Saturday, August 11, 2012

| বৈশেষিক দর্শন…০৯ : অভাব পদার্থ |

 .
| বৈশেষিক দর্শন…০৯ : অভাব পদার্থ |
রণদীপম বসু

২.৭ : অভাব পদার্থ (Negation or Non-existence) 
.
নিয়তপদার্থবাদী বৈশেষিক সম্প্রদায়সম্মত সপ্তম ও শেষ পদার্থ হলো অভাব। অভাব একটি নঞর্থক পদার্থ। বৈশেষিক সম্প্রদায় পদার্থকে প্রধানত ভাব ও অভাব ভেদে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এদের মধ্যে দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায় এই ছটি হলো ভাবপদার্থ। সপ্তম পদার্থ হলো অভাব। ‘টেবিলে কলমটি আছে’ এভাবে যেমন ভাব বস্তুর জ্ঞান হয়, তেমনি ‘টেবিলে বই নেই’ এভাবে আমাদের অভাব পদার্থের জ্ঞান হয়। রঘুনাথ শিরোমণি’র মতে, ‘নঞ্’ আদি শব্দের দ্বারা নিষেধবোধক জ্ঞানের বিষয়কে বলা হয় অভাব। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা বস্তুস্বাতস্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অভাব পদার্থ স্বীকার করেছেন। ন্যায়-বৈশেষিক মতে জ্ঞান কখনো নির্বিষয়ক হয় না। জ্ঞান মাত্রই সবিষয়ক, অর্থাৎ বিষয় ছাড়া জ্ঞান হয় না। জ্ঞানের বিষয় জ্ঞান নিরপেক্ষ সত্তাবিশিষ্ট। ভাববোধক সদর্থক জ্ঞানের বিষয়ের ন্যায় তাই নঞর্থক জ্ঞানেরও বিষয় স্বীকার করতে হয়। অভাব হলো এরূপ নঞর্থক জ্ঞানের বিষয়।

 .
মহর্ষি কণাদের বৈশেষিকসূত্রে এবং মহর্ষি গৌতমের ন্যায়সূত্রে স্বতন্ত্র পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ পাওয়া যায় না। মহর্ষি কণাদ তাঁর উদ্দেশ সূত্রে সপ্তম পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ না করলেও তিনি অভাব ও তার বিভাগসমূহ বৈশেষিকসূত্রের বিভিন্ন অধ্যায়ে প্রাসঙ্গিক স্থলে উপস্থাপন করেছেন। আর নবম অধ্যায়ের প্রথম আহ্নিকের প্রথম সূত্র থেকেই মহর্ষি কণাদ প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব, অত্যন্তাভাব ও অন্যোন্যাভাবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। এইসব সূত্র ধরেই তাঁর অনুগামী দার্শনিকগণ বৈশেষিক সম্মত সপ্তবিধ পদার্থের উল্লেখ করে সূত্রকারের অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করেছেন বলে অনুগামীদের অভিমত। পরবর্তীকালে অভাব পদার্থের স্বরূপ ও বিভাগ নিয়ে বিচার শুরু হয়। বাৎস্যায়নের ন্যায়ভাষ্যে এবং উদয়নাচার্যের কিরণাবলীতে স্বতন্ত্র পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ পাওয়া যায়।
 .
বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন তাঁর মুক্তাবলীতে অভাব পদার্থ নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন-

‘অভাবত্বম্ দ্রব্যাদিষট্কান্যোন্যাভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে পদার্থে ছয়টি ভাবপদার্থের ভেদ আছে তাই অভাব।
 .
দ্রব্যাদি ছয়টি ভাবপদার্থে (নিজ নিজ ভেদ ভিন্ন) ‘দ্রব্য নয়’ ‘গুণ নয়’ এইভাবে ভাবপদার্থের কেবল পাঁচটি ভেদ আছে, ছয়টি ভেদ নেই। একমাত্র অভাব পদার্থেই ছয়টি ভাবপদার্থের ভেদ আছে। তাই অভাব হলো দ্রব্যাদি ছয়টি ভাবপদার্থের অন্যোন্যাভাব (পারস্পরিক অভাব) বোধক পদার্থ।
 .
ভারতীয় দর্শনে লক্ষণ এবং প্রমাণের দ্বারা পদার্থ সিদ্ধ হয়। অভাবের লক্ষণ থেকে বোঝা যায়, অভাবনিরূপণ ভাবনিরূপণসাপেক্ষ। সেই কারণে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অভাব পদার্থ নিরূপণের আগে ছ’টি ভাব পদার্থ (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায়) নিরূপিত হয়েছে।
 .
যার অভাব থাকে, তাকে ঐ অভাবের প্রতিযোগী বলে এবং যেখানে অভাব থাকে, তাকে অভাবের অধিকরণ বা অনুযোগী বলে। টেবিলে কলমের অভাবের ক্ষেত্রে কলম অভাবের প্রতিযোগী এবং টেবিল অনুযোগী। অতএব অভাব সবসময় কোন অনুযোগীতে কোন প্রতিযোগীর অভাব। অভাবের সঙ্গে তার অনুযোগী বা প্রতিযোগীর সম্বন্ধ হলো স্বরূপ সম্বন্ধ। কোথাও কোথাও এই সম্বন্ধকে বিশেষণতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষণতা এক প্রকার স্বরূপ সম্বন্ধ হওয়ায় এই সম্বন্ধ অন্য কোন সম্বন্ধের অপেক্ষা করে না। অভাব অনুযোগী ও প্রতিযোগী সাপেক্ষ। যেহেতু অভাব পদার্থ প্রতিযোগী ভাবপদার্থের নিরূপণ ব্যতিরেকে নিরূপিত হতে পারে না, সেহেতু অভাব পদার্থকে ভাবপরতন্ত্র বলা হয়। কারণ প্রতিযোগী ভাবপদার্থের জ্ঞান ব্যতীত অভাবের স্বরূপ বোঝা যায় না। কিন্তু প্রতিযোগী পদার্থ পরিচিত হলেই, যেখানে প্রতিযোগী থাকে, সেস্থান ছাড়া অন্যস্থানে তা অভাব জ্ঞানের বিষয় হয়। দ্রব্য, গুণ প্রভৃতি ভাবপদার্থ পদার্থান্তর নিরূপণের অধীন নয়, তাই তাদের বলা হয় স্বতন্ত্র। ন্যায়-বৈশেষিক মতে অভাব বলতে আসলে নাস্তিত্বকে বোঝায় না। অভাব বলতে ‘কোন কিছুতে কোন কিছুর অভাব’ বোঝায়।
 .
অভাব বিষয়ে দার্শনিক মতান্তর :
কোন কোন দার্শনিক সম্প্রদায় ‘অভাব’ নামক অতিরিক্ত পদার্থ স্বীকার করেন না। যেমন প্রাভাকর মীমাংসক মতে, অভাব ভাব-পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র কোন পদার্থ নয়। কিন্তু বিভিন্ন ভাব পদার্থগুলিই অবস্থাবিশেষে অন্য ভাব-বস্তুর অভাবরূপে প্রতীত হয়। তাদের মতে, জ্ঞানের বিষয় সবসময় সদর্থকই হয়, নঞর্থক বিষয় বলে কোন বিষয় নেই।
 .
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক মতে, অভাব প্রমাণসিদ্ধ। কারণ ‘যা থাকে’ তা যেমন পদার্থ, ‘না-থাকা’টিও যেহেতু জ্ঞানের বিষয় সেহেতু পদার্থ।
দ্বিতীয়ত, অভাবকে পদার্থ বলে না মানলে নঞর্থক বচনের সত্যতা ও মিথ্যাত্বের পার্থক্য করা যায় না। কোন বচন যখন সত্য বলে বিবেচিত হয়, তখন তার অনুরূপ পদার্থ বাস্তব জগতে থাকে। ধরা যাক ‘ঘরে হাতি নেই’ এই বচনটি সত্য। ন্যায়-বৈশেষিক মতে হাতির অভাববিশিষ্ট ঘরই এই বচনের অনুরূপ বাস্তব পদার্থ। সুতরাং, হাতির অভাবকে পদার্থ বলে মানতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ন্যায়-বৈশেষিকদের ন্যায় বেদান্তী এবং ভাট্টমীমাংস সম্প্রদায়ও অভাবকে ভাববস্তুর মতোই পদার্থ বলে স্বীকার করেছেন।
 .
কিন্তু প্রাভাকর মতে, ‘ঘরে হাতি নেই’ এই জ্ঞানের অনুরূপ যে পদার্থ বাস্তব জগতে আছে, তা ঘরটি ছাড়া আর কিছু নয় এবং তা ভাব পদার্থ। এই কারণে তাঁরা বলেন যে, অভাবের জ্ঞান সর্বদাই কোন না কোন অধিকরণে বা আশ্রয়ে হয়। যে অধিকরণে অভাবের জ্ঞান হয়, অভাব সেই অধিকরণস্বরূপ। যেমন টেবিলে যে বই-এর অভাবের জ্ঞান হচ্ছে, সেটি টেবিলস্বরূপ অর্থাৎ টেবিল। সুতরাং, টেবিলের অতিরিক্ত বই-এর অভাব বলে কোন পদার্থ নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ঘটের অভাবকে যখন অধিকরণ ভূতলস্বরূপ বলা হয়, তখন অধিকরণের তৎকালীন স্বরূপকেই বুঝতে হবে। ‘ভূতলে ঘট নেই’ এই প্রতীতির বিষয় যে নাস্তিতা, তা হলো কেবল ভূতল অর্থাৎ ঘট-সংযোগ না থাকাকালীন ভূতল। ‘বিনষ্ট ঘট’ এই প্রতীতির বিষয় যে বিনাশরূপ অভাব, তা ঘটের ভাঙা খণ্ডগুলি ছাড়া আর কিছু নয়। ‘এই কপালে ঘট হবে’ এইভাবে উৎপত্তির পূর্বে যে ঘটাভাবের প্রতীতি হয়, তার বিষয়ও ঐ কপাল ছাড়া অন্য কিছুই নয়। আবার ‘ঘট পট নয়’ এইভাবে ঘটে যে পটের অভাব প্রতীত হয়, তা পৃথকত্ব গুণমাত্র, অতিরিক্ত অভাব পদার্থ নয়।
 .
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিকরা বলেন যে, অভাবকে অধিকরণ-স্বরূপ বললে কল্পনার গৌরব দোষ হয়। কারণ সেক্ষেত্রে ভূতলবৃত্তি ঘটাভাবকে ভূতলস্বরূপ বলতে হবে। আবার টেবিলবৃত্তি ঘটাভাবকে টেবিলস্বরূপ বলতে হবে। কিন্তু ভূতল ও টেবিল এক নয়। ফলে ঘটাভাব অনন্ত হয়ে পড়ায় গৌরব দোষ অবশ্যম্ভাবী।
অপরপক্ষে ঘটাভাবকে অধিকরণের অতিরিক্ত একটি পদার্থ বলে স্বীকার করলে আমরা বলতে পারি যে, একই ঘটাভাব ভূতলে আছে, আবার টেবিলে আছে। অধিকরণভেদে ঘটাভাব ভিন্ন ভিন্ন হয় না।
 .
এক্ষেত্রে প্রাভাকর মীমাংসক বলেন যে, ঐ অধিকরণগুলিই যেহেতু স্বীকৃত পদার্থ, সেহেতু নতুন কোন পদার্থ কল্পনা করা হয়নি। কিন্তু ঘটাভাবকে ভূতলের অতিরিক্ত বলায়, ‘ঘটাভাব’ বলে অপর একটি নতুন পদার্থ স্বীকার করতে হচ্ছে। সুতরাং ন্যায়-বৈশেষিকমতেই গৌরব দোষ হচ্ছে।
 .
উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকরা বলেন, যদিও অধিকরণগুলি স্বীকৃত পদার্থ, তবুও অভাবকে অধিকরণস্বরূপ বললে গৌরব দোষ হবে এইজন্যে যে, অধিকরণভেদে একই অভাবকে অনেক বলে কল্পনা করতে হচ্ছে। ঘটাভাবের কল্পনা হলো এক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয়। ন্যায়-বৈশেষিকমতে ঘটাভাবকে এক বলে কল্পনা করলেই চলে। কিন্তু প্রাভাকর মতে ঘটাভাবকে অনেক বলে কল্পনা করতে হয়। কারণ অধিকরণগুলি ভিন্ন ভিন্ন। অভাব যখন অধিকরণস্বরূপ, তখন বিভিন্ন অধিকরণবৃত্তি অভাবও বিভিন্ন। যদিও ন্যায়-বৈশেষিক মতে অভাবকে অধিকরণের অতিরিক্ত পদার্থ বলে স্বীকার করলে অভাব বলে স্বতন্ত্র একটি পদার্থ স্বীকার করতে হয়, তবুও তাতে গৌরব দোষ হয় না। কম স্বীকার করলে যেখানে চলে, সেখানে যদি বেশি স্বীকার করা হয়, তাহলেই দোষ হয়। কিন্তু অভাবকে অধিকরণের অতিরিক্তরূপে স্বীকার না করলে আমাদের অনুভবের যথাযথ ব্যাখ্যা হয় না। সুতরাং এই স্বীকারে কোন গৌরব দোষ নেই।
সর্বোপরি প্রত্যক্ষ এবং অনুমান প্রমাণের দ্বারা অভাব পদার্থ সিদ্ধ হয়।
 .
অভাবের জ্ঞান :
এখন প্রশ্ন হলো, অভাবের জ্ঞান কিভাবে হয় ? ভাট্ট মীমাংসক ও অদ্বৈত বেদান্ত সম্প্রদায় অভাবপদার্থের জ্ঞানের জন্য ‘অনুপলব্ধি’ নামক একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ স্বীকার করেছেন। এইমতে ঘটাদি বস্তুর উপস্থিতি যেমন প্রত্যক্ষাদি প্রমাণসিদ্ধ, তেমনি ঐ সকল বিষয়ের অনুপস্থিতি অনুপলব্ধি প্রমাণসিদ্ধ।
 .
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় অভাবকে প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলেছেন। অভাবের প্রতিযোগী যদি লৌকিক প্রত্যক্ষের যোগ্য হয়, তাহলে তাদের অভাবও লৌকিক প্রত্যক্ষের যোগ্য। তবে ন্যায়-বৈশেষিক মতে, যে প্রতিযোগীর প্রত্যক্ষ যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয়, তার অভাবেরও কেবল সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা লৌকিক প্রত্যক্ষ হতে পারে, অন্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয় না। যেমন, রূপ চক্ষুরিন্দ্রিয়ের বিষয়। এইজন্য রূপাভাব চক্ষু দ্বারাই প্রত্যক্ষ হয়, ত্বক্ বা কর্ণের দ্বারা রূপাভাবের প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়। কিন্তু যে প্রতিযোগী প্রত্যক্ষের অযোগ্য, তার অস্তিত্ব অমুমান দ্বারা সিদ্ধ হয়। এই কারণে তার অভাবও অনুমানযোগ্য।
 .
পদার্থের অভাব প্রত্যক্ষে বিশেষণ-বিশেষ্যভাব বা বিশেষণতা সন্নিকর্ষ স্বীকৃত (ন্যায়দর্শনের সন্নিকর্ষ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। ষড়বিধ লৌকিক সন্নিকর্ষ ভেদে বিশেষণতা সন্নিকর্ষও ষড়বিধ। দ্রব্যের অভাব প্রত্যক্ষে যে বিশেষণতা সন্নিকর্ষ হয় তা হলো সংযুক্ত বিশেষণতা। কিন্তু দ্রব্যের গুণের অভাব প্রত্যক্ষে দরকার সংযুক্তসমবেত বিশেষণতা।
 .
ন্যায়-বৈশেষিকমতে কোন বিষয়ের অভাব প্রত্যক্ষে প্রতিযোগীর যোগ্য অনুপলব্ধি সহকারিকারণ হয়। যে পদার্থ উপস্থিত থাকলে উপলব্ধি হয়, তার অনুপলব্ধিই যোগ্যানুপলব্ধি। যেমন এই ভূতলে ঘট থাকলে ভূতলের ন্যায় ঘটেরও উপলব্ধি হতো। কিন্তু এখন ভূতলের উপলব্ধি হলেও ঘটের উপলব্ধি হচ্ছে না। তাই ঘটের এই অনুপলব্ধিকে বলা হবে যোগ্যানুপলব্ধি। ঘটাভাবাদির সঙ্গে চক্ষুর সন্নিকর্ষ হলে যোগ্যানুপলব্ধিরূপ সহকারি কারণের মাধ্যমে ঐ সন্নিকর্ষ অভাবের লৌকিক প্রত্যক্ষ ঘটায়। ঘটাভাববিশিষ্ট ভূতলের জ্ঞানে ঘটাভাব ভূতলের বিশেষণ হওয়ায় ইন্দ্রিয়সংযুক্ত সন্নিকর্ষটি হবে বিশেষণতা সন্নিকর্ষ। আবার ভূতলে ঘটাভাবের জ্ঞানে ঘটাভাবটি বিশেষ্য হওয়ায় চক্ষুসংযুক্ত সন্নিকর্ষটি হবে বিশেষ্যতা সন্নিকর্ষ।
বিশেষণতা ও বিশেষ্যতা সন্নিকর্ষ ষড়বিধ। বিশেষণতার ক্ষেত্রে এই ষড়বিধ সন্নিকর্ষ হবে সংযুক্ত-বিশেষণতা, সংযুক্ত-সমবেত বিশেষণতা, সংযুক্ত-সমবেত-সমবেত বিশেষণতা, সমবেত-বিশেষণতা, সমবেত-সমবেত-বিশেষণতা ও বিশেষণতা-নিরূপিত-বিশেষণতা। অনুরূপভাবে বিশেষ্যতা সন্নিকর্ষও ষড়বিধ হয়।
 .
অভাবের শ্রেণীবিভাগ :
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অভাবকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে- (ক) অন্যোন্যাভাব ও (খ) সংসর্গাভাব।
 .
(ক) অন্যোন্যাভাব : অন্যোন্যাভাব বলতে বোঝায় দুটি বস্তুর পারস্পরিক ভেদ। অন্য, ভিন্ন, অপর, পৃথক, নহে, নয় ইত্যাদি শব্দ থেকে অন্যোন্যাভাবের প্রতীতি হয়। যেমন, রস রূপ হতে অন্য, গুণ দ্রব্য হতে ভিন্ন, বিশেষ সামান্য হতে অপর বস্তু, ক্রিয়া গুণ হতে পৃথক, রাম শ্যাম নয়, তেঁতুল মিষ্ট নয়, ঘট পট নয় ইত্যাদি বাক্য অন্যোন্যাভাবের প্রকাশক।
 .
‘অন্যোন্য’ শব্দের অর্থ পরস্পর। এক্ষেত্রে পরস্পর অর্থ প্রতিযোগী ও অনুযোগী। অন্যোন্যের অভাব অন্যোন্যাভাব। দুটি ভিন্ন জিনিসের মধ্যে পাস্পরিক যে অভাব, তাকে বলে অন্যোন্যাভাব। যেমন, গরু ও অশ্বের পারস্পরিক অভাব। এই অন্যোন্যাভাবের দ্বিবিধ বৈশিষ্ট্য।
প্রথমত, যে ভেদবিশেষের যা প্রতিযোগী, তা তারই অনুযোগী হয় না। যেমন, জলভেদের প্রতিযোগী জল। সুতরাং, জল জলভেদের অনুযোগী হয় না। যদি তা হতো তাহলে জল ‘জল ভিন্ন’ হতো। ভেদের প্রতিযোগী এবং অনুযোগী পরস্পর বিভিন্ন পদার্থই হবে এরূপ স্বভাব নির্ধারিত থাকায় জল কখনও জলভিন্ন হয় না। কিন্তু জলভিন্ন হয় অগ্নি বা অন্যান্য কিছু।
দ্বিতীয়ত, যে প্রতিযোগী পদার্থের ভেদ যে অনুযোগী পদার্থে থাকে, সেই অনুযোগী পদার্থের ভেদও সেই প্রতিযোগী পদার্থে অবশ্যই থাকে। যেমন, রাম শ্যাম হতে ভিন্ন। সুতরাং, শ্যামও রাম থেকে ভিন্ন হবেই। প্রতিযোগী ও অনুযোগীর পরস্পর এই বৈপরীত্য থেকে ভেদের অন্যোন্যাভাব সংজ্ঞার তাৎপর্য বোঝা যায়।
 .
নব্য নৈয়ায়িক বিশ্বনাথ ন্যায়-পঞ্চানন মুক্তাবলীতে অন্যোন্যাভাবের লক্ষণে বলেছেন-

‘অন্যোন্যাভাবত্বং তাদাত্ম্য-সম্বন্ধাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাকাভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে অভাবের প্রতিযোগিতা তাদাত্ম্য (অবিচ্ছেদ্য) সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন (পৃথক) সেই অভাবকেই অন্যোন্যাভাব বলে।
 .
এই লক্ষণ অনুসারে, ‘ঘট পট নয়’ বা ‘গরু অশ্ব নয়’ ইত্যাদি বাক্যে যে অভাবের কথা বলা হয় তাই অন্যোন্যাভাব। প্রশ্ন হলো, এরূপ আকারের অভাবসূচক বাক্যে কাকে নিষেধ করা হয় ? ‘ঘট পট নয়’ এরূপ প্রতীতির বিষয়রূপে যে অভাব তা ঘট-অনুযোগিক ও পট-প্রতিযোগিক। ঘটে পট নিষিদ্ধ হয় তাদাত্ম্য সম্বন্ধে। তাই তাদাত্ম্য সম্বন্ধটি প্রতিযোগিতার অবচ্ছেদক বা প্রতিযোগিতাবচ্ছেদক সম্বন্ধ। এক্ষেত্রে ঘটাধিকরণে পটরূপ প্রতিযোগীকে তাদাত্ম্য সম্বন্ধে নিষেধ করা হয়। অন্যোন্যাভাব সম্পর্কে এটিই নব্যমত।
 .
অন্যদিকে প্রাচীনমতে অন্যোন্যাভাবে যা নিষিদ্ধ হয় তা হলো দুটি পদার্থের তাদাত্ম্য সম্বন্ধ, তাদাত্ম্যসম্বন্ধাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগী নয়। ‘ঘট পট নয়’ এরূপ অভাবপ্রতীতির বিষয় হলো পট-তাদাত্ম্য। এক্ষেত্রে প্রাচীন মতানুসারী নৈয়ায়িক আচার্য উদয়ন বলেন- ‘এই বাক্যের দ্বারা যার নিষেধ হয়, তা হচ্ছে ঘটের সঙ্গে পটের তাদাত্ম্য। কাজেই অন্যোন্যাভাবের প্রতিযোগী হচ্ছে এই তাদাত্ম্য সম্বন্ধ। তবে এই তাদাত্ম্য বাস্তবিক তাদাত্ম্য নয়। ঘটের সঙ্গে পটের বাস্তবিক তাদাত্ম্য থাকে না। যখন ‘ঘট পট নয়’ এই জ্ঞান হয়, তখন ঘটে আরোপিত পট-তাদাত্ম্যের নিষেধ বিষয় হয়। এখানে নিষেধ করা হচ্ছে পট-তাদাত্ম্যের। ঘটেই নিষেধ করা হচ্ছে। কাজেই ঘট হচ্ছে এই নিষেধের অধিকরণ বা অনুযোগী এবং পট-তাদাত্ম্য হচ্ছে প্রতিযোগী।
 .
কিন্তু নব্য ন্যায়মতে নিষেধের বিষয় পট-তাদাত্ম্য নয়, পট। তবে পট ঘটে নিষিদ্ধ হচ্ছে তাদাত্ম্য সম্বন্ধে। সুতরাং তাদাত্ম্য সম্বন্ধটি প্রতিযোগী নয়, প্রতিযোগিতার অবচ্ছেদক সম্বন্ধ। অর্থাৎ, যে প্রতিযোগীটি তাদাত্ম্য সম্বন্ধে নিষিদ্ধ হয়, তাকে বলে অন্যোন্যাভাব। নব্যনৈয়ায়িক অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহে অন্যোন্যাভাবের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘তাদাত্ম্যসম্বন্ধাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাকঃ অন্যোন্যাভাবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অন্যোন্যাভাব হলো সেই অভাব যার প্রতিযোগিতা তাদাত্ম্য সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন।
 .
অন্যোন্যাভাব এক ও নিত্য। ‘ঘট পট নয়’, ‘গরু অশ্ব নয়’, ‘রাম রহিম নয়’ প্রভৃতি অভাব প্রতীতিতে একই নিত্য অন্যোন্যাভাব প্রতীত হয়। এই অভাব বা পারস্পরিক ভেদ এমন নয় যে আজ আছে, কাল থাকবে না। এই ভেদ চিরকালীন। ঘট ও পট বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তাদের ভেদ অবিনাশী। কোন ঘট ও পট না থাকলেও ঘট ও পটের ভেদ থাকেই। ঘট ও পট বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু বিনষ্ট হয়ে এক হয়ে যেতে পারে না। কারণ দুটি ভিন্ন বস্তু কখনই অভিন্ন হতে পারে না। তাই অন্যোন্যাভাব নিত্য।
 .
(খ) সংসর্গাভাব : অন্যোন্যাভাব ভিন্ন অভাবকে বলা হয় সংসর্গাভাব। যার দ্বারা একটি পদার্থ অন্য একটি পদার্থের আশ্রয় হয় তাকে সংসর্গ বলে। সংযোগ, সমবায় প্রভৃতি সম্বন্ধের দ্বারা একটি পদার্থ অন্য একটি পদার্থের আশ্রয় হয় বলে সংযোগাদিকে সংসর্গ বলে। তাদাত্ম্য (অবিচ্ছেদ্যতা) এই অর্থে সংসর্গ নয়। যে অভাব স্বপ্রতিযোগী সংসর্গবিরোধী তাই সংসর্গাভাব। সংসর্গাভাবমাত্রই তাই কোন অনুযোগীতে কোন প্রতিযোগীর সংসর্গের অভাব। যেমন, টেবিলে ঘটের অভাব। এখানে অনুযোগী টেবিলে প্রতিযোগী ঘটের সংসর্গের অভাব প্রতীতি হয়। এভাবে সংসর্গাভাবকে অন্যোন্যাভাবভিন্ন অভাব বলা যায়। তাই সংসর্গাভাবের লক্ষণে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন মুক্তাবলীতে বলেছেন-

‘সংসর্গাভাবান্যোন্যাভাবভিন্ন অভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : অন্যোন্যাভাব ভিন্ন অভাবই হলো সংসর্গাভাব।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, অন্যোন্যাভাবের প্রতিযোগী কেবল তাদাত্ম্য সম্বন্ধের দ্বারাই অবচ্ছিন্ন হয়, কিন্তু সংসর্গাভাবের প্রতিযোগী সংযোগ, সমবায়, স্বরূপ প্রভৃতি সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হতে পারে।
সংসর্গাভাব ত্রিবিধ- (১) প্রাগভাব, (২) ধ্বংসাভাব ও (৩) অত্যন্তাভাব।
 .
(১) প্রাগভাব : কোন একটি বস্তু উৎপন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তা যে অভাব, তাকে প্রাগভাব বলে। প্রাক+অভাব- এইরূপ ব্যুৎপত্তি অনুসারে কোন কার্যের উৎপত্তির পূর্বে তার সমবায়িকারণে ঐ কার্যের যে অভাব, তাই ঐ কার্যের প্রাগভাব। যেমন, একটা বস্ত্রের উৎপত্তির পূর্বে, সুতোতে ঐ বস্ত্রের অভাব হলো ঐ বস্ত্রের প্রাগভাব। বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন মুক্তাবলীতে প্রাগভাবের লক্ষণে বলেছেন-

‘বিনাশ্যভাবত্বং প্রাগভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে অভাব বিনাশ্য বা যে অভাবের বিনাশ আছে তাই প্রাগভাব।
 .
এখানে ‘যে অভাবের বিনাশ আছে’ বলতে বোঝায়, যে অভাবের বিনাশ আছে কিন্তু উৎপত্তি নেই। কেননা, যে ঘটটি এখনও উৎপন্ন হয়নি, জগতে সেই ঘটের অভাব আছে। এই অভাব কখন শুরু হয়েছে কেউ জানে না। উৎপত্তির পূর্বে একটি পদার্থ কোন কালেই থাকতে পারে না, তাই তার প্রাগভাব অনাদি। তবে যে মুহূর্তে ঘটটি উৎপন্ন হবে, সেই মুহূর্তেই ঐ ঘটের অভাব বিনষ্ট হবে। অর্থাৎ প্রাগভাব সান্ত, তার অন্ত বা শেষ আছে। তাই তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট আরো স্পষ্টভাবে প্রাগভাবের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘অনাদি সান্তঃ প্রাগভাবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে অভাব অনাদি ও সান্ত, তাই প্রাগভাব।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, যে প্রতিযোগীর প্রাগভাব থাকে, তারই উৎপত্তি হয়, আবার প্রতিযোগীর উৎপত্তিতে প্রাগভাব বিনষ্ট হয়। তাই প্রাগভাব একাধারে প্রতিযোগীর জনক এবং প্রতিযোগীর দ্বারা বিনাশ্য।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা কোন কার্যের প্রাগভাবকে সেই কার্যের কারণ বলে স্বীকার করেছেন। যেহেতু প্রাগভাবকে কারণ বলে না মানলে একই ঘটের বারবার উৎপত্তির সম্ভাবনা স্বীকার করতে হবে। কারণ কুম্ভকার, ঘট-কপাল, কপালদ্বয়ের সংযোগ, কুম্ভকারের চক্র, লাঠি ইত্যাদি, দিক, কাল, অদৃষ্ট প্রভৃতি ঘট উৎপত্তির কারণ। এই কারণগুলির কোনটিই পরক্ষণে বিনষ্ট হতে বাধ্য নয়। সুতরাং, অনায়াসেই কল্পনা করা যায় যে, ঘটটি উৎপন্ন হওয়ার পরক্ষণেও এই কারণগুলি থাকবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়ক্ষণে আবার ঘটটির উৎপত্তি স্বীকার করতে হবে। যেহেতু কারণসমূহ উপস্থিত থাকলে পরক্ষণে কার্য উৎপন্ন হতে বাধ্য। কিন্তু একই ঘটের বারবার উৎপত্তি কেউ স্বীকার করেন না। যদি প্রাগভাবকে কারণ বলে স্বীকার করা হয় তাহলে এই সমস্যার সহজেই সমাধান করা যায়। কুম্ভকার, কপাল ইত্যাদির মতো ঘটের প্রাগভাবও ঘট উৎপত্তির কারণ। কিন্তু এই কারণটি অন্যান্য কারণের মতো নয়। ঘটটি উৎপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কারণ বিনষ্ট হয়ে যায়।
 .
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, কার্যের প্রাগভাবের অধিকরণ কী ? অর্থাৎ ঘটটি উৎপত্তির পূর্বে ঐ ঘটের প্রাগভাব কোথায় ছিলো ?
ন্যায়-বৈশেষিক আচার্যরা এর উত্তরে বলেন, কার্যোৎপত্তির পূর্বে কার্যের সমবায়িকারণে তার প্রাগভাব থাকে। একটি ঘটের উৎপত্তির পূর্বে ঐ ঘটটির সমবায়িকারণ যে কপালদ্বয়, সেই কপালদ্বয়ই হলো ঐ ঘটের প্রাগভাবের অধিকরণ। ঘট ঘটাভাবের প্রতিযোগী। উভয়ের মধ্যে বিরোধ থাকায় ঘটের উৎপত্তিতে ঘটাভাব বিনষ্ট হয়। এজন্য প্রাগভাবকে বিনাশ্য অভাব বলা হয়। প্রাগভাবের অস্তিত্বে প্রমাণ হলো ‘কোন কার্য উৎপন্ন হবে’ এরূপ ব্যবহার।
 .
(২) ধ্বংসাভাব : কোন একটি জিনিস ধ্বংস হয়ে যাবার পর তার যে অভাব শুরু হয়, তাকে ধ্বংসাভাব বলে। কোন কার্য বিনষ্ট হলে তার যে অভাব তাই ধ্বংসাভাব। যেমন একটি ঘট ভেঙে গেলে, তার সমবায়িকারণে বা অংশগুলিতে ঐ ঘটটির যে অভাব, তাই ঐ ঘটের ধ্বংসাভাব। মুক্তাবলীতে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন ধ্বংসাভাবের লক্ষণে বলেছেন-

‘জন্য অভাবত্বং ধ্বংসত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে অভাব জন্য বা যে অভাবের উৎপত্তি আছে তাই ধ্বংসাভাব।
 .
এখানে ‘যে অভাবের উৎপত্তি আছে’ বলতে বোঝায়, যে অভাবের উৎপত্তি আছে কিন্তু বিনাশ নেই। ধ্বংসাভাবের আদি আছে যেহেতু একটি বস্তুর বিশেষ বিশেষ সময়ে ধ্বংস হয়। কিন্তু এই অভাবের অন্ত বা শেষ নেই, যেহেতু ঐ বিনষ্ট ঘটটি আর কোনদিনই ফিরে আসবে না। তাই অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ধ্বংসাভাবের লক্ষণে আরো স্পষ্টভাবে বলেন-

‘সাদিরনন্তঃ প্রধ্বংসঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে অভাব সাদি ও অনন্ত, তাই ধ্বংসাভাব।
 .
প্রাগভাবের ন্যায় ধ্বংসাভাবও নিজ প্রতিযোগীর সমবায়িকারণে অবস্থিত হয় এবং ঐ সমবায়িকারণ নষ্ট হলে কালিক সম্বন্ধে থাকে। প্রাগভাবের সঙ্গে ধ্বংসাভাবের পার্থক্য হলো, প্রাগভাগ তার প্রতিযোগীর জনক, কিন্তু ধ্বংসাভাব তার প্রতিযোগীর দ্বারা জন্য বা উৎপন্ন। অর্থাৎ ঘট ধ্বংসের একটি কারণ হলো ঘট নিজে। উৎপত্তিযোগ্য দ্রব্য, গুণসমূহ, যাবতীয় কর্ম এবং প্রাগভাব- এরা ধ্বংসের প্রতিযোগী। কিন্তু ধ্বংস স্বয়ং কোন ধ্বংসের প্রতিযোগী নয়, যেহেতু ধ্বংসের ধ্বংস স্বীকৃত হয় না।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, ধ্বংসাভাব উৎপন্ন হয় অথচ বিনষ্ট হয় না। ঘট, পট, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি ভাবপদার্থ বিশেষ সময়ে উৎপন্ন হয়ে আবার তা একসময়ে বিনষ্ট হলেও, অভাবপদার্থের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কারণ ধ্বংসাভাবের অভাবপদার্থ বিনাশ হতে হলে যার দ্বারা ঐ অভাব উৎপন্ন হয়েছে সেই পদার্থেরই পুনরাবির্ভাব দরকার। কিন্তু বিনষ্ট পদার্থের পুনরাবির্ভাব কখনোই সম্ভব নয়। বিনষ্ট পদার্থের পুনরাবির্ভাবের জন্য তার কারণসামগ্রির উপস্থিতি প্রয়োজন। কোন পদার্থের প্রাগভাব তার কারণসামগ্রির অন্তর্গত। প্রাগভাব বিনষ্ট হয়েই পদার্থটির উৎপত্তি হয়েছে। ঐ প্রাগভাবের উপস্থিতি তাই আর কোনভাবেই সম্ভব নয়। ফলে ঐ পদার্থের পুনরাবির্ভাবও সম্ভব নয়। এজন্যেই ধ্বংসাভাব অনন্ত বা অবিনাশী।
 .
(৩) অত্যন্তাভাব : কোন একটি জিনিসে অন্য কোন একটি জিনিসের চিরকালীন যে অভাব, তাকে বলে অত্যন্তাভাব। যেমন, বায়ুতে রূপের অভাব বা জলে গন্ধের অভাব প্রভৃতি অত্যন্তাভাবের দৃষ্টান্ত। বায়ুতে রূপ বা জলে গন্ধ কখনো ছিলো না, আবার কখনো থাকবেও না। এই অভাব নিত্য অর্থাৎ অনাদি ও অনন্ত। মুক্তাবলীতে অত্যন্তাভাবের লক্ষণে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন বলেছেন-

‘নিত্যসংসর্গাভাবত্বম্ অত্যন্তাভাবত্বম’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : নিত্য সংসর্গের অভাবই হলো অত্যন্তাভাব।
 .
ধ্বংসাভাবের আদি আছে, অন্ত নেই। প্রাগভাবের অন্ত আছে, আদি নেই। কিন্তু অত্যন্তাভাবের আদিও নেই, অন্তও নেই। এই নিত্য সংসর্গের অভাব ত্রৈকালিক অর্থাৎ অতীতে যে অভাব ছিলো, বর্তমানে সে অভাব আছে এবং ভবিষ্যতেও এই অভাব থাকবে। তাই অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অত্যন্তাভাবের লক্ষণে বলেন-

‘ত্রৈকালিক সংসর্গাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাকঃ অত্যন্তাভাবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে অভাব ত্রৈকালিক অর্থাৎ নিত্য এবং যার প্রতিযোগিতা কোন সংসর্গ বা সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন, তাই অত্যন্তাভাব।
 .
অত্যন্তাভাব নিত্য হিসেবে প্রাচীন নৈয়ায়িকেরা আকাশে কুসুমের অভাবের ন্যায় অলীকের অভাবকে অত্যন্তাভাব বলে উল্লেখ করলেও নব্য নৈয়ায়িকেরা অবশ্য অলীকের অভাব স্বীকার করেন না।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অন্যোন্যাভাব, প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব ও অত্যন্তাভাব এই চতুর্বিধ অভাব সাধারণভাবে প্রচলিত। কিন্তু এই চতুর্বিধ বিভাগ ছাড়াও ন্যায়-বৈশেষিক প্রস্থানে নানা ধরনের অভাবের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় এ ধরনের কয়েকটি অভাবের আলোচনা করেছেন, যেমন- সাময়িক অভাব, অভাবের অভাব, ব্যধিকরণ ধর্মাবচ্ছিন্ন অভাব, কেবলাভাব, বিশিষ্টাভাব, সামান্যাভাব, বিশেষাভাব, অন্যতরাভাব, উভয়াভাব প্রভৃতি। ভিন্ন ভিন্ন নামে উল্লিখিত হলেও এই অভাবগুলি ইতঃপূর্বে বর্ণিত চতুর্বিধ বিভাগের কোন না কোনটির অন্তর্গত হতে পারে বলে মনে করা হয়।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: সমবায়] [*] [পরের পর্ব: কারণ ও তার বিভাগ]

No comments: