.
.
| যোগ দর্শন-০২ : যোগ মনস্তত্ত্ব |
রণদীপম বসু
…
২.০ : যোগ মনস্তত্ত্ব
রণদীপম বসু
…
২.০ : যোগ মনস্তত্ত্ব
…
২.১ : চিত্ত
২.১ : চিত্ত
মহর্ষি
পতঞ্জলির মতে চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ। অতএব প্রশ্ন ওঠে, চিত্ত কী ?
মহর্ষি পতঞ্জলি ও ভাষ্যকার ব্যাসদেব বিভিন্ন স্থলে বুদ্ধি ও মনকে চিত্ত
বলেছেন। মূলত পাতঞ্জল দর্শনে প্রকৃতির কতকগুলি বিকারকে একত্রে চিত্ত শব্দের
অভিধেয় বলে গণ্য করা হয়। সাংখ্যমতে ত্রিগুণময়ী প্রকৃতির প্রথম বিকার হলো
মহৎ। মহতের বিকার বুদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকার অহংকার। আর অহংকারের অন্যতম
বিকার হলো মন। এগুলিকে একসঙ্গে সাংখ্য দর্শনে চিত্ত বলা হয়। সাংখ্যের এই মত
যোগ দর্শনেও স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং যোগসম্মত চিত্ত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই
ত্রিগুণময়ী।
.
স্বাভাবিকভাবেই
চিত্ত জড় ও অচেতন। তবে চিত্ত ত্রিগুণময়ী হলেও তাতে কালবিশেষে সত্ত্বগুণের
আধিক্য থাকে। সত্ত্বের আধিক্যবশত পুরুষের সান্নিধ্যে পুরুষের চৈতন্য চিত্তে
প্রতিবিম্বিত হয়। এর ফলে চিত্তকেও তখন চেতন বলে মনে হয়। বলাবাহুল্য,
চিত্তে সর্বদা সত্ত্বের আধিক্য থাকে না। সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের তুলনামূলক
আধিক্যে যোগ দর্শনে পাঁচপ্রকার চিত্তভূমি স্বীকার করা হয়।
.
.
২.২ : চিত্তভূমি
২.২ : চিত্তভূমি
সাধারণত চিত্তের ভূমি বা অবস্থাকে বলে চিত্তভূমি। কিন্তু যোগমতে চিত্তের সহজ ও স্বাভাবিক অবস্থাই হলো চিত্তভূমি-
‘চিত্তস্য সহজাবস্থাঃ’।
অর্থাৎ : (চিত্তভূমি) চিত্তের সহজ অবস্থা।
.
চিত্তভূমি বা চিত্তের স্বাভাবিক অবস্থা পাঁচ প্রকার- (১) ক্ষিপ্ত, (২) মূঢ়, (৩) বিক্ষিপ্ত, (৪) একাগ্র ও (৫) নিরুদ্ধ।
.
ক্ষিপ্তভূমি :
যে ভূমিতে চিত্ত স্বভাবতই অত্যন্ত অস্থির, তাকেই ক্ষিপ্ত বলা হয়। ক্ষিপ্ত
অবস্থায় চিত্ত রজঃ ও তমোগুণের প্রভাবে বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ধাবিত হয়। কোন
বিষয়ের প্রতিই স্থিরভাবে আকৃষ্ট হয় না বলে অতীন্দ্রিয় বিষয়ে চিন্তা করার
মতো স্থৈর্য বা ধীশক্তি থাকে না। চিত্তের এই অবস্থা এতো বলবান যে, সাধারণ
মানুষ এর প্রভাবে পাগলের মতো বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে বিচরণ করে। চিত্তের এই
ক্ষিপ্ত অবস্থা যোগ সাধনার উপযোগী নয়।
.
মূঢ়ভূমি :
প্রবল রাগ ও মোহের বশীভূত চিত্তের যে মুগ্ধ অবস্থা, তাই মূঢ়ভূমি। মূঢ়
অবস্থায় তমোগুণের প্রাধান্যহেতু ইন্দ্রিয়বিষয়ে অতি মুগ্ধ চিত্ত ভালো-মন্দ
বিচার করতে সমর্থ হয় না। মোহাচ্ছন্ন চিত্তে নিষ্ক্রিয়তা, আলস্য, তন্দ্রা
রাজত্ব করে। চিত্তের এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা তত্ত্বচিন্তায় অক্ষম বলে এ
অবস্থা যোগ সাধনার অনুপযোগী।
.
বিক্ষিপ্তভূমি :
চিত্তের তৃতীয় ভূমি হলো বিক্ষিপ্ত। এই অবস্থা ক্ষিপ্ত অবস্থা সদৃশ হলেও তা
থেকে কিঞ্চিৎ উন্নত। বিক্ষিপ্ত চিত্তের সাথে ক্ষিপ্তের ভেদ হলো, ক্ষিপ্ত
চিত্ত সর্বদাই অস্থির এবং চঞ্চল থাকে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত চিত্ত কোন কোন সময়ে
স্থির, আবার কোন কোন সময়ে চঞ্চল। ক্ষিপ্ত ও মূঢ় চিত্ত তত্ত্বচিন্তায়
সম্পূর্ণ অক্ষম। এ কারণে তাদের সমাধি হতেই পারে না। কিন্তু বিক্ষিপ্ত চিত্ত
সাময়িকভাবে কোন বিষয়ে নিবিষ্ট হয়ে তত্ত্ববিষয়ক জ্ঞানে চিত্তের আগ্রহ দেখা
গেলেও তা স্থায়ী হয় না। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় চিত্ত তমোগুণের প্রভাব থেকে
মুক্ত হয়, কিন্তু রজঃ-এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। তাই বিক্ষিপ্ত
অবস্থায়ও যোগ সম্ভব নয়।
.
একাগ্রভূমি :
যে চিত্তের অগ্র বা অবলম্বন এক তাই একাগ্র চিত্ত। একাগ্র অবস্থায় চিত্ত
তমের প্রভাবের সঙ্গে রজের প্রভাব থেকেও সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। এ অবস্থায়
সত্ত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে। একাগ্রভূমিতে চিত্ত কোন একটি বিশেষ বিষয়ে
নিবিষ্ট থাকে অর্থাৎ চিত্ত একটিমাত্র বিষয়ের আকারে আকারিত হয়ে স্থির ও
অচঞ্চলভাবে অবস্থান করে। এ অবস্থায় চিত্তের অনেক বৃত্তির নিরোধ হলেও সব
বৃত্তির নিরোধ হয় না। তা সত্ত্বেও চিত্তের একাগ্র অবস্থা যোগানুকূল। বস্তুত
এই অবস্থায় চিত্ত সমাধিস্থ হয় এবং এই সমাধিকে বলা হয় সম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
.
নিরুদ্ধভূমি :
চিত্তের পঞ্চম তথা শেষভূমির নাম নিরুদ্ধ। এই অবস্থায় চিত্তের সর্বপ্রকার
বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়। এই স্তরে চিত্ত শান্ত ও সমাহিত। যখন অভ্যাসের দ্বারা
চিত্তের সকল বৃত্তিই নিরুদ্ধ করে চিত্তকে সম্পূর্ণ স্থির রাখা হয়, তখন
চিত্তের নিরুদ্ধভূমিক অবস্থা হয়। এ অবস্থায় চিত্তের কোন অবলম্বন থাকে না। এ
অবস্থা সম্পর্কে যোগসূত্রে বলা হয়েছে-
‘তদা দ্রষ্টুঃ স্বরূপে অবস্থানম্’। -(যোগসূত্র : ১/৩)
অর্থাৎ : অবলম্বনহীন এই চিত্তভূমিতে পুরুষ স্বরূপে অবস্থান করে।
.
পাতঞ্জল
শাস্ত্রে ‘যোগ’ বলতে এইরূপ চিত্তবৃত্তি নিরোধকেই বোঝানো হয়। এ অবস্থায়
চিত্তবৃত্তি সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ হলেও দেহের কোন বিকার হয় না। কারণ দেহে তখন
আত্মা অবস্থান করে। যোগ সম্প্রদায়ের মতে যোগীর এই অবস্থা প্রমাণ করে যে,
আত্মা চিত্ত থেকে ভিন্ন। তাঁদের মতে আত্মা চিত্ত থেকে ভিন্ন না হলে চিত্তের
নিরোধে দেহের বিনাশ হতো। চিত্তবৃত্তির নিরোধে আত্মার যে অবস্থান, তা-ই
আত্মার স্বরূপে অবস্থান। এ অবস্থাতেই চিত্ত কৈবল্যলাভে অর্থাৎ মুক্তিলাভে
সক্ষম হয়। এ অবস্থায় যে সমাধি হয়, তাকে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়।
.
.
২.৩ : চিত্তবৃত্তি
বৃত্তি হলো পরিণাম। সুতরাং চিত্তবৃত্তি হলো চিত্তের পরিণাম। বলা হয়-
‘বিষয়সম্বন্ধাৎ চিত্তস্য পরিণাম-বিশেষা বৃত্তয়ঃ’।
অর্থাৎ : বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হওয়ার ফলে চিত্তের যে বিষয়াকারে পরিণতি, তাই চিত্তের বৃত্তি।
.
সাংখ্য-যোগমতে
গলিত ধাতু যে পাত্রে ঢালা হয়, ধাতু যেরূপ সেই পাত্রের আকার ধারণ করে,
সেরূপ জীবের চিত্তের সঙ্গে যখন কোন বস্তুর সংযোগ ঘটে, তখন চিত্ত সেরূপ
বস্তুর আকার ধারণ করে। বিষয়ের সঙ্গে সংযোগের ফলে চিত্তের এই বিষয়াকার
প্রাপ্তিই হলো চিত্তবৃত্তি। সাধারণভাবে এই বৃত্তিকেই জ্ঞান বলা হয়। চিত্তের
এই বিকার বা বৃত্তির মাধ্যমে আত্মার বিষয়জ্ঞান হয়ে থাকে। আত্মা স্বরূপত
মুক্ত, শুদ্ধ এবং আত্মার কোন বিকার বা পরিণাম নেই। কিন্তু গতিশীল তরঙ্গে
চন্দ্র প্রতিফলিত হলে চন্দ্রকে যেমন গতিশীল মনে হয়, তেমনি আত্মা চিত্তে
প্রতিফলিত হলে আত্মাকেও পরিণামী মনে হয়।
.
চিত্তের
বৃত্তি হলো জ্ঞানরূপ অবস্থাগুলি। যোগশাস্ত্রের পরিভাষায় পরিদৃষ্ট চিত্তভাব
বা বোধসমূহকেই বৃত্তি বলা হয়। এই বৃত্তিগুলি প্রাথমিকভাবে ক্লিষ্ট ও
অক্লিষ্ট ভেদে দ্বিবিধ। যে বৃত্তি কর্মসংস্কার সমূহের দ্বারা ক্লিষ্ট, তাকে
ক্লিষ্টবৃত্তি বলে। যে বৃত্তির মূলে বিবেকজ্ঞান থাকে, তাকে বলে
অক্লিষ্টবৃত্তি। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা অবিদ্যার নাশ হয়। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা
অবিদ্যা নষ্ট হলে যে বিবেকখ্যাতিরূপ বৃত্তি উৎপন্ন হয়, তা মুখ্য
অক্লিষ্টবৃত্তি। যোগমতে ক্লিষ্ট বৃত্তির ছিদ্রে অক্লিষ্ট বৃত্তি এবং
অক্লিষ্ট বৃত্তির ছিদ্রে ক্লিষ্ট বৃত্তি উৎপন্ন হয়।
.
ক্লেশ
থেকেই ক্লিষ্ট শব্দের উৎপত্তি। ক্লিষ্ট মানে ক্লেশপ্রাপ্ত। যোগমতে ক্লেশ
পাঁচ প্রকার। এই পঞ্চক্লেশ যে বৃত্তিগুলির মধ্যে থাকে, তাদেরকেই বলা হয়
ক্লিষ্টবৃত্তি। ক্লেশগুলি দুঃখদায়ক। এবং যোগমতে সব ক্লেশের মূলেই অবিদ্যা
বর্তমান।
.
.
২.৪ : পঞ্চক্লেশ
২.৪ : পঞ্চক্লেশ
যোগমতে পঞ্চক্লেশ হলো- (১) অবিদ্যা, (২)
অস্মিতা, (৩) রাগ, (৪) দ্বেষ ও (৫) অভিনিবেশ। তবে অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও
অভিনিবেশ- এই চারটি ক্লেশের মূল হলো অবিদ্যা।
.
অবিদ্যা :
অবিদ্যা নিজে ক্লেশ এবং অন্যান্য ক্লেশের প্রসবভূমি। যে বস্তু যা নয়, তাকে
সেইরূপে জানাই হলো অবিদ্যা। অনাত্মাতে আত্মার, অনিত্যতে নিত্যের জ্ঞান হলো
অবিদ্যাপ্রসূত। অবিদ্যার ব্যাখ্যায় যোগসূত্রকার পতঞ্জলি বলেছেন-
‘অনিত্যাশুচিদুঃখানাত্মসু নিত্যশুচিসুখাত্মখ্যাতিরবিদ্যা।’- (যোগসূত্র : ২/৫)
অর্থাৎ : অনিত্য, অশুচি, দুঃখকর ও অনাত্ম বিষয়ে যথাক্রমে নিত্য, শুচি, সুখকর ও আত্মস্বরূপতাখ্যাতি হলো অবিদ্যা।
.
অনিত্যকে
নিত্যরূপে জ্ঞান করা যথা স্বর্গবাসীরা অমর অথবা চাঁদ-তারাযুক্ত আকাশ নিত্য
এরূপ জ্ঞান অবিদ্যা। আবার অশুচিকে শুচিরূপে জ্ঞান করাও অবিদ্যা। যথা-
সুন্দরী নারীর অবয়বকে অমৃতের দ্বারা তৈরি বলে জ্ঞান করা। তৃতীয়ত, দুঃখকে
সুখরূপে জ্ঞান করাও অবিদ্যা। যেমন- অন্নগ্রহণ বা পান প্রভৃতিতে সুখের জ্ঞান
করা হলো অবিদ্যা। চতুর্থত, অনাত্মাকে আত্মারূপে জ্ঞান করা হলো অবিদ্যা।
যথা- পুত্র বা সম্পত্তিতে আমি বা আমার জ্ঞান করা। এগুলি সবই ভ্রান্তজ্ঞান,
যা অবিদ্যাপ্রসূত।
উল্লেখ্য, সাধারণ ভ্রান্তজ্ঞানকে যোগীরা অবিদ্যা বলেন না। কিন্তু পারমার্থিক ও যোগসাধনসম্বন্ধীয় জ্ঞানের দ্বারা নাশ্য ভ্রান্তিকেই তাঁরা অবিদ্যা বলেন।
উল্লেখ্য, সাধারণ ভ্রান্তজ্ঞানকে যোগীরা অবিদ্যা বলেন না। কিন্তু পারমার্থিক ও যোগসাধনসম্বন্ধীয় জ্ঞানের দ্বারা নাশ্য ভ্রান্তিকেই তাঁরা অবিদ্যা বলেন।
.
অস্মিতা :
দ্বিতীয় ক্লেশ হলো অস্মিতা। পুরুষ এবং বুদ্ধিকে ভ্রমক্রমে এক জ্ঞান করাই
হলো অস্মিতা নামক ক্লেশ। অস্মিতার ব্যাখ্যায় যোগসূত্রকার বলেন-
‘দৃক্দর্শনশক্তিঃ একাত্মতৈব অস্মিতা।’- (যোগসূত্র : ২/৬)
অর্থাৎ : দৃক্শক্তি ও দর্শনশক্তির একাত্মতার জ্ঞানই হলো অস্মিতা।
.
পুরুষ
বা আত্মা দৃক্শক্তি, বুদ্ধি দর্শনশক্তি। সুতরাং আত্মাকে বুদ্ধির সঙ্গে
অভিন্ন বলে মনে করাই হলো অস্মিতা। অস্মিতা ক্লেশের ফলে প্রকৃতির গুণবশত যা
ঘটে, অহঙ্কারের বশে নিঃসঙ্গ ও উদাসীন পুরুষ বা আত্মা নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা
বলে মনে করে।
.
রাগ : তৃতীয় ক্লেশ হলো রাগ। সুখ ভোগের বাসনা ও সুখ লাভের আসক্তি হলো রাগ। রাগের ব্যাখ্যায় যোগসূত্রে বলা হয়-
‘সুখানুশয়ী রাগঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৭)
অর্থাৎ : সুখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো রাগ।
.
নির্লিপ্ত
আত্মাকে অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের প্রতি আরোপ করে ইন্দ্রিয়সুখকেই আত্মার সুখ মনে
করে লুব্ধ হওয়া এবং তৃষ্ণার্ত হওয়া হলো রাগ। অস্মিতা থেকে উৎপন্ন হয় রাগ
ক্লেশ। রাগকে তৃষ্ণাও বলা হয়।
.
দ্বেষ :
চতুর্থ ক্লেশ হলো দ্বেষ। দ্বেষ হলো রাগের বিপরীত। দুঃখজনক বস্তুর প্রতি যে
বিরাগ বা বিতৃষ্ণা, তাকেই বলে দ্বেষ। যোগসূত্রে দ্বেষের পরিচয়ে বলা হয়-
‘দুঃখানুশয়ী দ্বেষঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৮)
অর্থাৎ : দুঃখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো দ্বেষ।
.
দ্বেষ
হলো দুঃখের সাধনগুলির প্রতি প্রতিঘাত ও হননের ইচ্ছা এবং ক্রোধের অনুভূতি।
এখানেও রাগের মতো অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আত্মার ভ্রান্ত একীকরণ এবং
অকর্তা আত্মাকে কর্তাজ্ঞান করার জন্য এই ক্লেশ উৎপন্ন হয়।
.
অভিনিবেশ : পঞ্চম ক্লেশ অভিনিবেশ হলো একপ্রকার সহজাত ক্লেশ। অভিনিবেশ অর্থ মৃত্যুভয়। যোগসূত্রে অভিনিবেশের পরিচয় দিতে গিয়ে যোগসূত্রকার বলেন-
‘স্বরসবাহী বিদুষোহপি তথারূঢ়ো অভিনিবেশঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৯)
অর্থাৎ : অবিদ্বানের ন্যায় বিদ্বানেরও যে সহজাত ও প্রসিদ্ধক্লেশ, তাই অভিনিবেশ।
.
মরণের
প্রতি আমাদের যে ভীতি তাকেই বলে অভিনিবেশ। চিত্তে দ্বেষ বদ্ধমূল থাকায়
অভিনিবেশ নামক পঞ্চম ক্লেশ উৎপন্ন হয়। জগতে সকল প্রকার দুঃখের মধ্যে
মৃত্যু-ভীতিজনক যে দুঃখ, তা-ই সব থেকে তীব্র। বার বার মরণদুঃখ ভোগ করায়
চিত্তে একপ্রকার সংস্কার বা বাসনা বদ্ধমূল হয়। ঐ সংস্কারকে বলে স্বরস। এই
স্বরসের জন্য জ্ঞানী ও অ-জ্ঞানী সকলেরই মরণের প্রতি একটি ভীতি জন্মায়। এই
ভীতিহেতু মরণের প্রতি যে বিতৃষ্ণা-বৃত্তির উদয় হয়, তাকেই অভিনিবেশ বলে।
বস্তুত জীবের ‘মরণ-অভিজ্ঞতা’ জীবনকালে হয় না। কিন্তু যোগমতে, জন্মান্তরের
মরণ-অভিজ্ঞতার সংস্কার জীবের চিত্তে থাকে বলেই মরণ-দুঃখের প্রতি অভিনিবেশ
ক্লেশ থাকে।
.
যোগশাস্ত্র মতে, এই অস্মিতাদি পঞ্চক্লেশের চারটি অবস্থা- প্রসুপ্ত, তনু, বিচ্ছিন্ন ও উদর।
যখন ক্লেশ বীজ বা শক্তিরূপে চিত্তে অবস্থান, আলম্বন বা বিষয় পেলেই পুনরায় উজ্জীবিত হয়, তাকে বলে ক্লেশের প্রসুপ্ত অবস্থা। বিদেহলয় ও প্রকৃতিলয় যোগীদের চিত্তে যে ক্লেশ থাকে, তা বীজের মধ্যে বৃক্ষশক্তি যেভাবে প্রসুপ্ত থাকে সেইভাবে প্রসুপ্ত থাকে। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুরের উদ্গম হয়, তেমনি প্রসুপ্ত ক্লেশ নিজে নিজে বিষয় লাভ করলে পুনরায় অভিব্যক্ত হয়।
যখন ক্লেশ ক্রিয়াযোগের দ্বারা ক্ষীণ হয়, তখন তা সংস্কাররূপে চিত্তে অবস্থান করে, তাকে বলে ক্লেশের ‘তনু’ অবস্থা। দগ্ধ বীজের যেমন কোন শক্তি থাকে না, তেমনি তনুক্লেশেরও কোন শক্তি থাকে না।
আবার অন্য ক্লেশের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলে অন্তরালে যে ক্লেশ থাকে, তাকে বলা হয় বিচ্ছিন্ন ক্লেশ। আর ব্যাপারযুক্ত ক্লেশ অর্থাৎ যে ক্লেশ পরিপূর্ণ অবস্থায় থাকে, বলা হয় উদার ক্লেশ। যেমন ক্রোধের সময় দ্বেষ উদার হয় এবং রাগ বিচ্ছিন্ন হয়। আবার রাগ তনু হয়ে যায় যদি বৈরাগ্য অভ্যাস করা হয়। যতক্ষণ সম্পূর্ণ ভেদজ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সংস্কাররূপ সকল ক্লেশই প্রসুপ্ত অবস্থায় থাকে।
যখন ক্লেশ বীজ বা শক্তিরূপে চিত্তে অবস্থান, আলম্বন বা বিষয় পেলেই পুনরায় উজ্জীবিত হয়, তাকে বলে ক্লেশের প্রসুপ্ত অবস্থা। বিদেহলয় ও প্রকৃতিলয় যোগীদের চিত্তে যে ক্লেশ থাকে, তা বীজের মধ্যে বৃক্ষশক্তি যেভাবে প্রসুপ্ত থাকে সেইভাবে প্রসুপ্ত থাকে। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুরের উদ্গম হয়, তেমনি প্রসুপ্ত ক্লেশ নিজে নিজে বিষয় লাভ করলে পুনরায় অভিব্যক্ত হয়।
যখন ক্লেশ ক্রিয়াযোগের দ্বারা ক্ষীণ হয়, তখন তা সংস্কাররূপে চিত্তে অবস্থান করে, তাকে বলে ক্লেশের ‘তনু’ অবস্থা। দগ্ধ বীজের যেমন কোন শক্তি থাকে না, তেমনি তনুক্লেশেরও কোন শক্তি থাকে না।
আবার অন্য ক্লেশের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলে অন্তরালে যে ক্লেশ থাকে, তাকে বলা হয় বিচ্ছিন্ন ক্লেশ। আর ব্যাপারযুক্ত ক্লেশ অর্থাৎ যে ক্লেশ পরিপূর্ণ অবস্থায় থাকে, বলা হয় উদার ক্লেশ। যেমন ক্রোধের সময় দ্বেষ উদার হয় এবং রাগ বিচ্ছিন্ন হয়। আবার রাগ তনু হয়ে যায় যদি বৈরাগ্য অভ্যাস করা হয়। যতক্ষণ সম্পূর্ণ ভেদজ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সংস্কাররূপ সকল ক্লেশই প্রসুপ্ত অবস্থায় থাকে।
.
.
২.৫ : চিত্তবৃত্তির প্রকারভেদ
২.৫ : চিত্তবৃত্তির প্রকারভেদ
যোগশাস্ত্রে
পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই পঞ্চপ্রকার বৃত্তি হলো-
(১) প্রমাণ, (২) বিপর্যয়, (৩) বিকল্প, (৪) নিদ্রা ও (৫) স্মৃতি।
এদের প্রত্যেকটি আবার ক্লিষ্ট বা অক্লিষ্ট হতে পারে। চিত্তের ভোগের প্রতি প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তির স্বভাব অনুযায়ী এই বৃত্তিগুলি ক্লিষ্ট বা অক্লিষ্ট হয়। যেমন রাগযুক্ত অথবা দ্বেষযুক্ত প্রত্যক্ষাদি প্রমাণবৃত্তি ক্লিষ্ট, এবং যা রাগদ্বেষের নিবৃত্তিকারক প্রমাণবৃত্তি তা অক্লিষ্ট। অর্থাৎ প্রমাণাদি বৃত্তি যে বিষয়ক হবে ও যেদিকে প্রযুক্ত হবে সে অনুযায়ী তা ক্লিষ্ট বা ক্লেশবর্ধক এবং অক্লিষ্ট বা ক্লেশনিবৃত্তিকারক বলে পরিগণিত হবে।
এদের প্রত্যেকটি আবার ক্লিষ্ট বা অক্লিষ্ট হতে পারে। চিত্তের ভোগের প্রতি প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তির স্বভাব অনুযায়ী এই বৃত্তিগুলি ক্লিষ্ট বা অক্লিষ্ট হয়। যেমন রাগযুক্ত অথবা দ্বেষযুক্ত প্রত্যক্ষাদি প্রমাণবৃত্তি ক্লিষ্ট, এবং যা রাগদ্বেষের নিবৃত্তিকারক প্রমাণবৃত্তি তা অক্লিষ্ট। অর্থাৎ প্রমাণাদি বৃত্তি যে বিষয়ক হবে ও যেদিকে প্রযুক্ত হবে সে অনুযায়ী তা ক্লিষ্ট বা ক্লেশবর্ধক এবং অক্লিষ্ট বা ক্লেশনিবৃত্তিকারক বলে পরিগণিত হবে।
.
(১) প্রমাণ :
প্রমার করণকে প্রমাণ বলে। প্রমাণের দ্বারা অনধিগত যথার্থ বিষয়ের নিশ্চয় হয়। অর্থাৎ, প্রমাণ থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করি। প্রমাণ অনধিগত বিষয়ক হওয়ায়, বোঝা যায়, প্রমাণ স্মৃতি থেকে ভিন্ন। যোগদর্শনে স্বীকৃত প্রমাণ তিনপ্রকার- (১) প্রত্যক্ষ, (২) অনুমান ও (৩) আগম।
প্রমার করণকে প্রমাণ বলে। প্রমাণের দ্বারা অনধিগত যথার্থ বিষয়ের নিশ্চয় হয়। অর্থাৎ, প্রমাণ থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করি। প্রমাণ অনধিগত বিষয়ক হওয়ায়, বোঝা যায়, প্রমাণ স্মৃতি থেকে ভিন্ন। যোগদর্শনে স্বীকৃত প্রমাণ তিনপ্রকার- (১) প্রত্যক্ষ, (২) অনুমান ও (৩) আগম।
.
প্রত্যক্ষ :
ইন্দ্রিয় প্রণালীর দ্বারা বাহ্য ও মানস বিষয়ের যে বৃত্তি তা-ই প্রত্যক্ষ।
বাহ্যবস্তুর দ্বারা ইন্দ্রিয় উপরঞ্জিত হলে ইন্দ্রিয় প্রণালীর দ্বারা চিত্তে
আগত বিষয়ের যে বৃত্তি উৎপন্ন হয় তাকেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে। সহজ কথায়,
ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভ হয় তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান।
প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রধানত বিশেষ বিষয়ক। কিন্তু অনুমান এবং আগম প্রমাণের বিষয় সামান্য। বিশেষ বিষয় বলতে আমরা বুঝি যার মূর্তি ও ব্যবধি আছে। অর্থাৎ বাস্তব গুণসকল। আর সামান্য বিষয় হলো জাতি, সত্তাদি। প্রত্যেক বস্তুর অন্য সব বস্তুর থেকে পৃথক যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ প্রভৃতি গুণ, তাই হলো তার মূর্তি। অপরপক্ষে ব্যবধি অর্থ হলো আকার। যে কোন একটি বস্তুর, যেমন একটি বই-এর মূর্তি ও আকার শত শত শব্দের সাহায্যেও যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু স্বচক্ষে দেখলে তৎক্ষণাৎ তার জ্ঞান হয়। এজন্যেই অন্ধকে রঙের বর্ণনা দিয়ে রঙের জ্ঞান অথবা বধিরকে শব্দের বর্ণনা দিয়ে শব্দের জ্ঞান দেওয়া যায় না। এ কারণে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ প্রধানত বিশেষ বিষয়ক। তবে প্রত্যক্ষে যে সামান্যজ্ঞান একেবারেই থাকে না, তা নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রাধান্য থাকে বিশেষজ্ঞানের।
প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রধানত বিশেষ বিষয়ক। কিন্তু অনুমান এবং আগম প্রমাণের বিষয় সামান্য। বিশেষ বিষয় বলতে আমরা বুঝি যার মূর্তি ও ব্যবধি আছে। অর্থাৎ বাস্তব গুণসকল। আর সামান্য বিষয় হলো জাতি, সত্তাদি। প্রত্যেক বস্তুর অন্য সব বস্তুর থেকে পৃথক যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ প্রভৃতি গুণ, তাই হলো তার মূর্তি। অপরপক্ষে ব্যবধি অর্থ হলো আকার। যে কোন একটি বস্তুর, যেমন একটি বই-এর মূর্তি ও আকার শত শত শব্দের সাহায্যেও যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু স্বচক্ষে দেখলে তৎক্ষণাৎ তার জ্ঞান হয়। এজন্যেই অন্ধকে রঙের বর্ণনা দিয়ে রঙের জ্ঞান অথবা বধিরকে শব্দের বর্ণনা দিয়ে শব্দের জ্ঞান দেওয়া যায় না। এ কারণে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ প্রধানত বিশেষ বিষয়ক। তবে প্রত্যক্ষে যে সামান্যজ্ঞান একেবারেই থাকে না, তা নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রাধান্য থাকে বিশেষজ্ঞানের।
.
অনুমান :
প্রত্যক্ষের দ্বারা অগৃহীত কিন্তু হেতুগম্য বিষয়ের জ্ঞান হলো অনুমান। কোন
স্থানে অগ্নি যদি অগৃহ্য বা আড়াল হয় কিন্তু ধূমের সঙ্গে অগ্নির
ব্যাপ্তিজ্ঞান যদি থাকে তাহলে ধূম প্রত্যক্ষ করে অগ্নির যথার্থজ্ঞান হতে
পারে। এরূপ প্রমাণই অনুমান প্রমাণ। এজন্য অনুমানকে হেতু-পূর্ব বৃত্তি বলা
হয়। অনুমান বৃত্তিতে সামান্যজ্ঞানেরই প্রাধান্য।
.
আগম :
কোন ব্যক্তির বাক্যে শ্রোতার যদি সংশয়হীন নিশ্চয়জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহলে
সেই জ্ঞানকে বলা হয় আগম। ঐরূপ বক্তাকে বলা হয় আপ্ত। যথার্থবক্তা বা আপ্তের
দ্বারা দৃষ্ট বা অনুমিত বিষয় যখন বাক্যের দ্বারা শ্রোতার প্রমাজ্ঞান উৎপন্ন
করে, তখন ঐ প্রমা-জ্ঞানকে বলা হয় আগম। এককথায় শব্দ শুনে শব্দার্থ-বিষয়ক যে
বৃত্তি শ্রোতার চিত্তে উৎপন্ন হয়, তা-ই আগম।
.
(২) বিপর্যয় :
বলা হয়, ইন্দ্রিয় বৈকল্যের জন্য প্রত্যক্ষজ্ঞান ভ্রান্ত হতে পারে। সাধ্য ও হেতুর সম্বন্ধজ্ঞানের দোষ ঘটলে অনুমানের দোষ হয়। আবার আগমের বক্তা যদি অজ্ঞ বা প্রবঞ্চক হন তবে আগমও দুষ্ট হয়। এ ধরনের ভ্রান্ত জ্ঞানকে বলা হয় বিপর্যয়। বিপর্যয়ের লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার পতঞ্জলি বলেন-
বলা হয়, ইন্দ্রিয় বৈকল্যের জন্য প্রত্যক্ষজ্ঞান ভ্রান্ত হতে পারে। সাধ্য ও হেতুর সম্বন্ধজ্ঞানের দোষ ঘটলে অনুমানের দোষ হয়। আবার আগমের বক্তা যদি অজ্ঞ বা প্রবঞ্চক হন তবে আগমও দুষ্ট হয়। এ ধরনের ভ্রান্ত জ্ঞানকে বলা হয় বিপর্যয়। বিপর্যয়ের লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার পতঞ্জলি বলেন-
‘বিপর্যয়ো মিথ্যাজ্ঞানমতদ্রুপপ্রতিষ্ঠম্’- (যোগসূত্র : ১/৮)
অর্থাৎ : বিপর্যয় হলো অতদ্রুপ, অপ্রতিষ্ঠ মিথ্যাজ্ঞান।
.
সোজাকথায়,
যে কোন প্রকার ভ্রান্তজ্ঞানই হলো বিপর্যয়, যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। রজ্জুতে
সর্পভ্রম কালে বস্তু প্রকৃতপক্ষে রজ্জু, কিন্তু জ্ঞান তদ্রূপ হয় না।
রজ্জুর যথার্থজ্ঞান উৎপন্ন হলে রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান খণ্ডিত হয়। এজন্য বলা
হয় প্রমাণের বিষয় যথাভূত, কিন্তু বিপর্যয়ের বিষয় তার বিপরীত।
.
(৩) বিকল্প :
অনেক শব্দ বা বাক্য আছে যাদের অভিধেয়ের বাস্তব কোনও সত্তা নেই, অথচ ঐ সব শব্দ বা বাক্য শুনলে একপ্রকার অস্ফুট জ্ঞানবৃত্তি আমাদের চিত্তে হয়। ঐ বৃত্তিগুলিই বিকল্পবৃত্তি। বিকল্পের লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার বলেন-
(৩) বিকল্প :
অনেক শব্দ বা বাক্য আছে যাদের অভিধেয়ের বাস্তব কোনও সত্তা নেই, অথচ ঐ সব শব্দ বা বাক্য শুনলে একপ্রকার অস্ফুট জ্ঞানবৃত্তি আমাদের চিত্তে হয়। ঐ বৃত্তিগুলিই বিকল্পবৃত্তি। বিকল্পের লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার বলেন-
‘শব্দ-জ্ঞানানুপাতী বস্তুশূন্যো বিকল্পঃ’- (যোগসূত্র : ১/৯)
অর্থাৎ : শব্দজ্ঞানানুপাতী ও বস্তুশূন্য অর্থাৎ অবাস্তব পদার্থ-বিষয়ক বৃত্তিই বিকল্প।
.
যেমন
আকাশকুসুম কোন বাস্তব পদার্থ নয়। ‘আকাশ’ ও ‘কুসুম’ শব্দ দুটিকে একত্রিত
করে একটি পৃথক আকাসকুসুমের যে কল্পনা, সেই কল্পনাই হলো বিকল্প। বস্তুর
অভাবে যেমন বিকল্প হয় তেমনি একপ্রকার বস্তুর স্থলে দু-প্রকার বৃত্তি এবং
একপ্রকার বৃত্তির স্থলে দু’প্রকার বস্তুর বিকল্প হয়। এই বিকল্প শব্দ জন্য।
যোগমতে, আত্মা ও চৈতন্য এক হওয়া সত্ত্বেও যখন ‘আমার চৈতন্য’ এরূপ ব্যবহার
করা হয়, তখন আমি ও চৈতন্য বিষয়ক দুটি পৃথক বৃত্তি জন্মায়। এরূপ বৃত্তিই
বিকল্পবৃত্তি। বিকল্প বস্তুস্বরূপের অপেক্ষা করে না। তাই তা বিপর্যয় থেকে
ভিন্ন। আবার বিকল্প যেহেতু বস্তুশূন্য সেহেতু তা প্রমাণ নয়।
.
(৪) নিদ্রা :
জাগ্রত ও স্বপ্নের অভাবে তমোমূলক যে চিত্তবৃত্তি তা-ই নিদ্রা। সেই নিদ্রা হলো স্বপ্নহীন সুষুপ্তি। নিদ্রার লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার বলেন-
(৪) নিদ্রা :
জাগ্রত ও স্বপ্নের অভাবে তমোমূলক যে চিত্তবৃত্তি তা-ই নিদ্রা। সেই নিদ্রা হলো স্বপ্নহীন সুষুপ্তি। নিদ্রার লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার বলেন-
‘অভাবপ্রত্যয়ালম্বনা বৃত্তিঃ নিদ্রা’- (যোগসূত্র : ১/১০)
অর্থাৎ : অভাবপ্রত্যয়ের আলম্বনা বৃত্তিই নিদ্রা।
.
অভাবের
যে প্রত্যয় তাকে অবলম্বন করে যে বৃত্তি হয় তাকেই নিদ্রা বলে। অভাব অর্থে
জাগ্রত এবং স্বপ্নের অভাবকেই বোঝানো হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে,
চিত্তবৃত্তিমাত্রই কোন না কোন প্রকার প্রত্যয়। অথচ নিদ্রা হলো প্রত্যয়ের
অভাব। তাহলে নিদ্রাকে চিত্তবৃত্তি বলা হয় কিভাবে ?
উত্তরে যোগভাষ্যকার ব্যাসদেব বলেন, নিদ্রাকালে যদি কোন প্রত্যয়ই না থাকতো তাহলে নিদ্রাভঙ্গের পর নিদ্রাকালীন তামসভাবের স্মরণ হতো না। অথচ নিদ্রাভঙ্গের পর যেহেতু নিদ্রাকালীন তামসভাবের স্মরণ হয়, সেহেতু নিদ্রাকালেও প্রত্যয় হয়, এটা স্বীকার করতে হবে। সংস্কার ব্যতীত স্মরণ হয় না, আবার পূর্বানুভব ব্যতীত সংস্কার হয় না। নিদ্রার যেহেতু স্মরণ হয়, সেহেতু নিদ্রা হলো অনুভূতি বিশেষ। নিদ্রার পূর্বে শরীরের যে আচ্ছন্নভাব বোধ হয়, তাই তমঃ। সেই তমোগুণই এতো গাঢ়তর হয়ে নিদ্রায় পর্যবসিত হয় যে, জাগরিত হয়েও বুঝতে পারে না কোথায় আছে। এই তমোগুণের ফলে সকল বিষয়ের সম্পর্কে আমাদের প্রত্যয়ের অভাব ঘটে। এই অভাব বা তমঃ যে বৃত্তির বিষয়ীভূত, চিত্তের সেই বৃত্তির নামই নিদ্রা।
উত্তরে যোগভাষ্যকার ব্যাসদেব বলেন, নিদ্রাকালে যদি কোন প্রত্যয়ই না থাকতো তাহলে নিদ্রাভঙ্গের পর নিদ্রাকালীন তামসভাবের স্মরণ হতো না। অথচ নিদ্রাভঙ্গের পর যেহেতু নিদ্রাকালীন তামসভাবের স্মরণ হয়, সেহেতু নিদ্রাকালেও প্রত্যয় হয়, এটা স্বীকার করতে হবে। সংস্কার ব্যতীত স্মরণ হয় না, আবার পূর্বানুভব ব্যতীত সংস্কার হয় না। নিদ্রার যেহেতু স্মরণ হয়, সেহেতু নিদ্রা হলো অনুভূতি বিশেষ। নিদ্রার পূর্বে শরীরের যে আচ্ছন্নভাব বোধ হয়, তাই তমঃ। সেই তমোগুণই এতো গাঢ়তর হয়ে নিদ্রায় পর্যবসিত হয় যে, জাগরিত হয়েও বুঝতে পারে না কোথায় আছে। এই তমোগুণের ফলে সকল বিষয়ের সম্পর্কে আমাদের প্রত্যয়ের অভাব ঘটে। এই অভাব বা তমঃ যে বৃত্তির বিষয়ীভূত, চিত্তের সেই বৃত্তির নামই নিদ্রা।
.
(৫) স্মৃতি :
স্মৃতির লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে যোগসূত্রকার বলেন-
(৫) স্মৃতি :
স্মৃতির লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে যোগসূত্রকার বলেন-
‘অনুভূত বিষয়াসম্প্রমোষঃ স্মৃতি’- (যোগসূত্র : ১/১১)
অর্থাৎ : অনুভূত বিষয়ের অসম্প্রমোষ অর্থাৎ অনুভূতি বিষয়ের অনুরূপ আকারযুক্ত যে বৃত্তি তা-ই স্মৃতি।
.
অসম্প্রমোষ
অর্থ হলো নিজস্বমাত্রের গ্রহণ এবং পরস্বের অগ্রহণ। বিষয়ের অনুভব যে পরিমাণ
হয়, স্মৃতি তার চেয়ে অধিক পরিমাণ হতে পারে না। আবার অগৃহীত বা অননুভূত
বিষয়ের স্মৃতি হতে পারে না। এজন্যেই স্মৃতি প্রমাণের অন্তর্গত নয়।
স্মৃতির দ্বারা যেমন ঘটাদি বিষয়ের স্মরণ হয় তেমনি ঘটাদি বিষয়ের জ্ঞানেরও স্মরণ হয়। আমরা জাগরিত অবস্থায় যা কিছু দেখি বা অনুভব করি, তাদের সংস্কার চিত্তে অবস্থান করে। কোন উদ্বোধকের উপস্থিতিতে সেই সংস্কার চিত্তপটে উদিত হয় এবং পূর্বানুভূত বস্তুর পুনরুদ্রেক ঘটায়। সংস্কার থেকে উৎপন্ন এই সকল চিত্তবৃত্তিই স্মৃতি।
স্মৃতির দ্বারা যেমন ঘটাদি বিষয়ের স্মরণ হয় তেমনি ঘটাদি বিষয়ের জ্ঞানেরও স্মরণ হয়। আমরা জাগরিত অবস্থায় যা কিছু দেখি বা অনুভব করি, তাদের সংস্কার চিত্তে অবস্থান করে। কোন উদ্বোধকের উপস্থিতিতে সেই সংস্কার চিত্তপটে উদিত হয় এবং পূর্বানুভূত বস্তুর পুনরুদ্রেক ঘটায়। সংস্কার থেকে উৎপন্ন এই সকল চিত্তবৃত্তিই স্মৃতি।
.
যোগমতে
এই পঞ্চপ্রকার বৃত্তির অতিরিক্ত কোন বৃত্তি নেই। উল্লেখ্য, চিত্তের নানা
বৃত্তি হলেও চিত্ত নানা নয়, এক। আবার দ্রষ্টা পুরুষ নানাবৃত্তির প্রকাশক
হলেও বিষয়ের নানাত্ব পুরুষে নানাত্ব বা পরিণাম আনে না। কারণ নানাত্ব থাকে
ইন্দ্রিয়ে ও অন্তকরণে। এই চিত্তবৃত্তির নিরোধ হবে কিভাবে ? এর উত্তরে
যোগসূত্রকার অভ্যাস ও বৈরাগ্যের কথা বলেছেন। অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা
উক্ত পঞ্চপ্রকার চিত্তবৃত্তিসমূহের নিরোধই হলো যোগ। বৃত্তির নিরোধের অর্থ
হলো বৃত্তিশূন্যতা। অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্ত বৃত্তিশূন্য হয়।
যোগমতে, বৃত্তিমুক্ত চিত্ত শান্ত ও স্থিত।
…
(চলবে…)
…
[ আগের পর্ব : ভূমিকা ] [*] [ পরের পর্ব : চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি ]
…
…
(চলবে…)
…
[ আগের পর্ব : ভূমিকা ] [*] [ পরের পর্ব : চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি ]
…
No comments:
Post a Comment