Friday, November 11, 2011

| বৌদ্ধদর্শন| পর্ব-৬/৪| সর্বাস্তিবাদ: সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক মত|


| বৌদ্ধদর্শন| পর্ব-৬/৪| সর্বাস্তিবাদ: সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক মত |
-রণদীপম বসু

(…আগের পর্বের পর)

৫.৩ : সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধ দর্শন : সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক মত (Buddhism: Soutrantik-Boibhashik
.

সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক মত হচ্ছে হীনযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত সর্বাস্তিবাদের দু’টি রূপ। এই দুই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব সর্বাস্তিবাদে এবং উভয়ের প্রাচীন নাম ছিলো সর্বাস্তিবাদ, যাঁরা হীনযান বৌদ্ধের আঠারোটি প্রাচীন সম্প্রদায়ের অন্যতম। বুদ্ধের পরিনির্বাণের (৪৮৩ খ্রীষ্টপূর্ব) পরবর্তী চার বা পাঁচ শতক ধরে এই সর্বাস্তিবাদ বিকশিত ও পরিপুষ্ট হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। ‘সর্বাস্তি’ নামের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘সবকিছু আছে’, মানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত বা অনাগত এই তিন কালেই সমস্ত কিছু বিদ্যমান এরূপ ধারণা। সর্বাস্তিবাদ সম্প্রদায়টি বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে প্রভাব বিস্তার করেছিলো।


.
৫.৩.১ : সৌত্রান্তিক মত : বাহ্যানুমেয়বাদ
.
বৌদ্ধদর্শনে বিনয়পিটক, সূত্তপিটক এবং অভিধম্মপিটক- এই তিনটি গ্রন্থকে একত্রে ত্রিপিটক বলা হয়। এর মধ্যে সৌত্রান্তিক দার্শনিকরা সূত্তপিটকের প্রামাণ্য ও গুরুত্ব স্বীকার করেন বলে তাদেরকে সৌত্রান্তিক নামে আখ্যায়িত করা হয় বলে মনে করা হয়। আর্যস্থবিরকে সৌত্রান্তিক মতের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। কণিষ্কের (৭৮-১৪৪ খ্রী.) রাজত্বকালে কাশ্মীরে ধর্মোক্ত নামক স্থবির এই মতের সমর্থক ও বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তবে অনেকের মতে, নাগার্জুনের সমসাময়িক খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে সর্বাস্তিবাদের আচার্য কুমারলব্ধ (কুমারলাত) এবং তাঁর শিষ্য হরিবর্মণ এই নতুন সৌত্রান্তিক মতবাদের প্রবর্তক। এছাড়া যশমিত্র তাঁর অভিধর্মকোশ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সৌত্রান্তিক মত সমর্থন করেন।
.
সৌত্রান্তিকরা অভিধর্ম ও বিভাষা গ্রন্থগুলিকে প্রামাণিক বলে স্বীকার না করে তাঁরা বলেন, বুদ্ধের বাণী সম্যক উপলব্ধি করতে হলে বুদ্ধের প্রচারিত মূল সূত্রগ্রন্থগুলির শরণ নিতে হবে। কেননা ওই সূত্তপিটকেই শুধু বুদ্ধের নিজের মুখনিঃসৃত বাণী রয়েছে। কুমারলব্ধের প্রণীত কোন মৌলিক গ্রন্থের খোঁজ আজো পাওয়া যায় নি, তবে হরিবর্মণের প্রণীত ‘সত্যসিদ্ধিশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থের মূল বিলুপ্ত হলেও খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে চীনাভাষায় অনূদিত গ্রন্থ পাওয়া যায়। মূলত সূত্রপিটককে আশ্রয় করেই সৌত্রান্তিক মত গড়ে ওঠেছে।
.
সৌত্রান্তিক দর্শনকে সর্বাস্তিবাদ বলা হয় এজন্যে যে, তাঁদের মতে বাহ্যজগৎ ও মনোজগৎ উভয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। এই বাহ্যবস্তু ক্ষণিক অর্থাৎ একটিমাত্র ক্ষণের জন্য স্থায়ী এবং সেজন্যেই বাহ্যবস্তু হলো সৎবস্তু। কোন বাহ্যবস্তুরই চিরন্তন সত্তা নেই।
.
কিন্তু সৌত্রান্তিক মতে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা যায় না, অনুমানের দ্বারা জানা যায়। এই মতানুসারে বাহ্যবস্তুর জ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞান নয়, কিন্তু তার জ্ঞান প্রতিচ্ছবির জ্ঞান। সৌত্রান্তিকের মতে বুদ্ধি দর্পণস্থানীয়। দর্পণে যেভাবে বাহ্যবস্তু প্রতিবিম্বিত হয় সেভাবে আমাদের বুদ্ধিরূপ দর্পণে প্রতিবিম্বিত বিষয়ই আমাদের প্রত্যক্ষ হয়। এ প্রতিবিম্বদর্শনে আমরা সমস্ত বিষয়ের অনুমান করি। বস্তুত বাহ্যবস্তু বা বিষয় আমাদের কখনো প্রত্যক্ষ হয় না। আবার ঐ বিষয়ের সত্তা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কেননা বিম্ব না থাকলে প্রতিবিম্ব সম্ভব হতে পারে না। অতএব যা আমাদের প্রত্যক্ষ হয় তা বাহ্য বিষয় দ্বারা সমর্থিত বুদ্ধির আকারবিশেষ এবং তা বুদ্ধিগত।
.
সৌত্রান্তিক মতে বাহ্যবস্তু হলো স্বলক্ষণ, তা সামান্যলক্ষণ নয়। যা স্বলক্ষণ তা ক্ষণিকমাত্র। যা ক্ষণিক তা প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায় না। বাহ্য বিষয়ের জ্ঞানোৎপত্তি প্রক্রিয়া হচ্ছে, প্রথমক্ষণে বিষয়ের দ্বারা ইন্দ্রিয় উদ্দীপিত হলে তার পরক্ষণে প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু যেহেতু বিষয় ক্ষণিক, সেহেতু প্রথম ক্ষণে ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করেই বিষয়টি বিনষ্ট হয়। যেহেতু বিষয়টি ধ্বংস হয়ে যায়, সেহেতু দ্বিতীয়ক্ষণে যখন প্রত্যক্ষটি উৎপন্ন হয় তখন বিষয়টির অস্তিত্ব থাকে না। বিষয়টি প্রত্যক্ষকালে না থাকলে তার প্রত্যক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে প্রশ্ন আসে, বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আমরা জানি কিভাবে ?
.
এক্ষেত্রে সৌত্রান্তিকরা বলেন, বাহ্যবস্তু সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা কখনোই সম্ভব নয়। তাকে জানতে হয় অনুমান দ্বারা। কিন্তু এই অনুমান কিভাবে প্রযুক্ত হয় ? এ বিষয়ে সৌত্রান্তিকদের বক্তব্য হলো, বাহ্যবস্তু তার একক্ষণের স্থায়িত্বকালে আমাদের মনকে উদ্দীপিত করে বিলীন হয়ে যায় এবং আমাদের মনে রেখে যায় ধারণা। এই ধারণাগুলিকেই আমরা সাক্ষাৎভাবে জানতে পারি। এই ধারণাগুলি হলো বস্তুর প্রতিলিপি। এটাই বাহ্যানুমেয়তা।
.
সৌত্রান্তিক মতবাদ অনুসারে, বাহ্য বিষয় পৃথক পৃথক আধারকে অবলম্বন করে উৎপন্ন হয় বলে প্রতিরূপ পৃথক পৃথক হয়। এদের ভিন্নতাকে অবলম্বন করে বাহ্য বিষয়ের ভিন্নতা অনুমান করা হয়। এভাবে বাহ্য বিষয়ের জ্ঞান উৎপন্ন হয়ে মানসিক আকার ধারণ করে। এজন্যেই এ মতবাদকে বাহ্যানুমেয়বাদ বলা হয়। এই মতবাদকে পরোক্ষ বস্তুবাদ (indirect realism) বা প্রতিরূপী বস্তুবাদ নামেও অভিহিত করা হয়। কেননা বাহ্য বিষয়ের জ্ঞান মনে প্রতিরূপের আধারে উৎপন্ন হয়। বাহ্যবস্তু মনে নিজের চিত্র অঙ্কন করে এবং তা হতে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব অনুমিত হয়।
.
এভাবে প্রতিরূপী বস্তুবাদ বা বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদের প্রধান প্রবক্তা ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক (John Locke, ১৬৩২-১৭০৪ খ্রী.) বাহ্যবস্তুর মনোনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেন, বস্তুর জ্ঞান হলো পরোক্ষ জ্ঞান। প্রত্যক্ষে আমরা সরাসরি বস্তু পাই না, পাই বস্তুর প্রতিরূপ বা প্রতিচ্ছবি। বস্তু হলো প্রতিরূপ বা প্রতিচ্ছবির জনক। মনের ধারণার সঙ্গে বাহ্যবস্তুর যদি সাদৃশ্য বা মিল থাকে তবে জ্ঞান হবে সত্য বা যথার্থ এবং মিল না থাকলে জ্ঞান হবে মিথ্যা বা অযথার্থ। বাহ্যবস্তুর জ্ঞান ধারণা বা প্রতীকের মাধ্যমে হয় বলে একে প্রতীকবাদ বা প্রতিরূপী বস্তুবাদ বলা হয়।
.
সৌত্রান্তিক মতে জ্ঞান ও অন্যান্য তত্ত্ব :
সৌত্রান্তিকের মতে জ্ঞানের চারটি কারণ স্বীকার করা হয়েছে। তাদের সংযোজনে জ্ঞান সম্ভব হয়। এই চারটি কারণ হলো আলম্বন (object), সমনন্তর (mind), অধিপতি (sense) ও সহকারি প্রত্যয় (auxiliary condition)।
.
সাকার চিত্তকে জ্ঞান বলে। তার আকার গ্রহণের শক্তিকে বোধরূপতা বলে। পূর্বক্ষণিক ঘট হতে যেমন একইরূপ ঘট পরবর্তীক্ষণে উৎপন্ন হয়, তেমনি পূর্বক্ষণিক আকার গ্রহণের সামর্থ্যবশত পরবর্তীক্ষণে একইরূপ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞানপ্রবাহ হচ্ছে অনাদি।
আকার দুই প্রকার- অহমাকার ও ইদমাকার। অহমাকার পূর্বক্ষণিক জ্ঞান হতে উৎপন্ন হয়, সেখানে অন্য কারণের অপেক্ষা থাকে না। তা হচ্ছে অনাদি, সার্বদিক এবং একরূপ। অন্যদিকে ইদমাকার কদাচিৎ। তা অন্য কারণের সাপেক্ষ, সাদি এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপ হয়।
.
বিজ্ঞানের দু’টি রূপ- আলয়বিজ্ঞান ও প্রবৃত্তিবিজ্ঞান। আলয়বিজ্ঞান শুদ্ধ অহমাকার বিজ্ঞান। সমস্ত ধর্ম তাতে বীজাকারে থাকে। অনাদি বাসনাস্থিত ভেদসংস্কার ঐগুলিকে বাহ্যবস্তুর বিজ্ঞানরূপে প্রদর্শন করে। আর প্রবৃত্তিবিজ্ঞান হলো ক্রিয়াশীল চিত্ত। তা নীলাদি বস্তুর বিজ্ঞানরূপে বিষয়ের প্রতীতি করায়। প্রবৃত্তিবিজ্ঞান কখনো কখনো আবির্ভূত হয়, সর্বদা নয়। সেকারণে বাসনার পরিণাম নিত্য, কিন্তু বিষয়ের জ্ঞান কখনো কখনো হয়।
.
এভাবে জ্ঞানের চারটি আকারকে ব্যাখ্যা করা হয় এভাবে-
১. টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি বাহ্য বিষয়কে আলম্বন কারণ বলে। কেননা তার জ্ঞানের আকার নির্মাণ করে।
২. পূর্বক্ষণের যে জ্ঞান হতে পববর্তী ক্ষণের জ্ঞান উদ্বুদ্ধ হয় বা আকার গ্রহণের শক্তি লাভ করে তাকে সমনন্তর কারণ বলে। রূপাদি পাঁচ বিষয়ের যে সামূহিক জ্ঞান তাকে বুদ্ধি, মন, অন্তঃকরণ বলে। বৌদ্ধ পরিভাষায় মনকে সমনন্তর প্রত্যয় বলা হয়। এখানে প্রত্যয় ও কারণ সমার্থক।
৩. ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানের অধিপতি প্রত্যয় বলে। আলম্বন এবং সমনন্তর থাকলেও ইন্দ্রিয়কে বাদ দিয়ে জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না। চক্ষু প্রভৃতি যে ইন্দ্রিয় প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট বিষয়ের গ্রহণের আধিপত্য করে তারা হচ্ছে অধিপতি প্রত্যয়। যেমন চক্ষু ইন্দ্রিয় জ্ঞানে রূপাকারকে নিয়ন্ত্রণ করে, রসনেন্দ্রিয় রসাকারকে।
৪. আলোক, মনঃসংযোগ প্রভৃতি হতে জ্ঞান স্পষ্টতা লাভ করে, এদেরকে সহায়ক কারণ বলে।
.
বাহ্যবস্তু যেমন ঘট পট প্রভৃতির মতো আন্তর অবস্থা সুখ, দুঃখ প্রভৃতিকে সৌত্রান্তিকরা জ্ঞান হতে ভিন্ন বলে স্বীকার করেন। সেকারণে চিত্তের ধর্ম বা অবস্থা এবং চিত্তের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত অবস্থা সুখ, দুঃখ প্রভৃতি বিষয়ের অনুভবে উপর্যুক্ত চারটি কারণকে স্বীকার করা হয়।
চিত্ত ও তার বিভিন্ন অবস্থারূপ যে স্কন্ধ বা তত্ত্ব তা হচ্ছে পাঁচ প্রকার- রূপ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার। এই পাঁচটি স্কন্ধের মধ্যে বিজ্ঞানস্কন্ধই হচ্ছে চিত্ত, অন্য চারটি স্কন্ধকে চৈত্ত বলা হয়।
রূপস্কন্ধ হচ্ছে একাদশ প্রকার। পঞ্চ ইন্দ্রিয় বা গ্রাহক এবং তাদের প্রত্যেকের গ্রাহ্যবিষয় অর্থাৎ চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা ও কায়, আর তার গ্রাহ্যধর্ম রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ। ইন্দ্রিয় হচ্ছে চৈত্ত পদার্থ, এগুলো ভৌতিক নয়।
.
মহাভূত চারটি- পৃথিবী, অপ্, তেজ ও বায়ু। তারা হচ্ছে অবিজ্ঞপ্তি ধর্মের উৎপাদহেতু। চিত্তের বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ও মহাভূতগুলিকে অবলম্বন করে যে শুভাশুভ ধর্মের প্রবাহ (serial continuity) ঘটে তাকে অবিজ্ঞপ্তি ধর্ম বলে। এ সবই রূপস্কন্ধের অন্তর্ভুক্ত।
বিজ্ঞানস্কন্ধ ও রূপস্কন্ধের সম্বন্ধ হতে যে সুখ, দুঃখ প্রভৃতি অনুভূতির প্রবাহ উৎপন্ন হয় তাকে বেদনাস্কন্ধ বলে। সুখ, দুঃখ হচ্ছে অভৌতিক ও চিত্তের পরিণাম। এই স্কন্ধ তিন প্রকার- সুখাত্মক, দুঃখাত্মক ও উপোত্মক।
গো, অশ্ব, ঘট ইত্যাদি নামের দ্বারা যুক্ত যে জ্ঞানপ্রবাহ তা হচ্ছে সংজ্ঞাস্কন্ধ।
বেদনাস্কন্ধ (সুখদুঃখের অনুভূতির প্রবাহ) হতে উদ্ভূত যে রাগ-দ্বেষ প্রভৃতি ক্লেশ, মদ, অভিমান, ধর্ম, অধর্মরূপ সংস্কার তার হচ্ছে সংস্কারস্কন্ধ। এগুলো অভৌতিক এবং চৈত্ত। বাসনার সমূহকে সংস্কারস্কন্ধ বলা হয়।
.
সৌত্রান্তিক ব্যক্তিবিশেষকে যথার্থ বলে স্বীকার করেন। তাঁরা ব্যক্তিবিশেষ হতে পৃথক সামান্য স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে নির্বাণের অর্থ দুঃখের অভাব। সুতরাং এই মতে নির্বাণ হলো নিষেধাত্মক।
.
সৌত্রান্তিক মতে সত্য দুই প্রকার- সংবৃতি (relative) ও পরমার্থ (absolute)। কোন ধর্ম বা বস্তুকে যখন পরিচ্ছিন্ন করা যায় তখন পরমার্থতঃ তার আর অস্তিত্ব থাকে না। তখন তার অস্তিত্ব আছে একথা বলা শুধু সংবৃতি সত্য (relative truth) মাত্র।
.
সৌত্রান্তিক মতে প্রমাণ দুই প্রকার- প্রত্যক্ষ ও অনুমান। অনুমান দুই প্রকার- স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান। স্বার্থানুমান নিজের জ্ঞানের জন্য এবং পরার্থানুমান অন্যের সংশয় দূর করার জন্য দরকার।
.
৫.৩.২ : বৈভাষিক মত : বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদ
.
বৈভাষিক দার্শনিকরা বাহ্য প্রত্যক্ষবাদী। প্রাচীন বৌদ্ধমতে কিছু বিরোধাত্মক বিচার বিদ্যমান থাকায় তা সংস্কারের লক্ষ্যে কণিষ্কের (৭৮-১৪৪ খ্রী.) শাসনকালে কাশ্মীরের জলন্ধরে একটি বৌদ্ধসভা আহ্বান করা হয়, যা চতুর্থ সঙ্গীতি নামে অভিহিত। এই সভায় অভিধম্মপিটক গ্রন্থের উপর যে সকল প্রাচীন টীকাভাষ্য প্রণয়ন করা হয়েছিলো তাকে বিভাষা বলা হতো। যে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এই ভাষ্যকে অনুসরণ করেছিলেন তাঁরা বৈভাষিক নামে পরিচিত হন। হীনযান সম্প্রদায়ের এই বৈভাষিক দার্শনিকরা সূত্তপিটকের প্রামাণ্য অস্বীকার করেন এবং একমাত্র অভিধম্মপিটকের প্রামাণ্যকে স্বীকার করেন।
.
সৌত্রান্তিকদের মতো বৈভাষিকরাও সর্বাস্তিবাদী ছিলেন। সৌত্রান্তিকদের মতো এই সম্প্রদায়ও বিশ্বাস করে যে, বাহ্য ও আন্তর উভয়প্রকার বস্তুরই অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ বাহ্যজগৎ ও মনোজগৎ উভয়ই ক্রিয়াশীল। কিন্তু সৌত্রান্তিক বাহ্যানুমেয়বাদ অনুসারে বাহ্যবস্তুকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা যায় না, বাহ্যবস্তু অনুমানের দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ মতকে বৈভাষিকরা স্বীকার করেন না। তাঁদের মতানুসারে বাহ্য বিষয়ের জ্ঞানও প্রত্যক্ষ হয়। এজন্যেই বৈভাষিকদের মতবাদকে বলা হয বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদ।
.
সর্বাস্তিবাদের সাতটি অভিধর্মপিটক বা দার্শনিক গ্রন্থই বৈভাষিকদের শাস্ত্র। গ্রন্থগুলো হচ্ছে জ্ঞানপ্রস্থান, ধর্মস্কন্ধ, সঙ্গীতিপর্যায়, বিজ্ঞপ্তিবাদ, প্রকরণপাদ, প্রজ্ঞপ্তিসার ও ধাতুকায়পাদশাস্ত্র। জ্ঞানপ্রস্থানশাস্ত্র খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের সর্বাস্তিবাদের প্রধান বৌদ্ধ আচার্য কাত্যায়ণীপুত্রের রচিত। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকে বসুবন্ধু (যিনি পরবর্তীতে যোগাচারী বিজ্ঞানবাদের আচার্য হয়েছিলেন) অভিধর্মকোষশাস্ত্র নামক যে গ্রন্থ রচনা করেন তা হলো জ্ঞানপ্রস্থানশাস্ত্রের টীকাভাষ্য। সর্বাস্তিবাদের এই অভিধর্মপিটক গ্রন্থ অবলম্বন করেই বৈভাষিকরা নিজেদের মত গড়ে তোলেন।
.
বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য হচ্ছে, জ্ঞেয় পদার্থমাত্রই অনুমেয় হলে কোন বস্তুরই প্রত্যক্ষজ্ঞান সম্ভব নয় বলে ব্যাপ্তিজ্ঞানের নিঃসন্দিগ্ধ প্রত্যয়ের কোন আধারই পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ যদি বাহ্যবস্তুর প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্ভব না হয়, তাহলে অনুমানও অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেমন আমরা ধূম দেখে আগুনের অস্তিত্ব অনুমান করি, যেহেতু অতীতে আমরা ধূম এবং আগুনকে একসঙ্গে বহুবার প্রত্যক্ষ করে ‘যেখানে ধূম সেখানে অগ্নি’ এই ব্যাপ্তি সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করেছি। কিন্তু যদি বাহ্য কোন বস্তুর প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্বীকার না করা হয় তবে ব্যাপ্তির সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান হতে পারে না।
.
সৌত্রান্তিকরা বলেন, জ্ঞেয় বিষয় হচ্ছে অনুমানগম্য। বৈভাষিকদের উত্তর হচ্ছে, অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তিজ্ঞান। প্রত্যক্ষ ভিন্ন ব্যাপ্তিজ্ঞানের আশ্রয় থাকতে পারে না, সুতরাং ব্যাপ্তিজ্ঞানই সম্ভব হয় না। তদুপরি জ্ঞেয় বিষয় যে প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা জানা যায় তা সকলের অনুভবসিদ্ধ। অর্থাৎ বৈভাষিক মতে, বাহ্যবস্তুকে যদি কখনোই প্রত্যক্ষ করা না যায়, তাহলে কেবল বাহ্যবস্তুর মানসিক ধারণা বা প্রতিবিম্ব দেখে কখনোই বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব অনুমান করা যাবে না।
.
সৌত্রান্তিকরা বলেছেন যে, বাহ্যবস্তুর সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়। মনের মধ্যে বাহ্যবস্তুর আকার বর্তমান থাকে এবং এই মানসিক আকার থেকে আমরা অনুমান করি যে বাহ্যবস্তু আছে।
এক্ষেত্রে বৈভাষিকদের প্রশ্ন হলো, মানসিক আকার যে বাহ্যবস্তুরই নকল তা আমরা জানবো কিভাবে ? মানসিক আকার বা ছবিটি বাহ্যবস্তুর নকল একথা আমরা তখনই বলতে পারি যদি আমরা বাহ্যবস্তুকে তার আগে প্রত্যক্ষ করে থাকি। সুতরাং বাহ্যবস্তুকে সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব।
.
বৈভাষিক মতে সৎ বস্তুমাত্রই ক্ষণিক অর্থাৎ একটিমাত্র ক্ষণের জন্য স্থায়ী। তাঁরা জগতে স্থায়ী বা নিত্য পদার্থের কোন অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। প্রথমক্ষণে বস্তু উৎপন্ন হয় এবং দ্বিতীয়ক্ষণে সেটি ধ্বংস হয়ে আরেকটি বস্তু উৎপন্ন হয়। সেই উৎপন্ন বস্তুটি আবার তৃতীয়ক্ষণে নাশ পায়। যেমন যে বীজটি আমরা দেখি সেটি আসলে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল বীজের সন্তান বা বীজের প্রবাহ। তাঁদের মতে মানসিক ও বাহ্যিক সকল সত্তাই সন্তান বা প্রবাহমাত্র। এই মতবাদ সন্তানবাদ নামে পরিচিত।
.
বৈভাষিকরা ছিলেন বস্তুর অস্তিত্ববাদী (realist)। কিন্তু সেকারণে তাঁদের অস্তিত্ববাদকে জড়বাদীর বস্তুবাদ (realism) বলা যাবে না। আত্মা বা পুদ্গলের (individuality) অস্তিত্বে তাঁরা বিশ্বাস করতেন না সত্য, কিন্তু নির্বাণ যে সম্পূর্ণ আনন্দময় সে বিশ্বাস তাঁদের অটল ছিলো। সে বিশ্বাসে তাঁরা প্রাচীন বৌদ্ধমত অনুসরণ করে হীনযানে অন্তর্গত হয়েছেন। কিন্তু কেবল পঞ্চস্কন্ধ ও ধর্ম বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহের আপেক্ষিক (relative) অস্তিত্ব ও বস্তুত্ব স্বীকার করতে গিয়েই তাঁরা মূল বৌদ্ধধর্মের প্রদর্শিত পথ থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
.
বৈভাষিক মতে বাহ্যপ্রত্যক্ষের তত্ত্ব :
বৈভাষিক মতানুযায়ী বাহ্যবস্তু কেবলমাত্র প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায়। প্রত্যক্ষ দুই প্রকার- নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক।
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হলো বিশুদ্ধ সংবেদন। যখন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বস্তুর সন্নিকর্ষ হয়, তখন বস্তু সম্পর্কে আমাদের যে জ্ঞান হয়, সেই জ্ঞানই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ। এই জাতীয় প্রত্যক্ষ বস্তুর স্বরূপকে প্রকাশিত করে এবং আমাদের যথার্থ জ্ঞান দেয।
অপরপক্ষে কোন বিষয় সম্বন্ধে বচনের আকারে আমাদের যে জ্ঞান হয় তা হলো সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। এই জাতীয় প্রত্যক্ষ কাল্পনিক বলে বস্তুর যথার্থ জ্ঞান দান করে না।
.
বৈভাষিক মতে, বাহ্যবস্তু হলো স্বলক্ষণের ধারা বা প্রবাহ। যা নিজেই নিজের লক্ষণ, তা-ই স্বলক্ষণ। স্ব-লক্ষণগুলি এক বা একটি স্বতন্ত্র তত্ত্ব। আমাদের মূল প্রত্যক্ষের বিষয় হলো স্বলক্ষণ, যাকে বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। দৃষ্ট ঘটের স্ব-লক্ষণ সেই ঘটটিতেই বর্তমান থাকে, অন্য কোন ঘটে থাকে না। তাই ঘটজাতি, ঘটনাম বা ঘটদ্রব্য বলে কোন কিছু নেই।
প্রত্যক্ষের সময় আমরা এই স্বলক্ষণের উপর জাতি, নাম, দ্রব্য, গুণ প্রভৃতি কল্পনা আরোপ করি। কাজেই ঘট-জাতি, ঘট-নাম, ঘট-দ্রব্য- এগুলি হলো কল্পিত সামান্যলক্ষণ বা সাধারণ লক্ষণ।
অপরপক্ষে স্বলক্ষণ অস্তিত্বশীল। বাহ্যজগতে অসংখ্য স্বলক্ষণের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এই স্ব-লক্ষণগুলি ক্ষণিক। আমরা এই ক্ষণিক স্ব-লক্ষণকেই সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করে থাকি।
.
বৈভাষিক দার্শনিকরা দ্বৈতবাদী। কারণ তাঁদের মতে, মন ও জড়জগৎ উভয়ই সত্য। মনোজগৎ এবং জড়জগৎ উভয়েরই পরস্পর নিরপেক্ষ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। মন হলো সদাচঞ্চল ও পরিবর্তনশীল পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি। এরূপ সদাচঞ্চল ও পরিবর্তনশীল মানসিক পদার্থই হলো জীবাত্মা। এজন্যেই বৈভাষিক মতে জীবাত্মা হলো নশ্বর ও অনিত্য।
.
জড়জগৎ সম্পর্কে বৈভাষিক মত হলো, ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও মরুৎ- এই চারটি ভূতের পরমাণুর সংযোগে বাহ্যবস্তু গঠিত হয়। পরমাণুগুলি স্বরূপগত মৌলিক, নিরবয়ব, নিত্য ও অবিনশ্বর। এই মতে, স্বলক্ষণ মৌলিক উপাদান নয়, পরমাণুই মৌলিক উপাদান। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৈভাষিকদেরকে পরমাণুবাদী বলা যায়। তবে জৈন ও বৈশেষিক দার্শনিকদের মতো এই পরমাণু স্থির বা স্থায়ী নয়। বৈশেষিক মতে পরমাণুগুলি চঞ্চল ও গতিশীল।
.
অন্যান্য বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতো বৈভাষিকরাও মনে করেন, জীবন দুঃখময় এবং এই দুঃখের মূলে রয়েছে অবিদ্যা। ক্ষণিক পদার্থকে স্থির বলে ভুল করা, স্বলক্ষণকে সামান্যলক্ষণ মনে করা এবং নির্বিকল্পককে সবিকল্পক ভাবার জন্যেই মানুষ দুঃখ পায়। সুতরাং অবিদ্যাই দুঃখের কারণ এবং অবিদ্যার বিনাশই দুঃখের নিবৃত্তি বা নির্বাণ।
.
বৈভাষিকের সভেদ ধর্ম :
বৈভাষিক মতে ‘ধর্ম’ শব্দটির যথেষ্ট তাৎপর্যময় প্রয়োগ রয়েছে। এই মতে, ভূত এবং চিত্তের সূক্ষ্ম তত্ত্বকে ‘ধর্ম’ বলা হয়। সম্পূর্ণ বিশ্ব হচ্ছে ধর্মের সঙ্ঘাত। ধর্ম চার প্রকার- পৃথিবী, অপ্ (জল), তেজ ও মরুৎ (বায়ু)। পৃথিবীর প্রকৃতি কাঠিন্য (hardness), জলের শৈত্য (coldness), বায়ুর গতিশীলতা (velocity) এবং তেজের উষ্ণতা (warmth)। বৈভাষিকরা আকাশের কোন ধর্ম স্বীকার করেন না।
.
বৈভাষিকরা ‘ধর্ম’ শব্দের যে অর্থ নির্দেশ করেন তা পাশ্চাত্য দর্শনে অবভাসের (phenomenon) প্রতিশব্দ বলা চলে। যা স্বলক্ষণ বা নিজের বিশিষ্ট লক্ষণ ধারণ করে তা হচ্ছে ধর্ম। ধর্ম হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়, ইন্দ্রিয়ের সেই গ্রহণরূপ ব্যাপারেই ধর্মের বিশেষ লক্ষণসমূহ ধরা পড়ে। আর ধর্মের প্রকৃত স্বভাবসম্বন্ধে জ্ঞান উৎপন্ন না হলে নির্বাণ (মুক্তি) লাভ হয় না। বসুবন্ধু বলেছেন, ধর্মসমূহের স্বভাব সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান ব্যতিরেকে ক্লেশ উপশান্তির উপায় লাভ হয় না। ক্লেশ বা দুঃখের নিরোধ না হলে নির্বাণের পথ মুক্ত হয় না।
.
ধর্ম বা ইন্দ্রিগ্রাহ্য বিষয়সমূহের স্বভাব পরিচ্ছেদ করতে গিয়ে বৈভাষিকরা পঁচাত্তরটি ধর্মের অস্তিত্ব স্থাপন করেছেন। এগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- সাস্রব বা মলযুক্ত এবং অনাস্রব বা মলহীন।
সাস্রব ধর্মকে সংস্কৃত ধর্ম নামেও বলা হয়। সংস্কৃত ধর্মের অর্থ করা হয়েছে রপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধ এবং পঞ্চস্কন্ধাত্মক ধর্মসমূহকেই সংস্কৃত বলা হয়েছে। যে ধর্ম একীভূত, সম্ভূত বা সমীকৃত হেতুসমূহ থেকে উৎপন্ন হয় তা হচ্ছে সংস্কৃত ধর্ম। প্রত্যেক ধর্মের উৎপত্তির পেছনে নানা হেতুর সমাবেশ রয়েছে, অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্মই অন্যান্য ধর্ম সংযোগে উৎপন্ন হয়। সেকারণেই পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্রভাবে গৃহীত শ্লোকে বলা হয়, ধর্মসমূহ হচ্ছে হেতুপ্রভব। তথাগত বা বুদ্ধ তাদের হেতু ও নিরোধোপায় নির্দেশ করেছেন।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় অবলম্বন করেই সংস্কৃত ধর্মের উৎপত্তি হয়। আর ইন্দ্রিয়শক্তির দ্বারা যা গ্রহণ করা অসম্ভব এবং যা অহৈতুকী তাকে অসংস্কৃত বা অনাস্রব ধর্ম বলে।
.
সংস্কৃত ধর্মের সংখ্যা ৭২ এবং অসংস্কৃতের সংখ্যা ৩। এই বাহাত্তরটি সংস্কৃত (conditioned) ধর্মকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে- রূপ, চিত্ত, চৈত্ত ও চিত্তবিপ্রযুক্ত। পঞ্চস্কন্ধ থেকে এদের উদ্ভব। রূপ ও বিজ্ঞান এই উভয় স্কন্ধকে অবলম্বন করে রূপ ও চিত্তধর্ম উদ্ভূত হয়। বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার এই তিন স্কন্ধকে অবলম্বন করে চৈত্ত ও চিত্তবিপ্রযুক্ত ধর্মগুলির উদ্ভব হয়।
বৈভাষিক মতে, চূড়ান্ত বিচারে চিত্ত থেকে সমস্ত ধর্মের উৎপত্তি হয় বলেই চিত্তকে মহাভূমি বলা হয়েছে। এই মতে রূপ, চিত্ত, চৈত্ত এই তিনপ্রকার ধর্মের বস্তুত্ব স্বীকার করা হয়, কিন্তু সংস্কার স্কন্ধকে আশ্রয় করে উদ্ভূত চিত্তবিপ্রযুক্ত ধর্মের বস্তুত্ব নেই। তাদের সংখ্যা ১৪। যেমন প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, সভাগতা, আসঙ্গিক, সমাপত্তি, জীবিত, লক্ষণ, নামকায় ইত্যাদি। কারণ তারা চৈত্তধর্ম নয়, তবে চৈত্তের সাথে তাদের ভাবসাদৃশ্য আছে।
.
বৈভাষিক মতে, যে ধর্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় তাদেরকে অসংস্কৃত (unconditioned) বা অনাস্রব ধর্ম বলে। অসংস্কৃত ধর্ম তিন প্রকার- আকাশ ও দুই প্রকারের নিরোধ। প্রতিসংখ্যা নিরোধ ও অপ্রতিসংখ্যা নিরোধ।
আকাশের অর্থ অনাবৃতি। যা রূপ বা বস্তু (matter) দ্বারা আবৃত হয় না এবং রূপ বা বস্তুকে আবৃত করে না তা হচ্ছে আকাশ।
.
প্রতিসংখ্যা ও অপ্রতিসংখ্যা নিরোধ হচ্ছে নির্বাণের অঙ্গ। প্রতিসংখ্যা নিরোধ হচ্ছে সাস্রব ধর্মসমূহের প্রত্যেকের পৃথকভাবে নিরোধ বা বিসংযোগ। এই বিসংযোগ বা নিরোধের ধর্মত্ব বা দ্রব্যত্ব (entity) আছে। এবং সে ধর্মত্ব অন্য ধর্মের আশ্রয়ে প্রত্যুৎপন্ন হয়, নিত্য। সে কারণে নিরোধ আর্যসত্য হিসেবে গণ্য হয়। এই দৃষ্টিতে প্রতিসংখ্যা হচ্ছে প্রজ্ঞা, এবং প্রজ্ঞার সাহায্যে সাস্রব ধর্মসমূহের স্বভাব সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করাই হচ্ছে প্রতিসংখ্যা নিরোধ।
.
যে নিরোধ ধর্মোৎপত্তির আত্যন্তিক বিঘ্ন ঘটায় তা হচ্ছে অপ্রতিসংখ্যা নিরোধ। প্রজ্ঞার সাহায্যে পৃথক পৃথক সাস্রব ধর্মের প্রকৃত স্বভাবের অবগতিতে এই নিরোধ হয় না, কিন্তু যখন ধর্মোৎপত্তির হেতুসমূহ বিনষ্ট হয় তখনই এই নিরোধ ঘটে। এই নিরোধই হলো বৈভাষিকের মতে বৌদ্ধ সাধকের কাম্য। কেননা তাতে আত্যন্তিক নির্বাণ লাভ হয়। বস্তুতঃ যখন সাস্রব ধর্মসমূহের উৎপাদ বিনষ্ট হয় তখনই অসংস্কৃত ধর্মের উৎপত্তি হয়। ধর্মশূন্যতাই হচ্ছে অসংস্কৃতত্রয়ের লক্ষণ।
.
বৈভাষিকদের এই ধর্মনিরূপণের পেছনে রয়েছে অস্তিবাদ। তবে এই অস্তিবাদে সাংখ্যের প্রকৃতি, পুরুষ কিংবা আত্মার কোন স্থান নেই। রূপের (form/matter) বস্তুত্ব এবং পরমাণুরও বস্তুত্ব আছে বটে, কিন্তু সেই পরমাণুর কোন স্বাধীন সত্তা নেই। এখানেই বৈশেষিক দর্শনের সাথে বৈভাষিক মতের বিরোধ। বৈভাষিকের পরমাণু দ্রব্যপরমাণু (atom, monad) নয়, তার কোন দ্রব্যত্ব (substantiality) নেই। এই পরমাণু হচ্ছে সঙ্ঘাতপরমাণু, অর্থাৎ সঙ্ঘাত বা রূপসঙ্ঘাতের (aggregate of matter) সূক্ষ্মতম অবস্থা। তবে রূপসঙ্ঘাতের সেই সূক্ষ্মতম অবস্থাও স্বলক্ষণ বিশিষ্ট। তার লক্ষণ হচ্ছে আটটি- ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও বায়ু নামক চতুর্মহাভূত এবং গন্ধ, রস, রূপ ও স্পর্শ নামক চতুর্ভৌতিক বস্তু। সুতরাং এই পরমাণুর কোন আত্যন্তিক সূক্ষ্মতা (ultimate simplicity) নেই।
বৈশেষিকের পরমাণু নিত্য অর্থাৎ তার নাশ নেই। কিন্তু বৈভাষিকের সঙ্ঘাতপরমাণু স্বল্পস্থায়ী, তার বিনাশে অনুরূপ অন্য পরমাণু সেস্থান গ্রহণ করে। এই প্রত্যেক সঙ্ঘাতপরমাণুর উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশ- তাদের হেতুপরম্পরার দ্বারা নির্ধারিত হয়।
.
চিত্ত (mind) ও চৈত্তধর্মের (mental phenomena) সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য হয়। চিত্তের বা মনের কোন স্বাধীন সত্তা নেই। বিজ্ঞানের (চেতনা) উৎপত্তিতে মনের অস্তিত্ব। বিজ্ঞানও স্বল্পস্থায়ী। একটি বিজ্ঞানের লয়ে নতুন বিজ্ঞান তার স্থান গ্রহণ করে। তাদের উৎপত্তি, স্থিতি, লয়ও হেতুপরম্পরার দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। ভূতপূর্ব বিনষ্ট বিজ্ঞানই পরবর্তী মুহূর্তে জাত বিজ্ঞানের আশ্রয় বলে গৃহীত হয় এবং সেকারণে তাকে মন বলা হয়। চিত্ত চৈত্তধর্ম ‘সংস্কৃত’ লক্ষণ নিয়ে উৎপন্ন হয়।

(চলবে…)
[ব্যবহৃত ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]
[আগের পর্ব: যোগাচার বৌদ্ধদর্শন বিজ্ঞানবাদ ][*][পরের পর্ব: ]
[ তথ্য-গ্রন্থসূচি ][ বৌদ্ধদর্শন অধ্যায়সূচি ]

No comments: