Friday, November 11, 2011

| অর্থহীন…|


| অর্থহীন…|
-রণদীপম বসু

কোনকিছুই অর্থহীন না। কথাটা কে বলেছিলেন জানি না। তবে কথাটা যে কোনোভাবেই অর্থহীন না, সেটা হলফ করেই বলা যায়। আর অর্থহীন হবেই বা কী করে ! কোন কারণ বা অর্থই যদি না থাকে তাহলে বিষয় বা বস্তুর অস্তিত্ব আসে কী করে ! অর্থাৎ কার্যটার পেছনে একটা কারণ অবশ্যই রয়ে গেছে। এর অর্থ বের করতে না পারলে তা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য হতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে অবোধ্যও হতে পারে। কিন্তু অর্থহীন হওয়ার আদৌ কি উপায় আছে ?


.

নৈরাত্মবাদী নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধের মতবাদে ‘প্রতীত্য-সমুৎপাদ’ নামে একটা তত্ত্ব আছে, ওটাই গোটা বৌদ্ধদর্শনের মূল বা কেন্দ্রবিন্দু বলতে পারি। সেটাকে ঘিরেই তাঁর অনুসারীদের মধ্যে নানান মতের সৃষ্টি হয়েছিলো। বুদ্ধের ওই প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্বের সারাংশ হলো, জগতের কোন কিছুই কার্য-কারণ সম্পর্কের বাইরে নয়। জগতের যাবতীয় বস্তু বা বিষয় ক্ষণিক এবং তা প্রতীত্য-সমুৎপন্ন, অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষণিকতার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। এই ক্ষণে যে আমিটা আছি, পরের ক্ষণেই সেটা বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এই আমি সদৃশ আরেকটা আমির উদ্ভব হয়। আবার এই দ্বিতীয় ক্ষণের আমিটাও পরের ক্ষণে বিনষ্ট হয়ে আরেকটা আমির সৃষ্টি হয়। এভাবে অসংখ্য ক্ষণিকতার মধ্য দিয়ে আমার অস্তিত্ব প্রবাহটা বয়ে যেতে থাকে। জগতের যেকোন বস্তু বা বিষয়ের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য বলে বুদ্ধমতে স্বীকার করা হয়। এভাবেই শিশু থেকে বুড়ো আমির দিকে চলমান আমার অস্তিত্ব একসময় জরামরণের মধ্যে দিয়ে আরেকটা জন্মচক্রের সূচনা করে। কারণ আমরা তো কেউ পূর্ণ তৃপ্তি বা তৃষ্ণাহীন অবস্থায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি না। আমাদের মধ্যে অসংখ্য অতৃপ্তি চাওয়া পাওয়া ও অবদমিত ইচ্ছার গুঞ্জরণ থেকে যায়। ফলে আমাদেরকে সেই অবদমিত তৃষ্ণার সংস্কার নিয়ে আবারো পুনর্জন্মের মাধ্যমে দেহধারণ করতে হয়। কিন্তু এই তৃষ্ণাটাকে যদি এই জীবনে নির্বাপণ করা যেতো, তাহলে আবারো আরেকটা জন্ম গ্রহণের মাধ্যমে দেহ ধারণ করে এই দুঃখময় জগতে পদার্পণ করতে হতো না। ফলে দেহধারণই দুঃখের কারণ এবং নির্বাণের মাধ্যমে তৃষ্ণা দূর করা গেলেই আর জন্মরূপ দুঃখে প্রত্যাবর্তন করতে হতো না। এই জন্মচক্র থেমে যাওয়াটাই নির্বাণ। সকল চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে এক তৃষ্ণাহীন অবস্থা, যা বর্ণনারও অগম্য। সে যাক।

 .
এই যে ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম, এটাও একটা অর্থহীন প্রগল্ভতা বলে ফেলা যায়। কিন্তু আবারও কার্য-কারণ তত্ত্ব সামনে এসে যাবে। অর্থাৎ অর্থহীন বলা যাবে না। নইলে আমি লিখতে বসলাম কেন ? বৌদ্ধদর্শনের এই জটিল গুহায় প্রবেশের দরকার নেই। কেননা এতে যে দার্শনিক কূটতর্কের আয়োজন হবে তা সামলানোর প্রজ্ঞা পাবো কোথায় ! নিরীশ্বরবাদী বা অনাত্মবাদী হলেও একে তো ভাববাদী দর্শন, তার ওপর বুদ্ধ নিজেই অধিবিদ্যা এড়াতে দশটি অ-কথনীয় প্রশ্নে মৌনতা অবলম্বন করে পরবর্তী অনুসারী দার্শনিকদের বিতণ্ডার একটা অদ্ভুত ক্ষেত্র সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন। যদিও এ কারণেই ভারতীয় দর্শন পরবর্তীকালে তার নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য ছড়ানোর দুর্দান্ত সুযোগ পেয়ে নিজেকে বিশ্ব দরবারে স্বতন্ত্রভাবে মেলে ধরতে পেরেছে, কিন্তু এর মধ্যে প্রবেশ করা মানে তো আমাদের সাধারণ জনের সাড়ে বারোটা বাজার অবস্থা ! এই দার্শনিক ভাষা আর শব্দের বিকট বর্ম পেরিয়ে ভেতর থেকে রস বের করতে করতে দেখা যাবে নিজেদের জীবনের রসই বেরিয়ে গেছে সব ! তাই অর্থহীনতার একটা বাস্তবসম্মত উদাহরণে আসা যাক।
 .
শিল্পে কিউবিজমের জনক বিশ্বখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোকে নাকি এক শিল্পরসিক দর্শক বেশ উষ্মার সাথেই বলেছিলেন- এসব অর্থহীন কী আঁকাবুকি করেন ! আগা নাই মাথা নাই এসব ছবি আঁকতে আবার কিছু শিখতে হয় নাকি ! পিকাসো মুচকি হেসে অবোধ্য হরফে লেখা একটা কাগজ বের করে লোকটার সামনে ধরে বললেন- দেখেন তো এখানে কী লেখা ? লোকটি কিছুই বুঝতে না পেরে বললো, এটা কোন্ ভাষা ? চিনারা তো এই লেখা বুঝে, পিকাসো উত্তর দিলেন। আমি তো চিনা ভাষা জানি না ! লোকটির কথায় অমনি পিকাসো বললেন- এই চিনা ভাষা শিখলে কি লেখাটার অর্থ উদ্ধার করতে পারবেন ? অবশ্যই পারবো, লোকটির ঝটপট উত্তর। সাথে সাথে লোকটির কথাই ফিরিয়ে দিয়ে পিকাসো বললেন, শিল্পেরও একটি ভাষা আছে, ওটাও শিখতে হয়। নইলে সবকিছু এরকম অর্থহীনই মনে হবে।
 .
কিন্তু এখানে কেন আমি এসব অর্থহীন কথাবার্তা বলছি ? আবারো বলতে হয়, অবশ্যই অর্থহীন না ! কারণ, এরও একটি কারণ আছে। সেই কারণটা হলো, একটা অর্থহীন বিষয়কে সামনে আনা। কী সেই অর্থহীন বিষয় ? তা হলো, বিশ্বপ্রকৃতির চিরায়ত অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের কাছে বিশেষত্ব বা অর্থহীন আজকের এই দিনটাকে একটা অর্থহীন প্রলাপের মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা ! কারণ আজকের দিনটাকে সংকেতিকভাবে চিহ্নিত করতে হলে লিখতে হবে ১১-১১-১১। নিশ্চিতভাবেই এখানে আমাদের স্বভাবসুলভ চৌর্যবৃত্তির মহিমা দিয়ে অন্য দুটো সংখ্যা ‘২’ ও ‘০’ কে গোপন করে আজকের দিনের মহিমা প্রকাশ করবো এই বলে যে, এই দিনটা আগামী একশ বছরের মধ্যে আমরা আর পাবো না। আমরা কী ভাগ্যবান প্রজন্ম যে এই দিনটাকে আমাদের আকস্মিক জন্মের কারণে কাকতালীয়ভাবে পেয়ে গেছি ! যা আজকের পর থেকে অন্তত দুটো প্রজন্ম এইরকম মারাত্মক একটা দিন মিস করবে, যেখানে একই সংখ্যা পর্যাক্রমে ছয়বার বসবে। আর যদি ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড মিলিয়ে কিছু একটা করে ফেলা যায়, তাহলে একনাগারে এই একটি সংখ্যাই বারোবার বসিয়ে মুহূর্তটাকে মহাকালের কাছে অমর করে দেয়া যাবে ! হা হা হা ! কী অদ্ভুত অর্থহীনতা আমাদের !
 .
কিন্তু সত্যি কি অর্থহীনতা ? এর পেছনে কোন অর্থই কি নেই ! অবশ্যই আছে। সেটা হচ্ছে মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনায় যে কোন অর্থহীন মুহূর্তকে অর্থময় বানিয়ে ফেলার অভাবনীয় ক্ষমতা ও সৃজনশীলতা। এই সময় বিভাগটাও তো মানুষের সৃষ্টিশীলতারই ফসল ! কে জানে এই আজকের দিনটাকে স্মৃতিময় করে রাখতে বিশ্বের কেউ কোথাও এমন কিছু সৃষ্টি করে ফেলতেও পারেন, যার কারণে তাঁকে আগামী একশ বছর মানুষ মনে করবে !!

No comments: