Tuesday, February 21, 2012

| বইমেলা ২০১২: যেখানে ধ্বনিত হয় সভ্যতার স্পন্দন |

.
| বইমেলা ২০১২: যেখানে ধ্বনিত হয় সভ্যতার স্পন্দন |
-রণদীপম বসু
১.০
বিগত মেলাগুলোর সাথে এবারের বইমেলার যে বাহ্যিক পরিবর্তনটা উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়লো, বাঙালির এই প্রাণের মেলাটা বুঝি শেষমেষ নিজেকে কর্পোরেট সংস্কৃতির কাছে পুরোপুরি সপেই দিলো। এইটা আমার টাকায় করা, ওইটা আমার টাকায় করা, ওইগুলা আমাদের টাকায় করা, এরকম আগ্রাসী মনোভাব ছড়িয়ে আছে গোটা মেলা জুড়ে স্পন্সরদাতার বিজ্ঞাপন আধিক্যে। এখানেই হয়তো দান বা সহায়তার সাথে বেনিয়াবৃত্তির তফাৎ।

 
.

.
প্রকৃত দানের মাহাত্ম্য নাকি দাতার স্বত্বও হস্তান্তর হয়ে যায়, ওটাও দানেরই অংশ, গ্রহীতার নিজস্বতা ক্ষুণ্ন হয়না কিছুতেই। কিন্তু স্পন্সরশীপ নামের যে কর্পোরেট বেনিয়াবৃত্তি, তা গ্রহীতাকেও দখল করে নেয়। গ্রহীতাই হয়ে যায় তার মূখ্য বিজ্ঞাপন। স্পষ্টতই তা এক কেনাবেচার খেলা। একাডেমী প্রাঙ্গণে পা দিয়েই যে বোঝার বুঝে যাচ্ছে ঠিকই- আমরা যে সত্যি সত্যি পণ্য হয়ে গেলাম, হয়তো বিক্রিও হয়ে গেলাম। এই বিশাল জাকজমকের মধ্যে যে কেউ নিজের সংবেদশীল মনটাকে কিঞ্চিৎ জাগিয়ে দিলেই একটা কষ্ট বুকের ভেতর খিঁচ করে বিঁধতে থাকবে- কী যেন কোথায় নেই, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে বা গেছে !
.

.
সংস্কৃতির এই যে স্পন্দন আমরা বুকের খুব গভীরে ধারণ করি লালন করি, বেনিয়ারা তা বুঝে ভালো করেই। কিন্তু এটাকে তারা দেখে পণ্যের চেহারায়, সম্ভাব্য মুনাফার ঐন্দ্রজালিক আবহে। এভাবেই এক উৎকট স্পন্সরশীপের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের দুখিনী বর্ণমালার শহীদ সন্তানদের রক্ত-পদাবলি সুর। বাঙলা একাডেমীর প্রাঙ্গণ ঘুরে এই উপলব্ধিটা খুব করে বাজলো এবার। বুঝে গেলাম, আমরা আমাদের দরিদ্র দুখিনী মায়ের লজ্জাটুকু ঢেকেছি জৌলুসে রাঙানো স্পন্সরকৃত মহার্ঘ শাড়িতে হয়তো, পরতে পরতে যার বিজ্ঞাপন আঁকা।
.

.
ভালোই ! ঢাকার আশেপাশে ছড়ানো ছিটানো আমাদের নাগরিক নৌকার ছইগুলো কর্পোরেট বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়েছে বেশ আগেই। ভাটির গাঙের নাইয়ারা নির্বাসিত। এবার বাঙলার বাউলের হাতেও একতারার বদলে শোভা পাবে কর্পোরেট বাদ্য। কেবল সময়ের ব্যাপার। এবং একদিন আমাদের কবিদের কলমও অপেক্ষায় থাকবে লীজে পাওয়া স্পন্সর-প্রভুর সরবরাহকৃত বর্ণমালার ঝলমলে বদান্যতার আশায়। আমাদের হাসি কান্না আনন্দ বিষাদ উচ্ছ্বাস আড্ডা সবই নির্ধারণ হবে বিজ্ঞাপন-মূল্যে। বাঙালির মায়ের ভাষার লালন কেন্দ্র বাঙলা একাডেমী নিজেই হয়তো সেই চিহ্নক হয়ে আমাদেরকে এই আগাম অভিজ্ঞান দিচ্ছে।
.

.
২.০
একুশে গ্রন্থমেলা ২০১২-এ অন্যান্যবারের মতো এবার আর ভিন্নভাবে কোন শিশু কর্ণার রাখা হয়নি বলেই মনে হলো। ফলে শিশুসাহিত্য নির্ভর প্রকাশনীগুলো বিচ্ছিন্নভাবে গোটা মেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার হ্যাপাটা টের পেয়েছেন শিশুদের অভিভাবকরা খুব ভালোভাবেই। ছুটির দিনের প্রচণ্ড চিড়েচেপ্টা ভিড়ে ছোট্ট শিশুদের নিয়ে কোথায় কোন প্রকাশনী খুঁজবে কে !
.
.
এরই আংশিক প্রভাব কিনা কে জানে, অনেক প্রকাশকের বয়ানেই শোনা গেলো- গতবারের চেয়ে এবারের ভিড় বেশি হলেও সমান্তরাল হিসাবে বিক্রি সে তুলনায় অনেক কম। এই লাভ-ক্ষতির হিসাব আমাদের পাঠকদের জানার কথা নয়। তবে কথাচ্ছলে একজন লেখকের দীর্ঘশ্বাসও শুনলাম একইসাথে- সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ফিরেন, মেলা শেষে লেখক ফিরেন খালি হাতে। বুকের কোণা ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কথা !
.

.
৩.০
লিটলম্যাগ চত্বরটার বড় গাছটার গোল বেদীটাকে এবার ফের লিটলম্যাগ স্টলের জন্য ছেড়ে দেয়ায় মন্দ হয় নি। তবে গোটা চত্বর জুড়ে ব্লগারদেরই আধিপত্য দেখা গেলো। লিটলম্যাগ কর্মী বলে পরিচয়ের আলাদা সত্তাটা এখন বিলীনপ্রায়। সম্ভবত প্রত্যেক লিটলম্যাগ কর্মী কোন না কোনভাবে এখন ব্লগারও। ইন্টারনেট তথ্যপ্রযুক্তির জয়ধ্বজাই বলি আর অন্তর্জালিক আধিপত্যই বলি, কলমকর্মীদের  নিজেকে ব্লগার পরিচয়ের সাচ্ছন্দ্যবোধ দেখে মনে হয় প্রতিষ্ঠানবিরোধি সাহিত্য আন্দোলনে এককালের অনিবার্য মাধ্যম লিটলম্যাগের বিবর্তিত অস্তিত্ব অনিবার্য নিয়তি হয়ে মিশে যাচ্ছে ব্লগস্ফিয়ারেই।
.

.
ভার্চুয়াল সমৃদ্ধির এই অফুরন্ত সুযোগ সুবিধাকে অস্বীকার করা না-গেলেও নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সেই লিটলম্যাগ প্রজন্মের বুকের বারুদের ঝাঁঝটুকু এখন স্তিমিত। সেই হারানোর কষ্টটুকু কে কিভাবে অনুভব করেন জানি না, এখনকার ব্লগ-নির্ভর লিটলম্যাগগুলোতে সেই আগুনের তাপটুকু কতোটা ধরে রাখা যাবে তা সময়ই বলবে। বিশ্ববেনিয়াদের ভার্চুয়াল ঠাণ্ডা হাত ঢুকে গেছে আমাদের বুকের উষ্ণতার ভেতরে। আমরা কি আমাদের উষ্ণতাটুকু হারিয়ে ফেলবো, না কি বুকের উষ্ণতা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়া সেই দুবৃত্ত বেনিয়া হাত পুড়িয়ে দেবো, সে বিবেচনা করার সময় কখন হবে জানি না। শুধু এটুকু জানি যে, আফসোস দিয়ে কোন সমাধান আসে না।
.

.
৪.০
যা কিছুই হোক, শেষ বিচারে বইমেলার মজমাই আলাদা। কতো কতো নতুন মুখের সাথে পরিচয় ঘটে, নতুন উচ্ছ্বাসে নতুন আন্দোলনে দোল খাওয়া হয়, নতুন নতুন স্বপ্নের উন্মেষে সিঞ্চিত হয়ে প্রাণ-প্রাচুর্যে  ভরপুর কত শত মুহূর্তকে বুকে পুরে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়।  শিল্পের সংস্কৃতির সাহিত্যের জীবনের কতো দুর্বোধ্য অক্ষরের সাথে পরিচিত হওয়ার মওকা তৈরি হয়। এ কেবল এরকম বইমেলাতেই সম্ভব, একুশের বইমেলা, অন্য কোন মেলায় যা চিন্তাও করা যায় না।
.
.
সারা বছরের অপেক্ষাগুলো একজোট হয়ে এই মেলাতেই এসে ফেটে পড়ে অবাধ্য উচ্ছ্বাসে। মুছে যায় সময়ের বোধ, ভুলে যাই বয়সের ফারাক, খুঁজে ফিরি প্রাণের স্পন্দন, মনন উল্লাস। আর তাই তো  এটা হলো আমাদের প্রাপ্তির মেলা। এই মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা, ভাষার মেলা, আমাদের অস্তিত্বের মেলা।
.

.
অথচ এই মেলাতেই এবার আসার সুযোগ পেয়েছি খুব কম। মেলার আজ কুড়িটি দিন গত হয়, এর মধ্যে আসতে পেরেছি সাকুল্যে তিনদিন। পেটের দায়, গোলামির শেকল ছিঁড়বো কী করে ! তৃতীয় দিনে মেলা জমে ওঠেনি যখনো, হালকা পাতলা আবহে ঘুরে গেলাম প্রথমবার। এরপর এলাম সতের ও আঠারোতম দিনে। আগামী ছুটির দিনগুলোয় যাবো তো নিশ্চয়ই, যদি কল্পনা অতিক্রম করে কিছু না ঘটে।
.

.
৫.০
ব্লগিংয়ের ভার্চুয়াল জগতটাই কীরকম যেন ! না-দেখেই কতো আপন হয়ে যাই আমরা ! সামনে এলে মনে হয় কতোকালের চেনা ! তা-ই মনে হলো প্রবাসী লেখক-ব্লগার সুদর্শন সুমন সুপান্থ, উচ্ছল মেয়ে বর্ণা (বন্দনা), চট্টগ্রাম থেকে হঠাৎ করে হাজির হয়ে যাওয়া মাই ডিয়ার হিল্লোল দত্ত, কিংবা এক্কেবারে নিটোল নিষ্পাপ চেহারার ছোট্ট ভাই নিটোল সহ আরো বেশ কয়েকজনকে এই প্রথম সামনাসামনি দেখে।
.
.
গতবারের আগের বার এক পলকের জন্যে দেখা ও কথা হয়েছিলো স্কলার অভিজিৎ রায়ের সাথে। মুক্তমনা ব্লগ নিয়ে মেতে থাকায় অনেকদিন সচলে লিখছেন না। এবারের যে অভিজিৎ রায়কে পেলাম তিনি এক আড্ডারু অভিজিৎ রায়। অবশ্য সচলের বাদাইম্যা আড্ডারু গ্রুপের পাল্লায় পড়লে পাথর থেকেও যে রস বেরুতে শুরু করে, সেটা কি অভিজিৎ রায় জানতেন ?
.

.
৬.০
সিলেট অঞ্চলে ‘বৈতল’ নামে একটা আঞ্চলিক শব্দ আছে, বেতাল ও ভবঘুরে শব্দ দুটোর অর্থের ককটেল বানিয়ে ছেড়ে দিলে যা বুঝায় অনেকটা তা-ই। স্বভাবে তেমন কিনা জানি না, তবে ব্লগস্ফিয়ারের বিভিন্ন অঙ্গনের ব্লগারদের সাথে চেনা-পরিচয়ের সূত্রে আড্ডার পরিধিটা নির্দিষ্ট সীমায় আটকে থাকে না বলে নিজেকে বৈতল বা বাদাইম্যা হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ হয় নি কখনো, বরং ভালোই লাগে।
.
.
কিন্তু ব্লগে হাতেখড়ির কিছুদিনের পর্যবেক্ষণে দেখলাম ব্লগারদের অধিকাংশই এই বাদাইম্যা গোত্রের ! এবং লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে আমার চেনা-জানা প্রত্যক্ষ সচলদেরও প্রায় সবক’টাই বাদাইম্যা। তবে ইদানিং এরা কেবল বাদাইম্যাই নয়, ফাঁকিবাজ বাদাইম্যা।
.

.
এই বইমেলায় সেই বাদাইম্যাদের আমদানি ঘটে প্রচুর। আর এর সুবাদে বাদাইম্যাগিরিটাও জমে ওঠে জোরেশোরেই। এবং একসময় খেয়াল করলে দেখা যায়, এই লিটলম্যাগ চত্বরটা বুঝি বাদাইম্যাদেরই আড্ডাখানা ! যেদিকেই তাকানো যায় কেবল বাদাইম্যা আর বাদাইম্যা ! সচলায়ন, মুক্তমনা, আমারব্লগ, সামহোয়ারইন, উন্মোচন, নাগরিক, আমরা বন্ধু ইত্যাদি ইত্যাদি কতো কতো ব্লগার।
.
.
এদেরই যন্ত্রণায় হয়তো আমাদের সুশীল লেখক-কবিরা এই প্রিয় জায়গাটা ছেড়ে ‘লেখক কুঞ্জ’ নামের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে বাঁচেন, যা কিনা ভাষা আন্দোলন স্মারক ভাস্কর্য ‘মোদের গরব’-এর পেছনপাশে খড়-বাঁশ দিয়ে সংস্কৃত করে তৈরি করে দিয়েছে বাঙলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এসে কেউ উঁকি দিয়ে তাঁদেরকে দেখে যান, কেউ বা পাশে বিগলিত দাঁড়িয়ে আরাধ্য ছবিটা তোলার মওকা খুঁজেন। বইমেলার এসব চিরন্তন দৃশ্য বরাবরের মতো এবারও উপভোগ করতে পারছি ভেবে ভালো লাগছে।
.

.
৭.০
ফেব্রুয়ারি মাসটা চলে যাচ্ছে, বইমেলারও দুই-তৃতীয়াংশ সময় কেটে গেলো, অথচ প্রখ্যাত ফাঁকিবাজ বাদাইম্যা সচলরা বইমেলায় সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে নানারকম ভঙ্গি করে সুদক্ষ পোজ দেয়ার উৎসাহে যতোটা তীব্র মনোযোগী দেখা গেছে, তার চেয়েও বইমেলা নিয়ে ছবিপোস্ট দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কে কতোটা অনাগ্রহী তারই প্রতিযোগিতা বেড়েই চলছে বলে মনে হয়। এ লজ্জা কোথায় রাখি ! সচলে নাকি ফটোবাজের সংখ্যা ঈর্ষণীয়ভাবে সমৃদ্ধ। মেলায় যাকেই জিজ্ঞেস করি, বলে- ক্যামেরা আনি নি, আনলে ঠিকই তুলতাম। অথচ সুন্দর সুন্দর মুখ পেলে তলে তলে…, সে আর না-ই বলি।
.

.
অতঃপর কী আর করা ! লাজুক আমি আবার ‘না’ বলতে পারি না, তাই হায়া-শরমের মাথা খেয়ে নিজেই নাচতে নেমে গেলাম। এতে যদি বেশরম কেউ অন্তত একটু লজ্জা পেয়েও নাচতে নামেন সে আশা এখনো ছাড়ি নি। কারণ মেলা শেষ হওয়ার এখনো প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় সামনে পড়ে আছে। কিন্তু কেউ কি আদৌ লজ্জা পাবে ? হা হা হা !
.
.
.


[আরো ছবি এই এলবামে : ফেসবুক অথবা ওয়েবশট ]

No comments: