| অনেকান্তবাদী : জৈন-দর্শন | পর্ব-০১ |
-রণদীপম বসু
…
১.০ : জৈন-দর্শন (The Jaina Philosophy)
.
ভারতের প্রাচীনতম অসনাতন নাস্তিক্য ধর্মদর্শনের অন্যতম হচ্ছে জৈনদর্শন। ‘জিন’ শব্দ থেকে জৈন শব্দের উৎপত্তি। ‘জিন’ অর্থ বিজয়ী। যিনি ষড়রিপুকে জয় করেছেন, তিনিই জিন। জৈনদের মতে, যথার্থ সাধনার বলে রাগ, দ্বেষ, কামনা বাসনা জয় করে যাঁরা মুক্তি বা মোক্ষলাভ করেছেন তাঁরাই জিন। জৈন ঐতিহ্যে এজাতীয় চব্বিশজন মুক্ত পুরুষের পারম্পর্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, যাঁদেরকে তীর্থঙ্কর বলা হয়। এই পরম্পরায় চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মধ্যে সর্বপ্রথম হলেন ঋষভদেব এবং সর্বশেষ হলেন বর্ধমান বা মহাবীর। মহাবীর ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। তাই জৈন ঐতিহ্যের ওই চব্বিশজন তীর্থঙ্করের পারম্পর্য ঐতিহাসিকভাবে সত্য হলে জৈনধর্মকে অত্যন্ত প্রাচীন বলে স্বীকার করতে হবে।
.
জৈনদর্শনের মূল কথা হলো, সাধারণ অভিজ্ঞতায় আমরা জগতকে যেভাবে জানি তাই সত্য ও যথার্থ। জগতে বস্তুর অস্তিত্ব আছে, অতএব কোনো এক বা অদ্বিতীয় পরমসত্তার কল্পনা করা নিরর্থক। এই বস্তুসমূহ প্রধানত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত, জীব এবং অজীব। দেহ যেমনই হোক না কেন, প্রত্যেক জীবন্ত বস্তুর মধ্যেই জীব বা আত্মা আছে। এই আত্মা অবিনাশী, কিন্তু ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়। জীবন্ত প্রাণী হত্যা না করা তথা সমস্ত জীবের প্রতি ঐকান্তিক অহিংসাই জৈনধর্মের অপরিহার্য মূলনীতি।
.
১.১ : জৈনদর্শনের উত্থানভূমি
প্রাচীন ভারতবর্ষে বৈদিকধর্ম ও এর ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্মকাণ্ডের প্রভাবে উদ্ভুত যে অস্থির সামাজিক পরিস্থিতিতে দুর্বিসহ ব্রাহ্মণ্যবাদের রিরোধী হিসেবে বৌদ্ধধর্মের জন্ম, সমসাময়িক হিসেবে সেই একই প্রেক্ষাপটে ব্রাহ্মণ্য বিরোধী জৈনধর্মেরও উত্থান। তবে কালানুক্রমের হিসাবে জৈনদর্শন বৌদ্ধদর্শন হতেও প্রাচীন। বৌদ্ধধর্মের পূর্ববর্তী এই ধর্ম সাংখ্যদর্শন ও উপনিষদভাবনার সাথে কম-বেশি সাদৃশ্য বহন করে। তবে চার্বাকদের মতো জৈনগণও বেদের প্রামাণ্য ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু ভূতচতুষ্টয়ের থেকে অতিরিক্ত জীবাত্মা স্বীকার করেন। এক্ষেত্রে নাস্তিক হয়েও জৈনরা অনাত্মবাদী বৌদ্ধদের থেকে স্বতন্ত্র। তাই অধ্যাপক হপকিন্সের (Hopkins) মতে, ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যবর্তী তাত্ত্বিক সোপানরূপে জৈনদর্শনের অবস্থান।
.
বেদ ও উপনিষদে বিবৃত কিছু সিদ্ধান্তের সাথে জৈনমতের কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন জৈনরাও পুনর্জন্মবাদ ও কর্মফলে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁদের মতে কৃতকর্মের ফল অনুযায়ী জীবের জন্ম হয়। জন্মান্তরে আত্মা ইতর প্রাণী, মানুষ, দেবতা কিংবা দৈত্যের দেহ ধারণ করতে পারে। কঠিন তপশ্চর্যা, সর্বত্যাগ ও আত্মপীড়নের মধ্য দিয়ে মুক্তিলাভ করা যায়। এই দর্শনে সিদ্ধপুরুষকে ‘অর্হৎ’ নামে অভিহিত করা হতো বলে জৈনদর্শনকে আর্হতদর্শনও বলা হয়। পরবর্তীকালে এই দর্শনের নাম হয়েছে জৈন দর্শন। ‘জিন’ দ্বারা প্রবর্তিত বলে এই ‘জৈন’ নামকরণ। জৈনমতের প্রচারকদেরকে ‘তীর্থঙ্কর’ বলা হয়। জৈনবিশ্বাস মতে, এই তীর্থঙ্কররা সকল পদার্থের জ্ঞান লাভ করে সকল তত্ত্ব জয় করেছেন বলে তাঁরা সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, সমুদয় জ্ঞান এবং দর্শনকে জানেন। একারণে এই মতকে সর্বজ্ঞাতাবাদীও বলা হয়।
.
জৈনমত অনুসারে, তাঁদের ধর্ম সৃষ্টির প্রারম্ভকাল হতে প্রচলিত আছে। প্রত্যেক উৎসর্পণকারী (=উত্থানকারী) ও অবসর্পণকারী (=নীচে অর্থাৎ ভূলোকে আবির্ভূত) তীর্থঙ্করের সংখ্যা হচ্ছে চব্বিশ। তাঁদের মধ্যে অন্তিম অবসর্পণকারী প্রথম তীর্থঙ্করের নাম ঋষভদেব, নামান্তরে যাঁকে আদিনাথ হিসেবে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দির ভারতীয়রা পূজা করতো বলে জানা যায়। ভাগবতপুরাণে তাঁকে জৈনদর্শনের প্রতিষ্ঠাপক বলা হয়েছে এবং তিনি বিষ্ণুর চব্বিশটি অবতারের মধ্যে অন্যতম বলে পরিচিত। তিনি মনুবংশীয় নাভিরাজের পুত্র এবং তাঁর মায়ের নাম হচ্ছে মরুদেবী। এছাড়া যজুর্বেদে ঋষভ, অজিতনাথ ও অরিষ্টনেমি এই তিনজন তীর্থঙ্করের নাম উল্লেখ রয়েছে বলে জৈনদর্শনের অতীব প্রাচীনতার দাবী করা হয়। এদের মধ্যে অরিষ্টনেমি হচ্ছেন বাইশতম তীর্থঙ্কর, যাঁর অন্য নাম হচ্ছে নেমিনাথ।
.
জৈন ঐতিহ্যে যে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের পারম্পর্য উল্লেখ করা হয়, তাঁদের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেব আদিনাথ ও চব্বিশতম বা শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমান। এ দুয়ের মধ্যবর্তীরা হচ্ছেন- ২.অজিতনাথ, ৩.সম্ভবনাথ, ৪.অভিনন্দ, ৫.সুমতিনাথ, ৬.পদ্ম, ৭.প্রভু, ৮.সুপর্শ্বনাথ, ৯.চন্দ্রপ্রভু, ১০.সুরিধিনাথ, ১১.শিতলনাথ, ১২.শ্রেয়োনাথ, ১৩.বসুপুজ্য, ১৪.বিমলনাথ, ১৫.অনন্তনাথ, ১৬.ধর্মনাথ, ১৭.শান্তিনাথ, ১৮.কুন্থুনাথ, ১৯.অমরনাথ, ২০.মল্লিনাথ, ২১.মুনিসুব্রত, ২২.নেমিনাথ, ২৩.পার্শ্বনাথ। আদিনাথ ও বর্ধমানের মধ্যবর্তী তীর্থঙ্করদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক সত্যতা দাবী করা হয়।
.
তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ (৮১৭-৭৪৭ খ্রীষ্টপূর্ব) হলেন কাশীরাজ অশ্বসেনের পুত্র। তাঁর মায়ের নাম বামদেবী। জনশ্রুতি অনুযায়ী, পার্শ্বনাথ প্রচুর ঐশ্বর্য ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে কঠোর তপস্যার মাধ্যমে কৈবল্য লাভ করেন এবং সত্তর বছর বয়সে ছোটনাগপুরের পরেশনাথ পাহাড়ে নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন। পার্শ্বনাথের দুই শতকেরও অধিককাল পর চব্বিশতম তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমানের আবির্ভাব। মহাবীর বর্ধমানকেই জৈনমতের প্রধান প্রবর্তন হিসেবে গণ্য করা হয়। তীর্থঙ্কর বর্ধমানকে জৈনরা বলেন মহাবীর এবং বৌদ্ধরা বলেন নিগণ্ঠ নাতপুত্ত (নির্গ্রন্থ জ্ঞাতৃপুত্র)। গ্রন্থিহীন বা নির্গ্রস্থ বা নগ্ন অবস্থায় থাকতেন বলে মহাবীর বর্ধমানকে বৌদ্ধ ত্রিপিটকে পালি পরিভাষায় নিগণ্ঠ বলা হতো।
.
১.২ : বর্ধমান মহাবীর (৫৬৯-৪৮৫ খ্রীষ্টপূর্ব)
জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বর্ধমান মহাবীর জ্ঞাতৃপুত্র ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। জ্ঞাত্রিক অর্থ ক্ষত্রিয়। জ্ঞাতৃপুত্র মানে ক্ষত্রিয়-পুত্র। বৌদ্ধ ত্রিপিটকে পালি পরিভাষায় যাকে বলা হয় নাতপুত্ত বা নাথপুত্ত। নাথ মানে প্রভাবশালী বা প্রভুস্থানীয়। বুদ্ধের জন্মের কিছু আগে প্রাচীন বজ্জী (মজঃফরপুর, বিহার) প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বৈশালীতে (বর্তমান বসরা, পাটনার নিকটবর্তী) লিচ্ছবিদের একটি শাখার জ্ঞাতৃবংশে মহাবীরের জন্ম। তাঁর পিতা মগধরাজ সিদ্ধার্থ। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে মহাবীরের পিতা সিদ্ধার্থ ছিলেন গণসংস্থার একজন সদস্য। কারণ তৎকালীন প্রজাতন্ত্রগুলি গণসংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তাঁর মা ছিলেন লিচ্ছবীপ্রধান চেটকের বোন ত্রিশালা। তাঁর পত্নীর নাম ছিলো যশোদা এবং তিনি একটি কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন।
.
মাতা-পিতার দেহত্যাগের পর আটাশ বছর মতান্তরে ত্রিশ বছর বয়সে বর্ধমান গৃহত্যাগ করে আধ্যাত্মচর্চা শুরু করেন। প্রথমে তিনি পার্শ্বনাথের প্রবর্তিত নির্গ্রন্থ তপস্বিসঙ্ঘের যতিধর্ম (=সন্ন্যাস) গ্রহণ করেন। বারো বছর কৃচ্ছ্রসাধনের পর তিনি কেবলপদ অর্থাৎ সর্বজ্ঞতা প্রাপ্ত হন। এই বারো বছর তিনি ভিক্ষা গ্রহণ করে নিদিধ্যাসন ও নানা প্রকার তপশ্চরণের দ্বারা শরীরকে ক্লিষ্ট করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে বেড়ান। তপশ্চরণের প্রথম দিকে তিনি একটি কাপড় পরতেন এবং তেরো মাস পর সেই কাপড়টিও পরিত্যাগ করে একেবারে নগ্নভাবে অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন।
.
এই বারো বছরের তপশ্চরণকালে প্রথম ছয় বছর মক্ষলি গোশাল নামে অন্য একজন তাপসের সাথে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যা করতে থাকেন। গোশালও গ্রন্থিহীন বা নগ্ন তাপস ছিলেন বলে জানা যায়। এরপর তাঁদের উভয়ের মধ্যে বিবাদ হলে মক্ষলি গোশাল বর্ধমানকে ত্যাগ করে আজীবক নামে স্বতন্ত্র একটি সম্প্রদায় প্রবর্তন করেন। পরবর্তী ছয়টি বছরও এই নির্গ্রন্থ বা গ্রন্থিহীন বা বাঁধহীন অবস্থায় তপস্যা করার পর সত্যজ্ঞান লাভ করে কেবলী বা সর্বজ্ঞ, জিন বা জিতেন্দ্রিয় ও মহাবীর নামে খ্যাত হন। নিজের বীর্যের দ্বারা রাগদ্বেষ প্রভৃতি জয় করায় তিনি এই মহাবীর আখ্যা পান।
.
এরপর মহাবীর পরবর্তী তিরিশ বছর মধ্যপ্রদেশের গাঙ্গেয় সমতলভূমির রাজ্য বিশেষ করে বিহার ও উত্তরপ্রদেশে নিজের ধর্মমত ও উপদেশ বিতরণ করেন। ৮৪ বছর বয়সে মগধের রাজধানী পাবা নগরীতে (কুশীনগরের উত্তরে বর্তমান গোরক্ষপুর) কার্তিক মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীর অমাবস্যা রাতে তাঁর দেহান্ত হয়। বর্ধমান মহাবীরের জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বেশ মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কারো মতে মহাবীরের পরিনির্বাণ হয় ৫২৭ খ্রীষ্টপূর্ব। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে বর্ধমান মহাবীরের জন্ম ৫৬৯ খ্রীষ্টপূর্ব ও মৃত্যু ৪৮৫ খ্রীষ্টপূর্ব। আবার কেউ বলেন জন্ম ৫৪০ খ্রীষ্টপূর্ব ও মৃত্যু ৪৬৮ খ্রীষ্টপূর্ব। তবে গৌতম বুদ্ধের (৫৬৩-৪৮৩ খ্রীষ্টপূর্ব) সময়কালের বিবেচনায় নিলে প্রথমোক্ত সময়কালকেই বুদ্ধপূর্ব মহাবীরের জীবনকাল হিসেবে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। কেননা এটা স্বীকৃত যে, বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরই মহাবীরের দেহান্ত হয়।
.
১.৩ : জৈন ধর্মপ্রসার
প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরায় এ বিশ্বাস স্বতঃসিদ্ধ ছিলো যে, কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা দৈহিক কামনা-বাসনার দমনের মাধ্যমে সাধারণ মানবিক স্পৃহা ও দুর্বলতা দূরীকরণ এবং মনঃসংযোগের শক্তিবৃদ্ধি করতে হয়। এ ধারাতেই মহাবীরের সন্ন্যাস জীবনে শরীরকে কঠোরভাবে ক্লিষ্ট করা তপস্যা এবং তার মাধ্যমে ধ্যানমগ্ন হয়ে নতুন ধর্মমত দানা বাঁধতে থাকে। কেবলপদ লাভ করে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে সেই নীতি প্রচার করতে থাকেন। প্রথম দিকে শুধুমাত্র বিহারে তাঁর ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং বহু প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষক পেয়েছিলেন তিনি। পরে তা ভারতের বিভিন্ন অত্যন্ত-প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতে নির্গ্রন্থ এ তপস্বী ‘মহাবীর’ ও ‘জিন’ (=বিজয়ী) নামে পরিচিত হয়ে ওঠলে তাঁর ধর্মমত জৈনধর্ম দর্শন নামে খ্যাত হয়। বহু সন্ন্যাসী তাঁর অনুগামী হলেও অসংখ্য গৃহীও তাঁর শিষ্য হতে থাকেন। এই গৃহী শিষ্যরা বিষয়-সম্পত্তি বা পরিবার-পরিজন ত্যাগ না করলেও জৈনধর্মের বিধিবদ্ধ সুনির্দিষ্ট আচারানুষ্ঠান মেনে চলতেন। ফলে পরবর্তীকালে এ ধর্ম বিস্তৃতি লাভ করে ভারতের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ স্থান গ্রহণ করে। তাই সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্ম-দর্শন হিসেবে বৌদ্ধ ত্রিপিটকে এই জৈনমতের সরব ও কটাক্ষপূর্ণ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
.
কঠোর তপস্যা, সংযম ও অহিংসাই ছিলো বর্ধমান মহাবীরের মূল শিক্ষা। তাঁর প্রধান শিক্ষাকে বৌদ্ধ ত্রিপিটকের দীঘনিকায়ে উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে-
“নিগণ্ঠ (জৈন সাধু)-গণ চার প্রকার সম্বর (সংযম) দ্বারা নিজেদের সংবৃত্ত রাখেন। (১) নিগণ্ঠগণ জল ব্যবহারে নিষেধ করেছেন (যাতে জলের প্রাণী না নিহত হয়); (২) সমস্ত পাপ কর্ম থেকেই বিরত থাকার শিক্ষা তাঁরা দিয়েছেন; (৩) সকল পাপের নিষেধ করায় তাঁরা পাপরহিত হন; (৪) নিগণ্ঠ সমস্ত পাপের বিপক্ষে থাকেন। …যদি নিগণ্ঠ এই চতুর্সংযমে সম্বৃত থাকেন তবে তাঁকে …গতাত্মা (অনিচ্ছুক), যতাত্মা (সংযমী) এবং স্থিতাত্মা বলা হয়।” (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
.
বৌদ্ধ ত্রিপিটক অনুযায়ী জৈনমতে তীর্থঙ্করকে সর্বজ্ঞ বলে জোর দেওয়া হয়েছে- ‘তীর্থঙ্কর সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, সমুদয় জ্ঞান এবং দর্শনকে জানেন। চলনে, উপবেশনে, শয়নে, জাগরণে সদা নিরন্তর জ্ঞান উপস্থিত থাকে।’
এই সর্বজ্ঞতাকে বিদ্রুপ করে বুদ্ধের শিষ্য আনন্দ বলেন- “…(তবুও) তাঁরা শূন্য ঘরে যান, সেখানে ভিক্ষাও পান না, কুকুরও তাড়া করে, উন্মত্ত হস্তী …অশ্ব …ভয়ঙ্কর ষণ্ডেরও সম্মুখীন হন। (সর্বজ্ঞ হয়েও) স্ত্রী-পুরুষের নাম জিজ্ঞাসা করেন, গ্রাম নগরের ঠিকানা ও পথের হদিস জানতে চান। (আপনারা তো সর্বজ্ঞ) তবে কেন প্রশ্ন করেন- জিজ্ঞাসা করলে বলেন- ‘শূন্য ঘরে যাওয়া …ভিক্ষা না পাওয়া …কুকুরের তাড়া খাওয়া …হস্তী …অশ্ব …ষাঁড়ের সামনে পড়া অদৃষ্টাধীন।’…”
‘সুখ হতে সুখ প্রাপ্য নয়, দুঃখ থেকেই সুখ প্রাপ্য’- এ ভিত্তিতে বর্ধমান
মহাবীরের বিশ্বাস ছিলো যে, দৈনিক দুঃখভোগই পাপক্ষালন এবং কৈবল্যসুখ
প্রাপ্তির সাধন। কায়িক তপস্যা যথা আমরণ অনশন, শীত-গ্রীষ্মে নগ্ন হয়ে
কৃচ্ছ্রসাধন জৈন-আগমে বহুল প্রচলিত ছিলো। তাই বৌদ্ধ ত্রিপিটকের মজ্ঝিমনিকায়
(১/২/৪) জৈন সাধুদের তপস্যা এবং তার ঔচিত্যের বর্ণনায় দেখা যায় বুদ্ধ
মহানাম শাক্যকে বলছেন-
“মহানাম ! একদা আমি রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করছিলাম। তখন বহুসংখ্যক নিগণ্ঠ সাধু গিরির কালোশিলার ওপর দণ্ডায়মান হয়ে তপস্যার দ্বারা দুঃখ-কষ্ট-বেদনার তীব্রতাকে উপলব্ধি করছিলেন। …(কারণ জিজ্ঞাসা করলে) তাঁরা বললেন- ‘নিগণ্ঠ নাতপুত্ত সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, …। তিনি বলেছেন …নিগণ্ঠগণ! তোমাদের পূর্বকৃত পাপকে এই দুষ্কর তপস্যার দ্বারা নাশ করো। যারা কায়মনোবাক্যে সংযমী তারা ভবিষ্যতে কোনো পাপ করবে না এই প্রকার তপস্যা দ্বারা পুরানো কর্মের সমাপ্তি ঘটিয়ে এবং নতুন কোনো ধর্ম গ্রহণ না করলে, ভবিষ্যতে চিত্ত নির্মল হয়ে যাবে। অনাসক্তি থেকেই ভবিষ্যতে কর্মক্ষয় হবে, তা থেকে দুঃখক্ষয়, তা থেকে বেদনাক্ষয়, এবং শেষে সকল দুঃখ নাশ হয়ে যাবে।’…”
বুদ্ধ তাঁদের প্রশ্ন করেন- “তোমরা কি প্রথমে আত্মোপলব্ধি করেছো ? সে সময় কি কোনো পাপ কর্ম করেছো ? জানতে পেরেছো কি, কতোটা পাপক্ষয় হয়েছে কতোটা বাকি আছে ? ইহজন্মেই পাপ নাশ হয়ে পুণ্যলাভ হবে কি-না তা কি তোমরা নিশ্চিত জানো ?” নিগণ্ঠগণ এই প্রশ্ন সমুদয়ের প্রত্যেকটিরই উত্তর দেন ‘না’। অতঃপর বুদ্ধ বলেন- “এইভাবেই পৃথিবীতে যাদের ভয়ঙ্কর স্বভাব, রক্তরঞ্জিত যাদের হাত, ক্রূরকর্মা, তারাই নিগণ্ঠ সাধু সাজে।” (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
.
সমকালীন প্রচলিত ধর্ম ও দর্শন হিসেবে জৈনমতকে উদ্দেশ্য করে বৌদ্ধ ত্রিপিটকে তীব্র কটাপূর্ণ উদ্ধৃতির এসব বর্ণনা থেকে আমরা নির্দ্বিধায় ধারণা করে নিতে পারি সে সময়ে জৈনধর্ম ও দর্শন ভারতীয় সামাজিক জীবনে কতোটা প্রভাব বিস্তার করেছিলো। প্রাচীন জৈনদর্শন মতে, জল মাটি প্রভৃতি সকল জড়-অজড় উপাদানই আত্মায় পূর্ণ; সকল প্রকার হিংসা থেকে মানুষকে রক্ষা করা দরকার। তাই মহাবীর জলের ব্যবহার তথা চলা-ফেরা করা প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই কঠিন প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেছিলেন বলে এরই পরিণাম হিসেবে শস্য কাটা, নিড়ানি দেওয়া ইত্যাদি কাজে অসংখ্য জীবকে মরতে দেখে জৈনগণ কৃষিকার্য ছেড়ে দেয়। ফলে বণিক সম্প্রদায়ে ধীরে ধীরে জৈন মতাবলম্বী বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন মন্তব্য করেন-
‘ইউরোপে ইহুদীগণ রাজশক্তি কর্তৃক কৃষিকার্যে বঞ্চিত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য গ্রহণ করে, কিন্তু ভারতীয় জৈনগণ তা করে স্বধর্ম প্রেরিত হয়ে স্বেচ্ছাপূর্বক। মানুষের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে কিভাবে ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে শ্রম ও উৎপাদন থেকে সরিয়ে এনে শ্রম-বিমুখ জাতিতে পরিণত করা যায় এ তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ।’
পরবর্তীকালে প্রতিভাবান জৈন দার্শনিকদের কল্যাণে বিকশিত জৈনদর্শন তার সমৃদ্ধ তর্ক ও প্রমাণশাস্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় দার্শনিক সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হলেও জৈনদের বিরাট অংশ একে একে শেষপর্যন্ত নবদীক্ষিত বৌদ্ধধর্মে মিশে যায়।
.
১.৪ : জৈন সম্প্রদায়
জৈনরা বেদও মানেন না, ঈশ্বরও নয়। প্রত্যেক জীবই জিনদের পন্থা অনুসরণ করে বন্ধনমুক্ত হতে পারে বলে তাঁদের বিশ্বাস। দার্শনিক দৃষ্টিতে জৈনদের নিজেদের মধ্যে কোন ভেদ না থাকলেও পরবর্তীকালে জৈনধর্ম দু’টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায় আচারগত দৃষ্টিতে কিছুটা ভিন্নতা সৃষ্টি হওয়ায়। জৈনমতের এই দু’টি অবান্তর ভেদ হচ্ছে- শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর।
দিগম্বর সম্প্রদায়ের যতি বা সন্ন্যাসীরা নিজ শরীরের আচ্ছাদনের জন্য বস্ত্রের উপযোগ গ্রহণ করেন না, তাঁরা সর্বদা নগ্ন থাকেন। কিন্তু শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের যতিরা সাদা বস্ত্র পরিধান করেন। আচারগত ধর্মানুষ্ঠানের খুঁটিনাটি ভিন্নতা ছাড়া উভয় সম্প্রদায়ের মূল ধর্মসূত্র অভিন্ন।
.
নিজ নিজ প্রাচীনত্ব নিয়েও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ই নিজেদেরকে প্রাচীন বলে প্রচার করেন। দিগম্বররা বলেন, ৭৯ খ্রীষ্টাব্দে শ্বেতাম্বরের উৎপত্তি। কিন্তু শ্বেতাম্বররা মনে করেন, ৮২ খ্রীষ্টাব্দে দিগম্বর সম্প্রদায়ের উদ্ভব। শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের অনুশ্রুতি অনুসারে বর্ধমান মহাবীরের পরিনির্বাণের (৫২৭ খ্রীষ্টপূর্ব) ৬০৯ বর্ষ পর ৮২ খ্রীষ্টাব্দে শিবভূতি নামে এক আচার্য ছিলেন যাকে আর্যরক্ষিত জৈনধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। একদা শিবভূতির নিবাসস্থান রথবীরপুরের রাজা শিবভূতিকে একটি মহামূল্য পোশাক উপহার দেন। মুনি আর্যরক্ষিত তাঁর শিষ্যকে সেই পোশাক পরিহিত দেখে তা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেন। গুরুর অভিপ্রায় বুঝে শিবভূতি নির্বসন হয়েই অবস্থান করেন। এথেকেই দিগম্বর সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
.
তবে এটাও জানা যায় যে, পার্শ্বনাথ বস্ত্র পরিধানের বিরোধী ছিলেন না। তিনি শ্বেত বস্ত্র পরিধান অনুমোদন করতেন। কিন্তু মহাবীর বর্ধমান অত্যন্ত বৈরাগ্যবান হওয়ায় বস্ত্র পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর মতে নগ্ন থাকাই যতির আদর্শ। এসব ঘটনা থেকে অনুমান হয়, পরবর্তীকালের বিভক্ত শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর নামক জৈন সম্প্রদায়ের ভেদবীজ বহুপূর্ব থেকেই সুপ্তভাবে বর্তমান ছিলো।
পার্শ্বনাথ অহিংসা (non-violence), সত্য (truthfulness), অস্তেয় (non-stealing) ও অপরিগ্রহ (non-attachment) এই চারটি মহাব্রত স্বীকার করতেন। মহাবীর এর সাথে ব্রহ্মচর্য (celibacy)-কে অন্তর্ভুক্ত করে পাঁচটি মহাব্রত (five great vows) স্বীকার করেছেন, যা সম্যক চরিত্রের জন্য পালন করতে হয়।
.
মহাবীরের পরিনির্বাণের পরে দুইশ’ বছর পর্যন্ত ভিক্ষুগণ ক্ষুদ্র একটি গণ বা সঙ্ঘে থাকতেন। মৌর্যযুগে জৈনধর্মের ব্যাপক প্রচার হয়েছিলো বলে জানা যায়। জৈনমত অনুসারে বলা হয়, ক্রমাগত অনাবৃষ্টির দরুন নিদারুণ দুর্ভিক্ষ হলে রাজত্ব ত্যাগ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২৪-৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব) জৈনধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। সেই সময় এক নাগাড়ে ১২ বছর দুর্ভিক্ষ হলে জৈন ভিক্ষুদের এক অংশ আচার্য ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চল ছেড়ে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে নিষ্ক্রমণ করেন। অন্যেরা স্থূলভদ্রের পরিচালনায় মগধে থেকে যান।
.
সেই নিষ্ক্রমণ হতে ভিক্ষুদের নিয়মাবলী নিয়ে জৈনমতে বিভাগ দেখা দিয়েছিলো। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে জৈনসঙ্ঘের নেতা সঙ্ঘভদ্রের পরিশোধিত আচার গ্রহণ করেই শ্বেতাম্বরগণ দিগম্বর হতে পৃথক হন। মানুষের দুর্বলতার ধরন ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নিরীক্ষণ করে এবং উগ্র তপস্যা ও কঠোর আচার পালনাদি সম্ভব নয় ভেবে সঙ্ঘভদ্র সর্বজনের পালনীয়রূপে আচারের কিছু সংশোধন করেন। সেই সময় থেকেই মূলত দু’টি সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে পড়ে। তখন মগধে অবস্থিত জৈনসঙ্ঘের নেতা স্থূলভদ্র দুর্ভিক্ষের দরুন ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ভিক্ষুদের শ্বেতবস্ত্র পড়তে অনুমতি দেন। দুর্ভিক্ষের পর ভদ্রবাহু মগধে ফিরে আসলে যারা পূর্বের মতো শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতেন তারা শ্বেতাম্বর নামে অভিহিত হন। আর যারা নগ্ন থাকতেন ও দার পরিগ্রহণ করতেন না তারা দিগম্বর সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হন। তখন থেকেই প্রাকৃতিক কারণে দিগম্বর সম্প্রদায় দক্ষিণ ভারতে এবং শ্বেতাম্বর সম্প্রদায় উত্তর ভারতে প্রাধান্য পায়।
.
জৈনদের মৌলিক বিষয়ে কোন ভেদ না থাকলেও কিছু অদ্ভুত গৌন আচার বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্নতা ছিলো। যেমন ধূলি পরিষ্কারক সম্মার্জনী ধারণকারী যিনি ভিক্ষান্ন ভোজন ও কেশমুণ্ডন করেন, সেই ক্ষমাশীল আসক্তিশূন্য জৈনমুনি শ্বেতাম্বর। অন্যদিকে মুণ্ডিতমস্তক, সম্মার্জনী ধারণকারী যিনি নিজের হাতকেই পাত্ররূপে ব্যবহার করে দাতৃগৃহে উর্ধ্বমুখে আহার করেন তিনি হচ্ছেন দিগম্বর জৈনঋষি। দিগম্বরমতে তীর্থঙ্করগণ কোন বস্তু সংগ্রহ করেন না এবং কেবল-জ্ঞানী বলে ভোজন না করেই বাস করেন। তাঁদের মতে বস্ত্রধারী সম্পত্তিযুক্ত সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু মোলাভে অধিকারী নয় এবং স্ত্রীর মোক্ষপ্রাপ্তির যোগ্যতার জন্য পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করা আবশ্যক।
বিপরীতে শ্বেতাম্বর সম্প্রদায় এতোটা কঠোর নয়। তাঁরা শ্বেতবস্ত্র ধারণকে অনিবার্য মনে করেন। তাঁদের মতে মহাবীরের শিষ্যদের মধ্যে স্ত্রী পুরুষ, গৃহী, ভিক্ষু সকলেই ছিলো। শিষ্যরা সঙ্ঘ গঠন করে একাদশ গণে বিভক্ত হয়ে অপসর নামক আশ্রমে বসবাস করতো। প্রত্যেক গণে একজন গণধর নামে নেতা থাকতো বলেও উল্লেখ আছে।
.
মহাবীরের পরিনির্বাণের পর তাঁর প্রধান অনুগামীরা দীর্ঘকাল যাবৎ সঙ্ঘকে রক্ষা করেছিলেন। ৩১৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ভদ্রবাহু এবং ৩১০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে স্থূলভদ্র সঙ্ঘপ্রধান হয়েছিলেন বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে সময়কাল নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা যায়। কেননা জৈনদের ‘পট্টাবলি’ অনুসারে স্থূলভদ্রের পরলোক গমন নন্দ বংশের নবম নন্দের মৃত্যুকালে (৩২৭ খ্রীষ্টপূর্ব) হয়েছে বলে বলা হয়। এছাড়া ভদ্রবাহুর সময়কালও ৪৩৩-৩৫৭ খ্রীষ্টপূর্ব হিসেবে জানা যায়। সে যাক, আচার্য স্থূলভদ্রের নেতৃত্বে জৈনশাস্ত্র সংগ্রহ হয়েছিলো। এই সন্ধিক্ষণেই জৈনরা দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর এ দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। সেই থেকে এরপর সতেরো শ’ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রখ্যাত জৈনপণ্ডিত দার্শনিকগণ কর্তৃক বিভিন্ন জৈনগ্রন্থ রচিত হয়।
.
১.৫ : জৈন সাহিত্য
জৈনাচার্যদের মতে জৈনধর্ম চিরন্তন। প্রবহমান কালস্রোতে বহু তীর্থঙ্কর এসেছেন এবং জৈনমত উজ্জীবিত করেছেন। এ পরম্পরায় উল্লেখকৃত চব্বিশজন তীর্থঙ্করের চব্বিশতম ও অন্তিম তীর্থঙ্কর হচ্ছেন মহাবীর বর্ধমান। জৈন ঐতিহ্য থেকে জানা যায়, মহাবীরের সময়কাল থেকে জৈনাচার্য ভদ্রবাহুর (৪৩৩-৩৫৭ খ্রীষ্টপূর্ব) সময় পর্যন্ত প্রায় দু’শতক জৈনসাহিত্য জৈনভিক্ষুদের শ্রুতিপরম্পরায় প্রচলিত ছিলো। আবার জৈন অনুশ্রুতি থেকে এও জানা যায় যে, ইন্দ্রভূতি গৌতম (৬০৭-৫১৫ খ্রীষ্টপূর্ব) নামে মহাবীরের শিষ্য জৈনধর্মের মূল বিষয়গুলি যা ‘চতুর্দশপূর্ব’ নামে পরিচিত, তা ‘দৃষ্টিবাদ’ নামক আগম বা সিদ্ধান্ত গ্রন্থে সঙ্কলন করেছিলেন। জৈনদের ‘পট্টাবলি’ অনুসারে আচার্য স্থূলভদ্রের (মৃত্যু ৩২৭ খ্রীষ্টপূর্ব) কাল পর্যন্ত গ্রন্থটি বিদ্যমান ছিলো। এরপর গ্রন্থটি বিলুপ্ত হয়। এখানে উল্লেখ্য, অনুশ্রুতি অনুযায়ী উল্লিখিত জৈনাচার্যদের সময়কাল ও অনুমিত সালগননায় পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তি, গরমিল ও বিতর্ক থাকলেও প্রাচীনত্ব অনুমানে সন্দেহ নেই।
.
‘সিদ্ধান্ত’— বা ‘আগম’ হচ্ছে জৈনদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। প্রথমতম লেখক হচ্ছেন আচার্য ভদ্রবাহু। তিনি দশাবয়ব ন্যায়ের প্রবর্তক। জৈন তর্কশাস্ত্রের বিধি নিয়ে রচিত ‘দশবৈকালিকসূত্রে’র উপর প্রাকৃত ভাষায় তিনি ‘দশবৈকালিকনির্যুক্তি’ নামক ব্যাখ্যা বা ভাষ্য রচনা করেন। তিনি ‘জৈনশ্রুতকেবলী’ অর্থাৎ দৃষ্টিবাদের ‘চতুর্দশপূর্বে’র তত্ত্বজ্ঞ ছিলেন। তিনি আবশ্যকসূত্র, উত্তরধ্যানসূত্র, আচারসুত্র ও কল্পসূত্রের ব্যাখ্যা লিখেন এবং সূত্রকৃতাঙ্গনির্যুক্তিতে স্যাদ্বাদের বিশদ ব্যাখ্যা করেন।
.
৩৫৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আচার্য ভদ্রবাহুর পরলোক গমনের পর আচার্য স্থূলভদ্র পাটলিপুত্রে একটি সভা আহ্বান করেন। তাতে একাদশটি অঙ্গ পুনরায় স্থিরীকৃত হয় এবং দ্বাদশতম অঙ্গ ‘চতুর্দশপূর্ব’ দ্বারা গঠিত হয়। এ সময়েই জৈনরা শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়, যা ইতঃপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। এ সভায় পুনঃসংগঠিত জৈন শাস্ত্রগুলি শ্বেতাম্বরগণ গ্রহণ করেন। কিন্তু দিগম্বরগণ বলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে, তার পুনর্রচনায় যত্নশীল হতে হবে।
.
শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর সম্প্রদায়ের মতপার্থক্য দূর করার জন্য পঞ্চম শতাব্দীতে (৪৫৪ খ্রীষ্টাব্দ) দেবর্দ্ধিগণির সভাপতিত্বে গুজরাটের বল্লভীরূপে একটি সভা আহূত হয়। তিনি সর্বপ্রথম জৈন সম্প্রদায়ের মূলসূত্রগুলিকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায়। পূর্বে সংগৃহীত দ্বাদশ অঙ্গ ছিন্নভিন্ন হওয়ায় তাঁর লিপিবদ্ধ এগারোটি অঙ্গ এই সভায় গৃহীত হয়, যা এখনো প্রচলিত আছে। সভায় চুরাশিটি (৮৪) সাহিত্য অনুমোদিত হয়েছিলো। এর মধ্যে ৪১ টি সূত্রগ্রন্থ, ১২ টি নির্যুক্তি, ১ টি মহাভাষ্য, ১০ টি প্রকীর্ণ, ৬ টি ছেদসূত্র, ৪ টি মূলসূত্র, ১ টি অন্তযোগদ্বারসূত্র এবং ১ টি নন্দীসূত্র।
.
৪১ টি সূত্রকে আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন ১১ টি অঙ্গ, ১২ টি উপাঙ্গ, ৬ টি ছেদ, ৪ টি মূল এবং ৮ টি বিবিধ।
এগারোটি অঙ্গসূত্র হচ্ছে- (১) আচারাঙ্গসূত্র, (২) সূত্র (সৌত্র্য) কৃতাঙ্গ, (৩) স্থানাঙ্গ, (৪) সমবায়াঙ্গ, (৫) ভগবতী, (৬) জ্ঞাতৃধর্ম কথা, (৭) উপাসকদশা, (৮) অন্তকৃদ্দশা, (৯) অনুত্তরৌপপাতিকদশা, (১০) প্রশ্নব্যাকরণ, (১১) বিপাকশ্রুত।
বারোটি উপাঙ্গ হচ্ছে- (১) ঔপপাতিক, (২) রাজপ্রশ্নীয়, (৩) জীবাভিগম, (৪) প্রজ্ঞাপনা, (৫) জম্বুদ্বীপপ্রজ্ঞপ্তি, (৭) সূর্যপ্রজ্ঞপ্তি, (৮) নিরয়াবলি, (৯) কল্পাবতংসিকা, (১০) পুষ্পিকা, (১১) পুষ্পচুলিকা, (১২) বন্দিদশা।
দশটি প্রকীর্ণ হচ্ছে- (১) চতুঃশরণ, (২) সংস্তরক, (৩) আতুরপ্রত্যাখ্যান, (৪) ভক্তাপরিজ্ঞা, (৫) তণ্ডুলবৈয়াসীয়, (৬) চন্দ্রবেধ্যক, (৭) দেবেন্দ্রস্তব, (৮) পণিবীজ্জা, (৯) মহাপ্রত্যাখ্যান, (১০) বীরস্তব।
ছয়টি ছেদসূত্র হচ্ছে- (১) নিশীথ, (২) মহানিশীথ, (৩) ব্যবহার, (৪) দশাশ্রুতস্কন্ধ, (৫) বৃহৎকল্প, (৬) পঞ্চকল্প।
চারটি মূলসূত্র হচ্ছে- (১) উত্তরাধ্যয়ন, (২) দশবৈকালিক, (৩) আবশ্যক, (৪) পিণ্ডনির্যুক্তি।
.
প্রাচীন এই জৈনগ্রন্থগুলির ভাষা অর্ধমাগধী প্রাকৃত। মহাবীর এ ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। পরবর্তীকালে জৈনদার্শনিকরা দার্শনিক তত্ত্বালোচনার লক্ষ্যে সংস্কৃত ভাষাকে প্রাধান্য দেন। প্রথম খ্রীষ্টাব্দ হতে জৈনগণ গ্রন্থ রচনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করতেন। এই দার্শনিক আলোচনার প্রয়োজনেই অন্যান্য শাস্ত্রের আলোচনাও লিখিত হতে থাকে। তাই জৈনদের বারোটি উপাঙ্গের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম উপাঙ্গে গণিত, জ্যোতিষ, ভূগোল প্রভৃতি শাস্ত্রের আলোচনা রয়েছে। দিগম্বরমতে ৫৭ খ্রীষ্টাব্দে জৈনশাস্ত্র লিখিত হয়েছে। এরপর থেকে জৈনশাস্ত্রে সাতটি তত্ত্ব, নয়টি পদার্থ, ছয়টি দ্রব্য, পঞ্চ অস্তিকায় প্রভৃতি আলোচনা শুরু হয়।
.
দর্শনের প্রমাণশাস্ত্র ও তর্কশাস্ত্রে জৈনদর্শনের অবদান অপরিসীম। জৈনদার্শনিকরা ধর্ম দর্শন নীতি এবং এই প্রমাণ বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রখ্যাত সেসব জৈনদার্শনিকরা হলেন কুন্দকুন্দাচার্য (৫০ খ্রীষ্টপূর্ব), ‘বাচক শ্রবণ’ নামে খ্যাত উমাস্বাতি বা উমাপতি (০১-৮৫ খ্রী.), সমন্তভদ্র (ষষ্ঠ শতক), অকলঙ্কদেব (ষষ্ঠ শতক), বিদ্যানন্দ (অষ্টম শতক), প্রভাচন্দ্র (৮২৫ খ্রী.), মানিক্যনন্দী (৭৫০-৮০০ খ্রী.), অভয়দেব সূরি (নবম শতক), অনন্তবীর্য (একাদশ শতক), হেমচন্দ্র সূরি (১০৮৮-১১৭২ খ্রী.), চন্দ্রপ্রভ (১১০০ খ্রী.), ‘কলিকাল গৌতম’ নামে খ্যাত হরিভদ্র সূরি (দ্বাদশ শতক), মল্লিসেন (১২৯২ খ্রী.), রাজশেখর সূরি (১৩৮৪ খ্রী.), যশোবিজয়গণি (১৬০৮-১৬৮৮ খ্রী.) প্রমুখ। দর্শনশাস্ত্র তাঁদের মহত্তপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ।
…
(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
…
[*] [পরের পর্ব: দার্শনিক সিদ্ধান্ত- অনেকান্তবাদ]
[সহায়ক-গ্রন্থসূচি].[জৈনদর্শন:অধ্যায়সূচি]
…
জৈনাচার্যদের মতে জৈনধর্ম চিরন্তন। প্রবহমান কালস্রোতে বহু তীর্থঙ্কর এসেছেন এবং জৈনমত উজ্জীবিত করেছেন। এ পরম্পরায় উল্লেখকৃত চব্বিশজন তীর্থঙ্করের চব্বিশতম ও অন্তিম তীর্থঙ্কর হচ্ছেন মহাবীর বর্ধমান। জৈন ঐতিহ্য থেকে জানা যায়, মহাবীরের সময়কাল থেকে জৈনাচার্য ভদ্রবাহুর (৪৩৩-৩৫৭ খ্রীষ্টপূর্ব) সময় পর্যন্ত প্রায় দু’শতক জৈনসাহিত্য জৈনভিক্ষুদের শ্রুতিপরম্পরায় প্রচলিত ছিলো। আবার জৈন অনুশ্রুতি থেকে এও জানা যায় যে, ইন্দ্রভূতি গৌতম (৬০৭-৫১৫ খ্রীষ্টপূর্ব) নামে মহাবীরের শিষ্য জৈনধর্মের মূল বিষয়গুলি যা ‘চতুর্দশপূর্ব’ নামে পরিচিত, তা ‘দৃষ্টিবাদ’ নামক আগম বা সিদ্ধান্ত গ্রন্থে সঙ্কলন করেছিলেন। জৈনদের ‘পট্টাবলি’ অনুসারে আচার্য স্থূলভদ্রের (মৃত্যু ৩২৭ খ্রীষ্টপূর্ব) কাল পর্যন্ত গ্রন্থটি বিদ্যমান ছিলো। এরপর গ্রন্থটি বিলুপ্ত হয়। এখানে উল্লেখ্য, অনুশ্রুতি অনুযায়ী উল্লিখিত জৈনাচার্যদের সময়কাল ও অনুমিত সালগননায় পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তি, গরমিল ও বিতর্ক থাকলেও প্রাচীনত্ব অনুমানে সন্দেহ নেই।
.
‘সিদ্ধান্ত’— বা ‘আগম’ হচ্ছে জৈনদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। প্রথমতম লেখক হচ্ছেন আচার্য ভদ্রবাহু। তিনি দশাবয়ব ন্যায়ের প্রবর্তক। জৈন তর্কশাস্ত্রের বিধি নিয়ে রচিত ‘দশবৈকালিকসূত্রে’র উপর প্রাকৃত ভাষায় তিনি ‘দশবৈকালিকনির্যুক্তি’ নামক ব্যাখ্যা বা ভাষ্য রচনা করেন। তিনি ‘জৈনশ্রুতকেবলী’ অর্থাৎ দৃষ্টিবাদের ‘চতুর্দশপূর্বে’র তত্ত্বজ্ঞ ছিলেন। তিনি আবশ্যকসূত্র, উত্তরধ্যানসূত্র, আচারসুত্র ও কল্পসূত্রের ব্যাখ্যা লিখেন এবং সূত্রকৃতাঙ্গনির্যুক্তিতে স্যাদ্বাদের বিশদ ব্যাখ্যা করেন।
.
৩৫৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আচার্য ভদ্রবাহুর পরলোক গমনের পর আচার্য স্থূলভদ্র পাটলিপুত্রে একটি সভা আহ্বান করেন। তাতে একাদশটি অঙ্গ পুনরায় স্থিরীকৃত হয় এবং দ্বাদশতম অঙ্গ ‘চতুর্দশপূর্ব’ দ্বারা গঠিত হয়। এ সময়েই জৈনরা শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়, যা ইতঃপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। এ সভায় পুনঃসংগঠিত জৈন শাস্ত্রগুলি শ্বেতাম্বরগণ গ্রহণ করেন। কিন্তু দিগম্বরগণ বলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে, তার পুনর্রচনায় যত্নশীল হতে হবে।
.
শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর সম্প্রদায়ের মতপার্থক্য দূর করার জন্য পঞ্চম শতাব্দীতে (৪৫৪ খ্রীষ্টাব্দ) দেবর্দ্ধিগণির সভাপতিত্বে গুজরাটের বল্লভীরূপে একটি সভা আহূত হয়। তিনি সর্বপ্রথম জৈন সম্প্রদায়ের মূলসূত্রগুলিকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায়। পূর্বে সংগৃহীত দ্বাদশ অঙ্গ ছিন্নভিন্ন হওয়ায় তাঁর লিপিবদ্ধ এগারোটি অঙ্গ এই সভায় গৃহীত হয়, যা এখনো প্রচলিত আছে। সভায় চুরাশিটি (৮৪) সাহিত্য অনুমোদিত হয়েছিলো। এর মধ্যে ৪১ টি সূত্রগ্রন্থ, ১২ টি নির্যুক্তি, ১ টি মহাভাষ্য, ১০ টি প্রকীর্ণ, ৬ টি ছেদসূত্র, ৪ টি মূলসূত্র, ১ টি অন্তযোগদ্বারসূত্র এবং ১ টি নন্দীসূত্র।
.
৪১ টি সূত্রকে আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন ১১ টি অঙ্গ, ১২ টি উপাঙ্গ, ৬ টি ছেদ, ৪ টি মূল এবং ৮ টি বিবিধ।
এগারোটি অঙ্গসূত্র হচ্ছে- (১) আচারাঙ্গসূত্র, (২) সূত্র (সৌত্র্য) কৃতাঙ্গ, (৩) স্থানাঙ্গ, (৪) সমবায়াঙ্গ, (৫) ভগবতী, (৬) জ্ঞাতৃধর্ম কথা, (৭) উপাসকদশা, (৮) অন্তকৃদ্দশা, (৯) অনুত্তরৌপপাতিকদশা, (১০) প্রশ্নব্যাকরণ, (১১) বিপাকশ্রুত।
বারোটি উপাঙ্গ হচ্ছে- (১) ঔপপাতিক, (২) রাজপ্রশ্নীয়, (৩) জীবাভিগম, (৪) প্রজ্ঞাপনা, (৫) জম্বুদ্বীপপ্রজ্ঞপ্তি, (৭) সূর্যপ্রজ্ঞপ্তি, (৮) নিরয়াবলি, (৯) কল্পাবতংসিকা, (১০) পুষ্পিকা, (১১) পুষ্পচুলিকা, (১২) বন্দিদশা।
দশটি প্রকীর্ণ হচ্ছে- (১) চতুঃশরণ, (২) সংস্তরক, (৩) আতুরপ্রত্যাখ্যান, (৪) ভক্তাপরিজ্ঞা, (৫) তণ্ডুলবৈয়াসীয়, (৬) চন্দ্রবেধ্যক, (৭) দেবেন্দ্রস্তব, (৮) পণিবীজ্জা, (৯) মহাপ্রত্যাখ্যান, (১০) বীরস্তব।
ছয়টি ছেদসূত্র হচ্ছে- (১) নিশীথ, (২) মহানিশীথ, (৩) ব্যবহার, (৪) দশাশ্রুতস্কন্ধ, (৫) বৃহৎকল্প, (৬) পঞ্চকল্প।
চারটি মূলসূত্র হচ্ছে- (১) উত্তরাধ্যয়ন, (২) দশবৈকালিক, (৩) আবশ্যক, (৪) পিণ্ডনির্যুক্তি।
.
প্রাচীন এই জৈনগ্রন্থগুলির ভাষা অর্ধমাগধী প্রাকৃত। মহাবীর এ ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। পরবর্তীকালে জৈনদার্শনিকরা দার্শনিক তত্ত্বালোচনার লক্ষ্যে সংস্কৃত ভাষাকে প্রাধান্য দেন। প্রথম খ্রীষ্টাব্দ হতে জৈনগণ গ্রন্থ রচনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করতেন। এই দার্শনিক আলোচনার প্রয়োজনেই অন্যান্য শাস্ত্রের আলোচনাও লিখিত হতে থাকে। তাই জৈনদের বারোটি উপাঙ্গের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম উপাঙ্গে গণিত, জ্যোতিষ, ভূগোল প্রভৃতি শাস্ত্রের আলোচনা রয়েছে। দিগম্বরমতে ৫৭ খ্রীষ্টাব্দে জৈনশাস্ত্র লিখিত হয়েছে। এরপর থেকে জৈনশাস্ত্রে সাতটি তত্ত্ব, নয়টি পদার্থ, ছয়টি দ্রব্য, পঞ্চ অস্তিকায় প্রভৃতি আলোচনা শুরু হয়।
.
দর্শনের প্রমাণশাস্ত্র ও তর্কশাস্ত্রে জৈনদর্শনের অবদান অপরিসীম। জৈনদার্শনিকরা ধর্ম দর্শন নীতি এবং এই প্রমাণ বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রখ্যাত সেসব জৈনদার্শনিকরা হলেন কুন্দকুন্দাচার্য (৫০ খ্রীষ্টপূর্ব), ‘বাচক শ্রবণ’ নামে খ্যাত উমাস্বাতি বা উমাপতি (০১-৮৫ খ্রী.), সমন্তভদ্র (ষষ্ঠ শতক), অকলঙ্কদেব (ষষ্ঠ শতক), বিদ্যানন্দ (অষ্টম শতক), প্রভাচন্দ্র (৮২৫ খ্রী.), মানিক্যনন্দী (৭৫০-৮০০ খ্রী.), অভয়দেব সূরি (নবম শতক), অনন্তবীর্য (একাদশ শতক), হেমচন্দ্র সূরি (১০৮৮-১১৭২ খ্রী.), চন্দ্রপ্রভ (১১০০ খ্রী.), ‘কলিকাল গৌতম’ নামে খ্যাত হরিভদ্র সূরি (দ্বাদশ শতক), মল্লিসেন (১২৯২ খ্রী.), রাজশেখর সূরি (১৩৮৪ খ্রী.), যশোবিজয়গণি (১৬০৮-১৬৮৮ খ্রী.) প্রমুখ। দর্শনশাস্ত্র তাঁদের মহত্তপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ।
…
(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
…
[*] [পরের পর্ব: দার্শনিক সিদ্ধান্ত- অনেকান্তবাদ]
[সহায়ক-গ্রন্থসূচি].[জৈনদর্শন:অধ্যায়সূচি]
…
No comments:
Post a Comment