| আলগা প্যাঁচাল-০৫ | রবিবারে আসেন… |
-রণদীপম বসু
…
অন্তর্জালিক উন্মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার সংরক্ষণে নাকি আমাদের দেশের সরকারি দপ্তর-অধিদপ্তরের পরিচয়বাহী ভবনগুলোর প্রয়োজনীয় ও ব্যবহারযোগ্য ছবি খুব একটা নেই। শিক্ষিত সচেতন জনগোষ্ঠির জন্য এরকম তথ্য নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক। এই ঘাটতি পূরণের আইডিয়া হিসেবে সবাইকে এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী উইকিপিডিয়ান মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন একটা ফটোওয়াক করে ফেলবেন। এটার নাম হবে ‘উইকি ফটো ওয়াক’। যেই কথা সেই কাজ। কিন্তু একটা গ্রুপের দ্বারা তো আর গোটা ঢাকা নগরী দ্রুত কাভার করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এলাকা, অবস্থান, যোগাযোগ, পথ-ঘাট ইত্যাদি চেনা-জানা বা অবগত না থাকলে দেখা যাবে কাজের চেয়ে অকাজের হাঁটাটাই সার হবে। তাই সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে যে অঞ্চলে যে বসবাস করছে সেরকম পাশাপাশি কয়েকজন মিলে একেকটা এলাকা কাভার করাটাই অধিক ফলপ্রসূ হতে পারে।
.
উল্লেখ্য,
উইকি নিয়ে কথা বলছি বলে আবার আমাকে উইকিপিডিয়ান ভাবার কারণ নেই। আমি
কিন্তু কোনোভাবেই উইকিপিডিয়ান নই বা নিজেকে উইকিপিডিয়ান দাবি করাটাও খুব
অন্যায্য ও অনৈতিক হবে। তবে রসকষহীন তরল আড্ডারু হিসেবে সময় সুযোগ থাকলে
যেমন যেকোনো আড্ডায় হাজির হয়ে যেতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ হয় না, তেমনি বয়সের
ব্যবধান উপেক্ষা করে যেকেউ আমাকে আমন্ত্রণ জানাতেও দ্বিধা করেন না আদৌ।
এভাবেই উইকিপিডিয়ান বন্ধুদের সাথে আমার কিছুটা সময়ের সান্নিধ্য পাওয়া বলা
যায়।
.
তো
যা বলছিলাম, ১৮ ডিসেম্বর তারিখের এক সকালে ন’টার দিকে ফটোওয়াক শুরু হলো
মিরপুর গোলচক্কর থেকে। যেহেতু আগারগাঁও বা শেরেবাংলা নগর এলাকাতেই বহু
সরকারি অফিস-আদালত রয়েছে, তাই আমাদের টার্গেট গোটা দিনে এই এলাকাটা কাভার
দেয়া। কিন্তু শুরুতেই যে সমস্যা দেখা দিলো তা হলো পাবলিক প্লেস থেকে অফিস
ভবনের ছবি উঠানোটাই রীতিমতো দুঃসাধ্য ! একে তো ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে
আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার নমুনা হচ্ছে এক চিলতে জমি ফাঁকা পড়ে থাকলে
পাবলিকের ধারণা, বুঝি বাতাস চলাচলের পথ দিয়ে সেই বাতাসের সাথে এসে কেউ
বাপদাদার জমিটা তুলে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে যেখানে কোথাও কোথাও কিছুটা ফাঁকা
জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই কাকতালীয়ভাবে সূর্যটা একেবারে লেন্সের সামনে
এসে চোখ টাটিয়ে সবকিছু অন্ধকার করে দিতে লাগলো। বেশ মুশকিলের কথা !
.
শুক্রবার
সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় অফিস অঙ্গনের ভেতরেও ঢোকা যাচ্ছে না। তাছাড়া
ক্যামেরাকে যে অনেকেই একটা মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে সেটাও
উপলব্ধি হলো উইকি ফটো ওয়াকে অংশ নিয়ে। যেন আমরা একেকজন খলনায়ক গিয়ে হাজির
হয়েছি ! দেখা গেলো, আধঘণ্টা ধরে উইকিপিডিয়া কী তা বোঝানোর পর যখন বলা হলো
উইকির জন্য ভবনের ছবি তুলবো, তখনই সেই অফিস সংশ্লিষ্ট একেকজনের ভাব-ভঙ্গি
চেহারাই পাল্টে যায় ! ভাবখানা এমন যে, এই ছবি তোলার কারণে অফিসটা একেবারে
তোলপাড় হয়ে যাবে, এবং একটা ছবির ধাক্কায় লোকগুলোর এতোকালের চাকরিটাই বুঝি
চলে যাবে ! মাত্রাতিরিক্ত এসব মূর্খতা দেখে নিজে নিজেই বিব্রত হয়ে পড়ি। এই
অর্থহীন মনস্তাত্ত্বিক ভয়ের কারণ খুঁজে পাই না। ভাবতে ভালো লাগে না যে,
হয়তো এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন অন্যায় বা অবৈধ কর্মতৎপরতার সূত্র লুকিয়ে
আছে। এই অফিসগুলোর ভেতরের স্বাস্থ্য ও কর্মকাণ্ডে এমন কী রহস্য লুকিয়ে আছে
যে, একটা ছোট্ট ক্যামেরার সামনে থেকে পারলে গোটা ভবনগুলোকেই এরা ঢেকে
রাখতে চায় ? এই স্বাধীন দেশে এমন অদ্ভুত মানসিকতা সৃষ্টির কারণ অবশ্যই
খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে হয়।
.
যাক্,
আগারগাঁওয়ের আবহাওয়া অধিদপ্তর না কি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র যেন, গেটের
গ্রিল দিয়ে উঁকিঝুকি মারতেই কর্তব্যরত প্রহরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি এগিয়ে
এলো। গলায় ঝুলানো উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবক কার্ড দেখিয়ে বললাম- খুলেন।
আমাদের কারো হাতে ক্যামেরা নেই তখন, ব্যাগের ভেতরে রাখা। গেটটা একটু ফাঁক
করতেই সরসর করে ঢুকে পড়লাম। এরকম ক্ষেত্রে এরপর কী হয় সে অভিজ্ঞতা তো
ইতোমধ্যে হয়েই গেছে। তাই আমাদের একজন তাঁদেরকে বেশ গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে
উইকিপিডিয়া কী তা বুঝানোর নিষ্ফল উদ্যোগ নিলো। আর এই ফাঁকে আমি সময় নষ্ট না
করে এগিয়ে গিয়ে ভবন ও তার নির্মাণশৈলী ক্যামেরাবন্দী করতে লেগে গেলাম। এবং
প্রায় সাথে সাথে হৈ হৈ করতে করতে তাদের অন্য লোকটি চেঁচাতে চেঁচাতে চলে
এলো- ‘না না ! এখানে ছবি উঠানো যাবে না !’
কেন ? আমি তাঁর দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলাম।
‘আগে অনুমতি নিতে হবে !’
চলেন, কার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে ?
‘আজকে না, অফিসের দিনে আসেন, রবিবারে !’
সেদিন তো আমারও অফিস আছে ! আমরাও তো ভাই আজাইরা লোক না, আপনাদের মতো চাকরিজীবীই ! ছুটির দিন হওয়ায় স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজটা করতে এসেছি।
‘না না, অনুমতি ছাড়া আপনারা কোনো ছবি ওঠাতে পারবেন না !’- বলেই অনবরত ক্লিক করে যাওয়া আমার হাতের ক্যামেরাটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
তাঁর ভাব বুঝে অনেকটা অনুমতি নেয়ার স্বরে বললাম- এতো কষ্ট করে এলাম, মাত্র একটা ছবি ওঠাই ?
আমার কথায় মনে হলো যেন একটু আস্বস্ত হলো। বললো- ‘সরি, আগে অনুমতি নিয়ে তারপরে আসবেন !’
কিভাবে ?
‘বললাম না, রবিবারে আসেন !’
কেন ? আমি তাঁর দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলাম।
‘আগে অনুমতি নিতে হবে !’
চলেন, কার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে ?
‘আজকে না, অফিসের দিনে আসেন, রবিবারে !’
সেদিন তো আমারও অফিস আছে ! আমরাও তো ভাই আজাইরা লোক না, আপনাদের মতো চাকরিজীবীই ! ছুটির দিন হওয়ায় স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজটা করতে এসেছি।
‘না না, অনুমতি ছাড়া আপনারা কোনো ছবি ওঠাতে পারবেন না !’- বলেই অনবরত ক্লিক করে যাওয়া আমার হাতের ক্যামেরাটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
তাঁর ভাব বুঝে অনেকটা অনুমতি নেয়ার স্বরে বললাম- এতো কষ্ট করে এলাম, মাত্র একটা ছবি ওঠাই ?
আমার কথায় মনে হলো যেন একটু আস্বস্ত হলো। বললো- ‘সরি, আগে অনুমতি নিয়ে তারপরে আসবেন !’
কিভাবে ?
‘বললাম না, রবিবারে আসেন !’
.
খুব
হতাশার ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসতে আসতে যথেষ্ট ক্ষোভ দেখিয়ে বললাম- এখানে কি
অনেক দুই-নম্বরি হয় ? নইলে ভবনের ছবি তুললে আপনারা এতো ভয় পান কেন ?বলে ফেললাম ঠিকই, কিন্তু মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখার ফুরসৎ তখন আমাদের হাতে নেই…।
(১৮-১০-২০১১)
…
No comments:
Post a Comment