Thursday, August 9, 2012

| বৈশেষিক দর্শন…০১ : ভূমিকা |

 .
| বৈশেষিক দর্শন…০১ : ভূমিকা |
রণদীপম বসু

১.০ : ভূমিকা
.
ভারতীয় আস্তিক ষড়দর্শনের মধ্যে অন্যতম দর্শন হলো বৈশেষিক দর্শন। এই দর্শনের ‘পদার্থতত্ত্ব’ বা ‘বিশ্বতত্ত্বে’র জ্ঞান প্রাচীনকালে যে কোন ছাত্রের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হতো। বিশ্বতত্ত্বের আলোচনাই বৈশেষিক দর্শনের প্রধান আলোচনা। ন্যায়-সম্প্রদায়ের মতো বৈশেষিক সম্প্রদায়ও মোক্ষকেই পরমপুরুষার্থ বলে মনে করেন। ন্যায় দর্শনে যেমন ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানকে মোক্ষের হেতুরূপে গণ্য করা হতো, বৈশেষিক দর্শনে তেমনি দ্রব্যাদি সপ্তপদার্থের সাধর্ম্য বা বৈধর্ম্যহেতুক তত্ত্বজ্ঞানকেই মোক্ষের হেতুরূপে গণ্য করা হয়।

.
মহর্ষি কণাদ-এর ‘বৈশেষিকসূত্র’ হলো বৈশেষিক দর্শন সম্প্রদায়ের মূল ও আদিগ্রন্থ। ‘বিশেষ’ পদার্থের উপর গুরুত্ব আরোপ করায় এই দর্শন ‘বৈশেষিক দর্শন’ নামে সমধিক পরিচিত হয়ে থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে ‘কণাদদর্শন’, ‘ঔলূক্যদর্শন’, ‘কাশ্যপীয় দর্শন’ প্রভৃতি নামেও পরিচিত। এই নামগুলির পেছনে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে।
.
মহর্ষি কণাদ ‘কণভূক’, ‘কণভক্ষ’, ‘যোগী’, ‘উলূক’, ‘কাশ্যপ’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিলেন। প্রবাদ আছে যে, তিনি দিবাভাগে গহন অরন্যে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন এবং রাত্রিকালে সবাই যখন নিদ্রিত থাকতো তখন তিনি আহারান্বেষণে বের হতেন। এরকম বৃত্তি উলূক বা পেচকের বৃত্তি তুল্য বলে তাঁর উলূক নামকরণ করা হয়েছে। মহাভারতের শান্তিপর্ব-১১-এ এরকম কাহিনীর ছায়া রয়েছে- ‘উলূকঃ পরমো বিপ্রো মার্কণ্ডেয় মহামুনিঃ’।
.
অন্য এক প্রবাদে বলা হয়েছে কণাদ কঠোর যোগাভ্যাসের ফলে শিবের অনুগ্রহ লাভ করেন। শিব কণাদের তপশ্চর্যায় সন্তুষ্ট হয়ে উলূকের রূপ ধরে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন এবং ষটপদার্থের উপদেশ দান করেন। বায়ুপুরাণেও উল্লেখ আছে যে, কণাদ পরম শৈব ছিলেন। ‘কণাদ’ নাম প্রসঙ্গে ন্যায়-কন্দলীতে উল্লেখ আছে, ক্ষেত্রে পড়ে থাকা শস্যকণা ভক্ষণ করে অর্থাৎ একপ্রকার ভিক্ষাবৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন বলে তাঁকে কণাদ বলা হতো। এবং এ কারণেই তাঁকে কণভূক বা কণভক্ষ বলা হতো। আবার কণাদ কাশ্যপ গোত্রীয় ছিলেন বলে তাঁর দর্শনকে কাশ্যপীয় দর্শনও বলা হয়। মোটকথা বৈশেষিক সূত্রকারের বিবিধ নাম অবলম্বনেই এই সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে সাধারণভাবে এই দর্শন ‘বৈশেষিক দর্শন’ নামেই পরিচিত।
 .
এক্ষেত্রে দর্শন-দিগদর্শন গ্রন্থে কণাদ সম্পর্কে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণের মন্তব্যটিও উল্লেখের দাবি রাখে-

‘বৈশেষিকের আর একটি নাম উলূক্য দর্শন। বৈশেষিকের স্রষ্টার সঙ্গে উলূক পক্ষীর (পেচক) বা নিশাচর প্রাণীর যে কি সম্বন্ধ ছিলো তা বলা যায় না। কণাদ যদি শুধু সরস্বতী নয় লক্ষ্মীরও কৃপাধন্য হতে পারতেন তবে না হয় তাঁর নাম উলূক হতে পারত। উলূক এমন কিছু সুশ্রী বা উত্তম জাতীয় পক্ষী নয় যে মা বাবা স্নেহবশত কণাদের এমন নাম রাখবেন। পেচক এথেন্সের একটি পবিত্র চিহ্ন। তবে কি গ্রীকদর্শনের সঙ্গে এই দর্শনের যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল তারই ফলস্বরূপ এই নামের সূচনা হয়েছে ?’ (দর্শন-দিগদর্শন)
 .
কণাদের বৈশেষিকসূত্র গ্রন্থের রচনাকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। তবে এ গ্রন্থকে বৌদ্ধ দর্শনের পূর্ববর্তী বলে স্বীকার করা হলেও তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বুদ্ধের জন্মের (৫৬৩ খ্রীষ্টপূর্ব) প্রায় আটশ বছর পূর্বে বৈশেষিকসূত্র রচিত হয়েছে এমন জনশ্রুতি রয়েছে। তবে বৈশেষিকসূত্র যে ন্যায়সূত্র থেকে প্রাচীন এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেউ কেউ (পণ্ডিত শ্রী শ্যামপদ মিশ্র প্রশস্তপাদভাষ্যের ভূমিকায়) কোন প্রমাণ ছাড়াই বৈশেষিকসূত্রের রচনাকাল ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্ব হিসেবে উল্লেখ করলেও এর সাথে ব্যাপক ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের বক্তব্যে। তিনি তাঁর দর্শন-দিগদর্শন গ্রন্থে পরমাণুবাদী দার্শনিক কণাদের সময়কাল উল্লেখ করেছেন ১৫০ খ্রীষ্টাব্দ। এ প্রসঙ্গে রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত-
‘কণাদের বৈশেষিক দর্শনকে বুদ্ধের পূর্বযুগের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা পণ্ডশ্রম কারণ কণাদের দর্শন যদি আগেই সৃষ্টি হতো তবে বুদ্ধ তথা অন্যান্য সমকালীন দার্শনিকগণকে ত্রিপিটক এবং অন্যান্য জৈনাগমের ভাষা-পরিভাষা দ্বারা নিজেদের দর্শন আরম্ভ করার প্রয়োজন হতো না। তাঁরা কণাদের দর্শন থেকে নিজেদের প্রভাবমুক্ত রাখতে পারতেন না।
কতিপয় বিদ্বান ব্যক্তি বৈশেষিককে বুদ্ধের আগের যুগে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, এই বলে যে, কণাদের দর্শনের ওপর বৌদ্ধদর্শনের কোনো প্রভাব নেই। এর উত্তরে আমি আগেই বলেছি যে (১) বুদ্ধের দর্শনের ওপর কণাদের দর্শনের গন্ধ পর্যন্ত নেই; (২) কণাদের দর্শন বুদ্ধের দর্শন থেকে অপ্রভাবিত নয়। কার আঘাতের প্রত্যুত্তর হিসেবে আত্মা এবং নিত্যতার সিদ্ধির ওপর এত জোর দেওয়া হয়েছিলো ? এটা নিশ্চিতই যে বুদ্ধের ‘অনিত্য’ এবং ‘অনাত্মা’-র বিরুদ্ধেই কণাদের দর্শন যেন জেহাদ ঘোষণা করেছিল। গ্রীক দর্শনেও হেরাক্লিটাসের অনিত্যতাবাদের উত্তরে নিত্য-সামান্যের কল্পনা করা হয়েছিল। কণাদ এবং তাঁর ভক্তগণের শতাব্দী জুড়ে সেই সামান্যকেই নিত্যতার নমুনার ধারায় উপস্থিত করা বৌদ্ধের অনিত্য (=ক্ষণিক)-বাদেরই উত্তর, অতএব বৈশেষিক যে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পরিচিত নয় এ কথা সর্বৈব মিথ্যা।’ (দর্শন-দিগদর্শন: পৃষ্ঠা-১২৭)
 .
এ প্রসঙ্গে বৈশেষিক দর্শন যে প্রকৃতই বুদ্ধপরবর্তী এবং তা যে পূর্ববর্তী গ্রীক দর্শন কর্তৃক বিপুলভাবে প্রভাবিত তা প্রমাণের নিমিত্তে রাহুল সাংকৃত্যায়নের আরো কিছু অভিমত স্মর্তব্য-
‘…ডিমোক্রিটাসের (৪৬০-৩৭০ খৃঃ.পূঃ.) জন্ম বুদ্ধের নির্বাণের (৪৮৩ খৃঃ.পূঃ.) ২৩ বছর পূর্বে হয়েছিল। সেটা ছিল এমন এক সময় যখন কিছু পুরাণ-উপনিষদ এবং বুদ্ধ-মহাবীর প্রভৃতি তীর্থঙ্করের উপদেশের ওপরেই আমাদের দর্শন নির্ভরশীল ছিল। শত অনুসন্ধান করলেও এর মধ্যে আমরা- “পরমাণুই জগতের মূলতত্ত্ব”- এর গন্ধ পর্যন্ত পাই না। ডিমোক্রিটাস যে সময়ে অবিভাজ্য, অবেধ্য, ‘অতোমোন’-এর সিদ্ধান্ত আবিষ্কার করেছিলেন, সে সময়ে ভারতে এ সম্পর্কে আবছা ধারণাও ছিল না। ডিমোক্রিটাস পরমাণুকেই সবচেয়ে সূক্ষ্ম সত্তা বলে মেনেছেন এবং তারও যে একটা পরিমাণ আছে তা অস্বীকার করেননি। কণাদও মনে করেছেন যে পরমাণু সূক্ষ্ম পরিমাণ-যুক্ত এবং উভয়েরই মতে পরমাণুই সৃষ্টি ইষ্টক স্বরূপ।
…পিথাগোরাস বলেছেন যে আকৃতিই মূল উপাদান, কারণ ভিন্ন ভিন্ন গরুর মৃত্যু হলেও গরু তার গো-আকৃতি নিয়েই জন্মাবে। প্লেটো আরও একটু অগ্রসর হয়ে পূর্বাপর আকৃতির মধ্যে যে সমানতা দেখা যায় তার ওপর অর্থাৎ সামান্যের ওপর জোর দিয়েছেন; তাঁর ধারণা বিশেষ মূল উপাদান (=ভাব)-এর মধ্যে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এই সামান্য-বিশেষের ধারণার কোনো আভাসই ভারতের সঙ্গে গ্রীসদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ার আগে ভারতীয় সাহিত্যে ছিল না।
…কণাদ তাঁর দর্শনে দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায় এই ছ’ভাগের পদার্থে বিশ্বের উপাদানকে ভাগ করেছেন। প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল তাঁর তর্কশাস্ত্রে আট ও দশটি পদার্থকে মেনেছেন : দ্রব্য, গুণ পরিমাণ, সম্বন্ধ, দিশা, কাল, আসন, স্থিতি, কর্ম, পরিমাণ। দ্রব্য, গুণ, কর্ম এবং সমবায় উভয়ের মতেই সমান। দিশা ও কালকে কণাদ দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং পরিমাণকে গুণের। অতএব আমরা বলতে পারি যে কণাদ অ্যারিস্টটলের পদার্থকেই পুনরায় বর্গীকরণ করেছেন। এই সঙ্গে যুগের কথা ধরলে অর্থাৎ গ্রীসের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ তথা আদান-প্রদানকে দেখে সহজেই বোঝা যায় যে, এই সাদৃশ্য আকস্মিক নয়।’ (দর্শন-দিগদর্শন: পৃষ্ঠা-১২৭)
 .
তবে একই প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতটিও উল্লেখযোগ্য-
‘…এ-অনুমান স্বীকারযোগ্য না হতেও পারে। কেননা, দুটি দেশে পরস্পরনিরপেক্ষভাবে পরমাণুবাদের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। তাছাড়া, বৈশেষিকদের দার্শনিক মতবাদের নানা বৈশিষ্ট্যও বর্তমান; তাকে কেবলমাত্র গ্রীস থেকে আমদানি করা পরমাণুবাদ মনে করলে অতিসারল্যের আশঙ্কাও থাকে। তৃতীয়ত, উলূক নামটি কোনো প্রাচীন গোত্রের পরিচায়কও হতে পারে; কেননা প্রাচীন ভারতে পশু-পক্ষীর নাম থেকে গোত্রনামের উদ্ভব মোটেই বিরল নয়।’ (ভারতীয় দর্শন: পৃষ্ঠা-১৭)
 .
যাই হোক, বৈশেষিক সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র ও নিজস্ব গ্রন্থাবলী খুব বেশি নয়। ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে প্রাচীনতম সূত্রর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে মহর্ষি কণাদের ‘বৈশেষিক সূত্র’কে স্বীকার করা হয়। এই গ্রন্থের প্রকৃত কোন ভাষ্যগ্রন্থ পাওয়া যায় না। লঙ্কেশ্বর রাবণ এই দর্শনের প্রাচীন ভাষ্যকার হিসেবে বেদান্ত গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। আচার্য শঙ্কর এই ভাষ্যকে রাবণভাষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। বেদান্তদর্শনে বৈশেষিকমতখণ্ডন প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য রাবণভাষ্যের মতের খণ্ডন করেছেন বলে জানা যায়। অনেকের মতে আচার্য প্রশস্তপাদ (২০০ খ্রীঃ)-এর ‘পদার্থধর্মসংগ্রহ’ বৈশেষিক-দর্শনের সঠিক ভাষ্য না হলেও ভাষ্যস্থানীয় এবং তা প্রশস্তপাদভাষ্য নামে পরিচিত। মূলত পদার্থধর্মসংগ্রহে সূত্র ব্যাখ্যাত হয়নি, তবে সূত্রের তাৎপর্য সংক্ষেপে ও যোগ্যতার সাথে সংগৃহীত হয়েছে। এটিই বর্তমানে প্রাপ্ত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ।  উদয়নাচার্যের (১০০০-১১০০ খ্রীঃ) ‘কিরণাবলী’ এবং শ্রীধরাচার্যের (৯৯১ খ্রীঃ) ‘ন্যায়কন্দলী’ এই পদার্থধর্মসংগ্রহের উপর উল্লেখযোগ্য টীকাগ্রন্থ। এছাড়া বল্লভাচার্যের (১১০০-১১৫০) ‘ন্যায়লীলাবতী’, চন্দ্রানন্দের ‘বৃত্তি’, শঙ্কর মিশ্রের (১৪৬২ খ্রীঃ) ‘বৈশেষিকসূত্রোপস্কার’ প্রভৃতি বৈশেষিক দর্শনের উল্লেখযোগ্য স্বতন্ত্র গ্রন্থ।
 .
বৈশেষিক সম্প্রদায়ের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র গ্রন্থাবলী খুব বেশি না হলেও ভারতীয় দর্শনে বৈশেষিক-মতের আলোচনা সুবিশাল। কেননা বৈশেষিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ন্যায় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে উভয়েরই প্রতিপাদ্য বিষয় অভিন্ন বা প্রায়-অভিন্ন। এজন্যেই ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনকে সমানতন্ত্র দর্শন বলা হয়। ফলে বহু গ্রন্থেই ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের তত্ত্বসমূহ একই সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। প্রাচীন ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হলেও আচার্য উদয়নের কাল থেকেই উভয় দর্শনের তত্ত্বসমূহ একই সঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিক হিসেবে আলোচিত হতে দেখা যায়। এভাবে পরবর্তীকালে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শন চর্চায় শিবাদিত্যের (১১৫০-১২০০ খ্রীঃ) ‘সপ্তপদার্থী’, লৌগাক্ষি ভাস্করের ‘তর্ককৌমুদী’, রঘুনাথ শিরোমণির (১৫০০-১৫৫০ খ্রীঃ) দীধিতি বা ‘পদার্থতত্ত্বনিরূপণ’, বিশ্বনাথ ন্যায় পঞ্চাননের (১৬০০-১৬৫০ খ্রীঃ) মুক্তাবলী টীকা সহ ‘ভাষাপরিচ্ছেদ’ এবং অন্নংভট্টের (১৫৫০-১৬০০ খ্রীঃ) ‘তর্কসংগ্রহ’ প্রভৃতি গ্রন্থে বৈশেষিকসম্মত মত এবং ন্যায়সম্মত মতের পার্থক্য প্রাসঙ্গিক স্থলে উল্লেখ করা হলেও যে সকল বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে যে কোন একটি মতেরই উল্লেখ আছে।
 .
ন্যায় ও বৈশেষিক এই দুই সমানতন্ত্র দর্শনে প্রধান প্রধান বিষয়ে উভয় সম্প্রদায় একমত হলেও কোন কোন অপ্রধান বিষয়ে অবশ্য উভয় সম্প্রদায়ের মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন, ন্যায়শাস্ত্র প্রধানত প্রমাণশাস্ত্র। তারা প্রমাণ চতুষ্টয়বাদী। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ- এই চারটি প্রমাণ ন্যায়দর্শনের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। কিন্তু বৈশেষিক দর্শনের মুখ্য আলোচ্য বিষয় প্রমেয় বা পদার্থ। বৈশেষিক দর্শন মুখ্যত প্রমেয়শাস্ত্র বা পদার্থশাস্ত্র। নৈয়ায়িকদের স্বীকৃত চারটি প্রমাণের মধ্যে বৈশেষিকেরা প্রত্যক্ষ ও অনুমান এই দুটি প্রমাণ স্বীকার করেছেন। উপমান ও শব্দ প্রমাণকে বৈশেষিকেরা প্রত্যক্ষ ও অনুমানের অন্তর্গত করেছেন।
.
উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু পরিভাষাগত ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। বৈশেষিক সম্প্রদায় যাকে ‘সামান্য’ বলেছেন, ন্যায় সম্প্রদায় তাকে প্রধানত ‘জাতি’ বলেছেন। আবার ন্যায় সূত্রোক্ত অনুমানের অবয়ব হিসেবে প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমনকে পদার্থধর্মসংগ্রহে প্রতিজ্ঞা, অপদেশ, নিদর্শন, অনুসন্ধান ও প্রত্যাস্নায় নামে কথিত হয়েছে। ন্যায়দর্শনে পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট এই ত্রিবিধ অনুমানের উল্লেখ আছে। কিন্তু বৈশেষিক দর্শনে দৃষ্ট ও সামান্যতোদৃষ্ট এই দ্বিবিধ অনুমানের উল্লেখ আছে। ন্যায় দর্শনে সব্যভিচার (অনৈকান্তিক), বিরুদ্ধ, প্রকরণসম (সৎপ্রতিপক্ষ), সাধ্যসম (অসিদ্ধ) ও কালাতীত (বাধিত) এই পাঁচপ্রকার হেত্বাভাস উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু বৈশেষিক দর্শনে অসিদ্ধ, বিরুদ্ধ ও সন্দিগ্ধ এই তিনপ্রকার হেত্বাভাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।
.
ন্যায়দর্শনে ষোড়শ পদার্থের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বৈশেষিক দর্শনে সপ্ত পদার্থের কথা বলা হয়েছে। তবে এই পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। পদার্থ বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের সংখ্যার পার্থক্য দুটি ভিন্ন বিন্যাস-প্রক্রিয়ার পার্থক্য মাত্র। বস্তুত সামগ্রিকভাবে জগতের পদার্থ বিষয়ে উভয় মতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ন্যায় দর্শনে ষোড়শ পদার্থের মাধ্যমে যে সকল তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে, বৈশেষিক দর্শনে তা সপ্তপদার্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
.
ন্যায়মতে সমবায় প্রত্যক্ষসিদ্ধ। কিন্তু বৈশেষিক মতে সমবায় প্রত্যক্ষের দ্বারা জ্ঞাত হতে পারে না, অনুমানের দ্বারা সমবায়ের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
মূলত ন্যায়সম্মত কোন মূলতত্ত্বই বৈশেষিকগণ কিংবা বৈশেষিকসম্মত কোন মূলতত্ত্বই নৈয়ায়িকগণ অস্বীকার করেননি।

(চলবে…)

[*] [পরের পর্ব: বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব]

No comments: