Thursday, August 9, 2012

| বৈশেষিক দর্শন…০৩ : দ্রব্য পদার্থ |

 .
| বৈশেষিক দর্শন…০৩ : দ্রব্য পদার্থ |
রণদীপম বসু

২.১ : দ্রব্য পদার্থ (Substance):
.
বৈশেষিক দর্শনে পদার্থকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- ভাবপদার্থ এবং অভাবপদার্থ। ভাবপদার্থ ছয় প্রকার- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ এবং সমবায়। সুতরাং বৈশেষিক মতে দ্রব্য হলো প্রথম ভাবপদার্থ। এই মতে দ্রব্য হলো গুণ ও কর্মের আধার বা আশ্রয় এবং গুণ ও কর্ম দ্রব্য নামক পদার্থে সমবায় সম্বন্ধে আশ্রিত থাকে।


সূত্রকার মহর্ষি কণাদ বৈশেষিকসূত্রে দ্রব্যের লক্ষণ বর্ণনা করেছেন এভাবে-

‘ক্রিয়াগুণবৎ সমবায়িকারণমিতি দ্রব্যলক্ষণম্’। (বৈশেষিক সূত্র: ১/১/১৫)।
অর্থাৎ : যে পদার্থ ক্রিয়া বা গুণের আশ্রয় অথবা যা সমবায়ী কারণ হয় তাই দ্রব্য।
 .
বস্তুত এই সূত্রে দ্রব্যের তিনটি বিকল্প লক্ষণ দেয়া হয়েছে- (১) যা ক্রিয়ার আশ্রয় বা ক্রিয়াবৎ তাই দ্রব্য, (২) যা গুণের আশ্রয় বা গুণবৎ তাই দ্রব্য এবং (৩) যা গুণ ও কর্মের সমবায়ী কারণ তাই দ্রব্য।
বলা বাহুল্য, এই তিনটি লক্ষণের কোনটিই এককভাবে নির্দোষ লক্ষণ হতে পারে না।
 .
প্রথম লক্ষণ অনুসারে ‘ক্রিয়াবত্বং দ্রব্যত্বং’ অর্থাৎ ক্রিয়া দ্রব্যে আশ্রিত থাকে। যেমন- ঘোড়া হলো দ্রব্য কারণ ঘোড়া হলো গতিবান। গতি একটি ক্রিয়া এবং ঘোড়া হলো তারই আশ্রয়। এই কারণে ঘোড়া একটি দ্রব্য। একইভাবে প্রবহমান জলও দ্রব্য, কারণ সেখানেও প্রবাহ বা গমন নামক ক্রিয়া আছে।
কিন্তু দ্রব্যের এই লক্ষণ অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট। কারণ কিছু কিছু দ্রব্য আছে যাতে কোন ক্রিয়া নেই। যেমন, আকাশ বা কাল হলো বিভুদ্রব্য। বিভু অর্থ সর্বব্যাপী। সর্বব্যাপী দ্রব্যের ক্রিয়া হয় না। বৈশেষিক মতে আকাশ, কাল, দিক্ ও আত্মা এই চারটি দ্রব্য নিষ্ক্রিয়। সুতরাং এই চারটি ক্রিয়াহীন দ্রব্যে ‘ক্রিয়াবত্বং দ্রব্যত্বং’ এই লক্ষণ প্রযোজ্য হতে পারে না। তাই লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট।
 .
এই কারণে দ্রব্যের পরবর্তী লক্ষণে বলা হয়েছে, ‘গুণবত্বং দ্রব্যত্বং’ অর্থাৎ দ্রব্য হলো গুণের আশ্রয়। যেমন, নীল ঘট একটি দ্রব্য, কারণ সেখানে নীল গুণ আছে। অথবা শ্বেতপদ্মে শ্বেতত্ব গুণ আছে, এ কারণে শ্বেতপদ্মটি একটি দ্রব্য।
কিন্তু এই লক্ষণটিও নির্দোষ নয়। কারণ, কেবলমাত্র কোন আশ্রয়েই গুণগুলি উৎপন্ন হয়। এর অর্থ গুণের আশ্রয় বা দ্রব্য প্রথমে উৎপন্ন হলে তবে তারপরে সেখানে গুণ উৎপন্ন হবে। সেক্ষেত্রে গুণ উৎপন্ন হওয়ার আগে দ্রব্যটি হবে গুণশূন্য। সুতরাং দ্রব্যের এমন একটি অবস্থা আছে যা গুণের আশ্রয় নয়।
.
বৈশেষিক মতে দ্রব্য নিত্য ও অনিত্যভেদে দ্বিবিধ। পৃথিবী, তেজ, জল ও বায়ু এই চারটি দ্রব্যের পরমাণু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা ও মন এগুলি হলো নিত্যদ্রব্য। এসবের উৎপত্তিও নেই, বিনাশও নেই। কিন্তু পরমাণু ভিন্ন সকল পার্থিব, জলীয়, তৈজস ও বায়বীয় দ্রব্যই উৎপত্তি-বিনাশশীল অনিত্যদ্রব্য। এই সকল অনিত্যদ্রব্য স্ব স্ব উৎপত্তিক্ষণে গুণহীন থাকে। বৈশেষিক মতে অনিত্য দ্রব্যের কারণসামগ্রি কেবল দ্রব্যই উৎপন্ন করতে পারে, গুণ উৎপন্ন করতে পারে না। দ্রব্যের উৎপত্তির পর সেই দ্রব্য গুণ উৎপন্ন করে। গুণ-উৎপত্তিকালীনদ্রব্য তাই নির্গুণই হয়। এই উৎপত্তিকালীন দ্রব্য নির্গুণ হওয়ায় ‘গুণবত্বাং দ্রব্যত্বং’ বা দ্রব্য গুণের আশ্রয় এই লক্ষণটিও অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়।
 .
এ কারণে বৈশেষিক সূত্রে দ্রব্যের তৃতীয় লক্ষণে বলা হয়েছে ‘গুণকর্মসমবায়িকরণত্ব’ অর্থাৎ, যা গুণ ও কর্মের সমবায়ী কারণ তাই দ্রব্য। গুণ দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, নীল গুণ দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থেকে উৎপন্ন হয়, এ কারণে দ্রব্য নীল গুণের সমবায়ী কারণ।
.
বৈশেষিক মতে এই সমবায়িকারণতার অবচ্ছেদকরূপে দ্রব্যত্ব জাতিকে সিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই মতে দ্রব্যের লক্ষণে বলা হচ্ছে- ‘দ্রব্যত্ব’ জাতি যাতে আছে তাই দ্রব্য। ভাষ্যকারেরা দ্রব্যের এই লক্ষণের নাম দিয়েছেন ‘দ্রব্যত্ববত্ব’, এটি একটি জাতিঘটিত লক্ষণ। অর্থাৎ, বিভিন্ন দ্রব্যে সমবেত যে নিত্য অনুগত দ্রব্যত্ব ধর্ম, সেটি হলো জাতি। যা দ্রব্যত্ববৎ বা দ্রব্যত্ববান তাই দ্রব্য। এই দ্রব্যত্ববত্বকে দ্রব্যের নির্দোষ লক্ষণ বলা হয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা দ্রব্যত্ব জাতি সিদ্ধ করা যায় না। এ কারণে অনুমান প্রমাণের দ্বারা দ্রব্যত্ব জাতি সিদ্ধ করা হয়েছে। ভাষাপরিচ্ছেদকার বিশ্বনাথ ন্যায়-পঞ্চাননও সিদ্ধান্ত মুক্তাবলীতে দ্রব্যত্বজাতির দ্বারাই দ্রব্যের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন। তর্কসংগ্রহদীপিকায় অন্নংভট্টও দ্রব্যের লক্ষণে বলেন-

‘দ্রব্যত্বজাতিমত্ত্বং গুণবত্ত্বং বা দ্রব্যসামান্যলক্ষণম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যাতে দ্রব্যত্ব জাতি থাকে তাই দ্রব্য, অথবা যাতে গুণ থাকে তাই দ্রব্য। দ্রব্যত্বজাতিমত্ত্ব অথবা গুণবত্ত্ব দ্রব্যের সামান্যলক্ষণ।
 .
তবে এতোসব জটিলতায় না গিয়ে সহজ কথায় দ্রব্যের লক্ষণ বলতে আমরা বুঝি, দ্রব্য হলো গুণবান ও কর্মবান। যা সর্ব অনিত্যগুণের ও সর্ব কর্মের সমবায়ী কারণ। সমবায়ী কারণে কার্য সরাসরি সমবায় সম্বন্ধে সংবদ্ধ হয়। গুণ ও কর্ম দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে বর্তমান থাকে। গুণ বা কর্ম কখনও দ্রব্য ছাড়া থাকতে পারে না। আবার দ্রব্যও উৎপত্তির পর কোন না কোন গুণ বা কর্মের সমবায়ী কারণ হয়। গুণ বা কর্মহীন কোন দ্রব্য আমরা পাই না। ন্যায়-বৈশেষিক মতে একমাত্র উৎপত্তিক্ষণেই দ্রব্য নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। গুণ ও কর্ম পদার্থ কোন না কোন আশ্রয়ে আশ্রিত। আশ্রয় ব্যতীত আশ্রিত থাকতে পারে না। যে পদার্থ গুণ ও কর্ম পদার্থের আশ্রয়, তাকেই দ্রব্য বলা হয়।
 .
দ্রব্যের বিভাগ:
বৈশেষিক মত অনুযায়ী তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট দ্রব্যের প্রকার নির্দেশ করে বলেন-

‘তত্র দ্রব্যাণি পৃথিব্যপতেজোবায়ব্কাশকালদিগাত্মমনাংসি নবৈব’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পদার্থসমূহের মধ্যে পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক্, আত্মা ও মন- এই ন’টি মাত্র দ্রব্য।
 .
আবার তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় তিনি বলেন-

‘দ্রব্যং বিভজতে তত্রেতি। তত্র দ্রব্যাদিমধ্যে দ্রব্যাণি নবৈবেত্যন্বয়ঃ।’ (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : দ্রব্য ন’টি- একথা বলার দ্বারা বলা হয়েছে যে, দ্রব্য ন’টি এবং ন’টির অতিরিক্ত দ্রব্য নাই।
 .
অতএব, বৈশেষিক মতে দ্রব্য নয় প্রকার। যথা- ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ্ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), দিক, কাল, আত্মা এবং মন।
এই নয়টি দ্রব্যের মধ্যে ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম্-কে ভূতদ্রব্য বা পঞ্চভূত এবং ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও মনকে মূর্তদ্রব্য বলা হয়। অর্থাৎ ন্যায়-বৈশেষিক মতে ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও মরুৎ এই চারটি ভূতদ্রব্যও বটে আবার মূর্তদ্রব্যও বটে। কাল, দিক্ ও আত্মা ভূতও নয় আবার মূর্তও নয়। ব্যোম্ ভূতদ্রব্য কিন্তু মূর্তদ্রব্য নয়। মন মূর্ত দ্রব্য কিন্তু ভূতদ্রব্য নয়।
 .
পঞ্চ ভূতদ্রব্যের সমন্বয়ে ভৌতজগৎ সৃষ্ট হয়েছে। যে দ্রব্যের বহিরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ গুণ আছে তাকে ভূতদ্রব্য বলে। সীমিত পরিমাণযুক্ত দ্রব্যকে বলে মূর্তদ্রব্য। ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম্ এই পাঁচটি ভূতদ্রব্য যথাক্রমে গন্ধ, রস বা স্বাদ, রূপ, স্পর্শ এবং শব্দ এই পাঁচটি উদ্ভূত বিশেষ গুণবিশিষ্ট। উদ্ভূত বিশেষগুণ নির্দিষ্ট দ্রব্য ছাড়া অন্যত্র থাকে না। গন্ধ, ক্ষিতির বিশেষ গুণ। তাই ক্ষিতি ছাড়া গন্ধ থাকতে পারে না। একইভাবে উদ্ভূত স্বাদ জল ব্যতীত, উদ্ভূত রূপ তেজ ব্যতীত, উদ্ভূত স্পর্শ বায়ু ব্যতীত এবং শব্দ আকাশ ব্যতীত কোথাও উদ্ভূতরূপে থাকে না। ন্যায়-বৈশেষিক মতে এক একটি বিশেষগুণ এক একটি বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য। পাঁচটি ভূতদ্রব্যের পাঁচটি বিশেষগুণ যথাক্রমে ঘ্রাণেন্দ্রিয় (নাক), রসনেন্দ্রিয় (জিহ্বা), চক্ষুরিন্দ্রিয় (চোখ), ত্বগিন্দ্রিয় (ত্বক) ও শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের (কান) দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়। বৈশেষিকমতে যে যে বিশেষগুণ যে যে বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য, সেই সেই বিশেষগুণের আশ্রয় যে ভূতদ্রব্য তাদের উপাদানে সেই সেই ইন্দ্রিয় উৎপন্ন। অন্যভাবে বললে, যে ইন্দ্রিয় যে ভূতদ্রব্যের উপাদানে গঠিত, সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সেই ভূতদ্রব্যের বিশেষগুণ প্রত্যক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে নৈয়ায়িকেরা বৈশেষিকদের সঙ্গে একমত। এ কারণেই ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে বহিরিন্দ্রিয়গুলিকে ভৌতিক বলা হয়েছে।
অভৌতিক দ্রব্যগুলিরও বিশেষগুণ আছে। কিন্তু এই বিশেষগুণগুলি বহিরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, যেমন- জ্ঞান আত্মার বিশেষগুণ, কিন্তু কোন বহিরিন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য নয়। অভৌতিক ইন্দ্রিয় মন এই গুণকে প্রত্যক্ষ করে।
 .
ক্ষিতি, অপ্, তেজ এবং মরুৎ এই চতুর্বিধ ভৌত দ্রব্য নিত্য ও অনিত্য ভেদে দু’প্রকার। প্রত্যক্ষগ্রাহ্য সাবয়ব ভৌত দ্রব্য অনিত্য এবং আদি উপাদানরূপ প্রত্যক্ষের অগোচর পরমাণু দ্রব্য নিত্য। এই ভৌত দ্রব্যগুলির মৌলিক আদি উপাদান হলো যথাক্রমে ক্ষিতি পরমাণু, অপ্ পরমাণু, তেজ পরমাণু এবং মরুৎ পরমাণু। এই পরমাণুগুলি নিত্য অর্থাৎ, এদের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই এবং এরা নিরাবয়ব। কিন্তু এই সমস্ত পরমাণুর সংযোগের ফলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে স্থূল ক্ষিতি, স্থূল অপ্, স্থূল তেজ ও স্থূল মরুৎ উৎপন্ন হয়, এগুলি অনিত্য। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ যৌগিক দ্রব্য বলে এদের উৎপত্তি ও বিনাশ রয়েছে। বৈশেষিক মতে পরমাণুগুলি অতীন্দ্রিয়, এ কারণে পরমাণুর প্রত্যক্ষ হয় না। পরমাণুর অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ করা হয়েছে।
.
নিত্য ও অনিত্য দ্রব্যসমূহ
 .
(১) ক্ষিতি বা পৃথিবী (Earth) : নবদ্রব্যের তালিকায় ক্ষিতির উল্লেখই প্রথম। ক্ষিতি বা পৃথিবী হলো গন্ধবতী দ্রব্য। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে পৃথিবীর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘তত্র গন্ধবতী পৃথিবী। সা দ্বিবিধা নিত্যা অনিত্যা চ। নিত্যাপরমাণুরূপা। অনিত্যা কার্যরূপা।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পৃথিবী হলো সেই দ্রব্য যা গন্ধযুক্ত। নিত্য ও অনিত্য ভেদে পৃথিবী দ্বিবিধ। পরমাণুরূপ পৃথিবী নিত্য, কার্যরূপ পৃথিবী অনিত্য।
.
পৃথিবীর লক্ষণ হলো গন্ধবত্ব কিংবা গন্ধের সমবায়িকারণত্ব। গন্ধের সমবায়িকারণতার অবচ্ছেদক ধর্মই হলো পৃথিবীত্ব। এই পৃথিবীত্ব জাতির দ্বারাও পৃথিবীর লক্ষণ করা যায়। বৈশেষিক মতে ক্ষিতি বা পৃথিবীতে মোট চৌদ্দটি গুণ থাকে, যথা- গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমিতি, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, গুরুত্ব, দ্রবত্ব ও সংস্কার (বেগ ও স্থিতিস্থাপক)।
পৃথিবী দুই প্রকার- নিত্য ও অনিত্য। ক্ষিতির পরমাণু নিত্য। তার উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। পরমাণু ব্যতীত সকল ক্ষিতিই অনিত্য। অনিত্য ক্ষিতি ত্রিবিধ- শরীর, ইন্দ্রিয় ও বিষয়। শরীররূপ ক্ষিতি দুই প্রকার- যোনিজ ও অযোনিজ। যোনিজ শরীর আবার দুই প্রকার- জরায়ুজ ও অণ্ডজ। অযোনিজ শরীরও দ্বিবিধ- স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ। ঘ্রাণেন্দ্রিয় ক্ষিতি থেকে উৎপন্ন।
 .
(২) অপ্ বা জল (Water) : শীতস্পর্শবতী দ্রব্য হলো অপ্ বা জল। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-

‘শীতস্পর্শবত্য আপঃ। তা দ্বিবিধাঃ নিত্যা অনিত্যাশ্চ। নিত্যাঃ পরমাণুরূপা। অনিত্যা কার্যরূপাঃ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : জল হলো সেই দ্রব্য যাতে শীতলস্পর্শ থাকে। নিত্য ও অনিত্য ভেদে জল দ্বিবিধ। পরমাণুরূপ জল নিত্য, কার্যরূপ জল অনিত্য।
 .
শীতস্পর্শবত্বই জলের লক্ষণ। অনিত্য শীতস্পর্শের সমবায়িকারণতাবচ্ছেদক ধর্মরূপে জলত্ব জাতি সিদ্ধ হয়। পৃথিবীতে যে চৌদ্দটি গুণ থাকে সেই চৌদ্দটি গুণের মধ্যে গন্ধ ব্যতীত বাকি গুণগুলি জলেও থাকে। গন্ধের পরিবর্তে জলে স্নেহ গুণটি থাকে। এই চৌদ্ধটি গুণের মধ্যে রস জলের বিশেষ গুণ। জলের রূপ শুক্ল। পাত্রবিশেষে জলের যে বিভিন্ন বর্ণ দেখা যায় তা পাত্রেরই রূপ। জল দুই প্রকার- নিত্য ও অনিত্য। নিত্য জল পরমাণু স্বরূপ। অনিত্য জল ত্রিবিধ- শরীর, ইন্দ্রিয় এবং বিষয়। রসনেন্দ্রিয় জলীয় দ্রব্য বা জল থেকে উৎপন্ন।
 .
(৩) তেজ (Tejas) : উষ্ণস্পর্শবান দ্রব্য হলো তেজ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-

‘উষ্ণ স্পর্শবৎ তেজঃ। তৎ চ দ্বিবিধং নিত্যমনিত্যং চ। নিত্যং পরমাণুরূপম্ । অনিত্যং কার্যরূপম্ । (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : তেজ হলো সেই দ্রব্য যাতে উষ্ণ স্পর্শ থাকে। তেজ দ্বিবিধ- নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ তেজ নিত্য, কার্যরূপ তেজ অনিত্য।
.
উষ্ণস্পর্শবত্বই তেজের লক্ষণ। অনিত্য উষ্ণ স্পর্শের সমবায়িকারণতাবচ্ছেদক রূপে তেজস্ত্ব জাতি সিদ্ধ হয়। পৃথিবী ও জলের বিশেষ গুণ গন্ধ ও রস তেজদ্রব্যে থাকে না। এছাড়া গুরুত্ব গুণটিও তেজে থাকে না, ফলে পৃথিবীর চৌদ্দটি গুণের মধ্যে মোট এগারটি গুণ তেজদ্রব্যে থাকে। যেমন- রূপ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমিতি, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, দ্রবত্ব ও বেগ নামক সংস্কার। তেজের রূপ হলো ভাস্বর শুক্ল। সোনা, রূপা প্রভৃতি পদার্থ তেজঃ পদার্থ। সেজন্য বাসনপত্রকে তৈজস বলা হয়। তেজ দ্রব্য নিত্য ও অনিত্য ভেদে দ্বিবিধ। পরমাণু স্বরূপ তেজ নিত্য। অন্য সমস্ত তেজ অনিত্য। অনিত্য তেজ পৃথিবী ও জলের ন্যায় শরীর, ইন্দ্রিয় ও বিষয় ভেদে ত্রিবিধ। চক্ষুরিন্দ্রিয় তেজ থেকে উৎপন্ন। তৈজস শরীর তৈজস পরমাণুর দ্বারা গঠিত। তেজের বিষয়কে অর্থাৎ বিষয়রূপ তেজকে কেউ কেউ চতুর্বিধ বলে মনে করেন- ভৌম, দিব্য, উদর্য ও আকরজ। অগ্ন্যাদি তেজ হলো ভৌম তেজ। বিদ্যুৎ, সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি হলো দিব্য তেজ। অন্নাদি পরিপাকের জন্য উদরস্থিত তেজ হলো উদর্য তেজ এবং সুবর্ণ রত্নাদি হলো আকরজ তেজ।
 .
(৪) মরুৎ বা বায়ু (Air) : রূপরহিত স্পর্শবান দ্রব্য হলো বায়ু। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বায়ুর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘রূপরহিতস্পর্শবান্ বায়ুঃ। স দ্বিবিধঃ নিত্যঃ অনিত্যশ্চ। নিত্যঃ পরমাণুরূপঃ। অনিত্যঃ কার্যরূপঃ। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বায়ু হলো সেই দ্রব্য যাতে স্পর্শ আছে, কিন্তু রূপ নাই। বায়ু দু’প্রকার- নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ বায়ু নিত্য, কার্যরূপ বায়ু অনিত্য।
 .
 পৃথিবী, জল ও তেজদ্রব্যে রূপ থাকে এবং স্পর্শও থাকে, কিন্তু বায়ুতে স্পর্শ থাকলেও রূপ থাকে না। স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব ও সংস্কার (বেগ) এই নয়টি গুণ বায়ুতে থাকে। প্রাচীনমতে বায়ু স্পর্শাদি গুণের আশ্রয়রূপে অনুমেয় কিন্তু নব্যমতে বায়ু ত্বাচপ্রত্যক্ষসিদ্ধ। ত্বগেন্দ্রিয় দ্বারা বায়ুকে স্পর্শ করা যায়। বায়ু দুইপ্রকার- নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ বায়ু নিত্য। অনিত্যবায়ু তিন প্রকার- শরীর, ইন্দ্রিয় ও বিষয়। ত্বগেন্দ্রিয় বায়ু থেকে উৎপন্ন। ত্বগেন্দ্রিয় সর্বশরীরব্যাপী। কেবল পুবিতৎ নাড়ীতে ত্বগেন্দ্রিয় থাকে না। বায়ুকে প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান ও উদান এই পঞ্চপ্রকার বলা হয়। হৃদয়ে স্থিত বায়ু প্রাণ, নিম্নগামীবায়ু অপান, নাভিস্থিত বায়ু সমান, কণ্ঠদেশস্থ বায়ু উদান এবং সর্বশরীর সঞ্চারী বায়ু ব্যান নামে পরিচিত। কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে বায়ুর সমবায়ী কারণ নেই। কারো কারো মতে বায়ু নিত্য।
 .
(৫) ব্যোম্ বা আকাশ (Akasa) : বৈশেষিকসম্মত পঞ্চম ভূতদ্রব্য হলো ব্যোম্ বা আকাশ। এই মতে আকাশ হলো এক, বিভু, নিত্য, ভূতদ্রব্য। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে আকাশের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘শব্দগুণকম্ আকাশম্ । তৎ চ একং বিভু নিত্যং চ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : শব্দ গুণ যার সেই দ্রব্য আকাশ। আকাশ এক, নিত্য ও বিভু।
 .
আকাশ শব্দগুণের অধিকরণ বা আশ্রয়। শব্দ আকাশে সমবেত। শব্দের প্রত্যক্ষ হয়, কিন্তু আকাশ অপ্রত্যক্ষ। আকাশের অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ। আকাশ অতীন্দ্রিয় ও সর্বব্যাপী। যেহেতু আকাশ সর্বব্যাপী সেহেতু সকল মূর্ত দ্রব্যের সঙ্গে আকাশের সংযোগ আছে। সর্বমুর্ত্তসংযোগিত্ব অর্থাৎ যে দ্রব্য সমস্ত মূর্ত দ্রব্যের সঙ্গে সংযুক্ত তাকে বলে বিভুদ্রব্য। এই কারণে আকাশ বিভু পদার্থ। আকাশের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। তাই আকাশ নিত্য এবং এক। আকাশ এক হওয়ায় আকাশত্ব জাতি স্বীকৃত হতে পারে না। আকাশত্বকে তাই অখণ্ডোপাধি বলা হয়। যদি আকাশ উৎপন্ন দ্রব্য হতো তাহলে তার সমবায়ী কারণরূপে আকাশের পরমাণু স্বীকার করতে হতো। কিন্তু পরমাণু থেকে উৎপন্ন দ্রব্য হয় অণুপরিমাণ বিশিষ্ট হবে অথবা মহৎ পরিমাণ বিশিষ্ট হবে। আকাশ বিভু পরিমাণ হওয়ায় তা পরমাণু থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। অনুৎপন্ন ভাবপদার্থ মাত্রই অবিনাশী। অতএব আকাশ নিত্য।
 .
আবার আকাশকে প্রত্যক্ষ করা যায় না অর্থাৎ আকাশ অতীন্দ্রিয় হওয়ায় পরিশেষানুমানের দ্বারা আকাশের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে শব্দ অনিত্য গুণ পদার্থ। শব্দ গুণ হওয়ায় তা কোন না কোন দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে সংবদ্ধ হবে। আবার তা অনিত্য হওয়ায় তার সমবায়ী কারণরূপে কোন দ্রব্য স্বীকার করতে হবে। শব্দ একটি বিশেষ গুণ হওয়ায় তা কাল, দিক্ ও মনে আশ্রিত হতে পারে না। কারণ এই তিনটি দ্রব্য কোন বিশেষ গুণের আশ্রয় হয় না। আবার শব্দ যেহেতু শ্রোত্রেন্দ্রিয় গ্রাহ্য সেহেতু তা পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আত্মার গুণ হতে পারে না। পৃথিব্যাদি দ্রব্যের গুণ শ্রোত্রেন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয় না। এভাবে পৃথিব্যাদি আটটি দ্রব্যের শব্দাশ্রয় বা শব্দের সমবায়ী-কারণতা অস্বীকৃত হওয়ায় নবতম দ্রব্য আকাশকেই শব্দাশ্রয় বা শব্দের সমবায়ী কারণরূপ দ্রব্য বলে স্বীকার করতে হয়। এভাবে পরিশেষানুমানের সাহায্যে আকাশের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
 .
(৬) কাল (Time) : বৈশেষিক স্বীকৃত ষষ্ঠ দ্রব্য হলো কাল। কালকে অতীতাদি ব্যবহারের হেতু বলা হয়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ প্রভৃতির বোধ থেকে কালের অস্তিত্ব অনুমান করা হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে কালের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘অতীতাদিব্যব্যবহারহেতুঃ কালঃ। স চ একঃ বিভুঃ নিত্যঃ চ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এরূপ ব্যবহারের হেতু যে দ্রব্য, তাই কাল। কাল এক, বিভু ও নিত্য।
 .
কালের রূপ নেই, এজন্য কাল অপ্রত্যক্ষ। কালের কল্পিত বিভাগ হলো মুহূর্ত। কাল জড়পদার্থ নয়, তাই কাল অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য। বৈশেষিক মতে কাল এক, বিভু ও নিত্য। কালের কোন বিশেষ গুণ নেই, সামান্য গুণ আছে। সামান্য গুণগুলি হলো সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কাল এক। কালে আশ্রিত পদার্থসমূহের ক্রিয়ার জন্য কাল অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, ক্ষণ, প্রহর, দিন, মাস, কর্ষাদি ভেদে ভিন্ন ভিন্নরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ধরনের ভেদ-ব্যবহার ঔপাধিক। প্রকৃতপক্ষে কাল এক ও অখণ্ড।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে উৎপত্তি ও বিনাশ না থাকায় কাল নিত্য। মহাপ্রলয়ে অনিত্য পদার্থসমূহের ধ্বংস কালেই উপপাদন করতে হয়। তাই প্রলয়েও কাল জগৎ-বিনাশের সাক্ষিরূপে অক্ষতই থাকে। আবার জগতের সৃষ্টি কালেই উপপাদন করতে হয় বলে কাল অনাদি। অনাদি ও অবিনাশী কালকে নিত্যই বলতে হয়।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কাল বিভু বা পরম মহৎপরিমাণ বিশিষ্ট। সর্বদা ও সর্বত্র ক্রিয়াসমূহ কালেই সম্পাদিত হয় বলে কাল সর্বব্যাপক বা সর্বত্র ব্যাপ্ত। কাল এক বলে কালত্ব ধর্ম জাতি হতে পারে না। কাল সকল কার্যের নিমিত্ত কারণ। তাই তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকাগ্রন্থে অন্নংভট্ট বলেন-

‘সর্বাধারঃ কালঃ সর্বকার্যনিমিত্তকারনং চ।’ (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : কাল সব কিছুর আধার এবং সকল কার্যের নিমিত্ত কারণ।
 .
(৭) দিক্ (Space) : দিকের অপর নাম দেশ। তা আকাশের মতোই এক, অতীন্দ্রিয়, বিভু বা সর্বব্যাপী ও নিত্য দ্রব্য। কাছে-দূরে, এখানে-ওখানে, পূর্বে-পশ্চিমে ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের কারণরূপে দিকের অস্তিত্ব অনুমান করা হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে দিক্-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘প্রাচ্যাদিব্যবহারহেতুঃ দিক্ । সা চ একা নিত্যা বিভুঃ চ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, এখানে, সেখানে, কাছে, দূরে প্রভৃতি ব্যবহারের কারণ যে দ্রব্য, তাই দিক্ । (কালের মতো) দিক্ এক, নিত্য ও বিভু দ্রব্য।
 .
কালের মতো দিকেরও কোন বিশেষ গুণ নেই, সামান্য গুণ আছে। যথা- সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ। কালের মতো দিক্-এও উদ্ভূতরূপ বা উদ্ভূতস্পর্শ নাই। তাই দিক্-এর প্রত্যক্ষ হয় না। এছাড়া দিক সকল কার্যের প্রতি নিমিত্ত কারণ। তর্কসংগ্রদীপিকা টীকায় অন্নংভট্ট বলেন-

‘দিগপিকার্যমাত্রে নিমিত্ত কারণম্ ।’ (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : দিক্ কার্যমাত্রের প্রতি নিমিত্ত কারণ।
.
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে পরত্ব এবং অপরত্ব বলে দুটি গুণ পদার্থ স্বীকৃত। পরত্ব এবং অপরত্ব গুণদ্বয়ের ব্যবহার আবার দুই প্রকার। একপ্রকার পরত্ব ও অপরত্বের দ্বারা জ্যেষ্ঠত্ব ও কনিষ্ঠত্বের উপপত্তি হয়। অপর প্রকার পরত্ব ও অপরত্বের দ্বারা দূরত্ব ও নিকটত্বের উপপত্তি হয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে প্রথম প্রকার ব্যবহারের দ্বারা কাল অনুমিত হয় এবং দ্বিতীয় প্রকার ব্যবহারের দ্বারা দিক্ অনুমিত হয়।
আমরা প্রাচী (পূর্ব), প্রতীচী (পশ্চিম), উদীচী (উত্তর) এবং অবাচী (দক্ষিণ) প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে দূরত্ব-নিকটত্বের প্রতীতি লাভ করি। দূরত্ব-নিকটত্ব দৈশিক অবস্থান নির্দেশক। এই দৈশিক অবস্থানই পরত্ব-অপরত্বের একটি অর্থ। এই দূরত্ব ও নিকটত্ব আমরা ফুট, গজ, মাইল, কিলোমিটারের দ্বারা নির্দেশ করি।
 .
বৈশেষিক মতে দিক্ এক ও বিভু। কিন্তু এক্ষেত্রে আপত্তি উঠতে পারে যে, যার দ্বারা প্রাচী ও প্রতীচী প্রভৃতি ব্যবহার সিদ্ধ হয় তা কি করে এক ও বিভু হতে পারে। প্রাচী প্রতীচী নয়, আবার প্রতীচী প্রাচী নয়। তাই দিককে এক ও বিভু বলা যায় না। এর উত্তরে বৈশেষিকাচার্যরা বলেন প্রাচী-প্রতীচী ইত্যাদি ব্যবহার উপাধি মাত্র। প্রকৃতপক্ষে দিক্ এক। উপাধিভেদে দিককে ভিন্ন ভিন্ন বলে মনে হয়। দিক্ এক হওয়ায় তার বস্তুত কোন ভেদ নেই। উৎপত্তি ও বিনাশ রহিত দিক্ এক, বিভু ও নিত্য।
 .
(৮) আত্মা (Soul) : বৈশেষিক দার্শনিকরা আত্মাকে দেহ, ইন্দ্রিয় এবং মন থেকে স্বতন্ত্র একটি নিত্যদ্রব্য বলেছেন। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে আত্মার লক্ষণ দিয়েছেন-

‘জ্ঞানাধিকরণমাত্মা।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আত্মা জ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
 .
আত্মা জ্ঞান বা চৈতন্যস্বরূপ নয়। জ্ঞানাধিকরণত্ব আত্মার লক্ষণ। জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার একটি গুণ। তবে জ্ঞান আত্মার নিত্য গুণ নয়, আগন্তুক গুণ। আত্মাতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। জ্ঞান উৎপন্ন হয়ে আত্মাতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। এই কারণে আত্মা হলো জ্ঞানের সমবায়ী কারণ। কিন্তু আত্মাতে জ্ঞান সর্বদা থাকে না। তিনপ্রকার সংযোগের ফলে আত্মাতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সেগুলি হলো বাহ্য বিষয়ের সঙ্গে বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সংযোগ, বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগ এবং মনের সঙ্গে আত্মার সংযোগ। কিন্তু সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রাকালে অথবা মুক্তির অবস্থায় আত্মাতে জ্ঞান থাকে না।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- ‘স দ্বিবিধঃ জীবাত্মা পরমাত্মা চ ইতি।’ অর্থাৎ ‘আত্মা দু’প্রকার- জীবাত্মা ও পরমাত্মা বা ঈশ্বর।’ 
 .
জীবাত্মার জ্ঞান অনিত্য, কিন্তু পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্য জ্ঞানবান। তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় অন্নংভট্ট বলেন-

‘নিত্যজ্ঞানাধিকরণত্বং ঈশ্বরত্বম’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্যজ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
 .
নিত্যজ্ঞান পরমাত্মার গুণ। সুতরাং ঈশ্বর সগুণ। সর্বজ্ঞ পরমাত্মা সর্ববিষয়ক নিত্যজ্ঞানের আশ্রয়, কিন্তু নিত্যজ্ঞানস্বরূপ নন। ঈশ্বর অতীন্দ্রিয়দর্শী, অনাদি, অসীম, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তিনি জ্ঞানাদি সকল গুণবিশিষ্ট, নিত্য।
ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ, জ্ঞান, ধর্ম, অধর্ম, সংস্কার- এই ন’টি জীবত্মার বিশেষ গুণ। জ্ঞানবত্ত্ব, ইচ্ছাবত্ত্ব, প্রযত্নবত্ত্ব- এই তিনটি জীবত্মা ও পরমাত্মা এই দ্বিবিধ আত্মারই সামান্য লক্ষণ, কারণ পরমাত্মা বা ঈশ্বরেরও নিত্য জ্ঞান, নিত্য ইচ্ছা, নিত্য প্রযত্ন আছে। জগতের নিমিত্ত কারণরূপে পরমাত্মার অস্তিত্ব অনুমান করা হয়। কিন্তু পরমাত্মা বা ঈশ্বরের সুখ, দুঃখ, দ্বেষ না থাকায় সুখবত্ত্ব, দুঃখবত্ত্ব, দ্বেষবত্ত্ব পরমাত্মার লক্ষণ নয়। এগুলি কেবল জীবাত্মারই লক্ষণ।
.
জীবাত্মা এক নয়, বহু। শরীর ভেদে বিভিন্ন জীবাত্মা স্বীকার করা হয়েছে। জীবাত্মা নিত্য অর্থাৎ উৎপত্তি ও বিনাশরহিত। জীবাত্মা বিভু, অর্থাৎ পরম মহৎপরিমাণ বিশিষ্ট। শরীরের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বলে জীবাত্মাকে সীমিত বলে মনে হয়। পরমাত্মা বা ঈশ্বর এক ও সর্বজ্ঞ।
 .
(৯) মন (Manas) : ন্যায়-বৈশেষিক মতে মন নবম দ্রব্য এবং অন্তিম দ্রব্য। সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব (দৈশিক), সংস্কার (বেগ)- এই আটটি গুণের অধিকরণ হলো মন।
.
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- মন অন্তরিন্দ্রিয়। সুখ, দুঃখ প্রভৃতি আন্তর বস্তুর জ্ঞান চক্ষুরাদি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয় না। সুখ, দুঃখ প্রভৃতি আত্মার গুণ। সুখ-দুঃখাদির প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধির সাধন হলো মন। প্রত্যেক আত্মায় ভোগসাধনরূপে একটি মন স্বীকার করা প্রয়োজন। বাহ্যবস্তুকে প্রত্যক্ষ করার জন্য যেমন বহিরেন্দ্রিয়ের প্রয়োজন, সেরকম সুখ, দুঃখ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করার জন্য একটি ইন্দ্রিয়কে করণ হিসেবে স্বীকার করতে হয়। এই অন্তরেন্দ্রিয়ই হলো মন। মন আত্মার মতো নিত্য দ্রব্য। আত্মা অসংখ্য, তাই মনও অসংখ্য। মন যেহেতু অতীন্দ্রিয়, তাই মনের অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায়  মন-এর লক্ষণ দিয়েছেন-

‘স্পর্শরহিতত্বে সতি ক্রিয়াবত্ত্বং মনসো লক্ষণম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যা স্পর্শশূন্য, কিন্তু ক্রিয়াবান, তাই মন।
 .
পৃথিবী, জল, বায়ু, তেজে স্পর্শ ও ক্রিয়া উভয়ই থাকে। আকাশ, দিক্, কাল, আত্মা এই চারটি দ্রব্যে স্পর্শ ও ক্রিয়া থাকে না। কেবলমাত্র মন ক্রিয়াবান, কিন্তু স্পর্শরহিত। তাই মন পৃথিব্যাদি আটটি দ্রব্য হতে ভিন্ন।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, মনের প্রত্যক্ষ হয় না, মনকে অণুপরিমাণ বলা হয়েছে। মনের অস্তিত্ব অনুমানসিদ্ধ। এই মতে মন দ্রব্য হওয়ায় তার পরিমাণ থাকবে। দর্শনের দৃষ্টিতে পরিমাণ তিন প্রকার- অণুপরিমাণ, মধ্যমপরিমাণ ও বিভুপরিমাণ। ন্যায়-বৈশেষিক মতে মন মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট হতে পারে না। কেননা মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট দ্রব্য সাবয়ব বলে তার বিনাশ স্বীকার্য। সুতরাং মন মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট হলে মন বিনাশী অর্থাৎ অনিত্য একথা স্বীকার করতে হয়। আবার একথা বলা যায় না যে, আকাশ, দিক্, কাল, আত্মা স্পর্শরহিত কিন্তু বিভুদ্রব্য এবং মন স্পর্শরহিত দ্রব্য হওয়ায় মনও আকাশাদির মতো বিভু দ্রব্য। মন বিভুদ্রব্য হলে আত্মমনঃসংযোগ রূপ অসমবায়িকারণ না থাকায় জ্ঞানের উৎপত্তি হবে না। কেননা ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা দুটি বিভু দ্রব্যের সংযোগ স্বীকার করেন না বলে আত্মমনঃসংযোগ রূপ অসমবায়িকারণ ছাড়াই জ্ঞানোৎপত্তি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু তা অসম্ভব। কারণ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ ঘটলেই প্রত্যক্ষণ বা জ্ঞানোৎপত্তি হয় না, প্রত্যক্ষণের জন্য প্রয়োজন আত্ম-মনোসংযোগ। সুতরাং যেহেতু আত্মার বিভুত্ব স্বীকৃত, সেহেতু স্বীকার করতে হবে যে, মন বিভুপরিমাণবিশিষ্ট নয়। অনুমানসিদ্ধ মনের অস্তিত্ব সাধনে ন্যায়সূত্র-এ বলা হয়েছে-

‘যুগপৎ জ্ঞানানুৎপত্তিঃ মনসো লিঙ্গম্’। (ন্যায়সূত্র)।
অর্থাৎ : যুগপৎ বা একই সময়ে দুটি বিষয়ের জ্ঞানের উৎপত্তি না হওয়ায় মনের অস্তিত্ব অনুমিত হয়।
 .
এই যুক্তির ব্যাখ্যা হলো, বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের যুগপৎ সম্বন্ধ থাকলেও যুগপৎ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান আমাদের হয় না। আত্মা বিভু হওয়ায় আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ সর্বদাই বর্তমান। তা সত্ত্বেও যুগপৎ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান না হওয়ার জন্য আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সরাসরি সংযোগ স্বীকার করা যায় না। উভয়ের মধ্যবর্তী তৃতীয় একটি কারণের অনুসন্ধান করতে হয়। এই তৃতীয় কারণটি হলো মন নামক দ্রব্য। আত্মার সঙ্গে সরাসরি মনের সংযোগ হয় এবং মনের সঙ্গে বহিরিন্দ্রিয়গুলির সংযোগ হয়। বহিরিন্দ্রিয়গুলি যুগপৎ বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হলেও কোন একটি নির্দিষ্ট ক্ষণে মনের সঙ্গে একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের সংযোগ সম্ভব। কারণ মন অণুপরিমাণবিশিষ্ট। অণুপরিমাণ দ্রব্য একক্ষণে একাধিক দ্রব্যের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে না। কোন একক্ষণে মনের সঙ্গে যে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হয় সেইক্ষণে কেবল সেই ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংবদ্ধ বিষয়েরই প্রত্যক্ষ হয়, অন্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংবদ্ধ বিষয়ের প্রত্যক্ষ হয় না। তাই দ্রব্যরূপ মন বহিরিন্দ্রিয়গুলির দ্বারা বাহ্যবিষয়ের জ্ঞানের নিয়ন্ত্রক। এভাবেই মনের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এছাড়া মানস-প্রত্যক্ষের করণরূপ ইন্দ্রিয় হলো মন। এজন্যেই মনকে অন্তরিন্দ্রিয় বলা হয়। তবে ভাট্টমীমাংসা ও পাতঞ্জল দর্শন সম্প্রদায় মনের অণুপরিমাণ স্বীকার করেন না। তাদের মতে মন বিভু।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব] [*] [পরের পর্ব: গুণ-পদার্থ]

No comments: