‘ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ শিষ্যো ভ্রাতা চ সোদরঃ
প্রাপ্তাপরাধাস্তাড্যাঃ স্যূ রজ্জ্বা বেণুলেন বা।।’
স্ত্রী, পুত্র, ভৃত্য, শিষ্য এবং কনিষ্ঠ সহোদরভ্রাতা অপরাধ করলে সূক্ষ দড়ির দ্বারা কিংবা বেতের দ্বারা শাসনের জন্য প্রহার করবে। (৮/২৯৯)।

এখানে স্ত্রীকে পুত্র, শিষ্য বা ভৃত্যের পর্যায়ে দেখার অর্থই হচ্ছে নারী শেষপর্যন্ত দাসীই। তবে তা সাধারণ দাসী নয়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ দাসী। এবং পুরুষ হচ্ছে তার সর্বত্রগামী প্রভু। এই সর্বত্রগামী প্রভুত্ব কায়েম রাখার স্বার্থেই নারীকে একধরনের গুরুত্বও দেয়া হয়েছে বৈ কি-
‘প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষোহস্তি কশ্চন।।’
স্ত্রীলোকেরা সন্তান প্রসব ও পালন করে বলে [‘প্রজন’ বলতে গর্ভধারণ থেকে সন্তান পালন পর্যন্ত ক্রিয়াকলাপকে বোঝায়] তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী [এ কারণে, তারা বস্ত্রারঙ্কারাদি প্রদানের দ্বারা বহুসম্মানের যোগ্য]; এরা গৃহের দীপ্তি অর্থাৎ প্রকাশস্বরূপ হয় [স্ত্রীলোক বাড়িতে না থাকলে কুটুম্ব বা আত্মীয়বর্গের আদর-আপ্যায়ন কিছুই হয় না। পুরুষের ধনৈশ্বর্য থাকলেও যদি ভার্যা না থাকে, তা হলে বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা উপস্থিত হলে গৃহস্বামী নিজে তাদের প্রত্যেককে পান-ভোজনাদির দ্বারা আপ্যায়িত করতে পারে না] এই কারণে, স্ত্রীলোকদের সকল সময়ে সম্মান-সহকারে রাখা উচিত, বাড়িতে স্ত্রী এবং শ্রী- এদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। (৯/২৬)।

তাই-
‘যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।’
যে বংশে স্ত্রীলোকেরা বস্ত্রালঙ্কারাদির দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন (আর প্রসন্ন হয়ে তাঁরা পরিবারের সকলকে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন), আর যে বংশে স্ত্রীলোকদের সমাদর নেই, সেখানে (যাগ, হোম, দেবতার আরাধনা প্রভৃতি) সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়। (৩/৫৬)।
.
‘এতাবানেব পুরুষো যজ্জায়াত্মা প্রজেতি হ।
বিপ্রাঃ প্রাহুস্তথা চৈতদ্ যো ভর্তা সা স্মৃতাঙ্গনা।।’
স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে পুরুষ পরিপূর্ণস্বরূপ হয়, একথা বেদিবদ ব্রাহ্মণগণ বলেন; কাজেই স্ত্রীও যে পতিও সে অর্থাৎ স্ত্রী হলো পতির আত্মভূত অংশস্বরূপ। (৯/৪৫)।
কিন্তু নারীর এ সমাদর যে স্বার্থহীন নয়, মনুশান্ত্রে তা অস্পষ্ট নয়। কেননা পুরুষের স্বার্থ বিন্দুমাত্র ব্যহত হলে কিভাবে রক্ষিতা স্ত্রীটি নিমেষে পরিত্যাজ্য হয়ে যায় তা আমরা আগেই দেখেছি। পুরুষের এই স্বার্থ হচ্ছে শর্তহীন ভোগ ও সম্পদ রক্ষার নিমিত্তে উত্তরাধিকারী উৎপাদনের স্বার্থ। এগুলো যথাযথ পূর্ণ করার মধ্যেই মূলত নারীর গুরুত্ব নিহিত। এ উভয় স্বার্থেই পুরুষ স্পষ্টতই আপোষহীন, কোথাও ছাড় দিতে নারাজ। একটি মনোদৈহিক সন্তুষ্টি, অন্যটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিকত্ব। তাই ভোগের স্বার্থ পূর্ণ না হলে যেমন নারীর কোন মূল্যই নেই, তেমনি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার উৎস পুত্র জন্ম দিতে না পারলেও সে নারীর আর সমাদর থাকে না। পুত্রের মাধ্যমেই পুরুষের বংশধারা রক্ষিত হয় এবং পুত্রের মাধ্যমে সম্পত্তির মালিকানাও পুরুষের অধীনন্থ থাকে। আর এই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার ধারা বহাল রাখতে নারীকে তার সর্বস্বের বিনিময়েই পুত্র উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ব্যস্ত থাকতে হয়। যদিও পুত্রের উপর মাতার কোন অধিকার নাই। তবু এটাই তার অস্তিত্বের প্রশ্ন। এবং অনুধাবনের বিষয় যে, এটা পিতৃতন্ত্রেরও অস্তিত্বের প্রশ্ন। সে কারণেই পতি অক্ষম হলে কিংবা সন্তানহীন অবস্থায় মারা গেলে বংশধারা রাকল্পে সমস্ত মুখোশ ছিঁড়ে ফেলেও পিতৃবংশ উন্মত্ত হয়ে ওঠে স্ত্রী কিংবা বিধবার গর্ভে পুত্র জন্মানোর নিমিত্তে এক ধরনের নিয়োগ-প্রথার মাধ্যমে-
‘দেবরাদ্বা সপিণ্ডাদ্বা স্ত্রিয়া সম্যঙ্ নিযুক্তয়া।
প্রজেপ্সিতাধিগন্তব্যা সন্তানস্য পরিক্ষয়ে।।’
সন্তানের পরিক্ষয়ে অর্থাৎ সন্তান-উৎপত্তি না হওয়ায় বা সন্তান-জন্মানোর পর তার মৃত্যু হওয়ায় বা কন্যার জন্ম হলে তাকে পুত্রিকারূপে গ্রহণ না করায় নারী শ্বশুর-শাশুড়ি-পতি প্রভৃতি গুরুজনদের দ্বারা সম্যকভাবে নিযুক্ত হয়ে দেবর (অর্থাৎ স্বামীর জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা) অথবা সপিণ্ডের (স্বামীর বংশের কোনও পুরুষের) সাহায্যে অভিলষিত সন্তান লাভ করবে। (৯/৫৯)।

বৈদিক বিধান এমনই অলৌকিক শাস্ত্র যে সম্পদরক্ষায় পুত্রের প্রয়োজনে মনুসংহিতার ৫/১৫৭ সংখ্যক শ্লোকে (ইতঃপূর্বে উদ্ধৃত) বর্ণিত বিধবার কর্তব্যও সাময়িক রদ হয়ে যায়-
‘সংস্থিতস্যানপত্যস্য সগোত্রাৎ পুত্রমাহরেৎ।
তত্র যদ্ রিক্থজাতং স্যাত্তত্তস্মিন্ প্রতিপাদয়েৎ।।’
কোনও ব্যক্তি যদি অপুত্র অবস্থায় মারা যায়, তাহলে তার স্ত্রী গুরুজনদের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে সগোত্র পুরুষের দ্বারা পুত্র উৎপাদন করবে এবং মৃত ব্যক্তির যা কিছু ধনসম্পত্তি তা ঐ পুত্রকে অর্পণ করবে। (৯/১৯০)।
কিভাবে এই নিয়োগ-প্রথাটি কার্যকর করা হবে মনুশাস্ত্রে তাও উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে-
‘বিধবায়াং নিযুক্তস্তু ঘৃতাক্তো বাগ্যতো নিশি।
একমুৎপাদয়েৎ পুত্রং ন দ্বিতীয়ং কথঞ্চন।।’
বিধবা নারীতে অথবা অক্ষম পতি থাকা সত্ত্বেও সধবাতেও পতি-প্রভৃতি গুরুজনের দ্বারা নিযুক্ত দেবর বা কোনও সপিণ্ড ব্যক্তি ঘৃতাক্ত শরীরে মৌনাবলম্বন করে রাত্রিতে একটিমাত্র পুত্র উৎপাদন করবে, কখনো দ্বিতীয় পুত্র উৎপাদন করবে না [নিশি অর্থাৎ রাত্রিতে কথাটি বলার তাৎপর্য হলো, সেখানে প্রদীপ প্রভৃতি আলো থাকবে না]। (৯/৬০)।
.
‘দ্বিতীয়মেকে প্রজনং মন্যন্তে স্ত্রীষু তদ্বিদঃ।
অনিবৃতং নিয়োগার্থং পশ্যন্তো ধর্মতস্তয়োঃ।।’
কোনও কোনও সন্তানোৎপত্তিবিদ আচার্য বলেন, একপুত্র অপুত্রের মধ্যে গণ্য, এইজন্য ঐভাবে দ্বিতীয় পুত্র উৎপাদন করানো যায়। অতএব এক পুত্রের দ্বারা নিয়োগকর্তার নিয়োগোদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না বলে শিষ্টাচার অনুসারে ঐ স্ত্রী এবং পূর্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিই দ্বিতীয় পুত্র উৎপাদন করতে পারবে। (৯/৬১)।

অতঃপর-
‘বিধবায়াং নিয়োগার্থে নির্বৃতে তু যথাবিধি।
গুরুবচ্চ স্নুষাবচ্চ বর্তেয়াতাং পরস্পরম্।।’
বিধবা নারীতে যথাবিধি নিয়োগের প্রয়োজন সিদ্ধ হলে [যে কারণে নিয়োগ করা হয়, তা-ই এখানে নিয়োগের বিষয়। তা হলো স্ত্রী-পুরুষের সম্প্রযোগ থেকে ক্রিয়ানিষ্পত্তি অর্থাৎ স্ত্রী-লোকের গর্ভধারণ পর্যন্ত] উভয়ের মধ্যে পূর্ববৎ আচরণই চলতে থাকবে। সেটি হলো গুরুবৎ স্নুষাবৎ; অর্থাৎ পুরুষের পক্ষে ঐ নারী যদি জ্যেষ্ঠভ্রাতার স্ত্রী হয় তা হলে তার প্রতি গুরুর মতো, আর যদি কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী হয়, তাহলে তার প্রতি পুত্রবধুর মতো আচরণ করবে। (৯/৬২)।
.
‘নিযুক্তৌ যৌ বিধিং হিত্বা বর্তেয়াতান্তু কামতঃ।
তাবুভৌ পতিতৌ স্যাতাং স্নুষাগ-গুরুতল্পগৌ।।’
জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিয়োগের জন্য নিযুক্ত হয়েও যদি পূর্বোক্ত ঘৃতাক্তাদি নিয়ম লঙ্ঘন করে কামনা চরিতার্থ করার ইচ্ছায় পরস্পরের ভার্যাতে আভিগমন করে, তাহলে জ্যেষ্ঠভ্রাতা পুত্রবধুগমন এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা গুরুপত্নীগমন-রূপ দোষে পতিত হবে। (৯/৬৩)।
বড় অদ্ভুত বিধান ! পরস্পর নিবিড় যৌনসংসর্গে অভিজ্ঞতায় পৌঁছেও কোনরূপ আবেগ বা কামনাহীন এমন যান্ত্রিক আচরণবিধি পালনের নির্দেশ থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, পিতৃতন্ত্রে মানবীয় আবেগ-অনুভূতির কোন স্থান নেই। আর নারী সেখানে আক্ষরিক অর্থেই শস্যক্ষেত্রস্বরূপ। সম্পদ রক্ষার্থে পিতৃতন্ত্রের এই নিয়োগপ্রথার বৈধতা নিরূপণ করেও আবার কূটাভাষের মাধ্যমে তাকে প্রতিষেধ করারও চেষ্টা করা হয়েছে-
‘নান্যস্মিন্ বিধবা নারী নিযোক্তব্যা দ্বিজাতিভিঃ।
অন্যস্মিন্ হি নিযুঞ্জানা ধর্মং হন্যুঃ সনাতনম্।।’
বিধবা নারীকে দ্বিজাতিগণ কখনো অন্য পুরুষে নিযুক্ত করবে না, কারণ, অন্য পুরুষে যারা ঐ ভাবে তাকে নিযুক্ত করে, তারা সনাতন ধর্ম উল্লঙ্ঘন করে। (৯/৬৪)।

কিভাবে উল্লঙ্ঘন হয় ?-
‘নোদ্বাহিকেষু মন্ত্রেষু নিয়োগঃ কীর্ত্যতে ক্বচিৎ।
ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনং পুনঃ।।’
বিবাহবিষয়ক যে সব মন্ত্র আছে তার কোথাও নিয়োগের প্রসঙ্গ নেই [অর্থাৎ বিবাহসম্পর্কিত যত সব মন্ত্র আছে সেগুলি প্রত্যেকটিতেই বিবাহকারীর নিজেরই উৎপাদিত সন্তানের কথা বলা আছে] আর বিবাহবিষয়ক-শাস্ত্রতেও বিধবা-আবেদনের অর্থাৎ বিধবা বিধবাবিবাহের বা বিধবা-গমনের কথা নেই। (৯/৬৫)।

অর্থাৎ নিয়োগবিধি উল্লেখ করে ধর্মীয় বিধানে তাকে আবার যতটুকু সম্ভব নিরুৎসাহিত করার কৌশলী বিভ্রম ছড়িয়ে মূলত সম্পদরক্ষায় নারীকে ব্যবহার ও ভোগের ভিন্ন একটি উপায়ের পেছনদরজা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব, নারীর অবস্থা তথৈবচ। মূলত প্রচলিত সামাজিক প্রথা হিসেবে নিয়োগবিধির আলোকে বিধবা-বিবাহের মাধ্যমে নারীর পুনর্বিবাহ প্রতিরোধকল্পেই এই বিভ্রান্তি পিতৃতন্ত্র কর্তৃক সৃষ্ট বলে মনে হয়। অন্যদিকে পিতৃতন্ত্রে সম্পদরক্ষারও কী অদ্ভুত উপায় !
 .
আবার বিবাহের আগে যে বাগদত্তা কন্যার বরের মৃত্যু হয় এবং শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী যেহেতু তাকে অন্যত্র সম্প্রদান করা যায় না (৯/৭১), তার ক্ষেত্রেও ভিন্ন নিয়োগপ্রথার উল্লেখ মনুশাস্ত্রে দেখা যায়-
‘যস্যা ম্রিয়েত কন্যায়া বাচা সত্যে কৃতে পতিঃ।
তামনেন বিধানেন নিজো বিন্দেত দেবরঃ।।’
বিবাহের আগে কোনও বাগদত্তা কন্যার বরের মৃত্যু হলে, নিম্নোক্ত বিধান অনুসারে বরের সহোদর ভ্রাতা তাকে বিবাহ করবে। (৯/৬৯)।
.
‘যথাবিধ্যধিগম্যৈনাং শুকবস্ত্রাং শুচিব্রতাম্।
মিথো ভজেতাপ্রসবাৎ সকৃৎ সকৃদৃতাবৃতৌ।।’
উক্ত দেবর কন্যাটিকে শাস্ত্রোক্ত নিয়ম অনুসারে বিবাহ করে তাকে গমন-কালীন নিয়মানুসারে বৈধব্যচিহ্নসূচক-শুকবস্ত্র পরিয়ে এবং কায়মনোবাক্যে তাকে শুদ্ধাচারিণী রেখে প্রত্যেক ঋতুকালে তাতে এক এক বার গমন করবে যতদিন না সে গর্ভ-ধারণ করে। (৯/৭০)।

ন্যুনতম মানবিক অধিকারও হরণের মাধ্যমে নিরূপায় বানিয়ে নারীনিবর্তনের এমন নির্মম নজির কেবল পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী সমাজ ও ধর্মশাস্ত্রেই সম্ভব।  
 .
সম্পদে উত্তরাধিকারে অধিকাররহিত নারী
সম্পত্তির অধিকারই অর্থনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকাঠামোয় এই অধিকার সম্পূর্ণই পিতার। পিতার বর্তমানে পুত্রেরাও সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। কেবল পিতার মৃত্যুর পরই পুত্রেরা সম্পত্তির মালিক হতে পারে। আর এ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান বহু বহু দূরে-
‘উর্দ্ধং পিতুশ্চ মাতুশ্চ সমেত্য ভ্রাতরঃ সমম্।
ভজেরন্ পৈতৃকং রিক্থমনীশাস্তে হি জীবতোঃ।।’
পিতা এবং মাতার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা সমবেত হয়ে পিতার এবং মাতার ধন বিভাগ করে নেবে, কারণ, তাঁরা জীবিত থাকতে পুত্রদের কোন স্বামিত্ব বা অধিকার নাই। (৯/১০৪)।

ধর্মানুসারে জ্যেষ্ঠ পুত্র ধর্মজ এবং অন্য সন্তানেরা কামজ (৯/১০৭) এবং জ্যেষ্ঠই জন্মমাত্র পিতৃঋণ পরিশোধ করে বলে জ্যেষ্ঠপুত্রই প্রকৃত অর্থে পুত্রপদবাচ্য (৯/১০৬)। তাই সম্পত্তির দায়ভাগ বিধান মতে জ্যেষ্ঠই সমস্ত পিতৃধন লাভ করার যোগ্য। অতঃপর-
‘পিতেব পালয়েৎ পুত্রান্ জ্যেষ্ঠো ভ্রাতৃন্ যবীয়সঃ।
পুত্রবচ্চাপি বর্তেরন্ জ্যেষ্ঠে ভ্রাতরি ধর্মতঃ।।’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আহার ও বস্ত্রাদি দান করে সহোদর কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের পিতার মতো পালন করবে; এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতারাও ধর্মানুসারে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি পিতার মতো আচরণ করবে। (৯/১০৮)।
.
‘জ্যেষ্ঠস্য বিংশ উদ্ধারঃ সর্বদ্রব্যাচ্চ যদ্বরম্।
ততোহর্দ্ধং মধ্যমস্য স্যাৎ তুরীয়ন্তু যবীয়সঃ।।’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতার ধন সম্পত্তির বিশ ভাগের এক ভাগ ‘উদ্ধার’ অর্থাৎ অতিরিক্ত পাবে, এবং সকল দ্রব্যের মধ্যে যেটি সেরা সেটিও পাবে। মধ্যম তার অর্দ্ধেক অর্থাৎ চল্লিশ ভাগের এক ভাগ ‘উদ্ধার’ পাবে আর কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের চতুর্থ ভাগ অর্থাৎ সমগ্র ধন-সম্পত্তির আশি ভাগের এক ভাগ ঐ ‘উদ্ধার’ পাবে। (৯/১১২)।
.
‘স্বেভ্যোহংশেভ্যস্তু কন্যাভ্যঃ প্রদদ্যুর্ভ্রাতরঃ পৃথক্।
স্বাৎ স্বাদংশাচ্চতুর্ভাগং পতিতাঃ স্যুরদিৎসবঃ।।’
ভ্রাতারা স্বজাতীয় অবিবাহিত ভগিনীগণকে নিজ নিজ অংশ থেকে চতুর্থ ভাগ ধন পৃথক করে দান করবে; যদি তারা দিতে অনিচ্ছুক হয় তা হলে পতিত হবে। (৯/১১৮)।

অর্থাৎ বিবাহিত ভগিনীরা পিতৃসম্পত্তির অধিকারী নয়।
 .
সম্পত্তির মালিকানা বা উত্তরাধিকারের জন্য পুত্র থাকা অনিবার্য বলেই যদি পুত্র না থাকে, সেক্ষেত্রে পিতা বিকল্প উপায় হিসেবে তার কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্বাচন করতে পারেন-
‘অপুত্রোহনেন বিধিনা সুতাং কুর্বীত পুত্রিকাম্।
যদপত্যং ভবেদস্যাং তন্মম স্যাৎ স্বধাকরম্।।’
যে লোকের কোন পুত্র সন্তান নেই সে এই বক্ষ্যমান নিয়মে নিজের কন্যাকে ‘পুত্রিকা’রূপে স্থির করবে। কন্যাকে পাত্রস্থ করবার সময় ঐ কন্যার পিতা জামাতার সাথে বন্দোবস্ত করে এই কথা তাকে বলবে- ‘এই কন্যার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে সে আমার পিণ্ডদানকারী হবে’। (৯/১২৭)।

উল্লেখ্য যে, শাস্ত্রানুযায়ী পুত্রের প্রয়োজন হয় পিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি বা সদগতির লক্ষ্যে (স্বর্গারোহণ) শ্রাদ্ধাতিতে পিণ্ডদান করার জন্য (৯/১৩৭)। পিণ্ডদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে মূলত অন্যান্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। একইভাবে পিণ্ডদানের অধিকারক্রম অনুযায়ীই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ধারাক্রম নির্ধারিত হয়। তাই কন্যার প্রতি দায় বা মমত্ব থেকে পিতৃতন্ত্র পুত্রিকা গ্রহণ করে তা ভাবার কোন সুযোগ নেই। বরং উত্তরাধিকারের সংকটমুক্তির লক্ষ্যে এখানে পুত্রিকার পুত্রকেই নিজ-পুত্র কল্পনা করার প্রকৃত মনোভাব হিসেবে কাজ করে। কেননা-
‘যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেৎ।।’
নিজেও যেমন পুত্রও সেইরকম অর্থাৎ আত্মা ও পুত্রতে প্রভেদ নেই; আবার দুহিতা অর্থাৎ ‘পুত্রিকা’ পুত্রেরই সমান। সেই পুত্রিকা-পুত্র স্বয়ং বিদ্যমান থাকতে অন্য কোনও ব্যক্তি ঐ পুত্রিকা-পিতার ধন কেমন ভাবে গ্রহণ করবে ? (৯/১৩০)।
আবার-
‘পুত্রিকায়াং কৃতায়ান্তু যদি পুত্রোহনুজায়তে।
সমস্তত্র বিভাগঃ স্যাজ্জ্যেষ্ঠতা নাস্তি হি স্ত্রিয়াঃ।।’
পুত্রিকা সম্পাদন করার পর যদি কোনও ব্যক্তির পুত্র জন্মগ্রহণ করে, তাহলে পুত্র ও পুত্রিকা উভয়ের মধ্যে সমান-সমান ভাবে ধনবিভাগ হবে। কারণ, স্ত্রীলোকের জ্যেষ্ঠতা নেই অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ পুত্র যে ‘উদ্ধার’ পেত তা ঐ পুত্রিকা পাবে না। (৯/১৩৪)।

এতেই প্রতীয়মান হয় যে পিতৃতন্ত্র আসলে পুত্রমুখীই। তাছাড়া পুত্রিকা গ্রহণে পিতৃবংশধারা রুদ্ধ হবার সংশয়ও ত্যাগ করা যায় না-
‘অপুত্রায়াং মৃতায়ান্তু পুত্রিকায়াং কথঞ্চন।
ধনং তৎপুত্রিকাভর্তা হরেতৈবাবিচারয়ন্।।’
পুত্রিকা যদি অপুত্রক অবস্থায় ঘটনাক্রমে মারা যায়, তাহলে ঐ পুত্রিকার যা কিছু ধন-সম্পত্তি তা তার ভর্তাই বিনা-বিচারে গ্রহণ করবে। (৯/১৩৫)।

এই সংশয় থেকেই, কিংবা ব্যক্তি সন্তানহীন হলে, সামাজিক নিয়োগ-প্রথায় দেবর বা অপর পুরুষের মাধ্যমে যথাবিহিত পুত্র উৎপাদনের মধ্য দিয়ে এই উত্তরাধিকারী সৃষ্টি করে সম্পত্তি-রক্ষার সংকট নিরসন করা হয়-
‘হরেত্তত্র নিযুক্তায়াং জাতঃ পুত্রো যথৌরসঃ।
ক্ষেত্রিকস্য তু তদ্বীজং ধর্মতঃ প্রসবশ্চ সঃ।।’
গুরুজনদের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে যদি কোনও স্ত্রী বিধানানুসারে সন্তানোৎপাদন করে, তাহলে ঐ পুত্র ঔরসপুত্রের মতো পৈত্রিকধন প্রাপ্তির যোগ্য হবে, কারণ শাস্ত্রব্যবস্থা অনুসারে সেই নারীর গর্ভে যে বীজ নিষিক্ত হয়েছিলো, তা ক্ষেত্রস্বামীরই বীজ বলে গণ্য হবে এবং সেই পুত্রটিও ক্ষেত্রস্বামীরই অপত্য হবে। (৯/১৪৫)।

কিন্তু তা গুরুজন কর্তৃক আদিষ্ট না-হয়ে কিংবা যথাবিহিত নিয়ম ব্যতিরেকে হলে উৎপাদিত সন্তান কামজ ও জারজ বলে গণ্য হওয়ায় সম্পত্তির অধিকারী হবে না। অতএব যথানিয়মে ক্ষেত্রজ পুত্র জন্মালে তার ক্ষেত্রে সম্পত্তি বন্টন হবে-
‘যবীয়ান্ জ্যেষ্ঠভার্যায়াং পুত্রমুৎপাদয়েদ্ যদি।
সমস্তত্র বিভাগঃ স্যাদিতি ধর্মো ব্যবস্থিতঃ।।’
কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি মৃত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পত্নীতে পুত্রসন্তান উৎপাদন করে, তা হলে সেই পুত্রের এবং তার পিতৃব্যের মধ্যে সমান সমান বিভাগ হবে, এটিই ধর্ম ব্যবস্থা। (৯/১২০)।
দায়ভাগ বিধানের উপরোক্ত বণ্টনপ্রক্রিয়া মূলত পূর্বে ধনবিভাগকৃত সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। কিন্তু পূর্বে ধনবিভাগ না করেই যদি কোনও ভ্রাতার মৃত্যু হয়, তাহলে মনুর বিধান হচ্ছে-
‘ধনং যো বিভৃয়াদ্ ভ্রাতুর্মৃতস্য স্ত্রিয়মেব চ।
সোহপত্যং ভ্রাতুরুৎপাদ্য দদ্যাত্তস্যৈব তদ্ ধনম্।।’
(পূর্বে ধনবিভাগ না করেই) যদি কোনও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্ত্রী রেখে পুত্ররহিত অবস্থায় মারা যায় এবং ঐ মৃত ভ্রাতার বিভক্ত ধনসম্পত্তি যদি পত্নী রক্ষা করতে অসমর্থ হয়, কিন্তু কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি ঐ সম্পত্তি রক্ষা করে এবং ভ্রাতৃপত্নীকে পোষণ করে, তাহলে ঐ কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠভ্রাতৃজায়াতে পুত্রোৎপাদন পূর্বক জ্যেষ্ঠভ্রাতার সমস্ত সম্পত্তি ঐ পুত্রটিকে দেবে। (৯/১৪৬)।
এ সব কিছু মিলিয়ে মানে দাঁড়ালো একটাই, কোনভাবেই পারিবারিক সম্পত্তি তথা ক্ষমতা হাতছাড়া করা যাবে না, তাই যেকোনভাবে পুত্র চাই। পুত্রই পিতৃতন্ত্রের ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। প্রয়োজনে ভ্রাতৃজায়াতেও পুত্র উৎপাদন করিয়ে নেয়াটাকেও বৈধ করা হয়েছে পারিবারিক, সামাজিক তথা অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন হিসেবে। তাই অদ্ভুতভাবে এই বিশেষ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যৌনসম্পর্ককে কাম-নিরপেক্ষতার আবরণ দেয়া হয়েছে। কেননা কামজ হলেই সম্পত্তিতে অধিকাররহীনতার নির্দেশনা। ক্ষমতার এই কেন্দ্রিকতায় নারী কার্যকরভাবেই অনুপস্থিত। নারীর উপস্থিতি এখানে শুধু পুরুষের নৈতিক-অনৈতিক ইচ্ছার ক্রীড়নক হয়ে পুত্র উৎপাদনে ব্যবহৃত হওয়া। যদিও এই নৈতিক বা অনৈতিকতার মানদণ্ডও নির্ধারণ হয়েছে পিতৃতন্ত্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে, যা একান্তই উদ্দেশ্যমূলক ও আধিপত্যবাদী। তবে এখানেই শেষ নয়।
 .
মনুশাস্ত্রে যেহেতু পুরুষের একাধিক বিয়ের স্বীকৃতি বিদ্যমান, সেক্ষেত্রে একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান বিদ্যমান থাকলে আরো কিছু বিষয়ও এসে যুক্ত হয় তখন। এবং যদি তারা হয় একাধিক বর্ণের, তবে জটিলতা আরো বেড়ে যায়। ফলে বর্ণাশ্রমের মৌলিক নীতি অনুযায়ী অনিবার্যভাবেই স্ত্রীর জ্যেষ্ঠতা ও  বর্ণের স্তরভেদ অনুসারে উৎপাদিত সন্তানের উত্তরাধিকার বা সম্পত্তির মালিকানার বিষয় নির্ধারণ করা হয়-
‘সর্বং বা রিক্থজাতং তদ্দশধা পরিকল্প্য চ।
ধর্ম্যং বিভাগং কুর্বীত বিধিনানেন ধর্মবিৎ।।’
যা কিছু ধনসম্পত্তি আছে তা দশ ভাগ করে বিভাগধর্মজ্ঞ ব্যক্তি নিম্নলিখিত ব্যবস্থা অনুসারে ধর্মসঙ্গতভাবে বিভাগ করবেন। (৯/১৫২)।
.
‘চতুরোহংশান্ হরেদ্বিপ্রস্ত্রীনংশান্ ক্ষত্রিয়াসুতঃ।
বৈশ্যাপুত্রো হরেদ্ব্যংশমংশং শূদ্রাসুতো হরেৎ।।’
ব্রাহ্মণীর পুত্র চার অংশ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র তিন অংশ, বৈশ্যার পুত্র দুই অংশ এবং শূদ্রার পুত্র এক অংশ লাভ করবে। (৯/১৫৩)।
.
‘যদ্যপি স্যাত্তু সৎপুত্রো হ্যসৎপুত্রোহপি বা ভবেৎ।
নাধিকং দশমাদ্দদ্যাচ্ছুদ্রাপুত্রায় ধর্মতঃ।।’
ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত পুত্র বিদ্যমান থাকুক আর নাই থাকুক শূদ্রাস্ত্রীর পুত্রকে দশমাংশের বেশি দেবে না, এ-ই হলো ধর্মসঙ্গত ব্যবস্থা। (৯/১৫৪)।

একে তো কন্যাসন্তানের পিতৃ-সম্পত্তিতে অধিকার স্বীকৃতই হয় নি, তারপরও নারীর জন্মজাত বর্ণ-অবস্থানের ভিত্তিতে তার গর্ভজাত পুত্রের সম্পত্তি-অধিকারে বৈষম্য সৃষ্টি করে মূলত নারীকেই আরেক দফা নিবর্তনের শিকার করা হয়েছে। এই নিবর্তন হীনজাতীয়া হওয়ার কারণে শূদ্রা নারীর উপরই তীব্রতম। দ্বিজাতি পুরুষের শূদ্রাস্ত্রীর পুত্রকে কোন অবস্থাতেই দশমাংশের বেশি দেয়া যাবে না। আবার আরেক জায়গায় বলা হচ্ছে-
‘ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশ্যাং শূদ্রাপুত্রো ন বিক্থভাক্।
যদেবাস্য পিতা দদ্যাত্তদেবাস্য ধনং ভবেৎ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এদের শূদ্রা নারীর গর্ভজাত পুত্র ধনাদির অংশ পাবে না। তবে পিতা তাকে স্বেচ্ছায় ধনের যা দিয়ে যাবেন তা-ই তার ধন হবে- তাই তার ভাগস্বরূপ হবে। (৯/১৫৫)।
তবে শূদ্র পুরুষের ক্ষেত্রে যেহেতু প্রতিলোম বিবাহ অর্থাৎ উচ্চবর্ণের স্ত্রী গ্রহনের কোন সুযোগ নেই, তাই তার সন্তানাদির ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই কোন বৈষম্য আরোপ দেখা যায় না-
‘শূদ্রস্য তু সবর্ণৈব নান্যা ভার্যা বিধীয়তে।
তস্যা জাতাঃ সমাংশাঃ স্যুর্যতি পুত্রশতং ভবেৎ।।’
শূদ্রের কিন্তু একমাত্র সবর্ণা স্ত্রী-ই ভার্যা হবে, অন্য কোনও জাতীয়া ভার্যার বিধান নেই। কাজেই শূদ্রের সজাতীয়া পত্নীতে যে সব পুত্র জন্মাবে তারা সংখ্যায় একশ জন হলেও সকলেই পৈতৃক ধনসম্পত্তির অংশ সমান সমানই হবে। (৯/১৫৭)।

এভাবেই সমাজকর্তৃত্ব দারিদ্র্যসাম্যের ক্ষেত্রে যে উদার থাকে, তা হয়তো ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্বের প্রতি যেখানে কেউ হুমকিস্বরূপ হয় না সেখানেই। তবে সেখানেও কন্যাসন্তানের সম্পত্তির অধিকার প্রযোজ্য হয় না।
 .
পিতৃতন্ত্রে পুত্র যেমন ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতীক, একইভাবে পিতৃতন্ত্র কর্তৃক নারীকে ইচ্ছানুরূপ ভোগ ও ব্যবহারের প্রতীকও পুত্র। এই প্রতীকী অবস্থান প্রকাশমান হয় পুত্রকে পিতৃসম্পত্তির অধিকার বণ্টনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তাই উত্তরাধিকার নির্বাচন কেবল নারী-নিবর্তন ও বঞ্চনার ইতিহাসই নয়, একইসাথে নারী-নিবর্তনের বহুমাত্রিক চিহ্নায়কও। মোটকথা পুরুষকর্তৃক বহুভোগ্যা নারীকে ব্যবহারের মাত্রা, অবস্থান ও বৈচিত্র্যের প্রকার-প্রক্রিয়ার উপর পুত্ররূপ ফলাফলের প্রকার-পরিস্থিতি বিবেচনাকে গ্রাহ্য করেই উত্তরাধিকার প্রদানের উদ্দেশ্যমূলক প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে। এটাই নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের স্পষ্টরূপ আধিপত্য ঘোষণা। এটা পিতৃতন্ত্রের বদমায়েশিকে নারীর উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া হলেও কোনও লুকোছাপের বিষয় হয়নি। আর এই নির্লজ্জ ঘোষণা বলবৎ হয় উৎপাদিত পুত্রের জাতিবাচক নামকরণ কিংবা প্রকার নির্দেশের মাধ্যমে। ভিন্ন বর্ণের অনুলোম-প্রতিলোম সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট বিভিন্নরকম সন্তানের বহুধরনের নামকরণ মনুসংহিতায় রয়েছে যাদের অধিকাংশই অস্পৃশ্য বা চণ্ডাল শ্রেণীভুক্ত, যাদেরকে পুত্র বলেই স্বীকার করা হয় না। তবে মনুশাস্ত্রে সম্পত্তি বণ্টনার্থে দ্বাদশ প্রকার পুত্রের উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর মধ্যে কারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, কারা হবে না তাও নির্দেশ করা হয়েছে-

‘ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব দত্তঃ কৃত্রিম এব চ।
গূঢ়োৎপন্নোহপবিদ্ধশ্চ দায়াদা বান্ধবাশ্চ ষট্।।’
ঔরস (সমানবর্ণা ভার্যাতে নিজের উৎপাদিত পুত্র- legitimate son of the body), ক্ষেত্রজ (সমাণবর্ণা ভার্যাতে অন্য ব্যক্তির দ্বারা উৎপাদিত পুত্র- son begotten on a wife of another), দত্তক (অন্যের পুত্রকে নিজ পুত্র হিসেবে গ্রহণ- adopted son), কৃত্রিম (মাতাপিতাহীন বালক, যাকে কেউ টাকা-জমি প্রভৃতির লোভ দেখিয়ে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছে- a son made), গূঢ়োৎপন্ন (স্বামীর ভার্যাতে সজাতীয় অজ্ঞাত পুরুষকর্তৃক উৎপন্ন পুত্র- son secretly born), এবং অপবিদ্ধ (যে পুত্র মাতা-পিতাকর্তৃক পরিত্যক্ত এবং অন্যের দ্বারা পুত্ররূপে গৃহীত- a son cast off)- এই ছয় প্রকারের পুত্র গোত্র-দায়াদ এবং বান্ধব (অর্থাৎ এরা সপিণ্ড ও সগোত্রদের শ্রাদ্ধতর্পণ করতে পারে এবং গোত্রধারী ও ধনাধিকারীও হয়- six heirs and kinsmen)। (৯/১৫)।
 .
‘কানীনশ্চ সহোঢ়শ্চ ক্রীতঃ পৌনর্ভবস্তথা।
স্বয়ংদত্তশ্চ শৌদ্রশ্চ ষডদায়াদবান্ধবাঃ।।’
কানীন (অবিবাহিতা নারীর পুত্র- son of an unmarried damsel), সহোঢ় (বিবাহের আগে যে নারী অন্তঃসত্ত্বা হয় সে যে পুত্রকে বিবাহের সময়ে সঙ্গে নিয়ে আসে- son received with the wife), ক্রীত (যে পুত্রকে তার পিতা-মাতার কাছ থেকে ক্রয় করে পুত্র করা হয়- the son bought from his parents), পৌনর্ভব (পুনর্ভূ অর্থাৎ পুনর্বিবাহিত স্ত্রীলোকের সন্তান- son begotten on a re-married woman), এবং শৌদ্র (দ্বিজের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত পুত্র- the son of a sudra female)- এই ছয় প্রকার পুত্র গোত্র-দায়াদ নয়, কেবল বান্ধব অর্থাৎ শ্রাদ্ধপিণ্ডাদির অধিকারী হয় মাত্র, ধনাধিকারী নয়। (৯/১৬০)।
সাধারণভাবে ঔরসপুত্রই পিতৃসম্পদে অধিকারী হয়। অন্য পুত্রদেরকে দেয়া হয় মূলত পাপ-পরিহারের কারণে-
‘এক এবৌরসঃ পুত্রঃ পিত্র্যস্য বসুনঃ প্রভুঃ।
শেষাণামানৃশংস্যার্থং প্রদদ্যাত্তু প্রজীবনম্।।’
একমাত্র ঔরসপুত্রই পিতার ধনসম্পত্তির অধিকারী হবে। তবে পাপ পরিহারের জন্য অর্থাৎ না দিলে পাপ হবে বা নিষ্ঠুরতা হবে- এই কারণে সেই ঔরসপুত্র অন্যান্য পুত্রগণের গ্রাসাচ্ছাদানের উপযোগী ধনদানের ব্যবস্থা করবে। (৯/১৬৩)।

অর্থাৎ পিতৃতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের পুত্র উৎপাদনে পাপ বা নিষ্ঠুরতা নেই। যদিও পুরুষের এমন উদার মনও কানীন পুত্রের সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতাই পালন করে। তবে চূড়ান্তভাবে এও বলা হচ্ছে-
‘সর্বাসামেকপত্নীনামেকা চেৎ পুত্রিণী ভবেৎ।
সর্বাস্তাস্তেন পুত্রেণ প্রাহ পুত্রবতীর্মনুঃ।।’
একই ব্যক্তির বহু পত্নী থাকলে তাদের মধ্যে একজনও যদি পুত্রবতী হয়, তাহলে ঐ পুত্রের দ্বারা অন্যান্য সকল পত্নী পুত্রবতী বলে পরিগণিত হবে অর্থাৎ তারা আর দত্তক-পুত্র নিতে পারবে না। -এ কথা মনু বলেছেন। (৯/১৮৩)।

এদ্বারা প্রকারান্তরে পুরুষকে তার যোগ্য উত্তরাধিকারী উৎপাদনের লক্ষ্যে পুনর্বিবাহের কথাই নির্দেশ করা হচ্ছে। সেই উত্তরাধিকারী হবে পিতৃতন্ত্রেরই সুযোগ্য রক্ষক। নইলে পিতৃতন্ত্র কতোটা নির্দয় মমতাশূণ্য হতে পারে তার আরেকটি নমুনা হচ্ছে-
‘অনংশৌ কীবপতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা।
উন্মত্তজড়মূকাশ্চ যে চ কেচিন্নিরিন্দ্রিয়াঃ।।’
কীব, পতিত (outcastes), জন্মান্ধ, জন্মবধির, উন্মত্ত, জড়-অর্থাৎ বিকলান্তঃকরণ, বর্ণের অনুচ্চারক মূক এবং ঐরকম কাণা প্রভৃতি বিকলেন্দ্রিয় ব্যক্তি- এরা কেউই পিতার ধনসম্পত্তির অংশভাগী হবে না। (৯/২০১)।
.
‘সর্বেষামপি তু ন্যায্যং দাতুং শক্ত্যা মনীষিণা।
গ্রাসাচ্ছাদনমত্যন্তং পতিতো হ্যদদদ্ভবেৎ।।’
তবে যারা রিক্থভাগী অর্থাৎ ধনসম্পত্তি লাভ করবে, তারা সুবিবেচনাপূর্বক যথাশক্তি ঐ সব ক্লীব প্রভৃতিকে যাবজ্জীবন গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করবে- তা না করলে তার পতিত হবে। (৯/২০২)।
পিতৃতন্ত্রে নারীকেও হয়তো এই সমান্তরালেই বিবেচনা করা হয়েছে।
 .
করুণার ধন স্ত্রীধন
পিতৃসম্পদে নারীর কোন উত্তরাধিকার নেই। কিন্তু যে ধনটুকুতে নারীর অধিকার স্বীকৃত তা হচ্ছে স্ত্রীধন। তবে এটা এমনই ধন যা নারীর প্রতি করুণার ধনই বলা যায়। মনুশাস্ত্রে ছয় ধরনের স্ত্রীধনের উল্লেখ রয়েছে, যা বণ্টনেও জটিলতা রয়েছে-
‘অধ্যগ্ন্যধ্যাবাহনিকং দত্তঞ্চ প্রীতিকর্মণি।
ভ্রাতৃমাতৃপিতৃপ্রাপ্তং ষড়বিধং স্ত্রীধনং স্মৃতম্।।’
স্ত্রীধন ছয় প্রকার- অধ্যাগ্নি, অধ্যাবাহনিক, প্রীতিদত্ত, ভ্রাতৃদত্ত, মাতৃদত্ত ও পিতৃদত্ত। অধ্যাগ্নি-স্ত্রীধন হলো বিবাহকালে পিতাপ্রভৃতিদের দ্বারা দত্ত ধন, অধ্যাবাহনিক ধন হলো পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে নিয়ে আসার সময় যে ধন লব্ধ হয়, প্রীতিদত্ত ধন হলো রতিকালে বা অন্যসময় পতি কর্তৃক প্রীতিপূর্বক যে ধন স্ত্রীকে প্রদত্ত হয়। (৯/১৯৪)।

এই স্ত্রীধনের মালিক স্ত্রী হলেও সামাজিক বাস্তবতা হচ্ছে তা সাধারণভাবে স্বামীর রক্ষণাবেক্ষণেই থাকে এবং প্রকৃতপক্ষে স্বামীই তা ভোগ করে। যদিও তা ভোগ করার ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি নেয়ার নৈতিক দায়িত্ব থাকে, বাস্তবে তা পালিত হয় না।
এই স্ত্রীধন রেখে স্ত্রীর মৃত্যু হলে তা বণ্টনেরও একটি নির্দেশিকা রয়েছে-
‘অন্বাধেয়ঞ্চ যদ্দত্তং পত্যা প্রীতেন চৈব যৎ।
পত্যৌ জীবতি বৃত্তায়াঃ প্রজায়াস্তদ্ধনং ভবেৎ।।’
বিবাহের পর পিতা, মাতা, স্বামী, পিতৃ-কুল এবং ভর্তৃকুল থেকে লব্ধ যে ধন তাকে সাধারণভাবে ‘অন্বাধেয়’ বলা হয়। স্ত্রীলোকের ‘অন্বাধেয়’ ধন এবং তার পতিকর্তৃক তাকে প্রীতিপূর্বক প্রদত্ত যে ধন তা-ও স্বামীর জীবদ্দশায় স্ত্রীলোকের মৃত্যু হলে তার সন্তানেরা পাবে। (৯/১৯৫)।

এই সন্তান বলতে এই স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র ও অবিবাহিতা কন্যারা সমান ভাগ প্রাপ্য (৯/১৯২)। আর তার বিবাহিত কন্যার যদি অবিবাহিত কন্যা অর্থাৎ অবিবাহিতা দৌহিত্রী থাকে তাদেরও মাতামহীর ধন থেকে কিছু কিছু অংশ দিয়ে সম্মানিত ও সন্তুষ্ট রাখতে (৯/১৯৩) বলা হয়েছে। কিন্তু নিঃসন্তান অবস্থায় স্ত্রীধন রেখে কোন স্ত্রীলোক মারা গেলে-
‘ব্রাহ্মদৈবার্ষগান্ধর্বপ্রাজাপত্যেষু যদ্বসু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং ভর্তুরেব তদিষ্যতে।।’
ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, গান্ধর্ব ও প্রাজাপাত্য- এই পাঁচপ্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তার সবই কোনও স্ত্রীলোক নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার স্বামীই পাবে। (৯/১৯৬)।
.
‘যৎ তস্যাঃ স্যাদ্ধনং দত্তং বিবাহেষ্বাসুরাদিষু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং মাতাপিত্রোস্তদিষ্যতে।।’
আসুর, রাক্ষস ও পৈশাচ- এই তিন প্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তা রেখে কোনও স্ত্রীলোক যদি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যায় তাহলে ঐ ধনে ঐ স্ত্রীর মাতার প্রথম অধিকার, কিন্তু মাতার মৃত্যু হলে পিতা অধিকারী হয়। (৯/১৯৭)।
মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক উত্তরাধিকারে নারীর কোন অধিকার না থাকায় এই করুণালব্ধ স্ত্রীধন যে আসলে একধরনের ভিক্ষালব্ধ ধনই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সামাজিক বাস্তবতা হচ্ছে, এই সামান্য ধনও আসলে স্ত্রী ভোগ করে যেতে পারে না। এজন্যেই হয়তো মৃত্যুপরবর্তী তা বণ্টনের নির্দেশনা মনুশাস্ত্রে দেখা যায়। তাছাড়া স্মৃতিশাস্ত্র নির্দেশিত বিধানে স্ত্রীর কোন আলাদা সত্তাই থাকে না-
‘ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ ত্রয় এবাধনাঃ স্মৃতাঃ।
যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ ধনম্।।’
স্মৃতিকারগণের মতে, ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম (বিকল্পপাঠ- অধন); এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে, তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে। (৮/৪১৬)।

অতএব, চূড়ান্ত বিচারে নারী কোন ধন-সম্পদেরই অধিকারী হতে পারে না। কেননা সে নিজেই ভোগ্যা, পিতৃতন্ত্রের উপাদেয় ভোগ-সামগ্রি। ব্যবহার্য ধন সে অন্যের ব্যবহার্য ধন মাত্র, কিছুতেই নিজেরও নয়। এবং এভাবেই পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার বলয়ে কুক্ষিগত নারী শেষপর্যন্ত নারীই থেকে যায়, মানুষ হতে পারে না।
 .
অতঃপর নারী অধিকার ও সামাজিক প্রেক্ষিত
সমাজের অনিবার্য অংশ হয়েও যৌক্তিক সামাজিক ক্ষমতার অধিকার থেকে যাবতীয় নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারীকে বিতাড়ণের গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছে পুরুষ তার পিতৃতান্ত্রিক হাতিয়ার তথা ধর্মশাস্ত্র নাম দিয়ে কতকগুলো বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক শাসনতান্ত্রিক অনুশাসন সৃষ্টির মাধ্যমে। আর এই ধর্মসৃষ্টির হোতা যে পুরুষই, এসব ধর্মশাস্ত্রে কথিত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টার পুরুষপ্রকৃতি এবং নারীকে পুরুষকর্তৃক ভোগ-ব্যবহারের উদগ্র প্রকাশই এর প্রমাণ। কোন অলৌকিক ঈশ্বরের চিন্তারাজিতে তাঁর সৃষ্টি বিষয়ক বিষয়বস্তু নিয়ে এতোটা অরুচিকর অবনমন ও বৈষম্য অচিন্তনীয়। বৈদিক ধর্মে মনুসংহিতা হচ্ছে এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এবং পরবর্তীকালের সৃষ্ট ও প্রচলিত অন্য ধর্মকাঠামোগুলোও মনে হয় তারই আরেকটু উৎকর্ষ ও বিবর্তিত প্রতিরূপ মাত্র। এর মাধ্যমেই তথাকথিত ধর্মশাস্ত্র সৃষ্টির পূর্বের নারী আর পরবর্তীকালের ধর্মপ্রবাহে নারীর অবস্থার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায় শাস্ত্র-নির্দেশিত অনুশাসনগুলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে। অর্থাৎ পরবর্তীকালের এই নারী সম্পূর্ণই পুরুষের ইচ্ছার প্রতীক এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজসৃষ্ট, যাকে মনুসংহিতার মতো কথিত শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে বৈধরূপে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই নারীর প্রকৃত অন্তর্জগত আর পুরুষসৃষ্ট এই সামাজিক নারীতে আরোপিত জগত কখনোই এক নয়। পুরুষের ক্ষমতার বলয়ে বন্দী নারীর নিজস্ব ঐ জগতটা শেষপর্যন্ত একান্ত গোপন ও সুপ্তই রয়ে গেছে। তাকে কখনোই বাইরে আসতে দেয়নি পুরুষ, সেই জগতটিকে অস্বীকারের মাধ্যমে। আর যে আক্রান্ত নারীটিকে ইচ্ছার বর্বরতা দিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়েছে পুরুষ, সেটাই বহিঃবাস্তবের সামাজিক নারী। এ নারী আসলে এক কল্পিত নারীই, যে কিনা পুরুষের অসভ্য মনের মাধুরি মেশানো প্রতিকৃতি। তাই নারীর মুক্তি মানে এই অসভ্য ক্ষমতার কবল থেকে মানবিক নারীসত্তার মুক্তি। অবগুণ্ঠিত অন্তর্জগতের ঘেরাটোপ থেকে মানুষ হিসেবে বাইরে বেরিয়ে আসার অধিকারই নারী-অধিকার। যেখানে সে তার মুক্তির আনন্দে নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠবে। কিন্তু মানবিক বোধ বর্জিত পিতৃতন্ত্র কি কখনো হতে দেবে তা ?
 .
পিতৃতন্ত্রের সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি হচ্ছে তার ধর্মজাগতিকতা, কাল্পনিক ঐশিকতায় অপ্রমাণিত এক পারলৌকিক জগত তৈরি করে যেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের শাসনতান্ত্রিক সুতোটাকে ধরে রেখেছে। এটাই তার ক্ষমতার উৎস, যা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। এবং এই ক্ষমতাই তার অস্তিত্ব। এখানে সামান্য আঁচরটুকু পড়তে গেলেই, কিংবা সামান্যতম আঁচর লাগার কোন কল্পিত সম্ভাবনা তৈরি হলেও সে মারমুখি হয়ে ওঠে। দেশীয় প্রেক্ষাপটে বা বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলোর উগ্রবাদী ক্রিয়াকলাপ এই রেশই বহন করছে। অতএব, নারী-পুরুষের সমতা বিধান তথা সার্বিক সামাজিক মঙ্গলবিধানের উপায় খুঁজতে হলে এক চিরায়ত মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার গত্যন্তর নেই বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সেই কল্যাণমূলক ক্ষমতায় উন্নীত করতে হবে, যাতে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের উপর নিবর্তনমূলক সবধরনের ধর্মীয় কুশাসন রাষ্ট্রীক ও সামাজিকভাবেই রদ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এজন্যে প্রথমেই দরকার রাষ্ট্র কর্তৃক সব ধরনের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা। ধর্ম যে আসলে কোন অলৌকিক বস্তু বা ধারণা নয়, তা মানুষেরই সৃষ্টি এবং সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যমূলক কূটভাবনার আর্থ-সামাজিক রূপই যে ধর্ম, এই বিজ্ঞান চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে মুক্তচিন্তাকে শানিয়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে হবে রাষ্ট্রকেই। আর এই উদ্যোগ নিতে হবে মুক্ত-চেতনায় বিশ্বাসী জনগোষ্ঠিকেই।
 .
এ প্রেক্ষিতে একটা বিষয় অনুধাবনযোগ্য যে, প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রগুলোয় উল্লেখকৃত সামাজিক আবহ আদতে দেড় থেকে দু’হাজার বছর বা তারও আগের সমাজকাঠামোয় সৃষ্ট। মনুসংহিতার নারী প্রতীকগুলোও সেই দু’হাজার বছর আগেরই প্রতিকৃতি। ইতোমধ্যে সমাজ বিকাশের সুদীর্ঘ ধারায় সভ্যতার বহু বহু পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধিত হওয়ার ফলে সেইসব শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সবগুলো এখন আর সামাজিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না বা তা প্রয়োগযোগ্যতায় নেই। এবং কালান্তরে এসে এগুলো অবিকল বা একেবারেই প্রয়োগ না করার কর্তৃত্বে একধরনের অধিকারবোধও রাষ্ট্রকাঠামোয় সংযোজিত হয়েছে। রাষ্ট্রের জনচেতনাও সেভাবেই বিকশিত হয়ে গেছে। তাই এমন ধারণা বদ্ধমূল করা মোটেও ঠিক নয় যে, রাষ্ট্র চাইলে সমস্ত ধর্মজাগতিকতাকে সরিয়ে তার জনমত প্রভাবিত করে কোন জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না। রাষ্ট্র চাইলে অবশ্যই তা পারে। এজন্যেই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এ প্রেক্ষিতে যেকোন ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বর্জনের সপক্ষে মানবিক চেতনাসম্পন্ন নাগরিকদের একাট্টা হওয়া জরুরি। তার জন্যে দরকার মুক্তচিন্তা প্রকাশের অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা। এটা নিশ্চিত করা না গেলে বাকি অর্জনগুলোও সুদূরপরাহতই থেকে যাবে। এবং নারীর অধিকার একটা অধরা কাল্পনিক বিষয় হয়েই থাকবে।
 .
অতএব, যে মাতৃ-নারীর গর্ভ থেকে উৎপন্ন পুরুষ, আমৃত্যু মঙ্গলকামী সুহৃদ হিসেবে যে প্রিয়তমাকে সাথে নিয়ে গোটা জীবন পারি দেয় পুরুষ, এবং যে অপত্যস্নেহে কন্যাশিশুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে পিতৃবাৎসল্যে ঝলমল করে ওঠতে পারে একজন পুরুষ, সেই নারীকে কোন মানবিক পুরুষ নিজের মতো মানুষ হিসেবে ভাবতে না পারার কোন কারণ কি থাকতে পারে ! যে পুরুষ তা ভাবতে পারে না, সে মানুষ হতে পারে না। আর মানুষ হতে না-পারা অমানুষের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী এবং মানুষের স্বপ্নময় জীবন নষ্ট হয়ে যাবে, তা কি আদৌ কাম্য কারো ?
 .
তথ্য সহায়তা:
১. ঋগ্বেদ-সংহিতা /অনুবাদ রমেশচন্দ্র দত্ত /প্রথম প্রকাশ, জুন ১৯৭৬, কলকাতা।
২. মনুসংহিতা /সম্পাদনা মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় /সুলভ সংস্করণ, বইমেলা ১৪১২, কলকাতা।
৩. ভারতীয় দর্শন /দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় /পঞ্চম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০৭, কলকাতা।
৪. ভারতীয় শাস্ত্রে নারীকথা /সিরাজ সালেকীন /প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১০, ঢাকা।
৫. অবমুক্ত গদ্যরেখা /রণদীপম বসু /প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১১, ঢাকা।

No comments: