সমতলে বক্ররেখা-০৪
মুখ ও মুখোশ এবং আমাদের মুখরতা
রণদীপম বসু
…
(১)
ভার্চুয়াল
একজনের সাথে আলাপ হচ্ছিলো ফেসবুক চ্যাটে। অবশ্য এটাকে আলাপ না বলে
দৃশ্যমান সংলাপ বিনিময় বলাই শ্রেয়। অন্তর্জালিক যুগের হাল আমলের ভৌতিক আলাপ
বললেও অত্যুক্তি হবে না ! কারণ ওপাশে যিনি আছেন তাঁকে কখনো কোথাও দেখেছি কিনা সেটাই জানি না যেহেতু, তাই তিনি আদৌ আমার পরিচিত কিনা সে প্রশ্নও অবান্তর। যেটুকু চেনার সূত্র, সেখানেও তাঁর পরিচয় একটা বানোয়াট ছদ্ম নিক-নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেউ যদি এটাকে বলেন মুখোশের সাথে কথোপকথন, তাও সই। কেননা, শেষপর্যন্ত আমরা তো মুখোশই। ইন্টারনেট প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য গতি-প্রকৃতি
আমাদেরকে সেদিকেই ধাবিত করছে বলেই মনে হয়। জানতে বা অজান্তে আমরা একেকটা
ভার্চুয়াল মুখোশে পরিণত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সেটুকু ভাবার ফুরসত আমরা করে
ওঠতে পারছি কিনা, সেটা ভাবার বিষয় বৈ কি।
.
অবশ্য এখানে প্রশ্ন হতে পারে, এই প্রযুক্তি-যুগের আগে আমরা কি তাহলে মুখোশধারী ছিলাম না ? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। এবং বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্যণীয় যে, এই সভ্য-ভব্য আমরা কবে কোন্ কালে কখন যে মুখোশহীন ছিলাম সেটাই খুঁজে পাওয়া ভার ! আদৌ কি কখনো মুখোশহীন ছিলাম আমরা ? নিজেকে প্রতারিত না করলে বলতেই হবে, আমরা
আসলে কখনোই মুখোশহীন ছিলাম না। পাপ শব্দটি প্রকৃতই কোন অর্থ বহন করে কিনা
আমার জানা নেই। তবু শব্দ বা বাক্যের অলঙ্কার হিসেবে নিষ্পাপ শব্দটির
ব্যবহার অর্থহীন মনে হয় না একমাত্র শিশুদেরকে বিশেষায়িত করার ক্ষেত্রে। এবং
আমার ধারণা, আমরা নিজেরা ভালো-মন্দ যাই হই, শিশু যে নিষ্পাপ এ বিষয়টাতে সহমত পোষণ করতে নিশ্চয়ই আমাদের কারো আপত্তি থাকবে না। তাহলে প্রশ্ন, শিশু কেন নিষ্পাপ ?
.
শিশু কেন নিষ্পাপ, এমন বালখিল্য প্রশ্নে বিদগ্ধ পাঠক যতোই বিরক্ত হোন না কেন, আমাকে কিন্তু এই প্রশ্নটি করতেই হবে এজন্যেই যে, কোন শিশু এ প্রশ্নটি করতে পারে না। আর এ প্রশ্ন করাটা যখন শিখে যায়, তখন সে আর নিষ্পাপ থাকে না, ফলে শিশুও থাকে না। কেন থাকে না ? কারণ, সুশৃঙ্খল সামাজিক জীব আমরা তার শৈশব নামধারী নিষ্পাপত্বটুকু কেড়ে নিই। কীভাবে ? প্রচলিত সমাজের নিয়মে তাকে আমরা চলনসই সভ্য-সংস্কৃত করে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হই। অর্থাৎ তার এই সভ্য হয়ে ওঠার আগের যে অসভ্য অবস্থা বা পর্যায়, সেটাই তার শৈশব। কী সেই অসভ্যতা ? এই অসভ্যতা আর কিছুই নয়, একটি শিশু তার সহজাত স্বভাবের কারণেই কোনরূপ শারীরিক বা মানসিক উদ্দীপনা ঢেকে রাখতে পারে না। সে যা করতে চায় তাই করে, যা
বলতে চায় তাই সে বলে। এটাই তার সত্যনিষ্ঠ স্বতঃস্ফূর্ততা। এই নির্বাধ
স্বতঃস্ফূর্ততাই শৈশবের সম্পদ। তাহলে কেন আমরা শিশুকে নিষ্পাপ না বলে অসভ্য
বলি না ? কারণ, প্রচলিত সমাজ যেটুকু স্বতঃস্ফূর্ততার স্বীকৃতি বা অনুমোদন দেয়, সেটুকুর
বৈধতাই নিষ্পাপত্ব। এই নিষ্পাপত্বের কারণেই স্বভাবনিষ্ঠ শিশু সর্বোচ্চ
ক্ষমতাবান রাজাকেও নির্দ্বিধায় নেংটা বলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কারণ তার
সত্যনিষ্ঠতায় ক্ষমতা বা কুণ্ঠা নামের কোন আরোপিত শব্দের জন্ম হয়নি তখনো। এই
অনুমোদনকৃত সত্যনিষ্ঠতাকে আমরা তাই অসভ্যতা বলি না। অসভ্যতা হবে সেটাই, যে সত্যনিষ্ঠতাকে এই কর্তৃত্ববাদী সমাজ অনুমোদন করে না। অর্থাৎ, সমাজের দৃষ্টিতে যা অসভ্যতা, তার সাথে সত্যনিষ্ঠতার একটা মজাদার সমানুপাতিক সম্পর্ক রচিত হয়ে আছে। অথচ আমরা কিন্তু উল্টো প্রচার শুনেই অভ্যস্ত।
.
সমাজ তার নিজস্ব নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনেই কিছু বাধ্যতামূলক রীতি-নীতির
প্রচলন করে থাকে। এর মাধ্যমে সমাজের সদস্য হিসেবে একজন মানুষের
স্বতঃস্ফূর্ত সত্যনিষ্ঠতারও একটা সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যাকে আমরা ইতোমধ্যেই শৈশব বলে চিহ্নিত করেছি, যে শৈশব নির্দোষ স্পষ্টবাদী, কোনকিছু ঢেকে রাখতে জানে না, বা তার ক্ষমতাও নেই। কালোকে সে কালোই বলবে, সাদাকে সাদা। এর ব্যতিক্রম করতে বললেও সে মানবে না কিছুই, শিশুসুলভ প্রতিবাদী হবে। বয়ঃক্রমের যে পর্যায় থেকে তার বিচারবোধ জাগ্রত হতে শুরু করে, তখনই শুরু হয় তার সমাজ অনুমোদিত শিক্ষা গ্রহণের কাল। প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতিতে যাকে বলা হতো ব্রহ্মচর্য। এ শিক্ষা আর কিছু নয়, নিজের
সহজাত সত্যনিষ্ঠ অসভ্যতাকে ঢেকে রাখার কৌশল রপ্ত করে করে নিজেকে প্রচলিত
সমাজের যোগ্য করে গড়ে তোলার পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া কেবল। সত্য যেহেতু
অনির্বাণ, মুছে ফেলা যায় না, তাই
বাধ্য হয়েই একে ঢেকে রাখতে হয়। এ পর্যায়ে তার প্রথম পাঠই হলো তার
সত্যনিষ্ঠ অস্তিত্বকে একটি লজ্জাপিণ্ড অসভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করে দেয়া। আর
এই সত্য বা লজ্জাকে ঢেকে রাখাই হলো চলমান সামাজিক সভ্যতা।
.
কোন কিছু ঢেকে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় আবরণের। সামাজিক মানুষ যেহেতু যুগপৎ দুটো অস্তিত্ব বা সত্তার সমষ্টি- একটি শারীরিক, অন্যটি মানসিক, তাই তাকে ঢেকে রাখার জন্যেও প্রয়োজন হয় দুটো আবরণের। দৈহিক সত্যকে ঢেকে রাখার জন্য তাকে দেয়া হয় বস্ত্রের আবরণ, যার
বস্তুগত মূর্ত রূপ হচ্ছে বাহারি পোশাক। আর তার সহজাত সত্যবাদী মানসিক
অস্তিত্বকে ঢেকে রাখার জন্য দেয়া হয় শিক্ষার আবরণ। ব্যক্তির মানসিক জগৎ
যেহেতু বিমূর্ত, তাই তার আবরণও হয় বিমূর্ত। যা সামাজিক মুখোশ হয়ে এটে থাকে আমাদের চলমান অস্তিত্ব জুড়ে। অর্থাৎ শিক্ষা হলো আমাদের সেই সামাজিক মুখোশ, যা দিয়ে আমরা আমাদের সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সত্তা বা অস্তিত্বটা গোপন করে একটা মেকি সাজানো রূপ-সত্তা নিয়ে আরেকজন সেইরূপ মানুষের সাথে সামাজিক সংযোগ রক্ষা করি। অতএব আমরা সামাজিক মানুষেরা যখন থেকে নিজেদের সভ্য বলে দাবী করি, তখন থেকেই আমরা যে আসলে মুখোশধারীই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত সামাজিক মানুষ মানেই একেকটা মেকি মানুষ।
.
ভাবতে কি খুব আশ্চর্যের মনে হয়, চলতি পথে আচমকা যে পরিচিত লোকটির সাথে দেখা হয়ে গেলো এবং যথারীতি কুশল বিনিময়ও হলো, এই চমৎকার সামাজিক মানুষটি আসলে সেই আসল মানুষটি নন যাকে দেখছি ! একইভাবে বাইরের আমাকে যিনি দেখছেন, সেটাও প্রকৃত আমি নই। আসল আমাকে আমি লুকিয়ে রেখেছি ঢেকে রেখেছি সভ্য-সামাজিকতার নিয়মে। কোন বিপনি-বিতানে বা কর্পোরেট অফিসের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে গেলেই যে সুন্দর মুখের সুবেশী তরুণীটি অসম্ভব আন্তরিকতা নিয়ে সহায়তায় এগিয়ে আসছেন, তিনি যে আসল তিনি নন, কেবলি যান্ত্রিক দায়িত্বের দায়বদ্ধতায় বাঁধা পড়া এক অসহায় মানুষ, ভাবতেই কষ্ট হয়। তাই বলে এই মুখোশপরা সামাজিকতা যে অর্থহীন, এ
লেখার বক্তব্য অবশ্যই তা নয়। এই বাধ্যগত সামাজিক শৃঙ্খলাটুকু আরোপ করা না
হলেও এ সমাজ হয়তো মানুষের বাসযোগ্যই থাকবে না। কেননা কথার কথা, আকর্ষণীয়
যে রমণীটির সাথে উপরে উপরে চমৎকার মহাপুরুষসুলভ ব্যবহার দেখিয়েও ভেতরের
অশ্লীল ভোগী মানুষটি তলে তলে কল্পনার অবাধ্য অবদমিত কামনায় পিষ্ট করে তাকে
গোটা গিলে খাচ্ছি, সামাজিক আইন ও শৃঙ্খলের জোয়ালটা চাপানো না হলে ওই দ্বিতীয় কার্যটিই যে সত্য হয়ে ঊঠার সম্ভাবনা আশঙ্কাজনকভাবে প্রবল হয়ে ঊঠবে, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টালে হরহামেশা এরকম জাজ্জ্বল্যমান নমুনার অভাব হয় না। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের আলোচনার প্রেক্ষিত এটা নয়।
.
এই যে মুখোশের কথা বলা হচ্ছে, এই মুখোশেরও একটা বিশেষত্ব আছে। কী সেটা ? তা হলো, মুখোশটি বিমূর্ত বলে তাকে আমরা দেখি না, হয়তো
উপলব্ধি করি। আর মুখোশের বিমূর্ততার কারণে আমরা কিন্তু সেই
ব্যক্তিমানুষটিকেই বাস্তবে প্রত্যক্ষ করি। ফলে মুখোশধারী হলেও মুখোশ
বহনকারী ব্যক্তিমানুষটির অস্তিত্ব লোপ পায় না কখনোই। চাইলেই কেউ তার
অস্তিত্ববান শরীরটাকে পাল্টে আরেকটা নতুন শরীর ধারণ করতে পারে না বলে
ভেতরের বিমূর্ত সত্য সত্তাটি অন্যের প্রত্যক্ষণের অন্তরালে থাকলেও চিহ্নায়ক
হিসেবে তার শারীরিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে না সে। এই শরীরই তার
পরিচিতি বহন করে। অর্থাৎ, আমরা ব্যক্তির শরীর দেখি, যদিও তার মুখোশ দেখি না।
.
কিন্তু আমাদের বর্তমান শনৈ শনৈ প্রযুক্তির অবদানে ভার্চুয়াল মুখোশের বিষয়টা একেবারেই তার উল্টো। কেননা, এখানে আমরা কেবল মুখোশটাই দেখি, তার পেছনের ব্যক্তিটা আসলে নেই। কেন নেই, সে প্রশ্নে পরে আসি। এবং ভয়ঙ্কর আশঙ্কার কথা হলো, যে মুখোশটিকে আমরা দেখি, সেটিও
একেকটি হাওয়াই মুখোশ। কারণ এই মুখোশটি ভার্চুয়াল। অর্থাৎ যে কোন সময় তা
বিলীন হয়ে অনায়াসে আরেকটি মুখোশ হয়ে ফিরে আসতে পারে। যাকে বলা চলে অলীক
মানুষ, কল্পনায় আছে বাস্তবে নেই। তবে কি আমরা স্বেচ্ছাক্রমেই পুরনো মেকি মানুষ থেকে আধুনিক অলীক মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছি ! বিষয়টা ভাবনার বৈ কি।
.
অতএব পুরনো প্রশ্নে ফিরে যাই আবার, যেখান থেকে এই বিষয়-বিস্তৃতির সূত্রপাত। ইন্টারনেট প্রযুক্তির সাই-সাই উন্নতির কালে এসে আমরা যে ক্রমেই কেবল এক ভার্চুয়াল মুখোশে অর্থাৎ অলীক মানুষে পরিণত হতে যাচ্ছি, তাতে সমস্যাটা কোথায় ? জানি না এ প্রশ্নটাকে কে কতোটা গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন, তবে একটু খেয়াল করলেই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই ঝোঁকের স্রোতে নিজেদের ভাসান যাত্রায় অভ্যস্ত হতে গিয়ে আমরা আসলে গভীর এক অস্তিত্ব-সংকটের দিকেই ধাবিত হচ্ছি। হয়তো এ সংকট প্রথমে একান্তই ব্যক্তি পর্যায়ে সীমিত বলেই মনে হবে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে তার সামাজিক ও জাতীয় সংকটে রূপান্তর হওয়াটা যে সময়ের ব্যাপার হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে ! কেননা ব্যক্তির প্রভাব সমাজ বা রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না।
.(২)
দর্শনশাস্ত্রে সর্বজনবিদিত যে কার্য-কারণ তত্ত্বের কথাটা আমরা জানি সেখানে বলাই হয়েছে, প্রতিটি কার্যের পেছনেই কোন-না-কোন কারণ অবশ্যই রয়েছে। আমাদের প্রকৃতিলব্ধ সাধারণ জ্ঞানেও তাই বলে। এই সাধারণ জ্ঞানকে পুঁজি ধরলে আমরা এক বাক্যেই বলে দিতে পারি, আমরা মুখোশ কেন পরি ? নিজেকে বা নিজের পরিচয় ঢেকে রাখতে। অর্থাৎ মুখোশের কাজ হলো প্রকৃত স্বরূপ ঢেকে রাখা। খুবই সত্য কথা। কিন্তু সাধারণ-জ্ঞান আর দর্শন-জ্ঞানের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ফারাকও আছে। কী সেটা ? সাধারণ জ্ঞান হলো আমাদের স্থূল ইন্দ্রিয় কর্তৃক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ স্থূল পর্যায়ের জ্ঞান। অন্যদিকে দর্শন-জ্ঞান হলো প্রকৃতি বা সৃষ্টি-রহস্যের উৎস সন্ধানী চিন্তালব্ধ সূক্ষ্ম জ্ঞান। দর্শন-জ্ঞানে বস্তুগত অভিজ্ঞতার স্থূল ছাপ না থাকতে পারে, কিন্তু এতে থাকে রহস্য-সন্ধানী চিন্তাসূত্র। সাধারণজ্ঞানে কাজ বলতে আমরা যা বুঝি, দর্শনের
ভাষায় সেটাকে বলা হয় বৃত্তি। মুখ বা স্বরূপ ঢেকে রাখা হলো মুখোশের বৃত্তি।
কিন্তু ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে কার্য শব্দটির অর্থ আরো অনেক গভীর ও
বিশ্লেষণধর্মী। সেখানে কার্য বলতে উৎপত্তি বা উৎপন্ন বস্তুকে বোঝায়। এই জগৎ
যেমন একটি কার্য। অর্থাৎ মুখোশ বস্তুটি দর্শনের দৃষ্টিতে একটি কার্য মাত্র, যার পেছনে অবশ্যই কোন কারণ রয়েছে।
.
ভারতীয় বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ে এই কার্য-কারণতত্ত্ব নিয়ে বিস্তর পাল্টাপাল্টি রয়েছে। ধান ভানতে শিবের গীতের মতো এই দর্শনালাপে ঢুকে যাওয়ায় পাঠকের ভড়কে যাবার কারণ নেই। কেননা, দর্শনের
জটিল বিভ্রমে ঢুকে পথ হারানোর অভিপ্রায় এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আধুনিক
বিজ্ঞান সৃষ্টির অনেক অজানা রহস্যই উন্মোচন করে দেয়ায় দর্শনের বিশ্রম্ভালাপ
অনেক ক্ষেত্রেই নিতান্ত পানসে মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান অন্বেষণে
চিন্তা বা যুক্তির অপূর্ব শৃঙ্খলা অর্জনে মননচর্চার উৎস মাধ্যম হিসেবে
দর্শনচর্চা এখনো অবিকল্প বলেই মনে হয়। তাত্ত্বিক বিজ্ঞান চর্চাও তাই
প্রকারান্তরে দর্শনেরই চর্চা। সে যাক, আমাদের বর্তমান বিষয় বিশ্লেষণেও নাহয় কিঞ্চিৎ দর্শন চর্চা করেই ফেললাম, হা হা হা ! তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা আবশ্যক যে, ভারতীয় দর্শনের মতো পাশ্চাত্য দর্শনেও কিন্তু কার্য-কারণতত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল প্রপঞ্চ। এই কার্য-কারণ রহস্য সন্ধান এড়িয়ে দর্শন চর্চা কেন, বিজ্ঞান চর্চাও আদতে সম্ভব নয়।
.
প্রাচীন
ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন প্রস্থানে কার্য বা এর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্কের
অবকাশ খুব কমই। যতো গ্যাঞ্জাম সবই ওই কারণের মধ্যে। এই গ্যাঞ্জামের
ডামাডোলে পড়ে যুক্তি-তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে প্রায় সবগুলো দর্শন এ বিষয়ে ডালপালা বাদ দিলে প্রধানত দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল হলেন সৎকার্যবাদী, যার প্রধান প্রবক্তা সাংখ্য দার্শনিকরা। আর অন্যদল হলেন অসৎকার্যবাদী, যার প্রধান প্রবক্তা ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকরা। দার্শনিক পরিভাষায় সৎ শব্দটির নিকটতম অর্থ হলো অস্তিত্ববান। যারা মনে করেন, কার্য উৎপন্নের পূর্বে তা কারণে সৎ বা অস্তিত্বশীল থাকে, তারা
সৎকার্যবাদী। তিল থেকে তেল হয়। তাদের মতে ব্যক্ত কার্য বা উৎপন্ন বস্তু
তেল তার কারণ তিলের মধ্যেও অব্যক্তরূপে সৎ বা অস্তিত্বশীল থাকে। অর্থাৎ
কারণ ও তার কার্য প্রকারান্তরে অভিন্ন। অন্যদিকে অসৎকার্যবাদীদের মতে, কার্য সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি। অর্থাৎ কারণ ও তার কার্য ভিন্ন, ফলে
কার্য তার কারণে অসৎ। এই মতে তিল ও তেল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। কেননা
তাদের আকৃতি প্রকৃতি উদ্দেশ্য স্বভাব ইত্যাদি সবকিছুই ভিন্ন। তাহলে প্রশ্ন, বালি থেকে বা অন্য যেকোন বস্তু থেকে কেন তেল উৎপন্ন হয় না ? তিল থেকেই কেন তেল হতে হবে ? এর উত্তর হলো, যে কারণের মধ্যে যে কার্যের প্রাগভাব থাকে, সেই কারণ থেকেই কার্যটি উৎপন্ন হবে। প্রাগভাব মানে প্রাক্ অভাব। বালির মধ্যে তেলের কোন প্রাগভাব নেই, তা আছে তিলের মধ্যেই। তাই বালি থেকে নয়, তিল থেকেই তেল হয়। এভাবেই জগতের সকল কার্য-কারণকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁরা।
.
প্রতিটা দর্শনের জটিল জটিল সব সিদ্ধান্তগুলোর পেছনেই এই কার্য-কারণতত্ত্বের
অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। তাই আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে বা জ্ঞানে কার্যের
সাথে কারণের সম্পর্কের এই দার্শনিক ভিন্নতাগুলো তেমন জটিল বিভাজন মনে না
হলেও এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে যুক্তি বিস্তারের যে প্রাবল্য দেখা
যায় তার গূঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে নিশ্চয়ই। তা হলো এই জগৎসৃষ্টিতত্ত্বের নিজ নিজ
দার্শনিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন। কিন্তু আমাদের বর্তমান উদ্দেশ্য তা নয়। আমাদের
এখনকার উদ্দেশ্য হলো মূর্ত বা বিমূর্ত মুখোশ নামক কোন বস্তু বা ধারণার
কারণ অন্বেষণ।
.
তবে আমাদের দর্শনগুলোর মধ্যে যত ভিন্নতাই থাকুক না কেন, তারা প্রত্যেকেই কিন্তু স্বীকার করেন যে, কারণের মধ্যে কার্য সৎ বা অসৎ যাই হোক, প্রতিটা কার্যের পেছনে দুটো উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে, উপাদান কারণ ও নিমিত্ত কারণ। একটি কার্য হিসেবে যে ঘট বা মৃৎপাত্রটিকে দেখছি, তার উপাদান কারণ হলো মাটি বা মৃত্তিকা, আর নিমিত্ত কারণ হলো কুম্ভকার, অলাতচক্র, আগুন, পানি ইত্যাদি। যে উপাদান দিয়ে যে বস্তুটি তৈরি, সেই কার্য-বস্তুর জন্য সেই উপাদান কারণ তো থাকতেই হবে। কিন্তু উপাদান কারণ থাকলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যবস্তুটি উৎপন্ন হবে না, তার
জন্য নিমিত্তকারণও থাকতে হবে। নইলে এ জগতে কার্য উৎপন্ন হবার মতো প্রচুর
উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। নিমিত্তকারণের প্রয়োজন না হলে সবকিছুই
স্বয়ম্ভু হয়ে যেতো, একটা অরাজকতার সৃষ্টি হতো। বাস্তবে তা হয় না।
.
একইভাবে আমাদের আলোচনায় মূল কার্যবস্তু হিসেবে যে বিমূর্ত মুখোশের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছি, তার উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধান করলে কী খুঁজে পাই আমরা ? যেহেতু মুখোশটি ভার্চুয়াল অর্থাৎ সৎ মানে অস্তিত্বশীল ও বিমূর্ত, তাই এর কারণগুলোও মূর্ত বা বিমূর্ত যেকোনটাই হতে পারে। যদি এর নিমিত্ত কারণ হিসেবে সার্বিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তিকে বিবেচনা করি, তাহলে এর উপাদান কারণ বর্তাবে আমাদের মানসিক জগতের সেই উদ্দীপনের ঘাড়ে, যার
মধ্যে অব্যক্ত অভিন্নতায় কিংবা প্রাগভাব হিসেবে এই মুখোশবৃত্তিটি লুকিয়ে
আছে। অর্থাৎ আমরা এখন যে ভার্চুয়াল মুখোশটিকেই আমাদের অভিন্ন অস্তিত্ব
বানিয়ে ফেলছি, তার অভিব্যক্তি আসলে আগেই আমরা আমাদের মনোজগতে ধারণ করে আছি।
.
অভিব্যক্তি
হচ্ছে বাস্তবতার ছায়াচিত্র। ভবিতব্যের অব্যবহিত পূর্বে হলেও বাস্তবতার
অণুকল্প ব্যক্তির অভিব্যক্তিতে আঁকা হয়ে যায়। একজন খুনি কিন্তু খুন করার
আগেই খুনিতে রূপান্তরিত হয়। নইলে খুন সংঘটিত হতে পারে না। সে যে খুনি, তার প্রমাণ হিসেবে খুনকার্যটি বস্তুনিষ্ঠতা অর্জন করে। যেমন, চৌর্যবৃত্তি
সংঘটনের আগেই কর্তাব্যক্তিটি চোরে রূপান্তরিত হয়। এরপরই এই কর্তার কৃত
চৌর্যকর্ম ঘটে। কিন্তু চুরি করবে এই নিমিত্তে কেন একজন ব্যক্তি চোরে
রূপান্তরিত হয়, তার কারণ খুঁজতে হলে আবার ভিন্ন কার্য-কারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনোজাগতিক, সমাজতাত্ত্বিক
ইত্যাদি বহুবিধ অনুঘটকের আগমন ঘটতে পারে। এভাবে কেন একজন ব্যক্তি নিজেকে
একজন অলীক মানুষ বা ভার্চুয়াল মুখোশে রূপান্তর করেন, তার
পেছনেও ব্যক্তির চেতনে বা অবচেতনে এরকম হাজারও কারণ নিমিত্ত হিসেবে থাকতে
পারে। কিন্তু খুনি বা চোরে রূপান্তর ঘটা অগ্রবর্তী বিমূর্ত কারণ হলেও খুন
চুরি ইত্যাদি পরবর্তী মূর্ত কর্ম সংঘটিত হবার পরেই যেমন পরম্পরাগতভাবে
দৃশ্যমান ব্যক্তিক বা সামাজিক বহু সমস্যার সূত্রপাত ঘটে, তেমনি আবার খুনি বা চোরে রূপান্তর ক্রিয়াই পরবর্তী ঘটনা ও সমস্যাগুলিকে অনিবার্য করে তোলে। কেননা, দর্শনশাস্ত্র মতেই, কার্য
উৎপন্ন করার শক্তিই কারণকে কার্য উৎপাদনে সক্রিয় করে তোলে। ফলে একইভাবে
একজন ব্যক্তি যেকোন কারণেই একজন অলীক মানুষ বা ভার্চুয়াল মুখোশে রূপান্তর
হলে তার অনিবার্য মুখোশবৃত্তিই পরবর্তী বহুবিধ সমস্যার উৎস ও কারণ হয়ে ওঠে।
আমাদের বক্ষ্যমান আলোচনা-বিন্দু মূলত এটাই।
.(৩)
যে ভার্চুয়াল আলাপের সূত্র ধরে লেখাটার সূত্রপাত, কথা প্রসঙ্গে ওই ভার্চুয়াল মুখোশের কাছে আমার বক্তব্য ছিলো,- আপনার প্রকৃত পরিচয় আমি জানতে চাইবো না, কারণ নিজেকে সেভাবে প্রকাশে আগ্রহী হলে আপনি এই মুখোশ ধারণ করতেন না।
.
আমার কথায় তাঁর অনাপত্তিই প্রকাশ পেলো। সম্মত ভঙ্গিতেই বললেন, আসলে স্বনামে ব্লগিং বা সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায় অনেক সমস্যা আছে।
কী সমস্যা, তাঁর
কাছ থেকে তা নতুন করে জানার আর আগ্রহ হলো না আমার। কেননা নিজ সত্তার উপর
দায় নিয়ে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখানোর ক্ষমতা তিনি ওই মুখোশের মধ্যেই
হারিয়ে ফেলেছেন। যার ভিত্তিটাই হাওয়াই, সে কী করে দায় বহন করবে ! আর যে নিজে দায় বহন করতে পারে না, অন্যকে কোন কৃতকর্মের জন্যে দায়ী করার নৈতিক অধিকারও সে রাখে না। আমি শুধু বললাম, আপনি যদি এই হাওয়াই মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন, আপনার সমস্ত কাজই বৃথা অসার হবে, কারণ আপনি নিজেই নিজের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলেছেন।
.
সাথে সাথেই তাঁর তীব্র আপত্তি ভেসে এলো- কেন, আমি তো মানুষকে সচেতন করাচ্ছি, নতুন নতুন বিষয়ের আলোচনা টেনে অন্যদেরকে আগ্রহী করে তুলছি !
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমরা বিষয়টি পাচ্ছি ঠিকই, কারণ বিষয়টি তো আর আপনার মতো হাওয়াই না। বিষয়ের বাস্তব অস্তিত্ব থাকে, ভিত্তি থাকে কিংবা এর প্রভাব প্রতিক্রিয়ার কার্যকর ফলাফলও থাকে এবং তা গ্রহণ-বর্জনেরও একটা অর্থময়তা থাকে। কিন্তু সেখানে আপনি নেই।
কেন ? আবারো তাঁর প্রশ্ন। বললাম, আপনি তো বিষয়টা ছুঁড়ে দিয়েই খালাশ ! যদি এর ভালো-মন্দ দায় নেয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা থাকতো, তাহলে তো আপনি মুখোশের আশ্রয় নিতেন না !
এবার আপত্তিটা আরো জোরালো, কেন, এটাই আমার পরিচয় !
আমি বললাম, না, তা
হতে পারে না। মুখ আর মুখোশ এক নয়। মুখ হলো ব্যক্তির অস্তিত্বের স্বাক্ষর।
যা চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে ফেলা যায় না। স্থান কাল অবস্থা ভেদে
ব্যক্তির মুখ অপরিবর্তনীয় বলে ব্যক্তির পরিচিতির চিহ্নায়ক এই মুখই। এবং তাই
এই মুখ যখন যা বলে বা করে তা সমস্ত দায় নিয়েই করে। আর এই মুখকে গোপন করার
উদ্দেশ্যমূলক প্রক্রিয়া বা বৃত্তির মাধ্যম হলো মুখোশ। যা মুহূর্তেই পাল্টে
ফেলা যায় বলে তা কোন দায় নিতে পারে না। তাই মুখোশ হলো দায়িত্বহীনতা আর
দুরভিসন্ধিত্বের প্রতীক। যিনি তা ধারণ করেন, তিনি এসব জেনে-বুঝেই নিজেকে গোপন করতেই করেন। এই মুখোশ কোন কাজের দায় নিতে পারে না বলে যদি তার দ্বারা ভালো কিছুও সংঘটিত হয়, সেই ভালো কাজগুলোও শেষপর্যন্ত বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে।
.
সর্বক্ষেত্রে
যে আদি ও অকৃত্রিম মুখই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে পারবে এমন নয়। অনেক
ক্ষেত্রে তা সম্ভবও নয়। সেক্ষেত্রে এই মুখেরই প্রতিনিধিত্ব করে তার সামাজিক
দায়বদ্ধতায় জড়ানো আপাত অপরিবর্তনীয় নামটি। এই প্রতিনিধিত্ব আসলে উভয়বিধই
হয়। এক জায়গায় যে মুখের প্রতিনিধিত্ব করে তার নাম, অন্যত্র আবার সেই নামের প্রতিনিধিত্ব করে তার অবিচ্ছেদ্য মুখটি। নাম আর মুখের এই যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, অর্থাৎ একটিকে ছাড়া অন্যটি অস্তিত্বহীন, ভারতীয় দর্শনে এই সম্বন্ধকেই বলা হয় সমবায়-সম্বন্ধ। কোন কোন দর্শনে বলে তাদাত্ম্য-সম্বন্ধ।
অর্থাৎ একটি ছাড়া অন্যটি থাকতে পারে না বা একটি থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন
করা যায় না। অন্যদিকে মুখ ও মুখোশের সম্পর্ক হলো দর্শনের পরিভাষায় সংযোগ-সম্বন্ধ। এই আছে, যা একটু পরে নাও থাকতে পারে। গাছের ডালে একটি পাখি এসে বসলো মানে পাখি ও গাছের সাথে একটা সংযোগ-সম্বন্ধ তৈরি হলো। আবার পাখিটি উড়াল দিলো মানে সম্বন্ধটি নষ্ট হয়ে গেলো।
.
এখানে হয়তো এরকম একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, যে মুখোশ নিয়ে এতো কথাবার্তা, সেটা তো আমার একটা স্থায়ী পরিচয়ও হতে পারে ! তাহলে আর সমস্যা কোথায় ?
এক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার কথা নয় যদি এই স্থায়ী পরিচয়টি বাস্তবিকই স্থায়িত্ব পায়। কেননা, যেকোন কারণে আমার আদি ও অকৃত্রিম মুখ বা চেহারাটি যদি কোন প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে পরিবর্তন করেই ফেলি, সেক্ষেত্রে
এই নতুন মুখ বা চেহারাটিই আমার অবিচ্ছেদ্য পরিচিতির স্বাক্ষর বহন করবে।
আগের মুখ বা চেহারাটিকে সত্যি সত্যি অন্তরালে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে বলে আমার
প্রতিনিধিত্বকারী নতুন মুখটিই সেই স্থান দখল করবে। ফলে এখন দায়-দায়িত্বের
ভার নিতে হবে নতুন পরিচয়কেই। এর মাধ্যমে আগের পরিচয়টি মুছে গিয়েছে বলে
নতুনটিকে মুখোশ বলা যাবে না ব্যক্তির অস্তিত্ব বা সত্তার সাথে তার
অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কারণেই। কিন্তু ব্যক্তির সর্বাবস্থার
প্রতিনিধিত্বকারিত্বে অভিন্ন অবিচ্ছেদ্যতায় কোন ফাঁক থেকে গেলে সেটি আর মুখ
হবে না, মুখোশই রয়ে যাবে শেষপর্যন্ত।
.
মুখ
ও মুখোশের এই মৌলিক বৃত্তি ও ভিন্নতাগুলো অনুধাবন করা গেলেই এর ব্যবহার ও
উদ্দেশ্য সম্পর্কেও এর বাস্তব অনুমিতিগুলোর একটা সম্ভাব্য রূপরেখা আমরা
ধারণা করে নিতে পারি।
.(৪)
ইতঃপূর্বেই বিষয়টা উল্লেখ করা হলেও আবারো কিঞ্চিৎ দ্বিরুক্তি করতে হচ্ছে এই বলে যে, আমাদের
লক্ষ্য উদ্দেশ্য বা ঘটিতব্য কর্মকাণ্ডের একটা অণুকল্প অভিব্যক্তি আগেভাগেই
আমাদের মনোজগতে আঁকা হয়ে যায় বা নিজেরাই তৈরি করে ফেলি আমরা, তা ভালো হোক কি মন্দ হোক। অর্থাৎ, আমাদের
পরবর্তী মুখরতাগুলো মুখ না মুখোশের হবে সেটা আগেভাগেই নির্ধারণ করে ফেলছি
আমরা নিজেরাই। মুখের স্বরূপে আবির্ভূত হলে তো আর কথাই নেই, সবরকম দায়-দায়িত্ব নিয়েই হয় মুখের আবির্ভাব। কিন্তু মুখ না হয়ে যদি মুখোশটাই বিবেচ্য হয়, তখন আর মুখোশবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো এড়ানোর কোন উপায়ই অবশিষ্ট থাকে না। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলিও হয় নেতিবাচকই। এর কিছু ধারণা বা আপাত সিদ্ধান্ত আমরা মনে হয় এ আলোচনায় ইতোমধ্যে তৈরি করেও ফেলেছি।
.
প্রথমত, মুখোশের আবির্ভাবই তার কার্য-কারণ সম্পর্কের মাধ্যমে বলে দেয়, মুখকে গোপন করতেই এই মুখোশের আবির্ভাব। মুখ গোপন করে কে ? যে তার পরিচয় প্রকাশ করতে অনাগ্রহী। কেন ? কারণ তিনি তার কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব নিতে অক্ষম। কেন অক্ষম ? এ প্রশ্নের একাধিক উত্তর হতে পারে। হয় তিনি ভীতু, দুর্বল, আত্মবিশ্বাসহীন, অযোগ্য, অপরাধপ্রবণ, ভণ্ড, কিংবা
ইত্যাদি ইত্যাদি সবকটিই। এগুলো আবার একে অন্যের সাথে সম্পর্কহীন নয়। তবে এ
সবগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে ব্যক্তির মনোজাগতিক হীনম্মণ্যবোধ বা হীনম্মণ্যতা।
.
যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি প্রত্যক্ষভাবে সংঘটিত করার সৎ-সাহস থাকে না, নিজেকে আড়ালে রেখে অন্যের মাধ্যমে করিয়ে নেয়ার অতি-সাহসিক মানসিকতা অনেকেই ধারণ করি আমরা। সফল হলে কৃতিত্বের ভাগ নেবো, আর বিফল হলে দায়ভার অন্যের। তখন মুখোশ তো মুখোশই, পেছনের ব্যক্তিটিকে পায় কে ! আরেকটি
মুখোশ নিয়ে নিলেই চলবে। এই পরিচয় গোপন করার মধ্যে যে ব্যক্তির অবচেতনে
অপরাধপ্রবণ ভণ্ডামি লুকিয়ে থাকে সেটি কেউ খুঁটিয়ে বিচার করে দেখি না। কেননা
উদ্দেশ্য যতো মহৎই হোক, দায়বদ্ধহীনতাই অপরাধপ্রবণতার জন্ম দেয়।
.
দর্শনশাস্ত্রে যুক্তি হলো সেই মোক্ষম অস্ত্র, যার কারণে তত্ত্ব-প্রসবেও
কেউ দায়মুক্ত হতে পারে না। যুক্তির একেকটা দ্বৈরথ পেরিয়েই তাঁকে তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তাই যিনি তাঁর বক্তব্যে সৎ ও আত্মবিশ্বাসী, তিনি মুখোশধারী হতে পারেন না। মুখোশ মানেই যা প্রকাশিত, কিন্তু
অন্তরালের ব্যক্তিসত্তাটি তার ভিন্ন অন্য কিছু। বিশ্বাস আর বক্তব্যের
বৈপরীত্য গোপন করতেই প্রয়োজন হয় মুখোশের। সোজা বাংলায় যাকে বলে ভণ্ডামি।
বুঝে হোক না-বুঝে হোক, এই ভণ্ডামির আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দিলে তাঁর নিজের ক্ষেত্রে যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিটি ভবিতব্য হয়ে যায় তা-ই
তাঁর সামগ্রিক অস্তিত্ব জুড়ে বিকট প্রভাব ফেলে। যা তাঁর পরবর্তী জীবনটাকে
ঠেলে দিতে পারে দুঃসহ এক সংকট আর অনিশ্চয়তার দিকে। তা কীরকম ?
.
যেহেতু শুরুটাই হচ্ছে একটা অলীক মানুষের পরিচয়হীনতা দিয়ে, তাই এর অভ্যস্ততা তাঁকে একটা দুর্বোধ্য পরিচিতি-সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। দুর্বোধ্য বলছি এজন্যেই যে, প্রথম প্রথম এই ভার্চুয়াল অলীক পরিচিতির বিভ্রম তাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করে ফেলবে যে, যখন প্রকৃতই সে তাঁর বাস্তবের আদি পরিচয়ের দ্বৈরথের মুখোমুখি হবে, তখন
এই সংকট তাঁর মধ্যে দিকশূন্য দুর্বোধ্যতাই ছড়াবে। এই শক্ত ফাঁদ থেকে
বেরোনোর উপায় খুঁজে হাপিত্যেশ করা ছাড়া তেমন কিছু একটা করার থাকবে না। যদি
বেরোতে পারেও, হয়তো আবারো তাঁকে শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে। তবে এসব তো অনেক পরের ব্যাপার। তার আগে যে ক্ষতিগুলো হবার তা হয়ে যাবে। যেমন ?
.
মুখোশবৃত্তির
স্বাভাবিক দায়বদ্ধহীনতার কারণে সে হবে এক কাল্পনিক বা ভার্চুয়াল জগতের
স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাধর প্রতিনিধি। অর্থাৎ নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে
থাকবে সে। কীবোর্ড টিপেই যদি বিপ্লব সংঘটিত করে ফেলা যায়, সেখানে শারীরিক বা মানসিক শক্তিক্ষয়ের প্রয়োজন কোথায় ! যাকে কতলের ইচ্ছে হবে কীবোর্ডের এক চাপে দাও কতল করে। কিংবা নিজের অতি-স্বেচ্ছাচারের কারণে যদি সম্মিলিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পড়ে, তাহলে
কীবোর্ডের আরেক চাপে দাও নিজের মুখোশটাকেই গায়েব করে। রক্তবীজের মতো নতুন
মুখোশ নিয়ে নতুন রূপে হাজির হতে তো বাধা নেই। এসব অভ্যস্ততায় মনোজগতের
মধ্যে ঘটতে থাকা মিথষ্ক্রিয়াগুলো একসময় তাকে যে মানসিক জগতের অধিবাসী করে
তুলবে, তার
সাথে যাপিত জীবনের বাস্তবতায় যোজন যোজন ফারাক। আমাদের বাস্তব জগতে যেকোন
সমস্যাই বাস্তব অস্তিত্ব দিয়ে সমাধান করার জন্য নিজেকে শারীরিক ও
মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হয়। কিন্তু ভার্চুয়াল অলীকত্বে অভ্যস্ত হয়ে
ওঠলে রূঢ় বাস্তব থেকে মানসিকভাবে আগেই ছিটকে পড়ায়, বাস্তবে সে পরিণত হবে কল্পনাবিলাসী ভীরু, কাপুরুষ, অলস
অকর্মায়। অতঃপর এই বাস্তবতা তাকে ছিটকে দেবে গভীর হীনম্মণ্যতায়। এই
হীনম্মণ্যতা তাকে কওে তুলবে বন্ধুহীন। বন্ধুহীন মানুষ হয় ভয়ঙ্কর, অমানবিক।
ফলে অমিত সম্ভাবনাময় সমস্ত সুকুমার বৃত্তি হারিয়ে সে ক্রমে ক্রমে ঘরকুনো
এক অন্ধকারের অমেরুদণ্ডী প্রাণীবৎ হয়ে রূঢ় অভব্যতায় বিষিয়ে তুলবে তার
আশপাশ। যে দায়বদ্ধতা সে হারিয়ে ফেলেছিলো মুখোশবৃত্তির সাথে, সেই
দায়বদ্ধতা চর্চার অভাবে শেষপর্যন্ত হীনম্মণ্য সে পতিত হবে বাস্তবের
আত্মবিশ্বাসহীনতার অতল খাদে। এভাবে সমস্ত সম্ভাবনা শূন্য হয়ে অতঃপর এক
অথর্ব মানুষ থেকে তার পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র আর কী আশা করতে পারে ?
.
বুদ্ধিমান
পাঠক হয়তো এই মনস্তাত্ত্বিক আশঙ্কার কথাগুলোকে অতিকথন বলে ভাবতে পারেন।
কিন্তু কোনরূপ দায়বদ্ধহীন মানুষের প্রকৃতি বাস্তবে কী হতে পারে তার নমুনা
মনে হয় না যে আমাদের দেশে এখনও অভাব আছে। বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, পরিবারের
অপদার্থ ছেলেটিকে অভিভাবকরা দ্রুত একটি বিয়ে করিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন।
তাঁদের এ অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্তে অন্য আরেকটি নারীর জন্য সম্ভাব্য
বেদনাদায়ক অভিশাপগ্রস্ততা বয়ে আনলেও এ উদ্যোগটি যে মূলত একটি অপদার্থ
যুবকের ঘাড়ে অবিচ্ছেদ্য দায়বদ্ধতা চাপিয়ে তাকে পথে আনার প্রয়াস তা বুঝতে
অসুবিধা হয় না। বস্তুত দায়বদ্ধহীন মানুষ আর ভারমুক্ত গাধায় কোন পার্থক্য
নেই, এটিই হয়তো তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি। তথ্য-প্রযুক্তির
ছোঁয়া থেকে শতযোজন দূরে অবস্থান করেও আমাদের সেইসব অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত
প্রবীণেরা জীবন ও প্রকৃতির পাঠশালা থেকে দায়বদ্ধতার আবশ্যকতা বিষয়ক যে
বাস্তব জ্ঞানটি রপ্ত করতে ভুল করেন নি, আমরা তাঁদেরই উত্তর-প্রজন্ম শিক্ষা ও প্রযুক্তির অগ্রবর্তী ভার্চুয়াল ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে সেই অতি-আবশ্যক দায়বদ্ধতাটুকুই ছুঁড়ে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছি। প্রকারান্তরে আমরাই কি আদতে বিবেচনাবোধহীন অবিমৃষ্যকারিতায় আক্রান্ত নই ?
.
প্রকৃতপক্ষে আমরা তো অলীক মানুষ নই। ‘কতোটা পথ পেরোলে পথিক হওয়া যায়’- এ প্রশ্নের উত্তর না জানলেও, যেটুকু
পথ পেরোবো অন্তত সেটুকু পথ কি নিজের অস্তিত্বের স্বাক্ষরে বলীয়ান হয়ে
আত্মবিশ্বাসী দৃপ্ত পদচ্ছাপ রেখে রেখে এগিয়ে যেতে পারি না আমরা ! অবশ্যই পারি। আমাদের ভবিতব্যকে আমরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ভুল হোক শুদ্ধ হোক, তবু বুক চিতিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলতে তো পারি- এই যে আমি !
… (২৩-১১-২০১২)
মিরপুর, ঢাকা।
…
[ Sachalayatan ]
[ BlogyMate ]
…
No comments:
Post a Comment