Sunday, December 30, 2012

| যোগ দর্শন-০১ : ভূমিকা |

.
| যোগ দর্শন-০১ : ভূমিকা |
রণদীপম বসু
১.০ : ভূমিকা

ভারতীয় আধ্যাত্মদর্শনে অন্যতম প্রভাবশালী দর্শন হলো যোগ দর্শন। মহর্ষি পতঞ্জলি এই দর্শনের সূত্রকার। ‘যোগসূত্র’ বা ‘পাতঞ্জলসূত্র’ই এই দর্শনের মূল বা সূত্রগ্রন্থ। পতঞ্জলির নাম অনুসারে এই দর্শনকে পাতঞ্জল দর্শনও বলা হয়। দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্য ও যোগ দর্শনের মধ্যে প্রভেদ খুবই সামান্য। তাই এ দুটোকে পরস্পর সমানতন্ত্র দর্শন বলা হয়। মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শনে স্বীকৃত পঞ্চবিংশতি তত্ত্বে কোন ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় নি। সাংখ্যের পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব বা পঁচিশ প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- (১) জ্ঞ বা পুরুষ, (২) অব্যক্ত বা মূলপ্রকৃতি বা প্রধান, (৩) মহৎ বা বুদ্ধি, (৪) অহংকার, (৫) মনস্ বা মন (৬) পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক- এই পাঁচটি), (৭) পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ- এই পাঁচটি), (৮) পঞ্চতন্মাত্র বা পঞ্চসূক্ষ্মভূত (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ- এই পাঁচটি), (৯) পঞ্চস্থূলভূত বা পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ্ বা জল, তেজ বা অগ্নি, মরুৎ বা বায়ু, আকাশ বা ব্যোম্- এই পাঁচটি)। অন্যদিকে পতঞ্জলির যোগ দর্শনে সাংখ্যের পঁচিশটি তত্ত্বের সাথে অতিরিক্ত একটি তত্ত্ব ঈশ্বরতত্ত্ব যুক্ত করে ঈশ্বর স্বীকৃত হয়েছে বলে নিরীশ্বর-সাংখ্যের বিপরীতে যোগ দর্শনকে ‘সেশ্বর-সাংখ্য’ও বলা হয়ে থাকে।

 .
প্রাচীন ভারতে ‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’ এই দুটি ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের নাম প্রায় সম অর্থে ব্যবহৃত হতো। তাই যোগ-সম্প্রদায়ের এই ঈশ্বর-স্বীকৃতির ইতিহাস ঠিক কতোটা প্রাচীন- তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও, প্রাচীন উপনিষদ পুরাণ ইত্যাদিতে যোগ ও যোগানুষ্ঠান বিধানের উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়া প্রাচীন সাহিত্য ও শাস্ত্র গ্রন্থগুলিতে যথা- মহাভারত, গীতা ইত্যাদিতে এই দুই সম্প্রদায়কে এক বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে-
‘সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্ বালাঃ প্রবদন্তি ন পণ্ডিতাঃ।
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্ ।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৫/৪)
অর্থাৎ : অজ্ঞ ব্যক্তিগণ সাংখ্য ও যোগকে পরস্পরবিরুদ্ধ ও ভিন্ন-ফল-বিশিষ্ট বলে থাকেন, কিন্তু আত্মজ্ঞানীগণ তা বলেন না। কারণ উভয়ের ফল এক মোক্ষ। সেজন্য একটি সম্যক্ রূপে অনুষ্ঠিত হলে উভয়ের ফল মোক্ষ লাভ হয়।
.
‘যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদযোগৈরপি গম্যতে।
একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৫/৫)
অর্থাৎ : সাংখ্য যার অধিগম্য, যোগও তার অধিগম্য। সাংখ্য ও যোগের ফল একই মোক্ষ বলে উভয়কে যিনি অভিন্ন দেখেন, তিনিই যথার্থদর্শী, সম্যক্ জ্ঞানী। 
 .
তবে সেসব শাস্ত্রগ্রন্থে দুটোকে এক বলা হলেও, দর্শন-সম্প্রদায়গত আলোচিত তত্ত্বের গুরুত্ব অনুযায়ী ভারতীয় দর্শন জগতে এ দুটি পৃথক সম্প্রদায়, দুটি পৃথক প্রস্থান। কেননা দুই সম্প্রদায়ের ভিত্তি এক হলেও এদের ব্যবহারিক প্রয়োগ ভিন্ন। তাই মোক্ষশাস্ত্রেও বলা হয়-

‘নাস্তি সাংখ্যসমং জ্ঞানং নাস্তি যোগসমং বলম্’।
অর্থাৎ : সাংখ্যতত্ত্বের তুল্য জ্ঞান নেই, যোগের তুল্য বল বা শক্তি নেই।
 .
যে দর্শন কেবল তত্ত্ব-নিদিধ্যাসন এবং বৈরাগ্য-অভাসের দ্বারা আত্মসাক্ষাৎকারে বিশ্বাসী, তাকে সাংখ্য এবং যে দর্শন তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধানরূপ ক্রিয়ার সাহায্যে আত্মসাক্ষাৎকারে বিশ্বাসী, তাকে যোগ বলা হয়। সাংখ্য বর্ণিত পুরুষতত্ত্ব, প্রকৃতিতত্ত্ব, জগৎ পরিণাম, সৎকার্যবাদ এবং মোক্ষ এসব যোগসম্মত। তবে কৈবল্যলাভের উপায় সম্পর্কে যোগ দর্শনে সাংখ্যের অতিরিক্ত কিছু নির্দেশ আছে। সাংখ্য দর্শনে বিবেকজ্ঞানকেই ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি এবং কৈবল্যলাভের উপায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে যোগ দর্শনে বিবেকজ্ঞান লাভ ও কৈবল্য প্রাপ্তির জন্য অতিরিক্ত কিছু প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলিকে এককথায় ‘যোগ’ বলা হয়।
 .
যোগশাস্ত্র মতে এই যোগ-ই তত্ত্বজ্ঞান লাভ এবং দুঃখ-নিবৃত্তির প্রধান উপায়। যোগের দ্বারাই পুরুষ বা আত্মা স্ব-স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। এই মতে ঈশ্বর-প্রণিধান পুরুষের প্রত্যক্ষলব্ধ অভিজ্ঞতা। তাই সাংখ্য দর্শনকে তত্ত্বমূলক দর্শন এবং যোগ দর্শনকে প্রয়োগমূলক দর্শন বলা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও জগতের বিবর্তন, ভ্রমের ব্যাখ্যা, মোক্ষের স্বরূপ এবং ঈশ্বর-কর্তৃত্বের বিষয়ে সাংখ্য ও যোগের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সাংখ্য-পরিণামবাদ হলো অচেতন উদ্দেশ্যবাদ, কিন্তু যোগ-পরিণামবাদ হলো সচেতন উদ্দেশ্যবাদ। যোগমতে ঈশ্বরই যেহেতু বিবর্তন-প্রক্রিয়ার কর্তা, তাই জগতের বিবর্তন কখনোই অচেতন হতে পারে না। মোটকথা, পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্রে জগৎ বহির্ভূত যে অতিরিক্ত ঈশ্বরতত্ত্ব স্বীকার করেছেন, তার ফলে জগতের অভিব্যক্তি, কল্পান্তে প্রলয় ও তার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যোগমত, সাংখ্যমত থেকে ভিন্ন হয়ে পড়েছে।
 .
কিন্তু এই ভিন্নতা সত্ত্বেও দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্য ও যোগ প্রায় অভিন্ন হওয়ায় সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃত বেদপন্থী দার্শনিকেরা যে বিবেচনায় নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যকে একান্তভাবেই বেদ-বিরোধী বলে চিহ্নিত করেন, সেই একই বিবেচনায় যোগকেও তাই বেদ-পন্থী বলে স্বীকার করার খুব সুযোগ থাকে না। এবং তা যে ছিলোও না, দার্শনিক সাহিত্যে এর নমুনা বিরল নয়। ব্রহ্মবাদী দার্শনিক বাদরায়ণ তাঁর ব্রহ্মসূত্রে ব্রহ্মবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বেদ বা শ্রুতি-বিরোধী সাংখ্যমত খণ্ডনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় সাংখ্য-খণ্ডনের ফলে যে যোগ-দর্শনও খণ্ডিত হয় তা প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে একটি সূত্র রচনা করেছিলেন-

‘এতেন যোগঃ প্রত্যুক্তঃ।। (ব্রহ্মসূত্র : ২/১/৩)
অর্থাৎ : এর দ্বারা যোগদর্শনকেও খণ্ডন করা হলো।
 .
এই সূত্রটির ভাষ্যে প্রখ্যাত অদ্বৈতবাদী বেদান্ত দার্শনিক শংকারাচার্যের বক্তব্য প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অভিমতটিও প্রাসঙ্গিক-

‘তত্রাপি শ্রুতিবিরোধেন প্রধানং স্বতন্ত্রমেব কারণং মহদাদীনি চ কার্যানি অ-লোকবেদ প্রসিদ্ধানি কল্পান্তে’। অর্থাৎ, যোগদর্শনেও শ্রুতি বিরুদ্ধ– বস্তুত লোকপ্রসিদ্ধি বিরুদ্ধ এবং বেদ-বিরুদ্ধও– প্রধান বা প্রকৃতির এবং প্রধানোৎপন্ন মহত্তত্ত্ব প্রভৃতির (সাংখ্যসম্মত) উপদেশ আছে। এই কারণেই যোগের প্রত্যাখ্যান প্রয়োজন। শংকর প্রশ্ন তুলেছেন, সাংখ্য-প্রত্যাখ্যানের ফলে যোগও যদি প্রত্যাখ্যাত হয় তা হলে এই অতিদেশ-সূত্রটির অবতারণা কেন ? উত্তরে তিনি বলছেন, প্রয়োজন এই যে শ্রুতিতে সম্যক-দর্শনের-উদ্ভব-উপায় হিসেবে– অর্থাৎ সাধনপদ্ধতি অর্থে– যোগের প্রশংসা আছে; কিন্তু তা থেকেই কেউ যেন কল্পনা না করেন যে যোগের দার্শনিক তত্ত্বও শ্রুতি-সমর্থিত। প্রসঙ্গত, যোগদর্শনের বেদ-বিরুদ্ধতা বিষয়ে শংকরের সঙ্গে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বেদান্ত দার্শনিক রামানুজ সম্পূর্ণ একমত। যোগ-দর্শন স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যাখ্যান করবার প্রয়োজন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি স্পষ্টই ‘অবৈদিকত্বাৎ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৬)।
 .
বৈদিক সংস্কৃতিতে যোগ-সাধনার অন্তর্ভুক্তি এবং একইসাথে দর্শনতত্ত্বে যোগদর্শন বেদবিরোধী হওয়ার এই স্ববিরোধী বিষয়টির একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আর্যপূর্ব সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসস্তুপ থেকেই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা হিসেবে যোগসাধনার প্রাচীনতম মূর্ত নিদর্শন পাওয়ায়। প্রাচীন সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আধুনিক বিদ্বানদের ধারণা, অবধারিতভাবেই সিন্ধু-সভ্যতা বেদপূর্ব। যোগ-সাধনার আদিপর্ব থেকেই যদি তার সঙ্গে সাংখ্য-তত্ত্বের সম্পর্ক থাকে এবং সুপ্রাচীন সিন্ধু-যুগেই যদি যোগ-সাধনার অবধারিত প্রমাণ পাওয়া যায় তা হলে সেই যুগ থেকেই সাংখ্য-তত্ত্বের সূত্রপাত অনুমিত হতে পারে। আগন্তুক আর্যরা সেই সিন্ধু-অধিবাসীদের কাছ থেকেই এই সাধন-পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো। যা পরবর্তীকালের বেদনিষ্ঠ সাধন-পদ্ধতিতে যুক্ত হয়ে গেছে।
 .
.
যোগ সাহিত্য
যোগ দর্শনের উপর বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তবে মূল গ্রন্থ হচ্ছে মহর্ষি পতঞ্জলির ‘যোগসূত্র’ বা ‘পাতঞ্জলসূত্র’। মহর্ষি বেদব্যাস যোগসূত্রের উপর অনবদ্য ভাষ্যগ্রন্থ ‘যোগভাষ্য’ রচনা করেন। অনেকের মতে যোগভাষ্য হচ্ছে যোগশাস্ত্রের উপর রচিত প্রাচীনতম ভাষ্যগ্রন্থ। এটিকে ব্যাসভাষ্যও বলা হয়। ব্যাসভাষ্যের উপর রচিত দুটি প্রামাণ্যটীকা গ্রন্থ হলো বাচস্পতি মিশ্রের ‘তত্ত্ববৈশারদী’ এবং বিজ্ঞানভিক্ষুর ‘যোগবার্তিক’। যোগবার্তিক ছাড়া যোগশাস্ত্রের উপর রচিত বিজ্ঞানভিক্ষুর অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘যোগসার সংগ্রহ’ ও ‘ভোজরাতকৃত বৃত্তি’ প্রভৃতি।
 .
ভোগরাজের ‘যোগবৃত্তি’ ও রামানন্দ সরস্বতীর ‘যোগমণিপ্রভা’ যোগ দর্শনের উপর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া রাঘবানন্দের ‘পাতঞ্জলরহস্য’, অনন্তের ‘যোগচন্দ্রিকা’, আনন্দশিষ্যের ‘যোগসুধাকর’, উদয়শংকরের ‘যোগবৃত্তিসংগ্রহ’, উমাপতি ত্রিপাঠীর ‘যোগসূত্রবৃত্তি’, গণেশ দীক্ষিতের ‘পাতঞ্জলবৃত্তি’, জ্ঞানানন্দের ‘যোগসূত্রবিবৃতি’, হরিহরানন্দ আরণ্য ও ধর্মমেঘ আরণ্যের ‘ভাস্বতী’ প্রভৃতি যোগ দর্শনের উপর রচিত মূল্যবান গ্রন্থরাজি।
 .
.
যোগ শাস্ত্র
যোগশাস্ত্র মতে ‘আত্মার বন্ধন বিবেকজ্ঞান দ্বারা মুক্তি সম্ভব’ এবং যোগ সাধনার দ্বারা বিবেকজ্ঞান লাভ হয়। এ জন্য যোগ দর্শন যোগ সাধনার পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বলা হয়, আত্মশুদ্ধির জন্য যোগ দর্শনের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া খুবই সহায়ক। মহর্ষির যোগসূত্র বা পাতঞ্জলসূত্রে যোগ দর্শনের উপর মোট ১৯৪টি সূত্র রয়েছে। এই সূত্রগুলিকে কোন অধ্যায়ে বিভক্ত না করে চারটি পরিচ্ছদ বা পাদে বিভক্ত করা হয়েছে। এই চারটি পাদ হলো- (১) সমাধিপাদ, (২) সাধনপাদ, (৩) বিভূতিপাদ এবং (৪) কৈবল্যপাদ। সমাধিপাদে আছে ৫১টি সূত্র, সাধনপাদে আছে ৫৫টি সূত্র, বিভূতিপাদে আছে ৫৪টি সূত্র এবং কৈবল্যপাদে আছে ৩৪টি সূত্র।
 .
যোগশাস্ত্র চারটি অঙ্গবিশিষ্ট- হেয়, হেয়হেতু, হান ও হানোপায়। হেয় হলো সংসার, হেয়-হেতু হলো সংসার হেতু। এখানে হেতু বলতে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ বোঝায়। হান হলো মোক্ষ বা কৈবল্য এবং হানোপায় হলো মোক্ষের বা কৈবল্যের উপায়। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘হেয়ং দুঃখমনাগতম্’- (যোগসূত্র : সাধনপাদ-১৬)
অর্থাৎ : সংসার দুঃখময় বলে তা পরিত্যাজ্য।
 .
‘দ্রষ্টদৃশ্যয়োঃ সংযোগো হেয়হেতুঃ’- (যোগসূত্র : সাধনপাদ-১৭)
অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ হলো হেয়-হেতু বা দুঃখের কারণ।
 .
‘তদভাবাৎ সংযোগাভাবো হানং তদ্দৃশেঃ কৈবল্যম্’- (যোগসূত্র : সাধনপাদ-২৫)
অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগাভাব হলো হান বা কৈবল্য।
 .
‘বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপায়ঃ’- (যোগসূত্র : সাধনপাদ-২৬)
অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হলো কৈবল্যলাভের উপায় বা হানোপায়।
 .
পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে যোগের লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্য সমাধিপাদকে যোগপাদও বলা হয়। যোগের লক্ষণ, প্রকারভেদ, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, চিত্তভূমির প্রকারভেদ, প্রমাণের লক্ষণ ও প্রকারভেদ, ঈশ্বরের লক্ষণ, ঈশ্বরপ্রণিধানের ফল, চিত্তবৃত্তি নিরোধের উপায় প্রভৃতি এই পাদে আলোচিত হয়েছে।
সাধনপাদে প্রধানত ক্রিয়াযোগের কথা আলোচিত হয়েছে। যোগের জন্য যে সব ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় তাদের পরিচয়, আবশ্যিকতা ও ফল এবং এছাড়াও অবিদ্যার লক্ষণ, কর্মফল, দুঃখের হেতু এবং দুঃখ-নিবৃত্তির উপায় এই পাদে আলোচিত হয়েছে।
বিভূতিপাদ প্রধাণত যোগলব্ধ অলৌকিক শক্তির বর্ণনা। এর সাথে ধারণার লক্ষণ, ধ্যানের লক্ষণ, সমাধির লক্ষণ, সংযম সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং বিবেকজ্ঞান আলোচিত হয়েছে।
আর কৈবল্যপাদে রয়েছে মোক্ষের স্বরূপ, মোক্ষের প্রকারভেদ, পরলোক প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা।
 .
শুধু যোগদর্শনই নয়, আত্মসাক্ষাৎকারের উপায়রূপে যোগের প্রয়োজনীয়তা চার্বাক ব্যতীত বাকি সব ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ই স্বীকার করেন। বেদ, উপনিষদ, স্মৃতি এবং পুরাণেও যোগের প্রয়োজন স্বীকৃত হয়েছে। আত্মশুদ্ধির প্রশস্ত পথ হলো যোগসাধনা। এই মতে, যোগসাধনা দেহ ও মনকে শুদ্ধ করে এবং আত্মসাক্ষাৎকারের যথাযোগ্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
 .
‘যুজ্’ ধাতুর সঙ্গে ‘ঘঞ্’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘যোগ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়। ‘যুজ্’ ধাতুর বিবিধ অর্থ হয়, যেমন- সংযোগ, সমাধি প্রভৃতি। তাই ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘যোগ’ শব্দটির অর্থ করা হয় জীবাত্মা ও পরমাত্মার সংযোগ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও শ্রীকৃষ্ণ অর্জুণকে বিভিন্নভাবে যোগের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক জায়গায় তিনি যোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন-

‘বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্ ।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ২/৫০)
অর্থাৎ : নিষ্কাম কর্মযোগী ঐহিক জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় হতে মুক্ত হন। সুতরাং তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান করো। কর্মের কৌশলই যোগ।
 .
এখানে কর্মের কৌশলকেই যোগ বলা হচ্ছে-

‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম্’।
অর্থাৎ : কোনও কাজে নৈপুণ্য অর্জনের নাম যোগ।
 .
অতএব, কী কৌশলের দ্বারা, কোন্ জ্ঞানার্জনের দ্বারা বা কোন্ সাধনার দ্বারা মনের বশ্যতা-জাল থেকে মুক্ত হওয়া যায়, তা-ই যোগ দর্শনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। এক্ষেত্রে যোগসূত্রকার মহর্ষি পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-

‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ’।- (যোগসূত্র)
অর্থাৎ : চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ।
 .
যোগের এই লক্ষণ বা সংজ্ঞা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিত্ত কী, তার বৃত্তিই বা কী এবং তার প্রকারভেদ, কীভাবে চিত্তবৃত্তির নিরোধ করা যায়, ইত্যাদি বিবিধ প্রশ্ন যোগশাস্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর চিত্তবৃত্তি-নিরোধের জন্যই চিত্তশুদ্ধি, সংযম ও ধ্যানের আলোচনা এই শাস্ত্রে গুরুত্ব পেয়েছে।

(চলবে…)

[ যোগদর্শন : অধ্যায়সূচি ] [*] [ পরের পর্ব : যোগ মনস্তত্ত্ব ]

No comments: