Saturday, June 22, 2013

| সমতলে বক্ররেখা-০৬ : আমাদের সব আবেগই কি যুক্তিহীন !


| সমতলে বক্ররেখা-০৬ :                           
আমাদের সব আবেগই কি যুক্তিহীন !
-রণদীপম বসু
(১)
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিরপুর হার্ট ফাউণ্ডেশনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। এখানে যারা আসেন, সখ করে তো নয়, দায়ে পড়েই আসেন। একটু একটু করে হৃদয়হীন হয়ে যাওয়া এই দেশটাতে হৃদয়গত সমস্যা যে কী প্রবল তা টের পাওয়া যায় রমনা পার্ক বা এ জাতীয় উদ্যানগুলোর অন্তর্হিত নিরালা স্পটগুলোতে গেলে অথবা নগরীর বিভিন্ন হার্ট ক্লিনিকগুলোতে ঢু মারলে। যদিও দুটো জায়গার পরিবেশ পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষিত ভিন্ন, দুই দল দুই ভুবনের পাত্রপাত্রী, তবু অভিন্নতা একটাই ; উভয়েই হৃদয়গত সমস্যায় তটস্থ, কখনো কখনো বিধ্বস্ত।


হার্টের কারবারি হার্টথ্রব চিকিৎসকদের কাছে বিধ্বস্ত হার্টের রোগিদের নিয়ে যারা আসে, আত্মীয় পরিজন তো বটেই, তাদের চোখে মুখেও বিধ্বস্ত হতে যাওয়া নিজস্ব হার্টের ছবিটাও কি বুক ফেটে বেরিয়ে আসে না ? তা দেখে যে বোঝার সে ঠিকই বুঝে নেয়। নিস্পৃহ নাগরিক হিসেবে এসবই আমাদের গা সওয়া এখন। অতএব ভাঙাচোরা চেহারা দেখতে দেখতে পার হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু থেমে যেতে হলো। জটলাটা যদিও আমাদের পথচারিদের জন্য পথরোধক ছিলো না, তবু হঠাৎ একটা কৌতূহল  সঞ্চারিত হলো। 


গেটের লাগোয়া ভেতরেই একটা এম্বুলেন্সকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম ভেতরে। ক’টা বিষাদগ্রস্ত ছেলে-মেয়ের পাশে এক ক্রন্দনরত মধ্যবয়সী মহিলার কাতরোক্তি। সদ্যমৃত স্বামীই হবে, ধবধবে সাদা কাপড়ে মোড়ানো। পেছনের হুডখোলা এম্বুলেন্সে মৃতদেহটাকে তুলে নিতে পেশাদার হাতে টানা-হেছড়া করছে ক’জন। আর ক্রন্দনরত মহিলার বুকভাঙা কাতরোক্তি- ‘আস্তে ওঠান, ব্যথা পাইবো, আস্তে ওঠান..!’ 


সুখ দুঃখের উর্ধ্বে ওঠে যাওয়া মৃতের দায় তো জীবিতরাই বহন করে। যাদের উদ্দেশ্যে এই শোকাকুল অনুরোধ, তারা শুনলো কি না বোঝা গেলো না, কিন্তু বুকের কোথায় যেনো সুইয়ের মতো এসে বিঁধে গেলো কথাটা- ‘আস্তে ওঠান, ব্যথা পাইবো !’ আহা ! 


সংসারের মায়াবী সুখে দুঃখে পাশাপাশি বন্ধনে কাটিয়ে দেয়া দিনগুলোকে আমরা কেউ আর ফিরিয়ে আনতে পারি না। স্মৃতিটাই হয়তো আবেগ হয়ে নাড়া দেয় আমাদেরকে। কিছুক্ষণ পর যে মৃতকে কবরে শায়িত বা চিতায় ওঠানো হবে, সেই মৃতদেহের কষ্ট পাওয়ার আশংকায় কেঁপে ওঠাটা যত যুক্তিহীনই হোক, বুকের ভেতরে কোথায় যেনো একটা প্রশ্ন নাড়াচাড়া করতেই থাকে- আমাদের সব আবেগই কি যুক্তিহীন ?  

.
(২)
কোনকিছুই অর্থহীন নয়। কথাটা কে বলেছিলেন জানি না। তবে কথাটা যে কোনোভাবেই যুক্তিহীন না, সেটা হলফ করেই বলা যায়। আর অর্থহীন হবেই বা কী করে ! কোন কারণ বা অর্থই যদি না থাকে তাহলে বিষয় বা বস্তুর অস্তিত্ব আসে কী করে ! অর্থাৎ কার্যটার পেছনে একটা কারণ অবশ্যই রয়ে গেছে। এর অর্থ বের করতে না পারলে তা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য হতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে অবোধ্যও হতে পারে। কিন্তু অর্থহীন হওয়ার আদৌ কি উপায় আছে ? তবে কি অর্থহীন বললে তাই বুঝতে হবে যা যুক্তিহীন ? সেক্ষেত্রে আবেগকে আমরা কী দিয়ে বিশ্লেষণ করবো ?

আবেগ ছাড়া কাজ হয় না। কিংবা যে কাজে আবেগের ছোঁয়া নেই তা যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত। আমাদের মহান ভাষা-আন্দোলন কিংবা মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির জাতিগত আবেগের উত্তুঙ্গ প্রকাশকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এই আবেগের তীব্র উপস্থিতি না থাকলে এর ফলাফল অন্যরকমও যে হতে পারতো সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না একেবারে। তবুও বলা হয়ে থাকে যে, আবেগ যুক্তিহীন। কারণ তা কোনো হিসাব-নিকাশ করে আসে না। যেমন স্বামীর মৃতদেহের পাশে শোকার্ত মহিলার উক্তিটি যুক্তির কোনো শৃঙ্খলা মানে নি বলে মনে হতে পারে। আমরা জানি, একই ধরনের প্রশ্নে একাধিক ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কোথাও বা তা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব বোধগম্যতা বা বিবেচনার সাপেক্ষে তা সেরকম যুক্তিহীন মনে হলেও আদৌ কি তা যুক্তিহীন ? বস্তুত যুক্তিহীন তাকেই বলে যার মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্কটা ঠিক থাকে না। অহেতুক মন্দ কথা শুনে একজন ব্যক্তি হয়তো না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেলেন, আরেকজন ঠিকই ক্রোধান্বিত হয়ে উল্টো চার্জ করে বসলেন। অন্য আরেকজন হয়তো মাথা নত করে কিছু মনে করেননি জাতীয় ভাব ধরলেন। এই যে ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি বা প্রতিক্রিয়া, তা কি কার্য-কারণ সম্পর্ক বিহীন ? অবশ্যই না। এখানে প্রভাবক হিসেবে স্থান-কাল-পরিবেশ-পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ যদিও, তবু একই বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া থেকেই কার্য-কারণ সম্বন্ধের মাধ্যমে কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়া-প্রকাশক ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোন কোন সম্ভাব্য দিক আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ে ঠিকই। যেমন কোন স্বাভাবিক অবস্থার সাপেক্ষে মন্দ কথা শুনেও না শোনার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া প্রথমোক্ত ব্যক্তিটি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মেরুদন্ডহীন ভীতু হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কিন্তু যিনি ক্রোধান্বিত হয়ে উল্টো চার্জ করলেন তাঁকে আমরা একজন ব্যক্তিত্ববান বলিষ্ঠ চরিত্রের ব্যক্তি হিসেবে ধারণা করবো। আর তৃতীয় ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই মোসাহেব গোছের কেউ হবেন।

আবার একই প্রসঙ্গে যদি প্রভাবক পরিস্থিতিটি পাল্টে যায়, অর্থাৎ মন্দ বক্তা লোকটি যদি অনৈতিক ক্ষমতাধর প্রভাবশালী বা বিপজ্জনক সন্ত্রাসী জাতীয় কেউ হয় বলে আমরা বুঝতে পারি ? তখন ভিকটিম হিসেবে উপরিউক্ত একই প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে কার্য-কারণ সম্বন্ধ বিশ্লেষণ করলে আমাদের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে নিশ্চয়ই। সেক্ষেত্রে প্রথমোক্ত ব্যক্তিটিকে মনে হবে সুচতুর বুদ্ধিমান, দ্বিতীয় ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই একগুয়ে নির্বোধ আর তৃতীয় ব্যক্তিটি হয় নিরূপায় অসহায় বা সেই মোসাহেবও হতে পারে। কিন্তু প্রথম পরিস্থিতির স্বাভাবিক আবেগ এখানে এই দ্বিতীয় অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়াশীল নয় বলে নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কিত ধারণাটাও একইরকম থাকছে না। অবশ্য এখানেও আরেকটি রকমফের রয়েছে। কী সেটা ? এই যে ভিকটিম ব্যক্তি-চরিত্রের বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, যিনি তা করছেন তিনি যদি মন্দ-বক্তা ব্যক্তিটি সম্পর্কে কোন প্রকৃত ধারণা না রাখেন তাহলে প্রতিক্রিয়া-প্রকাশক ব্যক্তিদের সম্পর্কে মূল্যায়ন যে যথার্থ হবে না তা বলা বাহুল্য। অর্থাৎ কার্য-কারণ সম্বন্ধ নির্ধারণটা সেখানে সঠিক হবে না। তাই বলে কার্য-কারণ সম্বন্ধটা কি অস্বীকার করা যাবে ? তা যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনি ওই প্রতিক্রিয়ার প্রকাশগুলিকেও অর্থহীন বা যুক্তিহীন বলা যাবে না। তাহলে আবারো প্রশ্ন, অর্থহীনতা কী ? 

.
(৩)
ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডের মাথায় দাঁড়িয়ে আছি টাউন-বাসের অপেক্ষায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তখন। হঠাৎ খুব ফিটফাট পোশাক পরিহিত পরিপাটি চেহারার এক ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন- আচ্ছা, এখানে পাগলের চিকিৎসালয়টা কোথায় বলতে পারেন ? আমার চিকিৎসা করাবো। বলতে বলতে তিনি তাঁর ডান হাতের তর্জনিটা নিজের মাথায় এমনভাবে ঠেকিয়ে হয়তো তার সম্ভাব্য চিকিৎসাস্থলটা দেখালেন যে, আমি উত্তর দেবো কী, হা করে চেয়ে রইলাম। এবং আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফের ‘আস-সালাম-ওয়ালাইকুম’ বলেই তিনি হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। আদৌ এখানে কোন পাগলের চিকিৎসালয় আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি তাঁর যাত্রাপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, প্রলাপ বলতে আসলে আমরা কী বুঝি ? প্রলাপ কি সত্যিই অর্থহীন বা যুক্তিহীন কিছু ?

অর্থহীনতা শব্দটিকে যুক্তিহীনতার সমকক্ষ পরিভাষা ধরা গেলেও শব্দরূপ বিবেচনায় যুক্তিহীনতা আর অর্থহীনতা বোধকরি অভিন্নার্থক নয়। কার্য-কারণ সম্পর্কে না মিললে তাকে যুক্তিহীন বলা চলে, কিন্তু অর্থহীন শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় যার কোনো অর্থ নেই। এটা কি আদৌ সম্ভব ? জগতে যাকিছুই আমাদের উপলব্ধি বা জ্ঞানের আওতায় চলে আসে তাকে অর্থহীন বলা চলে না। ভাবগত অর্থে অনর্থ বলতে আমরা বুঝি একটা লন্ডভন্ড অবস্থা। তাই অর্থহীনতা নিয়ে এমন অনর্থ কাণ্ড না করে আমরা বরং আলোচনাটাকে একটা অর্থময়তার দিকেই নিয়ে যাবার চেষ্টা করি। আদতে অর্থহীন বলতে হয়তো এমন একটা ফাঁপা শূন্যময় অহেতুক অবস্থা বোঝায় যা আসলে কার্য-কারণহীন। তাতেও মনে হয় বিষয়টাকে ব্যক্ত করা যাচ্ছে না। কারণ কার্য-কারণহীন অবস্থাকে আর যাই বলা হোক, বাস্তবতা বলা চলে না। শূন্যময়তাও এক ধরনের বাস্তবতা। তারচেয়ে আমরা দৃষ্টান্তমূলক লোকব্যবহারের সহায়তা নিতে পারি। যেমন, সুখ।

সুখ কী ? অত্যন্ত সহজ একটি প্রশ্ন। বুদ্ধিমান পাঠক এর অর্থ বা সংজ্ঞাটা খুঁজবেন অবশ্যই। এ ফাঁকে একান্ত অবিবেচকের মতো এখানে একটা কথা যোগ করে রাখতে চাই যে, সুখ হলো বাস্তবিকই একটা অর্থহীন প্রপঞ্চ। যার কোনো অস্তিত্ব নেই, অথচ আছে ভেবে আমরা একধরনের সুখানুভূতি উপলব্ধি করি। কথাটা যে কৌতুক করে বলছি না তার প্রমাণ যে কেবল আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ভারতীয় দর্শনের প্রাচীন ইতিহাস, তাই নয়। আমাদের চলমান বাস্তবতার সাক্ষ্যও কোনো অংশে কম নেই। সুখের খোঁজে আমরা কী-না করছি ! জমি-জিরাত সহায়-সম্পত্তি প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্ষমতা-বিলাস ইত্যাদি যাবতীয় মায়া-হরিণের পিছে আমরা বৈধ-অবৈধ প্রতিযোগিতা-ছুটোছুটির যে মহারণে নেমেছি তা কি সেই সুখটিকে পেতে নয় ? আমাদের আগ্রাসী তৃষ্ণা চাহিদা নিয়ে এখন যে জায়গায় অবস্থান করছি এখানে সুখের ছিটেফোঁটাও আছে মনে করছি না বলে সুখের আসল জায়গাটি কোথায় আছে সেটি চিহ্নিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। এবং সেখানে পৌঁছার সর্বাত্মক চেষ্টায় নিয়োজিত হচ্ছি, প্রয়োজনে আগ্রাসী হয়ে ওঠতেও দ্বিধা করছি না। কিন্তু সেই সুখটি কোথায় ? নদীর এপাড়ে থেকে ভাবছি ওপাড়েই সর্বসুখ, তাই তড়িঘড়ি ওপাড়ে যাওয়ার হুটোপুটি লাগিয়ে দিচ্ছি। ওপাড়ে গিয়ে দেখছি, নাহ্, এখানে তো নেই ! নিশ্চয়ই অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে। আবার হুড়োহুড়ি লেগে যাচ্ছে অন্য কোথাও ছুটার।

চাকুরির ধরাবাধা বৈধ আয়ে সুখ কোথায়, সংসারই তো চলে না। অতএব দরকার বাড়তি আয়। সেটা আসবে কী করে ? প্রচলিত নৈতিকতা ধ্বসে যাচ্ছে। ব্যবসার বাজারে মাৎসোন্যায় প্রতিযোগিতা, একে অন্যকে হটাতে গিয়ে বড় মাছ ছোটটাকে গিলে ফেলছে, নইলে ব্যবসায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে শাখা-প্রশাখা বিস্তারের ধারাবাহিক প্রতিপত্তি আসবে কী করে ! প্রতিপত্তিবান ভাবছে অর্জিত সম্পদের নিরাপত্তায় ক্ষমতা ও প্রভাব না-থাকাটাই তো সুখের কাঁটা। এজন্যে করায়ত্ত করা চাই মিডিয়া ও রাজনীতি। আর রাষ্ট্রক্ষমতা না পেলে রাজনীতির সুখটা কোথায় ! ক্ষমতাসীনের অ-সুখ হলো ক্ষমতার চেয়ার হাতছাড়া হওয়ার দুঃশ্চিন্তা। অতএব রুখে দাও প্রতিবাদী কণ্ঠ, বিরুদ্ধাচরণ। প্রতিবাদীরা ভাবছে এ তো অন্যায়, অতএব হটাও তাদের, চলুক সংগ্রাম। এই অষ্টচক্র প্রতিযোগিতার পদে পদে রয়েছে আবার সমস্তরের প্রতিযোগীদের মধ্যে টিকে থাকার ভিন্ন আরেক অখন্ড লড়াই, একে অন্যকে পেছনে ফেলার পদদলিত করার খন্ডযুদ্ধ। এই আবহমান যুদ্ধের সৈনিক কিন্তু আমরা সবাই, সমাজের প্রতিটা ব্যক্তি-সত্তা। পরস্পরকে চাপা দেয়ার নিশ্চিহ্ন করার এই অনিবার্য্য চক্রবুহ্যে আমরা ঢুকতে জানি সবাই, আমাদেরকে ঢুকতে হয়। কিন্তু এই সুখের অসুখে আক্রান্ত মহামারী থেকে বেরোবার উপায় কিংবা ফেরার রাস্তা জানা নেই আমাদের। এই সম্মোহনী প্রতিযোগিতায় থামতেও জানে না কেউ, কারণ তা এমনই এক মায়ার বিভ্রম যে, কোথায় থামতে হয় তাও জানা নেই কারো। কেবল প্রতিযোগিতা থেকে তীব্র আশাভঙ্গতায় ছিটকে গেলেই বুঝি তখন বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাসের মতো আকুতি বেরিয়ে আসে-
‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল, অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।/ সখি কি মোর করমে লেখি, শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু ভানুর কিরণ দেখি।/ উচল বলিয়া অচলে চড়িতে পড়িনু অগাধ জলে, লছিমি চাহিতে দারিদ্র্য বেঢ়ল মাণিক্য হারানু হেলে।/ নগর বসালাম সায়র বাঁধিলাম মাণিক পাবার আশে, সাগর শুকাল মাণিক লুকাল অভাগার করম-দোষে।/ পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু বজর পড়িয়া গেল, জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি মরণ অধিক শেল।’

এখন প্রশ্ন, এই যে সুখের জন্যে অনাদিকাল থেকে মানুষের মধ্যে এতো আহাকার, এতো প্রতিযোগিতা, এতো লড়াই-বিবাদ, এই সুখ কি পেয়েছে কেউ কখনো ? সবাই বলেন সুখ-দুঃখের অনুভূতি একান্তই ব্যক্তিনির্ভর এবং এটি একান্তই ব্যক্তির মানসিক-অনুভূতি বলে তার মূল্যায়নও একেকজনের কাছে একেকরকম। জানতে ইচ্ছে করে, সুখের এই সংজ্ঞাই বা কার কাছে কেমন তা কি জানে কেউ ? কেউ কি আজ পর্যন্ত জানিয়েছে কোথাও, সুখ এরকম বা সুখ ওইরকম ইত্যাদি ? বস্তুতই এটি এক গূঢ় রহস্যই বটে। তবে কি মানবজীবনের সবচাইতে উচ্চকিত না-পাওয়াজনিত বেদনার বিষয়টাই সুখ ? কী সেই না-পাওয়া সুখ, তার স্বরূপই বা কেমন ? জীবনের গূঢ়-তত্ত্ব নিয়ে কৌতুহলি বিচার-বিশ্লেষণ করেন তত্ত্বজ্ঞানী দার্শনিকেরা। সেক্ষেত্রে আমরা কি তাঁদের কাছ থেকে কোনো সুরাহা পেতে পারি ? 

.
(৪)
মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য বা পুরুষার্থ সিদ্ধির জন্যই ভারতবর্ষে দর্শনচর্চার উদ্ভব। সেকালের তত্ত্বজ্ঞানী দার্শনিকদের দৃষ্টিতে জীবন আর কিছু নয়, দুঃখের প্রবহমানতা মাত্র। জন্মে দুঃখ, মরণে দুঃখ, অপ্রিয়-সংযোগে দুঃখ, প্রিয় বিরহে দুঃখ, এমনকি প্রিয়-সংসর্গেও দুঃখ, সর্বত্রই দুঃখের আয়োজন। জন্মে দুঃখ কারণ জন্ম হলেই জরা-মরণের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। প্রিয় সংসর্গে দুঃখ কারণ তাতে বিচ্ছেদের দুঃখময় অনিবার্যতা নিশ্চিত হয়ে যায়। জীবনে দুঃখ, যাপনে দুঃখ, এই যে দুঃখ আর দুঃখ, তার কারণ খুঁজতে খুঁজতে এবং তা থেকে মুক্তির উপায় বের করতেই নিজের নিজের মতো করে এতোগুলো দর্শনের আবির্ভাব হয়ে গেলো। কিন্তু এই দর্শনগুলোতেই বা সুখের খোঁজ পেলাম কোথায় ! সুখ কি আসলেই নেই কোথাও ? আর যদি না-ই থাকে তো এই সুখ বিষয়টা আমাদের ধারণার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো কী করে ?

বিশ্বখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) তাঁর ‘The Principles of Mathematics’-এ বিষয়বস্তুর অবস্থানের দুটো ভেদের কথা উল্লেখ করেছেন- ‘Being’ ও ‘Existence’।  অভিধান ঘেটে শব্দ দুটোর বাংলা পারিভাষিক অর্থ হতে পারে যথাক্রমে ‘সত্তা’ ও ‘অস্তিত্ব’। কিন্তু তা দিয়ে প্রকৃত ভাবগত অর্থ ব্যাখ্যা করা যায় না। যেমন আমাদের প্রাচীন রূপকথার গল্পে ‘মৎসকন্যা’ কিংবা ‘পঙ্খিরাজ ঘোড়া’ এজাতীয় শব্দের উল্লেখ পাই। শব্দগুলো কিন্তু অর্থহীন নয়। কেননা সেগুলোর মাধ্যমে আমরা কোনো-না-কোনো অর্থরূপ বুঝি। ‘মৎস্যকন্যা সমুদ্রে ডুব দিলো’ কিংবা ‘রাজপুত্র পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে উড়ে চললো’ বললে বাক্যগুলোর ভাব ও অর্থ কিন্তু আমরা বুঝি ঠিকই, একটা চিত্রকল্পও ভেসে ওঠে আমাদের কল্পনার চোখে। যদিও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। প্রাচীন ব্যাকরণকার দার্শনিক পাণিনি’র (সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৪০০) দর্শনে এই দুটো শব্দেরই প্রতিরূপ পাই ‘বুদ্ধিসত্তা’ ও ‘বহিঃসত্তা’ হিসেবে। অর্থাৎ বুদ্ধিসত্তা হলো আমাদের কল্পনায় অবস্থান করলেও বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই। আর ‘বহিঃসত্তা’ হলো বাস্তবে যার অস্তিত্ব রয়েছে। ‘সুখ’ নামক বিষয়টা কি সেরকমই কোন বুদ্ধিসত্তা, যা ধারণায় আছে বাস্তবে নেই ? এর উত্তরটাও হয়তো ভারতীয় দর্শন থেকেই পেয়ে যেতে পারি আমরা।

ভারতীয় দর্শনে সুখ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য না থাকলেও দুঃখের যে ছড়াছড়ি রয়েছে তাই হয়তো স্বাভাবিক। কেননা, দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজাটাই ভারতীয় দর্শনের মূল বিবেচ্য। আর সে লক্ষ্য থেকেই দর্শন সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ জ্ঞান-তাত্ত্বিক চর্চা ও বহুবিধ তত্ত্বেরও উৎপত্তি বলা যায়। এই দুঃখকে বাদ দিলে ভারতীয় দর্শনটাই মূলত লক্ষ্যহীন হয়ে যায়। তাই দার্শনিক জ্ঞানচর্চার শুরুটাই হয়েছে দুঃখের কারণটাকে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। চার্বাক দর্শন ছাড়া বাদবাকি দর্শনগুলোতে মনে করা হয় অবিদ্যা বা অজ্ঞতাই হলো সকল দুঃখের কারণ। তাদের মতে, মানুষ দুঃখ পায় কারণ সে তার আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানে না। আত্মার সংকীর্ণ চেতনা থেকে উদ্ভূত হয় মানুষের ঘৃণা ও আসক্তি। প্রিয়বিয়োগ ও অপ্রিয়-সংযোগ দুঃখ যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করলে প্রিয় ও অপ্রিয়ের পার্থক্য দূরীভূত হয় এবং সব মানুষই এক পরম সত্তার প্রকাশ বলে মানুষ জানতে পারে। সুতরাং তখন দুঃখও দূরীভুত হয়। অনাত্মবাদী বৌদ্ধদর্শনে এই আত্মার স্থলে প্রতীত্য-সমুৎপাদ নীতিকে প্রযুক্ত করা হয়েছে।

দুঃখকে দূর করার নিমিত্তে বিভিন্ন দর্শনে বিভিন্ন প্রকারের সাধনা ও তা চর্চার বহুবিধ পথের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু এই উপায় বা প্রণালী উপস্থাপন ছাড়া প্রাচীন দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকেরা সুখের সংজ্ঞা দেননি কোথাও। যেমন গৌতম বুদ্ধের তথাগত বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির অনুসঙ্গ হিসেবে প্রসিদ্ধ যে চারটি আর্যসত্যের জ্ঞান, তাও দুঃখ-কেন্দ্রিক। সেগুলো হচ্ছে, দুঃখ আছে বা জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ নিবারণের উপায় আছে, এবং দুঃখ নিবৃত্তি মার্গ বা উপায়। এই চতুষ্টয় আর্যসত্যের ব্যাখ্যার মধ্যেও কোথাও কিন্তু সরাসরি সুখের কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, দুঃখ থেকে মুক্তি বা দুঃখ দূরীভূত করার উপায় আয়ত্ত করে তা প্রতিপাদন করাটাই বোধয় সুখ। অর্থাৎ যে দুঃখ অস্তিত্ববান তার অভাবই কি সুখ ? কিন্তু তাই বা বলি কী করে ! দুঃখের অভাবকে সুখ বলা হলে সুখকে অভাবাত্মক জ্ঞান বলতে হবে। দর্শনতত্ত্ব অনুযায়ী জ্ঞান হলো উপলব্ধির বিষয়। সেক্ষেত্রে অস্তিত্ববান দুঃখ উপলব্ধির বিষয় হলে সুখ হবে অনুপলব্ধির বিষয়। কিন্তু অনুপলব্ধি কি জ্ঞান হয় ? যা উপলব্ধির মধ্যেই নেই তাকে জ্ঞান বলা যায় না। আর যা জ্ঞানের বিষয় হয় না তার অস্তিত্ব কী করে স্বীকৃত হবে ! এজন্যেই কি গীতিকবির কণ্ঠনিঃসৃত জিজ্ঞাসা গুমড়ে ওঠে এভাবে- ‘সুখ তুমি কী আমার জানতে ইচ্ছে করে…!’ 

.
(৫)
নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধের মতবাদে ‘প্রতীত্য-সমুৎপাদ’ নামে যে তত্ত্বটি ভারতীয় দর্শনে অতি প্রসিদ্ধ নীতি হিসেবে চিহ্নিত, ওটাই গোটা বৌদ্ধদর্শনের মূল বা কেন্দ্রবিন্দু বলতে পারি। সেটাকে ঘিরেই তাঁর অনুসারীদের মধ্যে নানান দার্শনিক মতের সৃষ্টি হয়েছিলো। বুদ্ধের ওই প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্বের সারাংশ হলো, জগতের কোন কিছুই কার্য-কারণ সম্পর্কের বাইরে নয়। জগতের যাবতীয় বস্তু বা বিষয় ক্ষণিক এবং তা প্রতীত্য-সমুৎপন্ন, অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষণিকতার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। এই ক্ষণে যে আমিটা আছি, পরের ক্ষণেই সেটা বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এই আমি সদৃশ আরেকটা আমির উদ্ভব হয়। আবার এই দ্বিতীয় ক্ষণের আমিটাও পরের ক্ষণে বিনষ্ট হয়ে আরেকটা আমির সৃষ্টি হয়। এভাবে অসংখ্য ক্ষণিকতার মধ্য দিয়ে আমার অস্তিত্ব প্রবাহটা বয়ে যেতে থাকে। এই প্রবাহকে বুদ্ধবাদীরা বলেন বিজ্ঞান-প্রবাহ। এটিকে বোঝাতে বৌদ্ধ দার্শনিকেরা জ্বলন্ত প্রদীপের উদাহরণ দেন। প্রদীপের প্রতিটা শিখা যেমন ভিন্ন ভিন্ন, একটি শিখা নিভে গিয়ে পরক্ষণেই তার জায়গায় আরেকটি শিখা জ্বলে উঠে। তার পরমুহূর্তে আবার আরেকটি। এভাবে অসংখ্য শিখার অবিচ্ছিন্ন  ধারাবাহিকতা বা প্রবাহকেই আমরা প্রদীপ হিসেবে দেখি। যতক্ষণ প্রজ্জ্বলিত হবার মতো তৈল থাকে, ততক্ষণই এই প্রবাহ চলতে থাকবে। জগতের যেকোন বস্তু বা বিষয়ের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য বলে বুদ্ধমতে স্বীকার করা হয়। এভাবেই শিশু থেকে বুড়ো আমির দিকে চলমান আমার অস্তিত্ব একসময় জরামরণের মধ্যে দিয়ে আরেকটা জন্মচক্রের সূচনা করে। কারণ আমরা তো কেউ পূর্ণ তৃপ্তি বা তৃষ্ণাহীন অবস্থায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি না। আমাদের মধ্যে অসংখ্য অতৃপ্তি চাওয়া পাওয়া ও অবদমিত ইচ্ছার গুঞ্জরণ থেকে যায়। ফলে আমাদেরকে আবারো পুনর্জন্মের মাধ্যমে দেহধারণ করতে হয়। কিন্তু এই তৃষ্ণাটাকে যদি এই জীবনে নির্বাপণ করা যেতো, তাহলে আবারো আরেকটা জন্ম গ্রহণের মাধ্যমে দেহ ধারণ করে এই দুঃখময় জগতে পদার্পণ করতে হতো না। ফলে দেহধারণই দুঃখের কারণ এবং নির্বাণের মাধ্যমে তৃষ্ণা দূর করা গেলেই আর জন্মরূপ দুঃখে প্রত্যাবর্তন করতে হতো না। এই জন্মচক্র থেমে যাওয়াটাই নির্বাণ। সকল চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে এক তৃষ্ণাহীন অবস্থা, যা বর্ণনারও অগম্য।

দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে পূনর্জন্ম নিয়ে বিস্তর মতভেদ থাকতে পারে এবং রয়েছেও। দার্শনিক মতভেদ রয়েছে মৃত্যুর পরবর্তী কোন অন্তহীন অবস্থা নিয়েও। তবে, এই যে সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে নির্বাণরূপ চিরমুক্তির এক তৃষ্ণাহীন অবস্থা, তাকেও কিন্তু সুখ বলা হয়নি। এই নির্বাণ ধারণাটাকেই কোন দর্শনে বলা হয় মোক্ষ, কোথাও উচ্ছেদ, কোথাও বা ঐকান্তিক মুক্তি। এই অবস্থাটাকে বলা হচ্ছে বর্ণনার অগম্য। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, নির্বাণ নামক তৃষ্ণাহীন অজ্ঞাত অবস্থাটা বর্ণনার অগম্য কেন ? কারণ বর্ণনা করতে হলে জ্ঞানের যে ব্যক্ত অবস্থার প্রয়োজন সেটা এখানে অনুপস্থিত। ব্যক্ত না হলে কোন জ্ঞানই তো প্রত্যক্ষাদি অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয় না। ফলে তা ভাষার আওতায় আসে না বলে বর্ণনার অগম্য। ভাষার অক্ষমতাও এটাই যে, যে উপলব্ধি কখনো আমাদের লোকব্যবহারমূলক অভিজ্ঞতার মধ্যে আসেনি তাকে ভাষা প্রকাশ করতে পারে না। ভাষা তো আসলে অনুভূতি আদান-প্রদানের একটা সামাজিক ব্যবহার মাধ্যম। তার সক্ষমতা নির্ভর করে কোন সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠির পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের সক্ষম প্রক্রিয়ার উপর। অতএব, মানুষের অভিজ্ঞতা যেখানে পৌঁছাতে অক্ষম সেখানে ভাষার প্রকাশ অসম্ভব। ভাষা যা প্রকাশ করতে পারে না তাকে নিশ্চয়ই বুদ্ধিসত্তাও বলা যায় না। এটাই কি তবে অর্থহীনতা ? মৃত্যুপরবর্তী স্ব-আরোপিত কাল্পনিক অবস্থিতির একটা অব্যক্ত ধারণা, যা বর্ণনার অগম্য। সুখের মতোই প্রমাণবিহীন।

বাস্তবে অবস্থিতি সম্ভব না হলেও অর্থগতভাবে বুদ্ধিসত্তা যেহেতু অস্তিত্বহীন নয়, তাই প্রশ্ন হতে পারে,  অর্থহীনতা মানে কি অস্তিত্বহীনতা ? কিন্তু তা কেন হবে ! যার কোনো অস্তিত্বই নেই তার অর্থ বা অনর্থের বিষয়টাই প্রযোজ্যহীন নয় কি ? ধরা যাক্, জগতে আদৌ সৃষ্টিই হয়নি বা যা আমাদের ভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার বাইরে সেরকম অনির্বচনীয় কোনো কিছুর কাল্পনিক সৃষ্টি কি সম্ভব ? ইতঃপূর্বে বুদ্ধিসত্তার দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা যেসব কল্পকাহিনীর চরিত্রগুলোর কথা উল্লেখ করেছি যা আদৌ কখনো ছিলো না বা এখনো নেই, যেমন ময়ূরপঙ্খী ঘোড়া, ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানো-রাক্ষস-খোক্ষস কতো কিছু, সেগুলির কল্পনায়ও একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, আদৌ আমরা এমন কিছু কি কল্পনা করতে পারছি যা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরের ? শূন্যে উড়াল দিতে সক্ষম ময়ূরপঙ্খী ঘোড়া হয়তো বাস্তবে নেই, কিন্তু ময়ূরের পাখা বা ঘোড়ার উপলব্ধি কিংবা আকাশে উড়ন্ত কিছু দেখা কি আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু ? আসলে অনেকগুলি যৌক্তিক বাস্তবতার ধারণা থেকে নিজের মতো করে কিছু অভিজ্ঞতাকে এনে ইচ্ছেখুশি জোড়া লাগিয়ে নতুন একটা কাল্পনিক বাস্তবতার সৃষ্টি করা হয়েছে কেবল। সাহিত্যের ভাষায় তাকেই হয়তো জাদুবাস্তবতা বলে। এতে মানব-মনের কোন অবচেতন ইচ্ছার অতৃপ্তিকে বৈকল্পিক সুখ দিলেও সত্যিকার বাস্তবতার শর্ত পূরণ করে না আদৌ। এই জাদুবাস্তবতাকে আমরা ভাষায় ব্যবহার করতে পারছি, কারণ এগুলি অযৌক্তিক হলেও আমাদের উপলব্ধির বাইরের কিছু নয় বলে তাকে অর্থহীন বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। বাস্তবতার কল্পনা দিয়ে গড়া বলেই তারও একটা ব্যবহার-যোগ্যতা রয়েছে। যা দিয়ে রূপকথা জাতীয় কল্পকাহিনীর জন্ম দেয়া যাচ্ছে। কিন্তু অস্তিত্বহীন নয় এমন কোন্ অবস্থিতি রয়েছে যে তা ভাষার অগম্য ?

ভারতীয় দর্শনে বস্তু বা বিষয়ের উপলব্ধিকে জ্ঞান বলা হয় এবং আরো বলা হয় যে, জ্ঞান প্রকাশস্বভাব। বস্তুকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করাই জ্ঞানের কাজ। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উৎপত্তির দুটি পর্যায়- একটি নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ, অন্যটি সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের মাধ্যমে বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে অব্যক্ত জ্ঞান জন্মে। তার পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের অতীত জ্ঞানের ভিত্তিতে অর্থাৎ নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে বস্তুটির যখন ব্যাখ্যাযোগ্য জ্ঞান হয় অর্থাৎ বস্তুটির জাতি, ধর্ম, ক্রিয়া প্রভৃতির সুস্পষ্ট জ্ঞান হয় তখন তাকে বলা হয় সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। দ্রব্যাদি প্রত্যক্ষের প্রথমক্ষণে যে অব্যক্ত নির্বিকল্পকজ্ঞান উৎপন্ন হয়, তার পরক্ষণেই দ্রব্যাদি পদার্থ দ্রব্য, গুণ, কর্ম, জাতি ও নাম এই পঞ্চবিকল্পযুক্ত হয়ে আবির্ভূত হয়। আর তখনই আমরা বস্তুটিকে চিনতে পারি যে এটা কাগজ বা ওটা পাথর বা সেটা জল ইত্যাদি। বিষয়ের এই বিশিষ্টজ্ঞানই সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। বিষয়ের উপলব্ধি এই সবিকল্পক অবস্থায় এলেই তা ভাষায় প্রকাশের সক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। তাহলে যে উপলব্ধি এই সবিকল্পক অবস্থায় উত্তরণ ঘটে না তাকে কি আমরা জ্ঞান বলতে পারি ? যেহেতু জ্ঞান প্রকাশস্বভাব, তাই প্রকাশের অগম্য হলে দার্শনিক দৃষ্টিতেই আমরা সেই অব্যক্ত উপলব্ধিকে জ্ঞান বলতে পারি না। মূলত তা কোন উপলব্ধিই নয়। বস্তুত তার কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থিতিই নেই। যার অবস্থিতিই নেই তার অর্থহীনতারও দায় নেই। অর্থাৎ অর্থহীনতার ধারণার সাথে বিষয়ের অবস্থিতির একটা সম্পর্ক রয়েছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। তবুও ভাষার অগম্য বলে যে উপলব্ধিহীন অবস্থিতির কল্পনা করা হয়, তা কি আসলে অর্থহীন ভাববাদী প্রপঞ্চ মাত্র নয় ? সুখ হয়তো এরকমই কিছু। কিন্তু গোটা বিষয়টা নিশ্চয়ই অর্থহীন নয়। নইলে আমরা এতোক্ষণ সুখ সুখ বলে চেঁচাচ্ছি কেন ? 

.
(৬)
দর্শন কী তা বোঝাতে গিয়ে কে যেন কৌতুক করে বলেছিলেন, দর্শন হলো অমাবস্যার রাতে অন্ধকার বন্ধ ঘরে অস্তিত্বহীন কালো বিড়াল খোঁজা। এটাকেই যদি অর্থহীন কাণ্ডকীর্তি বলা না যায় তাহলে অর্থহীনতার আর কী অর্থ হবে ! দর্শনের দৃষ্টিতে সম্ভবত সুখই হলো সেই কালো বিড়াল যাকে আমরা এতোক্ষণ ধরে অর্থহীন খোঁজাখুঁজি করে গেলাম। কিন্তু ভীষণ অর্থময় একটা ‘সুখ’ নামের অস্তিত্বশীল শব্দরূপ থাকার পরও যদি সুখকে অন্তত একটা বর্ণনাগ্রাহ্য বুদ্ধিসত্তা বলেও স্বীকার করতে না পারি, এর চাইতে অর্থহীনতা আর কী থাকতে পারে ! তাই অযথা টানাহেঁচড়া করে ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়ে বরং অর্থহীনতার একটা বাস্তবসম্মত উদাহরণে আসা যাক।

শিল্পে কিউবিজমের জনক বলে স্বীকৃত ফরাসি শিল্পী পাবলো পিকাসোকে নাকি এক শিল্পরসিক দর্শক বেশ উষ্মার সাথেই বলেলেন- এসব অর্থহীন কী আঁকাবুকি করেন ! আগা নাই মাথা নাই এসব ছবি আঁকতে আবার কিছু জানতে হয় নাকি ! পিকাসো মুচকি হেসে আপাত অবোধ্য হরফে লেখা একটা কাগজ বের করে লোকটার সামনে ধরে বললেন- দেখুন তো এখানে কী লেখা আছে ? লোকটি কিছুই বুঝতে না পেরে বললো, এটা কোন্ ভাষা ? চিনারা কিন্তু এই লেখা বুঝে, পিকাসো উত্তর দিলেন। আমি তো চিনা ভাষা জানি না ! লোকটির কথায় অমনি পিকাসো বললেন- চিনা ভাষা শিখলে কি এই লেখাটার অর্থ উদ্ধার করা যাবে বলে মনে করেন? চিনা ভাষা হলে নিশ্চয়ই তা বোঝার কথা ! লোকটির ঝটপট উত্তর। সাথে সাথে লোকটির কথাই ফিরিয়ে দিয়ে পিকাসো বললেন, শিল্পেরও একটি ভাষা আছে, ওটাও শিখতে হয়। নইলে আপাত অবোধ্য শিল্পকলাকে এরকম অর্থহীনই মনে হবে।

পিকাসোর এই দৃষ্টান্ত থেকে আমরা অর্থহীনতার একটি অর্থ হয়তো বুঝে নিতে পারি। অর্থময়তার বিপরীত অবস্থাটাই অর্থহীনতা। একজনের কাছে যে বিষয় অর্থময়, আরেকজনের কাছে তাই আপাত অর্থহীন হতে পারে। অর্থাৎ কোন আপেক্ষিক অবস্থানে একই বিষয় কারো কাছে অর্থহীন হলেও আর কারো কাছে তা অর্থহীন নয়। তবে যেহেতু কোন বিষয়ের প্রসঙ্গ আসছে, তাই অর্থের সাথে বিষয়ের অবস্থিতি অনিবার্য বলেই মনে হয়। এবং জ্ঞান বা উপলব্ধি যেহেতু সবিকল্পক, তাই অর্থবোধকতার মানদন্ড ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু জগতে কোনকিছুই অর্থহীন হয় না আসলে। কারণ, মানুষই একমাত্র প্রাণী যার সীমাহীন সম্ভাবনায় যে কোন অর্থহীন বিষয় বা মুহূর্তকে অর্থময় বানিয়ে ফেলার অভাবনীয় ক্ষমতা ও সৃজনশীলতা রয়েছে। এই আপেক্ষিকতা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য।

সেরকমই কোন এক আপেক্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে স্বামীর মৃতদেহের টানাহেঁচড়ায় ক্রন্দনরত মহিলাটির  ‘আস্তে ওঠান, ব্যথা পাইবো’ বলে বুকভাঙা কাতরোক্তিটি যুক্তিহীন অর্থহীনতার সীমানা ডিঙিয়ে এমন এক বাঙ্ময় অর্থবোধকতায় উত্তরণ ঘটে, যেখানে প্রবহমান জীবনের ভাষাই অর্থহীন হয়ে যায়। এখানে না থাকতে পারে সৃজনশীলতার প্রভাব, কিন্তু আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত উত্তাপ জীবনলগ্ন হয়ে গেলে তা যদি হয় চিরায়ত দুঃখ বা বিষাদের ঐকান্তিক স্বর, সেখানে ভাষা নয়, অব্যক্ত বাঙ্ময়তাই অনিবার্য অবলম্বন হয়ে ওঠে। ক্ষুধা বা কষ্টের মতো কান্না বা বিষাদও একটি স্বপ্রকাশিত ভাষা। তাকে অর্থহীন বলার মতো অর্থহীনতা আর কিছু কি আছে ?

(১৯-০৬-২০১৩) 


No comments: