.
| যোগ দর্শন-০৩ : চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি |
রণদীপম বসু
…
৩.০ : চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি
…
যোগদর্শনে চিত্তের কতগুলি বিকারকে একত্রে চিত্ত বলা হয়। এই বিকারগুলি হলো মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার। এবং যোগমতে চিত্তবৃত্তির নিরোধকে যোগ বলা হয়েছে। যোগসূত্রকার পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে তাই বলেন-
| যোগ দর্শন-০৩ : চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি |
রণদীপম বসু
…
৩.০ : চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি
…
যোগদর্শনে চিত্তের কতগুলি বিকারকে একত্রে চিত্ত বলা হয়। এই বিকারগুলি হলো মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার। এবং যোগমতে চিত্তবৃত্তির নিরোধকে যোগ বলা হয়েছে। যোগসূত্রকার পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে তাই বলেন-
‘যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ’- (যোগসূত্র)
অর্থাৎ : চিত্তের বিভিন্ন প্রকারের বৃত্তির নিরোধই যোগ।
এই
যোগ বা চিত্তবৃত্তির নিরোধ কিভাবে হবে ? যোগশাস্ত্রকারদের মতে অভ্যাস ও
বৈরাগ্যের দ্বারাই চিত্তবৃত্তির নিরোধ হয়। এ বক্তব্যের প্রতিফলন
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও দেখা যায়-
‘অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৬/৩৫)
‘অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ।
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৬/৩৬)
অর্থাৎ : হে মহাবাহো, মন যে দুর্নিরোধ ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা তাকে সংযত করা যায়। (৬/৩৫)
অসংযত ব্যক্তির পক্ষে সমাধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু পুনঃ পুনঃ যত্নশীল ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্যসাধন দ্বারা এই সমাধি লাভ করতে পারেন। (৬/৩৬)
.
সাংখ্য-যোগ
দার্শনিকগণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এই ত্রিতাপ ব্যাপী দুঃখের উপস্থিতি
উপলব্ধি করে জগতকে দুঃখময় বলে অভিহিত করেন। এই ত্রিতাপ হলো- তাপ-দুঃখ,
পরিণাম-দুঃখ এবং সংস্কার-দুঃখ। সংস্কার-দুঃখ অতীত, তাপ-দুঃখ বর্তমান ও
পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত।
.
জন্ম
মৃত্যু তাপ জরা ইত্যাদিই বর্তমানের তাপ-দুঃখ। জগতে সুখ ও দুঃখ দুটোই আছে
বলে সাধারণ ধারণা। কিন্তু যোগশাস্ত্রকারদের মতে চিরায়ত সুখপ্রদ এমন কোন
বস্তু জগতে নেই। জগৎ যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি সুখপ্রদ বস্তুও পরিবর্তনশীল।
সুখপ্রদ বস্তু আপাতত সুখের কারণ হলেও পরিণামে বিয়োগজনিত দুঃখেরই কারণ। সুখ
ভোগের তৃষ্ণা বৃদ্ধির জন্য পরিণামে দুঃখ বাড়ে। এটাই পরিণাম-দুঃখ। সে কারণে
পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত।
সুখ ও দুঃখের অনুভূতির ফলে জীবের মনে সংস্কার উৎপন্ন হয়। সুখানুভূতি সুখ সংস্কারের এবং দুঃখানুভূতি দুঃখ সংস্কারের সৃষ্টি করে। যোগশাস্ত্রকারগণ বাসনাকে সংস্কার মনে করেন। তাই সুখ-সংস্কারের ফলে জীব বারবার সুখপ্রদ বস্তুর প্রতি আসক্ত হয় এবং দুঃখ-সংস্কারের ফলে দুঃখপ্রদ বস্তুর প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়। এর ফলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করে। সংস্কার হতে এই যে দুঃখের সৃষ্টি তা-ই সংস্কার-দুঃখ। এসব দুঃখের নিবৃত্তিই হলো জীবের পরম পুরুষার্থ। এর উপায়ই হলো চিত্তবৃত্তি নিরোধ বা যোগ। ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে তার নিরোধ করা সম্ভব বলে যোগশাস্ত্রে স্বীকৃত।
সুখ ও দুঃখের অনুভূতির ফলে জীবের মনে সংস্কার উৎপন্ন হয়। সুখানুভূতি সুখ সংস্কারের এবং দুঃখানুভূতি দুঃখ সংস্কারের সৃষ্টি করে। যোগশাস্ত্রকারগণ বাসনাকে সংস্কার মনে করেন। তাই সুখ-সংস্কারের ফলে জীব বারবার সুখপ্রদ বস্তুর প্রতি আসক্ত হয় এবং দুঃখ-সংস্কারের ফলে দুঃখপ্রদ বস্তুর প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়। এর ফলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করে। সংস্কার হতে এই যে দুঃখের সৃষ্টি তা-ই সংস্কার-দুঃখ। এসব দুঃখের নিবৃত্তিই হলো জীবের পরম পুরুষার্থ। এর উপায়ই হলো চিত্তবৃত্তি নিরোধ বা যোগ। ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে তার নিরোধ করা সম্ভব বলে যোগশাস্ত্রে স্বীকৃত।
.
যোগমতে,
বৈরাগ্য দু’প্রকার- বশীকার বা অপর এবং পর বা ধর্মমেষ। ভোগের বিষয়গুলিকে
দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা- দৃষ্ট অর্থাৎ যা সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতায় গম্য এবং
আনুশ্রবিক অর্থাৎ শ্রুতির উপর আস্থার ফলে যে বিষয়গুলি সম্বন্ধে আমাদের
জ্ঞান ও আকর্ষণ হয়। দৃষ্ট বিষয়গুলি হলো খাদ্য, পানীয়, কাপড়, শয্যা, বাড়ি,
রথ বা গাড়ি ইত্যাদি। আনুশ্রবিক বিষয় হলো যথাক্রমে স্বর্গ, প্রকৃতিলয়,
বিদেহলয় ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি আপাতমনোরম হলেও এরা ত্রিতাপের আকার।
.
এই
বিষয়গুলি যখন আমাদের আয়ত্তে আসে তখন যদি তত্ত্বজ্ঞানের ফলে আমরা তাদের দোষ
দেখে তাদের প্রতি বিরক্ত বা নিরাসক্ত হয়ে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের চিত্তে
বশীকার বৈরাগ্য হয়েছে বলে বোঝা যাবে। পরবৈরাগ্য হলো আরও উচ্চস্তরের
অবস্থা। যে জ্ঞান বা বুদ্ধির দ্বারা পুরুষতত্ত্বের সাক্ষাৎকার হয়, তাকে
অগ্র্যাবুদ্ধি বা চরমজ্ঞান বলে। পুরুষ-সাক্ষাৎকার হলে ত্রিগুণাপ্রকৃতি থেকে
আত্মা বা পুরুষের ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হয় এবং তার ফলে দুঃখের
আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। পরবৈরাগ্যের ফলও দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি।
পরবৈরাগ্যে প্রবৃত্তির আত্যন্তিক নাশ হয় এবং খ্যাতি বা জ্ঞানবিষয়েও বৈরাগ্য
দেখা যায়।
.
চিত্তের
বৃত্তিগুলির পরিপূর্ণ লয় বা নিরোধই মূলত সমাধি অবস্থা। যোগদর্শন মতে, সহজ
বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকেই চিত্ত সমাধি স্তরে উন্নীত হয়। চিত্তের সহজ বা
স্বাভাবিক অবস্থাকে বলা হয় চিত্তভূমি। চিত্তভূমি পাঁচ প্রকার। যথা-
ক্ষিপ্ত, মূঢ়, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র এবং নিরুদ্ধ। সকল জীবের চিত্তই স্থূলত এই
পাঁচ অবস্থায় থাকে। যোগমতে এই পঞ্চবিধ চিত্তভূমির শেষোক্ত দুটি ভূমি অর্থাৎ
একাগ্র ও নিরুদ্ধ অবস্থাই যোগ সাধনার অনুকূল। তবে এই দুই ভূমি যোগানুকূল
হলেও যোগপ্রক্রিয়া অতি জটিল। একাগ্র অবস্থায় বিষয়মাত্র অবশিষ্ট থাকায়
চিত্তের পরিপূর্ণ লয় সম্ভব হয় না। নিরুদ্ধ অবস্থায় চিত্তের পরিপূর্ণ লয় হয়
এবং পুরুষ স্বস্বরূপে অবস্থান করে। একাগ্র অবস্থা থেকে চিত্তের পূর্ণ লয়ের
অবস্থা পর্যন্ত যোগের অনেকগুলি পর্যায় বর্তমান। যোগের বিভিন্ন পর্যায়
অনুযায়ী যোগের নানা প্রকারভেদ যোগদর্শনে স্বীকৃত হয়েছে।
.
অভ্যাস
ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তি নিরোধের পর্যায় অনুযায়ী যোগ বা সমাধিকে
প্রধাণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ও (২) অসম্প্রজ্ঞাত
সমাধি।
.
(১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি
যোগশাস্ত্রমতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিগুলি নিরুদ্ধ হলে প্রথমে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়স্রোত মন্দীভূত হয় এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেকস্রোত উদ্ঘাটিত হয়। এই উপায়দ্বয়ের দ্বারা প্রথম যে যোগ বা সমাধিপ্রাপ্তি ঘটে তাকেই সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় একই বিষয়াকারে বৃত্তি দীর্ঘকাল ধরে একাগ্র চিত্তভূমিতে অবস্থান করে। ‘সম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সম্যক্ বা প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত। এ অবস্থায় ধ্যেয় বস্তুকে সম্যক্ ভাবে জানা যায় বলে এই সমাধিকে সম্প্রজ্ঞাত বলে। এ বিষয়ে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
(১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি
যোগশাস্ত্রমতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিগুলি নিরুদ্ধ হলে প্রথমে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়স্রোত মন্দীভূত হয় এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেকস্রোত উদ্ঘাটিত হয়। এই উপায়দ্বয়ের দ্বারা প্রথম যে যোগ বা সমাধিপ্রাপ্তি ঘটে তাকেই সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় একই বিষয়াকারে বৃত্তি দীর্ঘকাল ধরে একাগ্র চিত্তভূমিতে অবস্থান করে। ‘সম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সম্যক্ বা প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত। এ অবস্থায় ধ্যেয় বস্তুকে সম্যক্ ভাবে জানা যায় বলে এই সমাধিকে সম্প্রজ্ঞাত বলে। এ বিষয়ে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতারূপানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ’- (যোগসূত্র : ১/১৭)
অর্থাৎ : বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা এই ভাবচতুষ্টয়ানুগত সমাধি হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
.
যোগাভ্যাসের
প্রাথমিক স্তরে কোন স্থূল দেবমূর্তি বা ভৌতিক পদার্থকে অবলম্বন করে অগ্রসর
হতে হয়। স্থূলবস্তু থেকেই ক্রমশ সূক্ষ্ম বস্তুর দিকে চিত্ত প্রবাহিত হয়।
তাই যোগমতে ধ্যেয় বা ভাব্য বস্তু দ্বিবিধ- স্থূল ও সূক্ষ্ম। এই দ্বিবিধ
বস্তুই আবার বাহ্য ও আন্তর ভেদে দ্বিবিধ। সুতরাং মোট চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তু
বর্তমান। এগুলি হলো- (১) স্থূল বাহ্যবস্তু, যেমন- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও
ব্যোম এই পঞ্চভূত, (২) স্থূল আন্তরবস্তু, যেমন- একাদশ ইন্দ্রিয়সমূহ,
চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক এই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়,
বাক্-পানি-পাদ-পায়ু-উপস্থ এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও উভয়-ইন্দ্রিয় মন, (৩)
সূক্ষ্ম বাহ্যবস্তু, যেমন- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই
পঞ্চতন্মাত্রসমূহ ও (৪) সূক্ষ্ম আন্তরবস্তু, যেমন- অহং ও বুদ্ধি।
.
এই চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তুকে বিষয় হিসেবে বলা হয় যথাক্রমে- বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা। এই চারপ্রকার বিষয় তথা অবলম্বন ভেদে যোগ বা সমাধিও চারপ্রকার- (১) সবিতর্ক, (২) সবিচার, (৩) সানন্দ ও (৪) সাস্মিত।
এই চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তুকে বিষয় হিসেবে বলা হয় যথাক্রমে- বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা। এই চারপ্রকার বিষয় তথা অবলম্বন ভেদে যোগ বা সমাধিও চারপ্রকার- (১) সবিতর্ক, (২) সবিচার, (৩) সানন্দ ও (৪) সাস্মিত।
.
সাধারণত
ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে সকল বিষয় গৃহীত হয় তারা স্থূল বিষয়। যেমন গরু, ঘোড়া,
ঘট ইত্যাদি। এইসব স্থূল বিষয় যখন শব্দের বাচ্যরূপে অর্থাৎ নামজ্ঞান ও
সংকেতজ্ঞান হিসেবে সমাধিপ্রজ্ঞার বিষয় হয় তখন সেই সমাধিকে বলা হয় সবিতর্ক
সমাধি। অর্থাৎ, এই অবস্থায় যোগীর কোন একটি শব্দের বাচ্য স্থূল বিষয়ের
পুঙ্খানুপুঙ্খ ও সম্যক্ জ্ঞান হয়।
.
এরপর, অর্থাৎ স্থূলবিষয়ক সমাধি আয়ত্ত হলে যোগীর বিচারবিশেষের দ্বারা তন্মাত্র প্রভৃতির সূক্ষ্ম বিষয়ের জ্ঞান হয়। একেই বলে সবিচার সম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যেহেতু শব্দ ব্যতীত বিচার হয় না, তাই সবিচার সমাধিতেও বাচকশব্দের অপেক্ষা থাকে।
এরপর, অর্থাৎ স্থূলবিষয়ক সমাধি আয়ত্ত হলে যোগীর বিচারবিশেষের দ্বারা তন্মাত্র প্রভৃতির সূক্ষ্ম বিষয়ের জ্ঞান হয়। একেই বলে সবিচার সম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যেহেতু শব্দ ব্যতীত বিচার হয় না, তাই সবিচার সমাধিতেও বাচকশব্দের অপেক্ষা থাকে।
.
সানন্দ অবস্থা হলো অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের অবস্থা। এই অবস্থায় বাচক শব্দের ততো অপেক্ষা নেই। আমাদের শরীর হলো জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়, চিত্ত ও প্রাণের অধিষ্ঠাতা। অভ্যাসের ফলে ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণাদির সঙ্গে অধিষ্ঠাতা শরীরের যখন বিশেষ একপ্রকার স্থৈর্য সিদ্ধ হয় তখন এক সর্বব্যাপী সাত্ত্বিক সুখ অনুভূত হয়। সর্বশরীরে ঐ আনন্দময় সাত্ত্বিক ভাবের সহজ বোধই সানন্দ সমাধির বিষয়।
সানন্দ অবস্থা হলো অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের অবস্থা। এই অবস্থায় বাচক শব্দের ততো অপেক্ষা নেই। আমাদের শরীর হলো জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়, চিত্ত ও প্রাণের অধিষ্ঠাতা। অভ্যাসের ফলে ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণাদির সঙ্গে অধিষ্ঠাতা শরীরের যখন বিশেষ একপ্রকার স্থৈর্য সিদ্ধ হয় তখন এক সর্বব্যাপী সাত্ত্বিক সুখ অনুভূত হয়। সর্বশরীরে ঐ আনন্দময় সাত্ত্বিক ভাবের সহজ বোধই সানন্দ সমাধির বিষয়।
.
সাস্মিত সমাধির বিষয় হলো মহান আত্মা বা ব্যবহারিক গ্রহীতা। এই ব্যবহারিক গ্রহীতা কিন্তু স্বরূপত পুরুষ নন। সাংখ্যদর্শনে এঁকে মহৎ-তত্ত্ব বলা হয়েছে। ‘আমি’ এই বোধমাত্রই সাস্মিত সমাধির বিষয়। এইটি হলো বুদ্ধি বা মহৎ-এর অভিমান। সত্ত্বগুণের আধিক্য থাকায় একে পুরুষ বলে ভ্রম হয়। এই সাস্মিত অবস্থাই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্বোচ্চ অবস্থা।
সাস্মিত সমাধির বিষয় হলো মহান আত্মা বা ব্যবহারিক গ্রহীতা। এই ব্যবহারিক গ্রহীতা কিন্তু স্বরূপত পুরুষ নন। সাংখ্যদর্শনে এঁকে মহৎ-তত্ত্ব বলা হয়েছে। ‘আমি’ এই বোধমাত্রই সাস্মিত সমাধির বিষয়। এইটি হলো বুদ্ধি বা মহৎ-এর অভিমান। সত্ত্বগুণের আধিক্য থাকায় একে পুরুষ বলে ভ্রম হয়। এই সাস্মিত অবস্থাই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্বোচ্চ অবস্থা।
.
কিন্তু
সম্প্রজ্ঞাত সমাধি অবস্থায় চিত্তবৃত্তি কখনই সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ হতে পারে
না। কারণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম আকারে হলেও বিষয়াকার আলম্বন থেকেই যায়। এই
সমাধিতে সংসার বীজ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় না, সুপ্ত অবস্থাপ্রাপ্ত হয় বলে এই
সমাধিকে সবীজ সমাধিও বলা হয়।
.
(২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি
সম্প্রজ্ঞাত সমাধির দ্বারা চিত্ত যখন বিষয় চিন্তা থেকে মুক্ত হয় তখন অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির উদ্ভব হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি সম্পূর্ণ আলম্বন বা বিষয়হীন। এটি পরবৈরাগ্যের অভ্যাসসাধ্য সংস্কার। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনায় যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
(২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি
সম্প্রজ্ঞাত সমাধির দ্বারা চিত্ত যখন বিষয় চিন্তা থেকে মুক্ত হয় তখন অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির উদ্ভব হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি সম্পূর্ণ আলম্বন বা বিষয়হীন। এটি পরবৈরাগ্যের অভ্যাসসাধ্য সংস্কার। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনায় যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘বিরামপ্রত্যয়াভ্যাসপূর্ব্বঃ সংস্কারশেষোহন্যাঃ’- (যোগসূত্র : ১/১৮)
অর্থাৎ : অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো পরবৈরাগ্যের অভ্যাসের দ্বারা সংস্কার শেষ স্বরূপ সমাধি।
.
সকলপ্রকার
চিত্তবৃত্তির নিরোধকে বলা হয় বিরাম। এই বিরাম লাভের উপায় হলো বৈরাগ্য।
বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিসমূহ নিরুদ্ধ হয়। অভ্যাসের দ্বারা এই বৈরাগ্য
দৃঢ় হয়। বৈরাগ্য দৃঢ় হলে চিত্তবৃত্তির পুনরুৎপত্তির সম্ভাবনা থাকে না।
চিত্ত তখন দগ্ধবীজের ন্যায় শক্তিশূন্য হয়ে পড়ে।
শাস্ত্রবাক্যে ‘অসম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের অর্থ হলো-
শাস্ত্রবাক্যে ‘অসম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের অর্থ হলো-
‘ন কিঞ্চিৎ প্রজ্ঞায়তে ইতি অসম্প্রজ্ঞাতঃ’।
অর্থাৎ : যে অবস্থায় বিষয়ের কোন অস্তিত্ব থাকে না।
.
এইরূপ
নিরালম্ব ও নির্বীজ সমাধিকে বলা হয় অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। সম্প্রজ্ঞাত
সমাধিতে স্থূলতত্ত্ব থেকে ক্রমান্বয়ে অস্মিভাবে চিত্ত সমাহিত হয়। অস্মিভাবে
কোন স্থূল ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থাকে না। কিন্তু ঐ অবস্থায়ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম
বিজ্ঞানের জ্ঞান বা সংস্কার থাকে। যখন ঐ অস্মিভাবও চাই না মনে করে যোগী
নিরোধ আনতে পারেন, তখন তাঁর চিত্তবৃত্তি রুদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থাই
অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যোগমতে, এই অবস্থায় মনের সঙ্গে শরীরযন্ত্রের ক্রিয়াও
রুদ্ধ হয়ে যায় এবং স্থম্ভিতপ্রাণ অবস্থায় থাকে। নিরোধ ভঙ্গ হলে আবার শরীরের
যান্ত্রিক ক্রিয়া ফিরে এসে আগের অবস্থা হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে পুরুষ
প্রকৃতির সকল প্রকার সংযোগ ছিন্ন করে স্ব স্ব রূপে অবস্থান করে। প্রকৃতির
বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষ জন্ম-মৃত্যু ও সুখ-দুঃখকে অতিক্রম করে
কৈবল্যপ্রাপ্ত হয়। এইরূপ কৈবল্য-প্রাপ্তিকে যোগদর্শনে মোক্ষ বলা হয়।
.
তবে
যোগশাস্ত্রে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ভবপ্রত্যয় এবং
উপায়প্রত্যয়। ভব অর্থ জন্ম এবং প্রত্যয় অর্থ কারণ। বিদেহলীন ও প্রকৃতিলীন
যোগীদের এজাতীয় ভবপ্রত্যয় হয়। যে যোগী সব বিষয়ের ত্যাগকে চূড়ান্ত মনে করে
তাতেই আনন্দ লাভ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়ের অস্তিত্ব না থাকায় ইন্দ্রিয়
প্রভৃতি করণগুলি লয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। তাদের দেহের নাশ হলে তারা অসম্প্রজ্ঞাত
সমাধি লাভ করেন। এঁরাই বিদেহলীন নামে পরিচিত। কিন্তু
পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎকার না হওয়াতে এরা কৈবল্য লাভ করতে পারেন না। আবার
যে সব যোগী পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎ করেননি কিন্তু বিষয়ের ত্যাগ জন্য তাঁদের
অন্তঃকরণ মূলা প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়েছে, তাঁরা প্রকৃতিলীন নামে পরিচিত।
এঁদেরও মুক্তিলাভ সম্ভব নয়।
.
অপরপক্ষে
উপায়প্রত্যয় হলো প্রকৃত অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। উপায় অর্থ যথাবিহিত উপায় এবং
প্রত্যয় অর্থ কারণ। উপায়প্রত্যয় প্রকৃত যোগীর হয়ে থাকে। এর উপায়গুলি হলো
শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। শ্রদ্ধা অর্থ হলো
প্রসন্নচিত্তে ও আসক্তিসহ বিষয়ের গুণ আবিষ্কার করে জানার ইচ্ছা। বীর্য হলো
অন্য বিষয়ের থেকে সরিয়ে নিয়ে চিত্তকে সাধনে নিযুক্ত করা। স্মৃতি হলো ধ্যেয়
বিষয়কে বারবার অনুভব করা। বীর্য হলো শ্রদ্ধার ফল এবং স্মৃতি হলো বীর্যের
ফল। যখন স্মৃতি স্থির এবং ধ্রুব হয়, তখন সমাধি হয়। সমাধি অবস্থাতেই প্রজ্ঞা
বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের প্রকাশ হয়।
.
অভ্যাস,
বৈরাগ্য, শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি ইত্যাদি ছাড়াও ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধির
অন্যতম সাধন বলেছেন যোগসূত্রকার পতঞ্জলি। এজন্যেই এ প্রসঙ্গে যোগদর্শনে
ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনা স্থান পেয়েছে। সুতরাং, বিবেকখ্যাতি বা সম্পূর্ণ
ভেদজ্ঞানলব্ধ হয়ে পুরুষ সাক্ষাৎকার হলে তবেই সম্পূর্ণ সমাধিলাভ হয়। এই
অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির ফলে দ্রুত প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হওয়ার ফলে কৈবল্যলাভের
পথ প্রশস্ত হয়।…
(চলবে…)
…
[ আগের পর্ব : যোগ মনস্তত্ত্ব ] [*] [ পরের পর্ব : অষ্টাঙ্গিক যোগ ]
…
No comments:
Post a Comment