Monday, August 13, 2012

| বৈশেষিক দর্শন…১১ : বৈশেষিক পরমাণুবাদ |

 .
| বৈশেষিক দর্শন…১১ : বৈশেষিক পরমাণুবাদ |
রণদীপম বসু

৪.০ : বৈশেষিক পরমাণুবাদ 
.
বৈশেষিকমতে জগৎ সৃষ্টি উদ্দেশ্যপূর্ণ। এই উদ্দেশ্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক। এটি যান্ত্রিক নয়। জীব যাতে তার অদৃষ্ট বা কর্মফল অনুসারে পুণ্যের জন্য পুরস্কার এবং পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করতে পারে এবং জীবাত্মা যাতে নিঃশ্রেয়স বা মুক্তিলাভের চেষ্টা করতে পারে সে জন্যই পরমাত্মা বা ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন। বৈশেষিক সম্প্রদায় পরমাণুবাদের সাহায্যে জগতের সৃষ্টি ও লয় ব্যাখ্যা করেছেন। তাই পরমাণুবাদ বা পরমাণুতত্ত্ব বৈশেষিক দর্শনের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব।

 .
ভারতীয় দর্শনে দৃশ্যমান জগতে বস্তুর কার্য-কারণভাবের দ্বারাই তাদের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কার্যকারণ মতবাদ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, কার্য উৎপত্তির পূর্বে তার উপাদান কারণে সৎ নাকি অসৎ ? সাংখ্য ও বেদান্ত মতে কার্য উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে কোন এক অবস্থায় সৎ অর্থাৎ অস্তিত্বশীল। এই মতবাদ সৎকার্যবাদ নামে পরিচিত।
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় এই সৎকার্যবাদ স্বীকার করেন না। বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে তারা এই মতবাদ খণ্ডন করেছেন। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে তার উপাদান কারণে অসৎ। কারণ ও কার্য দুটি ভিন্ন বস্তু। সুতরাং কার্যদ্রব্য নতুন সৃষ্টি। এ মতবাদকে অসৎকার্যবাদ বলা হয়। জগতের উপাদান কারণ (সমবায়িকারণ) পরমাণুসমূহ সৎ অর্থাৎ নিত্য। পরমাণু থেকে যেসব কার্যের উৎপত্তি হয় তা উৎপত্তির পূর্বে ছিলো না, বিনাশে থাকবে না। তাই এগুলি অসৎ। কার্যোৎপত্তির পূর্বে সৎ উপাদান কারণে অসৎ কার্যের উৎপত্তি হলো ন্যায়-বৈশেষিক মতে আরম্ভ। এ কারণে এই অসৎকার্যবাদকে আরম্ভবাদ বলা হয়। অসৎকার্যবাদই আরম্ভবাদের মূল, এবং এই আরম্ভবাদের রূপান্তরই পরমাণুবাদ।
 .
বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি কণাদের মতে জগতের যাবতীয় অনিত্য ও যৌগিক বস্তু পরমাণু থেকেই উৎপন্ন। পরমাণু হলো জগতের উৎপত্তির প্রতি উপাদান কারণ। বৈশেষিক মতে দ্রব্য নয়টি- ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ্ (জল), তেজ, মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), দিক, কাল, আত্মা এবং মন। এর মধ্যে ক্ষিতি, অপ্, তেজ এবং মরুৎ এই চারটি হলো অনিত্য ভূতদ্রব্য। বাকিগুলি নিত্যদ্রব্য। চারটি অনিত্য ভূতদ্রব্যের ক্ষুদ্রতম এবং অবিভাজ্য অংশই হলো পরমাণু। অর্থাৎ পরমাণু চারপ্রকার, যথা- ক্ষিতি পরমাণু, জল পরমাণু, তেজ পরমাণু এবং বায়ু পরমাণু। এই পরমাণুগুলির গুণগত পার্থক্য থাকায় এরা প্রত্যেকে ভিন্ন। ক্ষিতি পরমাণুর গুণ হলো গন্ধ, জল পরমাণুর গুণ হলো স্বাদ, তেজ পরমাণুর গুণ হলো রূপ এবং বায়ু পরমাণুর গুণ হলো স্পর্শ। জগতের যাবতীয় অনিত্য ও সাবয়ব বস্তুর সৃষ্টি ও ধ্বংস ব্যাখ্যা করার জন্যেই ন্যায়-বৈশেষিক মতে পরমাণু স্বীকার করা হয়েছে।
 .
যেহেতু পরমাণু হলো জড়বস্তুর অবিভাজ্য ও ক্ষুদ্রতম অংশ, তাই পরমাণু অতীন্দ্রিয়। এ কারণে প্রত্যক্ষের দ্বারা পরমাণুকে জানা যায় না। অনুমান প্রমাণের দ্বারাই পরমাণুর অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। এই অনুমান প্রমাণ হিসেবে ন্যায়-বৈশেষিক মতে বলা হয়, জড়বস্তুকে যদি আমরা ভাঙতে শুরু করি তাহলে ভাঙতে ভাঙতে আমরা এমন একটা অংশে উপনীত হই যাকে আর বিভাগ করা যায় না। জড়বস্তুর এই অবিভাজ্য ও ক্ষুদ্রতম অংশকেই পরমাণু বলা হয়। পরমাণু অবিভাজ্য অর্থাৎ পরমাণুকে আর ভাঙা যায় না, কারণ পরমাণু হলো নিরংশ বা নিরবয়ব। কেননা যার অংশ বা অবয়ব নেই তাকে ভাঙা যায় না।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে আরো বলা হয়, জড়বস্তুর বিভাজন অনন্তকাল ধরে চলে একথা স্বীকার করলে পর্বত এবং সর্ষের পরিমাণের তারতম্য ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ সেক্ষেত্রে জড়বস্তুর বিভাজনের ফলে আমরা যে অবয়ব পাই, তার আবার অবয়ব থাকবে, সেই অবয়বেরও আবার অবয়ব থাকবে। এইভাবে পর্বত এবং সর্ষে অনন্ত অবয়ব বিশিষ্ট হওয়ায় উভয়ের পরিমাণের পার্থক্য থাকবে না। কিন্তু আমরা জানি যে, পর্বত এবং সর্ষের মধ্যে পর্বত হলো বৃহত্তর এবং সর্ষে হলো ক্ষুদ্রতর। পর্বত এবং সর্ষের পরিমাণের তারতম্য ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের স্বীকার করতে হবে যে বস্তুর বিভাজন প্রক্রিয়া কোন না কোন সময় শেষ হয়। যেহেতু সর্ষের থেকে পর্বতের অবয়ব-সংখ্যা বেশি সেহেতু আমাদের স্বীকার করতে হবে উভয়ের বিভাজন প্রক্রিয়া ভিন্ন সময়ে শেষ হয়। পর্বত এবং সর্ষের অবয়বে ভেদ থাকায় উভয়ের পরিমাণের ভেদও অনায়াসে ব্যাখ্যা করা যায়। সুতরাং, পরমাণু নিরবয়ব তা প্রমাণিত হয়।
 .
যেহেতু পরমাণু নিরবয়ব, সেহেতু পরমাণু নিত্য। অর্থাৎ পরমাণুর উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। উৎপত্তি অর্থ বিভিন্ন অবয়বের সংযোগ এবং বিভাগ অর্থ বিভিন্ন অবয়বের বিভাগ। যেহেতু পরমাণুর কোন অবয়বই নেই, সেহেতু পরমাণুর উৎপত্তি ও বিনাশ নেই।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা এই পরমাণুর সাহায্যে জগতের যাবতীয় অবয়ব এবং অনিত্য বিষয়ের সৃষ্টি ও ধ্বংসকে ব্যাখ্যা করেছেন। আগেই বলা হয়েছে যে, পরমাণুগুলি বিশেষ গুণবিশিষ্ট। অর্থাৎ রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ গুণবিশিষ্ট। কিন্তু গুণবিশিষ্ট হলেও তারা গতিহীন অর্থাৎ নিষ্ক্রিয়। তাহলে গতি ছাড়া সৃষ্টি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যাবে কীভাবে ?
মূলত এখানেই ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা জগতের নিমিত্ত-কারণ হিসেবে একজন ঈশ্বর বা পরমাত্মার সত্তা স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, পরমাণুগুলি স্বরূপত গতিহীন হলেও ঈশ্বরের ইচ্ছায় (চিকীর্ষা) পরমাণুগুলি গতিশীল হয়ে জগতের যাবতীয় বস্তুকে সৃষ্টি করে।
 .
কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে, ঈশ্বর যেহেতু পূর্ণতম সত্তা, তাঁর কোন অপূর্ণ ইচ্ছা নেই, তাহলে পরমাণুগুলিকে গতিশীল করে জগৎসৃষ্টির ইচ্ছা ঈশ্বরের মনে জাগে কেন ?
উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, জীব যাতে অদৃষ্ট অনুযায়ী কর্মফল ভোগ করতে পারে, সেজন্য ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা হয়। অদৃষ্ট হলো জীবের শুভ ও অশুভ কর্মফলের সমষ্টি। পরমাণু ও অদৃষ্টের নিজস্ব ক্রিয়াশীলতা নেই। তাই ঈশ্বর জীবের অদৃষ্টশক্তি অনুসারে তাদের কর্মফল ভোগের জন্য পরমাণুগুলির সাহায্যে এই সুশৃঙ্খল ও সুপরিকল্পিত জগৎ সৃষ্টি করেছেন। আবার প্রয়োজনবোধে তিনি পরমাণুগুলির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে জগতের বিনাশসাধন করেন। সুতরাং বৈশেষিক মতে, পরমাণুগুলি হলো জগৎ ও জাগতিক বস্তুগুলির সৃষ্টির প্রতি উপাদান কারণ বা সমবায়িকারণ এবং ঈশ্বর ও জীবের অদৃষ্ট হলো নিমিত্ত কারণ। যেহেতু সৃষ্টির মাধ্যমে জীব কর্মফল ভোগ করে, সেহেতু সৃষ্টিপ্রক্রিয়া হলো উদ্দেশ্যমূলক।
 .
বৈশেষিক মতে জাগতিক বস্তুর সৃষ্টির প্রতি পরমাণুসংযোগ হলো অসমবায়িকারণ। এখানেও প্রশ্ন, পরমাণুগুলি যদি নিরবয়ব পদার্থ হয়, তাহলে একটি পরমাণুর সঙ্গে অপর একটি পরমাণু সংযুক্ত হয় কীভাবে ? কোন দ্রব্যের সঙ্গে অপর একটি দ্রব্যের সংযোগস্থলে, একটি দ্রব্যের কোন অংশের সঙ্গে অপর দ্রব্যের কোন অংশের সংযোগ ঘটে। পরমাণুর সংযোগ স্বীকার করলে পরমাণুর অংশ স্বীকার করতে হবে। আর পরমাণুর অংশ স্বীকার করলে পরমাণুকে নিরবয়ব বলা যাবে না।
উত্তরে বৈশেষিকেরা বলেন, সাবয়ব দুটি দ্রব্য যেমন পরস্পর সংযুক্ত হয়, অনুরূপভাবে দুটি নিরবয়ব পদার্থও পরস্পর সংযুক্ত হতে পারে। পরমাণুসংযোগে কীভাবে বস্তুসৃষ্টি হয় তা বৈশেষিকেরা ব্যাখ্যা করেছেন।
 .
ঈশ্বরের ইচ্ছায় গতি সঞ্চারিত হওয়ার ফলে প্রথমে দুটি সজাতীয় পরমাণু পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং তার ফলে একটি দ্ব্যণুকের সৃষ্টি হয়। যেমন দুটি ক্ষিতি-পরমাণু সংযুক্ত হয়ে ক্ষিতির দ্ব্যণুক সৃষ্টি হয়। অপ্, তেজ ও মরুতের দ্ব্যণুকের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি প্রক্রিয়া একই থাকে। বিজাতীয় পরমাণু সংযোগে দ্ব্যণুকের উৎপত্তি কখনও হয় না। পরমাণুগুলির ন্যায় দ্ব্যণুকও প্রত্যক্ষ করা যায় না। এই দ্ব্যণুকের সৃষ্টিই হলো সৃষ্টির প্রথম স্তর। পরবর্তী স্তরে সজাতীয় তিনটি দ্ব্যণুকের সমন্বয়ে গঠিত হয় ত্র্যণুক বা ত্রসরেণু। ত্রস অর্থ গতি। ত্রসরেণু হলো গতিশীল রেণু। এই ত্রসরেণু হলো প্রত্যক্ষযোগ্য এবং সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুসমূহ। এরপর চারটি ত্র্যণুক মিলে উৎপন্ন হয় একটি চতুরণুক। স্বভাবতই চতুরণুক হলো ত্র্যণুক অপেক্ষা স্থূল পদার্থ। এভাবেই ক্রমে ক্রমে স্থূল থেকে স্থূলতর একই জাতীয় বস্তুর (স্থূলতর ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ) সৃষ্টি হয়।
 .
প্রশ্ন হতে পারে, পরমাণু ও দ্ব্যণুক প্রত্যক্ষযোগ্য না হলেও ত্র্যণুক প্রত্যক্ষযোগ্য হয় কেন ?
উত্তরে বলা হয়, প্রত্যক্ষের প্রতি কারণ হলো উপাদানের মহৎ পরিমাণ এবং বহুত্বসংখ্যা। দ্ব্যণুকের উপাদান কারণ পরমাণুর পরিমাণ হলো অণুপরিমাণ, মহৎপরিমাণ নয়। আবার দ্ব্যণুকের উপাদানকারণ পরমাণুর স্থূলত্ব বা বহুত্ব বা তুলাপিণ্ডের মতো শিথিল সংযোগ না থাকায় দ্ব্যণুকের প্রত্যক্ষ হয় না। কিন্তু ত্র্যণুকের পরিমাণ হলো মহৎপরিমাণ। আবার ত্র্যণুকের উপাদানকারণ দ্ব্যণুকের বহুত্ব সংখ্যা থাকায় ত্র্যণুকের প্রত্যক্ষ হয়।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই জগতের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু হলেও এই সৃষ্টিপ্রবাহ অনাদি। সৃষ্টির পর প্রলয় এবং প্রলয়ের পর সৃষ্টি অনাদিকাল ধরে চলে আসছে। সুতরাং সৃষ্টির আদি নির্ণয় করা যায় না। সৃষ্টি অনাদি। যখন মহেশ্বর জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা করেন, তখন জীবাত্মার মধ্যে অদৃষ্ট শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে প্রথমে বায়ু পরমাণুগুলিতে স্পন্দন শুরু হয় এবং এদের মিলনে দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুক গঠিত হয়। আবার দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুক মিলিত হয়ে বায়ুরূপ মহাভূত সৃষ্টি করে। এই মহাভূত আকাশে সবসময় কম্পমান অবস্থায় বিরাজ করে। তারপর অনুরূপভাবে অপ্-পরমাণুগুলি সক্রিয় হয় এবং অপ্-রূপ মহাভূত বা মহাসমুদ্র সৃষ্টি করে। এই মহাসমুদ্র বায়ুর দ্বারা কম্পিত হয়ে বায়ুতেই বিরাজ করে। এরপর ক্ষিতি-পরমাণু সক্রিয় হয়ে ক্ষিতি-রূপ মহাভূত বা মহাপৃথিবী সৃষ্টি করে এবং এই মহাপৃথিবী মহাসমুদ্রে অবস্থান করে। অবশেষে ঐ একইভাবে তেজ-পরমাণু সক্রিয় হয়ে তেজ-রূপ মহাভূত বা মহাতেজোরাশি সৃষ্টি করে এবং ঐ মহাতেজ মহাসমুদ্রের জলরাশিতে অবস্থান করতে থাকে। এরপর সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী ক্ষিতি এবং তেজ পরমাণু মিলিত হয়ে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হয়। ঈশ্বর এই ব্রহ্মাণ্ডকে জ্ঞান, বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্য গুণসম্পন্ন ব্রহ্মা বা জগৎ-আত্মার দ্বারা সঞ্জীবিত করেন। ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে ব্রহ্মা জীবের অদৃষ্ট অনুযায়ী জগতের যাবতীয় স্থূল ও সূক্ষ্ম বস্তু সৃষ্টি করেন।
 .
এইভাবে ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট জগৎ বহুকাল ধরে চলতে থাকে। কিন্তু এই সৃষ্টি চিরন্তন বা চিরস্থায়ী নয়। কারণ জগৎ অনিত্য এবং যা অনিত্য তার ধ্বংস অনিবার্য। এ প্রসঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর রাত্রিতে আমরা যেমন বিশ্রাম গ্রহণ করি, তেমনি দুঃখ যন্ত্রণায় ক্লান্ত জীবাত্মাকে কিছুটা বিশ্রাম দেবার জন্য ঈশ্বর এই জগতের ধ্বংস বা প্রলয় ঘটিয়ে থাকেন। কাজেই সৃষ্টিকালের পর আসে প্রলয়কাল। বৈশেষিক দার্শনিকেরা সৃষ্টিকে ঈশ্বরের দিন এবং প্রলয়কে ঈশ্বরের রাত্রিরূপে বর্ণনা করেছেন। সৃষ্টি ও প্রলয়- এই দুটি দিয়ে গঠিত হয় একটি কল্প এবং এই কল্প অনন্তকাল ধরে পর্যায়ক্রমে চলছে।
 .
বৈশেষিক দর্শনে জগতের প্রলয়-ক্রিয়ারও বর্ণনা পাওয়া যায়। সৃষ্টির মতো প্রলয়ও হঠাৎ হয় না, কিন্তু তা হয় ক্রমে ক্রমে। অন্যান্য আত্মার মতো জগৎ-আত্মা বা ব্রহ্মা যখন তাঁর জগৎরূপ দেহ পরিত্যাগ করেন, তখন ঈশ্বরের মধ্যে জগৎ ধ্বংস করবার ইচ্ছা (সংজিহীর্ষা) দেখা দেয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই জীবাত্মার মধ্যে অধিষ্ঠিত সৃজন-অভিমুখী অদৃষ্ট ধ্বংস-অভিমুখী অদৃষ্টের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এর ফলে সৃজন-অভিমুখী অদৃষ্ট তার শক্তি হারায় এবং ধ্বংস-অভিমুখী অদৃষ্ট সক্রিয় হয়ে পড়ে। ধ্বংস-অভিমুখী অদৃষ্টের সক্রিয়তার জন্য দ্ব্যণুকের উৎপাদক পরমাণুতে ক্রিয়া শুরু হয় এবং দুটি পরমাণুর বিভাগ বা সংযোগের নাশ হয়। পরমাণুদ্বয় সংযোগের নাশে দ্ব্যণুকের নাশ হয়, দ্ব্যণুকের নাশে ত্র্যণুকের নাশ হয়, ত্র্যণুকের নাশে চতুরণুকের নাশ হয় এবং ক্রমে ক্রমে পৃথিব্যাদি মহাভূতের নাশ হয়। তখন কেবল ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ- এই চারপ্রকারের পরমাণু এবং আকাশ, দিক, কাল, মন ও আত্মার মতো নিত্য দ্রব্যগুলি বর্তমান থাকে। অবশ্য তখনও আত্মার মধ্যে অতীতের সংস্কারযুক্ত ভাবনা ও অদৃষ্ট বিরাজ করে।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, সৃষ্টিকালে প্রথমে বায়ু, তারপর অপ্, তারপর ক্ষিতি এবং তারপর তেজ মহাভূত আবির্ভূত হয়। অপরপক্ষে, প্রলয়কালে প্রথমে ক্ষিতি মহাভূতের পরমাণুগুলি বিযুক্ত হয় এবং তারপর ক্রমান্বয়ে অপ্, তেজ ও বায়ু মহাভূতের পরমাণুগুলির বিযুক্তি ঘটে। বস্তুত বৈশেষিক পরমাণুবাদে জড়বাদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের মিশ্রণ দেখা যায়।
.
বৈশেষিক পরমাণুবাদ ও পাশ্চাত্য দর্শনের পরমাণুবাদের মধ্যকার পার্থক্য :
আমরা জানি যে, প্রাচীন গ্রিক দর্শনেও পরমাণুতত্ত্ব নামে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ রয়েছে। পাশ্চাত্য দর্শনের পরমাণুবাদ ও বৈশেষিক পরমাণুবাদের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য থাকলেও কিছুটা বৈসাদৃশ্যও দেখা যায়। যেমন-
.
(১)  বৈশেষিক পরমাণুবাদে জগৎ সৃষ্টি উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে পরমাণুবাদে সৃষ্টির মূলে কোন উদ্দেশ্য বা আদর্শ নেই। জগতের প্রতি ভারতীয় দার্শনিকদের একপ্রকার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা বৈশেষিক দর্শনেও প্রতিফলিত হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের পরমাণুবাদ অনুসারে অসংখ্য পরমাণু আকস্মিক যান্ত্রিক গতির দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করেছে।
.
(২)  বৈশেষিকদের মতে পরমাণু নিত্য। আকাশ, দিক, কাল, মন ও আত্মা নিত্য। এদের কোন উৎপত্তি বা বিনাশ নেই। আকাশ, দিক, কাল, মন ও আত্মাকে পরমাণুতে পরিণত করা যায় না। কিন্তু পাশ্চাত্য পরমাণুবাদ অনুসারে মন ও আত্মা পরমাণু দ্বারা সৃষ্ট।
.
(৩)  পাশ্চাত্য পরমাণুবাদ অনুসারে জগৎ সৃষ্টির পেছনে এমন কোন কর্তা নেই যার দ্বারা পরমাণুগুলি অনুশাসিত হতে পারে। কিন্তু বৈশেষিক পরমাণুবাদ বিশ্বাস করে যে, জগৎ সৃষ্টির পেছনে একজন সর্বশক্তিমান কর্তা রয়েছেন, যার ইচ্ছায় জগতের সৃষ্টি ও বিনাশ সংঘটিত হয়।

(১২-০৮-২০১২)

[আগের পর্ব: কারণ ও তার বিভাগ] [*] [শেষ...]

No comments: