.
| বৈশেষিক দর্শন-০২ : বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব |
রণদীপম বসু
…
২.০ : বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব
.
ন্যায় দর্শনে যেমন প্রমাণের আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে, বৈশেষিক দর্শনে তেমনি ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্বের আলোচনাই গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্ববৈচিত্র্য তথা পার্থিব জগতকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বৈশেষিক সম্প্রদায় সাতটি পদার্থ স্বীকার করেছেন। এই সাতটি পদার্থ হলো- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব। জগতে এমন কিছু নেই যা এই সাতটি পদার্থের কোন না কোনটির অন্তর্গত নয়। সুতরাং, বিশ্বের মৌলিক তত্ত্ব হলো সাতটি।
| বৈশেষিক দর্শন-০২ : বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব |
রণদীপম বসু
…
২.০ : বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব
.
ন্যায় দর্শনে যেমন প্রমাণের আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে, বৈশেষিক দর্শনে তেমনি ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্বের আলোচনাই গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্ববৈচিত্র্য তথা পার্থিব জগতকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বৈশেষিক সম্প্রদায় সাতটি পদার্থ স্বীকার করেছেন। এই সাতটি পদার্থ হলো- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব। জগতে এমন কিছু নেই যা এই সাতটি পদার্থের কোন না কোনটির অন্তর্গত নয়। সুতরাং, বিশ্বের মৌলিক তত্ত্ব হলো সাতটি।
.
এখানে উল্লেখ্য, বৈশেষিক সূত্রকার মহর্ষি কণাদ কিন্তু পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেননি। বৈশেষিক সূত্র-এ বলা হয়েছে-
‘দ্রব্যগুণকর্ম্মসামান্যবিশেষসমবায়নাং পদার্থানাং সাধর্ম্ম্যবৈধর্ম্ম্যাভ্যাং তত্ত্বজ্ঞাননিঃশ্রেয়সম।’ (বৈশেষিক সূত্র: ১/১/৪)।
অর্থাৎ : দ্রব্য-গুণ-কর্ম-সামান্য-বিশেষ-সমবায় পদার্থসমূহের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যের তত্ত্বজ্ঞান থেকেই নিঃশ্রেয়স লাভ হয়।
.
‘নিঃশ্রেয়স’
শব্দের অর্থ সবথেকে শ্রেয়। ভারতীয় দর্শনে পরামুক্তি বা মোক্ষই সবথেকে
শ্রেয়। তাই নিঃশ্রেয়স বলতে পরামুক্তি বা মোক্ষকেই বুঝতে হয়। অতএব, বৈশেষিক
দর্শনে মোক্ষলাভের নিমিত্তেই পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান আবশ্যক। এক্ষেত্রে
মহর্ষি কণাদ পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ না করলেও পরবর্তীকালে
ভাষ্যকার প্রশস্তপাদ কিন্তু নিঃশ্রেয়সের হেতু হিসেবে প্রথম ছ’টি পদার্থের
উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে অভাবের উল্লেখ নেই-
‘দ্রব্যগুণকর্ম্মসামান্যবিশেষসমবায়ানাং ষণ্নাং পদার্থানাং সাধর্ম্ম্য-বৈধর্ম্ম্যতত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সহেতুঃ। তচ্চেশ্বরচোদনানিভব্যক্তাদ্ধর্মাদেব।’ (প্রশস্তপাদভাষ্য)।
অর্থাৎ : দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায়- এই ছয়টি পদার্থের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যরূপ তত্ত্বের জ্ঞান নিঃশ্রেয়সের হেতু। এই নিঃশ্রেয়স কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছাবিশেষের দ্বারা অভিমুখীকৃত ধর্ম বা ঈশ্বর-উপদিষ্ট ধর্ম থেকেই হয়।
.
স্বভাবতই
প্রশ্ন উঠে সূত্রকার ও ভাষ্যকার কেন অভাব পদার্থের উল্লেখ করেননি। কণাদ
অভাবের ইঙ্গিত করেছেন, তবে অভাব স্বতন্ত্র পদার্থরূপে স্বীকৃত কিনা তা
উল্লেখ করেননি। বিভিন্ন বৈশেষিকাচার্য এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যাখ্যা
উপস্থাপন করেছেন। কিরণাবলীকার আচার্য উদয়ন বলেন-
‘অভাবস্তু স্বরূপবানপি পৃথঙনোদ্দিষ্টঃ প্রতিযোগিনিরূপণাধীননিরূপণত্বাৎ।’ (কিরণাবলী, পৃষ্ঠা-৫৭)।
অর্থাৎ : অভাব সৎ পদার্থ হলেও অভাবের নিরূপণ যেহেতু প্রতিযোগীর নিরূপণাধীন তাই তা পৃথকভাবে উল্লিখিত হয়নি।
.
‘প্রতিযোগী’
অর্থ অভাবপদার্থের মধ্যে যে পদার্থটির অভাব সেটিই অভাবপদার্থের প্রতিযোগী।
উদয়নের মতে কণাদের বৈশেষিক সূত্রের সৃষ্টি-সংহার প্রকরণে উৎপত্তি ও
বিনাশের ব্যাখ্যাতে প্রাগভাব ও প্রধ্বংসাভাব এবং বৈধর্ম্যের ব্যাখ্যাতে
অন্যোন্যাভাব ও অত্যন্তাভাব আলোচিত হয়েছে। সুতরাং অভাব পদার্থ যে বৈশেষিক
সম্মত তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে অভাবের নিরূপণ যেহেতু প্রতিযোগীর
নিরূপণাধীন তাই নিঃশ্রেয়সের হেতুর কথনে পদার্থের তালিকায় অভাবের স্বতন্ত্র
উল্লেখের প্রয়োজন হয়নি। আচার্য উদয়নই প্রথম অভাব সহ সাতটি বৈশেষিক পদার্থের
উল্লেখ করেন। শ্রীধর, শিবাদিত্য প্রমুখ পরবর্তী দার্শনিকেরাও সপ্তম
পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, বিশ্বের মৌলিক তত্ত্ব সাতটি।
তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্টও বৈশেষিকসম্মত পদার্থের বিভাগ দেখিয়েছেন-
‘দ্রব্যগুণকর্মসামান্যবিশেষসমবায়াভাবাঃ সপ্ত পদার্থাঃ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব- এই সাতটি পদার্থ।
.
এই
সাতটি মৌলিক তত্ত্বকেই বৈশেষিক দর্শনে ‘পদার্থ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
ন্যায়মতে পদার্থের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট না হলেও বৈশেষিক মতে পদার্থের সংখ্যা
সুনির্দিষ্ট এবং তা সাতটিই। এ থেকে বোঝা যায়, বৈশেষিক দর্শনে সাতের
অতিরিক্ত কোন পদার্থ নেই। এজন্যেই বৈশেষিক সম্প্রদায়কে নিয়ত পদার্থবাদী বলা
হয়। তাই বল্লভাচার্য তাঁর ‘ন্যায়লীলাবতী’ গ্রন্থে বলেন-
‘অনিয়তপদার্থবাদিনো নৈয়ায়িকাঃ
নিয়তপদার্থবাদিনশ্চ বৈশেষিকাঃ।’ (ন্যায়লীলাবতী)।
অর্থাৎ : নৈয়ায়িকরা অনিয়ত পদার্থবাদী, আর বৈশেষিকরা নিয়ত পদার্থবাদী।
.
সাধারণভাবে
পদার্থ বলতে যা বোঝায় বৈশেষিক দর্শনে ঠিক তা বোঝায় না। বৈশেষিক দর্শনে
পদার্থ কথাটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে পদের
অর্থ অর্থাৎ পদের দ্বারা যে বস্তুকে বোঝানো হয়, তাই পদার্থ। নব্য-নৈয়ায়িক
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘পদস্য অর্থঃ পদার্থঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)
অর্থাৎ : পদের অর্থকে (অভিধেয়) পদার্থ বলে।
.
জগতের
যে কোন বস্তুই পদের দ্বারা অভিহিত হতে পারে। আর ন্যায়-বৈশেষিক মতে যা
জ্ঞেয় তাই অভিধেয়। যাবতীয় অস্তিত্বশীল (কাল্পনিক নয়) বস্তুই জ্ঞেয়। জগতের
যাবতীয় বস্তুই যেহেতু জ্ঞেয়, সেহেতু যাবতীয় বস্তুই অভিধেয় (পদের দ্বারা
অভিহিত হতে পারে) অর্থাৎ পদার্থ। পদার্থ সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাতা ও জ্ঞান
নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল। পদার্থ যখন জ্ঞানে ভাসমান হয়, তখন তাকে
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে ‘বিষয়’ বলে।
.
দ্রব্য,
গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব- এই সপ্তপদার্থের মাধ্যমে
বৈশেষিক দর্শনে জগতের যাবতীয় পদার্থের সাতটি শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। এই সাতটি
শ্রেণীকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে প্রথম ছ’টিকে বলা হয় ‘ভাবপদার্থ’
এবং সপ্তমটিকে বলা হয় ‘অভাবপদার্থ’।
.
প্রসঙ্গত
উল্লেখ্য, ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পদার্থের সংখ্যা বিষয়ে
মতভেদ দেখা যায়। যেমন ন্যায়দর্শনে ষোলটি পদার্থ স্বীকার করা হয়- প্রমাণ,
প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ,
জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান। ভাট্ট মীমাংসক সম্প্রদায়
পাঁচটি পদার্থ স্বীকার করেন, যথা- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব।
আবার প্রাভাকর মীমাংসক মতে পদার্থ আটটি, যথা- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য,
সংখ্যা, সমবায়, সাদৃশ্য এবং শক্তি। অন্যদিকে বেদান্ত মতে ভাট্ট মীমাংসকদের
অনুরূপ পদার্থ পাঁচটি, যথা- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব। আবার
পদার্থ বিষয়ে নৈয়ায়িকদের মধ্যেও মতভেদ দেখা যায়। যেমন, নব্যনৈয়ায়িক রঘুনাথ
শিরোমণি বিশেষকে পদার্থরূপে স্বীকার করেননি।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব: ভূমিকা] [*] [পরের পর্ব: দ্রব্য-পদার্থ]
…
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব: ভূমিকা] [*] [পরের পর্ব: দ্রব্য-পদার্থ]
…
No comments:
Post a Comment