Saturday, June 1, 2013

| মীমাংসা দর্শন-১৬ : মীমাংসা-মতে ঈশ্বর |

.

| মীমাংসা দর্শন-১৬ : মীমাংসা-মতে ঈশ্বর |
-রণদীপম বসু

৪.৩ : মীমাংসা-মতে ঈশ্বর


মীমাংসার মূল আলোচ্য-বিষয় অবশ্যই বৈদিক যাগযজ্ঞ বা ক্রিয়াকর্ম- আধুনিক অর্থে যা দার্শনিক আলোচনা নয়। অর্থাৎ, মীমাংসকরা তত্ত্ব-লাভের উদ্দেশ্যে দর্শন-চর্চা করেননি। তবুও তাঁরা যে অনিবার্যভাবেই দার্শনিক সমস্যা উত্থাপন ও আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন তার কারণ এই যাগযজ্ঞে চরম বিশ্বাস স্থাপন করতে হলে বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবিক প্রচেষ্টাদি সংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিও অবলম্বন করা প্রয়োজন। অনুমান হয়, সুপ্রাচীন কালে যাজ্ঞিকদের মধ্যে যজ্ঞকর্মের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে বিভেদ ও বিতর্ক থাকলেও যে-মূল বিশ্বাসের ভিত্তিতে যজ্ঞের চরম গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত সে-সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ ছিলো না; সে-বিশ্বাস তাঁদের কাছে স্বতঃসিদ্ধ অতএব প্রমাণ-সাপেক্ষ না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কালক্রমে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় গড়ে উঠার প্রেক্ষিতে সেগুলির দিক থেকে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রচেষ্টাদি প্রসঙ্গে যে-সব মত প্রস্তাবিত হয়েছে তার সঙ্গে যাজ্ঞিকদের মূল বিশ্বাসের অনিবার্য সংঘাতও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। ফলে প্রয়োজন হয়েছে সেই মূল বিশ্বাসের যুক্তিতর্কমূলক সমর্থন ও সংরক্ষণ এবং তার সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত খন্ডন- অন্তত অন্যান্য সম্প্রদায়ের সেই দাবিগুলি খন্ডন করবার প্রয়োজন হয়েছে যার সঙ্গে যাজ্ঞিকদের মূল বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সংহতি সম্ভব নয়। এভাবেই দার্শনিকতত্ত্ব মীমাংসার মূখ্য বিষয়বস্তু না হলেও মীমাংসকরা ক্রমশই দার্শনিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন।  


বেদের চরম প্রামাণ্যই মীমাংসার ভিত্তি। মীমাংসা-মত ও তার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, স্রষ্টা হিসেবে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলে যাজ্ঞিকদের মূল বিশ্বাস ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। ফলে নিরীশ্বরবাদী মীমাংসকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার তো করেনই নি, বরং ঈশ্বরের অস্তিত্ব খন্ডনে বিস্ময়কর যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে সুপ্রাচীন অগ্রদূত হিসেবে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে ঈশ্বরকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন, আধুনিক মননের কাছে তার অসাধারণ দার্শনিক মূল্য কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। যদিও জৈমিনি তাঁর মীমাংসাসূত্রে ঈশ্বরের উল্লেখ করেননি তবুও ভাষ্যকার শবরস্বামী অনুভব করেছেন স্রষ্টার কথা স্বীকার করতে গেলে বেদ-এর প্রামাণ্য ক্ষুণ্ন হবার আশঙ্কা থাকে। তাই শবরভাষ্যেই (শাবরভাষ্য: মীমাংসাসূত্র-১/১/৫) প্রথম যুক্তিপূর্ণভাবে ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যানের সূত্রপাত। এবং পরবর্তী মীমাংসকদের রচনাতে আরো পল্লবিত হয়ে সুস্পষ্ট যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যানের পূর্ণ আয়োজন লক্ষ্য করা যায়।
.
শবরস্বামীর ঈশ্বর-খণ্ডন

শবরস্বামীর কাছে সমস্যা উঠেছে মূলত বেদ-নিত্যতায় শব্দপ্রমাণের জের ধরে। বেদ যে নিত্য তা প্রমাণ করবার উদ্দেশ্যে শবর বলছেন, শব্দও নিত্য, শব্দার্থও নিত্য এবং শব্দ ও শব্দার্থের মধ্যে সম্বন্ধও নিত্য। কিন্তু ঈশ্বর বা স্রষ্টার কথা স্বীকার করলে শব্দার্থ-সম্বন্ধের এই নিত্যতা হানি হবার কথা; কেননা তাহলে মানতে হবে ঈশ্বর বা স্রষ্টাই এই শব্দার্থ-সম্বন্ধ সৃষ্টি করেছিলেন, অর্থাৎ সে-সম্বন্ধ নিত্য নয়। এই আশঙ্কাতেই শবর স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন। 

এ-জাতীয় কোনো স্রষ্টার কল্পনা যে অবাস্তব সে-বিষয়ে শবরের যুক্তি হলো, তৎ-সম্বন্ধে প্রমাণাভাব- অর্থাৎ, কোনো প্রমাণের সাহায্যেই স্রষ্টার সত্তা সিদ্ধ হতে পারে না। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা তাঁর অস্তিত্ব সিদ্ধ নয়, কেননা এ-জাতীয় স্রষ্টারা প্রত্যক্ষ হয় না। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ নয় বলেই অন্য কোনো প্রমাণও তাঁর সত্তার প্রতিপাদক হতে পারে না, কারণ অপরাপর প্রমাণ প্রত্যক্ষমূলক। কেননা, যুক্তিন্যায় মতে- ‘সাধ্যের সাথে নিয়ত সম্বন্ধবিশিষ্ট কোনোও ধর্ম যদি প্রত্যক্ষ গ্রাহ্য না হয়, তাহলে সেই সাধ্য প্রমাণান্তরের বিষয় হতে পারে না।’ 

এখানে তর্ক তুলে হয়তো বলা হবে, বর্তমান কালে স্রষ্টা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য না হলেও অতীত কালে তাঁর প্রত্যক্ষ হয়েছিলো।
উত্তরে শবর বলছেন, তাহলে তাঁর কথা সকলের স্মরণ থাকতো; কিন্তু ( বৈদিক) শব্দ এবং শব্দার্থের সম্বন্ধ-স্রষ্টার কথা কেউই স্মরণ করতে পারে না।
তর্ক তুলে হয়তো আবার বলা হবে, সুদূর অতীতে এই স্রষ্টা প্রত্যক্ষত উপলব্ধ হলেও বহুকাল অতীত হওয়ায় তা এখন স্মরণেরও বিষয় নয়; যেমন স্থলবিশেষে কূপ, উপবন প্রভৃতি দৃষ্ট হলেও তার স্রষ্টা যে কে তা কারুর স্মৃতিতে নেই।
উত্তরে শবর বলছেন, অধিককালের ব্যবধান হলেই অস্মরণ অনিবার্য নয়; কূপ, উপবন প্রভৃতির দৃষ্টান্তে বুঝতে হবে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় হেতু স্থানটি জনশূন্য হয়েছে এবং এইভাবে পূর্বেও পারম্পর্য লোপ পাওয়ায় এগুলির-স্রষ্টা বিস্মৃত হয়েছে; কিন্তু বৈদিক শব্দার্থ নিয়ে অবিচ্ছিন্নভাবে গুরু-শিষ্যের একটি পারম্পর্য চলে আসছে, তাই যদি বৈদিক শব্দার্থ-সম্বন্ধের কোনো স্রষ্টা থাকতেন তাহলে তাঁর স্মৃতিও বর্তমান থাকতো; কিন্তু এ-জাতীয় কোনো স্মৃতি বর্তমানে নেই। 


তর্ক তুলে আবারও হয়তো বলা হবে, ঘট শরাবাদি দ্রব্য সকলে ব্যবহার করলেও এগুলির যে কুম্ভকার তার নাম কি সকলের স্মরণে থাকে ?
উত্তরে শবর বলছেন, এ-তুলনা সমীচীন নয়। কেননা ব্যবহার-নির্বাহের জন্য সেগুলির স্রষ্টা কুম্ভকারের নাম স্মরণের প্রয়োজন হয় না; কিন্তু বেদের আপ্তত্ব অবধারিত না হলে বৈদিক ব্যবহার অসম্ভব। কারণ, যাঁর আপ্তত্ব অবধারিত নয়- অর্থাৎ যাঁর সম্বন্ধে এ-কথা জানা নেই যে ইনি ভ্রম-প্রমাদ-প্রতারণাবুদ্ধিশূন্য- তাঁর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে কেউই কোনো কষ্টসাধ্য কর্মে প্রবৃত্ত হয় না; অথচ বেদবাক্য শুনেই বৈদিকেরা যজ্ঞকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন। অতএব, বেদবাক্যের যদি কোনো স্রষ্টা থাকতেন এবং তিনিই যদি শব্দার্থের স্রষ্টা হতেন তাহলে অবশ্যই তাঁর স্মরণও থাকতো; কেননা বেদবিহিত ব্যবহারের জন্য তা অপরিহার্য। 

পূর্বপক্ষ হয়তো বলবেন, অর্থাপত্তির দ্বারা এই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ হয়। বেদান্ত এবং মীমাংসা সম্প্রদায়ে অর্থাপত্তি নামের একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ স্বীকৃত হয়েছে যে, অন্য একটি বিষয় স্বীকার না করে যখন একটি জ্ঞাত বিষয়ের ব্যাখ্যা হয় না তখন এই জ্ঞাতবিষয়টির ব্যাখ্যাকল্পে  উক্ত বিষয়টির যে প্রমাণ তারই নাম অর্থাপত্তি। যেমন দেবদত্ত দিনে খায় না অথচ মোটা হচ্ছে; এই ঘটনার ব্যাখ্যাকল্পে প্রমাণ হয় যে দেবদত্ত রাতে খায়। অতএব পূর্বপক্ষ বলতে পারেন, ঘট-শরাবাদির স্রষ্টা অজ্ঞাত হলেও কর্তা ব্যতীত এগুলির উৎপত্তি সম্ভব নয় বলেই অর্থাপত্তির দ্বারা যেমন কর্তার প্রমাণ হয়, তেমনি শব্দ ও শব্দার্থের সম্বন্ধ সৃষ্টি না হলে শব্দ থেকে অর্থবোধ সম্ভব হতো না,- অতএব শব্দ থেকে অর্থবোধ হয় এই ঘটনাই অর্থাপত্তি হিসেবে শব্দ ও শব্দার্থের স্রষ্টা প্রমাণ করে।
উত্তরে শবর বলছেন, এ-কথা স্বীকার করতে হলে মানতে হয় শব্দার্থ-সম্বন্ধের স্রষ্টা ব্যতীত শব্দের অর্থবোধ উৎপন্ন হওয়া অসম্ভব। কিন্তু সে-কথা স্বীকার করবার কারণ নেই। কেননা, শব্দের অর্থবোধ অন্যভাবেই উৎপন্ন হয়ে থাকে। শব্দ ও শব্দার্থের সংকেতে ব্যুৎপন্ন ব্যক্তির কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই; বৃদ্ধগণের সংকেত-নির্দেশ এই শব্দার্থ-সম্পর্কের জ্ঞাপক, যদিও কারক নয়; এবং এই বৃদ্ধগণ যখন অব্যুৎপন্ন ছিলেন তখন তাঁদের পূর্ববর্তীরা ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং সেই পূর্ববর্তীদের উপদেশানুসারে বৃদ্ধগণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। এই ভাবেই সেই পূর্ববর্তীগণ- এবং তাঁদের পূর্ববর্তীগণও- ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। তাই শব্দার্থের সম্বন্ধ-জ্ঞানের আদি নির্দেশ অসম্ভব; অর্থাৎ তা অনাদি বা নিত্য। এবং এই ব্যাখ্যা সম্ভব বলেই শব্দার্থ-সম্বন্ধ প্রসঙ্গে কোনো এক স্রষ্টার অর্থাপত্তি অবান্তর। 

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, শবরভাষ্যে শব্দার্থ প্রসঙ্গে আলোচনা উত্থাপিত হলেও শবরের যুক্তির মূল তাৎপর্য হলো শব্দ ও শব্দার্থের সম্বন্ধকে প্রবাহ-নিত্যতা বা ‘অনিদংপ্রথমত্ব’ (অর্থাৎ ইনিই প্রথম বেদবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, এই হলো বেদের আবির্ভাব- এমন কথা কেউ বলতে পারে না, তাই বেদ নিত্য অপৌরুষেয়) জাতীয় দুর্বল যুক্তির মাধ্যমে স্রষ্টা অর্থে ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান। কেননা, ঈশ্বর স্বীকার করলে আরও স্বীকার করতে হবে যে শব্দ, শব্দার্থ এবং উভয়ের সম্বন্ধ তাঁরই সৃষ্টি। কিন্তু মীমাংসকরা তা স্বীকার করতে পারেন না। তাঁরা প্রমাণ করতে চান শব্দ, শব্দার্থ এবং উভয়ের সম্বন্ধ অনাদি বা নিত্য। তা না হলে বেদের আপ্তত্ব ক্ষুণ্ন হবার আশঙ্কা- বেদকে যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি বলেও মানা হয় তাহলে বেদের আপ্তত্ব ঈশ্বরের আপ্তত্বের উপরই নির্ভরশীল হবে, অর্থাৎ বেদের আপ্তত্ব স্বকীয় ও চরম হবে না। বলা বাহুল্য, এভাবে বেদের চরম বা চূড়ান্ত আপ্তত্ব প্রতিপাদনের প্রচেষ্টা মীমাংসা-দর্শনের চরম সংরক্ষণশীলতারই পরিচায়ক। তবে এটাও মনে রাখা আবশ্যক, এই তাগিদ থেকে উদ্ভূত হলেও পরবর্তীকালের মীমাংসকরা ক্রমশ যে-ভাবে ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যানের যুক্তি অবতারণা করেছেন সেগুলির স্বকীয় গুরুত্বের দিক থেকে এই মীমাংসা-দর্শনই অন্যদিকে অত্যন্ত মৌলিকভাবে রীতি-বিরুদ্ধ এবং রক্ষণশীলতা-বিরুদ্ধ অভাবনীয় দর্শনে পরিণত হয়। 

মীমাংসা-দর্শনের প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের প্রবক্তা প্রভাকর মিশ্র ও কুমারিল ভট্টের মধ্যে মীমাংসা-ব্যাখ্যায় যথেষ্ট মৌলিক মতান্তর সত্ত্বেও উভয় সম্প্রদায়ই ঈশ্বর-প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই একমত পোষণ করেছেন। শবর পরবর্তী এসব দার্শনিকদের রচনায় ঈশ্বর-খণ্ডন প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক যুক্তি বিস্তার ক্রমশ এমন অসাধারণ জোরালো হয়ে উঠেছে যে অন্যান্য দর্শন-তত্ত্বের ব্যাখ্যায় পরবর্তীকালের দার্শনিকদের অনেক সতর্কী করে তোলেছে।
.
প্রাভাকর-মতে ঈশ্বর-খণ্ডন 

এ-বিষয়ে প্রাভাকর-মীমাংসক শালিকনাথ মিশ্রের ‘প্রকরণপঞ্চিকা’ গ্রন্থটি মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানদের কাছে প্রাভাকরমতের একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ  হিসেবে বিচেচিত হয়েছে বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং ঈশ্বর-খন্ডনে প্রাভাকর-মতের সুগ্রাহী আলোচনা করেছেন (পৃষ্ঠা-২৩৯)। এই প্রকরণপঞ্চিকা গ্রন্থে শুধু যে শব্দার্থ-সম্বন্ধের স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বর অস্বীকৃত তা-ই নয়- জগৎ-স্রষ্টা অর্থে ঈশ্বর স্বীকার করা সম্ভব নয়, এই কথাটিই বিশেষভাবে প্রমাণ করবার আয়োজন হয়েছে। কেননা ইতোমধ্যে নৈয়ায়িকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিপাদনার্থে নানা যুক্তিতর্কের অবতারণ করেছেন। 

ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিপাদনার্থে নৈয়ায়িকদের উপস্থাপিত যুক্তির মধ্যে প্রধান যুক্তি হলো, জগৎ-স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের সত্তা অবশ্য-স্বীকার্য; কারণ ক্ষিতি, জল প্রভৃতি সমস্ত সংহত বা জটিল বস্তুই কার্যাত্মক, কেননা এগুলি অবয়বদ্বারা গঠিত; এবং কার্য বলেই এগুলির কারণ থাকতে বাধ্য এবং সেই কারণ কোনো বুদ্ধিমান কর্তা না হয়ে পারেন না। বলা হয়ে থাকে, অবয়ব দ্বারা গঠিত সমস্ত বস্তুই কার্য এবং কার্য বলেই কার্য-কারণ তত্ত্ব অনুযায়ী তার কারণও থাকবে। যেহেতু মাটি, জল প্রভৃতি পরমাণু নামের অবয়ব দ্বারা গঠিত সেহেতু এগুলিও কার্য। তাই পরমাণুপুঞ্জ থেকে সুসমঞ্জস্য ও নির্দিষ্ট আকারে ক্ষিতি, জল প্রভৃতি সংহত বা জটিল বস্তুগুলি কোনো বুদ্ধিমান কর্তার নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত উৎপন্ন হতে পারে না; অতএব এই বুদ্ধিমান কর্তা অর্থে জগতের নিমিত্তকারণ হিসেবে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর অনুমেয়- তাঁরই নিয়ন্ত্রণে সৃষ্টি ও প্রলয় ঘটে। 

এর উত্তরে প্রাভাকররা বলেন, জাগতিক বস্তুগুলি অবশ্যই অবয়ব দ্বারা গঠিত, অতএব এগুলির উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু তাই বলে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো সৃষ্টি বা প্রলয়ের কথা কল্পনামাত্র; অতএব জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের নিয়ন্ত্রণকর্তা ঈশ্বরের পরিকল্পনাও অবান্তর। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক বস্তুগুলির দৃষ্টান্তে সুস্পষ্টভাবেই অভিজ্ঞতা হয় যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই সেগুলির জন্ম হচ্ছে- যেমন মানুষ ও জীবজন্তুর দেহ শুধুমাত্র তাদের পিতামাতার দরুনই উৎপন্ন হয়। এবং এ-জাতীয় অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে অতীত ও ভবিষ্যতের বস্তুগুলিরও উৎপাদন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অতএব, জাগতিক বস্তুগুলির স্রষ্টা হিসেবে কোনো অতি-প্রাকৃত নিয়ন্ত্রাতার কথা অনুমিত হয় না। 

নৈয়ায়িকরা আরো দাবি করেছেন, ব্যক্তির ধর্মাধর্ম পরিচালনা করার জন্য সাধারণভাবে কোনো পরিচালক- অর্থাৎ ঈশ্বর- স্বীকারযোগ্য।
তার উত্তরে প্রাভাকররা বলেন, প্রথমত যার ধর্মাধর্ম সেই এ-জাতীয় পরিচালক হতে পারে, অতএব ঈশ্বর বলে স্বতন্ত্র পরিচালকের প্রসঙ্গ অবান্তর। দ্বিতীয়ত, একের ধর্মাধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান অপর কারুর পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়; অতএব তথাকথিত ঈশ্বরের পক্ষে কোনো মানবের ধর্মাধর্ম জানাই সম্ভব নয়।
প্রাভাকররা আরো বলেন, তথাকথিত ঈশ্বরের পক্ষে মানবাদির ধর্মাধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞানই যদি সম্ভব না হয় তাহলে তাঁর পক্ষে এই ধর্মাধর্মের পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন ওঠে না। তাছাড়া, উক্ত জ্ঞানের সম্ভাবনা থাকলেও ঈশ্বরের পক্ষে ধর্মাধর্ম পরিচালনা করা সম্ভব হতো না। কেননা, পরিচালনার জন্য সম্বন্ধ প্রয়োজন; কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে মানবাদির ধর্মাধর্মের কোনো সম্বন্ধ অসম্ভব। ন্যায়মতেই সম্বন্ধ মাত্র দুরকম হতে পারে- সংযোগ ও সমবায়। ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মাধর্মর সংযোগ সম্ভব নয়; কারণ ধর্মাধর্ম হলো গুণ এবং ন্যায়-মতেই শুধুমাত্র দ্রব্যের সঙ্গে দ্রব্যের সংযোগ সম্ভব। ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মাধর্মের সমবায়ও সম্ভব নয়; কারণ এই ধর্মাধর্ম মানবাদিরই গুণ, অতএব মানবাদির সঙ্গেই তার সমবায় হতে পারে- মানবাদির গুণের সঙ্গে ঈশ্বরের সমবায় অসম্ভব। 

এক্ষেত্রে নৈয়ায়িকরা সূত্রধর বা ছুতোরের উপমা দিতে পারেন। অবশ্যই দেহবিশিষ্ট বলে এই ছুতোরের সঙ্গে তার যন্ত্রপাতির এবং যন্ত্রপাতির সঙ্গে কাষ্ঠাদি বস্তুর সংযোগ সম্ভব; কিন্তু তথাকথিত ঈশ্বর দেহবিহীন বলেই পরিকল্পিত, অতএব তাঁর দৃষ্টান্তে এ জাতীয় প্রশ্ন ওঠে না।
প্রাভাকরা আরো বলেন, নৈয়ায়িকরা এ কথাও বলতে পারেন না যে পরমাণুসমূহ ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করে। কারণ এ-জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনার কোনো দৃষ্টান্তই অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, একমাত্র দেহস্থ আত্মাই দেহকে পরিচালনা করতে পারে; কিন্তু পরমাণুসমূহ বা মানবীয় ধর্মাধর্মও ঈশ্বরের দেহ নয়, অতএব ঈশ্বরের পক্ষে এগুলির পরিচালনাও সম্ভব নয়। আর যদিই বা তর্কের খাতিরে এগুলিকে ঈশ্বরের দেহ বলেই পরিকল্পনা করা হয় তাহলেও এগুলির নিয়ন্ত্রণের জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টার কথা স্বীকার করতে হবে এবং সে ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা যদি নিত্য হয় তাহলে পরমাণুসমূহের সৃষ্টিকার্যকেও, অর্থাৎ জগতের সৃষ্টিকেও, নিত্য বা নিয়ত ঘটনা বলে স্বীকার করতে হবে। 

ন্যায়-বৈশেষিকরা বলে থাকেন, মানবদেহ বুদ্ধিহীন বলেই তার নিয়ন্ত্রণের জন্য এক বুদ্ধিমান স্রষ্টা বা ঈশ্বর অনুমেয়।
উত্তরে প্রাভাকররা বলছেন, নিয়ন্ত্রণ-কার্য উদ্দেশ্যবিহীন হতে পারে না; কিন্তু এই তথাকথিত নিয়ন্ত্রণের পেছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কী হতে পারে ? তাছাড়া, নৈয়ায়িকরা যে যুক্তিবলে বুদ্ধিমান নিয়ন্ত্রণকর্তা প্রমাণ করতে চান সেই যুক্তি অনুসারেই উক্ত নিয়ন্ত্রণকর্তা দেহ-বিশিষ্ট বলেই প্রমাণিত হবেন। কেননা, কাষ্ঠাদি বস্তুর উপর সূত্রধর-এর নিয়ন্ত্রণ-কার্যর দৃষ্টান্ত অনুসারেই তাঁরা জগৎ-স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণ প্রমাণ করতে চান; কিন্তু সূত্রধর দেহবিশিষ্ট, তারই উপমান অনুসারে কল্পিত ঈশ্বরও দেহবিশিষ্ট বলে প্রমাণিত হবেন। কিন্তু দেহবিশিষ্ট কারুর পক্ষেই পরমাণু বা ধর্মাধর্মের মতো সূক্ষ্ম বিষয়কে বুদ্ধিসম্মত এবং কার্যকরিভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এবং যদিই বা তা সম্ভব হয় তাহলে দেহবিশিষ্ট বলেই তাঁর পরিচালনার জন্য আরো কোনো স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ-কর্তার কথা স্বীকৃত হতে বাধ্য, আবার এই স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ-কর্তার পরিচালনার জন্য অপর কোনো এক নিয়ন্ত্রণ-কর্তার কথা স্বীকৃত হতে বাধ্য- এবং এইভাবে অনবস্থা-দোষ ঘটবে। 

এইভাবে প্রাভাকররা স্রষ্টা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন। এবং তাঁরা সৃষ্টি বা প্রলয় মানেন নি বলেই বিশ্বজগৎ তাঁদের কাছে নিয়ত পরিবর্তনশীল ঘটনাস্রোত বলেই প্রতীত হয়েছে।
.
কুমারিলের নিরীশ্বরবাদ

ভাট্ট-সম্প্রদায়েও বেদের চরম আপ্তত্ব প্রতিপাদন করবার উদ্দেশ্যেই শব্দ, শব্দার্থ এবং উভয়ের সম্বন্ধ নিত্য বলে স্বীকৃত এবং এই মত প্রতিপাদনের উদ্দেশ্যেই ভাট্ট-মীমাংসকরাও সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এ জাতীয় সংরক্ষণশীল চাহিদায় উদ্ভাবিত হলেও স্বকীয় দার্শনিক গুরুত্বের দিক থেকে ভাট্ট-মীমাংসকদের- বিশেষত কুমারিলের- যুক্তিগুলি সাধারণভাবে ভারতীয় দর্শনের পটভূমিতে প্রায় বৈপ্লবিক বলে প্রতীত হতে পারে ( দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৪০)।
কুমারিল ভট্ট তাঁর ‘শ্লোকবার্তিক’ গ্রন্থে সম্বন্ধাক্ষেপপরিহার:৪১-১১৬-এ এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দেবীপ্রসাদের মতে, এগুলির তর্জমায় মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা সুচরিত মিশ্র এবং পার্থসারথি মিশ্রের টীকা অবলম্বনে যে-পাদটীকা দিয়েছেন, কুমারিল মতের প্রকৃত তাৎপর্য অবগতির জন্য সেগুলি বিশেষ মূল্যবান। 

কুমারিল বস্তুত নিরীশ্বরবাদের সূচনা করেছেন সর্বজ্ঞতা-খণ্ডনের দ্বারা। মহামহোপাধ্যায় হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বৈদিকধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১৭৯) বলেন, কুমারিল চার্বাকপন্থীদের কাছ থেকে একটা আপত্তি আশঙ্কা করেছেন- বৌদ্ধরা বুদ্ধকে সর্বজ্ঞ মনে করেন, আর মীমাংসকরা মনে করেন বেদ অপৌরুষেয়। দুই মতই সমান নির্যুক্তিক। তা হলে বুদ্ধবাণী ত্যাগ করে বেদবাণী গ্রহণ করবো কেন ? তাই কুমারিলকে একদিকে সর্বজ্ঞতা খন্ডন করতে হয়েছে। অন্যদিকে বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিপাদনের চেষ্টা করতে হয়েছে। 

যদিও বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিপাদনের চেষ্টা বুদ্ধিমান মীমাংসকদের যুক্তিহীন গোঁড়ামির একটা বড় নজির বলে মনে করা হয়, তবু সর্বজ্ঞতা খণ্ডনে কুমারিলের সাফল্য অসামান্য। কুমারিলের সর্বজ্ঞত্ব-খণ্ডন প্রণালি গভীরভাবে অনুধাবন করলে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শনে উপস্থাপিত সর্বজ্ঞত্ব-সমর্থক যুক্তিগুলি অত্যন্ত দুর্বল বলে প্রতিপন্ন হয়। তাই কুমারিলের যুক্তিগুলি বিশ্লেষণনির্ভর। 

সর্বজ্ঞতা-খণ্ডন : সর্বজ্ঞ মানে যিনি বিশ্বজগতের ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সবকিছু জানেন। কী করে জানেন ? আমরা মানুষ, তাই মানুষ যেভাবে জানে, সেভাবে জানার বাইরে অন্য কোনো অতিমানবিক উপায় যদি থাকে তা আমরা কী করে জানবো, আর না জানলে কী করে বলবো আমাদের মানববুদ্ধির অগোচরে এক সবজান্তা অতিমানব আছেন যিনি কোনো অতিমানবিক উপায়ে বিশ্বের প্রতিটি ধূলিকণা প্রতিটি অণুপরমাণু ও প্রতিটি বীজাণু পর্যন্ত আপন নখদর্পণে প্রত্যক্ষ করেন। জানার উপায়কে বলে প্রমাণ, যেমন প্রত্যক্ষ ও অনুমান। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপায় আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়, চোখ, কান, জিহ্বা প্রভৃতি। জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলিকে বলে প্রত্যক্ষপ্রমাণ যা দ্বারা প্রত্যক্ষ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। প্রত্যক্ষ কেবল বর্তমানগ্রাহী, যেমন চক্ষু শুধু বর্তমান বস্তুকেই গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু অতিদূর স্থিত, অন্তরালিত, অতীত বা ভবিষ্যৎ বস্তুকে গ্রহণ করতে পারে না। এখন যদি কেউ সর্বজ্ঞ হন, তিনি কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু প্রত্যক্ষ করবেন ? 

মানুষের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা প্রকৃতির নিয়মে সীমাবদ্ধ। তাই কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই সবকিছুই বিশ্বের সবকিছু জানা সম্ভব নয়। ‘সব’ ইন্দ্রিয়ের ‘অবিষয়’ অর্থাৎ অগোচর- এটাই স্বভাবনিয়ম বা প্রাকৃতিক নিয়ম। কেউ সর্বজ্ঞ হলে তাকে হতে হবে এই প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম। আমরা কিন্তু ব্যতিক্রম নই। তাহলে আমরা কী করে বুঝবো যে এমন কোনো মহাপুরুষ আছেন যিনি স্বভাবনিয়মের ব্যতিক্রম ? বুঝতে হলে আমাদেরও ব্যতিক্রম হতে হবে। তাই কুমারিল বিদ্রূপ করে বলেছেন ( শ্লোকবার্তিক-২/১২২)- যিনি কোনো সর্বজ্ঞ পুরুষ আছে বলে কল্পনা করেন তিনি বোধহয় চোখ দিয়ে বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ চোখের দ্বারা দেখে, কানের দ্বারা শোনে, জিহ্বার দ্বারা রসগ্রহণ- এই প্রাকৃতিক নিয়মের উর্ধ্বে তিনি বিচরণ করেন। একথাই কুমারিল আরেকটি সাধারণ সূত্রাকারে উপস্থিত করেছেন-
‘য এব স্যাদসর্বজ্ঞঃ স সর্বজ্ঞং ন বুধ্যতে।’- ( শ্লোকবার্তিক- ২/১৩৫)
অর্থাৎ : যে নিজে অসর্বজ্ঞ সে অন্য কাউকে সর্বজ্ঞ বলে সাব্যস্ত করতে পারে না।
কুমারিল বলতে চাইছেন- অমুক মহাপুরুষ চোখ দিয়ে তামাম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখতে পান, কথাটা আমি কী করে জানবো যদি না আমিও মহাপুরুষের মতো দেখতে পাই। তাহলে আমাকেও প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হবে। এখানে কুমারিলের আলোচনার প্রসঙ্গ অবশ্য বুদ্ধের সর্বজ্ঞত্ব। তাই বলছেন- ধরে নিলাম বুদ্ধ ছিলেন সর্বজ্ঞ মহাপুরুষ। শিষ্যরা কী করে জানলেন যে গুরু সব কিছু জানেন। শিষ্য নিজে সর্বজ্ঞ নন। সকল অণু, পরমাণু, বীজাণু ও কীটপতঙ্গের সংখ্যা সহ বিশ্বের সবকিছু যদি শিষ্যের জ্ঞানগোচর না হয় তবে শিষ্য কী করে সাব্যস্ত করলেন যে ঐ সকল বস্তুই গুরুর জ্ঞানগোচর। যে সকল বস্তু মিলে ‘সর্ব’-ব্রহ্মাণ্ড হয়, সে ‘সব’ যদি শিষ্য না জানেন তা হলে শিষ্য কী করে নির্ণয় করবেন যে তার গুরু সবটাই জানেন অথবা ‘সব’-এর চেয়ে কিছু কম জানেন। ধরুন শিষ্যটিও সর্বজ্ঞ। এখন শিষ্যটিকে সর্বজ্ঞ বলে জানতে হলে আর একজন সর্বজ্ঞের দরকার হবে। এভাবে একে একে আমাদের সকলকেই সর্বজ্ঞ মহাপুরুষ হতে হবে। বুদ্ধবিদ্বেষী কুমারিল আসলে ‘সর্বজ্ঞ’-শব্দটির আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করে বুদ্ধশিষ্যদের উপহাস করেছেন। 

নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধমতে সর্বজ্ঞেয় শব্দটির প্রকৃত অর্থ ভিন্ন। সুবিখ্যাত বৌদ্ধদার্শনিকরা কিন্তু ‘সর্বজ্ঞ’ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেননি। এ সম্পর্কে সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধদার্শনিক ধর্মকীর্তির ‘প্রমাণবার্তিক’ গ্রন্থের  উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য-
‘সর্বজ্ঞ হতে হলে বিশ্বে কত হাজার কোটি কীট আছে তা জানার প্রয়োজন নেই। মানুষের কল্যাণের জন্য কী করা উচিত, এ জ্ঞান যার আছে তিনিই সর্বজ্ঞ। বিচার করুন, ভগবান তথাগতের এ জ্ঞান আছে কিনা, এবং এ জ্ঞানকে তিনি মানুষের কল্যাণসাধনে নিয়োজিত করেছেন কিনা। মানুষের দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ প্রতিরোধের উপায় এবং দুঃখের প্রতিরোধ- এই চারটি ‘আর্যসত্য’ হলো ধর্মের মূল তত্ত্ব। এই তত্ত্ব আয়ত্ব করে যিনি মানুষের সুখ ও হিতসাধনে ব্যাপৃত হন সেই কল্যানব্রতী মহাপুরুষকেই আমরা বলি ‘সর্বজ্ঞ’। তথাগতের দৃষ্টি কতোটা দূরভেদী তা জানার প্রয়োজন নেই, মানুষের মঙ্গলের মূল তত্ত্বটি তার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে কিনা সেটাই আসল কথা। দূরদর্শী বলেই যদি কোনো ব্যক্তি প্রমাণ হন তাহলে শকুনের মতো প্রমাণপুরুষ আর কে আছে ? শূন্যে ভেসে ভেসে কতো উঁচু থেকে ডাঙায় বা জলে পড়ে থাকা মড়াটাকে দেখতে পায়। তবে আসুন আমরা সবাই মিলে শকুনের উপাসনা করি।’ (সূত্র: হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়/ বৈদিকধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১৮১) 

তবে ঈশ্বরবিশ্বাসীরা কিন্তু ঈশ্বরকে আক্ষরিক অর্থেই সর্বজ্ঞ মনে করেন, অর্থাৎ তাদের মতে ঈশ্বর বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু প্রত্যক্ষ করেন। যোগভাষ্যকার বেদব্যাস ঈশ্বরানুমান প্রণালী প্রমাণ করেন বিচিত্রভাবে-
কেউ স্বল্পজ্ঞানী, কেউ তার তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী, কেউ আরও অধিকতর জ্ঞানী; সুতরাং এমন একজন আছেন যিনি অধিকতম জ্ঞানী। ইনি হলেন নিরতিশয় জ্ঞানী, যার জ্ঞানের চেয়ে বেশি জ্ঞান আর সম্ভব নয়; সুতরং তিনি সর্বজ্ঞ। সবজান্তার ওপর আর কোনো জ্ঞানী থাকা সম্ভব নয়। এহেন সর্বজ্ঞ পুরুষই হলেন ঈশ্বর। দশ বিশজন সর্বজ্ঞ থাকতে বাধা কী ? বাধা শাস্ত্র। শাস্ত্র এক ঈশ্বরের কথাই বলেছে।- (যোগভাষ্য-১/২৫) 

মানুষের জ্ঞানের তারতম্য থেকে ‘অমানুষ’ সর্বজ্ঞ পুরুষে পৌঁছানোর অনুমান-প্রণালীটি কুমারিলের দৃষ্টি এড়ায়নি। (জ্ঞাতা মানুষের) প্রমাতৃভেদে প্রত্যক্ষদর্শনের তারতম্য দেখা যায়। কেউ কেউ অধিক দূরস্থিত বা অধিক সূক্ষ্ম বস্তুও দেখতে পায়, কেউ আবার তা পারে না। তেমনি লৌকিক বা শাস্ত্রীয় বিষয়ে কারুর জ্ঞান অপরের তুলনায় অনেক বেশি। এই তারতম্য থেকে অনুমান করা যেতে পারে এমন কোনো বরিষ্ঠ পুরুষ আছেন যার জ্ঞান সর্বাধিক। সর্বাধিক জ্ঞান হলো সর্ববিষয়ক জ্ঞান। এহেন সর্ববিষয়ক-জ্ঞান সম্পন্ন পুরুষই হলেন সর্বজ্ঞ। 

ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা যে প্রাকৃতিক নিয়মে সীমাবদ্ধ, স্বাভাবিক অবস্থায় তার ব্যত্যয় ঘটে না, সর্বজ্ঞত্ব-খণ্ডনে কুমারিল এই স্বভাবনিয়ম প্রয়োগ করেই বলেন-
‘যথাপ্যতিশয়ো দৃষ্টঃ স স্বার্থানতিলঙ্ঘনাত্ ।
দূরসূক্ষ্মাদিদৃষ্টেঃ স্যান্ন রূপে শ্রোত্রবৃত্তিতা।।’- ( শ্লোকবার্তিক-২/১১৪, পার্থসারথির টীকা)
অর্থাৎ : দূরসূক্ষ্মাদি বস্তুদর্শনে কোনো ব্যক্তির যে জ্ঞানাধিক্য পরিলক্ষিত হয় তা কিন্তু জ্ঞান ও বিষয়ের সুনির্দিষ্ট স্বাভাবিক সম্বন্ধকে লঙ্ঘন করে না, যেমন কোনো সমধিক জ্ঞানী ব্যক্তিও কর্ণের দ্বারা বস্তুর রূপ গ্রহণ করে না।
এরপর কুমারিলের যুক্তি হলো, যদি বলেন সর্বজ্ঞ পুরুষ প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা নন, তিনি সব নিয়ম লঙ্ঘন করে সবকিছু দেখতে পান তা হলেও একটা দুরুত্তর প্রশ্ন থেকে যায়। সর্বজ্ঞ পুরুষ নাকি অন্তহীন ভবিষ্যৎকেও বর্তমানের মতো স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেন। এ ধরনের উদ্ভট দাবি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দ্বারাও সমর্থিত হতে পারে না। যা এখন পর্যন্ত বিশ্বে কোথাও জন্মগ্রহণই করেনি, যা এখনও কোথাও নেই সেই না-থাকা বস্তুগুলিকেও এখনই কেউ আক্ষরিক অর্থে প্রত্যক্ষ করছে, কেবল কল্পনা করছে না- এরকমের বক্তব্য প্রমত্তের প্রলাপ ছাড়া আর কী হতে পারে ? তাই কুমারিল বলছেন- ‘ভবিষ্যৎ বস্তুর জ্ঞানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের বিন্দুমাত্র সামর্থ্যও পরিদৃষ্ট হয় না’- (শ্লোকবার্তিক-২/২১৫)। 

যদি কোন সর্বজ্ঞ-বিশ্বাসী বলেন- সমগ্র ভবিষ্যৎ সর্বজ্ঞ পুরুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞানে ধরা না পড়ুক, তিনি অনুমানের দ্বারা অনন্ত ভবিষ্যতের অনন্ত বস্তু জানতে পারেন, তবু কিন্তু সর্বজ্ঞতা সম্ভব নয়। অনুমান জ্ঞান হয় সামান্যাকারে। আমরা বিশ্বাস করি সকল মানুষ মরণশীল। এই সাধারণ সূত্র দেখে আমরাও অনুমান করতে পারি বর্তমানে জীবিত কোনো ব্যক্তিবিশেষও অমর নয়, একদিন তাকে মরতেই হবে। ‘সকল মানুষ মরণশীল’ এই সাধারণ সূত্রটি যখন আমরা জানি তখন অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষের অনন্ত কোটি চিতার আগুন সারিবদ্ধভাবে একে একে আমাদের কল্পনার আকাশে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে না। তিনকালের কোন লোকটি কীভাবে কোথায় কখন মরেছে বা মরবে তা কিন্তু আমাদের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব। আমরা প্রত্যেকেই একদিন মরবো, কারণ আমরা মানুষ এবং মানুষমাত্রেই মরণশীল- এ ধারণাটা হয় সামান্যাকারে বা সাধারণভাবে। প্রত্যেকটি মানুষকে আলাদা করে একে একে গুনে গুনে হয় না, কে কোথায় কখন কীভাবে মরবে তাও জানা যায় না। সর্বজ্ঞ হতে হলে কিন্তু এসব কিছুই বিশেষভাবে, বিভক্তরূপে আলাদা আলাদা করে জানতে হবে। না হলে আমাদেরই বা সর্বজ্ঞ হতে বাধা কোথায়। একথাই কুমারিল সংক্ষেপে বলেছেন-
‘ভবিষ্যতি ন দৃষ্টং চ প্রত্যক্ষস্য মনাগপি।
সামর্থ্যং, নানুমানাদের্লিঙ্গাদিরহিতে ক্বচিত্ ।।’- (শ্লোকবার্তিক-২/১১৫)
অর্থাৎ : ভবিষ্যৎ বস্তুর জ্ঞানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের বিন্দুমাত্র সামর্থ্যও পরিদৃষ্ট হয় না। বিশ্বের সকল বস্তু সম্বন্ধে অনুমান করার কোনো ‘হেতু’ বা সূচক চিহ্ন নেই।
কুমারিলের এ সকল আপত্তির পিছনে রয়েছে আসলে ন্যায়শাস্ত্রেও অনুমানতত্ত্বের অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা। আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জানা থেকে অজানার দিকে কতোটা উল্লম্ফন করা যুক্তিগত এই পরিমিতিবোধটুকু না থাকলে যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব বলে প্রতিপন্ন করার জন্য বল্গাহীন কল্পনার আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। যে কোনো আজব কল্পনাকে সজীব করে তোলা যেতে পারে। 

মানুষের জ্ঞানের ক্রমিক উৎকর্ষ অনস্বীকার্য। কিন্তু এই উৎকর্ষ থেকে কোনো সর্বজ্ঞ পুরুষে পৌঁছানোর যৌক্তিক প্রয়োজন নেই।… বুদ্ধের সর্বজ্ঞতার বিরুদ্ধে কুমারিল যে কঠোর যুক্তিসমূহ উপস্থিত করেছেন ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতার বিরুদ্ধেও সে যুক্তিসমূহ সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই সর্বজ্ঞতা খণ্ডনের দ্বারা পরোক্ষভাবে বা প্রকারান্তরে ঈশ্বরও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, কারণ সর্বজ্ঞ পুরুষ না হলে ঈশ্বর ঈশ্বর হতে পারে না।- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়/ বৈদিকধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১৮৩)
তাই কুমারিল যখন সরাসরি ঈশ্বর খণ্ডন করেছেন তখন আর তিনি আলাদা করে ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা খণ্ডন করেন নি। সেখানে তিনি নতুন নতুন যুক্তির অবতারণা করেছেন, যে যুক্তির গুরুত্ব অসাধারণ। 

কুমারিলের ঈশ্বর-খণ্ডন : কুমারিল কর্তৃক ঈশ্বর খণ্ডনের প্রসঙ্গ হলো শব্দার্থ সম্বন্ধের নিত্যতা প্রতিপাদন। বর্ণের কূটস্থ বা বিকারবিহীন নিত্যতা থেকে শব্দ ও বেদবাক্যের নিত্যতায় উত্তরণের বিষয়টি শব্দ-প্রমাণ প্রতিষ্ঠায় আলোচিত হয়েছে। শব্দ-প্রমাণের মাধ্যমে বেদকে অপৌরুষেয় প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কুমারিলের যুক্তি অনুসরণ করলে বেদের অপৌরুষেয়ত্ব শুধুমাত্র প্রবাহ-নিত্যতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য, যে নিত্যতাকে পার্থসারথি মিশ্র বলেছেন ‘অনিদংপ্রাথম্য’, অর্থাৎ ইনিই প্রথম বেদবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, এই হলো বেদের প্রথম আবির্ভাব- এমন কথা কেউ বলতে পারে না, তাই বেদ নিত্য অপৌরুষেয়। মীমাংসা-মতে বেদের অভ্রান্তত্ব নির্ভর করছে অপৌরুষেয়ত্বের ওপর। এই অপৌরুষেয়ত্ব প্রমাণ করবার জন্য মীমাংসকরা প্রবাহ-নিত্যতার নিতান্ত ভঙ্গুর যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করলেও বেদের অপৌরুষেয়ত্ব সিদ্ধির অন্যদিকে কুমারিল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুক্তিতে কঠোর ও অবিচল। এক্ষেত্রে বেদ সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের রচনা বলে মেনে নিলে কী হতো ?
এ বিষয়ে কুমারিল বলছেন, পূর্বপক্ষবাদী হয়তো দাবি করতে পারেন যে জগৎ-স্রষ্টার কথা স্বীকার করলেও বেদের প্রামাণ্য ক্ষুণ্ন হয় না; কিন্তু তবুও এ জাতীয় স্রষ্টা বা ঈশ্বরের কথা স্বীকার করার প্রশ্ন ওঠে না, কেননা তাঁর সত্তা সম্ভব নয় এবং সৃষ্টির কল্পনাও অসম্ভব। অতএব আমরা মীমাংসা দর্শনে ঈশ্বর এবং সৃষ্টি স্বীকার করি না। 

কুমারিল বিশ্বস্রষ্টা প্রজাপতির পরিকল্পনা নিয়ে নানা রকম বিদ্রূপ করেছেন। তিনি বলেন, যদি বলো কোনো এককালে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিলো তাহলে প্রশ্ন করবো, সৃষ্টির আগে বিশ্বের অবস্থা কী ছিলো ?
ঈশ্বরবাদী তখন বলবেন, তৈত্তিরীয়-সংহিতায় বলা আছে ‘সৃষ্টির পূর্বে প্রজাপতি একাই ছিলেন’-  (তৈত্তিরীয়-সংহিতা-২/১/১)। আবার ঋগ্বেদের প্রজাপতি-সূক্তেও বলা হয়েছে-
‘হিরণ্যগর্ভঃসমবর্ততাগ্রে ভূবস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।’- (ঋগ্বেদ-১০/১২১/১)
অর্থাৎ : সর্ব প্রথমে কেবল (প্রজাপতি) হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন। তিনি জাত মাত্রই সর্বভূতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হলেন। তিনি এ পৃথিবী ও আকাশকে স্বস্থানে স্থাপিত করলেন।
কুমারিলের প্রশ্ন, সৃষ্টির পূর্বে বিশ্বই যদি তখন না থাকে তাহলে বিশ্বস্রষ্টা প্রজাপতিই বা কোথায় ছিলেন ? তাঁর রূপই বা কী রকম ছিলো ? থাকার জন্য কোনো অধিকরণ বা আশ্রয় প্রয়োজন। ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কুমারিল এই যে গুরুতর আপত্তি তুললেন সে আপত্তি ঋগ্বেদেই রয়েছে (১০/৮১)। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের একাশি সূক্তে (বিশ্বকর্মা-সূক্ত) বলা হয়েছে-
‘কিং স্বিদাসীদধিষ্ঠানমারম্ভণং কতমৎস্বিৎ কথাসীৎ।
ষতো ভূমিং জনয়ন্বিশ্বকর্মা বি দ্যামৌর্ণোন্মহিনা বিশ্বচক্ষাঃ।।’- (ঋগ্বেদ-১০/৮১/২)
অর্থাৎ : সৃষ্টিকালে তাঁর অধিষ্ঠান অর্থাৎ আশ্রয়স্থল কী ছিলো ? কোন স্থান হতে কিরূপে তিনি সৃষ্টি কার্য আরম্ভ করলেন ? সে বিশ্বকর্মা, বিশ্বদর্শনকারী দেব কোন স্থান থেকে পৃথিবী নির্মাণ-পূর্বক প্রকাণ্ড আকাশকে উপরে বিস্তারিত করে দিলেন ?
তা ছাড়া সৃষ্টির জন্য উপাদানগুলি তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন ? তিনি ছাড়া আর কিছুই তো ছিলো না-
‘কিং স্বিদ্বনং ক উ স বৃক্ষ আস যতো দ্যাবাপৃথিবী নিষ্টতক্ষুঃ।
মনীষিণো মনসা পৃচ্ছতেদু তদ্যদধ্যতিষ্ঠদ্ভুবনানি ধারয়ন্ ।।’- (ঋগ্বেদ-১০/৮১/৪)
অর্থাৎ : সে কোন বন ? কোন বৃক্ষের কাষ্ঠ ? যা হতে দ্যুলোক ও ভূলোক গঠন করা হয়েছে ? হে বিদ্বানগণ ! তোমরা একবার আপন আপন মনে জিজ্ঞাসা করে দেখ, দেখ তিনি কিসের উপর দাঁড়িয়ে ব্রহ্মাণ্ড ধারণ করেন ?
তবে ঈশ্বরবাদীর পক্ষ হয়ে বৈদিক ঋষিই তার উত্তর দেন-
‘বিশ্বতশ্চক্ষুরুত বিশ্বতোমুখো বিশ্বতোবাহুরুত বিশ্বতস্পাৎ।
সং বাহুভ্যাং ধমতি সং পতত্রৈর্দ্যাবাভূমী জনয়ন্দেব একঃ।।’- (ঋগ্বেদ-১০/৮১/৩)
অর্থাৎ : সে এক প্রভু, তাঁর সকল দিকে চক্ষু, সকল দিকে মুখ, সকল দিকে হস্ত, সকল দিকে পদ, ইনি দু হস্তে এবং বিবিধ পক্ষ সঞ্চালনপূর্বক নির্বাণ করেন, তাতে বৃহৎ দ্যুলোক ও ভূলোক রচনা হয়।
তাহলেও প্রশ্ন, এই যে সর্বত্র তার চক্ষু, সর্বত্র তার মুখ, সর্বত্র তার বাহু, সর্বত্র তার পদ, কথাগুলি যদি আলংকারিক প্রয়োগ বলেও ধরা হয় তাহলেও ‘সর্বব্যাপী’ কথাটি নিরর্থক অথবা বিকল্পমাত্রে পর্যবসিত হতে বাধ্য। কারণ ঈশ্বর ব্যতিরিক্ত ‘সর্ব’ বলে কিছুই ছিলো না। সুতরাং ‘সর্বব্যাপী’ কথাটি বন্ধ্যাপুত্রের মতো সমগোত্রীয় অর্থহীন। 

কুমারিল বলেন, যদি বলো ঈশ্বর তার ইচ্ছাবলেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, দেহবিশিষ্ট চেতনপদার্থেরই ইচ্ছা থাকতে পারে। ঈশ্বর তো অশরীরী। যদি বলো ঈশ্বরেরও দেহ আছে, তবে শরীরের উপাদানগুলি কোথা থেকে এলো ? তবে কি ঈশ্বরের দেহ তৈরি করার উপাদানগুলি আগে থেকেই ছিলো ? অর্থাৎ ঈশ্বরের পূর্বেই জগৎ ছিলো ? তাহলে বলতে হবে জগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেনি। 

কুমারিল আবার প্রশ্ন করেন, সৃষ্টির পূর্বে তো কোনো মানুষেরই অবস্থান সম্ভব নয়; তাই তোমাদের মতে প্রজাপতি তখন যে উপস্থিত ছিলেন এ কথা কার পক্ষেই বা জানা সম্ভব ? এবং কেই বা পরবর্তীকালে সৃষ্ট মানুষদের কাছে প্রজাপতির কথা পৌঁছে দিতে পারেন ? যদি বলো, প্রজাপতির পক্ষে কোনো মানুষেরই প্রত্যক্ষাদি জ্ঞানের বিষয় হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে প্রশ্ন করবো তাঁর যে একান্তই কোনো রকম অস্তিত্ব আছে সে কথাই বা জানা গেলো কীভাবে ? তোমাদের মতে কোনো এককালে বিশ্বের সৃষ্টি বা শুরু হয়েছিলো; কিন্তু তা কীভাবে সম্ভবপর হতে পারে ? প্রজাপতির ইচ্ছায় সৃষ্টি শুরু হলো ? কিন্তু সে-কথা তোমরা কী করে বলবে ? কেননা, তোমাদের মতেই স্রষ্টা দেহ-বিশিষ্ট নন; এবং দেহ ছাড়া ইচ্ছা সম্ভবই নয়। তাই দেহহীন স্রষ্টার পক্ষে সৃষ্টি করার ইচ্ছাও অসম্ভব। যদি বলো, স্রষ্টার দেহ আছে, তাহলে সেই দেহটিকেও তো তাঁরই সৃষ্টি বলতে পারো না। অতএব তাঁর দেহ সৃষ্টির জন্য আর একটি স্রষ্টার কথা, আবার তাঁরও দেহ সৃষ্টির জন্য আর একটি স্রষ্টার কথা- এইভাবে অবিশ্রাম ভেবে যেতে হবে। স্রষ্টার দেহকে নিত্য বা অনাদিও বলতে পারো না, কেননা সৃষ্টির পূর্বে ক্ষিতি অপ্ প্রভৃতি দেহের উপাদানই যখন নেই তখন কী দিয়ে তাঁর দেহ নির্মিত হতে পারে ?
তাছাড়া, প্রাণীদের পক্ষে নানা রকম জ্বালা-যন্ত্রণায় পূর্ণ এই পৃথিবীটি সৃষ্টি করবার ইচ্ছেই বা তাঁর হলো কেন ? এ-কথাও বলতে পারো না যে প্রাণীদের কর্মফলের দরুনই পৃথিবীতে এই সব জ্বালা-যন্ত্রণা। কেননা, সৃষ্টির পূর্বে এ জাতীয় কর্মফল সম্ভবই নয়। অতএব প্রাণীদের কর্মফল অনুসারে স্রষ্টার পক্ষে পৃথিবী সৃষ্টি করাও সম্ভব নয়। 

কুমারিল বলেন, উপকরণাদি ব্যতিরেকেও সৃষ্টি সম্ভব নয় এবং সৃষ্টির পূর্বে এ-জাতীয় উপকরণ বলে কিছুর অস্তিত্ব অসম্ভব। উর্ণনাভ বা মাকড়সার জালও উপাদানহীন সৃষ্টি নয়, কেননা ভক্ষিত পতঙ্গ থেকে মাকড়সার লালা উৎপাদন হয় এবং জালের উপাদান হিসেবে এই লালা ব্যবহৃত। আর এ কথাও বলা যায় না যে, করুণা বা দায় থেকেই স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন; কেননা, সৃষ্টির আগে কোনো প্রাণীই ছিলো না, অতএব করুণা বা অনুকম্পা দেখাবার মতো কোনো জীবই ছিলো না, কাকে অনুকম্পা দেখাবেন ? যখন করুণার কোনো পাত্রই নেই তখন করুণাও সম্ভব নয়। তাছাড়া করুণা বা দয়া-পরবশ হয়ে সৃষ্টি করলে তিনি শুধুমাত্র সুখী ব্যক্তিই সৃষ্টি করতেন। যদি বলো, কিছুটা দুঃখ না থাকলে জগতের সৃষ্টি বা স্থিতি সম্ভব নয়, তাহলে উত্তরে বলবো, তোমাদের মতে সবই তো স্রষ্টার শুধুমাত্র ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল, তাই তার পক্ষে আবার অসম্ভব কী হতে পারে ? আর সৃষ্টির জন্য তাঁকেও যদি নিয়মাদির উপর নির্ভরশীলই হতে হয় তাহলে তাঁর আবার স্বাধীনতা কোথায় ? তোমাদের মতে তাঁর মধ্যে সৃষ্টির ইচ্ছা জেগেছিলো; কিন্তু বলতে পারো কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থতার জন্য তাঁর এই ইচ্ছা জেগেছিলো- এমন কোন্ উদ্দেশ্যই বা সম্ভব হতে পারে যা কিনা সৃষ্টি-ব্যতিরেকে চরিতার্থ হওয়া অসম্ভব ? নির্বোধও উদ্দেশ্যবিহীন কাজ করে না। অতএব তিনি যদি বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তাঁর বুদ্ধিকে নিষ্ফল বলতে হবে। যদি বলো, এই সৃষ্টি তাঁর লীলা- প্রমোদ বা বিলাসমাত্র, তাহলে তাঁকে আর সদানন্দ বা চিরসন্তুষ্ট বলতে পারো না, অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে তিনি নিশ্চয়ই প্রমোদের অভাব অনুভব করেছিলেন, অতএব তখন তাঁর সন্তুষ্টির অভাব ছিলো। তাছাড়া সৃষ্টি-ব্যাপারে যে পরিমাণ দুর্ভোগ ও পরিশ্রম প্রয়োজন তার তুলনায় প্রমোদ আর কতটুকুই বা ? আর সৃষ্টি যদি প্রমোদের জন্যই হয় তাহলে তোমরা যে প্রলয়ের কথা বলো তারই বা ব্যাখ্যা কী ? 

আর সর্বোপরি কথা হলো, কারুর পক্ষেই এ জাতীয় স্রষ্টাকে জানা সম্ভব নয়। যদিই মানা যায় যে তাঁর রূপ সংক্রান্ত অবগতি সম্ভব, তবুও তিনিই যে স্রষ্টা এ বিষয়ে জ্ঞান অসম্ভব। সৃষ্টির শৈশবে যে সব প্রাণীদের আবির্ভাব তাদের পক্ষে কতটুকুই বা বোধ সম্ভবপর ? অতএব, কীভাবে তাদের জন্ম হলো এবং সৃষ্টির পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা কী ছিলো- এ সব কথা তাদের পক্ষে বুঝতে পারা অসম্ভব, অর্থাৎ বুঝতে পারা অসম্ভব যে প্রজাপতিই সৃষ্টি করেছিলেন। যদি বলো, প্রজাপতিই সেই প্রাণীদের বলে দিয়েছিলেন যে, তিনিই স্রষ্টা তাহলেও তাদের পক্ষে তাঁর কথায় আস্থা স্থাপন সম্ভব নয়; কেননা, এমনও তো হতে পারে যে, তিনি নিজের শক্তিসংক্রান্ত শুধু দম্ভই প্রকাশ করেছেন। 

সাধারণ লোকের ধারণায়, প্রজাপতি যে স্রষ্টা এ-কথা বেদ-এ আছে। কিন্তু কুমারিল বলছেন, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আসলে কয়েকটি বিধির প্রশংসামূলক বাক্যের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা থেকে এ ধারণার উদ্ভব- কোনো একটি বাক্যের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বাক্যের সঙ্গে সঙ্গতি ব্যতিরেকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এ জাতীয় ভ্রান্তির উদ্ভব হয়। কুমারিল আরো দাবি করছেন, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী থেকেও প্রমাণ হয় না যে, প্রজাপতিই স্রষ্টা। আসলে নিছক কাহিনী হিসেবে কোনো কাহিনীই সার্থক নয়; অতএব তথাকথিত কাহিনীগুলিকে নিছক কাহিনী হিসেবে না বুঝে প্রকৃতপক্ষে বিধি বা যজ্ঞকর্মের প্রশংসা বা অর্থবাদ হিসেবেই বুঝবার চেষ্টা করা প্রয়োজন।
উপরিউক্ত যুক্তিগুলির পর কুমারিল বিশেষ করে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি-প্রলয় সংক্রান্ত ন্যায়-বৈশেষিক মতের সমালোচনা করেছেন। 

কুমারিল-কর্তৃক ঈশ্বর-অস্তিত্ব-সংক্রান্ত ন্যায়-বৈশেষিক মত খণ্ডন : ন্যায়-বৈশেষিকরা ঈশ্বরকে কেবলমাত্র নিমিত্তকারণ বলে স্বীকার করেন। তাদের মতে, জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের পরিপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বা স্বনির্ভরতা নেই। জীবের কর্ম ও অদৃষ্টের ওপর ঈশ্বরকে নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া নিমিত্ত-কারণ কখনো উপাদান-কারণ হতে পারে না। ঘটের উপাদান-কারণ মৃত্তিকা। কুম্ভকার মাটি দিয়ে ঘট তৈরি করে, কুম্ভকার কখনো নিজেই মৃত্তিকা হতে পারে না। কুম্ভকার ঘটের নির্মাতা, মাটি উপাদান। জগতের উপাদান পরমাণু, ঈশ্বর পরমাণুর সাহায্যে জগৎ নির্মাণ করেন জীবের কর্ম ও অদৃষ্ট অনুসারে। 

কুমারিল এখানে বলতে চান যে, প্রথমত, বৈশেষিকরা যে মনে করেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় অকস্মাৎ সৃষ্টি হয় তা সম্ভব নয়; কেননা ঘট প্রভৃতি নির্মাণের দৃষ্টান্তে দেখা যায় একটি বস্তুর নির্মাণ ক্রমপদ্ধতি মাত্র। দ্বিতীয়ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রলয় স্বীকার করা যায় না, কেননা তার কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া প্রলয়ের কথা স্বীকার করলে মানতে হবে যে ঈশ্বরের মনে প্রলয়ের ইচ্ছা জাগে; কিন্তু এ জাতীয় ইচ্ছায় লাভ কী ? অর্থাৎ বুদ্ধিমান স্রষ্টার পক্ষেই নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করবার ইচ্ছা জাগা সম্ভব নয়। 

বৈশেষিকরা বলেন, প্রলয়কালে মানবাত্মার ধর্মাধর্ম নিষ্ক্রিয় বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কুমারিল বলছেন, তা কোনোমতেই সম্ভব নয়। প্রথমত কৃতকর্মের ফলাফল অবশ্যম্ভাবী; তাই এমন কোনো অবস্থা সম্ভবই নয় যখন কৃতকর্মের পরিণাম স্থগিত থাকবে। বৈশেষিকরা বলবেন, ঈশ্বরের ইচ্ছা নামক কর্মটির দরুন বাকি সকলের কর্মফল এইভাবে স্থগিত থাকে; কিন্তু তাও সম্ভব নয়, কারণ একজনের একটি কর্মের ফলে বাকি সকলের কর্মফল স্থগিত থাকতে পারে না।
যদি বলা হয়, প্রলয়কালে সকলের ধর্ম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে কুমারিল বলছেন, আর কখনো সৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকবে না, কেননা সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কর্মগুলিকে আবার কীভাবে সঞ্জীবিত করা যাবে ? 

বৈশেষিকরা যদি বলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছায় তা সম্ভব হতে পারে, তাহলে, কুমারিল বলছেন, শুধু এই ঈশ্বরের ইচ্ছার কথা বলাই তো যথেষ্ট- বৈশেষিকরা আবার কেন সৃষ্টির জন্য ধর্মাধর্মের কথা তোলেন ? তাছাড়া, ঈশ্বরের ইচ্ছাও সম্পূর্ণ অকারণ হতে পারে না; এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার কারণ হিসেবে যদি কিছু স্বীকার করা হয় তাহলে সেই কারণটির সাহায্যেই তো সৃষ্টির ব্যাখ্যা সম্ভব, তদুপরি ঈশ্বর মানার প্রয়োজন কী ? 

ন্যায়-বৈশেষিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করবার উদ্দেশ্যে বলেন, গৃহাদির দৃষ্টান্তে দেখা যায় বিভিন্ন অবয়ব দ্বারা গঠিত বস্তুর উৎপত্তি বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণব্যতীত সম্ভব নয়; অতএব অবয়ব-বিশিষ্ট মানবদেহের নিয়ন্তা বা নিয়ন্ত্রণ-কর্তা হিসেবেও বুদ্ধিমান ঈশ্বর অনুমেয়।
কিন্তু কুমারিল বলছেন, এই বুদ্ধিমান নিয়ন্তা অর্থে ঈশ্বরের কথা বাহুল্য মাত্র। কেননা সকলেই জানে যে মানবাদি বুদ্ধিমান জীবের নিয়ন্ত্রণ ফলেই পৃথিবীতে যাবতীয় উৎপাদন সম্ভব হয়; অতএব তার জন্য ঈশ্বর মানবার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া বৈশেষিকরা যে বলেন, ঈশ্বরেচ্ছায় আকস্মিকভাবে বা হঠাৎ জগৎ সৃষ্ট হয় তাও মানবার কারণ নেই; কেননা গৃহাদি নির্মাণের দৃষ্টান্তেই দেখা যায় কোনো কিছুই নির্মাণকর্তার ইচ্ছা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয় না। 

বৈশেষিকরা বলেন, সকলের দেহই বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন। কুমারিল বলছেন, কিন্তু এই যুক্তি অনুসারে ঈশ্বর-দেহের নিয়ন্ত্রণকর্তা কে হবেন ? তথাকথিত ঈশ্বরের দেহও দেহ, এবং আমাদের দেহের মতোই অবয়ব-গঠিত; অতএব তারও কোনো নিয়ন্তা স্বীকার্য। যদি বলো, ঈশ্বরের ইচ্ছাই এই নিয়ন্ত্রণের কারণ, তাহলে তোমাদের নিজেদেরই মূল যুক্তির বিরুদ্ধে যেতে হবে; কেননা তোমাদের মূল যুক্তি হলো, অবয়ব-গঠিত বস্তুর নিয়ন্তা হিসেবে স্বতন্ত্র কোনো বুদ্ধিমান অনুমেয়। তাছাড়া, ঈশ্বরেচ্ছার দ্বারাই বা কীভাবে তাঁর দেহ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে ? কেননা, ঈশ্বর যদি তাঁর দেহ সৃষ্টি করতে চান তাহলে তাঁকে দেহীপূর্ব বা দেহবিহীন অবস্থাতেই এ প্রয়াস করতে হবে,- উক্ত প্রয়াসের পূর্বে তাঁর দেহের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। এবং দেহবিহীন অবস্থায় ঈশ্বরের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। 

ঈশ্বরানুমানের জন্য বৈশেষিকরা কুম্ভকারের দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেন- অবয়ব-বিশিষ্ট ঘট যেমন কুম্ভকারের সৃষ্টি, অবয়ব-বিশিষ্ট সমগ্র জাগতিক বস্তুও তেমনি ঈশ্বরের সৃষ্টি।
কিন্তু কুমারিল বলছেন, ঘটাদি যদি প্রকৃতপক্ষে কুম্ভকারের সৃষ্টি হয় তাহলে তা ঈশ্বরের সৃষ্টি হতে পারে না, অর্থাৎ সমস্ত জাগতিক বস্তুর স্রষ্টা ঈশ্বর হতে পারেন না; অপরপক্ষে যদি বলো, ঘটাদি প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরেরই সৃষ্টি- অর্থাৎ কুম্ভকারের সৃষ্টি নয়, তাহলে যে দৃষ্টান্তের উপর নির্ভর করে তোমরা ঈশ্বর অনুমান করো সেইটিই প্রত্যাখ্যান করতে হবে- অর্থাৎ ঈশ্বরানুমানের দৃষ্টান্তাভাব ঘটবে। তাছাড়া, ঘটাদির সৃষ্টি সাধারণত যেভাবে কুম্ভকারাদির কীর্তি বলে স্বীকৃত হয়, বৈশেষিকরাও যদি তা স্বীকার করেন তাহলে তাঁদের সিদ্ধান্তই খণ্ডিত হবে; কেননা, তাহলে মানতে হবে জীবদেহ প্রভৃতিও মরলোকের জীবদেরই সৃষ্টি- ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। 

উত্তরে বৈশেষিকরা বলবেন, ঈশ্বরের সৃষ্টিকাজ কুম্ভকারাদির মতো নয়; বস্তুত ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত হয়ে পরমাণুসমূহই সৃষ্টিকাজ সম্পাদন করে।
এক্ষেত্রে কুমারিল বলছেন, এ কথাও যুক্তিযুক্ত হবে না; কারণ পরমাণুসমূহ জড় বা অচেতন, অতএব তাদের পক্ষে ঈশ্বরেচ্ছা অনুসারে কোনো কাজ করাই সম্ভব নয়; কেননা অচেতন পরমাণুর পক্ষে ঈশ্বরেচ্ছার অবগতিই সম্ভব নয়। 

ঈশ্বর এবং সৃষ্টি-প্রলয় সংক্রান্ত ন্যায়-বৈশেষিক মত খণ্ডন করেই কুমারিল ক্ষান্ত নন; এই প্রসঙ্গে তিনি বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্বও খণ্ডন করতে অগ্রসর হয়েছেন। 

কুমারিল-কর্তৃক বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব খণ্ডন : বৈদান্তিক-মতে নিত্য শুদ্ধ বা পরম পবিত্র পুরুষ ব্রহ্ম বা পরমাত্মা থেকে জগতের সৃষ্টি। এ জগৎ ব্রহ্মময়। ব্রহ্মই জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ। তবে বৈদান্তিকরা বলেন, পারমার্থিকভাবে সৃষ্টি-জগৎ মিথ্যা, জগতের কোন সত্তা নেই। তবুও উপাদানরূপ ব্যবহারিক সত্তা হিসেবে এই জগৎ যে আমরা দেখি তা অবিদ্যা বা মায়ার অধ্যাস, যার কোন পারমার্থিক সত্তা নেই। স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুর মতো জগৎ মিথ্যা অবভাস মাত্র। এই মতে, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে জীবাত্মার পরমাত্মার সাথে একাত্ম হওয়াই মোক্ষ। 

এ প্রেক্ষিতে কুমারিল বলেন, নিত্য শুদ্ধ বা পরম পবিত্র পুরুষ ব্রহ্ম বা পরমাত্মা থেকেই যদি জগতের সৃষ্টি হয় তাহলে জগৎটিও তো পরম পবিত্র বা বিশুদ্ধ হবার কথা; কিন্তু জগতে পাপাদি দোষ বা অশুদ্ধতা বর্তমান। যদি বলা হয়, জগতের পাপাদি মানুষের অতীত অধর্মের ফল অতএব এগুলির জন্য নিত্যশুদ্ধ পরমাত্মা দায়ী নন, তাহলে মানুষের এই অধর্মও তো বিশুদ্ধ পরমাত্মারই নিয়ন্ত্রণাধীন; অতএব পরম পবিত্র পরমাত্মার পক্ষে মানবীয় ধর্মাধর্মকে সুনিয়ন্ত্রিত করে একটি পরম নিষ্কলুষ জগৎই সৃষ্টি করা উচিত ছিলো। 

বৈদান্তিকরা যদি বলেন, জগৎ সৃষ্টির মূলে অবিদ্যা বা মায়া; কিন্তু একথা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। কেননা তাঁদের মতে সৃষ্টির সময় ঈশ্বর বা ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুরই সত্তা ছিলো না; আর যদি তাই-ই হয় তাহলে কিসের প্রভাবে এই অবিদ্যার পক্ষে কার্যকরি হওয়া সম্ভব ? একথা বলা যায় না যে ব্রহ্মই অবিদ্যাকে সৃষ্টিকার্যে প্রণোদিত করেন; কেননা মায়া হলো স্বপ্নের মতো মিথ্যা এবং ব্রহ্ম বিশুদ্ধ, অতএব মিথ্যা মায়ার পক্ষে বিশুদ্ধ ব্রহ্ম দ্বারা প্রভাবিত হওয়া সম্ভব নয়। 

বৈদান্তিকরা যদি বলেন, মায়ার উপর এই প্রভাব প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মর নয়, তাহলে তাঁদের পক্ষে ব্রহ্ম ছাড়াও মায়াকে প্রভাবিত করবার জন্য আরো কিছুর সত্তা স্বীকার করতে হবে এবং এইভাবে অদ্বৈতবাদ পরিত্যাগ করে দ্বৈতবাদী হতে হবে।
অপরপক্ষে, বৈদান্তিকরা যদি বলেন, মায়ার কার্যকারিতা স্বাভাবিক ও স্বতঃ-পরিচালিত অতএব তার উপর আর কিছুর প্রভাব নিষ্প্রয়োজন, তাহলে কিন্তু বৈদান্তিকদের পক্ষে মুক্তি বা মোক্ষর পরিকল্পনাই পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা, মায়া যদি স্বাভাবিক ও স্বাধীন অর্থাৎ অপর কিছুর প্রভাব-নিরপেক্ষ হয় তাহলে তার বিনাশও অসম্ভব বিবেচিত হতে বাধ্য। অদ্বৈতবাদীরা বলেন, অবিদ্যা-নিবৃত্তির একমাত্র উপায় আত্মজ্ঞান; কিন্তু আত্মজ্ঞানই বা কীভাবে স্বাভাবিক ও স্বাধীন মায়াকে ধ্বংস করতে পারে ? 

এই প্রসঙ্গে কুমারিল প্রচলিত সাংখ্য মতেরও সমালোচনা করেছেন। 

কুমারিলের সাংখ্য-মত খণ্ডন : সাংখ্যমতে জগতের মূল হচ্ছে পুরুষ ও প্রকৃতি। পুরুষ নিত্য ও উদাসীন, প্রকৃতি নিত্য পরিবর্তনশীল। এই মতে বস্তু বা প্রকৃতির মূল উপাদান তিনটি গুণ- সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। জগৎ সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ- এই তিন গুণের সাম্যাবস্থায় থাকে। প্রকৃতি ও পুরুষের যখন সংযোগ ঘটে তখন প্রকৃতির সাম্যাবস্থার অবসান ঘটে। প্রকৃতির সাম্যাবস্থার অবসান না হলে জগতের অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। প্রকৃতি ও পুরুষের গুণ ভিন্নরূপ। প্রকৃতি অচেতন ও বোধ শক্তিহীন। অপরদিকে পুরুষ সচেতন বুদ্ধিমান কিন্তু নিষ্ক্রিয়। প্রকৃতি অচেতন ও বোধশক্তিহীন বলে সচেতন ও বুদ্ধিমান সত্তার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তার কাজ করা সম্ভব নয়। পুরুষও নিষ্ক্রিয় বলে তার পক্ষে একা জগৎ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ের যখন সংযোগ হয় তখনই প্রকৃতির সত্ত্ব, রজ ও তম গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে জগতের অভিব্যক্তি ঘটে।
কুমারিল এই মতের আভ্যন্তরীন অসম্ভাবনা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, প্রকৃতির সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতি কীভাবে স্বীকৃত হতে পারে ? পুরুষ উদাসীন বলেই এ বিচ্যুতি তাঁর প্রভাবজনিত হতে পারে না। সাংখ্যমতাবলম্বীরা এ কথাও বলতে পারেন না যে, প্রকৃতির এই পরিবর্তনের মূলে জীবাত্মাদের কর্মের প্রভাব আছে; কেননা প্রথম সৃষ্টির পূর্বে এ জাতীয় তোনো কর্ম সম্ভব নয়, অতএব তার প্রভাবে প্রকৃতিতে পরিবর্তনও সম্ভব নয়। 

উল্লেখ্য সাংখ্যমতের প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারে মোক্ষতত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্য ও বেদান্তর মধ্যে বিশেষ কোনো প্রভেদ নেই; সাংখ্যমতেও সম্যক্জ্ঞান উপলব্ধিহেতুই মুক্তি বা মোক্ষ। তাই সাংখ্য-সমালোচনায় কুমারিল সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব সমালোচনা করলেও তিনি বিশেষ করে মোক্ষতত্ত্বই প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন এবং এ বিষয়ে কুমারিলের মূল যুক্তি হলো সম্যক্-জ্ঞানের উপলব্ধি থেকে মুক্তি সম্ভব নয়, কেননা বন্ধনের কারণ যদি কর্ম হয় তাহলে জ্ঞান কীভাবে এই কর্ম ধ্বংস করতে পারে ? স্বভাবতই এ-জাতীয় যুক্তি প্রচলিত সাংখ্যের সমালোচনা ছাড়াও বেদান্তমতেরও সমালোচনা। 

পরিশেষে, মীমাংসকদের ঈশ্বর-খণ্ডন প্রসঙ্গে এ কথা বলা যায় যে, প্রভাকর ও কুমারিল উভয়েই সামগ্রিকভাবে জগতের সৃষ্টি বা প্রলয় স্বীকার করেননি; বিভিন্ন জাগতিক বস্তুর উৎপত্তি ও বিনাশ উভয়ের মতে জাগতিক কারণ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। অতএব উভয়েই সৃষ্টি-প্রলয়ের কর্তা হিসেবে তথাকথিত সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বও সুদীর্ঘভাবে খণ্ডন করেছেন। বাহ্যবস্তুবাদী হিসেবে মীমাংসকরা বেদান্ত-প্রতিপাদ্য তত্ত্বকে অস্বীকার করলেও ভারতীয় দর্শনে অন্যতম বাহ্যবস্তুবাদী দর্শন ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ে ঈশ্বর-প্রমাণের প্রচেষ্টা প্রসিদ্ধ হওয়ায় নিরীশ্বরবাদী মীমাংসকদের ঈশ্বর-খণ্ডন বিষয়ক যুক্তিগুলি প্রধানত ন্যায়-বৈশেষিকদের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য হয়েছে বেশি।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : অপূর্ব-বাদ] [*] [পরের পর্ব : বৈদিক-দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসামত]

No comments: