.
| চার্বাকের খোঁজে…১৩ | চার্বাক সাহিত্য: চার্বাক দর্শনের শ্রেণীগত ভেদ |
রণদীপম বসু
…
রণদীপম বসু
…
৯.০ : চার্বাক দর্শনের শ্রেণীগত ভেদ
…
চার্বাক দর্শনের যে-কোন পর্যায়ের আলোচনাতেই আমাদেরকে এটা মাথায় না-রেখে উপায় থাকে না যে, বিলুপ্তির কারণেই চার্বাকদের নিজস্ব কোন সাহিত্য আমাদের জ্ঞান জগতের আয়ত্তে নেই। এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে তথা বিপক্ষ দার্শনিকদের রচিত সাহিত্যে তাঁদের নিজের মতো করে চার্বাক-উপস্থাপনাকে ভিত্তি ধরেই আমাদেরকে চার্বাক-সিদ্ধান্তের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করতে হয়। ফলে বাস্তবিকই চার্বাকদের মধ্যে একাধিক সুনির্দিষ্ট মতগোষ্ঠি ছিলো কি ছিলো না, নিশ্চিত প্রামাণিক তথ্য-উপাত্ত ছাড়া সে ব্যাপারে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত আরোপ করার উপায় নেই। তবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের যেসব কৌতুহলি নমুনা বিভিন্ন সাহিত্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা থেকে গবেষকরা চার্বাকদের মধ্যে তিনটি সম্প্রদায়ের অতীত উপস্থিতি নিয়ে ধারণা করেন।
চার্বাক দর্শনের যে-কোন পর্যায়ের আলোচনাতেই আমাদেরকে এটা মাথায় না-রেখে উপায় থাকে না যে, বিলুপ্তির কারণেই চার্বাকদের নিজস্ব কোন সাহিত্য আমাদের জ্ঞান জগতের আয়ত্তে নেই। এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে তথা বিপক্ষ দার্শনিকদের রচিত সাহিত্যে তাঁদের নিজের মতো করে চার্বাক-উপস্থাপনাকে ভিত্তি ধরেই আমাদেরকে চার্বাক-সিদ্ধান্তের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করতে হয়। ফলে বাস্তবিকই চার্বাকদের মধ্যে একাধিক সুনির্দিষ্ট মতগোষ্ঠি ছিলো কি ছিলো না, নিশ্চিত প্রামাণিক তথ্য-উপাত্ত ছাড়া সে ব্যাপারে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত আরোপ করার উপায় নেই। তবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের যেসব কৌতুহলি নমুনা বিভিন্ন সাহিত্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা থেকে গবেষকরা চার্বাকদের মধ্যে তিনটি সম্প্রদায়ের অতীত উপস্থিতি নিয়ে ধারণা করেন।
.
এবং
এই সম্প্রদায়গুলিকে (১) ‘বৈতণ্ডিক’, (২) ‘স্থূল বা ধূর্ত’ ও (৩)
‘সুশিক্ষিত’ চার্বাক নামে অভিহিত করা হয়েছে। যদিও তা নিয়েও চূড়ান্ত
সিদ্ধান্তবিহীন প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। কেননা আমাদের এটাও মনে রাখতে হয় যে,
বিভিন্ন সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা এই নামগুলি কিন্তু চার্বাক-বিরোধী
দার্শনিকদেরই প্রদত্ত। এবং তাও হয়েছে কেবল একটিমাত্র বিষয়কে কেন্দ্র করে।
সেটা হলো, দার্শনিক সিদ্ধান্ত বিচারের যুক্তি-তর্কে প্রমাণগ্রাহ্যতার
মানদণ্ড নিরূপণ। সেটা কী ? প্রথম দলের বৈতণ্ডিকেরা প্রমাণাসত্ত্ব, অর্থাৎ
কোন প্রমাণকেই যারা স্বীকার করেন না। দ্বিতীয় দলের স্থূল বা ধূর্ত
চার্বাকেরা হলেন প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী, অর্থাৎ যাঁরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র
প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেন। আর তৃতীয় দলভুক্ত সুশিক্ষিতরা অনুমানমাত্রকেও
প্রমাণ বলে স্বীকার করেন।
.
এখন
প্রশ্ন, সত্যি কি চার্বাকদের মধ্যে এতো ভেদ ছিলো ? ‘ধূর্ত’, ‘সুশিক্ষিত’
এই শব্দদুটির উপস্থিতি মূলত চার্বাক মতের সবচাইতে কট্টর সমালোচক নবম শতকের
ন্যায় দার্শনিক জয়ন্ত ভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থেই চোখে পড়ে। জয়ন্ত ভট্ট
ন্যায়দর্শনের বিভিন্ন খুঁটিনাটির বিস্তার প্রসঙ্গে চার্বাক মতের সমালোচনা
করতে গিয়ে চার্বাক গোষ্ঠির কয়েকটি শ্রেণীর চিন্তাধারার আলোচনা করেন। এবং তা
করতে গিয়ে তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চার্বাক গোষ্ঠিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিশেষ
কিছু বিশেষণে চিহ্নিত করেছেন। কাজেই কেউ কেউ মনে করেন যে এ দুটি সংজ্ঞা
চার্বাক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপরীতধর্মী বিশেষ দুটি বিভাগের অস্তিত্বের
দ্যোতক। অর্থাৎ ‘ধূর্ত’ চার্বাকগোষ্ঠির প্রচারিত মতবাদ ‘সুশিক্ষিত’ গোষ্ঠির
মতের থেকে পৃথক।
দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয়ও তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে চার্বাক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘ধূর্ত’ এবং ‘সুশিক্ষিত’ এই দুটি গোষ্ঠির অস্তিত্বের উল্লেখ করেছেন (পৃঃ ২৪,৩৩,১৩৪)। যদিও তাঁর এই ধারণার সপক্ষে তিনি উপযুক্ত কোন প্রমাণের সমর্থন দেখাবার চেষ্টা করেন নি। (লতিকা চট্টোপাধ্যায়: চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৮)।
দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয়ও তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে চার্বাক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘ধূর্ত’ এবং ‘সুশিক্ষিত’ এই দুটি গোষ্ঠির অস্তিত্বের উল্লেখ করেছেন (পৃঃ ২৪,৩৩,১৩৪)। যদিও তাঁর এই ধারণার সপক্ষে তিনি উপযুক্ত কোন প্রমাণের সমর্থন দেখাবার চেষ্টা করেন নি। (লতিকা চট্টোপাধ্যায়: চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৮)।
.
তাই এই গোষ্ঠির উপস্থিতি বা পার্থক্যটুকু বুঝতে প্রথমে প্রচলিত চার্বাক মতের বৃহৎ বা প্রধান গোষ্ঠির চিন্তাধারা কী তা জানা আবশ্যক।
তাই এই গোষ্ঠির উপস্থিতি বা পার্থক্যটুকু বুঝতে প্রথমে প্রচলিত চার্বাক মতের বৃহৎ বা প্রধান গোষ্ঠির চিন্তাধারা কী তা জানা আবশ্যক।
.
গ্রন্থপরম্পরায়
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন যে বেশ সমৃদ্ধ ও পরিণত দর্শন হিসেবেই পরিগণিত
হতো, সমসাময়িক দার্শনিকদের বিভিন্ন আলোচনা থেকেই তা প্রকাশ পায়। বিভিন্ন
উৎস থেকে সংগৃহিত তথ্যানুযায়ী বস্তুবাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে
প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকী চিন্তাধারা সাধারণের কাছে যেভাবে পরিচিতি লাভ
করেছে, তাতে চার্বাকের নিজস্ব বক্তব্য হিসেবে চতুর্ভূতাত্মক স্থূল জগতকে
একমাত্র স্বীকৃতি দেয়া এবং চৈতন্যকে এর বিকার হিসেবে ব্যাখ্যা করে কিছু
বার্হস্পত্য সূত্র বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের কাছে প্রকাশিত।
চার্বাকী প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদিতার সমর্থনে চার্বাক পক্ষের নিজস্ব বক্তব্য
হিসেবে বোধ করি একমাত্র সেগুলিকেই উপস্থাপিত করা চলে। যেমন-
পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি তত্ত্বানি। (বার্হস্পত্য-সূত্র : ১)।
[ পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। ]
.
তৎ-সমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়-বিষয়-সংজ্ঞা। (বার্হস্পত্য-সূত্র :২)।
[ এর (পদার্থ বা তত্ত্ব চতুষ্টয়) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট। ]
.
প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম্ । (বার্হস্পত্য-সূত্র : ৭০)।
[ কেবল প্রত্যক্ষই প্রমাণ। ]
.
নানুমানং প্রমাণম্ । (বার্হস্পত্য-সূত্র :৭১)।
[ অনুমান প্রমাণ নহে। ]
.
শরীরমাত্মা। (বার্হস্পত্য-সূত্র : ৯১)।
[ শরীরই আত্মা। ]
.
চৈতন্য-বিশিষ্টঃ কায়ঃ পুরুষঃ। (বার্হস্পত্য-সূত্র : ৯২)।
[ চৈতন্যবিশিষ্ট কায়া বা দেহই পুরুষ বা আত্মা। ]
.
বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকাতে’ও চার্বাক মতের আলোচনায় একটি লোকায়তসূত্রের উদ্ধৃতি দেখা যায় এভাবে-
বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকাতে’ও চার্বাক মতের আলোচনায় একটি লোকায়তসূত্রের উদ্ধৃতি দেখা যায় এভাবে-
পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি তেভ্যশ্চৈতন্যম্।
অর্থাৎ : তত্ত্বের সংখ্যা চার- পৃথিবী (মাটি), জল, তেজ (অগ্নি) ও বায়ু ; এবং এই পদার্থচতুষ্টয়ই চৈতন্যের কারণ।
.
এরকম
বিভিন্ন দার্শনিকদের অন্যান্য সাহিত্যেও চার্বাক মতের উল্লেখ ইতঃপূর্বে
আলোচনা হয়েছে। অর্থাৎ প্রচলিত চার্বাক মতে তত্ত্ব চতুষ্টয় এবং প্রমাণ
হিসেবে একমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষই চার্বাকী সিদ্ধান্তে স্বীকৃতির
যোগ্য। বিলুপ্তির কারণে চার্বাকদের নিজস্ব সাহিত্যের অবর্তমানে যদিও
প্রত্যক্ষের সমর্থনে কোন চার্বাকী যুক্তি আমাদের গোচরীভূত হয়নি, তবু অন্য
প্রমাণগুলির বিরোধিতার ক্ষেত্রে চার্বাকী তৎপরতার সাক্ষ্য ভারতীয় সাহিত্যের
বিভিন্ন বিভাগে তথা বিভিন্ন প্রামাণিক লোকগাথা বা চার্বাকষষ্ঠীর ভূমিকা
বিশ্লেষণে সুপরিস্ফুট হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রত্যক্ষের
সাহায্যে লভ্য তত্ত্বের অতিরিক্ত অপর কোন তত্ত্বকে এরা গ্রাহ্য করতে
অসম্মত। এরা প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী। ফলে একমাত্র বস্তুজগতেই চার্বাকী চিন্তা
কেন্দ্রীভূত এবং চার্বাক দর্শন এই আলোকেই সাধারণের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে।
.
তাঁদের
এই মত সর্বসাধারণ্যে আরো বিস্তারলাভ করেছে এভাবে যে- এই মতে দেহই আত্মা,
তাই এরা দেহাত্মবাদী। তাঁদের মতে পরিদৃশ্যমান জগৎ চতুর্ভূত হতে উৎপন্ন,
অচেতন চারটি ভূতের মিলন হতে চৈতন্য উৎপন্ন হয়। তাই এরা ভূতচৈতন্যবাদী। এই
মতে স্থূল ইন্দ্রিয়ের উপভোগ জনিত একমাত্র সুখই হচ্ছে পুরুষার্থ। তাই এদেরকে
স্থূল চার্বাকও বলা হয়। তাঁদের মতে ঈশ্বর, পরলোক বা জন্মান্তর নেই। তাই
এরা অনীশ্বরবাদী। এই মতে কার্যকারণভাব বা কর্মফল স্বীকৃত হয় না। ঐহিক,
ক্ষণিক দৈহিক সুখকেই স্বর্গ বলা হয়, তাই এরা সুখবাদী। কণ্টকাদি ব্যথাজনিত
দুঃখই নরক এবং দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ, তাই এরা উচ্ছেদবাদী। এবং বেদবিরোধী বলে
এরা নাস্তিক। এভাবেই সর্বজনপ্রসিদ্ধ চার্বাক দর্শন বিপক্ষ আধ্যাত্মবাদী
দার্শনিকদের কাছে বহুভাবে নিন্দিতও হয়েছেন। কারো কারো মতে এই সম্প্রদায়কেই
ন্যায়ভাষ্যকার জয়ন্তভট্ট ধূর্ত চার্বাক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
.
প্রচলিত
চার্বাক মতের এই বৃহৎগোষ্ঠিকে বিবেচনায় রেখে আমরা জয়ন্ত ভট্টের উক্তি
বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে এক জায়গায় জয়ন্ত ভট্ট
বলছেন-
তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/২৬)।
অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।
.
জয়ন্তের
এই বক্তব্য যে প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকদের উদ্দেশ্যেই বলা, যাঁদের মতে
অনুমান বলে কোন প্রমাণ সম্ভব নয়, এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু
খটকা লাগে, তিনিই যখন আবার অন্যত্র মন্তব্য করেন-
চার্বাকধূর্তঃ তু অথ অতঃ তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ ইতি প্রতিজ্ঞায় প্রমাণ-প্রমেয়-সংখ্যা-লক্ষণ-নিয়ম-অশক্য-করণীয়ত্বম্ এব তত্ত্বং ব্যাখ্যাতবান্ । (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৫৯)।
অর্থাৎ : ধূর্ত চার্বাক কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো- এবার আমরা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো; কিন্তু ‘তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো’ বলে চার্বাক আসলে দেখাতে চাইলো যে প্রমাণ ও প্রমেয়র সংখ্যা ও লক্ষণ সংক্রান্ত কোনো নিয়মই সম্ভব নয়।
.
জয়ন্ত
ভট্টের চার্বাক সংক্রান্ত এই দুটি উক্তির মধ্যে সংগতিবিধান করা যে দুরুহ
তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, প্রথম উক্তি অনুসারে, প্রত্যক্ষই একমাত্র
প্রমাণ। কিন্তু দ্বিতীয় উক্তি অনুসারে, কোন রকম প্রমাণেরই লক্ষণ নির্ণয় করা
সম্ভব নয়, মানে কোন রকম প্রমাণই সম্ভব নয়- ফলে প্রত্যক্ষও সংশয়াতীত নয়।
এমন পরস্পরবিরোধী দুটি মত একই মতগোষ্ঠির কাঁধে চাপিয়ে দেয়াটা নিশ্চয়ই
স্বাভাবিক কোন প্রক্রিয়া নয়। তাছাড়া এই দ্বিতীয়মতটি যে অবশ্যই
প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকদের মতাদর্শ নয়, এ ব্যাপারে সন্দেহও নেই। তাহলে
জয়ন্ত ভট্ট কর্তৃক বিশেষ ‘ধূর্ত’ সংজ্ঞায় বিশেষিত চার্বাকেরা নিশ্চয়ই
প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদীদের থেকে পৃথক অন্য কোন গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত। তবে কি
যারা কোনরকম প্রমাণই স্বীকার করেন না, তাঁদেরকেই ধূর্ত বলা হয়েছে? এখানেও
খটকা আছে। কেননা এই একই ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থেই জয়ন্ত ভট্ট আবার
‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞায় বিশেষিত চার্বাকদের সম্পর্কেও বলেন-
অশক্য এব প্রমাণসংখ্যানিয়ম ইতি সুশিক্ষিত চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৩৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিত চার্বাকদের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম করা সম্ভব নয়।
.
এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য-
‘জয়ন্তর স্বীয় সম্প্রদায়ের- অর্থাৎ ন্যায় সম্প্রদায়ের- দাবি এই যে প্রমাণ আসলে চার রকম। অতএব স্বমত সমর্থনে যে-দার্শনিকেরা প্রমাণের সংখ্যা চারের চেয়ে বেশি বলে মনে করেন, জয়ন্তর পক্ষে তাঁদের মত খণ্ডনের প্রয়োজন বোধ করার কথা। কিন্তু কারা চারের চেয়ে বেশি প্রমাণ মানেন ? জয়ন্ত বলছেন : প্রভাকর-পন্থী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ পাঁচ রকমের; কুমারিলভট্টর অনুগামী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ ছয় রকমের; কেউ-কেউ আবার বলেন, প্রমাণ আট রকমের; কিন্তু ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’রা বলেন, প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো নিয়ম মানা যায় না। কথাটার তাৎপর্য কি এই যে ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’ মতে প্রমাণের সংখ্যা অসংখ্য, নাকি, প্রমাণ বলেই কিছু নেই ? (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫ : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)।
‘জয়ন্তর স্বীয় সম্প্রদায়ের- অর্থাৎ ন্যায় সম্প্রদায়ের- দাবি এই যে প্রমাণ আসলে চার রকম। অতএব স্বমত সমর্থনে যে-দার্শনিকেরা প্রমাণের সংখ্যা চারের চেয়ে বেশি বলে মনে করেন, জয়ন্তর পক্ষে তাঁদের মত খণ্ডনের প্রয়োজন বোধ করার কথা। কিন্তু কারা চারের চেয়ে বেশি প্রমাণ মানেন ? জয়ন্ত বলছেন : প্রভাকর-পন্থী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ পাঁচ রকমের; কুমারিলভট্টর অনুগামী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ ছয় রকমের; কেউ-কেউ আবার বলেন, প্রমাণ আট রকমের; কিন্তু ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’রা বলেন, প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো নিয়ম মানা যায় না। কথাটার তাৎপর্য কি এই যে ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’ মতে প্রমাণের সংখ্যা অসংখ্য, নাকি, প্রমাণ বলেই কিছু নেই ? (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫ : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)।
.
দেবীপ্রসাদ
থেকে আরো জানা যায় যে, ‘গ্রন্থিভঙ্গ’ নামে ‘ন্যায়মঞ্জরী’র একটি টীকা
প্রকাশিত হয়েছে। টীকাকার চক্রধর। এই টীকায় জয়ন্তর ধূর্ত চার্বাক সম্পর্কে
উপরিউক্ত দ্বিতীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জয়ন্ত এখানে আসলে উদ্ভট নামে
জনৈক চার্বাকপন্থীর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। উদ্ভট নামের এই চার্বাকপন্থীর
মতে সব রকম প্রমাণ-প্রমেয় প্রভৃতি বর্জনের উপদেশ আছে। তবে চক্রধর আরো বলেন-
উদ্ভটের এই মন্তব্য অবশ্যই (চার্বাক) সূত্রের যথাশ্রুত বা আক্ষরিক অর্থ
নয়; এটা আসলে উদ্ভটের নিজস্ব উদ্ভাবন। উল্লেখ্য, উদ্ভট-প্রস্তাবিত
চার্বাকমতের কোন সংস্করণের উল্লেখ বা এ বিষয়ে কোন নজির জয়ন্তর গ্রন্থে নেই।
.
কোনরূপ
প্রমাণকেই স্বীকার করেন না এরকম মতগোষ্ঠির উল্লেখ শ্রীহর্ষের
‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্’ গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদে
চার্বাক প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে যে- ‘চার্বাকেরা কোন প্রমাণকে স্বীকার করেন
না’-
‘সোহয়মপূর্বঃ প্রমাণাদিসত্তানভ্যুপগমাত্মা’। (খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্ : পৃষ্ঠা ২৬)।
‘সোহয়মপূর্বঃ প্রমাণাদিসত্তানভ্যুপগমাত্মা’। (খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্ : পৃষ্ঠা ২৬)।
.
বিভিন্ন
ভাষ্যকাররা শ্রীহর্ষকৃত গ্রন্থের এই অংশের বিভিন্নরূপ ব্যাখ্যাও করেছেন।
ভাষ্যকার শঙ্করকৃত ব্যাখ্যায় এরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্’
গ্রন্থে উল্লিখিত ‘চার্বাকঃ’ শব্দের অর্থ ‘চার্বাকৈকদেশী’ এবং এই
‘চার্বাকৈকদেশী’ বলতে বোঝায় চার্বাকের এক বিশেষ শাখা যাঁরা প্রত্যক্ষাদি
কোন প্রমাণ মানেন না। সম্ভবতঃ জয়রাশি এই শাখারই অন্তর্ভুক্ত এক চার্বাক।
(চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৪ : লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
.
ইতঃপূর্বে
জয়রাশি ভট্ট কর্তৃক সবরকম দার্শনিক মতকে উপপ্লব বা উৎখাত করে দেবার দাবি
সংবলিত ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ নামের গ্রন্থটি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে।
সেখানে এটিকে সর্বপ্রমাণবিরোধী সংশয়বাদের নিদর্শক গ্রন্থ হিসেবে উপস্থাপন
করা হয়েছে। বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো প্রমাণমাত্রেরই খণ্ডন। ইতঃপূর্বে
ন্যায় বা তর্কশাস্ত্রের দৃষ্টিতে জল্প ও বিতণ্ডার সংজ্ঞা নিয়েও আলোচনা
হয়েছে। নিজের কোন মত স্থাপন না করে কেবলই পরমত দূষণ ও খণ্ডনে উদ্যত
বিতণ্ডার মাধ্যমে প্রমাণসিদ্ধ কোন মত আছে বলে স্বীকার না-করায় জয়রাশির মতকে
ন্যায়শাস্ত্রানুযায়ী বৈতণ্ডিক হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। গুরু বৃহস্পতিকেও
ধরাশায়ী করতে উদ্যত জয়রাশি নিজেকে কি বৃহস্পতিশিষ্য হিসেবে দাবি করেছিলেন ?
তবু জয়রাশি মতের তত্ত্বোপপ্লববাদী গোষ্ঠিকে ‘বৈতাণ্ডিক চার্বাক’ নামে
আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে প্রতিদ্বন্দ্বীর
বিরুদ্ধে তর্কই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই হয়তো
‘সম্মতিতর্কপ্রকরণে’র ব্যাখ্যাকার অভয়দেব সূরির উদ্ধৃত উক্তি হচ্ছে-
সর্বত্র পর্যনুযোগঃ পরাণ্যেব সূত্রাণি বৃহস্পতেঃ। (সম্মতিতর্কপ্রকরণ)।
অর্থাৎ : চার্বাক শাস্ত্রকার বৃহস্পতির সকল উক্তিই পর্যনুযোগপর অর্থাৎ পরমত দূষণের জন্য প্রশ্নাত্মক।
.
এবং
মনুসংহিতার অন্যতম টীকাকার কুল্লুক ভট্টের মতে- চার্বাকী তর্ক, ‘কুতর্ক’
(মনু : ১২/৯৫)। এবং ‘ন্যায়মঞ্জরী’র মতে ‘বরাক’ সংজ্ঞায় বিশেষিত এই চার্বাকী
তর্ক ‘ক্ষুদ্রতর্ক’-
‘চার্বাকাস্তু বরাকাঃ প্রতিক্ষেপ্তব্যা এবেতি কঃ ক্ষুদ্রতর্কস্য তদীয়স্যেহ গণনাবসরঃ’। (ন্যায়মঞ্জরী)।
‘চার্বাকাস্তু বরাকাঃ প্রতিক্ষেপ্তব্যা এবেতি কঃ ক্ষুদ্রতর্কস্য তদীয়স্যেহ গণনাবসরঃ’। (ন্যায়মঞ্জরী)।
.
সর্বত্র
সন্দেহ উৎপাদন করার অভীষ্টে নিয়োজিত এই বৈতাণ্ডিক গোষ্ঠি যে প্রচলিত
চার্বাক মতেরও ঘোর বিরোধী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরা পরমেশ্বর, পরলোক,
বেদ, আপ্ত প্রভৃতির অস্বীকারের পাশাপাশি সর্বজনস্বীকৃত প্রত্যক্ষ প্রমাণও
মানেন না। এমনকি কোন ধরনের চার্বাক মতকেও স্বীকার করেন না। বিরোধীপক্ষের
সমালোচনায় কথিত এই সর্বপ্রমাণবিরোধী চার্বাক শাখার স্থান বস্তুবাদের
সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণযুক্ত অন্য যে দুটি প্রসিদ্ধ মতের সাথে একই
পঙক্তিতে নির্ধারণ করা হয়, তা হলো বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের শূন্যবাদ এবং
ব্রহ্মবাদী অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ। তাই জৈন
দার্শনিক বিদ্যানন্দী ‘তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক’ গ্রন্থে বৌদ্ধ শূন্যবাদী
এবং ব্রহ্মবাদীদের সঙ্গে একযোগে তত্ত্বোপপ্লববাদীদের উল্লেখ করেছেন-
‘সর্বথা শূন্যবাদিনস্তত্ত্বোপপ্লববাদিনো ব্রহ্মবাদিনো বা জাগ্রদুপলব্ধার্থক্রিয়ায়াং কিং ন বাধকপ্রত্যয়ঃ। (তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক, পৃষ্ঠা-১৯৫ : সূত্র- চার্বাক দর্শন, লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
‘সর্বথা শূন্যবাদিনস্তত্ত্বোপপ্লববাদিনো ব্রহ্মবাদিনো বা জাগ্রদুপলব্ধার্থক্রিয়ায়াং কিং ন বাধকপ্রত্যয়ঃ। (তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক, পৃষ্ঠা-১৯৫ : সূত্র- চার্বাক দর্শন, লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
.
এমনকি
শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্য’ গ্রন্থেও (পৃ: ২৬) এই তিনটি মতবাদের অনুরূপ
একত্র উল্লেখ দেখা যায় (চার্বাক দর্শন: লতিকা চট্টোপাধ্যায়)। এরপরও
তত্ত্বোপপ্লববাদীদেরকে আধ্যাত্মবাদীগণ কর্তৃক ‘বৈতণ্ডিক চার্বাক’ নামে
আখ্যায়িত করে অন্যতম চার্বাক গোষ্ঠি হিসেবে অভিহিত করার পেছনে কি তবে
চার্বাকদেরকে হেয় ও কলঙ্কিত করার পরিকল্পিত উদ্দেশ্যই ক্রিয়াশীল ?
‘ন্যায়মঞ্জরী’র জয়ন্ত ভট্টের মতে এই বৈতণ্ডিকরাই হীন হাবাগোবা ‘বরাক’ এবং
হয়তো এরাই আবার ‘ধূর্ত’ চার্বাক হিসেবে অভিহিত। ফলে এখানে চার্বাক
সম্প্রদায়ের শ্রেণীভেদে বৈতণ্ডিক ও ধূত চার্বাক নামের দুটি গোষ্ঠিগত বিভাজন
করা শেষপর্যন্ত প্রশ্নবোধক হয়ে থাকে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ‘ধূর্ত’ শব্দটি
সম্ভবত ন্যায়মঞ্জরীতে নিন্দাত্মক ভঙ্গিতেই ব্যবহৃত হয়েছে। এরকম নিন্দাত্মক
বক্তব্য আমরা চার্বাকদের বক্তব্যেও দেখতে পাই, যেমন- ‘ধূর্তপ্রলাপস্ত্রয়ী’
(বার্হস্পত্যসূত্র: ৫৯), ‘ভণ্ডধূর্তনিশাচরাঃ’ (লোকায়ত-প্রকরণ-১৩ :
সর্বদর্শনসংগ্রহ) ইত্যাদি। আদতে হয়তো এই ‘ধূর্ত’ বিশেষণ কোন শ্রেণীভেদের
ইঙ্গিত করে না।
.
অন্যদিকে
গবেষকদের দৃষ্টিতে প্রমাণগ্রাহ্যতার মানদণ্ডে ‘সুশিক্ষিত’ নামে খ্যাত
চার্বাকদের অন্যতম তৃতীয় সম্প্রদায়টির বৈশিষ্ট্য কী ? এরা প্রত্যক্ষকে
প্রমাণ হিসেবে স্বীকার তো করেনই, উপরন্তু শর্তসাপেক্ষে কিছু অনুমানকেও
প্রমাণের মর্যাদা দেন। এই সম্প্রদায় লৌকিক জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য যেরূপ
অনুমান অবশ্য স্বীকার করতে হয় বলে মনে করেন এবং যে পরিমাণ
কার্যকারণসম্বন্ধ স্বীকার না করলে লোকযাত্রা নির্বাহ হয় না, সে পরিমাণ
কার্যকারণভাবের প্রামাণ্য স্বীকার করেন। কিন্তু কোন অলৌকিক অনুমান অর্থাৎ
যেরূপ অনুমানের সাহায্যে ঈশ্বর, পরলোক, পুনর্জন্ম, কর্মফল, স্বর্গ, নরক
প্রভৃতি প্রতিপন্ন হয় সেরূপ অনুমানের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না। এই মতে
অর্থ ও কাম এই দ্বিবিধ পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়। তাঁরা স্বভাবকে
পরিদৃশ্যমান জগতের কারণ বলে স্বীকার করেন। এই সুশিক্ষিত চার্বাকগণ ঐহিক,
দৈহিক, আত্মকেন্দ্রিক, স্থূল, ক্ষণিক সুখের পরিবর্তে মনুষ্যোচিত পবিত্রতর,
সূক্ষ্মতর মানসিক সুখকে পুরুষার্থ বলে স্বীকার করেন।
এই সুশিক্ষিত চার্বাকগণ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। কেউ দেহকে অতিক্রম করে ইন্দ্রিয়কে, কেউ ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে মনকে, কেউ মনকে অতিক্রম করে প্রাণকে আত্মা বলে স্বীকার করেন। তাঁদেরকে যথাক্রমে ইন্দ্রিয়াত্ববাদী, মনআত্মবাদী ও প্রাণাত্মবাদী চার্বাক নামে অভিহিত করা হয়। আর এক শ্রেণীর চার্বাক আকাশকেও পঞ্চম মহাভূত বলে স্বীকার করেছেন। ফলে তাঁরা ক্রমে ক্রমে আধ্যাত্মবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। এবং সুশিক্ষিততর ভূমসুখবাদী চার্বাকগণ ঔপনিষদিকগণের প্রতিপাদিত আধ্যাত্মবাদের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন।
এই সুশিক্ষিত চার্বাকগণ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। কেউ দেহকে অতিক্রম করে ইন্দ্রিয়কে, কেউ ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে মনকে, কেউ মনকে অতিক্রম করে প্রাণকে আত্মা বলে স্বীকার করেন। তাঁদেরকে যথাক্রমে ইন্দ্রিয়াত্ববাদী, মনআত্মবাদী ও প্রাণাত্মবাদী চার্বাক নামে অভিহিত করা হয়। আর এক শ্রেণীর চার্বাক আকাশকেও পঞ্চম মহাভূত বলে স্বীকার করেছেন। ফলে তাঁরা ক্রমে ক্রমে আধ্যাত্মবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। এবং সুশিক্ষিততর ভূমসুখবাদী চার্বাকগণ ঔপনিষদিকগণের প্রতিপাদিত আধ্যাত্মবাদের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন।
.
উপনিষদীয়
আধ্যাত্মবাদী মতাদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করলে যে আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের
পক্ষ থেকে এরা সুশিতিতর অভিধায় ভূষিত হবেন এ আর নতুন কী ! তবে আমাদের
আলোচনা আধ্যাত্মবাদে আত্মসমর্পণকারী সুশিক্ষিততরদের নিয়ে নয়। কেননা প্রচলিত
চার্বাকী ভাবনায় তাদেরকে চার্বাকপন্থী ভাবার সুযোগ নেই। বরং সুশিক্ষিত
চার্বাকরাই আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু।
.
বৌদ্ধ
দার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় পুরন্দর নামে এক চার্বাকের
উল্লেখ আছে। চার্বাকী সাধারণ ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে এই পুরন্দর লৌকিক
অনুমানকে প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করলেও অলৌকিক কোন ধারণাকে এই অনুমানের
মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে তাঁর অসম্মতির পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও দুর্ভাগ্যজনক
বিলুপ্তির কারণেই পুরন্দরের রচিত কোন গ্রন্থের অস্তিত্বের কথা জানা যায় না,
তবে বিভিন্ন লেখকরা পুরন্দরকে ‘চার্বাকমতে গ্রন্থকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ
করেছেন। এজাতীয় উল্লেখ থেকে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রভৃতি আধুনিক
বিদ্বানরাও পুরন্দরকে চার্বাকপন্থী বলেই ধরে নিয়েছেন।
.
কমলশীল
তাঁর ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ গ্রন্থটি যে গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ হিসেবে
রচনা করেন, বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের সেই ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থে
শান্তরক্ষিত দীর্ঘবিস্তৃতভাবে পূর্বপক্ষ হিসেবে উপস্থাপিত চার্বাকপন্থী
লোকায়তমত খণ্ডনের প্রয়াস করেছেন। এই পূর্বপক্ষ বর্ণনার একটি বৈশিষ্ট্য হলো,
প্রকৃত চার্বাকপন্থী জনৈক দার্শনিকের উল্লেখ এবং এক্ষেত্রে দার্শনিকটির
নাম পুরন্দর। কমলশীল তাঁর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় বলছেন-
‘পুরন্দরঃ তু আহ লোকপ্রসিদ্ধম্ অনুমানং চার্বাকৈঃ অপি ইষ্যতে এব, যৎ তু কৈশ্চিৎ লৌকিকং মার্গম্ অতিক্রম্য অনুমানম্ উচ্যতে তন্নিষিধ্যতে।’ (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা)।
অর্থাৎ : পুরন্দর কিন্তু বলেন চার্বাকও লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার করেন; তবে কেউ যদি লৌকিক পথ অতিক্রম করে কোনকিছু অনুমান করতে চান তাহলে চার্বাক তার নিষেধ করবেন বা স্বীকার করবেন না।
.
অতএব,
চার্বাকমতের এই প্রবক্তার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট যে, অনুমানমাত্রই- বা সব
রকম অনুমানই- অস্বীকার করার দরকার নেই। লোকপ্রসিদ্ধ বা ইহলোক সংক্রান্ত
বিষয়ে সাধারণত অনুমানের যে প্রয়োগ তার বিরুদ্ধে চার্বাকেরও কোন আপত্তি নেই।
আপত্তিটা সেখানেই- পারলৌকিক বিষয়ে অনুমানের বিরুদ্ধে। লৌকিক পথ অতিক্রম
করে পারলৌকিক বিষয়ে অনুমান অবশ্যই অচল। এখানে একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে
বোঝা যাবে যে, এই মতের সাথে প্রচলিত প্রত্যপ্রমাণবাদী চার্বাকপন্থী মতের
আদর্শগত কোন বিরোধ বা প্রতিষেধ নেই। কারণ লোকপ্রসিদ্ধ বা ইহলোক সংক্রান্ত
বিষয়ে অনুমানের পেছনে আসলে পূর্ব-প্রত্যক্ষ ইহজাগতিক অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য
থেকে যায়। যেমন প্রাতে উঠোন ভেজা দেখে পূর্বরাত্রে বৃষ্টির অনুমান বা গর্ভ
দেখে পূর্ব-সঙ্গমের অনুমান আসলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পূর্ব-প্রত্যক্ষ
অভিজ্ঞতার পরম্পরাগত অনুমান প্রমাণ। কিন্তু পারলৌকিক বিষয়ে অনুমানের পেছনে
পূর্বে কোন প্রত্যক্ষ-অভিজ্ঞতার নজির থাকে না বলে এই অনুমান গ্রাহ্য হয় না।
তাই পুরন্দর প্রবর্তিত চার্বাক মত আসলে প্রচলিত চার্বাক মতেরই উন্নত
সংস্করণ বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না।
.
কিন্তু
‘সুশিক্ষিত’ শব্দটি যেহেতু জয়ন্ত ভট্টের ন্যায়মঞ্জরী থেকেই উদ্ভূত, তাই
চার্বাকদের কোন শাখাকে এই সংজ্ঞায় শ্রেণীবদ্ধ করতে জয়ন্ত ভট্টের
দৃষ্টিভঙ্গি না-জানা পর্যন্ত বিষয়টির সুরাহা হয় না। এদের সম্পর্কে জয়ন্তের
উক্তিটি আগেই দেখেছি আমরা- ‘সুশিক্ষিত চার্বাকদের মতে প্রমাণের সংখ্যা
সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম করা সম্ভব নয়’ (ন্যায়মঞ্জরী: ১/৩৩)।
সাধারণ চার্বাক মত থেকে পৃথক অপর একটি মতের সমর্থক হিসেবে চার্বাকদের বর্ণনা করার সময় ন্যায়াচার্য জয়ন্ত এই ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞাটির আরও একবার প্রয়োগ করে বলেন-
সাধারণ চার্বাক মত থেকে পৃথক অপর একটি মতের সমর্থক হিসেবে চার্বাকদের বর্ণনা করার সময় ন্যায়াচার্য জয়ন্ত এই ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞাটির আরও একবার প্রয়োগ করে বলেন-
‘অত্র সুশিক্ষিতাশ্চার্বাকা আহঃ, যাবচ্ছরীরমধ্যস্থিতমেকং প্রমাতৃতত্ত্বম…’ (ন্যায়মঞ্জরী: ২/৩৯)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিত চার্বাকরা বলেন- আত্মা বা ‘প্রমাতৃতত্ত্ব’ স্থূলদেহ হতে ভিন্ন এবং সচেতন ব্যবহারের সব কিছু এই ‘প্রমাতৃতত্ত্বে’ আরোপ্য। কিন্তু এই আত্মার স্থায়িত্ব শরীরের অস্তিত্বের সমকালীন।
.
প্রচলিত
চার্বাকী চিন্তার দেহাত্মবাদী মতে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহ থেকে উৎপন্ন মনে
করা হয়। কিন্তু জয়ন্তের বক্তব্য অনুযায়ী এই ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞার মাধ্যমে
বিশেষিত যে চার্বাকদের মতে আত্মা দেহ থেকে পৃথক, অথচ দেহের মধ্য দিয়ে
অভিব্যক্ত, তাঁরা স্পষ্টতঃতই চার্বাক সম্প্রদায়ে আত্মাসম্বন্ধীয় ধারণায়
শ্রেণীভেদের ইঙ্গিত দেয়।
.
এবং ‘ন্যায়মঞ্জরী’র আরেক জায়গায় জয়ন্ত ভট্ট আবার চার্বাক প্রসঙ্গে ‘সুশিক্ষিততর’ বিশেষণ যুক্ত করে বলেন-
সুশিক্ষিততরাঃ প্রাহুঃ… যত্ত্বাত্মেশ্বরসর্বজ্ঞপরলোকাদিগোচরম্ । অনুমানং ন তস্যেষ্টং প্রামাণ্যং তত্ত্বদর্শিভিঃ। (ন্যায়মঞ্জরী: ১/১১৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিততররা বলে থাকেন- অনুমান দু-রকম, উৎপন্ন-প্রতীতি এবং উৎপাদ্য-প্রতীতি। ধূম প্রভৃতি থেকে বহ্নি প্রভৃতির অনুমান কে অস্বীকার করে ? এসব দ্বারা তার্কিক দ্বারা অক্ষত ব্যক্তিরাও সাধ্য-কে জানতে পারে। তবে আত্মা, সর্বজ্ঞ, ঈশ্বর, পরলোক ইত্যাদি বিষয়ে যে-অনুমানের কথা বলা হয় সেগুলির প্রামাণ্য তত্ত্বদর্শীরা স্বীকার করেন না। এইসব অনুমানের দ্বারা সোজা মানুষের অনুমেয় বিষয়ে জ্ঞান হয় না- অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের মন দুষ্ট তার্কিকদের দ্বারা কুটিল হয়ে ওঠে।
.
একে
তো ন্যায়শাস্ত্রের জটিল পরিভাষা, তার উপরে জয়ন্ত ভট্টের পাণ্ডিত্যপূর্ণ
শ্লেষ বা ঠাট্টা-তামাশায় ঠাসা বক্তব্যের তীর্যক কায়দা থেকে সহজ-সরল অর্থ
উদ্ধার করা চাট্টিখানি কথা নয়। এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জয়ন্তর এ
বক্তব্যকে আমাদের বোধগম্য করে সোজা ভাষায় উদ্ধৃত করেছেন এভাবে-
‘জয়ন্ত বলছেন, সুশিক্ষিততরদের মতে প্রত্যক্ষগোচর ইহলোক বিষয়ে সাধারণ লোক যা অনুমান করে থাকে তা অবশ্যই স্বীকার্য : যেমন ধূম থেকে বহ্নির অনুমান। কিন্তু আত্মা, পরলোক প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে কূট তার্কিকেরা যে-সব অনুমান প্রদর্শন করেন তা শুধু তাঁদের কূটবুদ্ধিরই পরিচায়ক, স্বীকারযোগ্য অনুমান হতে পারে না।’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫)।
‘জয়ন্ত বলছেন, সুশিক্ষিততরদের মতে প্রত্যক্ষগোচর ইহলোক বিষয়ে সাধারণ লোক যা অনুমান করে থাকে তা অবশ্যই স্বীকার্য : যেমন ধূম থেকে বহ্নির অনুমান। কিন্তু আত্মা, পরলোক প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে কূট তার্কিকেরা যে-সব অনুমান প্রদর্শন করেন তা শুধু তাঁদের কূটবুদ্ধিরই পরিচায়ক, স্বীকারযোগ্য অনুমান হতে পারে না।’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫)।
.
‘সুশিক্ষিততর’-দের
মত হিসেবে জয়ন্তর এ বক্তব্য মূলত পুরন্দরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বক্তব্যের
প্রকাশভঙ্গি যেরকমই হোক, মূল বক্তব্য আসলে একই। এবং পুরন্দর যে
চার্বাকপন্থীই এ বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে চার্বাকদের বিষয়ে জয়ন্ত
ভট্টের বিবিধ বিশেষণ প্রয়োগকে আদৌ কোন শ্রেণীভেদ হিসেবে গণ্য করা হবে কিনা
তাও সতর্ক বিবেচনার বিষয়। কেননা, শ্লেষাত্মক বিশেষণ ব্যবহারপূর্ণ রচনাকৌশলে
রচিত ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে জয়ন্ত ভট্ট ‘সুশিক্ষিত’ শব্দটিকে ব্যাঙ্গাত্মক
অর্থেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়। এই শব্দটি শুধু
চার্বাকদের বেলায়ই নয়, ন্যায়মঞ্জরীতে অন্যান্য দার্শনিকদের সমালোচনায়ও
একইরকম ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন, একই গ্রন্থে (ন্যায়মঞ্জরী: ১/১৬১)
ঠাট্টা করে তিনি মীমাংসক প্রাভাকরদের সম্বন্ধে এই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন।
আবার অন্যত্র (ন্যায়মঞ্জরী: ১/২৭৩) যে দার্শনিকেরা ‘সামান্য বা জাতি’
(Universal) মানেন না তাঁদেরও পরিহাস করে ‘সুশিক্ষিত’ বলেছেন। তাই
জয়ন্তভট্টর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ থেকে চার্বাকমতের শ্রেণীভেদ সম্বন্ধে কোনো
সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন বলে বিদ্বান গবেষকদের অভিমত। ফলে পাণ্ডিত্য ও
তর্কবিদ্যায় পারদর্শী ও সুপরিচিত চার্বাক গোষ্ঠির সাধারণ সংজ্ঞা হিসেবে
সুশিক্ষিত শব্দের ব্যবহার অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। কিন্তু শুধু জয়ন্তর
রচনার নজির দেখিয়ে চার্বাকদের ‘ধূর্ত’, ‘সুশিক্ষিত’ এসব নামের স্বতন্ত্র
সম্প্রদায়ের কল্পনা করা আদৌ সমীচীন হবে না বলেই মনে হয়।
…
(চলবে…)
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব: লোকায়ত ও আন্বীক্ষিকী] [*] [পরের পর্ব: ...]
…
No comments:
Post a Comment