Saturday, June 1, 2013

| মীমাংসা দর্শন-০২ : মীমাংসা-সাহিত্য |

.
| মীমাংসা দর্শন-০২ : মীমাংসা-সাহিত্য |
রণদীপম বসু

২.০ : মীমাংসা-সাহিত্য
 
মীমাংসা-দর্শনের প্রাচীনতম এবং মূল গ্রন্থ হলো জৈমিনির ‘মীমাংসাসূত্র’। ভারতীয় দর্শনের সূত্রগ্রন্থ হিসেবে এটিকেই সর্বপ্রাচীন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও তার রচনাকাল সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হওয়া যায় না। বিভিন্ন বিদ্বান-গবেষকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টীয় ২০০-এর মধ্যে হওয়াই সম্ভব। তবে আধুনিক বিদ্বানমহলে মীমাংসাসূত্র’র রচনাকাল খ্রিস্টীয় ২০০-র কিছু পূর্ববর্তী বলে বিবেচিত হয়। জৈমিনির রচনা বলেই মীমাংসাসূত্রকে ‘জৈমিনিসূত্র’ও বলা হয়ে থাকে।

জৈমিনি কে ছিলেন সে-বিষয়ে প্রকৃত কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে নামটি যে প্রাচীন এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সামবেদের একটি শাখার নাম জৈমিনীয় সংহিতা। সামবেদের একটি ব্রাহ্মণও জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ নামে খ্যাত। কিন্তু এই জৈমিনি এবং মীমাংসা-সূত্রকার একব্যক্তি হওয়া সম্ভব নয়। আবার পঞ্চতন্ত্র-এর (২/৩৬) উপাখ্যান অনুসারে জৈমিনি হস্তীপদদলিত হয়ে মারা যান বলে উল্লেখ আছে। ভাগবত পুরাণে (১২/৬/৫৫) বলা হয়েছে আচার্য ব্যাস-এর কাছে জৈমিনি সামবেদসংহিতা অধ্যয়ন করেছিলেন। এ জাতীয় কোন উক্তির উপরই ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরোপ করা সম্ভব নয় বলে গবেষকরা মনে করেন।

মীমাংসাসূত্রের রচনাকাল নিয়ে সংশয় থাকলেও মীমাংসা-দর্শনকে তার চেয়ে অনেক প্রাচীন বলে অনেকেই মনে করেন। এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেন-
‘প্রথমত, জৈমিনি-সূত্রেই বাদরি, ঐতিশায়ন, কার্ষ্ণাজিনি, লাবুকায়ন, কামুকায়, আত্রেয়, আলেখন, বাদরায়ণ প্রমুখ প্রাচীনতর মীমাংসকাচার্যর মত উদ্ধৃত হয়েছে; অতএব জৈমিনিপূর্ব সুদীর্ঘ আচার্য-পরম্পরা অনুমেয়। দ্বিতীয়ত, কীথ্ যেমন দেখাচ্ছেন, ধর্মসূত্রগুলিতেই দেখা যায় যজ্ঞ-প্রসঙ্গে যাজ্ঞিকদের মধ্যে নানা মতান্তরের উদ্ভব হয়েছে এবং আপস্তম্ব প্রমুখ “ন্যায়”-এর নজির দেখিয়ে তার সমাধান দিচ্ছেন; এই “ন্যায়”-ই মীমাংসার প্রাচীনতম নাম, যদিও পরবর্তীকালে এ-নামের একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিলো। এমনকি আপস্তম্ব-ধর্ম-সূত্রর অনেক সূত্রের সঙ্গে মীমাংসা সূত্রের প্রায় হুবহু সাদৃশ্য প্রদর্শিত হয়েছে। বস্তুত ব্রাহ্মণ-সাহিত্যেই বিভিন্ন যজ্ঞের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে মতভেদের পরিচয় পাওয়া যায় এবং অনুমান হয় এ-জাতীয় মতভেদের সমাধানকল্পেই ক্রমশ মীমাংসা-শাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। অতএব মীমাংসাসূত্রের কাল-নির্ণয় যাই হোক না কেন সম্প্রদায়টির সূত্রপাত অত্যন্ত সুপ্রাচীন।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৩৪) 


জৈমিনির মীমাংসাসূত্র ১২টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই অধ্যায়ে ৭টি পাদ এবং ২৭৪৪টি সূত্র আছে। তবে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর দর্শন-দিগদর্শন গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১৪২) মীমাংসাসূত্রের সূত্র সংখ্যা ২৫০০ উল্লেখ করেছেন। মীমাংসাসূত্রের পরিপূরক হিসেবে মহর্ষি জৈমিনি ‘সঙ্কর্ষণ কাণ্ড’ নামে চার অধ্যায় বিশিষ্ট একটি গ্রন্থ রচনা করেন বলে কারো কারো অভিমত। তবে এ বিষয়ে সবাই একমত নন। মীমাংসার ১২ অধ্যায়, সঙ্কর্ষণ কাণ্ডের চার অধ্যায় এবং উত্তরমীমাংসার চার অধ্যায়ের একটি ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন আচার্য বৌধায়ন। এই ভাষ্যগ্রন্থটির নাম ‘কোটিভাষ্য’। আচার্য উপবর্ষ এই বিশ অধ্যায়েরই বৃত্তি রচনা করেন। পরবর্তীতে আচার্য দেবস্বামী উত্তরমীমাংসার চার অধ্যায়কে বাদ দিয়ে ষোল অধ্যায়ের অপর একটি ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তীকালে মীমাংসাসূত্রের উপর অনেক ভাষ্যগ্রন্থ রচিত হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে এসব ভাষ্যগ্রন্থের মধ্যে শবরস্বামীর ‘শাবরভাষ্য’ই প্রাচীনতম। এই শাবরভাষ্যেই মীমাংসাসূত্রের প্রাচীনতর ব্যাখ্যাকারদের কথা পাওয়া যায়। 

শবরের কাল-নির্ণয়ও অনিশ্চিত। শুধু এটুকু ধারণা করা হয় যে, শবর খ্রিস্টীয় ৪০০-এর পূর্ববর্তী হবেন। এবং মীমাংসা-দর্শনের সমস্ত আলোচনার প্রধানতম ভিত্তি এই শাবরভাষ্যই। শবরের পর মীমাংসকাচার্যদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুজন হলেন- প্রভাকর মিশ্র ও কুমারিল ভট্ট। উভয়েই শাবরভাষ্যের ব্যাখ্যা করেছেন। প্রভাকরের প্রধান ও বড়ো ব্যাখ্যাগ্রন্থটির নাম ‘বৃহতী’ এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার নাম ‘লঘবী’। কুমারিলের ব্যাখ্যাগ্রন্থের তিনটি খণ্ড- ‘শ্লোকবার্তিক’, ‘তন্ত্রবার্তিক’ এবং ‘টুপ্-টীকা’। কিন্তু প্রভাকর ও কুমারিল উভয়ের ব্যাখ্যায় এতোটাই মৌলিক পার্থক্য যে, তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে মীমাংসামত দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রভাকরের নাম থেকে প্রথমটিকে প্রাভাকর-সম্প্রদায় এবং কুমারিল-ভট্টর নাম থেকে দ্বিতীয়টিকে ভাট্ট-সম্প্রদায় নামে আখ্যায়িত করা হয়। প্রচলিত মতে প্রভাকর ছিলেন কুমারিলের শিষ্য এবং কুমারিল তাঁকে সম্ভবত বিদ্রূপ করেই গুরু আখ্যা দিয়েছিলেন, এ কারণে প্রভাকর-মত গুরুমত নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করে। 

প্রভাকর-মতের উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যাকার হলেন শালিকনাথ মিশ্র। তিনি প্রভাকরের বৃহতী টীকার উপর ‘ঋজুবিমলা’, লঘবী টীকার উপর ‘দীপশিখা’ গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া প্রাভাকর-মতের ব্যাখ্যা করে ‘প্রকরণপঞ্চিকা’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রকরণ গ্রন্থ রচনা করেন। প্রাভাকর-মতের আধুনিক ব্যাখ্যা মূলত এই প্রকরণপঞ্চিকার উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।
কুমারিল বা ভাট্ট মতের প্রথম ব্যাখ্যাকার মণ্ডন মিশ্র। তিনি কুমারিলের শিষ্য ও জামাতা বলে পরিচিত। তাঁর প্রধান রচনাগুলি হলো ‘বিধিবিবেক’, ‘ভাবনাবিবেক’, ‘মীমাংসানুক্রমণিকা’ ‘বিভ্রমবিবেক’। মণ্ডন মিশ্রের ‘বিধিবিবেক’-এর ব্যাখ্যায় খ্রিস্টীয় নবম শতকের দার্শনিক বাচস্পতি মিশ্র ‘ন্যায়কণিকা’ রচনা করেন।
ভাট্ট-মতের আরেকজন বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের পার্থসারথি মিশ্র। তিনি কুমারিলের ‘শ্লোকবার্তিক’-এর উপর ‘ন্যায়রত্নাকর’, টুপটিকার উপর ‘তন্ত্ররত্ন’ নামে টীকাগ্রন্থ রচনা করেন। তাছাড়া ভাট্ট-মতের ব্যাখ্যায় ‘ন্যায়রত্নমালা’ ও ‘শাস্ত্রদীপিকা’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া পরবর্তীকালে গাগাভট্টের ‘ভাট্ট চিন্তামণি’, নারায়ণ ভট্টের ‘মানমেয়োদয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ ভাট্টমতের উপর রচিত স্বতন্ত্র গ্রন্থ। অবশ্য পরবর্তীতে আরো অনেকেই মীমাংসা-মত ব্যাখ্যায় গ্রন্থ রচনা করেছেন, কিন্তু উপরিউক্ত গ্রন্থাবলিই বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 

মীমাংসাশাস্ত্রের বিষয় অতি বিস্তৃত। প্রমাণ, প্রমেয়, ধর্ম, শব্দের নিত্যতাবাদ, বেদের অপৌরুষেয়তা, মন্ত্র, বিধি, কর্মানুষ্ঠান, যজ্ঞাদির অধিকার, বাক্যার্থ বিচার, অর্থবাদ, স্বর্গ, নরক, অপূর্ব, নিরীশ্বরবাদ, মোক্ষ এ সবই মীমাংসাশাস্ত্রের আলোচিত বিষয়।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : ভূমিকা] [×] [পরের পর্ব : মীমাংসা জ্ঞানতত্ত্ব- প্রমাণ]

No comments: