Wednesday, July 4, 2012

| ন্যায়দর্শন…০৩ : ন্যায়-জ্ঞানতত্ত্ব |

 .
| ন্যায়দর্শন…০৩ : ন্যায়-জ্ঞানতত্ত্ব |
রণদীপম বসু

৩.০ : ন্যায়-জ্ঞানতত্ত্ব
.
ন্যায়দর্শনে বস্তুতত্ত্ব জ্ঞানতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এই দর্শনে জ্ঞানের সংজ্ঞা, জ্ঞানের প্রকারভেদ, যথার্থ জ্ঞান ও অযথার্থ জ্ঞানের প্রকৃতি কী এবং এদের মধ্যে পার্থক্য কী তা বিস্তৃত আলোচনায় করা হয়।

 .
৩.১ : জ্ঞানের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ :
ন্যায়মতে জ্ঞান গুণপদার্থ। এই গুণ হলো আত্মার গুণ। জ্ঞান ও বুদ্ধি এই দর্শনে সমার্থক। তাই মহর্ষি গৌতম বলেছেন-

‘বুদ্ধিঃ উপলব্ধিঃ জ্ঞানম্ ইতি অনর্থান্তরম্’। (ন্যায়সূত্র)।
অর্থাৎ : বুদ্ধি, উপলব্ধি জ্ঞান ইত্যাদি শব্দগুলি একই পদার্থকে বোঝায়।
 .
আবার অন্নংভট্ট ‘তর্কসংগ্রহ’ গ্রন্থে বুদ্ধি বা জ্ঞানের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘সর্বব্যবহারহেতুঃ গুণঃ বুদ্ধিঃ জ্ঞানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে পদার্থটি সকল ব্যবহারের প্রতি কারণ, সেই গুণস্বরূপ পদার্থই জ্ঞান। এবং জ্ঞান বুদ্ধির নামান্তর বা বুদ্ধি জ্ঞানের নামান্তর; যা বুদ্ধি, তাই জ্ঞান; যা জ্ঞান তাই বুদ্ধি। বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন।
 .
ন্যায় মতে জ্ঞানের মাধ্যমে বিষয় আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়। জ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো বিষয়ের রূপ আমাদের কাছে প্রকাশ করা। আলো যেমন তার সামনের স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল যাবতীয় বস্তুকে আলোকিত করে, তেমনি জ্ঞানও তার সম্মুখের স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল যাবতীয় বিষয়কে আমাদের কাছে প্রকাশ করে। তাই জ্ঞান সকল ব্যবহারের হেতু এবং আত্মার গুণ। পদার্থরূপে জগতের সকল বস্তুই জ্ঞান-নিরপেক্ষ। জ্ঞাতা যখন পদার্থকে জানে তখন সেই পদার্থ জ্ঞাতার জ্ঞানের বিষয় হয়। সুতরাং জ্ঞানের বিষয় ও পদার্থ একই জিনিস হলেও কেবলমাত্র জ্ঞানের প্রসঙ্গেই পদার্থকে ‘বিষয়’ বলে অভিহিত করা হয়। জ্ঞানের প্রসঙ্গে আত্মা ‘জ্ঞাতা’ রূপে, পদার্থ ‘বিষয়’ রূপে, মন ও ইন্দ্রিয়াদি ‘করণ’ রূপে পরিচিত হয়।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞান ত্রি-ক্ষণবর্তী। প্রথমক্ষণের উৎপন্ন জ্ঞান দ্বিতীয়ক্ষণে স্থিতি লাভ করে এবং তৃতীয়ক্ষণে তার বিনাশ হয়। তবে স্থায়িত্বের এই ‘দ্বিতীয়ক্ষণ’ যদিও ‘ক্ষণ’ বলেই পরিচিত তবুও এই ‘ক্ষণ’ যে কতোটা পরিমাণ কালকে নির্দেশ করে তা সঠিকভাবে বলা যায় না। পদার্থের উপস্থিতিতে, তা প্রত্যক্ষভাবেই হোক আর পরোক্ষভাবেই হোক, পদার্থের জ্ঞানকে বলে অনুভব। অন্যান্য প্রকার জ্ঞানের ন্যায় অনুভবও উৎপত্তির পর আত্মার গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত থাকে। দ্বিক্ষণ অতিবাহিত হলে অনুভব ধ্বংস হয় এবং ঐ অনুভবের বিষয়ের সংস্কার আত্মায় আশ্রিত হয়। পরবর্তীকালে বস্তুর অ-সাক্ষাতে এই সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে এক প্রকার জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এরূপ জ্ঞানকে বলা হয় ‘স্মৃতি’। এইজন্য স্মৃতিকে কেবলমাত্র সংস্কার থেকে উৎপন্ন জ্ঞান বলা হয়। তাই অন্নংভট্ট বলেন-

‘সংস্কারমাত্রজন্যং জ্ঞানং স্মৃতিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে জ্ঞানে কেবল সংস্কারই কারণ হয় (চক্ষুরাদি বহিরিন্দ্রিয় কারণ হয় না), তাই স্মৃতি।
 .
 ‘কেবলমাত্র’ পদটির দ্বারা বস্তুর উপস্থিতিতে ইন্দ্রিয়াদির মাধ্যমে বস্তুর সরাসরি সাক্ষাতকে বহির্ভুত করা হয়েছে। অতঃপর অন্নংভট্ট জ্ঞান বা অনুভবের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘তদভিন্নং জ্ঞানং অনুভবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অনুভব হলো স্মৃতি ভিন্ন জ্ঞান।
 .
ন্যায়মতে সমস্ত প্রকার জ্ঞান (তা অনুভবই হোক আর স্মৃতিই হোক) যেমন সত্য হতে পারে, তেমনি আবার মিথ্যাও হতে পারে। মিথ্যাজ্ঞানকে বলা হয় ‘ভ্রমজ্ঞান’।
 .
এই বিবেচনায় জ্ঞান বা অনুভব প্রধানত দুই প্রকার- যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা এবং অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা।
 .
প্রমা (Veridical anubhava) : প্রমা হলো অসন্দিগ্ধ যথার্থ অনুভব। অর্থাৎ যে জ্ঞানে আমাদের কোনো রকম সন্দেহ বা সংশয় নেই এবং যে জ্ঞান বিষয়ের অনুরূপ সেই জ্ঞানই হলো প্রমা বা যথার্থ জ্ঞান। তাই যথার্থ স্মৃতিও ন্যায়মতে প্রমা নয়। অনুভবই কেবল প্রমা হতে পারে। কোনো বিষয়ের যে গুণ আছে সেই গুণ যদি জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশিত হয় অর্থাৎ সেই গুণ জ্ঞাত বিষয়ের মধ্যে যথাযথ আছে এ ধরনের জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা। উদাহরণ স্বরূপ- আমার সামনে একটি গাছ আছে। এখানে গাছ সম্পর্কে আমার যে জ্ঞান রয়েছে তাকে আমি যথার্থ জ্ঞান বলবো। কারণ এখানে গাছ সম্পর্কে কোন রকম সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রমা বলতে বিষয়ের যথার্থ অনুভব বোঝায়। তাই অন্নংভট্ট বলেন-

‘তদ্বতি তৎপ্রকারকঃ অনুভবঃ যথার্থঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অনুভব যখন বিষয়ের অনুরূপ হয় তখন সেই অনুভবকে বলা হয় যথার্থ।
 .
প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানকে উৎস অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা হয়- (১) প্রত্যক্ষণ (Perception), (২) অনুমান (Inference), (৩) উপমান (Comparison) ও (৪) শব্দ (Testimony)।
 .
অপ্রমা (Non-veridical anubhava) : জ্ঞানে যে ধর্মটি প্রকাশিত হয় সেটি যদি বিষয়ে বস্তুত না থাকে তাহলে সেটিকে বলা হয় অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা। অর্থাৎ কোনো বস্তুতে যে গুণ আছে বলে আমরা জানি সে গুণ সেই বস্তুতে প্রকৃতপক্ষে নেই, এ ধরনের জ্ঞানকে অযথার্থ জ্ঞান বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ- রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান হলো ভ্রান্তজ্ঞান। দড়ির মধ্যে সাপের গুণ উপলব্ধি করা হয় কিন্তু আসলে দড়ির মধ্যে সাপের গুণ বর্তমান নেই। একটি বস্তুর মধ্যে বিপরীত গুণের সমাবেশ থাকলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। সন্দেহ বা সংশয় যেখানে থাকে সেখানে জ্ঞান যথার্থ হতে পারে না, তখন সেটা হয় অনিশ্চিত জ্ঞান। ভ্রম যথার্থ জ্ঞান নয় কারণ ভ্রমে বিষয়ের যথার্থ অনুভব হয় না। দড়িকে সাপ বলে প্রত্যক্ষ করা হয়। এই ধরনের প্রত্যক্ষ ভ্রমাত্মক, কেননা এই প্রত্যেক্ষ বস্তুর যথার্থ অনুভব হয় না। তাই অন্নংভট্টের মতে-

‘তদভাববতি তৎপ্রকারকঃ অনুভবঃ অযথার্থঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অনুভব যখন বিষয়ের অনুরূপ হয় না তখন সেই অনুভবকে বলা হয় অযথার্থ।
 .
অপ্রমাকেও চারভাগে ভাগ করা হয়- (১) স্মৃতি (Memory),  (২) সংশয় (Doubt), (৩) ভ্রম (Illusion), এবং (৪) তর্ক (Hypothetical Argument)।
 .
৩.২ : জ্ঞানের সত্যতা নির্ণয়
তর্কের দ্বারা বিষয়ের যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায় না। তর্ক প্রমাণের সহায়ক মাত্র। প্রমাণের সাহায্যে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, সেই সিদ্ধান্তের বিপরীত মতকে অসম্ভব বলে প্রমাণ করার জন্য যে যুক্তি দেখানো হয় তাকে তর্ক বলে।
.
উদাহরণস্বরূপ, কোন স্থান হতে দূরবর্তী একটি গৃহ থেকে যখন ধোঁয়া দেখা গেলো তখন মনে করা হলো যে গৃহটিতে আগুন লেগেছে। একজন যুক্তি দিলেন যে সেখানে কোনো আগুন নেই। তখন তর্ক করা হলো যে যদি সেখানে আগুন না থাকে তাহলে সেখানে ধোঁয়া থাকতে পারে না। এই যুক্তিটি ‘যদি’ দিয়ে উদঘাটন করা হচ্ছে। এখানে যুক্তি দ্বারা আগুনের জ্ঞান পাওয়া যাচ্ছে না। আগুন থাকলে ধোঁয়া হবে পূর্বের অনুমানের উপর নির্ভর করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। এইভাবে প্রত্যক্ষ বা অনুমান করে আমরা আগুন সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারি না। তাই তর্ক সুনির্দিষ্ট জ্ঞান নয় এবং সে জন্য তর্কের দ্বারা যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায় না।
 .
নৈয়ায়িকদের মতে বিষয়ের স্বরূপের সঙ্গে জ্ঞানের সঙ্গতি এবং অসঙ্গতির উপর জ্ঞানের সত্যতা এবং মিথ্যাত্ব নির্ভর করে। নৈয়ায়িকদের এই মতবাদকে বৈশেষিক, জৈন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায় সমর্থন করেন।  জ্ঞান যখন বিষয়ের অনুরূপ হয় তখনই জ্ঞান সত্য হয়। তা না হলে জ্ঞান সত্য হয় না, সেটা অযথার্থ জ্ঞান। গোলাপ ফুলটি আমি লাল বলে জানছি। যদি গোলাপ ফুলটির রং প্রকৃতই লাল হয় তাহলে আমার জ্ঞান যথার্থ হবে। কিন্তু কী করে আমি জানবো যে জ্ঞানটি সত্য ? নৈয়ায়িকদের মতে বিষয়ের স্বভাবের সঙ্গে যখন জ্ঞানের সঙ্গতি থাকে তখনই জ্ঞান সত্য। অনুরূপের অভাবে জ্ঞান অসত্য। সে জন্য সত্য জ্ঞানের লক্ষণ হলো অনুরূপতা (Correspondence) অর্থাৎ ‘তদবতি তৎপ্রকারম’। আর অনুরূপতার অভাব (Non-correspondence) অর্থাৎ ‘তদভাববতি তৎপ্রকারম’ হলো অযথার্থ জ্ঞানের লক্ষণ।
 .
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জ্ঞানের সত্যতা বা প্রামাণ্য কিভাবে নির্ধারিত হয় ? কিসের উপর নির্ভর করে জ্ঞান যথার্থ না অযথার্থ তা বিচার করা যায় ? জ্ঞানের সত্যতা ও মিথ্যাত্ব নির্ণর করার মাপকাঠি কী ? নৈয়ায়িকদের মতে প্রবৃত্তিসামর্থ্যই হলো জ্ঞানের সত্যতার নির্ধারক। কর্মের সফলতা (প্রবৃত্তিসামর্থ্য বা প্রবৃত্তি সংবাদ) ও কর্মের বিফলতা (প্রবৃত্তি বিসংবাদ) এ দুয়ের সাহায্যে জ্ঞানের সত্যতা এবং জ্ঞানের মিথ্যাত্ব প্রমাণ করা যায়। ‘প্রবৃত্তিসামর্থ্য’ বলতে কোন একটি জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অভীষ্টসিদ্ধিকে বোঝানো হয়। কোনো বস্তুকে ‘চিনি’ বলে জেনে মিষ্টত্বের প্রবৃত্তি যদি সফল হয় অর্থাৎ কোনো বস্তুকে ‘চিনি’ বলে খেয়ে যদি কোন ব্যক্তির মিষ্ট স্বাদ লাভ হয় তাহলে ঐ ব্যক্তির প্রবৃত্তি সমর্থ বা সফল হয়েছে বলে মনে করতে পারি। কিন্তু কোন জিনিসকে ‘চিনি’ বলে খেয়ে কোন ব্যক্তি যদি নোনা স্বাদ লাভ করে তাহলে তার প্রবৃত্তি সফল হয় না। প্রবৃত্তি সফল না হলে জ্ঞানটিকে প্রমা বলা যায় না। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, যথার্থ অনুভব হলো সফল প্রবৃত্তির জনক এবং অযথার্থ অনুভব হলো বিফল প্রবৃত্তির জনক। জ্ঞানের কাজ কেবল বিষয়ের স্বরূপ প্রকাশ করা। জ্ঞান নিজেই যথার্থ বা অযথার্থ হতে পারে না। জ্ঞান বা অনুভব যদি সফল প্রবৃত্তির কারক হয় তাহলে জ্ঞান যথার্থ হবে, তা না হলে অযথার্থ হবে।
 .
ন্যায় মতে একটি অনুভবের প্রামাণ্য অনুভবটির কারণ-সামগ্রির দ্বারা নির্ধারিত হয় না। কারণ বলতে বোঝায়-

‘কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি কারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি মানে যা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ।
 .
 নৈয়ায়িকরা জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্য (Extrinsic Validity) স্বীকার করেন। পরতঃপ্রামাণ্যের অর্থ হলো অন্য শর্তের উপর নির্ভরশীল। ন্যায় মতে জ্ঞানের প্রামাণ্য অন্য শর্তের উপর নির্ভর করে। আর জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্যের অর্থ হলো জ্ঞানের যথার্থ জ্ঞানের মধ্যেই নিহিত, অন্য কোন শর্তের উপর নির্ভর করে না। কিন্তু নৈয়ায়িকরা জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য (Intrinsic Validity) স্বীকার করেন না। ন্যায়মতে জ্ঞানের উৎপত্তি এক জিনিস, জ্ঞানের প্রামাণ্য আর এক জিনিস। জ্ঞানের প্রামাণ্য না জেনেও একজন একটি জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন। তাই নৈয়ায়িকগণ হলেন পরতঃপ্রামাণ্যবাদী।
 .
ন্যায়দর্শনে যথার্থ অনুভবের জ্ঞাতাকে ‘প্রমাতা’, জ্ঞানকে ‘প্রমা’, জ্ঞানের বিষয়কে ‘প্রমেয়’ এবং জ্ঞানের করণকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। উল্লেখ্য, অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- করণ হল অসাধারণ কারণ (‘অসাধারণং কারণং করণম্’)। অর্থাৎ যেকোন কারণ করণ নয়। আর কারণের লক্ষণ হিসেবে অন্নংভট্ট বলেন- ‘যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, যা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ (‘কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি কারণম্’)। ন্যায়মতে, সাধারণ ও অসাধারণ ভেদে কারণ দু’প্রকার। ঈশ্বর, ঈশ্বরের জ্ঞান-ইচ্ছা-প্রযত্ন, অদৃষ্ট, দিক্, কাল ও তৎ তৎ কার্যের প্রাগভাব- এই আটটি যে কোন কার্যের উৎপত্তিতে কারণ। তাই এগুলি সাধারণ কারণ। এই আটটি সাধারণ কারণ ভিন্ন যে যে পদার্থ কার্যোৎপত্তির জন্য প্রয়োজনীয়, তাই অসাধারণ কারণ। অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন- ‘করণের লক্ষণে ‘অসাধারণ’ শব্দ না দিলে দিক্, কাল প্রভৃতি সাধারণ কারণে করণের লক্ষণ সমন্বয় হয়ে যাবে। ফলে করণের লক্ষণে অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্য করণের লক্ষণে অসাধারণ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে (‘সাধারণকারণে দিককালাদৌ অতিব্যাপ্তি বারণায় অসাধারণ ইতি’)।
 .
ন্যায়মতে একমাত্র আত্মাই জ্ঞাতা হতে পারে। তবে জ্ঞান আত্মার আগন্তুক গুণ। মোক্ষাবস্থায় আত্মায় কোন জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। মুক্ত আত্মা তাই জ্ঞাতা হয় না। নৈয়ায়িকগণ যথার্থ অনুভব বা প্রমার চারটি উৎস (প্রমাণ) স্বীকার করেন। এই চারটি উৎস হলো- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দ। মূলত এই চতুর্বিধ প্রমাণের আলোচনাই হলো ন্যায় দর্শনের মুখ্য আলোচনা।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞানের বিভাগ
ন্যায়মতে জ্ঞান প্রথমত দুইভাগে বিভক্ত- অনিত্যজ্ঞান (জীবের জ্ঞান) ও  নিত্যজ্ঞান (ঈশ্বরের জ্ঞান)।
অনিত্যজ্ঞান আবার দুই ভাগ- (ক) অনুভব ও (খ) স্মৃতি।
স্মৃতির দুই ভাগ- (১) যথার্থ স্মৃতি ও (২) অযথার্থ স্মৃতি।
অনুভবও দুই ভাগ- (১) যথার্থ অনুভব (প্রমা) ও (২) অযথার্থ অনুভব (অপ্রমা)।
 .
প্রমা বা যথার্থ অনুভবের উৎস হলো- যথার্থ প্রত্যক্ষণ, যথার্থ অনুমিতি, যথার্থ উপমিতি ও যথার্থ শাব্দবোধ।
অপ্রমা বা অযথার্থ অনুভবের উৎস হলো- ভ্রম, তর্ক, সংশয় ইত্যাদি এবং অযথার্থ প্রত্যক্ষ, অযথার্থ অনুমিতি, অযথার্থ উপমিতি ও অযথার্থ শাব্দবোধ।
 .
ন্যায়মতে একই বিষয়কে একাধিক প্রমাণের দ্বারা জানা যেতে পারে। এই মতবাদ ‘প্রমাণসংপ্লববাদ’ নামে পরিচিত। অপরদিকে যে মতবাদ ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণের ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট বিষয় স্বীকার করে তা ‘প্রমাণব্যবস্থা’ নামে পরিচিত। ন্যায়সম্প্রদায় প্রমাণসংপ্লববাদী, কিন্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রমাণ ব্যবস্থাবাদী।
 .
ন্যায়মতে জ্ঞানের উৎপত্তি-প্রক্রিয়া
প্রত্যক্ষ : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > বিষয় (পদার্থ) > (ফল) প্রত্যক্ষজ্ঞান।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
অনুমান : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > ব্যাপ্তিজ্ঞান > বিষয় > (ফল) অনুমিতি।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
উপমান : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > সাদৃশ্যজ্ঞান > বিষয় > (ফল) উপমিতি।
উৎপন্ন জ্ঞান আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
শব্দ : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > ইন্দ্রিয় > পদজ্ঞান > বিষয় > (ফল) শাব্দ।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।
 .
স্মৃতি : জ্ঞাতা (আত্মা) > মন > বিষয়ের > সংস্কার > (ফল) স্মৃতিজ্ঞান।
উৎপন্ন জ্ঞান গুণরূপে আত্মায় আশ্রিত এবং তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট ও সংস্কাররূপে আত্মায় আশ্রিত।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: ন্যায়মতে ষোড়শ পদার্থ] [*] [পরের পর্ব: প্রত্যক্ষ প্রমাণ]

No comments: