Thursday, August 9, 2012

| বৈশেষিক দর্শন…০৪ : গুণ পদার্থ |

 .
| বৈশেষিক দর্শন…০৪ : গুণ পদার্থ |
রণদীপম বসু

২.২ : গুণ পদার্থ (Quality):
.
বৈশেষিক সম্মত সপ্তপদার্থের দ্বিতীয় পদার্থ হলো গুণ। গুণ একটি ভাবপদার্থ। যে পদার্থ দ্রব্যে অবস্থান করে এবং যার কোন কর্ম নেই তার নাম গুণ। গুণ সব সময়ই দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে। দ্রব্য ছাড়া গুণের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।


মহর্ষি কণাদ বৈশেষিকসূত্রে গুণের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন-

‘দ্রব্যাশ্রয়া অগুণবান সংযোগবিভাগেষবকারণমনপেক্ষ ইতি গুণলক্ষণম্’। (বৈশেষিকসূত্র: ১/১/১৬)।
অর্থাৎ : দ্রব্যাশ্রয়ী, অগুণবান, এবং সংযোগ বিভাগের নিরপেক্ষ অকারণ পদার্থ হলো গুণ।
 .
বৈশেষিক মতে দ্রব্যই গুণের আশ্রয়। দ্রব্য ছাড়া গুণাদি কোন পদার্থই গুণের আশ্রয় হয় না। তাই গুণ দ্রব্যাশ্রয়ী। গুণের গুণ স্বীকৃত নয় বলে গুণ হলো অগুণবান। কোন কোন গুণ বৈশেষিকমতে সংযোগ ও বিভাগের কারণ হয় যেমন, ধর্ম, অধর্ম, জ্ঞান, ইচ্ছা প্রভৃতি। কিন্তু এই গুণগুলি কর্মকে অপেক্ষা না করে সংযোগ বা বিভাগের কারণ হয় না। অর্থাৎ কর্মের দ্বারাই সংযোগ বা বিভাগ সম্ভব, একক গুণের দ্বারা নয়। এজন্যেই বলা হয়েছে গুণ সংযোগ ও বিভাগের অনপেক্ষ কারণ নয়। অর্থাৎ গুণকে সংযোগ-বিভাগ-অকারণ-নিরপেক্ষ পদার্থ বলা হয়।
.
‘দ্রব্যাশ্রয়ী-অগুণবান’ ও ‘সংযোগ-বিভাগ-অকারণ-অনপেক্ষ’ এই দুটি পদের দ্বারা গুণকে যথাক্রমে দ্রব্য ও কর্ম থেকে পৃথক করা হয়েছে। অন্যভাবে গুণকে দ্রব্য ও কর্ম ভিন্ন সামান্য বা জাতিবিশিষ্ট পদার্থও বলা হয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে দ্রব্য, গুণ ও কর্মই কেবলমাত্র জাতিবিশিষ্ট, অন্য কোন পদার্থ জাতিবিশিষ্ট নয়। তাই দ্রব্য ও কর্ম বাদ দিলে যা জাতিমান বা সামান্যবান তাই গুণ।
 .
প্রশস্তপাদ উদ্দেশ প্রকরণে গুণের কোন লক্ষণ নির্দেশ করেননি। তবে তাঁর মতে গুণবত্বই গুণের লক্ষণ। শঙ্কর মিশ্র গুণের একাধিক লক্ষণ নির্দেশ করেছেন। এই লক্ষণগুলির অন্যতম লক্ষণ হলো-

‘সামান্যবত্ত্বেসতি কর্ম্মান্যত্ত্বে সতি অগুণবত্ত্বং’। (বৈশেষিকসূত্রোপষ্কার)।
অর্থাৎ : সামান্যবান, কর্মভিন্ন অথচ যা গুণরহিত পদার্থ তাই গুণ।
 .
প্রশস্তপাদভাষ্য থেকে জানা যায় যে, বৈশেষিক সম্মত গুণপদার্থ চব্বিশপ্রকার। এই চব্বিশপ্রকার গুণের মধ্যে সতেরোটি গুণ মহর্ষি কণাদ তাঁর বৈশেষিকসূত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এই সতেরোটি গুণ হলো- (১) রূপ, (২) রস, (৩) গন্ধ, (৪) স্পর্শ, (৫) সংখ্যা, (৬) পরিমাণ, (৭) পৃথকত্ব, (৮) সংযোগ, (৯) বিভাগ, (১০) পরত্ব, (১১) অপরত্ব, (১২) বুদ্ধি বা জ্ঞান, (১৩) সুখ, (১৪) দুঃখ, (১৫) ইচ্ছা, (১৬) দ্বেষ ও (১৭) প্রযত্ন।
.
এছাড়া সূত্রগ্রন্থের স্থানে স্থানে বাকি সাতটি গুণ যথা (১৮) গুরুত্ব, (১৯) দ্রবত্ব, (২০) স্নেহ, (২১) সংস্কার, (২২) ধর্ম, (২৩) অধর্ম ও (২৪) শব্দ-এর উল্লেখ থাকায় প্রশস্তপাদের ভাষ্যে এই সাতটি গুণও সূত্রকারের অভিপ্রেত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আচার্য প্রশস্তপাদ ‘ধর্ম’ ও ‘অধর্ম’-এর পরিবর্তে ‘অদৃষ্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার দ্বারা তিনি ধর্ম ও অধর্মকেই বুঝিয়েছেন। নইলে শেষোক্ত গুণের সংখ্যা সাত হবে না। তাই বৈশেষিক দর্শনে মোট চব্বিশ প্রকার গুণ স্বীকৃত। নব্য-নৈয়ায়িকেরাও এই চব্বিশ প্রকার গুণকে স্বীকার করেছেন।
 .
বৈশেষিক দর্শনে যে চব্বিশ প্রকার গুণ স্বীকৃত তা মৌলিক গুণ। বৈশেষিক মতে মৌলিক গুণ চব্বিশ প্রকারের কম বা বেশি নয়। এই চব্বিশ প্রকার মৌলিক গুণের পারস্পরিক সংযোগে কোন কোন নতুন গুণের আবির্ভাব হতে পারে কিন্তু মৌলিক গুণের তালিকায় তারা অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
 .
গুণমাত্রই গুণত্বের আশ্রয়, দ্রব্যে সমবেত, গুণরহিত ও ক্রিয়াশূন্য। বৈশেষিক সম্মত চব্বিশ প্রকার গুণের মধ্যে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, পরত্ব, অপরত্ব, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ ও বেগরূপ-সংস্কার- এই দশটি গুণ হলো মূর্তদ্রব্যের গুণ। অর্থাৎ এরা পরিচ্ছিন্ন পরিমাণবিশিষ্ট দ্রব্যের গুণ। বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, ধর্ম, অধর্ম, ভাবনাখ্য-সংস্কার ও শব্দ- এই দশটি হলো অমূর্ত দ্রব্যের গুণ। সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ- এই পাঁচটি মূর্ত এবং অমূর্ত উভয়প্রকার দ্রব্যের গুণ। সংযোগ, বিভাগ, পৃথকত্ব, সংখ্যা প্রভৃতি গুণ একাধিক দ্রব্যে আশ্রিত হতে পারে। আবার রূপ, রস প্রভৃতি গুণ কেবলমাত্র একটি দ্রব্যেই আশ্রিত।
.
রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, স্নেহ, দ্রবত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, ধর্ম, অধর্ম, ভাবনাখ্য-সংস্কার ও শব্দ- এই ষোলটি গুণ হলো বিশেষ গুণ। সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, গুরুত্ব, দ্রবত্ব এবং বেগরূপ-সংস্কার- এই দশটি হলো সামান্যগুণ।
গুরুত্ব, ধর্ম, অধর্ম ও ভাবনাখ্য-সংস্কার- এই চারটি গুণ হলো অতীন্দ্রিয় গুণ। বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ এবং প্রযত্ন- এই ছয়টি গুণ অন্তরিন্দ্রিয় মনের দ্বারা গ্রাহ্য। রূপ, রস, শব্দ, স্পর্শ ও গন্ধ- এই পাঁচটি গুণ একেন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য গুণ। সংখ্য, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, স্নেহ ও বেগরূপ-সংস্কার- এই নয়টি গুণ হলো দুইটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য গুণ।
 .
গুণপদার্থ সমূহ :
.
(১) রূপ (Colour) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো রূপ। রূপের লক্ষণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-

‘চক্ষুর্মাত্রগ্রাহ্যো গুণো রূপম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কেবলমাত্র চক্ষুরিন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহিত হয় যে গুণ তাকেই রূপ বলা হয়।
 .
রূপ চক্ষু ভিন্ন অন্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহিত হয় না। ক্ষিতি, অপ্ এবং তেজ এই তিনটি দ্রব্যে রূপ থাকে, অন্য দ্রব্যে থাকে না। রূপ সাত প্রকার- শুক্ল, নীল, পীত, রক্ত, হরিত (সবুজ), কপিশ ও চিত্র। ন্যায়-বৈশেষিক মতে নীল, কৃষ্ণ, শ্যাম প্রভৃতি অভিন্ন। কৃষ্ণ ও পীতরূপের মিশ্রিত রূপ কপিশ। ক্ষিতিতে সকল প্রকার রূপই থাকে, কিন্তু অপ্ ও তেজে শুধু শুক্লরূপ থাকে। রূপকে দুইভাগে ভাগ করা হয়- উদ্ভূত ও অনুদ্ভূত। ‘উদ্ভূত’ শব্দের অর্থ প্রকাশিত এবং ‘অনুদ্ভূত’ শব্দের অর্থ অপ্রকাশিত।
.
রূপকে আবার অন্যদিক থেকে দুভাগে ভাগ করা হয়- নিত্য এবং অনিত্য। অপ ও তেজের পরমাণুতে স্থিত রূপ নিত্য। পার্থিব পরমাণুর যে রূপ তা অনিত্য। কারণ তেজঃ সংযোগে ক্ষিতির পরমাণুতে পাক হয়ে থাকে এবং রূপ পরিবর্তিত হয়। পাক বলতে তেজের সংযোগকে বোঝায়। বায়ুর পরমাণুতে রূপ থাকে না। পৃথিবী, জল ও তেজে রূপ থাকলেও রূপ তেজেরই বিশেষ গুণ। চক্ষুরিন্দ্রিয় তেজের পরমাণু থেকে উৎপন্ন। তাই চক্ষুরিন্দ্রিয় তৈজস বা তেজ দ্রব্য।
 .
(২) রস (Taste) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো রস। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে রস-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘রসনাগ্রাহ্যো গুণো রসঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : রসনা (জিহ্বা) ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহিত হয় যে গুণ তাকে রস বলা হয়।
 .
এই গুণটি জল ও পৃথিবী এই দুই দ্রব্যে থাকে, অন্য দ্রব্যে থাকে না। রস ছয় প্রকার- মধুর, অম্ল, লবণ, কটু (ঝাল), কষায় ও তিক্ত। ক্ষিতি বা পৃথিবীতে সকল প্রকার রসই থাকে, কিন্তু জলে কেবল মধুর রস থাকে। জলীয় পরমাণুর রস নিত্য, কিন্তু অনিত্য জলের রস অনিত্য। পৃথিবীর রস অনিত্য। জলের বিশেষ গুণ রস। রসনা ইন্দ্রিয় জল পরমাণু থেকে উৎপন্ন হয়। তাই রসনা ইন্দ্রিয় জলীয় দ্রব্য।
 .
(৩) গন্ধ (Smell) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো গন্ধ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট গন্ধ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘ঘ্রাণগ্রাহ্যো গুণো গন্ধঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে গুণ গ্রাহ্য বা গৃহিত হয় তাকে গন্ধ বলা হয়।
 .
কেবল ক্ষিতি বা পৃথিবীই গন্ধের আশ্রয়। গন্ধমাত্রেই অনিত্য। পৃথিবীর বিশেষ গুণ গন্ধ। গন্ধ দু প্রকার- সুরভি ও অসুরভি। পৃথিবী পরমাণু থেকে ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয় উৎপন্ন। তাই ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয় পার্থিব দ্রব্য।
 .
(৪) স্পর্শ (Touch) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো স্পর্শ। স্পর্শের লক্ষণ প্রসঙ্গে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেন-

‘ত্বগিন্দ্রিয়মাত্রগ্রাহ্যো গুণঃ স্পর্শ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কেবলমাত্র ত্বক্ ইন্দ্রিয় দ্বরা যে গুণ গ্রাহ্য হয় তাকে স্পর্শ বলা হয়।
 .
পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু এই চারটি দ্রব্যে স্পর্শ গুণ থাকে। বায়ুর বিশেষ গুণ স্পর্শ। বায়ুর পরমাণু থেকে ত্বক্ ইন্দ্রিয় উৎপন্ন। তাই ত্বগিন্দ্রিয় বায়বীয় দ্রব্য বা বায়ু দ্রব্য। স্পর্শ তিনপ্রকার- উষ্ণ, শীত, অনুষ্ণাশীত। তেজের স্পর্শ উষ্ণ, জলের স্পর্শ শীত এবং পৃথিবী ও বায়ুর স্পর্শ অনুষ্ণাশীত। পৃথিবীর স্পর্শ পাকজ হওয়ায় তা অনিত্য। তবে জল, তেজ ও বায়ুর স্পর্শ অপাকজ। জল, তেজ ও বায়ুর পরমাণুর এই অপাকজ স্পর্শ নিত্য। কিন্তু অনিত্য জল, তেজ ও বায়ুর দ্ব্যণুক। ত্র্যণুকের স্পর্শ অনিত্য।
উল্লেখ্য, পাক বলতে তেজের সংযোগকে বোঝায়। পাকের ফলে পূর্বরূপের নাশ হয় এবং একটি নতুন রূপের উৎপত্তি হয়। পাকজ রূপ বলতে পাকের ফলে উৎপন্ন রূপই বোঝায়। দুইটি পরমাণু সংযোগে দ্ব্যণুক ও তিনটি দ্ব্যণুক মিলে একটি ত্র্যণুক গঠিত হয়।
 .
(৫) সংখ্যা (Number) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সংখ্যা। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সংখ্যা’র লক্ষণ দিয়েছেন-

‘একত্বাদি ব্যবহারহেতুঃ সংখ্যা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : সংখ্যা হলো বস্তুর সেই ধর্ম যা এক, দুই, তিন ইত্যাদি ব্যবহারের হেতু বা কারণ।
 .
সংখ্যা হলো এমন গুণ যা প্রত্যেক দ্রব্যেই থাকে। তাই সংখ্যা একটি সামান্য গুণ। একত্ব থেকে পরার্ধ পর্যন্ত সংখ্যা নামে অভিহিত হয়। সংখ্যার ক্রম এক থেকে শুরু হয়ে পরার্ধে শেষ হয়। এক হলো সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্রতম সংখ্যা এবং পরার্ধ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সংখ্যা। যে দ্রব্যে একত্ব সংখ্যা থাকে তাকে ‘এক’ বলা হয়, যে দ্রব্যে দ্বিত্ব সংখ্যা থাকে তাকে ‘দুই’ বলা হয়, যে দ্রব্যে ত্রিত্ব সংখ্যা থাকে তাকে ‘তিন’ বলা হয়। নিত্য দ্রব্যের একত্ব সংখ্যা নিত্য, অপর সমস্ত সংখ্যাই অনিত্য। পৃথিবী, জল, বায়ু ও তেজের পরমাণু এবং আকাশ, কাল, দিক, আত্মা ও মন নিত্যদ্রব্য বলে তাদের প্রত্যেকটিতে স্থিত একত্ব সংখ্যা নিত্য। অর্থাৎ নিত্যদ্রব্যস্থিত একত্ব সংখ্যার উৎপত্তি ও বিনাশ নাই। কিন্তু বৃক্ষ, ঘট প্রভৃতি অনিত্য দ্রব্যে স্থিত একত্ব সংখ্যা অনিত্য। দ্বিত্বাদি সংখ্যা সর্বত্র অনিত্যই হয়। অর্থাৎ দ্বিত্ব, ত্রিত্ব প্রভৃতি সংখ্যার উৎপত্তি ও বিনাশ হয়।
.
দ্বিত্ব, ত্রিত্ব প্রভৃতি সংখ্যা অপেক্ষাবুদ্ধি থেকে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ দ্বিত্ব সংখ্যার উৎপত্তিতে ‘এটি এক’, ‘এটি এক’ এরকম জ্ঞানের অপেক্ষা থাকে বলে এই জ্ঞান অপেক্ষাবুদ্ধি। অনেককে বিষয় করে প্রত্যেকটিতে যে একত্বের জ্ঞান হয় তাই অপেক্ষাবুদ্ধি। দ্বিত্ব, ত্রিত্ব ইত্যাদি সংখ্যার উৎপত্তিতে যে দুটি বা তিনটি দ্রব্যকে আমরা গণনা করি সেই দ্রব্যগুলিই তার সমবায়ী কারণ, প্রতিটি দ্রব্যের একত্ব অসমবায়ী কারণ এবং প্রত্যেকটি দ্রব্যের একত্বের জ্ঞান নিমিত্ত কারণ। যেমন যদু ও মধুকে গণনা করে জানা যায় যে এরা দুজন। যদু ও মধুতে যে দ্বিত্ব সংখ্যার উৎপন্ন হলো, যদু ও মধুই তার সমবায়ী কারণ। যদু সমবেত একত্ব ও মধু সমবেত একত্ব, এই দ্বিত্ব সংখ্যা অসমবায়ী কারণ। আর আমি যে যদুকে এক বলে জেনেছি এবং যে মধুকে এক বলে জেনেছি সেই জ্ঞানই (অপেক্ষাবুদ্ধি) হচ্ছে দ্বিত্ব সংখ্যার উৎপত্তির নিমিত্ত কারণ। উল্লেখ্য, বৈশেষিক মতে পরমাণুতে দ্বিত্ব সংখ্যার ও দ্ব্যণুকে ত্রিত্ব সংখ্যার উৎপত্তিতে ঈশ্বরের অপেক্ষাবুদ্ধিই কারণ হয়।
 .
(৬) পরিমাণ (Magnitude) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো পরিমাণ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট পরিমাণ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘মানব্যবহারাসাধারণং কারণং পরিমাণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : মান বা পরিমিতি ব্যবহারের অসাধারণ কারণকে পরিমাণ বলা হয়।
 .
‘এটি বড়’, ‘এটি দীর্ঘ’, ‘এটি হ্রস্ব’ এভাবে দ্রব্যের মানের যে ব্যবহার হয়, তার অসাধারণ কারণকেই পরিমাণ বলা হয়। পরিমাণ গুণটি সকল দ্রব্যেই থাকে। তাই পরিমাণ একটি সামান্য গুণ। পরিমাণ চতুর্বিধ- অণু, হ্রস্ব, মহৎ এবং দীর্ঘ। প্রত্যেক পরিমাণ আবার নিত্য ও অনিত্য ভেদে দ্বিবিধ। নিত্য দ্রব্যের পরিমাণ নিত্য এবং অনিত্য দ্রব্যের পরিমাণ অনিত্য। অনিত্য পরিমাণ তিন প্রকারে উৎপন্ন হয়- (১) কারণের সংখ্যার দ্বারা কার্যের পরিমাণ উৎপন্ন হয়, (২) কারণের পরিমাণের দ্বারা কার্যদ্রব্যের পরিমাণ উৎপন্ন হয় এবং (৩) পরিমাণাশ্রয় দ্রব্যের অবয়বসমূহের প্রচয় বা শিথিল সংযোগের দ্বারা ঐ দ্রব্যের পরিমাণ উৎপন্ন হয়।
.
আকাশ, কাল, দিক্ ও আত্মাতে নিত্যমহত্ব (পরমমহত্ব) আশ্রিত থাকে। অনিত্য মহত্ব ত্র্যণুক থেকে শুরু করে যাবৎ অবয়বী দ্রব্যের গুণ। নিত্য অণুত্ব মন ও পরমাণুর গুণ। অনিত্য অণুত্ব কেবল দ্ব্যণুকেই থাকে। দীর্ঘত্ব ও হ্রস্বত্ব গুণদ্বয় মহত্ব এবং অণুত্বের আশ্রয়ে সমবেত হয়। অনিত্য পরিমাণগুলি সংখ্যা, পরিমাণ ও শিথিল সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়।
 .
(৭) পৃথকত্ব (Difference) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো পৃথকত্ব। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে পৃথকত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘পৃথক্ ব্যবহারাসাধারণকারণং পৃথকত্বম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ‘এটি ঐটি থেকে পৃথক্’ এরূপ ব্যবহারের অসাধারণ কারণ হলো পৃথকত্ব।
 .
একটি পদার্থ যে অন্য পদার্থ থেকে পৃথক তা (ভেদজ্ঞান) বোঝানোর জন্য যে শব্দ প্রয়োগ করা হয় তার হেতু হলো পৃথকত্বের জ্ঞান। সকল দ্রব্যেই পৃথকত্ব থাকে। তাই পৃথকত্ব সামান্য গুণ। পৃথকত্ব দ্বিবিধ- একপৃথকত্ব ও দ্বিপৃথকত্ব। একপৃথকত্ব নিত্যও হয় আবার অনিত্যও হয়, কিন্তু দ্বিপৃথকত্ব সর্বদাই অনিত্য হয়। আবার পৃথকত্বকে একদ্রব্যক ও অনেকদ্রব্যক ভেদে দ্বিবিধ বলা হয়, অর্থাৎ পৃথকত্ব কখনো একটি দ্রব্যে থাকে আবার কখনো অনেক দ্রব্যে থাকে।
 .
(৮) সংযোগ (Conjunction) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সংযোগ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট সংযোগ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সংযুক্ত ব্যবহার হেতুঃ সংযোগঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : দুটি দ্রব্য সংযুক্ত, এরূপ ব্যবহারের হেতু বা কারণ হলো সংযোগ।
 .
যে সকল দ্রব্য স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে, তাদের মিলনকে সংযোগ বলা হয়। সংযোগ তিন প্রকার- (১) অন্যতর কর্মজ সংযোগ : দুটি দ্রব্যের একটির ক্রিয়ার ফলে যে সংযোগ উৎপন্ন হয়, যেমন- একটি পাখি উড়ে এসে একটি গাছের ডালে বসলে গাছ ও পাখির সংযোগ হয়। (২) উভয় কর্মজ সংযোগ : দুটি দ্রব্যের উভয়ই ক্রিয়াশীল বা গতিশীল হওয়ার ফলে যে সংযোগ ঘটে, যেমন- দুটি চলন্ত গাড়ি দুই দিক থেকে এসে মুখোমুখি লেগে গেলো। (৩) সংযোগজ সংযোগ : দুটি দ্রব্যের মধ্যে তৃতীয় কোন দ্রব্যের মাধ্যমে যদি সংযোগ ঘটে, যেমন- হাতের লাঠি দিয়ে ভূতল স্পর্শ করলে লাঠির মাধ্যমে হাতের সঙ্গে ভূতলের সংযোগ ঘটে। সংযোগজ সংযোগ একটি সংযোগ বা একাধিক সংযোগ থেকে হতে পারে।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সংযোগ অনিত্য গুণ।
 .
(৯) বিভাগ (Disjunction) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো বিভাগ। বিভাগ হলো সংযোগের বিপরীত গুণ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বিভাগের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সংযোগনাশকো গুণঃ বিভাগঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : সংযোগের নাশক যে গুণ তাই বিভাগ।
 .
যে দুটি দ্রব্য পরস্পর বিভক্ত হয় বিভাগ গুণটি তাদের প্রত্যেকটিতেই থাকে। বিভাগ সর্বদ্রব্যবৃত্তি অর্থাৎ সকল দ্রব্যেই এই গুণ থাকে। তাই বিভাগ সামান্য গুণ। বিভাগও তিন প্রকার- (১) অন্যতর কর্মজন্য বিভাগ : সংযোগ দ্রব্যের কোন একটা দ্রব্য ক্রিয়াশীল বা গতিশীল হওয়ার জন্য যে বিভাগ হয়, যেমন- গাছ থেকে পাখিটি উড়ে গেলেই গাছ ও পাখির বিভাগ হয়। এই বিভাগ কেবলমাত্র পাখির প্রযত্নে উৎপন্ন তাই এটি অন্যতর কর্মবিভাগ। (২) উভয়কর্মজন্য বিভাগ : সংযুক্ত দ্রব্যের উভয়ই গতিশীল হওয়ায় যে বিভাগ ঘটে, যেমন- দুটি চলমান গাড়ি বিপরীত দিকে চলার ফলে যে বিভাগ ঘটে। (৩) বিভাগজন্য বিভাগ : তৃতীয় দ্রব্যের মাধ্যমে সংযুক্ত দুটি দ্রব্যের সংযোগ থেকে তৃতীয় দ্রব্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যে বিভাগ ঘটে, যেমন- হাত থেকে লাঠি ছেড়ে দিলে ভূতল ও হাতের যে বিভাগ হয় তা হাত ও লাঠির বিভাগজন্য বিভাগ।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে বিভাগ অনিত্য গুণ।
 .
(১০-১১) পরত্ব (Remoteness) ও অপরত্ব (Proximity) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম দুটি গুণ হলো পরত্ব ও অপরত্ব। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট পরত্ব ও অপরত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘পরাপরব্যবহারাসাধারণ কারণে পরত্বাপরত্বে’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পর (দূরবর্তী বা জ্যেষ্ঠ) ব্যবহারের অসাধারণ কারণকে পরত্ব এবং অপর (নিকটবর্তী বা কনিষ্ঠ) ব্যবহারের অসাধারণ কারণকে অপরত্ব বলে।
 .
যে গুণ পর অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ বা দূর এইরূপ ব্যবহারের কারণ তাই পরত্ব এবং যে গুণ অপর অর্থাৎ কনিষ্ঠ বা নিকট এইরূপ ব্যবহারের কারণ তাই অপরত্ব। অর্থাৎ পরত্ব ও অপরত্ব দ্রব্যের এমন দুটি গুণ যা দ্বারা আমরা দ্রব্যের দূরত্ব ও নিকটত্ব অথবা অতীত ও বর্তমান এই ধারণাগুলি করি। পরত্ব ও অপরত্ব গুণ দুটি পরস্পর সাপেক্ষ। এককভাবে একটির প্রতীতি হয় না। পরত্বের প্রতীতি অপরত্বের প্রতীতি না হলে হয় না আবার অপরত্বের প্রতীতি পরত্বের প্রতীতি না হলে হয় না। এই দুটি গুণ পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও মনে থাকে। পরত্ব ও অপরত্ব দু’প্রকার- কালিক ও দৈশিক। ঐ দ্রব্যটি দূরে অথবা এই দ্রব্যটি নিকটে এটাই হলো দৈশিক বা দেশগত। আর একটি দ্রব্য পুরাতন বা জ্যেষ্ঠ কিংবা একটি দ্রব্য নতুন বা কনিষ্ঠ এটা কালিক বা কালগত।
.
পরত্ব ও অপরত্ব সামান্য বা জাতি না হওয়ায় তাদের একই অধিকরণে আশ্রয় সম্ভব। কালিক পরত্ব ও অপরত্ব গুণ নিত্যদ্রব্যে থাকে না, কেবল জন্য (উৎপন্ন) দ্রব্যেই থাকে। আর দৈশিক পরত্ব ও অপরত্ব গুণ কেবল মূর্তদ্রব্যেই থাকে, বিভুদ্রব্যে থাকে না।
 .
(১২) বুদ্ধি বা জ্ঞান (Buddhi or Knowledge) :  ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো বুদ্ধি বা জ্ঞান। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বুদ্ধি বা জ্ঞানের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘সর্বব্যবহারহেতুঃ গুণঃ বুদ্ধিঃ জ্ঞানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে পদার্থ সকল ব্যবহারের প্রতি কারণ, সেই গুণস্বরূপ পদার্থই জ্ঞান এবং জ্ঞান বুদ্ধির নামান্তর বা বুদ্ধি জ্ঞানের নামান্তর। যা বুদ্ধি তাই জ্ঞান, যা জ্ঞান তাই বুদ্ধি। বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন।
 .
সাংখ্যমতে বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন হতে পারে না, কারণ বুদ্ধি অচেতন প্রকৃতি হতে উদ্ভূত প্রথম তত্ত্ব। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তিতে আত্মা বা পুরুষের প্রতিবিম্ব বা প্রতিফলন হলে জ্ঞান হয়। কিন্তু অন্নংভট্ট ন্যায়দর্শন প্রণেতা মহর্ষি গৌতমকে অনুসরণ করে বুদ্ধি ও জ্ঞানকে অভিন্ন বলেছেন। মহর্ষি গৌতম বলেছেন-

‘বুদ্ধিঃ উপলব্ধিঃ জ্ঞানম্ ইতি অনর্থান্তরম্’। (ন্যায়সূত্র)।
অর্থাৎ : বুদ্ধি, উপলব্ধি, জ্ঞান শব্দগুলি ভিন্নার্থক নয়, তারা একই পদার্থকে বোঝায়।
 .
বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ ও প্রযত্ন হলো আত্মার বিশেষ গুণ। বুদ্ধি, উপলব্ধি, জ্ঞান ও প্রত্যয় ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে পর্যায়শব্দ। জ্ঞান আত্মা নামক দ্রব্যের গুণ। তাই জ্ঞান গুণ পদার্থের অন্তর্ভুক্ত। বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন। যা বুদ্ধির লক্ষণ তাই জ্ঞানের লক্ষণ, আবার যা জ্ঞানের লক্ষণ তাই বুদ্ধির লক্ষণ। জ্ঞান গুণস্বরূপ, এবং জ্ঞানকে সকল ব্যবহারের প্রতি কারণ বলা হয়েছে। ব্যবহার বলতে গ্রহণ, বর্জন, উপেক্ষা, শব্দব্যবহারকে বোঝায়। কোন পদার্থের ব্যবহার সম্ভব হয় যদি ব্যবহারকারীর ঐ পদার্থ বিষয়ে জ্ঞান থাকে। এই জ্ঞান হলো ইচ্ছার সাক্ষাৎ কারণ, আত্মার বিশেষ গুণ এবং জ্ঞানত্ব জাতিমান। ইষ্টসাধনতা জ্ঞান থেকেই ইচ্ছা হয়। এজন্য জ্ঞানকে ইচ্ছার সাক্ষাৎকারণ বলা হয়। আবার জ্ঞানত্ব জাতি জ্ঞানে থাকে বলে জ্ঞানকে জ্ঞানত্বজাতিমানও বলা হয়। জ্ঞানত্ব ধর্ম জ্ঞানের অসাধারণ ধর্ম এবং তা জ্ঞানকে অন্য বস্তু থেকে পৃথক করে।
 .
বুদ্ধি বা জ্ঞানের বিষয় অনন্ত, তাদের কারণও ভিন্ন ভিন্ন এবং তার প্রকারও অনেক। নানাভাবে বুদ্ধি বা জ্ঞানের প্রকারভেদ করা হয়। অনুভূতি ও স্মৃতিভেদে বুদ্ধি দুই প্রকার।
‘সংস্কারমাত্রজন্যং জ্ঞানং স্মৃতিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)। অর্থাৎ, কেবলমাত্র সংস্কারের দ্বারা উৎপন্ন যে জ্ঞান সেই জ্ঞানই স্মৃতি।
‘তদভিন্নং জ্ঞানম্ অনুভবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)। অর্থাৎ, অনুভব হলো স্মৃতি ভিন্ন জ্ঞান।
অনুভব বা অনুভূতি আবার প্রত্যক্ষ এবং লৈঙ্গিক বা অনুমিতিভেদে দ্বিবিধ- প্রত্যক্ষণ ও অনুমান। 
 .
অন্য একভাবে জ্ঞানকে বিদ্যা ও অবিদ্যাভেদে দ্বিবিধ বলা হয়। বিদ্যা মানে প্রমা বা যথার্থজ্ঞান এবং অবিদ্যা মানে অপ্রমা বা অযথার্থজ্ঞান। বৈশেষিক ভাষ্যকার প্রশস্তপাদ চারপ্রকার বিদ্যা ও চারপ্রকার অবিদ্যার উল্লেখ করেছেন। চারপ্রকার বিদ্যা হলো- প্রত্যক্ষ, অনুমিতি, স্মৃতি ও আর্ষ। চারপ্রকার অবিদ্যা হলো- সংশয়, বিপর্যয়, অনধ্যবসায় ও স্বপ্ন।
জ্ঞানকে নিত্য ও অনিত্য ভেদেও দ্বিবিধ বলা হয়। ঈশ্বর বা পরমাত্মার জ্ঞান নিত্য, কিন্তু জীবাত্মার জ্ঞান অনিত্য। জীবাত্মা অনিত্যজ্ঞানের সমবায়িকারণ, এবং আত্মমনোসংযোগ জ্ঞানের অসমবায়িকারণ। সুষুপ্তি কালে আত্মায় কোন জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। এর কারণরূপে ত্বগেন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগকে জ্ঞানের নিমিত্তকারণ বলা হয়। সুষুপ্তিতে যেহেতু এই সংযোগ থাকে না সেহেতু জ্ঞান উৎপন্ন হয় না।
 .
(১৩) সুখ : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সুখ। সুখের লক্ষণ হলো ‘অনুগ্রহ লক্ষণং সুখম্’ অর্থাৎ, সুখ হলো অনুগ্রহ বা অনুকূল স্বভাব।
বুদ্ধির ন্যায় সুখও আত্মার একটি বিশেষ গুণ। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট সুখ-এর লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘সর্বেষাং অনুকূল (তয়া) বেদনীয়ং সুখম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা সকলে অনুকূল বলে অনুভব করে, তাই সুখ।
 .
সুখ সকলেরই কাম্য বা কামনার বিষয়। আবার যে বিষয়ের প্রাপ্তিতে সুখ হয় সেই বিষয়ও সবার কাম্য বিষয়। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, সুখ তার নিজের জন্যই কাম্য। কিন্তু যে বিষয়টির প্রাপ্তিতে সুখ হয় তা সুখজনক বলেই কাম্য। এজন্য সুখকে স্বতোকাম্য বলা হয়। সুখ তার জ্ঞানের কারণ সহযোগেই উৎপন্ন হয়। সুখের উৎপত্তিতে আত্মা সমবায়ী কারণ। আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং ধর্ম নিমিত্তকারণ। এজন্য সুখ উৎপন্ন হলে তার পরক্ষণে সুখের জ্ঞান উৎপন্ন হয়। একই কারণে তাই সুখকে তীব্র সংবেগী বলা হয়। জ্ঞানের সঙ্গে সুখের এখানেই পার্থক্য। যদিও জ্ঞান উৎপন্ন হলে পরবর্তীকালে তার মানসপ্রত্যক্ষ হতে পারে, তবে প্রতিটি জ্ঞানের মানসপ্রত্যক্ষ হবেই এমন কোন কথা নেই। কিন্তু সুখ উৎপত্তির পরক্ষণেই ‘আমি সুখী’ এরূপে তার মানসপ্রত্যক্ষ হয়। সুখের মানসপ্রত্যক্ষে সুখত্ব জাতিরও মানসপ্রত্যক্ষ হয়।
.
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন- ‘আমি সুখী’ এরূপ অনুব্যবসায়ে যে সুখত্বের প্রকাশ হয়, তাই সুখের প্রকৃত লক্ষণ। তর্কসংগ্রহে যা বলা হয়েছে তা সুখের স্বরূপকথন। বৌদ্ধমতে অবশ্য সুখ ও সুখজ্ঞান এক ও অভিন্ন।
 .
(১৪) দুঃখ : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো দুঃখ। দুঃখের লক্ষণ হলো ‘উপঘাত লক্ষণং দুঃখম্’ অর্থাৎ, দুঃখ হলো উপঘাত লক্ষণ।
দুঃখ পীড়াজনক এবং প্রাণীগণের পক্ষে প্রতিকূল অবস্থা। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে দুঃখ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সর্বেষাং প্রতিকূল (তয়া) বেদনীয়ং দুঃখম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা সকলে প্রতিকূল বলে অনুভব করে, তাই দুঃখ।
 .
দুঃখকে কেউ কামনা করে না। দুঃখ তাই স্বতোই পরিত্যাজ্য। যে বিষয় দুঃখদায়ক, দুঃখের ন্যায় তাও পরিত্যাজ্য। সুখের ন্যায় দুঃখ তীব্র সংবেগী। ফলে দুঃখ উৎপন্ন হলেই পরক্ষণেই তার উপলব্ধি হয়। এ কারণে বৌদ্ধগণ দুঃখ ও দুঃখের অনুভবকে এক ও অভিন্ন বলেন। কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক মতে দুঃখ ও দুঃখের অনুভব এক নয়। দুঃখের অনুভব সামগ্রি দুঃখের সঙ্গেই উৎপন্ন হয়। কিন্তু তবুও দুঃখ ও দুঃখের অনুভবকে এক বলা যাবে না। দুঃখের মানসপ্রত্যক্ষের মাধ্যমে দুঃখত্ব জাতিরও প্রত্যক্ষ হয়।
.
জ্ঞান বা বুদ্ধি ও সুখের ন্যায় দুঃখও আত্মার একটি বিশেষ গুণ। দুঃখের উৎপত্তিতে আত্মা সমবায়ী কারণ, আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং ধর্ম নিমিত্তকারণ হয়। অন্যান্য বিশেষ গুণের উৎপত্তিতে দুঃখের বিনাশ হয়। বস্তুত যেকোন বিশেষ গুণই পরবর্তী বিশেষ গুণের দ্বারা বিনষ্ট হয়।
 .
(১৫) ইচ্ছা : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো ইচ্ছা। ইচ্ছার লক্ষণ হলো- ‘স্বার্থং পরার্থং বা অপ্রাপ্তপ্রার্থনেচ্ছা’ অর্থাৎ, নিজের জন্য বা পরের জন্য অপ্রাপ্ত বিষয়ের যে প্রার্থনা তাই ইচ্ছা।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ইচ্ছা-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘ইচ্ছা কামঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ইচ্ছা হলো কোন কিছুর কামনা।
 .
এই ইচ্ছা সুখ প্রভৃতি বা স্মৃতি প্রভৃতির সহায়তায় আত্মমনোসংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়। আত্মা ইচ্ছার সমবায়ী কারণ, আত্মমনোসংযোগ ইচ্ছার অসমবায়ী কারণ এবং ইচ্ছার নিমিত্তকারণ দ্বিবিধ। ইষ্টের জ্ঞান ফলবিষয়ক ইচ্ছার নিমিত্তকারণ। এবং ইষ্টসাধনতার জ্ঞান উপায়বিষয়ক ইচ্ছার নিমিত্তকারণ। নিমিত্তকারণের ভেদে ইচ্ছারও ভেদ স্বীকৃত হয়। সুখ ও দুঃখাভাব আমাদের ইষ্ট। ফলের জ্ঞানই ফলের ইচ্ছার কারণ বলে সুখ ও দুঃখাভাবের ইচ্ছাকে বলা হয় ফলবিষয়ক ইচ্ছা। উপায়বিষয়ক ইচ্ছা ফলের ইচ্ছার অধীন। যে বিষয় সুখ ও দুঃখাভাবের সাধক তার প্রতি আমাদের ইচ্ছাকে বলা হয় উপায়বিষয়ক ইচ্ছা। যে বিষয় পূর্বে আমাদের সুখসাধন করেছিলো সেজাতীয় কোন বিষয়কে আমরা ইষ্টের সাধক বলে জানি ও তাকে কামনা করি। এজন্য ইষ্টসাধনতার জ্ঞানই হলো উপায়বিষয়ক ইচ্ছার নিমিত্তকারণ।
.
জ্ঞানাদির ন্যায় ইচ্ছাও মানসপ্রত্যক্ষের বিষয়। ইচ্ছার প্রত্যক্ষে ইচ্ছার জাতিরও মানসপ্রত্যক্ষ হয়। ইচ্ছা শুধু জীবাত্মার গুণ নয়, পরমাত্মারও গুণ। পরমাত্মা বা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই জগতের সৃষ্টি হয়। তবে ঈশ্বরেচ্ছা তার জ্ঞানের মতোই নিত্য। সুখ ও দুঃখ এ দুটি বিশেষ গুণ কিন্তু ঈশ্বরে থাকে না, এগুলি কেবলই জীবাত্মার গুণ। কাম, অভিলাষ, রাগ, সংকল্প, করুণা, বৈরাগ্য, উপধা এবং ভাব প্রভৃতি ইচ্ছারই প্রকারভেদ।
 .
(১৬) দ্বেষ : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো দ্বেষ। দ্বেষের লক্ষণ হলো- ‘প্রজ্জ্বলণাত্মকো দ্বেষঃ’ অর্থাৎ, দ্বেষ হলো প্রজ্জ্বলনরূপ আত্মগুণ।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে দ্বেষ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘ক্রোধো দ্বেষঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কোন কিছুর প্রতি ক্রোধকে দ্বেষ বলা হয়।
 .
দ্বেষের উৎপত্তিতে প্রাণীগণ প্রজ্জ্বলিত বা দগ্ধ হয়। জীবাত্মা দ্বেষের সমবায়ী কারণ, আত্মমনোসংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং দুঃখের জ্ঞান বা দুঃখ সাধনতার জ্ঞান হলো তার নিমিত্তকারণ। যে বিষয় থেকে দুঃখের আশঙ্কা থাকে সেই বিষয়ের প্রতি আমাদের দ্বেষ জন্মায়। আবার পরিণতিতে অভিষ্ঠসিদ্ধির সম্ভাবনা থাকলে দুঃখজনক বিষয়ের প্রতিও আমাদের দ্বেষ জন্মায় না। যেমন ভোজনের আনন্দ অন্নপাকের প্রতি দ্বেষের জনক হয় না। দ্বেষ যত্ন, স্মৃতি, ধর্ম ও অধর্মের জনক। ক্রোধ, দ্রোহ, মন্যু, অক্ষমা এবং অমর্ষ এইগুলি দ্বেষের প্রকারভেদ।
জ্ঞানাদির ন্যায় দ্বেষও মানসপ্রত্যক্ষের বিষয় হয়। দ্বেষ প্রত্যক্ষকালে দ্বেষত্বজাতিরও প্রত্যক্ষ হয়। দ্বেষ জীবাত্মার গুণ, পরমাত্মা বা ঈশ্বরের দ্বেষ নেই।
 .
(১৭) প্রযত্ন : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো প্রযত্ন। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট প্রযত্ন-এর লক্ষণে বলেছেন-

‘কৃতিঃ প্রযত্নঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কৃতি বা প্রচেষ্টাকে প্রযত্ন বলে।
 .
প্রযত্ন, সংরম্ভ, উৎসাহ ও কৃতি পর্যায় শব্দ। জ্ঞানাদির ন্যায় প্রযত্নও আত্মার একটি বিশেষ গুণ। আত্মা প্রযত্নের সমবায়ী কারণ, আত্মমনোসংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং কোন বিষয়ের প্রতি ইচ্ছা বা দ্বেষ হলো তার নিমিত্তকারণ। ইচ্ছা থেকে ঐ ইচ্ছার বিষয়কে প্রাপ্তির প্রযত্ন উৎপন্ন হয়, দ্বেষ থেকে ঐ দ্বেষের বিষয়কে পরিহারের প্রযত্ন উৎপন্ন হয়।
.
প্রযত্ন তিন প্রকার- প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি ও জীবনযোনি। ইচ্ছা থেকে ঐ ইচ্ছার বিষয়কে প্রাপ্তির যে প্রযত্ন বা চেষ্টা, তাকে বলে প্রবৃত্তি প্রযত্ন। দ্বেষ থেকে ঐ দ্বেষের বিষয়কে পরিহারের যে প্রযত্ন বা চেষ্টা, তাকে বলে নিবৃত্তি প্রযত্ন। আর যে প্রযত্ন প্রাণীর শরীরের শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণ হয় তাকে বলে জীবনযোনি প্রযত্ন।
.
প্রবৃত্তি প্রযত্ন ও নিবৃত্তি প্রযত্ন মানসপ্রত্যক্ষের বিষয়, কিন্তু জীবনযোনি প্রযত্ন অনুমানের বিষয়। শারীরিক পরিশ্রম করলে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া আমরা অনুভব করি। এর দ্বারা সুষুপ্তিকালে প্রাণীর প্রাণ-অপান ক্রিয়া প্রযত্ন হেতুক বলে আমরা অনুভব করি। সুষুপ্তিকালে ইচ্ছা বা দ্বেষ প্রযত্নের কারণ হয় না। অতএব জীবনযোনি প্রযত্নই যে সুষুপ্তিতে প্রাণ ও অপানের প্রেরক হয় তা অনুমান করা যায়। জীবন মানে শরীরে প্রাণ সঞ্চার। এই প্রাণ সঞ্চারের কারণরূপে প্রাণ-অপান ধারার প্রবর্তকরূপে যে প্রযত্ন তাই হলো জীবনযোনি প্রযত্ন। সুষুপ্তিকালে এই জীবনযোনি প্রযত্ন যেমন প্রাণ-অপান ধারার প্রবর্তক হয়, জাগ্রত অবস্থায় তেমনি এই প্রযত্ন বহিরিন্দ্রিয়ের দ্বারা মনের সংযোগের কারণ হয়।
প্রযত্ন জীবাত্মা ও পরমাত্মার সমানগুণ। পরমাত্মা বা ঈশ্বরের প্রযত্ন তার জ্ঞানাদির ন্যায় নিত্য, জীবাত্মার প্রযত্ন অনিত্য।
 .
(১৮) গুরুত্ব (Heaviness) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো গুরুত্ব। গুরুত্ব হলো দ্রব্যের এমন গুণ যার জন্য দ্রব্য নিচের দিকে পতিত হয়। গুরুত্বের লক্ষণ হলো- ‘গুরুত্বং জলভূম্যোঃ পতনকর্ম্মকারণম্’ অর্থাৎ, গুরুত্ব জল ও পৃথিবীর গুণ এবং পতনক্রিয়ার কারণ।
কোন দ্রব্যের প্রথম পতনক্রিয়ার অসমবায়ী কারণ হলো গুরুত্ব। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে গুরুত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘আদ্যপতনাসমবায়িকারণং গুরুত্বম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : গুরুত্ব হলো আদ্যপতনের অসমবায়িকারণ।
 .
গুরুত্ব হলো জড় দ্রব্যের গুণ বা প্রথম পতনক্রিয়ার (initial fall) কারণ।  কোন দ্রব্যের পতন একপ্রকার গমনক্রিয়া (motion)- উর্ধ্বদেশ হতে নিম্নদেশে গমন ক্রিয়া। এই নিম্নদেশগামী গমনক্রিয়া অনেকগুলি নিম্নগামী গমনক্রিয়ার সমষ্টি। এই পতনক্রিয়াগুলির প্রথম পতনক্রিয়াকে বলে আদ্যপতন। এই ক্রিয়ার (আদ্যপতন) আশ্রয় দ্রব্যটি এই ক্রিয়ার সমবায়িকারণ এবং এই ক্রিয়ার অসমবায়িকারণ ঐ দ্রব্যের গুরুত্ব, ওজন বা ভার (Heaviness)। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় বলেছেন- কোন দ্রব্যের পতনক্রিয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়াদি পতনক্রিয়ার অসমবায়িকারণ ঐ দ্রব্যের বেগ নামক গুণ।
.
গুরুত্ব গুণটিকে পতনক্রিয়ার দ্বারা অনুমান করা যায়। গাছের ডাল থেকে যখন একটি পাতা ঝরে মাটিতে পড়ে তখন ঐ পাতাটিতে অনেকগুলি পতনক্রিয়া ঘটে। ঐ সকল পতনক্রিয়ার মধ্যে প্রথম পতনক্রিয়ার প্রতি ঐ পত্রের ওজন অসমবায়িকারণ হয়। দ্বিতীয়াদি পতনক্রিয়ার অসমবায়িকারণ হয় বেগ নামক সংস্কার। কিন্তু গুরুত্ব বলা হবে কেবল প্রথম পতনক্রিয়ার অসমবায়িকারণকে।
গুরুত্ব গুণটি একটি সামান্যগুণ এবং তা পৃথিবী ও জলে থাকে। পৃথিবী ও জলের পরমাণুর গুরুত্ব নিত্য। অনিত্য পৃথিবী ও অনিত্য জলের গুরুত্ব অনিত্য।
 .
(১৯) দ্রবত্ব (Fluidity) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো দ্রবত্ব। দ্রব্যত্ব হলো দ্রব্যের সেই গুণ যার জন্য দ্রব্য গড়িয়ে পড়ে। দ্রবত্বের লক্ষণ হলো- ‘দ্রবত্বং স্যন্দনকর্মকারণম্’ অর্থাৎ, স্যন্দনের অসমবায়িকারণ হলো দ্রবত্ব।
কোন তরল দ্রব্যের প্রস্রবণ বা প্রবাহকে স্যন্দন (flowing) বলে। গুরুত্বের ন্যায় দ্রবত্বকেও আদি স্যন্দনের কারণ বলতে হয়। দ্বিতীয়াদি স্যন্দনের অসমবায়িকারণ বেগ নামক সংস্কার। অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহে দ্রবত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘স্যন্দনাসমবায়িকারণং দ্রবত্বম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : দ্রবত্ব হলো স্যন্দন-এর অসমবায়িকারণ।
 .
দ্রবত্ব গুণটি পৃথিবী, জল ও তেজ এই তিনটি দ্রব্যে থাকে। দ্রবত্ব দু’প্রকার- সাংসিদ্ধিক বা স্বাভাবিক এবং নৈমিত্তিক। জলের দ্রবত্ব সাংসিদ্ধিক বা স্বাভাবিক, ক্ষিতি ও তেজের দ্রবত্ব নৈমিত্তিক। স্বাভাবিক দ্রবত্বের জন্য জল নিচের দিকে গড়িয়ে যায়। নৈমিত্তিক দ্রবত্বের জন্য তেজসংযোগে ঘৃতাদি পার্থিবদ্রব্য ও সুবর্ণাদি তৈজস দ্রব্য তরল হয়। দ্রবত্বগুণ চক্ষু ও ত্বক্ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য। জলের পরমাণুস্থিত দ্রবত্ব নিত্য, অন্য সকল দ্রবত্ব অনিত্য।
 .
(২০) স্নেহ (Viscosity) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো স্নেহ। স্নেহ হলো সেই গুণ যে গুণের প্রভাবে চূর্ণ বস্তু সংলগ্ন হয়। স্নেহ গুণটি কেবলমাত্র জলে থাকে। স্নেহের লক্ষণে বলা হয়- ‘স্নেহঃ অপাং বিশেষ গুণ’ অর্থাৎ, স্নেহ জলের বিশেষগুণ।
জলভিন্ন অন্য কোন দ্রব্যে স্নেহ থাকে না। তেলে যে স্নেহের উপলব্ধি হয় তা তেলের অন্তর্গত জলেরই স্নেহ। তর্কসংগ্রহে স্নেহের লক্ষণ প্রসঙ্গে অন্নংভট্ট বলেন-

‘চূর্ণাদিপিণ্ডীভাব হেতুঃ গুণঃ স্নেহঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে গুণ চূর্ণাদি দ্রব্যের পিণ্ডভাবের (lumping together) হেতু বা কারণ তাকে স্নেহ বলা হয়।
 .
আটা, ময়দা প্রভৃতি দ্রব্যকে জলে মিশিয়ে পিণ্ডাকার করা যায়। স্নেহগুণের দ্বারা এই পিণ্ডাকার হয়ে থাকে। স্নেহ নিত্য ও অনিত্য ভেদে দ্বিবিধ। জলীয় পরমাণুতে অবস্থিত স্নেহ নিত্য। অপর সকল স্নেহ অনিত্য। উৎকৃষ্ট স্নেহ প্রজ্জ্বলনে সহায়তা করে। অপকৃষ্ট স্নেহ প্রজ্জ্বলনে বাধা দেয়।
 .
(২১) সংস্কার : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সংস্কার। সংস্কারত্ব জাতিমান পদার্থই সংস্কার নামক গুণ। অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় সংস্কার-এর লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেন-

‘সংস্কারত্ব জাতিমান্ সংস্কারঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যাতে সংস্কারত্ব জাতি আছে, তাই সংস্কার।
 .
সংস্কার তিন প্রকার- বেগ, ভাবনা ও স্থিতিস্থাপক।
 .
বেগ সংস্কার (speed) : যে গুণ ক্রিয়ার দ্বারা জন্য বা উৎপন্ন হয়ে অন্য ক্রিয়ার জনক তাই বেগ। বেগরূপ সংস্কার যেকোন দ্রব্যকে গতিশীল রাখে। দীপিকা টীকায় বেগ-এর লক্ষণে বলা হয়েছে-

‘বেগত্ব জাতিমান্ বেগঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যাতে বেগত্ব জাতি আছে, তাই বেগ।
 .
পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু দ্বারা নির্মিত দ্রব্যে ও মনে বেগ থাকে। একটা ঢিল উপরে ছুঁড়লে হাতের ক্রিয়ার দ্বারা ঢিলটিতে ক্রিয়া উৎপন্ন হয়। এই ক্রিয়া আবার ঢিলটিতে বেগ উৎপন্ন করে। ঐ বেগ ঢিলটির পূর্বক্রিয়াকে বিনষ্ট করে এবং এজাতীয় অপর একটি ক্রিয়া উৎপন্ন করে। এই ক্রিয়াটি আবার পূর্ববেগকে নষ্ট করে এবং অন্য একটি বেগকে উৎপন্ন করে। এভাবেই নিক্ষিপ্ত ঢিলটি দ্রুত একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছায়। বেগ দ্বিবিধ- কর্মজন্য বেগ ও বেগজন্য বেগ। বেগ দ্রব্যের সামান্যগুণ ও তা প্রত্যক্ষগোচর।
 .
ভাবনা সংস্কার (psychical trace) : ‘ভাবনা’ নামক সংস্কার হলো আত্মার বিশেষ গুণ। এইরূপ সংস্কারই স্মৃতির জনক এবং তা প্রত্যভিজ্ঞাকে সম্ভব করে। তর্কসংগ্রহে ভাবনার লক্ষণ দেওয়া হয়েছে-

‘অনুভবজন্যা স্মৃতিহেতুঃ ভাবনা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ভাবনা রূপ সংস্কার অনুভবজন্য হয়ে স্মৃতির হেতু হয়।
 .
ভাবনাখ্যসংস্কার প্রত্যক্ষ গোচর নয়। স্মৃতির কারণরূপে তা অনুমান করা হয়। অনুভব আত্মায় সংস্কার উৎপন্ন করে বিনষ্ট হয়। এই সংস্কার আত্মায় সমবেত থাকে এবং পরে তা উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মাতে স্মৃতি উৎপন্ন করে। স্মৃতিকালে যেহেতু অনুভব থাকে না, সেহেতু স্মৃতির কারণরূপে সংস্কারকে অনুমান করা হয়। ভাবনাখ্য সংস্কার কেবল জীবাত্মারই গুণ। পরমাত্মায় সংস্কার থাকে না। পরমাত্মার জ্ঞান নিত্যপ্রত্যক্ষমূলক। সুতরাং সেখানে স্মৃতিজনক সংস্কারের কোন স্থান নেই।
 .
স্থিতিস্থাপক সংস্কার (elasticity) : স্থিতিস্থাপক সংস্কার হলো দ্রব্যের সেই গুণ যার জন্য দ্রব্যের অবস্থান্তর ঘটাবার পরও দ্রব্য পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। নিবিড় অবয়বের দ্বারা সন্নিবিষ্ট স্পর্শবান দ্রব্যের গুণ হলো স্থিতিস্থাপক সংস্কার। তর্কসংগ্রহে স্থিতিস্থাপক-এর লক্ষণ দেওয়া হয়েছে-

‘অন্যথাকৃতস্য পুনস্তদবস্থাপাদকঃ স্থিতিস্থাপকঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : স্থিতিস্থাপক হলো যার জন্য একটি বস্তু পরিবর্তিত কোন অবস্থা হতে পূর্ব অবস্থায় ফিরে যায়।
 .
এই সংস্কার কেবলমাত্র পৃথিবীতে বা পার্থিব দ্রব্যে থাকে। স্থাবর ও জঙ্গম উভয়প্রকার পৃথিবীরই গুণ হলো স্থিতিস্থাপক সংস্কার। স্থিতিস্থাপক সংস্কার তার আশ্রয়কে পূর্বাবস্থায় স্থাপন করে। যেমন একটি গাছের ডাল বা ধনুককে বাঁকিয়ে তা ছেড়ে দিলে তা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। স্থিতিস্থাপক সংস্কার নিত্য দ্রব্যের গুণ হলে তা নিত্য এবং অনিত্য দ্রব্যের গুণ হলে তা অনিত্য।
বেগ ও স্থিতিস্থাপক সংস্কার হলো দ্রব্যের সামান্যগুণ। কিন্তু ভাবনা নামক সংস্কার হলো দ্রব্যের বিশেষ গুণ।
 .
(২২) ধর্ম : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো ধর্ম। ধর্ম ও অধর্ম গুণকে একত্রে অদৃষ্ট বলা হয়। আর ধর্মকে বলা হয় পুরুষগুণ। এখানে পুরুষ হলো জীবাত্মা। জীবাত্মার অন্যতম বিশেষগুণ হলো ধর্ম। পরমাত্মা বা ঈশ্বরের ধর্মগুণ স্বীকৃত নয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে শাস্ত্রবিহিত যাগযজ্ঞাদিক্রিয়াজন্য জীবাত্মায় যে বিশেষ গুণ উৎপন্ন হয় তাই ধর্ম। তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-

‘বেদবিহিত কর্মজন্যোধর্মঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বৈদিক শাস্ত্র নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের ফলে জীবাত্মায় যে বিশেষ গুণ উৎপন্ন হয়, তাই ধর্ম। 
 .
উৎকৃষ্ট গুণ হিসেবে ধর্মকে পুণ্যও বলা হয়। ধর্ম হলো শাস্ত্রসম্মত কৃতকর্মের ফল। ধর্মের ফল সুখ। সাংখ্যমতে মনের বৃত্তিবিশেষই ধর্ম। বৌদ্ধমতে ধর্ম হলো শুভ বাসনা। জৈনমতে কার্যের উৎপাদক সূক্ষ্ম মূর্তিমান পুদ্গলই হলো ধর্ম। প্রাভাকর মীমাংসামতে যাগাদি কর্মজন্য অপূর্বই হলো ধর্ম। অপূর্ব আত্মাশ্রিত হলেও এই মতে তা আত্মার গুণ নয়। আর ভাট্ট মীমাংসামতে যাগ, দান, হোম প্রভৃতি শাস্ত্রবিহিত কর্মই হলো ধর্ম।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে ধর্ম যদিও জ্ঞান, সুখ, দুঃখ ইত্যাদির মতো আত্মার একটি বিশেষ গুণ, তবু তা জ্ঞান, সুখ বা দুঃখ ইত্যাদির মতো তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট হয় না। ধর্ম সুখভোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকে, শেষ হয়ে গেলে বিনষ্ট হয়। অবশ্য তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাও ধর্ম বিনষ্ট হয়। তবে তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা সঞ্চিত ধর্মই বিনষ্ট হয়, কিন্তু প্রারব্ধ ধর্ম বিনষ্ট হয় না। ধর্ম অতীন্দ্রিয়।
ধর্ম মানসপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়, কিন্তু জ্ঞান, সুখ, দুঃখ ইত্যাদি মানসপ্রত্যক্ষযোগ্য। সুখের কারণ রূপে ধর্মকে অনুমান করা হয়। শাস্ত্রবিহিত কর্ম, ঐ কর্মের কর্তা যে আত্মা সেই আত্মাতেই ধর্ম উৎপন্ন করে। ধর্ম আত্মাতে সমবেত হয়ে উৎপন্ন হয়। তাই আত্মাই ধর্মের সমবায়িকারণ। আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ ধর্মের অসমবায়িকারণ। এবং শাস্ত্রবিহিত কর্মের অনুষ্ঠান হলো ধর্মের নিমিত্তকারণ।
 .
(২৩) অধর্ম : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো  অধর্ম। অধর্ম সম্বন্ধে বলা হয়- ‘অধর্ম্মোহপ্যাত্মগুণ’ অর্থাৎ, ‘ধর্মের ন্যায় অধর্মও আত্মার গুণ।’
অধর্ম সম্পর্কে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-

‘নিষিদ্ধ কর্মজন্যঃ তু অধর্মঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বৈদিক শাস্ত্রনির্দিষ্ট নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদনের ফলে জীবাত্মায় যে বিশেষ গুণ উৎপন্ন হয়, তাই অধর্ম।
 .
অধর্মের উৎপত্তিতে আত্মা সমবায়িকারণ, আত্ম-মনোসংযোগ অসমবায়িকারণ। এবং শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্মের ফললাভের সংকল্প বা দুষ্ট অভিসন্ধি হলো নিমিত্তকারণ। ধর্মের ন্যায় অধর্মও অতীন্দ্রিয়। সাধারণভাবে অধর্ম বলতে পাপকে বোঝায়। অধর্ম দুঃখের হেতু বা কারণ। দুঃখ থেকেই অধর্ম অনুমিত হয়, সকল দুঃখই অধর্মজন্য।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে অন্ত্যদুঃখের অর্থাৎ চরম দুঃখের নাশে অধর্মের নাশ হয়। হিংসা, মিথ্যাবচন, স্তেয় (চৌর্যবৃত্তি) প্রভৃতি কর্মের জন্য অধর্ম উৎপন্ন হয়। দুঃখভোগ শেষ না হলে অধর্মের নাশ হয় না। অধর্ম যেমন ভোগের দ্বারা বিনষ্ট হয়, তেমনি আবার তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাও সঞ্চিত অধর্ম বিনষ্ট হয়। অধর্ম কেবল জীবাত্মারই গুণ, পরমাত্মায় অধর্ম থাকে না।
 .
(২৪) শব্দ (Sound) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো শব্দ। শব্দের লক্ষণে বলা হয় ‘শব্দ অম্বর গুণঃ শ্রোত্রগ্রাহ্যঃ’ অর্থাৎ, ‘শব্দ আকাশের গুণ এবং শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ হয়।’
.
শব্দের আশ্রয় আকাশ। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ যেমন ব্যাপ্যবৃত্তি অর্থাৎ আশ্রয়কে ব্যাপ্ত করে থাকে, শব্দ কিন্তু সেরূপ নয়। শব্দগুণ তার আশ্রয়কে ব্যাপ্ত করে থাকে না। কোন শব্দ যখন উৎপন্ন হয় তখন আকাশের এক বিশেষ অবচ্ছেদেই উৎপন্ন হয়। সারা আকাশ জুড়ে কোন শব্দ থাকে না। ধরা যাক দূরে কেউ শাঁখ বাজালো। তার ফলে সেখানের আকাশে একটি শব্দ উৎপন্ন হলো। এই শব্দ তার পূর্ববর্তী আকাশে আরেকটা শব্দ উৎপন্ন করলো। ঐ শব্দ থেকে আরেকটি শব্দ, তার থেকে আরেকটি শব্দ এভাবে শব্দ পরম্পরা ক্রমে আমাদের কর্ণবিবরবর্তী আকাশে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তাই আমরা শুনি। শব্দের কর্ণবিবরবর্তী হওয়ার এই প্রক্রিয়া ন্যায়দর্শনে কদম্বমুকুল-ন্যায় নামে পরিচিত।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে শব্দ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘শ্রোত্রগ্রাহ্যো গুণঃ শব্দঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : শ্রোত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহীত হয় যে গুণ তাকে শব্দ বলা হয়।
 .
শব্দ দুই প্রকার- ধ্বন্যাত্মক শব্দ এবং বর্ণাত্মক শব্দ।
বর্ণাত্মক শব্দ হচ্ছে- ‘বর্ণাত্মকঃ সংস্কৃত ভাষাদিরূপঃ’ (তর্কসংগ্রহ), অর্থাৎ ‘যে শব্দ ক, খ, গ ইত্যাদি বর্ণে বিভক্ত হয় এবং যা সংস্কৃতাদি ভাষাতে পাওয়া যায়, তাই বর্ণাত্মক শব্দ।’
আর ধ্বন্যাত্মক শব্দ হচ্ছে- ‘ধ্বন্যাত্মকো ভের্যাদৌ’ (তর্কসংগ্রহ), অর্থাৎ ‘যে শব্দ ক, খ, গ ইত্যাদি বর্ণে বিভক্ত হয় না তাকে ধ্বনি বা ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে।’ ভেরী (drum) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র থেকে যে শব্দ নির্গত হয়, যাকে পৃথক পৃথক বর্ণে বিভক্ত করা যায় না, তাই ধ্বন্যাত্মক শব্দ।
 .
উৎপত্তি ভেদেও শব্দের প্রকারভেদ রয়েছে। তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় অন্নংভট্ট বলেন- উৎপত্তির দিক থেকে শব্দ তিন প্রকার, যথা- সংযোগজন্য, বিভাগজন্য ও শব্দজন্য শব্দ। ভেরী ও দণ্ডের সংযোগ থেকে উৎপন্ন শব্দ সংযোগজন্য শব্দ। বাঁশকে চিরলে বাঁশের দুটি অংশের বিভাগ থেকে উৎপন্ন চট্চট্ শব্দ বিভাগজন্য শব্দ। আর ভেরী ও দণ্ডের সংযোগ হতে কিংবা বাঁশের অংশ-বিভাগ থেকে শব্দ উৎপন্ন হলে ভেরী প্রভৃতির দেশ বা স্থান হতে আরম্ভ করে শ্রোতার শ্রোত্র ইন্দ্রিয় পর্যন্ত দ্বিতীয়াদি শব্দ-পরম্পরায় যে শব্দসমূহ উৎপন্ন হয়, তা শব্দজন্য শব্দ।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে শব্দ আকাশের বিশেষ গুণ। কর্ণ ইন্দ্রিয় হচ্ছে কর্ণবিররবর্তী আকাশ। আকাশে শব্দ সমবেত, অর্থাৎ সমবায় সম্বন্ধে থাকে। কর্ণ ইন্দ্রিয় বলতে আকাশকে বোঝায় এবং শব্দ আকাশের বিশেষ গুণ বলে কর্ণ ইন্দ্রিয়ই শব্দ গ্রহণে সমর্থ হয়।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: দ্রব্য-পদার্থ] [*] [পরের পর্ব: কর্ম-পদার্থ]

No comments: