.
| মীমাংসা দর্শন-০১ : ভূমিকা |
রণদীপম বসু
…
১.০ : ভূমিকা
…
ব্যুৎপত্তিগতভাবে পাণিনিব্যাকরণ অনুসারে সংস্কৃত ‘মীমাংসা’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে বিচারার্থক ‘মান্’-ধাতুর সাথে ‘সন্’ প্রত্যয় যোগে। ফলে ‘মীমাংসা’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘বিচার’ বা ‘বিচারপূর্বক তত্ত্বনির্ণয়’। বিচার মানে কোন বিষয়ের বিচার। মীমাংসা দর্শনে বিচারের কেন্দ্রস্থল হলো ধর্ম অর্থাৎ বেদপ্রতিপাদ্য অর্থ বা বিষয়। মীমাংসা দর্শনের সূত্রকার জৈমিনি’র ‘মীমাংসাসূত্র’-এর শুরুতেই বলা হয়েছে-
এখানে ধর্ম বলতে কোন ধর্মমত বোঝানো হয়নি বা সমাজকে ধারণ করে যে সব আচার-আচরণ, আইন-কানুন তাও নয়। জৈমিনি তাঁর দ্বিতীয় সূত্রে এই ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন। আর ‘জিজ্ঞাসা’ শব্দের মুখ্য অর্থ ‘জানার ইচ্ছা’ হলেও এখানে গৃহীত হয়েছে গৌণ অর্থ ‘বিচার’। অর্থাৎ মীমাংসার মূল সুর হলো ধর্ম বা বেদার্থের বিচার। জৈমিনির দ্বিতীয় সূত্রটি হলো-
| মীমাংসা দর্শন-০১ : ভূমিকা |
রণদীপম বসু
…
১.০ : ভূমিকা
…
ভারতীয় দর্শনে যে ছয়টি সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন, তাঁদের
মধ্যে দুটি সম্প্রদায় নিঃসংশয়ে বৈদিক বা বেদমূলক। এদের একটি হলো
পূর্ব-মীমাংসা বা সংক্ষেপে মীমাংসা, অন্যটি উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত।
সাধারণত বেদের চারটি পর্যায় স্বীকার করা হয়- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও
উপনিষদ। এদের মধ্যে সংহিতা ও ব্রাহ্মণকে বলা হয় কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও
উপনিষদকে বলা হয় জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে যজুর্বেদ ও
ব্রাহ্মণগুলিতে বেদের যাজ্ঞিক ক্রিয়াকর্মের স্বরূপ এবং কর্মবিষয়ক
বেদবাক্যসমূহের তাৎপর্য বিবৃত হয়েছে। তার বিচারকে বলা হয় পূর্ব-মীমাংসা। আর
জ্ঞানকাণ্ড, অর্থাৎ বেদের অন্তিমভাগ বা উপনিষদ (বেদান্ত) যার মূখ্য বিষয়
হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যেখানে আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি এবং জ্ঞান-বিষয়ক
বাক্যসমূহের অর্থ বিবৃত হয়েছে, তার বিচারকে বলা হয় উত্তর-মীমাংসা। কিন্তু
দার্শনিকদের ব্যবহার অনুসারে জৈমিনি প্রবর্তিত পূর্বমীমাংসা বোঝাতে কেবল
‘মীমাংসা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, আর উত্তর-মীমাংসা বোঝাতে সাধারণভাবে
‘বেদান্ত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। পূর্ব-মীমাংসার আরেক নাম ধর্ম-মীমাংসা বা
কর্ম-মীমাংসা, এবং উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্তের আরেক নাম ব্রহ্ম-মীমাংসা।
তবে এ দুই শাস্ত্রের জন্য যথাক্রমে মীমাংসা দর্শন ও বেদান্ত দর্শন এই দুটি
নামই সমধিক প্রচলিত।
ব্যুৎপত্তিগতভাবে পাণিনিব্যাকরণ অনুসারে সংস্কৃত ‘মীমাংসা’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে বিচারার্থক ‘মান্’-ধাতুর সাথে ‘সন্’ প্রত্যয় যোগে। ফলে ‘মীমাংসা’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘বিচার’ বা ‘বিচারপূর্বক তত্ত্বনির্ণয়’। বিচার মানে কোন বিষয়ের বিচার। মীমাংসা দর্শনে বিচারের কেন্দ্রস্থল হলো ধর্ম অর্থাৎ বেদপ্রতিপাদ্য অর্থ বা বিষয়। মীমাংসা দর্শনের সূত্রকার জৈমিনি’র ‘মীমাংসাসূত্র’-এর শুরুতেই বলা হয়েছে-
‘অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা’।- (মীমাংসাসূত্র : ১/১/১)
অর্থাৎ : এবার ধর্মজিজ্ঞাসা আরম্ভ হচ্ছে।
এখানে ধর্ম বলতে কোন ধর্মমত বোঝানো হয়নি বা সমাজকে ধারণ করে যে সব আচার-আচরণ, আইন-কানুন তাও নয়। জৈমিনি তাঁর দ্বিতীয় সূত্রে এই ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন। আর ‘জিজ্ঞাসা’ শব্দের মুখ্য অর্থ ‘জানার ইচ্ছা’ হলেও এখানে গৃহীত হয়েছে গৌণ অর্থ ‘বিচার’। অর্থাৎ মীমাংসার মূল সুর হলো ধর্ম বা বেদার্থের বিচার। জৈমিনির দ্বিতীয় সূত্রটি হলো-
‘চোদনালক্ষণোহর্থো ধর্ম’।- (মীমাংসাসূত্র : ১/১/২)অর্থাৎ : চোদনা লক্ষণ অর্থাৎ চিহ্ন বা জ্ঞাপক যার সেই বিষয়ই ধর্ম।
‘চোদনা’ শব্দের মীমাংসাসম্মত অবিসংবাদিত অর্থ হলো প্রবর্তক বাক্য। তবে যে
কোন প্রবর্তক বাক্য নয়, প্রবর্তক বেদবাক্য দ্বারা সূচিত বিষয়ই ধর্ম। বেদের
মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ অংশে যে সব যোগ ও উপাসনামূলক কর্মবাক্যের অর্থ নিয়ে
বিরোধ হতে পারে তাদের যথার্থ ব্যাখ্যা দেয়াই মীমাংসাশাস্ত্রের কাজ।
এখানে উল্লেখ্য, সাধারণ প্রসিদ্ধি অনুসারে ‘মন্ত্র’ শব্দটি বৈদিক বাক্য বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। পারিভাষিক প্রসিদ্ধি অনুসারে জৈমিনি বেদকে দুভাগে ভাগ করেছেন- মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ। কিন্তু ঠিক ঠিক কোন্ অংশ মন্ত্র ও কোন্ অংশ ব্রাহ্মণ তা সুনির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই। মন্ত্রাংশ সাধারণত সংহিতা নামে পরিচিত। সংহিতা ব্যতিরিক্ত অংশ ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত।
‘ব্রাহ্মণ বলতে কি বোঝায় তা বোঝাবার জন্য শবরস্বামী সংক্ষেপে ব্রাহ্মণের আলোচ্য বিষয়গুলি এভাবে নির্ধারণ করেছেন- যজ্ঞের উপকরণ ( হেতু), যজ্ঞে প্রয়োজনীয় বস্তুর লক্ষণনির্দেশ (নির্বচন); যা অনুচিত বা নিষিদ্ধ তার নিন্দা; বিধেয় কর্মের প্রশংসা; কোন কাজ দুরকমে হতে পারে, কিন্তু কোনটি গ্রহণীয় এ বিষয়ে সন্দেহ (সংশয়); যিনি অমুক বস্তু কামনা করেন তিনি অমুক যজ্ঞ করবেন এভাবে যজ্ঞীয় বিধান (বিধি); বিধেয় কর্মের প্রশস্তির জন্য এবং নিষেধ্যের নিন্দার জন্য প্রচলিত পুরাতন উপাখ্যান (পরকৃতি ও পুরাকল্প); প্রসঙ্গ অনুসারে কোন শব্দের স্পষ্ট ব্যাকরণগত অর্থের স্থলে অন্য অর্থ নির্ধারণ (ব্যবধারণ)- যে বৈদিক বাক্যগুলি দ্বারা এই বিষয়গুলি জ্ঞাপিত হয় সেই বাক্যাত্মক বেদভাগকে ব্রাহ্মণ বলে। এই সমস্ত বিষয়গুলির মধ্যে প্রধান হল বিধি বা কোনযজ্ঞের কর্তব্যতা নির্দেশক বাক্য, কারণ এই যজ্ঞকর্মেই সমস্ত বেদের তাৎপর্য পর্যবসিত। বাকি বিষয়গুলি বিধির সহায়ক। তাই বেদের ব্রাহ্মণভাগকে ‘বিধি’ এই একটি শব্দের দ্বারাও নির্দেশ করা যেতে পারে (সূ: ২/১/৩৩ শাবরভাষ্য ও তন্ত্রবার্তিক দ্রষ্টব্য)। ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত বৈদিক গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রধানত এই বিষয়গুলিই দেখা যায়। আরণ্যক ও উপনিষৎকে ব্রাহ্মণের অংশ বলে ধরা হয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে, শবরস্বামী ব্রাহ্মণের যে প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে ঔপনিষদিক অধ্যাত্মবাদের কোন স্থান নেই। শবরস্বামী স্বীকার করেছেন যে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের কোন নিখুঁত লক্ষণ (definition) বলার উপায় নেই। যা বলা হল তা ‘প্রায়িক’ (approximate) মাত্র। উল্লিখিত বিষয়গুলি মন্ত্ররূপে পরিচিত সংহিতাগুলিতেও পাওয়া যাবে, যেমন যজুর্বেদে। ঋকবেদের অধিক অংশই দেবতার স্তুতিবন্দনা। মীমাংসক মতে দেবস্তুতির দ্বারা প্রকারান্তরে, যে যজ্ঞে দেব স্তুতিবাচক মন্ত্রগুলি প্রযুক্ত হবে সেই যজ্ঞেরই প্রশংসা করা হয়েছে। দেবতা গৌণ, যজ্ঞই প্রধান (অপি বা শব্দপূর্বত্বাদ যজ্ঞকর্ম প্রধানং স্যাত্, গুণত্বে দেবতাশ্রুতিঃ। মী: সূ: ৯/১/৯) আবার মন্ত্রপ্রধান সংহিতাগুলিতে প্রচুর উপাখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। ব্রাহ্মণভাগের মধ্যেও দেবস্তুতিপ্রভৃতি প্রচুর রয়েছে যে বাক্যগুলি আপাতদৃষ্টিতে যজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত নয়। এভাবে মন্ত্রের মধ্যে ব্রাহ্মণ আছে আবার ব্রাহ্মণের মধ্যেও মন্ত্র আছে। যজ্ঞে প্রযুক্ত বিষয়বস্তু স্মরণ করিয়ে দেয় যে বেদবাক্য, তাকে মন্ত্র বলে; বাকী অংশকে বলে ব্রাহ্মণ (মী: সূ: ২/১/৩১-৩৩) কিন্তু এভাবে মন্ত্র-ব্রাহ্মণ ভাগ করা যায় না।’ (সূত্র: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা দর্শন/ হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-১৯২)
বস্তুত বৈদিক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর বৈদিক বাক্যের অর্থ এবং বৈদিক বিধান নিয়ে নানা ধরনের বিবাদ ও অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে-
‘উপনিষদ যুগের কাছাকাছি সময়ে (৭০০-৬০০ খৃঃ পূঃ) স্বর্গ ও ধর্মের নানা ক্রিয়াকলাপ পশুহত্যা, মন্ত্রতন্ত্র, যাদুবিদ্যা প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে বুদ্ধির সংঘর্ষ শুরু হয়েছিলো। উপনিষদে যজ্ঞ অপেক্ষা ব্রহ্মজ্ঞানকে উচ্চস্থান দিয়ে ব্রাহ্মণকে নতুন ধর্মের (=ব্রহ্মবাদ) পুরোহিতের স্থানই শুধু দেয়নি, এমনকি প্রাচীন যাগযজ্ঞকে পিতৃযানের সাধন (উপায়) বলে মেনে নিয়ে প্রাচীন পুরোহিতদের হাতে রেখেছিল। এরপর এলো বুদ্ধের যুগ। জাতপাত এবং আর্থিক বৈষম্য থেকে উৎপন্ন অসন্তোষ ধর্ম-বিদ্রোহের রূপ নিল। অজিত কেশকম্বলের মতো বস্তুবাদী তথা বুদ্ধের ন্যায় প্রতীত্য-সমুৎপাদ প্রচারক যুক্তিবাদীগণ প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের ওপর কঠিন আঘাত করলেন। ভৌগোলিক ও বৌদ্ধিক জগৎ থেকে সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডুকতা দূর হতে লাগল, অতঃপর এদেশে বসবাসকারী গ্রীক, শক প্রভৃতি আগন্তুক জাতিগণ এই বুদ্ধিবাদী সংগ্রামকে আরও প্রবল করে দিলেন। এখন আর (উপনিষদের) যাজ্ঞবল্ক্য অথবা আরুণির শিক্ষা থেকে, অথবা গার্গীকে মুণ্ডচ্যুত হওয়ার ভয় দেখানোর উপমা দিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহের সীমাকে রুদ্ধ করা গেলো না। নবাগত জাতিসমূহ যখন ভারতীয় হতে লাগল তখন তারা আবার স্ব-স্ব ধর্মকে বৌদ্ধিক ভিত্তিতে যুক্তিসম্মতভাবে সিদ্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলো।’- (দর্শন-দিগদর্শন, পৃষ্ঠা-১৪৭)
এ সময়ে বেদ-বিরোধী বৌদ্ধধর্মের প্রভাব অতি প্রবল আকার ধারণ করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেদবাক্য ও বেদবিধি নিয়ে নানা ধরনের সংশয় দেখা যায়। বেদের উপজীব্য যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ড নামক ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের অসারতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের ধারক-বাহক যজমান পুরোহিত ব্রাহ্মণদের জীবিকা সংশয় দেখা দেওয়ার প্রেক্ষিতে এ ধর্মসংকট কাটিয়ে উঠার জন্য স্মৃতি, পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতি শাস্ত্র বেদবাক্যের তাৎপর্য নির্ধারণে সচেষ্ট হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টাও প্রবল সংকটকে কাটিয়ে উঠতে পারে না। কেননা ইতোমধ্যে ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ পরিশ্রমলব্ধ কর্মানুষ্ঠানের চাইতে জ্ঞানযোগের মাধ্যমে ধর্ম ও মোক্ষের সন্ধানে প্রবৃত্ত বিভিন্ন জ্ঞান-দর্শনের আবির্ভাব হওয়ায় যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডের জ্ঞানতাত্ত্বিক দার্শনিক ভিত্তিশূন্যতা দেখা দেয়। মহর্ষি জৈমিনি বৈদিক কর্মকাণ্ডের এই গভীর সংকটকে দূর করার জন্য বেদবাক্যের যথার্থ ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন কর্মের স্বরূপ ও অনুষ্ঠানপ্রণালী স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার অভিপ্রায়ে মীমাংসাসূত্র রচনা করেন।
মূলত মীমাংসা দর্শনের প্রধান উপজীব্য হলো বেদের অপৌরুষেয়ত্ব ও নিত্যত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈদিক কর্মকাণ্ডের স্বতসিদ্ধতা প্রমাণ করা। যজ্ঞকর্ম যে নিষ্ফল নয় তার আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রয়োজন হয় দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার। ভারতীয় দর্শনের নিয়ম অনুযায়ী যে কোন দর্শনই প্রচলিত কিছু বিষয়কে যেমন বস্তু, জগত, ঈশ্বর, আত্মা, পরকাল, পাপ-পূণ্য, স্বর্গ-নরক, মোক্ষ, ধর্ম, প্রমাণ-প্রমেয় ইত্যাদি বিষয়কে নিজ নিজ মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে হয়। আর তা করতে গিয়ে দার্শনিক বিচারে অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায়ের তত্ত্বের যেখান থেকে যেটুকু স্বীকার করা আবশ্যক তা নিজের মতো করে স্বীকার করা এবং যেখানে বিরোধিতার প্রয়োজন সেখানে বিরোধী যুক্তি উপস্থান করতে মীমাংসকরা কার্পণ্য করলেন না। ফলে একদিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে প্রচণ্ড অবিশ্বাসী এ দর্শনের বস্তুবাদী বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিস্রোতের পাশাপাশি যজ্ঞানুষ্ঠানের মতো একটি আদিম কুসংস্কারের মধ্যে যাদুক্ষমতা আরোপ প্রচেষ্টার চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীন দর্শনটিকে জটিল স্ববিরোধিতায় ঠেলে দিয়েছে বলে একালের বিদ্বানেরা মনে করেন।
মীমাংসাদর্শন সাংখ্য বৌদ্ধ বা ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের মতো একটা সুশৃঙ্খল সুসংহত দার্শনিক প্রস্থানরূপে গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠেছে যাগযজ্ঞসম্পৃক্ত মন্ত্ররাশির অর্থবিচারকে উপলক্ষ করে। এই দর্শনের মুখ্য উদ্দেশ্য কোন বিশুদ্ধ দার্শনিক তত্ত্বের উদ্ভাবন ও প্রচার নয়। মুখ্য উদ্দেশ্য যাগযজ্ঞের সামাজিক প্রয়োজন অক্ষুণ্ন ও অব্যাহত রাখার জন্য মন্ত্রার্থবিচার। এই বিচারের প্রসঙ্গেই প্রয়োজনানুরূপ দার্শনিক যুক্তিতর্ক বিক্ষিপ্তভাবে উপস্থিত হয়েছে। অথচ এই উপস্থিতি বিপুল ও বিস্ময়কর ! মীমাংসার বহু সূক্ষ্ম দার্শনিক বিচার ও সিদ্ধান্ত আধুনিক সমাজ-দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মীমাংসা দর্শন অবশ্যই আস্তিক দর্শন। কেননা ভারতীয় দর্শনে আস্তিক মানে বেদ-পন্থী। আস্তিক্য বিচারে তাই ঈশ্বর মানা-না-মানার প্রসঙ্গ অবান্তর। বস্তুত আস্তিকদের পক্ষেও যে ঈশ্বর অস্বীকারের পরিপূর্ণ সুযোগ ছিলো তারই নজির হিসেবে সাধারণত সাংখ্য ও মীমাংসার উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এদিক থেকে সাংখ্যের চেয়ে মীমাংসা চিত্তাকর্ষক বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে-
‘…সাংখ্যকে বেদমূলক বলে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে শঙ্কর, রামানুজ প্রমুখ অগ্রণী আস্তিকেরা তীব্র আপত্তি তুলেছেন এবং সে আপত্তি ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু মীমাংসা-প্রসঙ্গে এ-জাতীয় সামান্যতম সংশয়ও কল্পনাতীত। কেননা, বেদের চরম প্রামাণ্যই– বেদের অপৌরুষেয়ত্ব এবং নিত্যত্ব– এ সম্প্রদায়ের মূল প্রতিপাদ্য এবং “এই কর্মমীমাংসার মধ্যে দুইটি কার্য করা হইয়াছে। প্রথম, –বেদবাক্যের প্রকারভেদ নির্ণয় এবং দ্বিতীয়, –বেদ-বাক্যের মধ্যে আপাতবিরোধের পরিহারপূর্বক একবাক্যতাসাধন। আর এইজন্য একসহস্র বিচার বা ন্যায় রচিত হইয়াছে।”- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৩০)
অন্যদিকে মীমাংসা চরম নিরীশ্বরবাদী দর্শন। প্রাচীন সাংখ্যকে নিরীশ্বরবাদী বলা হলেও পরবর্তীকালে বিজ্ঞানভিক্ষুর মতো ঈশ্বরবাদী দার্শনিকদের সুকৌশল ব্যাখ্যাবলে সাংখ্যের ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান কিছুটা হলেও অস্পষ্টতায় পর্যবসিত হয়েছে। সেদিক থেকে মীমাংসা দর্শনে ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান এতোটাই চরম যে পরবর্তীকালে তাকে ঈশ্বরবাদী বানানোর কোন চেষ্টাই সফল হয়নি। এই ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যানের দিক থেকে আস্তিক মীমাংসার সঙ্গে নাস্তিক বৌদ্ধাদি-সম্প্রদায়ের তুলনা চিত্তাকর্ষক হয় বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন-
‘বস্তুত, অশ্বঘোষের রচনায় যে-সব যুক্তি-তর্কের সাহায্যে বুদ্ধ ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন সেগুলির সঙ্গে প্রাচীন মীমাংসকদের যুক্তি-তর্কের আশ্চর্য সাদৃশ্য চোখে পড়ে ! আরো আশ্চর্য কথা হলো, মীমাংসা-মতে বৈদিক দেবতারাও নেহাতই শব্দমাত্র ; অতএব তাঁদের পূজা-উপাসনা সম্পূর্ণ অর্থহীন। চরম বেদপন্থী সম্প্রদায়ের পক্ষে বৈদিক দেবতা সম্বন্ধে এ-জাতীয় মত অন্তত আপাত-অদ্ভূত মনে হবে। কিন্তু আরো বিস্ময়কর মনে হবে স্বর্গ এবং অপবর্গ সংক্রান্ত মীমাংসা-মত। কেননা নিরতিশয় সুখ বা প্রীতির নামই স্বর্গ এবং তা এই মর্ত্যলোকেই সম্ভব। আর মোক্ষ ? আধুনিক বিদ্বানদের পক্ষ থেকে মীমাংসাকে মোক্ষশাস্ত্র প্রতিপন্ন করার নানান কষ্টকল্পিত প্রয়াস সত্ত্বেও, প্রাচীন মীমাংসকেরা মোক্ষের প্রতি প্রকৃতই উদাসীন ; এবং তাঁদের দর্শনে মোক্ষ-প্রসঙ্গ কেন অবান্তর সে-কথার ব্যাখ্যা পাওয়াও কঠিন নয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৩১)।
তবে এই দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান, মোক্ষ-উপেক্ষা, ভাববাদ-খন্ডন প্রভৃতির স্বকীয় দার্শনিক গুরুত্ব যাই হোক না কেন, এ সমস্তই পুরোহিত শ্রেণী বা যাজ্ঞিকদের ধ্যানধারণাই বিকশিত হয়েছিলো,- যাঁদের কাছে বৈদিক যাগযজ্ঞ বা ক্রিয়াকর্মের চেয়ে মূল্যবান বলতে আর কিছু ছিলো না। অতএব মীমাংসার এই দিকটি অনিবার্যভাবেই চূড়ান্ত সংরক্ষণশীলতার পরিচায়ক। কেবল এই বৈদিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মীমাংসা দর্শনকে বেদান্ত দর্শনের সমানতন্ত্র বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে চরম ভাববাদী বেদান্ত দর্শনের বিপরীতে মীমাংসা দর্শন আশ্চর্যজনকভাবে দুর্দান্ত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও ধারণ করে আছে। সে বিচারে মীমাংসাকে বরং ন্যায়-বৈশেষিকের সমানতন্ত্র বিবেচনা করাটা অধিকতর বিবেচনা-সম্মত মনে হয়। তবে আপাত-দৃষ্টিতে মীমাংসাকে কোনো এক কুহেলিকা মনে হতে পারে। কেননা, সামগ্রিকভাবে দেখলে মনে হয় এ-দর্শনের কিছুটা উপাদান যেন অত্যাধুনিক, কিছুটা অতি আদিম। তাই মীমাংসা দর্শন বুঝতে হলে খণ্ডিতভাবে না-দেখে সামগ্রিকভাবেই বোঝার প্রচেষ্টা নিতে হয়।
…
(চলবে…)
…
[*] [পরের পর্ব : মীমাংসা সাহিত্য]
…
এখানে উল্লেখ্য, সাধারণ প্রসিদ্ধি অনুসারে ‘মন্ত্র’ শব্দটি বৈদিক বাক্য বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। পারিভাষিক প্রসিদ্ধি অনুসারে জৈমিনি বেদকে দুভাগে ভাগ করেছেন- মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ। কিন্তু ঠিক ঠিক কোন্ অংশ মন্ত্র ও কোন্ অংশ ব্রাহ্মণ তা সুনির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই। মন্ত্রাংশ সাধারণত সংহিতা নামে পরিচিত। সংহিতা ব্যতিরিক্ত অংশ ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত।
‘ব্রাহ্মণ বলতে কি বোঝায় তা বোঝাবার জন্য শবরস্বামী সংক্ষেপে ব্রাহ্মণের আলোচ্য বিষয়গুলি এভাবে নির্ধারণ করেছেন- যজ্ঞের উপকরণ ( হেতু), যজ্ঞে প্রয়োজনীয় বস্তুর লক্ষণনির্দেশ (নির্বচন); যা অনুচিত বা নিষিদ্ধ তার নিন্দা; বিধেয় কর্মের প্রশংসা; কোন কাজ দুরকমে হতে পারে, কিন্তু কোনটি গ্রহণীয় এ বিষয়ে সন্দেহ (সংশয়); যিনি অমুক বস্তু কামনা করেন তিনি অমুক যজ্ঞ করবেন এভাবে যজ্ঞীয় বিধান (বিধি); বিধেয় কর্মের প্রশস্তির জন্য এবং নিষেধ্যের নিন্দার জন্য প্রচলিত পুরাতন উপাখ্যান (পরকৃতি ও পুরাকল্প); প্রসঙ্গ অনুসারে কোন শব্দের স্পষ্ট ব্যাকরণগত অর্থের স্থলে অন্য অর্থ নির্ধারণ (ব্যবধারণ)- যে বৈদিক বাক্যগুলি দ্বারা এই বিষয়গুলি জ্ঞাপিত হয় সেই বাক্যাত্মক বেদভাগকে ব্রাহ্মণ বলে। এই সমস্ত বিষয়গুলির মধ্যে প্রধান হল বিধি বা কোনযজ্ঞের কর্তব্যতা নির্দেশক বাক্য, কারণ এই যজ্ঞকর্মেই সমস্ত বেদের তাৎপর্য পর্যবসিত। বাকি বিষয়গুলি বিধির সহায়ক। তাই বেদের ব্রাহ্মণভাগকে ‘বিধি’ এই একটি শব্দের দ্বারাও নির্দেশ করা যেতে পারে (সূ: ২/১/৩৩ শাবরভাষ্য ও তন্ত্রবার্তিক দ্রষ্টব্য)। ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত বৈদিক গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রধানত এই বিষয়গুলিই দেখা যায়। আরণ্যক ও উপনিষৎকে ব্রাহ্মণের অংশ বলে ধরা হয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে, শবরস্বামী ব্রাহ্মণের যে প্রধান বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে ঔপনিষদিক অধ্যাত্মবাদের কোন স্থান নেই। শবরস্বামী স্বীকার করেছেন যে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের কোন নিখুঁত লক্ষণ (definition) বলার উপায় নেই। যা বলা হল তা ‘প্রায়িক’ (approximate) মাত্র। উল্লিখিত বিষয়গুলি মন্ত্ররূপে পরিচিত সংহিতাগুলিতেও পাওয়া যাবে, যেমন যজুর্বেদে। ঋকবেদের অধিক অংশই দেবতার স্তুতিবন্দনা। মীমাংসক মতে দেবস্তুতির দ্বারা প্রকারান্তরে, যে যজ্ঞে দেব স্তুতিবাচক মন্ত্রগুলি প্রযুক্ত হবে সেই যজ্ঞেরই প্রশংসা করা হয়েছে। দেবতা গৌণ, যজ্ঞই প্রধান (অপি বা শব্দপূর্বত্বাদ যজ্ঞকর্ম প্রধানং স্যাত্, গুণত্বে দেবতাশ্রুতিঃ। মী: সূ: ৯/১/৯) আবার মন্ত্রপ্রধান সংহিতাগুলিতে প্রচুর উপাখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। ব্রাহ্মণভাগের মধ্যেও দেবস্তুতিপ্রভৃতি প্রচুর রয়েছে যে বাক্যগুলি আপাতদৃষ্টিতে যজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত নয়। এভাবে মন্ত্রের মধ্যে ব্রাহ্মণ আছে আবার ব্রাহ্মণের মধ্যেও মন্ত্র আছে। যজ্ঞে প্রযুক্ত বিষয়বস্তু স্মরণ করিয়ে দেয় যে বেদবাক্য, তাকে মন্ত্র বলে; বাকী অংশকে বলে ব্রাহ্মণ (মী: সূ: ২/১/৩১-৩৩) কিন্তু এভাবে মন্ত্র-ব্রাহ্মণ ভাগ করা যায় না।’ (সূত্র: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা দর্শন/ হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-১৯২)
বস্তুত বৈদিক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর বৈদিক বাক্যের অর্থ এবং বৈদিক বিধান নিয়ে নানা ধরনের বিবাদ ও অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে-
‘উপনিষদ যুগের কাছাকাছি সময়ে (৭০০-৬০০ খৃঃ পূঃ) স্বর্গ ও ধর্মের নানা ক্রিয়াকলাপ পশুহত্যা, মন্ত্রতন্ত্র, যাদুবিদ্যা প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে বুদ্ধির সংঘর্ষ শুরু হয়েছিলো। উপনিষদে যজ্ঞ অপেক্ষা ব্রহ্মজ্ঞানকে উচ্চস্থান দিয়ে ব্রাহ্মণকে নতুন ধর্মের (=ব্রহ্মবাদ) পুরোহিতের স্থানই শুধু দেয়নি, এমনকি প্রাচীন যাগযজ্ঞকে পিতৃযানের সাধন (উপায়) বলে মেনে নিয়ে প্রাচীন পুরোহিতদের হাতে রেখেছিল। এরপর এলো বুদ্ধের যুগ। জাতপাত এবং আর্থিক বৈষম্য থেকে উৎপন্ন অসন্তোষ ধর্ম-বিদ্রোহের রূপ নিল। অজিত কেশকম্বলের মতো বস্তুবাদী তথা বুদ্ধের ন্যায় প্রতীত্য-সমুৎপাদ প্রচারক যুক্তিবাদীগণ প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের ওপর কঠিন আঘাত করলেন। ভৌগোলিক ও বৌদ্ধিক জগৎ থেকে সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডুকতা দূর হতে লাগল, অতঃপর এদেশে বসবাসকারী গ্রীক, শক প্রভৃতি আগন্তুক জাতিগণ এই বুদ্ধিবাদী সংগ্রামকে আরও প্রবল করে দিলেন। এখন আর (উপনিষদের) যাজ্ঞবল্ক্য অথবা আরুণির শিক্ষা থেকে, অথবা গার্গীকে মুণ্ডচ্যুত হওয়ার ভয় দেখানোর উপমা দিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহের সীমাকে রুদ্ধ করা গেলো না। নবাগত জাতিসমূহ যখন ভারতীয় হতে লাগল তখন তারা আবার স্ব-স্ব ধর্মকে বৌদ্ধিক ভিত্তিতে যুক্তিসম্মতভাবে সিদ্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলো।’- (দর্শন-দিগদর্শন, পৃষ্ঠা-১৪৭)
এ সময়ে বেদ-বিরোধী বৌদ্ধধর্মের প্রভাব অতি প্রবল আকার ধারণ করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেদবাক্য ও বেদবিধি নিয়ে নানা ধরনের সংশয় দেখা যায়। বেদের উপজীব্য যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ড নামক ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের অসারতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের ধারক-বাহক যজমান পুরোহিত ব্রাহ্মণদের জীবিকা সংশয় দেখা দেওয়ার প্রেক্ষিতে এ ধর্মসংকট কাটিয়ে উঠার জন্য স্মৃতি, পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতি শাস্ত্র বেদবাক্যের তাৎপর্য নির্ধারণে সচেষ্ট হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টাও প্রবল সংকটকে কাটিয়ে উঠতে পারে না। কেননা ইতোমধ্যে ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ পরিশ্রমলব্ধ কর্মানুষ্ঠানের চাইতে জ্ঞানযোগের মাধ্যমে ধর্ম ও মোক্ষের সন্ধানে প্রবৃত্ত বিভিন্ন জ্ঞান-দর্শনের আবির্ভাব হওয়ায় যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডের জ্ঞানতাত্ত্বিক দার্শনিক ভিত্তিশূন্যতা দেখা দেয়। মহর্ষি জৈমিনি বৈদিক কর্মকাণ্ডের এই গভীর সংকটকে দূর করার জন্য বেদবাক্যের যথার্থ ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন কর্মের স্বরূপ ও অনুষ্ঠানপ্রণালী স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার অভিপ্রায়ে মীমাংসাসূত্র রচনা করেন।
মূলত মীমাংসা দর্শনের প্রধান উপজীব্য হলো বেদের অপৌরুষেয়ত্ব ও নিত্যত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈদিক কর্মকাণ্ডের স্বতসিদ্ধতা প্রমাণ করা। যজ্ঞকর্ম যে নিষ্ফল নয় তার আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রয়োজন হয় দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার। ভারতীয় দর্শনের নিয়ম অনুযায়ী যে কোন দর্শনই প্রচলিত কিছু বিষয়কে যেমন বস্তু, জগত, ঈশ্বর, আত্মা, পরকাল, পাপ-পূণ্য, স্বর্গ-নরক, মোক্ষ, ধর্ম, প্রমাণ-প্রমেয় ইত্যাদি বিষয়কে নিজ নিজ মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে হয়। আর তা করতে গিয়ে দার্শনিক বিচারে অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায়ের তত্ত্বের যেখান থেকে যেটুকু স্বীকার করা আবশ্যক তা নিজের মতো করে স্বীকার করা এবং যেখানে বিরোধিতার প্রয়োজন সেখানে বিরোধী যুক্তি উপস্থান করতে মীমাংসকরা কার্পণ্য করলেন না। ফলে একদিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে প্রচণ্ড অবিশ্বাসী এ দর্শনের বস্তুবাদী বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিস্রোতের পাশাপাশি যজ্ঞানুষ্ঠানের মতো একটি আদিম কুসংস্কারের মধ্যে যাদুক্ষমতা আরোপ প্রচেষ্টার চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীন দর্শনটিকে জটিল স্ববিরোধিতায় ঠেলে দিয়েছে বলে একালের বিদ্বানেরা মনে করেন।
মীমাংসাদর্শন সাংখ্য বৌদ্ধ বা ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের মতো একটা সুশৃঙ্খল সুসংহত দার্শনিক প্রস্থানরূপে গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠেছে যাগযজ্ঞসম্পৃক্ত মন্ত্ররাশির অর্থবিচারকে উপলক্ষ করে। এই দর্শনের মুখ্য উদ্দেশ্য কোন বিশুদ্ধ দার্শনিক তত্ত্বের উদ্ভাবন ও প্রচার নয়। মুখ্য উদ্দেশ্য যাগযজ্ঞের সামাজিক প্রয়োজন অক্ষুণ্ন ও অব্যাহত রাখার জন্য মন্ত্রার্থবিচার। এই বিচারের প্রসঙ্গেই প্রয়োজনানুরূপ দার্শনিক যুক্তিতর্ক বিক্ষিপ্তভাবে উপস্থিত হয়েছে। অথচ এই উপস্থিতি বিপুল ও বিস্ময়কর ! মীমাংসার বহু সূক্ষ্ম দার্শনিক বিচার ও সিদ্ধান্ত আধুনিক সমাজ-দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মীমাংসা দর্শন অবশ্যই আস্তিক দর্শন। কেননা ভারতীয় দর্শনে আস্তিক মানে বেদ-পন্থী। আস্তিক্য বিচারে তাই ঈশ্বর মানা-না-মানার প্রসঙ্গ অবান্তর। বস্তুত আস্তিকদের পক্ষেও যে ঈশ্বর অস্বীকারের পরিপূর্ণ সুযোগ ছিলো তারই নজির হিসেবে সাধারণত সাংখ্য ও মীমাংসার উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এদিক থেকে সাংখ্যের চেয়ে মীমাংসা চিত্তাকর্ষক বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে-
‘…সাংখ্যকে বেদমূলক বলে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে শঙ্কর, রামানুজ প্রমুখ অগ্রণী আস্তিকেরা তীব্র আপত্তি তুলেছেন এবং সে আপত্তি ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু মীমাংসা-প্রসঙ্গে এ-জাতীয় সামান্যতম সংশয়ও কল্পনাতীত। কেননা, বেদের চরম প্রামাণ্যই– বেদের অপৌরুষেয়ত্ব এবং নিত্যত্ব– এ সম্প্রদায়ের মূল প্রতিপাদ্য এবং “এই কর্মমীমাংসার মধ্যে দুইটি কার্য করা হইয়াছে। প্রথম, –বেদবাক্যের প্রকারভেদ নির্ণয় এবং দ্বিতীয়, –বেদ-বাক্যের মধ্যে আপাতবিরোধের পরিহারপূর্বক একবাক্যতাসাধন। আর এইজন্য একসহস্র বিচার বা ন্যায় রচিত হইয়াছে।”- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৩০)
অন্যদিকে মীমাংসা চরম নিরীশ্বরবাদী দর্শন। প্রাচীন সাংখ্যকে নিরীশ্বরবাদী বলা হলেও পরবর্তীকালে বিজ্ঞানভিক্ষুর মতো ঈশ্বরবাদী দার্শনিকদের সুকৌশল ব্যাখ্যাবলে সাংখ্যের ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান কিছুটা হলেও অস্পষ্টতায় পর্যবসিত হয়েছে। সেদিক থেকে মীমাংসা দর্শনে ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান এতোটাই চরম যে পরবর্তীকালে তাকে ঈশ্বরবাদী বানানোর কোন চেষ্টাই সফল হয়নি। এই ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যানের দিক থেকে আস্তিক মীমাংসার সঙ্গে নাস্তিক বৌদ্ধাদি-সম্প্রদায়ের তুলনা চিত্তাকর্ষক হয় বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন-
‘বস্তুত, অশ্বঘোষের রচনায় যে-সব যুক্তি-তর্কের সাহায্যে বুদ্ধ ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন সেগুলির সঙ্গে প্রাচীন মীমাংসকদের যুক্তি-তর্কের আশ্চর্য সাদৃশ্য চোখে পড়ে ! আরো আশ্চর্য কথা হলো, মীমাংসা-মতে বৈদিক দেবতারাও নেহাতই শব্দমাত্র ; অতএব তাঁদের পূজা-উপাসনা সম্পূর্ণ অর্থহীন। চরম বেদপন্থী সম্প্রদায়ের পক্ষে বৈদিক দেবতা সম্বন্ধে এ-জাতীয় মত অন্তত আপাত-অদ্ভূত মনে হবে। কিন্তু আরো বিস্ময়কর মনে হবে স্বর্গ এবং অপবর্গ সংক্রান্ত মীমাংসা-মত। কেননা নিরতিশয় সুখ বা প্রীতির নামই স্বর্গ এবং তা এই মর্ত্যলোকেই সম্ভব। আর মোক্ষ ? আধুনিক বিদ্বানদের পক্ষ থেকে মীমাংসাকে মোক্ষশাস্ত্র প্রতিপন্ন করার নানান কষ্টকল্পিত প্রয়াস সত্ত্বেও, প্রাচীন মীমাংসকেরা মোক্ষের প্রতি প্রকৃতই উদাসীন ; এবং তাঁদের দর্শনে মোক্ষ-প্রসঙ্গ কেন অবান্তর সে-কথার ব্যাখ্যা পাওয়াও কঠিন নয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৩১)।
তবে এই দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান, মোক্ষ-উপেক্ষা, ভাববাদ-খন্ডন প্রভৃতির স্বকীয় দার্শনিক গুরুত্ব যাই হোক না কেন, এ সমস্তই পুরোহিত শ্রেণী বা যাজ্ঞিকদের ধ্যানধারণাই বিকশিত হয়েছিলো,- যাঁদের কাছে বৈদিক যাগযজ্ঞ বা ক্রিয়াকর্মের চেয়ে মূল্যবান বলতে আর কিছু ছিলো না। অতএব মীমাংসার এই দিকটি অনিবার্যভাবেই চূড়ান্ত সংরক্ষণশীলতার পরিচায়ক। কেবল এই বৈদিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মীমাংসা দর্শনকে বেদান্ত দর্শনের সমানতন্ত্র বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে চরম ভাববাদী বেদান্ত দর্শনের বিপরীতে মীমাংসা দর্শন আশ্চর্যজনকভাবে দুর্দান্ত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও ধারণ করে আছে। সে বিচারে মীমাংসাকে বরং ন্যায়-বৈশেষিকের সমানতন্ত্র বিবেচনা করাটা অধিকতর বিবেচনা-সম্মত মনে হয়। তবে আপাত-দৃষ্টিতে মীমাংসাকে কোনো এক কুহেলিকা মনে হতে পারে। কেননা, সামগ্রিকভাবে দেখলে মনে হয় এ-দর্শনের কিছুটা উপাদান যেন অত্যাধুনিক, কিছুটা অতি আদিম। তাই মীমাংসা দর্শন বুঝতে হলে খণ্ডিতভাবে না-দেখে সামগ্রিকভাবেই বোঝার প্রচেষ্টা নিতে হয়।
…
(চলবে…)
…
[*] [পরের পর্ব : মীমাংসা সাহিত্য]
…
No comments:
Post a Comment