Saturday, June 1, 2013

| মীমাংসা দর্শন-১৭ : বৈদিক দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসা-মত |

.

| মীমাংসা দর্শন-১৭ : বৈদিক দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসা-মত |
-রণদীপম বসু

৪.৪ : বৈদিক দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসা-মত


বেদে প্রচুর সংখ্যক দেব-দেবীর প্রতি স্তুতিপূর্ণ মন্ত্র-পূজাদির উপস্থিতি থেকে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যেতে পারে যে, মীমাংসকরা ঐকান্তিক অর্থে বেদপন্থী বলেই সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান কোনো ঈশ্বর অস্বীকার করলেও তাঁরা অন্তত বৈদিক দেবতাদের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী হবেন, এবং এই অর্থে তাদের মতবাদ বহু-দেববাদী হওয়াই সম্ভব। কিন্তু, আপাত-বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই ঠিক যে, মীমাংসকরা বৈদিক দেবতাদের কর্তৃত্ব- এমনকি তাঁদের সত্তাও- সম্পূর্ণভাবেই অস্বীকার করেছেন। 


প্রশ্নটি তোলা হয়েছে জৈমিনির মীমাংসাসূত্রের দেবতা-অধিকরণে (৯/১/৬-১০)। মীমাংসকদের মূল আলোচ্য বিষয় বলতে বৈদিক যজ্ঞ। বৈদিক যজ্ঞের সঙ্গে বৈদিক দেবতাদের নাম সংযুক্ত। অতএব প্রশ্ন ওঠে, যজ্ঞগুলিকে কি সংশ্লিষ্ট দেবতাদের পূজা-উপাসনা বলে গ্রহণ করা হবে ? যজমান কোন ফল কামনা করে যজ্ঞ করেন ? যজমানের ফললাভে প্রধান ভূমিকা কার ? যজ্ঞের না দেবতার ? যজ্ঞকর্ম কি আপন শক্তিতে স্বাভাবিকভাবেই ফল উৎপাদন করে, না কি যজ্ঞে নিবেদিত আহুতি বা হবি বা নৈবেদ্য-ভোজন করে পরিতৃপ্ত দেবতা প্রসন্নচিত্তে যজমানকে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন ? দেবতা বলতে ঠিক কী বোঝায় ? যজ্ঞফল উৎপাদনের ব্যাপারে দেবতাদের কি আদৌ কোনো কর্তৃত্ব আছে ? যজ্ঞ প্রধান, না দেবতা প্রধান ? ইত্যাদি ইত্যাদি। 

জৈমিনির মীমাংসাসূত্রেই এ জাতীয় সমস্যা উত্থাপিত হয়েছে এবং সূত্রকার এগুলির সমাধান দিয়েছেন। ভাষ্যকার শবরস্বামীর শাবরভাষ্যে তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে। ভারতীয় দার্শনিক রচনার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী লেখকরা প্রায়ই প্রথমে বিরুদ্ধমতের একটি ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, যাকে বলে পূর্বপক্ষ। তারপর এই পূর্বপক্ষ খন্ডন করে তাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করেন। জৈমিনি (মীমাংসাসূত্র-৯/১/৬-৮) এবং বিশেষ করে শবরের রচনায় আলোচ্যপ্রসঙ্গে নানান যুক্তির অবতারণা করা পূর্বপক্ষের আলোচনা যেমন অত্যন্ত সুদীর্ঘ ও জটিল, তেমনি স্বভাবতই সিদ্ধান্তও (মীমাংসাসূত্র-৯/১/৯-১০) বিশেষ জটিল। আমাদের জন্য সুবিধাজনক হলো মূল যুক্তিগুলি খুঁজে নেওয়া। 

দেবতায় বিশ্বাসী পূর্বপক্ষের বক্তব্য :
পূর্বপক্ষ বা প্রতিবাদী বিরোধী পক্ষের বক্তব্য হলো- দেবতাই ফল দান করে, দেবতার অনুগ্রহ লাভই যাগযজ্ঞের সবচেয়ে বড়ো কথা। কারণ, যজ্ঞ মানেই তো দেবপূজা এবং যাঁর পূজা তিনিই প্রধান। যজ্ঞে প্রযুক্ত মন্ত্রে দেবতাকে সম্বোধন করে আহ্বান করা হয়- তুমি আমাদের নিবেদিত হবি গ্রহণ করো, পানভোজনে আপ্যায়িত হয়ে আমাদের প্রার্থিত ফল দান করো। আবার যজ্ঞ মানে হলো দেবতার ভোজন। ভোজ্যদ্রব্য দেবতাকে দান করার কথা তো বেদেই রয়েছে। দেবতা খাবেন বলেই তো ভোজ্যদ্রব্য দেবতাকে নিবেদন করতে হয়। পূজা আর পূজনীয়ের মধ্যে পূজনীয়ই প্রধান, পূজা গুণীভূত বা অপ্রধান। যেমন অতিথির পরিচর্যায় অতিথিই প্রধান, অতিথি এলেন বলেই তো পরিচর্যার প্রশ্ন ওঠে। পরিচর্যা যেমন অতিথির জন্য, যাগযজ্ঞও তেমনি দেবতার জন্য। অতিথিকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই সমস্ত আতিথ্যকর্ম; তেমনি, দেবতাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই সমস্ত যজ্ঞকর্ম। আতিথ্যকর্মে অতিথি প্রধান বলেই আতিথ্যকর্মের প্রযোজক, দেবতাও তেমনি যজ্ঞকর্মে প্রধান বলেই যজ্ঞকর্মের প্রযোজক। তাই যজ্ঞকর্মে দেবতাই প্রধান, যাগটা গৌণ। 

আপত্তি উঠতে পারে, ভোজন করার মতো কাজ করতে হলে তো দেবতার শরীর থাকা প্রয়োজন। উত্তর হলো, হাঁ, দেবতার দেহ বর্তমান, তাই দেবতা ‘বিগ্রহবর্তী’, এবং তিনি বাস্তবিকই ভোজনাদি কর্ম সম্পাদন করেন। এ কথার প্রমাণ হলো- ঐতিহ্য (স্মৃতি), লোকব্যবহার (উপচার) এবং আনুষঙ্গিক সাক্ষ্য (অন্যার্থদর্শন)।
স্মৃতিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, দেবতাদের দেহ আছে এবং আমাদের মতে স্মৃতি ( বেদ) অবশ্যই প্রামাণ্য। তাছাড়া, লোক-ব্যবহার অনুসারেও দেবতারা দেহবিশিষ্ট- তাই যম-দেবতাকে আঁকবার সময় তাঁর হাতে দণ্ড অঙ্কন করা হয়, বরুণের চিত্রে তাঁর হাতে পাশ অঙ্কন করা হয়, ইন্দ্রের হাতে বজ্র আঁকা হয়। অতএব আমাদের মতে এই জাতীয় লোক-ব্যবহার স্মৃতির সাক্ষ্যকে আরও শক্তিশালী করে। এবং অন্যার্থদর্শনও এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। যেমন বেদেই রয়েছে-
‘জগৃভমা কে দক্ষিণম্ ইন্দ্র হস্তং বসূযবো বসূপতে বসূনাম্’- অর্থাৎ, হে ধনের অধিপতি ইন্দ্র, আমরা ধন কামনা করে তোমার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করলাম।’- (ঋগ্বেদ-১০/৪৭/১)।
‘ইমে চিৎ ইন্দ্র রোদসী অপারে যৎ সংগৃভণা মঘবন্ কাশিরিত্তে।’- অর্থাৎ, হে ইন্দ্র, হে মঘবন, এই বিশাল স্বর্গ ও পৃথিবী তুমি মুষ্টির মধ্যে ধারণ করো।’- (ঋগ্বেদ-৩/৩০/৫)।-
ইত্যাদি ঋগ্বেদের বাক্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় ইন্দ্র দেহ-বিশিষ্ট, কেননা একমাত্র মানুষের মতো দেহ থাকলেই দক্ষিণ হস্ত বা বাম হস্ত বা মুষ্টি সম্ভব হতে পারে। অন্যান্য বাক্যেও দেবতাদের ‘গ্রীবা’, ‘উদর’, ‘বাহু’ প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন-
‘তুবিগ্রীবো বপোদরঃ সুবাহুরন্ধসো মদে। ইন্দ্রো বৃত্রাণি জিঘ্নতে।’- অর্থাৎ, ইন্দ্রের বিপুল গ্রীবা বিরাট উদর, সুন্দর বাহু; ইন্দ্র শত্রুদের নিধন করছে’- (ঋগ্বেদ-৮/১৭/৮)।
অতএব স্বীকার করতে হবে যে দেবতাদেরও মানুষের মতো দেহ আছে এবং তাঁরা বাস্তবিকই ভক্ষণ করতে পারেন।
দেবতা যদি নিবেদিত হবি নাই ভোজন করবে তবে তার কাছে বিবিধ ভোজ্যদ্রব্য উপস্থিত করা হবে কেন ? স্মৃতিতে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, দেবতা হবি ভক্ষণ করেন। সাধারণ লোকের বিশ্বাসও তাই; এই কারণেই তারা দেবতাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের আহুতি দেন। তাছাড়া বেদে যখন সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে তখন তো আর এর কোনো ঔপচারিক বা গৌণ আলংকারিক অর্থ গ্রহণ করা যায় না। যেমন-
‘অদ্ধীদিন্দ্র প্রস্থিতেমা হবীংষি চনো দধিত্ব পচতোত সোমম্, প্রয়স্বন্তঃ প্রতি হর্ষামসি ত্বা সত্যাঃ সন্তু যজমানস্য কামাঃ।’- অর্থাৎ, হে ইন্দ্র, তোমার আহারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত এই হবিদ্রব্য ও পানীয় সোম উভয়ই ভোজন করো। অন্ন দিয়ে তোমাকে আহারার্থে নিমন্ত্রণ করছি। যজমানের মনের বাসনাগুলি সফল হোক’- (ঋগ্বেদ-১০/১১৬/৮)।
এছাড়াও ‘অন্নরাশি অগ্নি আপন জঠরে ধারণ করেন’- (ঋগ্বেদ-১/৯৫/১০) বা ‘(ইন্দ্র) এক চুমুকে তিরিশ কলস সোম পান করেন’- ঋগ্বেদের এ জাতীয় বাক্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, দেবতারা ভোজন এবং পান করে থাকেন। 

আপত্তি তুলে হয়তো বলা হবে,- ‘ন দেবতা ভুঙক্তে। যদি চ ভুঞ্জীত, দেবতায়ে প্রত্তং হবিঃ ক্ষীয়েত।’- অর্থাৎ, ‘দেবতা ভোজন করেন না। যদি বাস্তবিকই ভোজন করে থাকেন, তাহলে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত খাদ্যদ্রব্য (হবি) ক্ষয়প্রাপ্ত হতো বা পরিমাণে কমে যেতো।’
উত্তরে বলা হবে, দেবতা তো মানুষের মতো অন্ন ভোজন করেন না।- ‘অন্নরসভোজিনী দেবতা মধুকরীবদ্ অবগম্যতে। কথম্ ? দেবতায়ৈ প্রত্তং হবিঃ নীরসং ভবতি। তস্মাদ্ অন্নরসং ভুঙক্তে দেবতা ইতি গম্যতে।’- অর্থাৎ, ‘অন্নরসভোজী দেবতা মধুকরী বা মৌমাছির মতো অন্নের রসটুকু শুধু চুষে নিয়ে ছিবড়ের মতো নীরস অন্নরাশি ফেলে রেখে যান। তাই তো দেবভোগের পর পড়ে থাকা অন্ন নীরস বা বিস্বাদ হয়ে যায়।’ অতএব দেবতারা ভোজনসমর্থ বলেই যজ্ঞে দেবতাদের উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্যেরই আহুতি দেয়া হয়। 

আপত্তি উঠতে পারে, দেবতারা যদি বাস্তবিকই পার্থিব সম্পদের অধিপতি হন এবং যদি পূজা করে দেবতাদের বাস্তবিকই প্রসন্ন করা সম্ভব হয়- শুধুমাত্র তাহলেই তাঁদেরকে পূজা করার সার্থকতা থাকতে পারে।
উত্তরে বলা হচ্ছে, প্রথমত, দেবতা প্রকৃতপক্ষেই পার্থিব সম্পদের অধিপতি। এবং তার প্রমাণ স্মৃতি, লোকব্যবহার এবং আনুষঙ্গিক সাক্ষ্য। স্মৃতিতে স্পষ্টই বলা হয়েছে, দেবতা সমস্ত পার্থিব বস্তুর ঈশান বা অধীশ্বর। যেমন-
‘ইন্দ্র আকাশ, পৃথিবী, জল ও মেঘের অধিপতি। তিনি বৃদ্ধের অধিপতি, প্রাজ্ঞের অধিপতি। লব্ধ ধনসম্পদ রক্ষার জন্য ইন্দ্রকেই ডাকতে হবে, অলব্ধ ধনসম্পদ লাভের জন্যও তাকেই ডাকতে হবে’- (ঋগ্বেদ-১০/১৬/১০)।
তাছাড়া, লোক-ব্যবহারের মধ্যেও এ কথা স্বীকৃত; কেননা প্রায়ই বলা হয় ‘দেবগ্রাম’ ‘দেবক্ষেত্র’ ইত্যাদি; অর্থাৎ গ্রাম, ক্ষেত্র প্রভৃতির অধিপতি হিসেবে দেবতার কথাই স্বীকার করা হয়।
দ্বিতীয়ত, পূজা করে প্রকৃতপক্ষেই দেবতাকে প্রসন্ন করা সম্ভব। তার প্রমাণও স্মৃতি, লোক-ব্যবহার এবং আনুষঙ্গিক সাক্ষ্য। যেমন স্পষ্ট করে স্মৃতিতেই বলা আছে-
‘স ইজ্জনেন স বিশা স জন্মনা স পুত্রৈর্ব্বাজং ভরতে ধনা নৃভিঃ। দেবানং যঃ পিতরমাবিবাসতি শ্রদ্ধামনা হাবষা ব্রহ্মণস্পতিম্’- অর্থাৎ, ‘যে যজমান দেবতাদের পিতৃস্বরূপ ব্রহ্মণস্পতিকে (বৃহস্পতি) সশ্রদ্ধচিত্তে হবিপ্রদানের দ্বারা পরিপূর্ণভাবে পরিচর্যা করে সেই যজমান সেবাপরায়ণ ভৃত্য, করদাতা প্রজা, ব্রাহ্মণাদি জাতি ও পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ভোজ্যদ্রব্য উপভোগ করে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ধনসম্পদ উপভোগ করে’- (তৈত্তিরীয় সংহিতা-২/৩/১৪)।
তাছাড়া, লোকে বলে, পশুপতি অমুকের প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন, তাই পুত্রলাভ করেছে। অর্থাৎ উপাসকের পক্ষে কর্মফল লাভের হেতু বা কারণ দেবতাই।
অতএব, পূর্বমীমাংসার বিরোধীপক্ষের বক্তব্যেও সার-কথা হলো, বৈদিক প্রমাণের দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে, যজ্ঞে দেবতাই প্রধান- দেবতার উদ্দেশ্যেই যজ্ঞ, যজ্ঞে দেবতা প্রীত হন এবং প্রীত হয়ে তিনিই যজ্ঞফল দান করেন। তাই যজ্ঞকর্মে দেবতারই মুখ্য ভূমিকা। 

দেবতা প্রসঙ্গে পূর্ব-মীমাংসকের সিদ্ধান্ত :
দেবতা-বিশ্বাসী পূর্বপক্ষের উত্তরে শবরস্বামী বলেন, ‘যজ্ঞ মানে দেবপূজা এবং যাঁর পূজা তিনিই প্রধান’- পূর্বপক্ষের এ জাতীয় যুক্তি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। যজ্ঞকর্মের দরুনই যজ্ঞফল; অতএব যজ্ঞকর্মই প্রধান বা প্রয়োজক। এবং যেহেতু দেহহীন ও ভক্ষণক্ষমতাহীন কাউকে খাদ্যাদি প্রদানের প্রশ্ন ওঠে না সেই হেতু পূর্বপক্ষের মতে দেবতারাও মানুষের মতোই দেহবিশিষ্ট এবং ভক্ষণাদি কর্ম সম্পাদক- এ মত স্বীকার করা যায় না।
পূর্বপক্ষবাদী যে অতিথির দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তা পরিহার করতে হবে। আতিথ্যকর্মে অতিথির তৃপ্তির বিধানই প্রধান- পান, ভোজন, দান প্রভৃতি দ্বারা যাতে অতিথি প্রীত হন সেইভাবেই পরিচর্যা করবার বিধি আছে। কিন্তু ‘স্বর্গকামো যজেত’ অর্থাৎ ‘স্বর্গকামী যজ্ঞ করবে’ ইত্যাদি বাক্যে যজ্ঞেরই কর্তব্যতা বোধিত হয়, দেবতার প্রীতি সম্পাদন বোধিত হয় না। 

পূর্বপক্ষবাদী দাবি করেন, স্মৃতি বা ঐহিত্য অনুসারে দেবতা মানুষের মতোই দেহবিশিষ্ট এবং তিনি ভক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু শবরের মতে এ কথা ঠিক নয়। কেননা, স্মৃতির ভিত্তি বলতে বেদ হলো মন্ত্র এবং অর্থবাদ। এটা স্পষ্ট যে মন্ত্র এবং অর্থবাদ অনুসারে দেবতাকে এইভাবে ভাবা যায় না। বস্তুত, মন্ত্র এবং অর্থবাদের গভীর তাৎপর্য প্রত্যাহার না করে মনে করা যায় না যে তৎপ্রতিষ্ঠিত স্মৃতি অনুসারে দেবতাও মানুষের মতো দেহসম্পন্ন এবং তিনি আহারাদি করে থাকেন। এবং লোক-ব্যবহার যেহেতু স্মৃতিরই অনুগামী সেই হেতু পূর্বপক্ষবাদীর পক্ষে লোক-ব্যবহারের নজির দেখিয়ে নিজের যুক্তিকে আরও দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবার প্রশ্ন ওঠে না। 

পূর্বপক্ষবাদী অন্যার্থদর্শনের প্রমাণ হিসেবে ‘হে ইন্দ্র, আমরা তোমার দক্ষিণহস্ত গ্রহণ করি’, ইত্যাদি বাক্য উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো আমরা কখনোই ইন্দ্রর দক্ষিণ-হস্ত গ্রহণ করি না, কেননা তা প্রত্যক্ষসিদ্ধ নয়। অতএব পূর্বপক্ষর যুক্তি মানতে হলে- স্বীকার করতে হলে যে এ জাতীয় ঋকের তাৎপর্য ইন্দ্রের প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ-হস্ত বর্তমান- এ অসম্ভব কথা স্বীকার করতে হবে। এবং এ জাতীয় অসম্ভবকে প্রত্যাহার করতে হলে মানতেই হবে, ঋক-টির প্রকৃত তাৎপর্য এই নয় যে, প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রের হস্তাদি বর্তমান এবং তা গ্রহণ করা সম্ভবপর। অতএব এ জাতীয় বর্ণনাকে প্রশংসাসূচক বা অর্থবাদ হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। সংক্ষেপে, ঋকটির প্রকৃত তাৎপর্য বলতে এমন যজ্ঞকর্মের প্রশংসা যার সঙ্গে ইন্দ্র-নামের সম্পর্ক আছে। পূর্বপক্ষোদ্ধৃত ঋকগুলির প্রকৃত তাৎপর্য এই নয় যে, ইন্দ্রাদি দেবতার হস্তাদি অঙ্গ- অর্থাৎ মনুষ্যসুলভ অঙ্গ- বর্তমান। 

এখানে দেবতাবিশ্বাসী পূর্বপক্ষ যে যুক্তির দ্বারা দেবতা এবং দেবতার শরীর বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান তাকে বলে ‘অর্থাপত্তি’। কোন প্রমাণলব্ধ অর্থের (বিষয়ের) উপপত্তি বা সঙ্গতি রক্ষার জন্য অর্থান্তর (বিষয়ান্তর) কল্পনাকে বলে অর্থাপত্তি। যেমন, জীবিত দেবদত্ত ঘরে নেই। সুতরাং নিশ্চিত ঘরের বাইরে কোথাও আছে। ঘরের বাইরে কল্পনা না করলে, ‘দেবদত্ত ঘরে নেই অথচ জীবিত’ এই প্রমাণলব্ধ সত্য বিষয়টির কোনো সঙ্গতি হয় না। আবার ধরা যাক্, হৃষ্টপুষ্ট দেবদত্ত দিনে খায় না। সুতরাং নিশ্চয়ই রাতে খায়। রাত্রিভোজন-রূপ বিষয়টি কল্পনা না করলে, ‘দেবদত্ত দিনে খায় না অথচ মোটাসোটা হচ্ছে’ এই সত্য ঘটনাটির উপপত্তি হয় না। দেবতা-বিশ্বাসীর যুক্তিও হলো এরূপ অর্থাপত্তিপ্রমাণ। বেদ বলছে- ইন্দ্রের হস্তে বজ্র, তার বাহু রোমশ, চক্ষু পিঙ্গল, বিপুল গ্রীবা, বিশাল মুষ্টি। ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করেছিলো। ইন্দ্র বলে যদি কেউ নাই থাকবে, তবে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এলো কোথা থেকে; অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যদি নাই থাকবে, তবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের এতো গুণাবলি থাকবে কী করে ? ইন্দ্র বলে কেউ না থাকলে, ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করলো কী করে ? আমরা বেদবাক্য প্রামাণিক বলে স্বীকার করেছি। বেদ হলো শ্রুত (শ্রুতি)-প্রমাণ। অতএব শ্রুতার্থাপত্তিপ্রমাণের দ্বারা ইন্দ্রাদি দেবতা ও তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হচ্ছে। 

পূর্বপক্ষবাদীর এই দাবির উত্তরে শবরস্বামী বলছেন,- না, অর্থাপত্তি প্রমাণের দ্বারা দেবতার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। অর্থাপত্তি হলো অগতির গতি, এর প্রাণ হলো ‘অন্যথানুপপত্তি’। একটা বিষয়ান্তর কল্পনা হয় এজন্যেই যে, অন্যথা সত্য বলে স্বীকৃত বিষয়টির অনুপপত্তি বা অসঙ্গতি দেখা দেয়। সুতরাং অগত্যা, গত্যন্তর নেই বলে বিষয়ান্তরের কল্পনাই অর্থাপত্তি। দেবদত্ত ঘরে নেই কিন্তু জীবিত- এই ঘটনাটি সত্য বলে মেনে নিলে তার বাইরে থাকাটা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ‘দেবদত্ত দিনে খায় না, অথচ মোটাসোটা হচ্ছে’ একথা সত্য বলে স্বীকার করে নিলে, তার রাত্রিভোজনটা কল্পনা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই দেবদত্তের ঘরের বাইরে থাকা বা রাতে খাওয়াটা অর্থাপত্তিপ্রমাণসিদ্ধ। কিন্তু দেবতা সম্পর্কে একথা খাটে না কারণ এখানে গত্যন্তর আছে। এই গত্যন্তর হলো ‘কাল্পনিক আরোপ’ (‘আরোপ’ কী এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা হবে)। দৃষ্টবিরুদ্ধ অথবা সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতার অগোচর কোনো অলৌকিক বিষয় কল্পনা করতে হলে উপায়ান্তর আছে কিনা তা নিপুণভাবে খুটিয়ে দেখে তার সীমারেখাটি বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত। না হলে ‘বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না’ বলে পাগলের মতো যা কিছু কল্পনা করলেই চলে। বেদ মানার অর্থ এই নয় যে বেদে লোকানুভববিরুদ্ধ অলৌকিক কাহিনি ইত্যাদি যা কিছু আছে সেগুলি আক্ষরিক অর্থে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। লোকব্যবহারসিদ্ধ কাল্পনিক আরোপের দ্বারা এগুলি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু ‘এরূপ কামনা করলে এরূপ যজ্ঞ করতে হবে’ এ জাতীয় সুস্পষ্ট বৈদিক বিধানের বেলা উপায়ান্তর নেই, তাই আমরা যজ্ঞ ও যজ্ঞফলের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধের ব্যবধান ঘোচাবার একটা অলৌকিক ‘অপূর্ব’ শক্তি মানতে বাধ্য হয়েছি। এই অপূর্বই প্রারব্ধ কর্মের ফল প্রদান করে। ঐ বিধানগুলি এতো স্পষ্ট যে বেদ মানলে আক্ষরিক অর্থেই ঐসব স্থলে কার্যকারণভাব মেনে নিতে হয়। কল্পনানির্মিত দেবতাতে কল্পিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরোপ করে দেবতাবাচক শব্দযুক্ত মন্ত্রোচ্চারণ করে যজ্ঞ করলে ফল পাওয়া যাবে না এমন কথা কোনো বৈদিক বাক্যে নেই। যেহেতু কল্পনারূঢ় আরোপিত দেবত্বের দ্বারাও কাজকর্ম চলে যেতে পারে, সুতরাং অনাবশ্যকভাবে দেবতার অলৌকিক বাস্তব অস্তিত্ব অঙ্গীকার করতে যাবো কেন ! দেবতা যখন প্রত্যক্ষ লোকানুভব সিদ্ধ নয়, তখন এ জাতীয় অঙ্গীকারের ভিত্তিও তো শেষপর্যন্ত কল্পনাতেই শেষ। অতএব-
‘তস্মান্ ন স্তুতিবচনাদ্ অর্থাপত্তির্ভবতি পুরুষবিধত্বে দেবতায়াঃ’- অর্থাৎ, ‘অর্থবাদ বা স্তুতিবাক্যকে অর্থাপত্তি প্রমাণের দ্বারা দেবতার ‘পুরুষবিধত্ব’ অর্থাৎ সচেতন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো দেবতার অস্তিত্ব সিদ্ধ করা যায় না’- (শাবরভাষ্য-মীমাংসাসূত্র-৯/১/৯)।
এরপর শবরস্বামী বলেন, দেবতার যদি দেহ না থাকে তাহলে তাঁর পক্ষে ভোজনাদি কর্মও অসম্ভব। তাছাড়া- (‘ভুঞ্জানায়ৈ দেবতায়ৈ প্রত্তংহবিঃ ক্ষীয়েত। ন চ মধুকরীবদ্ অন্নরসভোজিন্যো দেবতা ইতি প্রমাণমস্তি। মধুকরীষু প্রত্যক্ষম্ । ন তদ্ দেবতায়াম্ । তস্মান্ ন ভুঙক্তে। যদুক্তং দেবতায়ৈ হবিঃ প্রত্তং নীরসং ভবতি ইতি। নৈষ দোষঃ। বাতোপহতং নীরসং ভবতিইতি। শীতোপহতং চ। ন চাসৌ কস্যচিদর্থস্যেষ্টে। অনীশা কথং দারয়ীতি।’- মীমাংসাশাবরভাষ্য)- অর্থাৎ,
দেবতা যদি প্রকৃতপক্ষে ভোজন করতেন তাহলে খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ অবশ্যই হ্রাস পেতো। মৌমাছির মতো তাঁরা শুধুমাত্র খাদ্যদ্রব্যের সারাংশটুকু গ্রহণ করেন- এ যুক্তি স্বীকারযোগ্য নয়। কেননা, মৌমাছির দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষসিদ্ধ, দেবতার দৃষ্টান্ত তা নয়। আর খাদ্যদ্রব্য যে বিস্বাদ হয়ে যায় তার প্রকৃত কারণ দীর্ঘক্ষণ ধরে খাদ্যের সঙ্গে শৈত্য ও বাতাসের সম্পর্ক- তার প্রকৃত কারণ এই নয় যে, দেবতারা খাদ্যদ্রব্যের সারাংশ গ্রহণ করে নিয়েছেন। 

শবরস্বামী আরও বলেন, দেবতা প্রকৃতপক্ষে পার্থিব সম্পদের অধিপতি নন এবং শক্তিবিহীন বলেই তাঁর পক্ষে কোনো কিছু দান করবার প্রশ্ন ওঠে না। যেহেতু স্মৃতির মূলে মন্ত্র ও অর্থবাদ এবং মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের তাৎপর্য এই নয় যে, দেবতাই ধনসম্পদের অধিপতি- অতএব স্মৃতিরও প্রকৃত তাৎপর্য তা হতে পারে না। লোকে বলে ‘দেবতার গ্রাম’, ‘দেবতার ক্ষেত’ ইত্যাদি। কিন্তু এ জাতীয় কথা অহেতুক বিশ্বাসের পরিচায়ক মাত্র। দেবতা যদি প্রকৃতপক্ষেই গ্রাম বা ক্ষেতের মালিক হতেন তাহলে তাঁর পক্ষে এ জাতীয় বস্তু দান করবার ক্ষমতাও থাকতো। কিন্তু কোনো দেবতাই কখনো কাউকে কোনো গ্রাম বা ক্ষেত দান করেন নি। ‘ইন্দ্র স্বর্গের অধিপতি’ ইত্যাদি বাক্য থেকেও প্রমাণ হয় না যে, দেবতাই স্বর্গাদির প্রকৃত মালিক। কেননা আমরা প্রত্যক্ষভাবে জানি যে, দেবতা আসলে মালিক নন; অতএব এ-জাতীয় বাক্যকে নেহাতই অলঙ্কারমূলক বিবেচনা করতে হবে। এটা ঔপচারিক বা লাক্ষণিক প্রয়োগ-
(উপচারোৎপি দেবগ্রামো দেবক্ষেত্রমিতি। উপচারমাত্রম্ ।… ন চ গ্রামং ক্ষেত্রং বা যথাভিপ্রায়ং বিনিযুঙক্তে দেবতা। তস্মান্ ন সংপ্রযচ্ছতি। দেবপরিচারকাণাং তু ততো ভৃতির্ভবতি দেবতামুদ্দিশ্য যত্ত্যক্তম্’- শাবরভাষ্য-মীমাংসাসূত্র-৯/১/৯)।
অর্থাৎ, ‘আমরা কোনো জায়গাকে বলে থাকি- দেবগ্রাম, দেবক্ষেত্র। এটা ঔপচারিক প্রয়োগ। কোনো দেবতা কাউকে গ্রাম বা ক্ষেত্র দান করেন না। ঐ সব স্থানে দেবপূজায়, দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত দ্রব্যাদি দ্বারা ‘দেব-পরিচারক’ বা সেবায়েতদের ভরণপোষণ হয়।’ এই তথ্যটিই হলো দেবগ্রাম-দেবক্ষেত্র প্রভৃতি শব্দের লক্ষ্যার্থ।
পূর্বপক্ষবাদী বলেন, পূজা করে দেবতাকে প্রীত করা যায়; কিন্তু এ কথা স্বীকার করলে আরও স্বীকার করতে হবে যে, দেবতার ইচ্ছাশক্তি তাঁর নিজের আয়ত্তাধীন নয়, তা উপাসকেরই আয়ত্তাধীন। এমন কি যাঁরা দেবতাদের ঈশান বা সর্বশক্তিমান বলেও কল্পনা করেন তাঁরাও উপাসকের প্রচেষ্টা অস্বীকার করতে পারবেন না এবং তাঁরা যদি বলেন, পূজায় প্রীত হয়ে দেবতা উপাসকের ইচ্ছা চরিতার্থ করেন তাহলে তাঁদের পক্ষেও স্বীকার করা প্রয়োজন যে উপাসক দেবতাদের দিয়ে নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করিয়ে নেন- এবং যদি তাই হয় তাহলে দেবতাদের সর্বশক্তিমান করে কল্পনার সুযোগ কোথায় ? শবর বলেন-
(‘তথা দেবতা করোতি যথা পরিচারকাণাম্ অভিপ্রায়ো ভবতি। ন চ স ঈশানো ভবতি যঃ পরাভিপ্রায়ম্ অনুরুধ্যতে। যস্য ন স্বাভিপ্রায়াদ্ বিনিয়োগো ভবতি।’- শাবরভাষ্য-মীমাংসাসূত্র-৯/১/৯)
অর্থাৎ, ‘উপাসক যা ইচ্ছা করেন দেবতা তা পূরণ করতে বাধ্য হন। দেবতা যদি সত্যিই ঈশান বা সর্বশক্তিমান হতেন তবে তোষামোদের তোয়াক্কা না করে নিরঙ্কুশ স্বাধীন ইচ্ছা বলে অযাচিতভাবে সকল জীবের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান করতেন। যিনি ঈশান না তিনি দেবতা নন।’
পূর্বপক্ষবাদী যে বলেন, দেবতাই যজ্ঞরূপ উপাসনায় প্রীত হয়ে উপাসককে কর্মফল দান করেন সে কথাও সঠিক হতে পারে না। এই মতের পক্ষে স্মৃতি এবং লোকাচারমূলক যুক্তিগুলি ইতঃপূর্বে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বাকি থাকে, অন্যার্থদর্শন। কিন্তু ‘প্রীত হয়ে দেবতা তাকে খাদ্যাদি দান করেন’, এ জাতীয় শ্রুতিবাক্য থেকেই প্রমাণ হয় না যে, প্রকৃতপক্ষে দেবতাই আসল ফলদাতা। আসলে, একটি শ্রুতিবাক্যের প্রকৃত তাৎপর্য গ্রহণ করতে হলে তার আগে ও পরে যে বাক্য আছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বুঝতে হবে। এবং দেখা যায়, আলোচ্য বাক্যের অব্যবহিত পরেই বিধিমূলক (যজ্ঞকর্মেও নির্দেশমূলক) বাক্য আছে। অতএব এ জাতীয় যজ্ঞকর্মের দরুনই ফলপ্রাপ্তি ঘটে; ফলপ্রাপ্তির কারণ দেবতা নয়। ‘কর্ম বিনা যখন দেবতাও ফল দিতে পারেন না, তখন কর্মকেই ফলপ্রদ বলিয়া স্বীকার করা উচিত, দেবতাকে আর মধ্যস্থ রাখিয়া ফল কী ? তারপরও, দেবতাকে ফলপ্রদ বলিয়া স্বীকার করিলে ‘বনস্পতিভ্যঃ স্বাহা’, ‘মূলেভ্যঃ স্বাহা’ ইত্যাদি মন্ত্রে যে সমস্ত অচেতন দেবতা প্রতিপাদিত হইতেছে, তাহাদেরও ফলপ্রদত্ব সুতরাং সচেতনত্ব এবং বিগ্রহবত্ব স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু তাহা কি যুক্তিসঙ্গত হইবে ?’ (সূত্র; দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৫০) 

এ প্রেক্ষিতে পূর্বপক্ষ যে সব ঋগ্বেদের মন্ত্র উদ্ধৃত করেছেন তার মধ্যে ইন্দ্রাদি দেবতা অথবা তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বাস্তব অস্তিত্ব আছে এমন কথা কোথাও বলা হয়নি। আবার বেদে এমন অনেক অচেতন পদার্থরূপ দেবতাও আবিষ্কার করা যাবে, যেমন পাথর-দেবতা। ঋগ্বেদের একটি প্রসিদ্ধ সূক্ত (মন্ত্রগুচ্ছ) আছে যা ‘গ্রাবস্তোত্র’ (১০/৯৪) বা পাথরের স্তুতি নামে প্রসিদ্ধ। পাথরের যাঁতাকলে পিষে সোমযাগের জন্য সোমরস নিষ্কাশনের সময় এই স্তোত্র পাঠ করা হতো। এই পাথরপ্রশস্তি ঋগ্বেদের সাহিত্য-সৌন্দর্যের একটি অপূর্ব নিদর্শন। যেমন-
‘এতে বদন্তি শতবৎ সহস্রবদভি ক্রন্দন্তি হরিতেভিরাসভিঃ। বিষ্ট্রী গ্রাহণঃ সুকৃতঃ সুকৃতায়া হোতুশ্চিৎপূর্বে হরিরদ্যমাশত।।’- অর্থাৎ, ‘পাথরগুলি শত সহস্র মানুষের মতো একসঙ্গে কথা বলছে, সোমরসরঞ্জিত সবুজ মুখগুলি মেলে দিয়ে একসঙ্গে কাঁদছে। কিন্তু এই পাথরগুলি যজ্ঞশালায় উপস্থিত হয়ে অনেক পুণ্য অর্জন করেছে, তাই এরা যজ্ঞের হোতা অগ্নিদেবতার আগেই হোমের দ্রব্য সোমরস ভোজন করছে।’- (ঋগ্বেদ-১০/৯৪/২)
বৃহদ্বদন্তি মদিরেণ মন্দিনেন্দ্রং ক্রোশন্তোহবিদন্ননা মধু। সংরভ্যা ধীরাঃ স্বসৃভিরনর্তিষুরাঘোষয়ন্তঃ পৃথিবীমুপাব্দিভিঃ।।’- অর্থাৎ, মন্দ মদির সোমরসে উৎফুল্ল এই পাথরগুলি চীৎকার করে ইন্দ্রকে আহ্বান করছে, মুখ দিয়ে সোমমধু পান করছে, পেষকের আঙুলের সঙ্গে সঙ্গে বোনের সঙ্গে ভাইয়ের মতো নিঃসঙ্কোচে নৃত্য করছে, এদের শব্দে পৃথিবী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।’- (ঋগ্বেদ-১০/৯৪/৪)
ঋগ্বেদের আর একটি প্রখ্যাত সূক্ত হলো নদীস্তুতি (১০/৭৫)।-
‘স্বশ্বা সিন্ধুঃ সুরথা সুবাসা হিরণ্যয়ী সুকৃতো বজিনীবতী। উর্ণাবতী যুবতিঃ সীলমাবত্যুতাধি বস্তে সুভগা মধূবৃধম্’।- অর্থাৎ, ‘বড় সুন্দর অশ্ব, সুন্দর রথ এই সিন্ধুর, সুন্দর তার বসন। পুণ্যবতী হিরণ্ময়ী, ঊর্নাবতী অন্নময়ী, নিত্যযুবতি সিন্ধু, তৃণগুল্মের প্রাচুর্যে ঐশ্বর্যময়ী সিন্ধু মধুপ্রসবকারী পুষ্পের আবরণে নিজেকে আবৃত করেছে।’- (ঋগ্বেদ-১০/৭৫/৮)
‘সুখং রথং ষুষুজে সিন্ধুরশ্বিনং তেন বাজং সনিষদস্মিন্নাজৌ। মহান্ হাস্য মহিমা পনস্যতেহদব্ধস্য স্বষশসো বিরপশিনঃ।’- অর্থাৎ, সিন্ধু তার সুন্দর রথে ঘোড়া জুড়েছে। সেই রথে সিন্ধু আমাদের অন্ন বহন করুক। গতি যার অপ্রতিহত, খ্যাতি যার স্বাধিকার, সেই মহনীয় সিন্ধুরথের গৌরবগাথা আমরা কীর্তন করছি।’- (ঋগ্বেদ-১০/৭৫/৯)
শবর বলেন, উপরিউক্ত দৃষ্টান্তের সাক্ষ্য থেকে পূর্বপক্ষ কি এখানেও অর্থাপত্তির দ্বারা এক একটি পাথর দেবতা বা নদী দেবতার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাইছেন ? উজ্জ্বল রসদীপ্ত কবিকৃতি ‘আহার্য আরোপের’ অকুণ্ঠিত দুঃসাহসে পাথরকে কথা বলাতে পারে, কাঁদাতে পারে, নাচাতে পারে, নদীস্রোত দিয়ে চেতনাময়ী নারীমূর্তি গড়তে পারে। অথবা সরল বিশ্বাসীর উদার বিশ্বাস ‘অনাহার্য আরোপের’ বিভ্রান্তির ঘোরে একাজ করাতে পারে। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রের পক্ষে একাজ দুঃসাধ্য। তাই এজাতীয় সকল মন্ত্রই স্তুতিমূলক অর্থবাদ। উদ্ধৃত মন্ত্রগুলি প্রধানত সোমযাগে বিনিযুক্ত। আপাত দেবস্তুতির অন্তরালে বাস্তবে যজ্ঞকর্মের প্রশস্তি করা হয়েছে। অর্থাপত্তি প্রমাণ অচেতন পদার্থে সচেতন দেবত্ব সঞ্চার করতে পারে না। ইন্দ্র অগ্নি-মিত্র বরুণ-বায়ু-বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাজ্ঞাপক মন্ত্র সম্বন্ধে একই কথা প্রযোজ্য। মন্ত্রে দেবতা গৌণ, যজ্ঞই মুখ্য।
বস্তুত বেদের নির্দেশ থেকেই বোঝা যায়, যজ্ঞকর্মই ফলপ্রদ, দেবতা ফলদাতা নন। ‘দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং স্বর্গকামো যজেত’, ‘জ্যোতিষ্টোমেন সর্বকামো যজেত’- ইত্যাদি বাক্যে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, স্বর্গ প্রভৃতি ফলের হেতু যজ্ঞই, দেবতা নন। 

পূর্বপক্ষবাদী বলবেন, এ জাতীয় দৃষ্টান্তের প্রায়ই দেবতা ও যজ্ঞীয় দ্রব্যেরও উল্লেখ দেখা যায়। উত্তরে বলা হবে, সে উল্লেখ থেকেও প্রমাণ হয় যজ্ঞই প্রধান, দেবতা অপ্রধান বা গৌণ।
পূর্বপক্ষ হয়তো আরো বলবেন, বেদোত্তর স্মৃতি-পুরাণ রামায়ণ-মহাভারত প্রভৃতি বিপুল সাহিত্যরাজিতে দেবতার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে, দেবতা মানলে বা না মানলে কীরূপ ইষ্ট বা অনিষ্ট হবে, কতোরকমে স্বর্গ বা নরক বাস হবে সে বিষয়ে অনেক কথা, অনেক উপাখ্যান রয়েছে। তবে কেন বৈদিক সাহিত্যে দেবতার উপস্থিতিকে আপনারা ঔপচারিক আরোপমূলক অর্থবাদ বলছেন ?
উত্তরে শবর বলছেন, বেদোত্তর যুগের ঐসব কথা ও কাহিনির ভিত্তিও হলো বৈদিক অর্থবাদ। তাই ওগুলিও অর্থবাদমাত্র যার বেদবিধি-বহির্ভূত কোনো স্বতন্ত্র প্রামাণ্য নেই। 

অতএব, মীমাংসার সিদ্ধান্তানুসারে, যজ্ঞ এবং পূজা বা স্তুতি এক নয়। যজ্ঞে দেবতার নামে হবি প্রদান করা হলেও দেবতা যে বাস্তবিকই হবি ভক্ষণ করে প্রীত হবেন এবং প্রীত হয়ে যজ্ঞফল প্রদান করবেন- এ জাতীয় কোনো সম্ভাবনা নেই। বস্তুত, যজ্ঞফল দেবতাদের ইচ্ছাধীন বা আয়ত্তাধীন নয়।-
‘অপি বা শব্দপূর্বত্বাদ্ যজ্ঞকর্মপ্রধানংগুণত্বে দেবতাশ্রুতিঃ’- অর্থাৎ, ‘দেবতা ও যজ্ঞের মধ্যে যজ্ঞই প্রধান, দেবতা গৌণ বা অপ্রধান, কেবল শব্দমাত্র। আবার যজ্ঞ ও ফলের মধ্যে ফলটাই প্রধান, যজ্ঞকর্মটা গৌণ।’- (শাবরভাষ্য-মীমাংসাসূত্র-৯/১/৯)
এ প্রেক্ষিতে ভাষ্যকার শবরস্বামী পরে মীমাংসাসূত্র-১০/৪/২৩-এর ভাষ্যে আবার প্রশ্ন তুলেছেন, দেবতা বলতে তাহলে কী বুঝবো ? এ প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর সমালোচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন, দেবতা মানে ‘সুক্তভাক্’ এবং ‘হাবির্ভাক্’- অর্থাৎ যে নামে সুক্ত উচ্চারিত হয় এবং হবি প্রদান করা হয় তাই-ই দেবতা। প্রশ্ন ওঠে, যেহেতু একই দেবনামের বিভিন্ন প্রতিশব্দ আছে সেইহেতু যজ্ঞে কি কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহার করা যাবে ? যেমন, অগ্নিবাচক নানা শব্দ আছে; যজ্ঞে কি তার যে কোনো শব্দ প্রযোজ্য ?
উত্তরে শবর বলছেন, অগ্নি বলতে যদি প্রকৃতপক্ষে আগুনই বোঝাতো তাহলে এ সম্ভাবনা স্বীকার্য হতো; কিন্তু তা বোঝায় না। যজ্ঞ প্রসঙ্গে প্রকৃত গুরুত্ব হলো নির্দিষ্ট নামটির বা শব্দটির। তাই যজ্ঞপ্রসঙ্গে শব্দান্তর ব্যবহার সম্ভব নয়। পূর্বপক্ষবাদী আপত্তি তুলবেন, ‘যদি তাই-ই হয় তাহলে তো ওই নির্দিষ্ট শব্দটিরই দেবত্ব প্রতিপন্ন হবে।’ উত্তরে শবর বলছেন, ‘এ সম্ভাবনায় আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কেননা আমাদের মতবাদের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ হয় না।’ (সূত্র: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৫০)। 


এ আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মীমাংসা-মতে তাহলে দেবতা বলতে শব্দ বা নাম ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না। সূত্রকার জৈমিনিও (মীমাংসাসূত্র-৯/১/১০) সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘আতিথ্যকর্মে যেমন অতিথিই প্রধান যজ্ঞকর্মে সেইভাবে দেবতা প্রধান নয়; অর্থাৎ যজ্ঞই মুখ্য, দেবতা গৌণ।’ জৈমিনি (মীমাংসাসূত্র-৮/১/৩২-৩৪) আরও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘দেবতা এবং হবির্দ্রব্যর মধ্যে কোনটি প্রধান বা বলবৎ ?’ এবং তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছে, ‘কর্ম যেহেতু হবির্দ্রব্য দ্বারাই প্রকাশিত হয় এবং হবির্দ্রব্য সম্বন্ধরূপেই যেহেতু কর্ম বিহিত হয়, সেই হেতু হবির্দ্রব্যই প্রধান, হবির্দ্রব্যই যজ্ঞের অন্তরঙ্গ- দেবতা বহিরঙ্গ মাত্র।’ 

অতএব, মীমাংসকেরা দেবতাকে ‘হবির্ভাক্’ বিবেচনা করলেও তাঁদের মতে হবির তুলনায় দেবতা অপ্রধান ও গৌণ। এমন কি, দেবতার নাম করে হবি প্রদান করা হলেও সেই হবি প্রকৃতপক্ষে দেবতার হয়ে যায় না, কেননা দেবতার পক্ষে হবি গ্রহণ করবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। দেবতা নামমাত্র বা শব্দমাত্র, তাই দেবতা কী করে হবি গ্রহণ করবেন ? 


অতএব যজ্ঞকর্ম- এমন কি যজ্ঞকর্মে ব্যবহৃত বস্তুগুলিও- মীমাংসামতে দেবতার তুলনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দেবতা আসলে শব্দমাত্র বা নামমাত্র; কর্মফল উৎপাদনে দেবতার কোনো প্রকার শক্তি বা কার্যকারিতার প্রশ্নই ওঠে না- যজ্ঞকর্মই যজ্ঞফল উৎপাদনের একমাত্র কারণ, কর্মের আভ্যন্তরীন বা স্বকীয় শক্তির দরুনই কর্মফল, কর্মফল দেবতার দান নয়- এটাই মীমাংসকরা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। তাই মীমাংসা-দর্শনের অন্যতম দিকপাল ভাট্ট-মীমাংসক পার্থসারথি মিশ্র বলিষ্টভাবে বলেন-
‘মন্দধিয়স্ত শ্রদ্ধালবস্তাত্পর্যম্ অজানানা ভ্রাম্যন্তু নাম দেবতা ফলং প্রযচ্ছতীতি। বস্তুতঃ কর্মণ এব তত্’- অর্থাৎ, ‘যারা অল্পবুদ্ধি অথচ শ্রদ্ধাশীল তারা তাৎপর্য না বুঝে এই ভেবে ভুল করতে পারে যে দেবতা ফল প্রদান করে। কিন্তু বাস্তব কথা হলো কর্ম থেকেই স্বাভাবিক নিয়মে ফল উৎপন্ন হয়।’ অর্থাৎ এজন্য কোনো দেবতার প্রয়োজন হয় না। (খণ্ডদেবকৃত ‘ভাট্টদীপিকা’র শম্ভু ভট্টকৃত ‘প্রভাবলী’-টীকায় উদ্ধৃত)

বৈদিক দেবতা-কল্পনায় আহার্য ও অনাহার্য আরোপ :
মধ্যযুগীয় নব্য-মীমাংসক খণ্ডদেব ‘ভাট্টদীপিকা’য় মীমাংসা-দর্শন অর্থাৎ জৈমিনিমতের ব্যাখ্যা করে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন যে, জৈমিনিমতে বাস্তব অস্তিত্বশালী কোনো দেবতাকে দাঁড় করাবার কোনো যৌক্তিক উপায় নেই। মীমাংসামতে, বিভিন্ন বৈদিকমন্ত্রে যে বিভিন্ন দেবতার নামোল্লেখ রয়েছে, ঐ উল্লিখিত নামমাত্রই দেবতা; ঐ নাম বা শব্দের বাইরে নামধারী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সচেতন পদার্থরূপে কোনো দেবতা বলে কিছু নেই। একেই বলে মীমাংসাসম্মত শব্দাত্মক বা মন্ত্রাত্মক দেবতা। 

কিন্তু আপদেব-কৃত ‘মীমাংসান্যায়প্রকাশে’র ‘ভাট্টালংকার’-টীকায় অনন্তদেব নানারকম ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে মীমাংসামতেও দেবতার বাস্তব অস্তিত্বের সঙ্গতি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। আর খণ্ডদেব ও তার টীকাকার শম্ভু ভট্ট বিস্তৃত যুক্তির দ্বারা অনন্তদেবের যুক্তি খন্ডন করেছেন। এ প্রসঙ্গে খণ্ডদেব ও শম্ভু ভট্ট এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যার গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। তাই এর গুরুত্ব অনুধাবন করে মহামহোপাধ্যায় হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বৈদিকধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন’ গ্রন্থে বিষয়টির প্রয়োজনীয় আলোকপাত (পৃষ্ঠা-২৯) করেছেন। প্রাসঙ্গিক কারণেই আমরা তাঁর আলোচনাটি অনুসরণ করতে পারি।
দেবতাবাদীদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠলো,- বিগ্রহবতী দেবতা নেই, অধিগ্রহা দেবতাও নেই, তাহলে দেবতার উপাসনা, ধ্যান এ সবের অর্থ কী ? (বিগ্রহ মানে হলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদিসমন্বিত শরীর।)
খণ্ডদেবের উত্তরটি প্রণিধানযোগ্য। ধ্যানোপাসনার ভিত্তি হলো ‘আহার্য আরোপ’। 

ভারতীয় দর্শন ও অলঙ্কারশাস্ত্রে ‘আরোপ’ কথাটির অসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। কথাটির অর্থ হলো, বাস্তবে যা নেই কল্পনায় তার অস্তিত্ব আরোপিত করা। যেমন স্বপ্ন-চেতনায় অবাস্তব বস্তু আরোপিত হয়। সহজ কথায় যেখানে যা নেই সেখানে তার অস্তিত্ব কল্পনা করা। আদিম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এই ‘আরোপ’ মানবচেতনার একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই আরোপ দুরকমের- আহার্য ও অনাহার্য। 

আহার্য আরোপ স্বেচ্ছাকৃত, যেমন আমরা কবির মতো বলি, মেয়েটির মুখখানা একেবারে চাঁদ। আমরা ঠিকই জানি, বাস্তবে মুখ কখনো চাঁদ হয় না, চাঁদ কখনো মুখ হয় না। চাঁদ ও মুখের ঐক্য আমাদের লৌকিক-অভিজ্ঞতা-বিরুদ্ধ। এই বিরুদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থেকেও আমরা মুখখানির সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ‘চাঁদের মতো’ না বলে ‘একেবারে চাঁদ’ বলি; অর্থাৎ উপমা ব্যবহার না করে রূপক ব্যবহার করি। 

আবার ধরা যাক, আমরা মৎস্যকন্যা আছে কি নেই এই নিয়ে আলোচনা করছি, সিদ্ধান্ত করছি- ‘মৎস্যকন্যা নেই’। এখানেও কিন্তু মৎস্যকন্যার একটা কাল্পনিক অর্থ সম্পর্কে মনে মনে একটা ধারণা করছি। কল্পনার আরোপিত বিষয়রূপে মৎস্যকন্যা উপস্থিত না থাকলে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছি ? কার সম্পর্কে ‘নেই’ বলছি ? ‘নেই’-ক্রিয়ার কর্তা না থাকলে সিদ্ধান্তবাক্যটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। তাই সিদ্ধান্ত বাক্যটির অর্থ হলো- আমার আপনার চেতনায় যার একটা কাল্পনিক সত্তা মাত্র আছে সেই মৎস্যকন্যার কল্পনাবহির্ভূত কোনো বাস্তব সত্তা নেই। এ জাতীয় কাল্পনিক-সত্তা-গ্রাহী আরোপচেতনাকে সাধারণত বিকল্প বা কল্পনা বলা হয়। কাল্পনিকসত্তার আর এক নাম ঔপচারিক সত্তা।
কিন্তু এই কাল্পনিক সত্তার অনুরূপ বাস্তব সত্তায় যদি কেউ সত্যিই বিশ্বাস করে তখন কল্পিত বস্তুতে সত্যের আরোপকে বলতে হবে ‘অনাহার্য’ আরোপ। কারণ এই আরোপ অনিচ্ছাকৃত অজ্ঞানকৃত। কোনো বস্তু নেই জেনেশুনে কেউ ইচ্ছা করে সে বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে পারে না। আহার্য আরোপে আরোপিত বস্তুর বাস্তব সত্তায় বিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অনাহার্য আরোপের মধ্যে রয়েছে ভ্রান্তবিশ্বাস। যেমন- ভূত-প্রেত বা পৌরাণিক রূপকথায় সরল বিশ্বাস, স্বপ্নাবস্থায় স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়ে বিশ্বাস, স্বপ্নের ভবিষ্যৎ ফলশ্রুতিতে বিশ্বাস। প্রাচীন যাদুভিত্তিক ধর্মবিশ্বাস থেকে আরম্ভ করে আধুনিক কাল পর্যন্ত দেবতা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস, অন্ধকারে রজ্জুতে সর্পভ্রম, জ্যোৎস্নারাতে নুয়ে পড়া কলাপাতায় অবগুণ্ঠিত বধূভ্রম, এসব হলো অনাহার্য আরোপের উদাহরণ। 

এবার খণ্ডদেবের বক্তব্যে ফিরে আসা যাক। ধ্যানোপাসনায় সচেতন ও ইচ্ছাকৃতভাবে কল্পলোকে কোনো দেবতাকে দাঁড় করিয়ে এই কল্পিত দেবতায় কাল্পনিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরোপ করে মানসিক একাগ্রতা অভ্যাস করা হয়। এটা আহার্য আরোপ। আহার্য আরোপে ভ্রান্তি নেই, তাই আহার্য জ্ঞান বা বিকল্প জ্ঞান বাধিত হয় না। কারণ এখানে ভ্রান্তি দূর করার প্রশ্ন ওঠে না, ভ্রান্তবিশ্বাসের কোনো ভূমিকা নেই। তথাপি এরূপ একাগ্রতা অভ্যাসে নৈপুণ্য ও গভীরতা অর্জন করতে পারলে আপনার ধ্যানকল্পলোকে মূর্তিহীন অবাস্তব দেবতাও মূর্তি পরিগ্রহ করে আবির্ভূত হতে পারে। এই আবির্ভাবকে ঠিক মূর্তিবিভ্রম বলা যাবে না, কারণ ব্যাপারটা কী ঘটছে আপনি জানেন, দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস না করেও কল্পনাকৌশলে দেবতার আবির্ভাব ঘটাচ্ছেন। তবু যদি বলতে হয় বলুন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মূর্তিবিভ্রম।
অন্যদিকে সরল বিশ্বাসী ভক্তের কথা ধরা যাক। তার ধ্যানকল্পলোকে দেবতার আবির্ভাবের মূলে রয়েছে ‘অনাহার্য’ আরোপ, কারণ সে মনে করছে, যে দেবতা বাস্তবে আছে বলে সে বিশ্বাস করে সেই দেবতাই প্রত্যক্ষ আবির্ভূত হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের দেবদেবীর ধ্যানমন্ত্রগুলিতে এমন এক চিত্রকল্প কাব্যসৌন্দর্যের আকর্ষণ আছে যা ‘কাব্যিক’ অলংকারের মর্যাদায় উন্নীত হয়ে অবাস্তব অপ্রত্যক্ষ দেবাতাকেও ‘বাস্তবায়িত’ ও ‘প্রত্যক্ষায়িত’ করতে সাহায্য করে। ভক্তের বিশ্বাস যদি দৃঢ় ও গভীর হয় তখন দেবতা কাব্যিক অলংকারের গন্ডি পার হয়ে ‘অনাহার্য রূপকারোপের’ প্রকোপে ভক্তের নিকট যেখানে-সেখানে আবির্ভূত হবে। এই হলো বিশ্বাসভিত্তিক অনাহার্য আরোপঘটিত মূর্তিবিভ্রম বা যথার্থ বিভ্রম।  

অতএব, খণ্ডদেবের বক্তব্যের তাৎপর্য হলো,- যারা দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস না করেও ধ্যানোপাসনা করেন এদের ধ্যানোপাসনার মূলে রয়েছে ‘আহার্য আরোপ’। এবং এ কথার অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে অন্য যে কথাটা এসে যায়,- যারা সত্যি সত্যি দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস পোষণ করেন তাদের ধ্যানোপাসনার ভিত্তি হবে ‘অনাহার্য আরোপ’। এবং অনাহার্য আরোপ মানে ভ্রান্তি। 

টীকাকার শম্ভু ভট্ট ব্যাখ্যা করে বললেন,- মন্ত্রে উল্লিখিত দেবতার একটা অর্থ আছে আমরাও স্বীকার করি। ঐ(কল্পিত) অর্থে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরোপ করে যাজ্ঞিকদের উপাসনা প্রভৃতিতে বাচনিক ধ্যানমাত্র বিধান করা হয়েছে। তথাপি মন্ত্র বা মন্ত্রে উল্লিখিত নাম বা শব্দমাত্রই দেবতা, তার বাইরে কোন দেবতা নেই।
শম্ভু ভট্ট যে ‘বাচনিক ধ্যানমাত্রে’র কথা বলেছেন এর তাৎপর্য হলো, যাজ্ঞিকদের পক্ষে কল্পিত দেবতায় কল্পিত বিগ্রহের আরোপ করে মন্ত্রের ভাষা ও ভাষাগত অর্থের ধারণা করাই যথেষ্ট। এখানে কিন্তু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মূর্তিবিভ্রমেরও কোনো অবকাশ নেই। 

খণ্ডদেব দেবতাবিষয়ক আলোচনা শেষ করে বললেন- এই হলো ‘জৈমিনিমতনিষ্কর্ষঃ’। অর্থাৎ জৈমিনির সুস্পষ্ট অভিমত যে বিগ্রহবতী দেবতা নেই; বিগ্রহহীন দেবতার কথাই ওঠে না। বস্তুত মন্ত্রে যেখানে ইন্দ্রাদি দেবতার উল্লেখ আছে সেখানে ইন্দ্রাদি দেবতার অস্তিত্বপ্রতিপাদন মন্ত্রের তাৎপর্য নয়; দেবতার হস্তপদাদি বিগ্রহ তো দূরের কথা। দেবতার স্তুতি, দেবতার প্রসাদ প্রভৃতি ‘আহার্য আরোপ’।
টীকায় শম্ভু ভট্ট বলেন,-
‘যাগস্তুত্যৈ আহার্যং স্বীক্রিয়তে, ন তু দেবতাস্তুতৌ তাত্পর্যম্’- অর্থাৎ, ‘আসল তাৎপর্য হলো যাগের স্তুতি। যাগের প্রশস্তির জন্য আহার্যরূপে দেবতার প্রশস্তি আরোপিত হয়েছে।’
দেবতা-বিশ্বাসীদের তিনি উপহাস করে বলেন,- যারা মনে করেন বিগ্রহ না থাক, দেবতা আছেন; দেবতা অনুগ্রহ বিতরণ না করুন, তবু তিনি থাকুন; তাদের দেবতা যে ‘অজা-গল-স্তনতুল্য’ নিষ্ফল নিরর্থক কেবল তাই নয়, এ দেবতাবিশ্বাসীদের যুক্তিতে ‘অর্ধজরতী’ বা ‘অর্ধকুক্কুট’ ন্যায়ের ছায়াপাত দেখা যাচ্ছে।
ছাগীর গলায় স্তনের মতো উদ্বৃত্ত মাংসপিন্ড থেকে দুধ পাওয়া যায় না, তাই ওটা ‘অজা-গল-স্তনতুল্য’ নিষ্ফল অর্থহীন। কেউ যদি কোন বৃদ্ধার প্রতি প্রেমাসক্তির সমর্থনে বলেন- এই বৃদ্ধার অর্ধেক শরীরে বার্ধক্য দেখা দিলেও বাকি অর্ধেকে সে যুবতী, এই যুক্তিকে বলে ‘অর্ধজরতী’ ন্যায়। অথবা কেউ যদি বলেন- মুরগিটা যখন ডিম দিচ্ছে তখন এটার পিছন দিকটা রেখে সামনের দিকটা রান্না করো, এই যুক্তিকে বলে ‘অর্ধকুক্কুট’ ন্যায়। এসব যুক্তি যেমন হাস্যকর তেমনি বিগ্রহধারণে বা প্রসাদবিতরণে অক্ষম হলেও দেবতা বলে একটা কিছু আছে এ ধারণাও সমান হাস্যকর। সুতরাং মীমাংসা-মতে, যজ্ঞকর্মে দেবতার বিগ্রহ ও অনুগ্রহ যেমন আহার্য অর্থাৎ স্বেচ্ছাকৃত কল্পনার সৃষ্টি তেমনি দেবতাও আহার্য কল্পনা মাত্র।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : মীমাংসা-মতে ঈশ্বর] [*] [পরের পর্ব : মীমাংসায় ভাববাদ-খণ্ডন]

No comments: