Friday, October 21, 2011

| আলগা প্যাঁচাল-০৬ | এইটা ঠিক না !


| আলগা প্যাঁচাল-০৬ | এইটা ঠিক না !
-রণদীপম বসু

আশেপাশে সিটি কর্পোরেশানের টানানো বৈদ্যুতিক লাইন থাকায় বাড়ন্ত ডালপালা ছেটে ঠুটু বানিয়ে রাখা হলেও তরুণ বটগাছটার গোড়ায় চারদিক ঘিরে বাঁধানো গোল বেদীটা চওড়া ফুটপাথের মধ্যে চমৎকার একটা আবহ তৈরি করে রেখেছে। হাঁটুরে পথিকদের জন্য বা অপেক্ষমান ড্রাইভার-রিক্সাচালকদের জন্য এই বেদীটার মতো এমন আরামের ছায়াময় বিশ্রামস্থল আশেপাশে আর না থাকায় মিরপুর জিপিও গেটের এই কোণাটা অফিস কর্মদিবসে সারাক্ষণই সরগরম থাকে এবং একে ঘিরে কিছু খুচরা ভ্রাম্যমান টং-দোকানও বেশ জমে ওঠে। খুব নিকটবর্তী দূরত্বে গ্রামীণ ব্যাংক, হার্ট ফাউন্ডেশন, ওএসবি চক্ষু হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশন, মিরপুর কলেজ, ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয়, সর্বোপরি মিরপুর জেনারেল পোস্ট অফিস ইত্যাদি বহুল পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থিতির সুবাদে এখানে শিক্ষিত সচেতন লোকদের আনাগোনা এমনিতেই বেশি থাকে। ফলে অফিস আওয়ারে এই বটের বেদীটাতে বসার জায়গা পাওয়াই ভার। কিন্তু আজকের প্যাঁচাল অন্য বিষয়ে।


 .
বেদীটার পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম এক কলিগ বন্ধু সহ। বেশ কতকগুলো পাখির খাঁচাসহ এক পাখি বিক্রেতা এসে বেদীটার এক কোণায় বসলো। তাঁর সামনে মাটিতে রাখা খাঁচাগুলোর দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার কলিগটি হঠাৎ বলতে শুরু করলো-
.
 
.
“আমি তখন ময়মনসিংহে। উনিশশো পঁচানব্বই সালের দিকে। এইরকম এক গাছের তলায় এক গণক টিয়া পাখি দিয়া ভাগ্য গণনা করতেছে। আমিও কৌতুহল নিয়া দাঁড়াইলাম। গণকের সামনে অনেকগুলা সারিবদ্ধ খাম মাটিতে বিছানো। তার পাশে একটা কাঠের খাঁচার মধ্যে দুইটা খোপে দুইটা টিয়া। বেশ কতজন লোক, মনে হয় ভাগ্য গণতে আসছে, গণক লোকটার সামনে কেউ দাঁড়াইয়া আছে কেউ বইসা আছে। এমন সময় যুবক বয়সের একটা ছেলে আইসা গণকটার সামনে হাতটা বাড়াইয়া ধরলো। ভাগ্য গণতে চায় আর কি ! ছোট্ট একটা লাঠির আগা দিয়া খোপের ভেতর থাইকা একটা টিয়া বাইর কইরা গণক লোকটা টিয়াটারে খামগুলা যেখানে সুন্দর সারিবদ্ধ করে বিছাইয়া রাখছে তার এক মাথায় ছাইড়া দিলো। টিয়াটাও খামগুলার উপর দিয়া হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা খামের কোণা কামড়াইয়া ধরলো। গণক লোকটা খামটা তুইলা আইনা ভিতর থাইকা একটা চিরকুট বাইর কইরা পড়তে লাগলো।
চিরকূটের বৈশিষ্ট্য হইলো, ভাগ্য সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত কথার পরে লেখা ‘বিস্তারিত জানতে ভলিউম এতো এর এতো নম্বর’। ছেলেটা সেইটাও বিস্তারিত জানতে চাইলো। বিস্তারিত জানতে হইলে রেট কিন্তু বিশ টাকা, গণক আগেই স্মরণ করাইয়া দিলো। নরমাল গণায় দশ টাকা। ছেলেটা সম্মতি দিলো। এইবার গণক লোকটা চিরকূটটা আগের খামের মধ্যে ভরে বিছানো খামগুলার মধ্যে ঢুকাইয়া রাখলো। এরপর তার পাশেই রাখা চাইর-পাঁচটা ভলিউম থাইকা এতো নম্বরটা বাইর কইরা পইড়া শুনাইলো। ছেলের তো মন ভরে না। সে আবার গণাইবো। গণক তারে মনে করাইয়া দিলো, রেট কিন্তু ডবল ! সেও রাজী।
পাখি আবার একটা খাম তুললো, চিরকূট বাইর কইরা পড়া হইলো। আবার সে বিস্তারিতও শুনতে চাইলো। ভলিউম বাইর কইরা তাও শুনানো হইলো। ছেলেটা আস্তে কইরা উঠে হাঁটা ধরলো। গণক তো হৈ চৈ শুরু করলো- আমার টাকা ! দুইবারে চল্লিশ টাকা। ছেলেটা আবার ফিরা আইলো। ‘বান্দীর পুত, ভগলামি ধরছো ! ওই মিয়া, মিনিটের মধ্যে আমার ভাগ্য উল্টাইয়া গেছে ! বেটা ধান্দাবাজ… !’ আরো যা তা বলতে লাগলো।
অবস্থা এমন দাঁড়াইলো যে এখন টাকার দরকার নাই, গণক চায় ছেলে বিদায় হউক, চল্লিশ টাকার সাথে তার ব্যবসাও তো যাইতে বসছে ! কাস্টমারও কমতে লাগছে। কিন্তু ছেলে তো আর যায় না, হা হা হা ! এই পাখিগুলা দেইখা আমার সেই স্মৃতিটা মনে পড়লো।”
.
 .
কলিগের স্মৃতিভ্রমণ শেষ হলে আমি বললাম, আসলে কে ঠিক ছিলো ? ছেলেটা ? না কি গণক ?
“আ-রে ! এইটা কি আর বলা লাগে ! টিয়ায় করে ভাগ্য গণনা ! একটু আগের ভাগ্য পরেরবারেই উল্টা ! ভণ্ডামি !”
কিভাবে বুঝলেন আপনি ?
“চোক্ষের সামনেই তো দেখলাম ! আপনে কি মশকরা করতেছেন ?”
এবার আমি সিরিয়াস হয়ে বললাম- না, মশকারি না। টিয়ে পাখি ওই ভাগ্যটা গণেছে বলে বিশ্বাস করলেন না ! টিয়ে কি ধান্ধাবাজি জানে ?
“আমি বলেছি নাকি টিয়ে ধান্ধাবাজি করছে ! টিয়েটাকে দিয়া ওই গণকটাই তো ধান্ধাবাজি করছে !”
বললাম, আচ্ছা, ওই গণকটি যদি টিয়ের বদলে একটা ধর্মগ্রন্থ আর কিছু তাবিজ নিয়ে বসতো ? তাহলে বিশ্বাস করতেন ?
এবার আমার অতিশয় ধার্মিক কলিগটি খুব সিরিয়াস হয়ে গেলেন- “আপনাদের বড় সমস্যা হইলো সবকিছু নিয়া আপনারা মশকরা করেন, এইটা ঠিক না !”
বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না তিনি।
(১৯-১০-২০১১)

No comments: