Thursday, August 9, 2012

| বৈশেষিক দর্শন…০৮ : সমবায় |

 .
| বৈশেষিক দর্শন…০৮ : সমবায় |
রণদীপম বসু

২.৬ : সমবায় (Inherence) 
.
বৈশেষিক দর্শনে সপ্তপদার্থকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাবপদার্থ ছয়টি, আর একটি অভাবপদার্থ। ছটি ভাবপদার্থের ষষ্ঠ তথা সর্বশেষ ভাবপদার্থটি হচ্ছে সমবায়।

 .
বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় যেমন নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল বিভিন্ন দ্রব্য পদার্থ স্বীকার করেছেন, তেমনি এই সকল পদার্থের পারস্পরিক সম্বন্ধেরও নিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। জগতের সকল পদার্থই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কোন না কোন সম্বন্ধে সম্পর্কযুক্ত। পদার্থের এই পারস্পরিক সম্বন্ধগুলি নানা প্রকারের, যেমন- সমবায়, সংগোগ, বিভাগ, স্বরূপ প্রভৃতি। এ সকল সম্বন্ধের মধ্যে সমবায় সম্বন্ধকে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সমবায় এক ধরনের সম্বন্ধ হলেও জগতের সাতটি মৌলিক পদার্থের অন্যতম। সমবায় ভিন্ন অন্যান্য সম্বন্ধগুলিকে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় অন্যান্য পদার্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। একমাত্র সমবায়ই স্বতন্ত্র পদার্থের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি নিশ্চয়ই গুরুত্ববহ।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে কার্য-কারণভাব, আত্মাদি দ্রব্যের নিত্যতা প্রভৃতি বহু মুখ্য সিদ্ধান্ত সমবায়-নির্ভর। অন্যদিকে সাংখ্য, বেদান্ত, বৌদ্ধ, জৈন ও ভাট্ট মীমাংসায় সমবায় উপেক্ষিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আবার প্রাভাকর মীমাংসক সম্প্রদায় মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের অনুগমন করে সমবায়কে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একমাত্র ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনেই সমবায় সগৌরবে এবং সমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।
 .
মূলত দুটি পদার্থের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য ও নিত্য সম্পর্কের নাম ‘সমবায়’। বৈশেষিক সূত্রকার মহর্ষি কণাদ সপ্তম অধ্যায়ের দ্বিতীয় আহ্নিকে বলেছেন-

‘ইহেদমিতি যতঃ কার্যকরণয়োঃ স সমবায়ঃ’। (বৈশেষিকসূত্র: ৭/২/২৬)।
অর্থাৎ : কার্য ও কারণের এবং অকার্য ও অকারণের সম্বন্ধই সমবায় পদার্থ।
 .
মহর্ষি কণাদ সমবায়কে অন্যতম পদার্থরূপে উল্লেখ করলেও তিনি সমবায়ের স্বরূপ প্রকাশ করেননি। ভাষ্যকার প্রশস্তপাদই বিস্তারিতভাবে সমবায়ের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ন্যায়-বৈশেষিক আচার্যরা সমবায় পদার্থের আলোচনা করেছেন। আচার্য প্রশস্তপাদ উদ্দেশ প্রকরণে সমবায়ের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন-

‘অযুতসিদ্ধানাম্ আধার্যাধারভূতানাং যৎ সম্বন্ধ ইহ প্রত্যয়হেতুঃ স সমবায়ঃ’। (প্রশস্তপাদভাষ্য)।
অর্থাৎ : অযুতসিদ্ধ ও আধার-আধেয়রূপ পদার্থ সমূহের যে সম্বন্ধ আধার-আধেয় ভাবরূপ প্রত্যয়ের হেতু তাই সমবায়।
 .
উক্ত ভাষ্যে সমবায়ের গুরুত্বপূর্ণ দুটি লক্ষণ চিহ্নিত করা হয়েছে, ‘অযুতসিদ্ধানাম্’ বা অযুতসিদ্ধরূপী এবং ‘আধার্যাধারভূতানাং’ বা আধার-আধেয়রূপ পদার্থ। অযুতসিদ্ধ পদার্থ হলো সেই পদার্থ যা অন্য একটি পদার্থের সঙ্গে এমনভাবে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকে যে ঐ দুই পদার্থের কোন একটির বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যেমন সুতার সঙ্গে পট বা কাপড়ের সম্বন্ধ। কাপড় সুতার মধ্যেই অবস্থান করে। কাপড় ও সুতা পৃথকভাবে অবস্থান করতে পারে না। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অযুতসিদ্ধ-এর সংজ্ঞা দিয়েছেন-

‘যয়োঃ দ্বয়োঃ মধ্যে একম্ অবিনশ্যৎ এব অবতিষ্ঠতে তাবৎ অযুতসিদ্ধৌ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে দুটি পদার্থের একটি, তার বিনাশ পর্যন্ত, অন্যটিতে আশ্রিত হয়েই থাকে, সে দুটি পদার্থ অযুতসিদ্ধ।
 .
তাই প্রশস্তপাদ-ভাষ্যোক্ত ‘অযুতসিদ্ধানাম্’ পদকে সমবায়ের লক্ষণ নির্দেশ বলে বর্ণনা করে কিরণাবলীকার আচার্য উদয়ন ‘অযুতসিদ্ধ’ পদের অর্থ নিরূপণার্থে বলেন-

‘অযুতাঃ প্রাপ্তাশ্চসিদ্ধা ইতি অযুতসিদ্ধাঃ’। (কিরণাবলী)।
অর্থাৎ : যারা প্রাপ্ত হয়েই (অযুত) সিদ্ধ হয় তারাই অযুতসিদ্ধ।
 .
যারা কখনো অপ্রাপ্ত থাকে না, সর্বদা প্রাপ্ত হয়েই থাকে তারাই অযুতসিদ্ধ এবং তাদের মধ্যস্থিত প্রাপ্তসম্বন্ধই সমবায়। সমবায়কে তাই নিত্যপ্রাপ্তি সম্বন্ধ বলা যায়। উদয়নের মতে তাই ‘নিত্যপ্রাপ্তিঃ সম্বন্ধঃ সমবায়ঃ’ অর্থাৎ ‘নিত্যপ্রাপ্তি সম্বন্ধই সমবায়’। বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চাননও মুক্তাবলীতে নিত্যসম্বন্ধকেই সমবায়ের লক্ষণ বলেছেন। এবং নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে সমবায়ের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘নিত্যসম্বন্ধঃ সমবায়ঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : নিত্য সম্বন্ধই সমবায়।
 .
উল্লেখ্য, যদি দুটি পদার্থ পরস্পর যুত হয়ে (অসম্বন্ধ হয়ে) সিদ্ধ হয়, অর্থাৎ পরস্পরের সম্বন্ধ নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারে, সে দুটি পদার্থকে যুতসিদ্ধ বলা হয়। দুটি যুতসিদ্ধ পদার্থের সম্বন্ধকে সংযোগ বলা হয়। যুতসিদ্ধ ভিন্ন পদার্থকেই অযুতসিদ্ধ বলা হয়েছে। যেমন হাতের সাথে কলমের যে সম্পর্ক তা সংযোগ। কেননা হাত ও কলম দুটি যুতসিদ্ধ পদার্থ। অর্থাৎ পূর্বে হাত ও কলমের সম্পর্ক বিযুক্ত ছিলো এবং পরেও তা বিযুক্ত হয়ে ভিন্ন আশ্রয়ে আশ্রিত হতে পারে। তাই সংযোগ অনিত্য সম্পর্ক বলে তা অযুতসিদ্ধ নয়। কিন্তু সমবায় হচ্ছে নিত্য সম্বন্ধ।
 .
সমবায়ের অপর লক্ষণটি হলো আধার্যাধার বা আধার-আধেয়ভাব। সমবায়ের আধার-আধেয়ভাব একপাক্ষিক। যেমন মনুষ্যত্ব জাতি রাম, শ্যাম প্রভৃতি ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে এমনভাবে সম্বন্ধযুক্ত থাকে যে, ব্যক্তিমানুষের নাশ না হওয়া পর্যন্ত মনুষ্যত্বকে ব্যক্তিমানুষ থেকে পৃথক করা যায় না। তেমনি ঘট থেকে ঘটের রূপকে, পট বা কাপড় থেকে তন্তু বা সুতাকে, ঘট বা পটকে অক্ষুণ্ন রেখে পৃথক করা যায় না। ব্যক্তিমানুষ ও মনুষ্যত্ব জাতি, ঘট ও ঘটরূপ, পট ও তন্তুকে তাই অযুতসিদ্ধ পদার্থ বলা হয়। এগুলির সম্পর্ক আবার আধার-আধেয় সম্পর্ক। আধেয় মনুষ্যত্ব জাতির আধার হচ্ছে ব্যক্তিমানুষ, আধার ঘটরূপে আধেয় হচ্ছে ঘট ইত্যাদি। এদের পারস্পরিক সম্বন্ধ হলো সমবায় সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধই দুটি পদার্থের অযুতসিদ্ধরূপে প্রতীতির কারণ বা হেতু।
 .
অন্যদিকে ‘হাঁড়িতে আম আছে’ এইরূপ আধার্যাধার পদার্থদ্বয়ের আধার-আধেয় ভাবরূপ প্রত্যয়ের হেতু সংযোগ সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধকে কোনভাবে সমবায় সম্বন্ধ বলা যাবে না, এতে সমবায় লক্ষণের অতিব্যাপ্তি দোষ ঘটে। কারণ আধার হাঁড়ির সঙ্গে আধেয় আমের সম্বন্ধ হচ্ছে সংযোগ সম্বন্ধ। হাঁড়ি ও আম এই পদার্থদ্বয় হলো যুতসিদ্ধ। যুতসিদ্ধ পদার্থদ্বয় পরস্পর পরস্পরকে পরিহার করে ভিন্ন আশ্রয়ে আশ্রিত হতে পারে। আম হাঁড়িতে না থেকে অন্যত্র থাকতে পারে। সংযোগ নিত্য সম্বন্ধ নয়। তাই আম ও হাঁড়ির সম্বন্ধকে সমবায় বলা হয় না।
 .
আবার ধর্ম ও সুখ, অধর্ম ও দুঃখ সমানাধিকরণ হওয়ায় সব সময় ধর্মের সঙ্গে সুখ এবং অধর্মের সঙ্গে দুঃখ থাকে। ধর্ম হলো সুখের কারণ, অধর্ম হলো দুঃখের কারণ। ধর্ম ও অধর্ম আত্মার গুণ হিসেবে যেমন আত্মাতে আশ্রিত, তেমনি সুখ ও দুঃখ আত্মার গুণ হিসেবে আত্মাতে আশ্রিত। সুতরাং বলা যায় যে ধর্ম ও সুখ, অধর্ম ও দুঃখ অযুতসিদ্ধ সম্বন্ধ (অভিন্নাশ্রয়ত্ববিশিষ্ট)। কিন্তু ধর্ম ও সুখ এবং অধর্ম ও দুঃখের মধ্যে আধার-আধেয় ভাব না থাকায় এদের মধ্যস্থিত সম্বন্ধ সমবায় বলে বিবেচিত হয় না।
 .
অর্থাৎ, যে সম্বন্ধে অযুতসিদ্ধ ও আধার-আধেয়ভাবের সার্বত্রিক ও সর্বকালিক প্রতীতি হয়, তাই সমবায় সম্বন্ধ। ন্যায়মতে সমবায় প্রত্যক্ষসিদ্ধ, অর্থাৎ সমবায়ের জ্ঞান হয় প্রত্যক্ষের দ্বারা। কিন্তু বৈশেষিক মতে, সমবায় প্রত্যক্ষের দ্বারা জ্ঞাত হতে পারে না। তাঁদের মতে, সমবায়ের অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ। এবং এই মতে, সমবায় নিত্য ও এক।
 .
সমবায়ের দৃষ্টান্ত বা ক্ষেত্র :
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সমবায়ের দৃষ্টান্ত হলো পঞ্চবিধ। ‘দৃষ্টান্ত’ বলতে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ জোড়া সম্বন্ধীর কথা বোঝানো হয়েছে। এই পাঁচটি যুগ্ম পদার্থ অযুতসিদ্ধ। সমবায়ের এই বিভিন্ন দৃষ্টান্তগুলিকে উল্লেখপূর্বক সমবায়ের পরিচয় নির্দেশ করতে গিয়ে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন তাঁর ভাষাপরিচ্ছেদ গ্রন্থে বলেছেন-

‘ঘটাদীনাং কপালাদৌ দ্রব্যেষু গুণকর্মণোঃ
তেষু জাতেশ্চ সম্বন্ধঃ সমবায়ঃ প্রকীর্তিতঃ।।’ (ভাষাপরিচ্ছেদ)।
অর্থাৎ : দ্রব্য ও গুণ, দ্রব্য ও কর্ম, জাতি ও ব্যক্তি, অবয়ব ও অবয়বী, নিত্যদ্রব্য ও বিশেষের মধ্যে যে সম্বন্ধ, তাই হলো সমবায় সম্বন্ধ।
 .
এই সমবায় সম্বন্ধই অযুতসিদ্ধ। অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে তাবৎ অযুতসিদ্ধ সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন-

‘তাবৎ অযুতসিদ্ধৌ যথা অবয়ব-অবয়বিনৌ, গুণ-গুণিনৌ, ক্রিয়া-ক্রিয়াবন্তৌ, জাতি-ব্যক্তী, বিশেষ নিত্যদ্রব্যে চেতি।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অবয়ব-অবয়বী, গুণ-গুণী (দ্রব্য), ক্রিয়া-ক্রিয়াবান (দ্রব্য), জাতি-ব্যক্তি, বিশেষ-নিত্যদ্রব্য এই পাঁচটি যুগ্ম পদার্থ অযুতসিদ্ধ। এদের সম্বন্ধ সমবায়।
 .
অতএব, ন্যায়-বৈশেষিক মতে সমবায় সম্পর্ক পাঁচ প্রকারের- (১) দ্রব্য ও গুণের (গুণ-গুণীর)  সম্পর্ক, (খ) দ্রব্য ও কর্মের (ক্রিয়া-ক্রিয়াবান) সম্পর্ক, (৩) ব্যক্তি ও জাতির সম্পর্ক, (৪) অবয়ব ও অবয়বীর (অংশ-অংশীর) সম্পর্ক, (৫) নিত্যদ্রব্য ও বিশেষের সম্পর্ক।
 .
(১) দ্রব্য ও গুণের সম্পর্ক : গুণ দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, ঘটের রূপ হচ্ছে তার গুণ এবং তা ঘটে (দ্রব্যে) সমবায় সম্বন্ধে থাকে। ঘট ও তার রূপ- এ দুটির অন্তত একটি (ঘটের রূপ) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ঘটেই থাকে। কিন্তু ঘট অন্তত একটি ক্ষণ (উৎপত্তি ক্ষণ) রূপ ছাড়া থাকতে পারে। তাই তারা অযুতসিদ্ধ।
 .
(২) দ্রব্য ও কর্মের সম্পর্ক : ক্রিয়া দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, গাছের পাতা (দ্রব্য) ও তার ক্রিয়া- এ দুটির মধ্যে অন্তত একটি (ক্রিয়া) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ গাছের পাতাতেই থাকে। উৎপত্তিকালীন দ্রব্যে ক্রিয়া থাকে না বলে দ্রব্য ক্রিয়াহীন থাকতে পারে। এ দুটির মধ্যে অন্তত একটি অপরটি থেকে অবিচ্ছেদ্য বলে তারা অযুতসিদ্ধ।
 .
(৩) ব্যক্তি ও জাতির সম্পর্ক : জাতি দ্রব্য, গুণ ও ক্রিয়াতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, জাতি (গোত্ব) ব্যক্তি গো-তে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। গোত্ব  ও গো (গরু)-এ দুটির মধ্যে গো (গরু) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তাতে গোত্ব জাতি থাকবেই। কিন্তু গো-ব্যক্তি না থাকলেও গোত্ব জাতি থাকতে পারে। এ দুটির মধ্যে অন্তত একটি অপরটি থেকে অবিচ্ছেদ্য বলে তারা অযুতসিদ্ধ।
 .
(৪) অবয়ব ও অবয়বীর সম্পর্ক : অবয়বী অবয়বে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন বস্ত্র (অবয়বী) সুতা বা তন্তুতে (অবয়ব) সমবায় সম্বন্ধে থাকে। তন্তু বস্ত্র ছাড়া থাকতে পারে, কিন্তু বস্ত্র তন্তু ছাড়া থাকতে পারে না। এই দুটি পদার্থের মধ্যে অন্তত একটি (বস্ত্র) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তা তন্তুতেই থাকে। তাই তারা অযুতসিদ্ধ।
 .
(৫) নিত্যদ্রব্য ও বিশেষের সম্পর্ক : পরমাণু, আকাশ, দিক্, কাল, আত্মা, মন প্রভৃতি নিত্যদ্রব্যে বিশেষ থাকে সমবায় সম্বন্ধে। এক্ষেত্রে সম্বন্ধী দুটিই নিত্য বলে এরা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। তাই তারা অযুতসিদ্ধ।
 .
সংযোগ ও সমবায়
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সম্বন্ধ প্রধানত দুই রকমের- সংযোগ ও সমবায়। ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে সংযোগকে সম্বন্ধ বলা হলেও সংযোগ ও সমবায়ের মধ্যে নানা পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
 .
১. সমবায় স্বরূপগতভাবে সম্বন্ধ হলেও তা ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে একটি স্বতন্ত্র পদার্থরূপে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু সংযোগকে পদার্থ বলা হয় নি। সংযোগকে গুণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
 .
২. সমবায়কে নিত্য সম্বন্ধ বলা হয়েছে। কিন্তু সংযোগ অনিত্য সম্বন্ধ। যেখানে সংযোগ সম্বন্ধ হয়, সেখানে শেষে বিভাগ দেখা যেতে পারে। যেমন, বৃক্ষে পাখির যে সংযোগ বা হাতের সাথে পুস্তকের যে সংযোগ, তা শেষে বিভাগ হলে নষ্ট হয়ে যায়। গাছ থেকে পাখি আবার উড়ে গেলে গাছের সাথে পাখির সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তাই সংযোগ অনিত্য সম্বন্ধ।
অপরপক্ষে, কপাল (আকৃতি) ও ঘটের যে সমবায় সম্বন্ধ তা বিভাগে শেষ হয়ে যায় না। ঘট বা   কপাল কোনটিই কখনও বিভক্ত হয়ে অবস্থান করে না। সমবায়ের উৎপত্তি ও বিনাশ নাই। সমবায়ের সম্বন্ধীর বিনাশে সম্বন্ধের জ্ঞান সামগ্রি বিনষ্ট হয়, কিন্তু সমবায় নিত্য ও স্বতন্ত্র বলে তা বিনষ্ট হয় না।
 .
৩. সমবায় সম্বন্ধ অবয়ব-অবয়বী, দ্রব্য-গুণ প্রভৃতি অযুতসিদ্ধ পদার্থেই হয়। অপরপক্ষে, সংযোগ যে সম্বন্ধীদ্বয়ে থাকে তা যুতসিদ্ধ, অযুতসিদ্ধ নয়। দণ্ড পুরুষ প্রথমে অসম্বন্ধ থাকে, পরে সম্বন্ধ হয়। তাই দণ্ড ও পুরুষ যুতসিদ্ধ পদার্থ। এদের সম্বন্ধই সংযোগ। কিন্তু ঘট ও তার রূপ, ঘট ও ঘটত্ব কখনও অসম্বন্ধ হয়ে থাকতেই পারে না। তাই তারা অযুতসিদ্ধ পদার্থ। এদের সম্বন্ধই সমবায়।
 .
৪. সংযোগ সম্বন্ধ দুটি দ্রব্যেই হয়। দ্রব্যাতিরিক্ত পদার্থে সংযোগ হয় না। ঘট ও পট দুটি দ্রব্য। এদের সংযোগ হতে পারে। কিন্তু সমবায় সম্বন্ধ দুটি দ্রব্যের মধ্যে (যেমন, অবয়ব-অবয়বী) হতে পারে, আবার এমন দুটি পদার্থের মধ্যেও হতে পারে যারা দুটিই দ্রব্য নয় (যেমন, দ্রব্য-গুণ, দ্রব্য-কর্ম)।
 .
৫. সংযোগ ও সমবায় উভয়ই বৃত্তি নিয়ামক সম্বন্ধ। কিন্তু এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। সমবায় সম্বন্ধ যে দুটি অযুতসিদ্ধ পদার্থে থাকে তাদের মধ্যে সর্বদা আধার-আধেয় ভাব থাকে। যেমন, কপাল (আকৃতি) ও ঘটের যে সমবায় সম্বন্ধ সেস্থলে কপাল হচ্ছে আধার এবং ঘট আধেয়। কিন্তু সংযোগ সম্বন্ধ যে দুটি সম্বন্ধীতে থাকে তাদের মধ্যে সর্বদা আধার-আধেয় ভাব থাকে না। হাত ও কলমের যে সংযোগ, সে স্থলে হাত আধার এবং কলম আধেয় হয়। কিন্তু হাতের দুটি আঙুলের মধ্যে যে সংযোগ সেখানে কোন আঙুলই আধার বা আধেয় হয় না। সুতরাং সমবায় ও সংযোগ ভিন্ন।
 .
৬. সংযোগ অব্যাপ্যবৃত্তি সম্বন্ধ। অর্থাৎ সংযোগ যে অধিকরণে (আশ্রয়ে) থাকে, সেই অধিকরণে তার অভাবও থাকে। যেমন, বৃক্ষে পাখিসংযোগ আছে বললে সেখানে পাখিসংযোগের অভাবও আছে বলা যায়। কেননা বৃক্ষের সর্বাংশে পাখিসংযোগ থাকে না। কিন্তু সমবায় ব্যাপ্যবৃত্তি সম্বন্ধ। ঘটে রূপ থাকে সমবায় সম্বন্ধে। ঘটের কোন অংশে রূপ আছে, কোন অংশে রূপের অভাব আছে, তা বলা যায় না।
 .
ভাট্ট মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনে সমবায়ের পরিবর্তে তাদাত্ম্য সম্বন্ধ স্বীকার করা হয়েছে। তাঁদের মতে, তাদাত্ম্যের অর্থ ভেদাভেদ বা ভেদ-সহিষ্ণু অভেদ। অর্থাৎ কোন অংশে ভেদ, কোন অংশে অভেদ। ন্যায়-বৈশেষিকেরা তাদাত্ম্য বলতে অভেদকে বোঝেন। ভাট্ট ও বেদান্তীদের মতে, ঘট ও রূপ এ দুটি পদার্থের সম্বন্ধ সমবায় হতে পারে না। ‘ঘটে রূপ থাকে’ এক্ষেত্রে ঘট আধার ও রূপ আধেয় হয়। সুতরাং ঘট ও রূপ অভিন্ন নয়, যেহেতু অভিন্ন পদার্থে আধার-আধেয় ভাব হয় না। আবার ঘট ও রূপ ভিন্নও নয়, যেহেতু এ দুটি পৃথকভাবে থাকে না। সুতরাং ঘট ও রূপের সম্বন্ধ ভেদাভেদ।
এর বিরুদ্ধে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, ভেদাভেদ পরস্পর বিরুদ্ধ, তাই তা একই অধিকরণে থাকতে পারে না। সুতরাং সমবায় অবশ্য স্বীকার্য।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: বিশেষ] [*] [পরের পর্ব: অভাব-পদার্থ]

1 comment:

Kendra Dolan said...

Thankss for writing this