.
ভাববাদী মতবাদের এই মিথ্যাবুদ্ধি অনুমানের জন্য স্বপ্ন-প্রত্যয় এবং মায়া মরীচিকা গন্ধর্বনগর প্রভৃতি ভ্রমপ্রত্যয়কে দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ করার যথেষ্ট নমুনা শূন্যবাদের সমর্থক গ্রন্থ ‘মাধ্যমিককারিকা’ বা বিজ্ঞানবাদের সমর্থক গ্রন্থ ‘লঙ্কাবতারসূত্র’-এ উল্লেখ রয়েছে। যেমন-
যে-জ্ঞান সমর্থপ্রবৃত্তির জনক তাকে তথাকথিত সত্য বলতে হবে। সমর্থপ্রবৃত্তির অর্থ সফল প্রবৃত্তি। প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তি হলো জ্ঞানের ফল। জ্ঞানের বিষয়টি সংক্রান্ত প্রাপ্তি বা পরিত্যাগের যে প্রবৃত্তি জন্মে, যে-জ্ঞান এই প্রবৃত্তির সাফল্যদানে সক্ষম তাই যথার্থ। যেমন, ব্যবহারিকভাবে রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান যথার্থ কেননা তা রজ্জুপ্রাপ্তি সংক্রান্ত প্রবৃত্তির সফলতা দেয়। এই প্রবৃত্তি-সামর্থ্য অবশ্যই জ্ঞান-বাহ্য, তাই পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ। এই প্রবৃত্তি-সামর্থ্যরূপ জ্ঞানবাহ্য শর্তের দরুনই জ্ঞানের যথার্থতা বা প্রামাণ্যের উৎপত্তি ও প্রতিপত্তি। তাই, স্বতঃ-অপ্রামাণ্য ও পরতঃ-প্রমাণ্যবাদী ভাববাদীদের মতবাদটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হলো, দার্শনিক বিচারে সমস্ত জ্ঞানই জ্ঞান হিসেবে ভ্রান্ত হলেও যে-জ্ঞান কর্মজীবনে কার্যকরি হয় তাকে ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথাকথিত অর্থে যথার্থজ্ঞান বলা হবে।
প্রস্থানগত দিক থেকে ন্যায়-বৈশেষিক ও মীমাংসকরা বাহ্যবস্তুবাদী হলেও উপরিউক্ত প্রশ্ন প্রসঙ্গে উভয়ের সিদ্ধান্ত কিন্তু এক নয়। জ্ঞানের প্রামাণ্য বিষয়ক প্রথম প্রশ্নের উত্তরে মীমাংসকরা প্রস্তাব করেছেন স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ ও পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ, অন্যদিকে ন্যায়-বৈশেষিকরা প্রস্তাব করেছেন পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ ও পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ। আর ভ্রম বিষয়ক দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিক ও ভাট্টমীমাংসকরা প্রস্তাব করেছেন অন্যথাখ্যাতিবাদ, অপরপক্ষে ভাট্টদের সাথে সাদৃশ্য সত্ত্বেও প্রাভাকর-মীমাংসকরা সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তার নাম অখ্যাতিবাদ।
ভাববাদ অনুসারে অপ্রামাণ্যই স্বতঃসিদ্ধ। তার উত্তরে বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসক এবং ন্যায়-বৈশেষিক উভয়েই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে উৎপত্তি বা জ্ঞপ্তি কোনো দিক থেকেই জ্ঞানকে স্বতঃসিদ্ধভাবে অপ্রমা বলা যায় না। কেননা, তাঁদের মতে, যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয় তার থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি হতে পারে না, তার বদলে ‘দোষ’ নামের একটি বাড়তি কারণ থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি। এবং যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞান-জ্ঞপ্তি ঘটে তা থেকেই অপ্রমা-জ্ঞপ্তি ঘটে না, তার পরিবর্তে ‘প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য’ বলে স্বতন্ত্র কারণ থেকে অপ্রমার জ্ঞপ্তি হয়। তাই এরা পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদী।
‘এই মতবাদ ভাববাদী স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী। স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ অনুসারে জ্ঞান-মাত্রেই স্বতঃসিদ্ধভাবে মিথ্যা, কিন্তু স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ অনুসারে জ্ঞান-মাত্রেই স্বতঃসিদ্ধভাবে সত্য। যে কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই যদি প্রমার উৎপত্তি হয় তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে জ্ঞান মাত্রই প্রমা, সমস্ত জ্ঞানই যথার্থ। শুধু তাই নয়, যে-কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের জ্ঞপ্তি বা অবগতি হয় সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই যদি প্রমারও জ্ঞপ্তি হয় তাহলে আরো স্বীকার করতে হবে, জ্ঞানমাত্রই যথার্থ বলে জ্ঞাত। অর্থাৎ সংক্ষেপে, সমস্ত জ্ঞানই জ্ঞান হিসেবে যথার্থ এবং যথার্থ বলেই জ্ঞাত। এ-কথা দাবি করলে অবশ্যই অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা, জ্ঞানমাত্রই যদি প্রমা হয় তাহলে অপ্রমা বলে কিছুই সম্ভব হতে পারে না; অথচ শুক্তিরজত, রজ্জুসর্প, মায়া-মরীচিকা প্রভৃতির জ্ঞানকে কি অপ্রমা বলা হবে না ? মীমাংসকেরা কি প্রমা ও অপ্রমার মধ্যে কোনো পার্থক্য স্বীকার করবেন না ? তাঁরা নিজেরাই যে পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ প্রস্তাব করেছেন সেখানে অপ্রামাণ্যের প্রকৃত তাৎপর্য কী ?’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: ভারতীয় দর্শন, পৃ-৩০৬)
এবার দেখা যাক, মীমাংসকরা কীভাবে স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চান।
বস্তুত, পরতঃ-প্রামাণ্যবাদের বিরুদ্ধে মীমাংসকদের অন্যতম প্রধান যুক্তি বলতে এই অনবস্থা-দোষের আশঙ্কা। তাঁদের মতে, স্বতঃ-প্রামাণ্য অস্বীকার করলে বলতে হবে, যে জ্ঞান-কারণ-সামগ্রির জন্য জ্ঞান উৎপন্ন হলো তা-ব্যতীত স্বতন্ত্র কোনো কারণের জন্য জ্ঞানের প্রামাণ্য উৎপন্ন হলো। কিন্তু এই স্বতন্ত্র কারণটির যদি নিজস্ব প্রামাণ্য না থাকে তাহলে তা আলোচ্য জ্ঞানের মথ্যে প্রামাণ্য উৎপাদন করতে পারবে না। কিন্তু এই স্বতন্ত্র কারণটির প্রামাণ্যের ব্যাখ্যা কী হতে পারে ? হয় বলতে হবে তা স্বতঃ-প্রমাণ, আর না হয় তো বলতে হবে অপর কোনো তৃতীয় কারণের ফলে তার প্রামাণ্য উৎপন্ন হয়। যদি তাকে স্বতঃ-প্রমাণ বলে স্বীকার করা হয় তাহলে তো স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদই মানা হলো। আর যদি বলা হয়, অপর কোনো তৃতীয় কারণের ফলে তার প্রামাণ্য উৎপন্ন হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে এই তৃতীয় কারণটির প্রামাণ্য উৎপন্ন হয় কীভাবে ? তৃতীয় কারণটির প্রামাণ্য উৎপাদনের জন্য চতুর্থ কারণ স্বীকার করতে হবে, চতুর্থ কারণের প্রামাণ্য উৎপাদনের জন্য পঞ্চম কারণ স্বীকার করতে হবে- এভাবে কোথাও বিশ্রামের সম্ভাবনা থাকবে না, অর্থাৎ অনবস্থা দোষ ঘটবে।
কিন্তু এখানে যে অন্য প্রশ্নটি ওঠে তা হলো, পরতঃ-প্রামাণ্যবাদী ন্যায়-বৈশেষিকরা শব্দজ্ঞানের নজির থেকে যে প্রমাণ করতে চান, সাধারণভাবে সমস্ত প্রকার প্রমাণের ক্ষেত্রেই প্রমা-উৎপত্তির মূলে জ্ঞান-কারণ-সামগ্রি ছাড়াও ‘গুণ’ নামের কোনো এক অতিরিক্ত কারণ বর্তমান- এ-কথাই বা কতখানি যুক্তিসঙ্গত হতে পারে ? শব্দজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বাক্যকে গুণ হিসেবে যুক্ত করে’ কথাটি যতো সহজে প্রতিপন্ন করা যায় প্রত্যক্ষ-অনুমানাদি অন্যান্য জ্ঞানের দৃষ্টান্তে তা সম্ভব নয়। যেমন, প্রত্যক্ষজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়াদি জ্ঞান-কারণ-সামগ্রি ছাড়াও স্বতন্ত্র কোন্ ‘গুণ’ থেকে প্রমার উৎপত্তি ব্যাখ্যাত হতে পারে ? উত্তরে ইন্দ্রিয়াদির দোষাভাবকে উক্ত ‘গুণ’ বললে সমস্যার সমাধান হয় না। কেননা, দোষাভাব অভাব-পদার্থ; অভাবপদার্থ থেকে প্রমা নামের ভাবপদার্থের উৎপত্তি কী করে সম্ভব হবে ? অতএব দেখা যায়, উৎপত্তির দিক থেকে সামগ্রিকভাবে- অর্থাৎ, সমস্ত জ্ঞানের দৃষ্টান্তে ন্যায়-বৈশেষিকেরা যেভাবে পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ প্রস্তাব করেছেন সে-সম্বন্ধে সংশয় হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, জ্ঞপ্তির দিক থেকেও তাঁদের পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ সংশয়-সাপেক্ষ। বস্তুত, প্রবৃত্তি-সামর্থ্যকে প্রমা জ্ঞপ্তির কারণ নির্ণয় করে ন্যায়-বৈশেষিকরা ভাববাদ-বিরোধী ঐতিহ্যে অবদান রেখেছেন।
মীমাংসকদের এই যুক্তি হলো, প্রবৃত্তি-সামর্থমূলক কোনো একটি দ্বিতীয় জ্ঞান যদি প্রথম জ্ঞানের প্রামাণ্য-জ্ঞপ্তির কারণ হয় তাহলে এই দ্বিতীয় জ্ঞানটির প্রামাণ্য-জ্ঞপ্তির কারণ হিসেবে অপর কোনো তৃতীয় জ্ঞানের কথা কল্পনা করতে হবে, এবং তৃতীয় জ্ঞানটির প্রামাণ্য-জ্ঞপ্তির কারণ হিসেবে একটি চতুর্থ জ্ঞানের কথা কল্পনা করতে হবে- এবং এইভাবে কোনোই বিশ্রামের সম্ভাবনা থাকবে না, অনবস্থা-দোষ ঘটবে।
| মীমাংসা দর্শন-১০ : জ্ঞানের প্রামাণ্য |
রণদীপম বসু
…
৩.৩ : জ্ঞানের প্রামাণ্য
…
ভারতীয় দর্শনে ‘প্রমা’ মানে যথার্থজ্ঞান। আর পারিভাষিক অর্থে ‘প্রমাণ’ মানে প্রমার করণ। যে-অসাধারণ কারণের সক্রিয়তার ফলে একটি নির্দিষ্ট কার্যের উৎপত্তি তাকে করণ বলা হয়। এই অর্থে ‘প্রমার করণ’ বা ‘প্রমাণ’ মানে প্রত্যক্ষ অনুমানাদি যথার্থজ্ঞানের উৎস। প্রত্যক্ষই প্রত্যক্ষ-প্রমার কারণ, অনুমানই অনুমানমূলক প্রমার কারণ, ইত্যাদি। কিন্তু ‘প্রমাণ’ শব্দটি সবসময় শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। অনেক সময় প্রমা বা যথার্থজ্ঞান অর্থেও তা ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে প্রমার যে-যথার্থত্ব বা সত্যতা, তাকে বলা হয়েছে প্রামাণ্য বা প্রমাত্ব। একইভাবে অযথার্থত্ব বা মিথ্যাত্বকে বলা হয়েছে অপ্রামাণ্য বা অপ্রমাত্ব।
রণদীপম বসু
…
৩.৩ : জ্ঞানের প্রামাণ্য
…
ভারতীয় দর্শনে ‘প্রমা’ মানে যথার্থজ্ঞান। আর পারিভাষিক অর্থে ‘প্রমাণ’ মানে প্রমার করণ। যে-অসাধারণ কারণের সক্রিয়তার ফলে একটি নির্দিষ্ট কার্যের উৎপত্তি তাকে করণ বলা হয়। এই অর্থে ‘প্রমার করণ’ বা ‘প্রমাণ’ মানে প্রত্যক্ষ অনুমানাদি যথার্থজ্ঞানের উৎস। প্রত্যক্ষই প্রত্যক্ষ-প্রমার কারণ, অনুমানই অনুমানমূলক প্রমার কারণ, ইত্যাদি। কিন্তু ‘প্রমাণ’ শব্দটি সবসময় শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। অনেক সময় প্রমা বা যথার্থজ্ঞান অর্থেও তা ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে প্রমার যে-যথার্থত্ব বা সত্যতা, তাকে বলা হয়েছে প্রামাণ্য বা প্রমাত্ব। একইভাবে অযথার্থত্ব বা মিথ্যাত্বকে বলা হয়েছে অপ্রামাণ্য বা অপ্রমাত্ব।
ভারতীয় দর্শনে প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এই বিতর্কের মূলে প্রধানত দুটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়-
(এক) : প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্যের উৎপত্তির ব্যাখ্যা কী ? যে-কারণে জ্ঞানের উৎপত্তি সেই কারণেই কি প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি ? নাকি, প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি স্বতন্ত্র বা বাহ্য কোনো কারণে হয় ?
(দুই) : প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের অবগতি বা জ্ঞপ্তিই বা হয় কী করে ? অর্থাৎ, এই প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের কথা কেমন করেই বা জানা যায় ? যে-কারণে জ্ঞানের জ্ঞপ্তি সেই কারণেই কি প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যেরও জ্ঞপ্তি ? নাকি, প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি স্বতন্ত্র বা বাহ্য কোনো কারণে হয় ?
(এক) : প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্যের উৎপত্তির ব্যাখ্যা কী ? যে-কারণে জ্ঞানের উৎপত্তি সেই কারণেই কি প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি ? নাকি, প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি স্বতন্ত্র বা বাহ্য কোনো কারণে হয় ?
(দুই) : প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের অবগতি বা জ্ঞপ্তিই বা হয় কী করে ? অর্থাৎ, এই প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের কথা কেমন করেই বা জানা যায় ? যে-কারণে জ্ঞানের জ্ঞপ্তি সেই কারণেই কি প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যেরও জ্ঞপ্তি ? নাকি, প্রামাণ্য বা অপ্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি স্বতন্ত্র বা বাহ্য কোনো কারণে হয় ?
ভারতীয়
দর্শনজগতে জ্ঞানের প্রামাণ্য প্রসঙ্গে দুটি মতবাদ প্রচলিত আছে-
স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ ও পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ। স্বতন্ত্রভাবে এই তত্ত্বগুলি
নিম্নরূপ।
যদি বলা যায়, যে-কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞান উৎপন্ন হয় ও জ্ঞাত হয়, সেই কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকেই প্রমাও উৎপন্ন ও জ্ঞাত হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। অতএব এই মতের নাম স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ (theory of intrinsic validity)।
পক্ষান্তরে যদি বলা যায়, যে-কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হয় সেই কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকেই প্রমার উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হয় না,- অর্থাৎ উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তির দিক থেকে প্রমা জ্ঞান-কারণ বা জ্ঞান-কারণ-সামগ্রি অতিরিক্ত অন্য কোনো কারণের উপর নির্ভরশীল, তাহলে মানতে হবে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ নয়, জ্ঞানবাহ্য। অতএব এই মতবাদের নাম পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ ((theory of extrinsic validity)।
যদি বলা যায়, যে-কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞান উৎপন্ন হয় ও জ্ঞাত হয়, সেই কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকেই প্রমাও উৎপন্ন ও জ্ঞাত হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। অতএব এই মতের নাম স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ (theory of intrinsic validity)।
পক্ষান্তরে যদি বলা যায়, যে-কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হয় সেই কারণ বা কারণ-সামগ্রি থেকেই প্রমার উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হয় না,- অর্থাৎ উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তির দিক থেকে প্রমা জ্ঞান-কারণ বা জ্ঞান-কারণ-সামগ্রি অতিরিক্ত অন্য কোনো কারণের উপর নির্ভরশীল, তাহলে মানতে হবে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ নয়, জ্ঞানবাহ্য। অতএব এই মতবাদের নাম পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ ((theory of extrinsic validity)।
অপ্রামাণ্য প্রসঙ্গেও এ-জাতীয় দুটি মতবাদ আছে- স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ ও পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ।
স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ (theory of intrinsic invalidity) অনুসারে যে-কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই অপ্রামাণ্যেরও উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি ; অর্থাৎ জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধভাবেই অযথার্থ বা অপ্রমা। জ্ঞানের উৎপত্তি হলেই তা অযথার্থ বলে উৎপন্ন হবে এবং জ্ঞানের জ্ঞপ্তি হলেই তা অযথার্থ বলেই জ্ঞাত হয়।
অন্যদিকে, পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ (theory of extrinsic invalidity) অনুসারে যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি নয়,- তার বদলে স্বতন্ত্র বা জ্ঞান-কারণ-বাহ্য কোনো কারণ থেকে অপ্রমার উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হয়।
স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ (theory of intrinsic invalidity) অনুসারে যে-কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই অপ্রামাণ্যেরও উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি ; অর্থাৎ জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধভাবেই অযথার্থ বা অপ্রমা। জ্ঞানের উৎপত্তি হলেই তা অযথার্থ বলে উৎপন্ন হবে এবং জ্ঞানের জ্ঞপ্তি হলেই তা অযথার্থ বলেই জ্ঞাত হয়।
অন্যদিকে, পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ (theory of extrinsic invalidity) অনুসারে যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি নয়,- তার বদলে স্বতন্ত্র বা জ্ঞান-কারণ-বাহ্য কোনো কারণ থেকে অপ্রমার উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হয়।
প্রামাণ্য
ও অপ্রামাণ্য বিষয়ে দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মত
প্রস্তাবিত হয়েছে। সায়ণ মাধবাচার্য্যরে ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে উক্ত
বিষয়ে চারটি মত পাওয়া যায়। প্রথমত, সাংখ্যদার্শনিকদের মতে জ্ঞানের
প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য- উভয়ই স্বতঃ। দ্বিতীয়, নৈয়ায়িক মতে জ্ঞানের
প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য উভয়ই পরতঃ। তৃতীয়ত, বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে জ্ঞানের
অপ্রামাণ্য হলো স্বতঃ, কিন্তু জ্ঞানের প্রামাণ্য হলো পরতঃ। চতুর্থত,
মীমাংসা মতে জ্ঞানের প্রামাণ্য হলো স্বতঃ, কিন্তু অপ্রামাণ্য হলো পরতঃ।
জ্ঞানের
প্রামাণ্য প্রসঙ্গে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের মধ্যে এই যে মতভেদ,
সমস্যাটি মূলত জ্ঞানের উৎপত্তি ও যথার্থতা বিষয়ে। ফলে এই মতবাদগুলি থেকেই
বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের স্ব স্ব ভাববাদী কিংবা বাহ্যবস্তুবাদী
দৃষ্টিভঙ্গির সম্যক প্রকাশ ঘটেছে। তাই মীমাংসামতে স্বীকৃত মতবাদ বোঝার
সুবিধার্থে অন্যান্য মতবাদগুলির তাৎপর্যও জানা আবশ্যক মনে হয়। প্রামাণ্য
প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতবাদগুলি সংক্ষেপে-
সাংখ্য ভাববাদী মত : ‘স্বতঃ-প্রামাণ্য ও স্বতঃ-অপ্রামাণ্য’।
বৌদ্ধাদি ভাববাদীর মত : ‘স্বতঃ-অপ্রামাণ্য ও পরতঃ-প্রামাণ্য’।
বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসা মত : ‘স্বতঃ-প্রামাণ্য ও পরতঃ-অপ্রামাণ্য’।
বাহ্যবস্তুবাদী ন্যায়-বৈশেষিক মত : ‘পরতঃ-প্রামাণ্য ও পরতঃ-অপ্রামাণ্য’।
বিষয়ে
প্রবেশের সুবিধার্থে এ পর্যায়ে প্রথমে স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদের তাৎপর্য দেখা
যাক। স্বতঃ-অপ্রামাণ্য মানে অযথার্থত্ব বা মিথ্যাত্ব স্বতঃসিদ্ধ। আর
অপ্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ হলে স্বীকার করতে হবে যে জ্ঞানমাত্রই ভ্রম বা
অপ্রমা। যে কারণ বা কারণ-সামগ্রির ফলে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি সেই
কারণেই অপ্রমারও উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হলে কোনো জ্ঞানের পক্ষেই যথার্থ হবার
সুযোগ থাকে না, জ্ঞানমাত্রেই স্বতঃসিদ্ধভাবে মিথ্যা হতে বাধ্য। ফলে তথাকথিত
যথার্থজ্ঞানও আসলে অযথার্থই। অতএব এক্ষেত্রে মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ
তর্কবাগীশের মতে ওইসব মতবাদে- ‘প্রমাণ-প্রমেয় ব্যবহার কাল্পনিক। জগতে সমস্ত
জ্ঞানই ভ্রম। সুতরাং যে-সমস্তকে প্রমাণ বলা হয় তাহাও প্রমাণাভাস।
(ন্যায়দর্শন-১/৬)।’
এখানে
উল্লেখ্য যে, দর্শনতত্ত্বে জগতের সকলকিছুই কিন্তু এই প্রমাণ ও প্রমেয়ের
অন্তর্গত। যে মতবাদে জগতের সমস্ত জ্ঞান বা প্রতীতিকে মিথ্যে বলে ঘোষণা করা
হয়, আপাত-দৃষ্টিতে মতবাদটিকে অতি-অদ্ভুত মনে হতে পারে। কেননা, রজ্জুতে
সর্পজ্ঞান অবশ্যই ভ্রম, কিন্তু রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান কী করে ভ্রম হতে পারে ?
কিন্তু প্রকৃত ভাববাদী দার্শনিকের পক্ষে এ জাতীয় মতবাদের প্রস্তাব
অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ভাববাদী মতে বহির্জগত বলে কিছু নেই, বাহ্যবস্তু বলে
কিছু নেই। অথচ আমাদের সাধারণ প্রতীতি বলতে যে বাহ্যবস্তুর প্রতীতি বুঝি,
ভাববাদীদের মতে তা হলো যা নেই তারই প্রতীতি। অবস্তুতে বস্তুর প্রতীতি। অতএব
এ সব মিথ্যা। তাদের মতে জগতে রজ্জু বলে সত্যিই যদি কিছু থাকতো তাহলে
রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান সত্য হতে পারতো। তথাকথিত রজ্জুও শেষপর্যন্ত
স্বপ্নপ্রতীত বিষয়ের মতোই মিথ্যা, অথচ আমাদের রজ্জুজ্ঞান রজ্জুর
বাহ্যত্বরূপের জ্ঞান। তাই মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তাঁর বাৎসায়ণভাষ্যের
ব্যাখ্যারূপ ‘ন্যায়দর্শন’ গ্রন্থে শূন্যবাদী-বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধসম্প্রদায়ের
মতো ওইসব ভাববাদী মতবাদের সিদ্ধান্তটি উক্ত করেন এভাবে- ‘সমস্ত বুদ্ধিই
নিজের অবাহ্য আকারকে বাহ্যত্বরূপে বিষয় করায় মিথ্যাবুদ্ধি।
(ন্যায়দর্শন-৫/১২৩)।
ভাববাদী মতবাদের এই মিথ্যাবুদ্ধি অনুমানের জন্য স্বপ্ন-প্রত্যয় এবং মায়া মরীচিকা গন্ধর্বনগর প্রভৃতি ভ্রমপ্রত্যয়কে দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ করার যথেষ্ট নমুনা শূন্যবাদের সমর্থক গ্রন্থ ‘মাধ্যমিককারিকা’ বা বিজ্ঞানবাদের সমর্থক গ্রন্থ ‘লঙ্কাবতারসূত্র’-এ উল্লেখ রয়েছে। যেমন-
‘যথা মায়া যথা স্বপ্নো গন্ধর্বনগরং যথা।
তথোৎপাদস্তথা স্থানং তথা ভঙ্গ উদাহৃতা।।’- (মাধ্যমিককারিকা-৫৭)
অর্থাৎ : স্বপ্নাবস্থায় বিষয়ভ্রমের ন্যায় অথবা মায়া গন্ধর্বনগর ও মরীচিকাপ্রযুক্ত ভ্রমের ন্যায় এই প্রমাণ ও প্রমেয়বিষয়ক ভ্রম সৃষ্টি হয়। (মুক্ততর্জমা)
তাই
মীমাংসক কুমারিল বলেন, ‘ভাববাদ অনুসারে স্তম্ভাদির প্রত্যয় মিথ্যা, কেননা
তা প্রত্যয়, যাই প্রত্যয় তাই মিথ্যা, যেমন স্বপ্নপ্রত্যয়।’ স্তম্ভাদি
অর্থাৎ স্তম্ভ ইত্যাদি হলো জাগতিক বাহ্যবস্তুর প্রতীকী নমুনা। এক্ষেত্রে
ন্যায়সূত্রে পূর্বপক্ষ হিসেবে উপস্থাপিত ভাববাদীদের এই যুক্তির ব্যাখ্যায়
মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের বক্তব্যে ওই ভাববাদী মতবাদের রূপরেখা স্পষ্টভাবে
বিধৃত হয়েছে-
‘প্রমাণ বলিয়া কোনো পদার্থ বস্তুত নাই এবং প্রমেয়ও নাই। সুতরাং বাস্তব প্রমাণের দ্বারা কোনো বাস্তব প্রমেয়সিদ্ধিও হয় না। প্রমাণ-প্রমেয়ভাবই বাস্তব নহে। কিন্তু উহা অনাদি সংস্কার-প্রযুক্ত কল্পনামূলক। যেমন স্বপ্নাবস্থায় নানা বিষয়ের যে সমস্ত জ্ঞান জন্মে, তাহা ঐ সমস্ত বিষয়ের সত্তা না থাকায় অসদবিষয়ক বলিয়া ভ্রম, তদ্রূপ জাগ্রদবস্থায় ‘ইহা প্রমাণ’ ও ‘ইহা প্রমেয়’ এই রূপে যে সমস্ত জ্ঞান জন্মে, তাহাও ভ্রম। কারণ প্রমাণ ও প্রমেয় সৎ পদার্থ নহে। অসৎ বিষয়ে যে সমস্ত জ্ঞান জন্মে, তাহা অবশ্যই ভ্রম। আপত্তি হইতে পারে যে, জাগ্রদবস্থায় যে অসংখ্য বিষয়জ্ঞান জন্য লোকব্যবহার চলিতেছে উহা স্বপ্নাবস্থার বিষয়জ্ঞান হইতে অত্যন্ত বিলক্ষণ। সুতরাং তদ্দৃষ্টান্তে জাগ্রদবস্থার সমস্ত বিষয়জ্ঞানকে ভ্রম বলা যায় না। এজন্য পূর্বোক্ত মতবাদীরা শেষে বলিয়াছেন যে, জাগ্রদবস্থাতেও যে বহু বহু ভ্রমজ্ঞান জন্মে ইহাও সর্বসম্মত। ঐন্দ্রজালিক মায়া প্রয়োগ করিয়া বহু অসদবিষয়ে দ্রষ্টার ভ্রম উৎপন্ন করে। এবং আকাশে গন্ধর্বনগর না থাকিলেও কোনো কোনো সময়ে গন্ধর্বনগর বলিয়া ভ্রম হয় এবং মরীচিকায় জলভ্রম হয়, ইহা তো সকলেরই স্বীকৃত। সুতরাং জাগ্রদবস্থার ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞানকে দৃষ্টান্ত করিয়া সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম, সুতরাং প্রমাণ ও প্রমেয়বিষয়ক জ্ঞানও ভ্রম, ইহা অবশ্য বলিতে পারি।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৩০)
‘প্রমাণ বলিয়া কোনো পদার্থ বস্তুত নাই এবং প্রমেয়ও নাই। সুতরাং বাস্তব প্রমাণের দ্বারা কোনো বাস্তব প্রমেয়সিদ্ধিও হয় না। প্রমাণ-প্রমেয়ভাবই বাস্তব নহে। কিন্তু উহা অনাদি সংস্কার-প্রযুক্ত কল্পনামূলক। যেমন স্বপ্নাবস্থায় নানা বিষয়ের যে সমস্ত জ্ঞান জন্মে, তাহা ঐ সমস্ত বিষয়ের সত্তা না থাকায় অসদবিষয়ক বলিয়া ভ্রম, তদ্রূপ জাগ্রদবস্থায় ‘ইহা প্রমাণ’ ও ‘ইহা প্রমেয়’ এই রূপে যে সমস্ত জ্ঞান জন্মে, তাহাও ভ্রম। কারণ প্রমাণ ও প্রমেয় সৎ পদার্থ নহে। অসৎ বিষয়ে যে সমস্ত জ্ঞান জন্মে, তাহা অবশ্যই ভ্রম। আপত্তি হইতে পারে যে, জাগ্রদবস্থায় যে অসংখ্য বিষয়জ্ঞান জন্য লোকব্যবহার চলিতেছে উহা স্বপ্নাবস্থার বিষয়জ্ঞান হইতে অত্যন্ত বিলক্ষণ। সুতরাং তদ্দৃষ্টান্তে জাগ্রদবস্থার সমস্ত বিষয়জ্ঞানকে ভ্রম বলা যায় না। এজন্য পূর্বোক্ত মতবাদীরা শেষে বলিয়াছেন যে, জাগ্রদবস্থাতেও যে বহু বহু ভ্রমজ্ঞান জন্মে ইহাও সর্বসম্মত। ঐন্দ্রজালিক মায়া প্রয়োগ করিয়া বহু অসদবিষয়ে দ্রষ্টার ভ্রম উৎপন্ন করে। এবং আকাশে গন্ধর্বনগর না থাকিলেও কোনো কোনো সময়ে গন্ধর্বনগর বলিয়া ভ্রম হয় এবং মরীচিকায় জলভ্রম হয়, ইহা তো সকলেরই স্বীকৃত। সুতরাং জাগ্রদবস্থার ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞানকে দৃষ্টান্ত করিয়া সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম, সুতরাং প্রমাণ ও প্রমেয়বিষয়ক জ্ঞানও ভ্রম, ইহা অবশ্য বলিতে পারি।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৩০)
অতএব,
স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদের উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে লোকব্যবহারমূলক সমস্ত
প্রতীতিই মিথ্যা, কেননা তা অবস্তুতে বস্তুর প্রতীতি, চেতনাপদার্থেরই
বাহ্যবস্তুরূপে প্রতীতি। শূন্যবাদী ও বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ এবং অদ্বৈতবেদান্ত
সম্প্রদায়ের দার্শনিক প্রস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি যে এরূপ ভাববাদে আকীর্ণ তা
বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে প্রশ্ন আসে, এই বাহ্যজগতে অবস্থান করে
দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্মাদির প্রত্যক্ষ উৎযাপন করেও ভাববাদীরা এই যে
প্রমাণ-প্রমেয়স্বরূপ বাহ্যজগতটাকে ‘অধ্যাস’ বা মিথ্যা-মায়া বলে উড়িয়ে
দিচ্ছেন, তাহলে তাদের কাছে প্রাত্যহিক লোকব্যবহারের প্রত্যক্ষতার ব্যাখ্যা
কী ? এ প্রসঙ্গে তাদের ব্যাখ্যাটা আকর্ষণীয় বটে। তাদের মতে, পারমার্থিক
দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণ-প্রমেয় মিথ্যা স্বীকৃত হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ
থেকে তা নয়। যেমন, ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান সত্য,
রজ্জুতে সর্পজ্ঞান মিথ্যা। অর্থাৎ, রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান শেষ পর্যন্ত মিথ্যা
হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথাকথিত অর্থে সত্য। বস্তুত এ কারণেই তাঁরা
স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদের সঙ্গে পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ স্বীকার করেন। অর্থাৎ,
তাঁদের মতে দার্শনিক বিচারে সমস্ত জ্ঞানই অযথার্থ, তবুও ব্যবহারিক জীবনের
দিক থেকে কোনো কোনো জ্ঞানকে তথাকথিত অর্থে যথার্থ বলে গ্রহণ করা হয়।
কোনগুলিকে ? যেগুলির প্রবৃত্তিসামর্থ্য বর্তমান।
যে-জ্ঞান সমর্থপ্রবৃত্তির জনক তাকে তথাকথিত সত্য বলতে হবে। সমর্থপ্রবৃত্তির অর্থ সফল প্রবৃত্তি। প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তি হলো জ্ঞানের ফল। জ্ঞানের বিষয়টি সংক্রান্ত প্রাপ্তি বা পরিত্যাগের যে প্রবৃত্তি জন্মে, যে-জ্ঞান এই প্রবৃত্তির সাফল্যদানে সক্ষম তাই যথার্থ। যেমন, ব্যবহারিকভাবে রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান যথার্থ কেননা তা রজ্জুপ্রাপ্তি সংক্রান্ত প্রবৃত্তির সফলতা দেয়। এই প্রবৃত্তি-সামর্থ্য অবশ্যই জ্ঞান-বাহ্য, তাই পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ। এই প্রবৃত্তি-সামর্থ্যরূপ জ্ঞানবাহ্য শর্তের দরুনই জ্ঞানের যথার্থতা বা প্রামাণ্যের উৎপত্তি ও প্রতিপত্তি। তাই, স্বতঃ-অপ্রামাণ্য ও পরতঃ-প্রমাণ্যবাদী ভাববাদীদের মতবাদটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হলো, দার্শনিক বিচারে সমস্ত জ্ঞানই জ্ঞান হিসেবে ভ্রান্ত হলেও যে-জ্ঞান কর্মজীবনে কার্যকরি হয় তাকে ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথাকথিত অর্থে যথার্থজ্ঞান বলা হবে।
দার্শনিক
দৃষ্টিভঙ্গিগত বিচারে নিশ্চয়ই এই ভাববাদী সম্প্রদায়ের বিপরীত-ধর্মী
অবস্থানে থাকার কথা বাহ্যবস্তুবাদী সম্প্রদায়কে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন,
প্রথমত, বাহ্যবস্তুবাদী দৃষ্টিতে জ্ঞান যদি স্বতঃ-অপ্রমাণ না হয় তাহলে
তাঁদের মতে জ্ঞানের প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্যের প্রকৃত ব্যাখ্যা কী হবে ?
দ্বিতীয়ত, যে ভ্রমপ্রতীতির দৃষ্টান্ত অবলম্বন করে ভাববাদীরা জ্ঞানমাত্রকেই
মিথ্যা বলে অনুমান করতে চান বাহ্যবস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারই বা
প্রকৃত ব্যাখ্যা কী ?
প্রস্থানগত দিক থেকে ন্যায়-বৈশেষিক ও মীমাংসকরা বাহ্যবস্তুবাদী হলেও উপরিউক্ত প্রশ্ন প্রসঙ্গে উভয়ের সিদ্ধান্ত কিন্তু এক নয়। জ্ঞানের প্রামাণ্য বিষয়ক প্রথম প্রশ্নের উত্তরে মীমাংসকরা প্রস্তাব করেছেন স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ ও পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ, অন্যদিকে ন্যায়-বৈশেষিকরা প্রস্তাব করেছেন পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ ও পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ। আর ভ্রম বিষয়ক দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিক ও ভাট্টমীমাংসকরা প্রস্তাব করেছেন অন্যথাখ্যাতিবাদ, অপরপক্ষে ভাট্টদের সাথে সাদৃশ্য সত্ত্বেও প্রাভাকর-মীমাংসকরা সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তার নাম অখ্যাতিবাদ।
ভ্রম
বিষয়ক প্রশ্নের পর্যালোচনা ভ্রম-জ্ঞান প্রসঙ্গে আলোচিত হবে। প্রথমে
প্রামাণ্য-অপ্রামাণ্য প্রসঙ্গ বিচার করা যাক। এক্ষেত্রে বিষয়টি বোঝার
সুবিধার্থে মীমাংসার সাথে অন্য বাহ্যবস্তুবাদী প্রস্থান ন্যায়-বৈশেষিক মতের
পার্থক্য কোথায় তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রামাণ্য-অপ্রামাণ্য
প্রসঙ্গে মূলত দুটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। একটি জ্ঞানের উৎপত্তি-সংক্রান্ত,
অন্যটি জ্ঞানের প্রকাশ বা জ্ঞপ্তি-সংক্রান্ত।
জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি প্রসঙ্গে ভাট্ট-মীমাংসা মত-
(১) উৎপত্তৌ প্রামাণ্যঃ স্বতঃ। অর্থাৎ, উৎপত্তির দিক থেকে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। কেননা, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রিই প্রমার কারণ-সামগ্রি। যে-কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞান উৎপন্ন হয় সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই প্রমাও উৎপন্ন হয়।
(২) উৎপত্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, উৎপত্তির দিক থেকে অপ্রামাণ্য জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। কেননা, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রির সাথে কোনো দোষ যুক্ত থেকে অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি। অর্থাৎ, অপ্রামাণ্যের উৎসে এই ‘দোষ’ বলে বাড়তি কারণ বর্তমান। অতএব, জ্ঞান-কারণ-বাহ্য কারণে অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি। যেমন, প্রত্যক্ষজ্ঞানের কারণ-সামগ্রি বলতে ইন্দ্রিয়াদি। কিন্তু তাতে যদি কোন দোষ থাকে তাহলে জ্ঞানটি অপ্রমা হয়। উদাহরণস্বরূপ, পিত্তদোষ থাকলে শ্বেত শঙ্খ পীত বলে প্রতীত হয়, চক্ষুদোষ থাকলে একই চন্দ্র দ্বিচন্দ্র বলে প্রতীত হয়। অতএব, অপ্রামাণ্য এই দোষ-জনিত। জ্ঞান-কারণ-সামগ্রিজনিত নয়। সুতরাং উৎপত্তৌ অপ্রামাণ্য পরতঃ।
(৩) জ্ঞপ্তৌ প্রামাণ্যঃ স্বতঃ। অর্থাৎ, জ্ঞপ্তির দিক থেকে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। কেননা, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রিই প্রমাণ-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি। অর্থাৎ, যে কারণ-সামগ্রির ফলে জ্ঞানের জ্ঞপ্তি হয় তারই ফলে প্রমারও জ্ঞপ্তি হয়।
(৪) জ্ঞপ্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, অপ্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়াও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। কেননা, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রির সাথে প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য যুক্ত থেকে অপ্রমার জ্ঞপ্তি হয়। প্রবৃত্তি অসামর্থ্য মানে প্রয়োগক্ষেত্রে অসাফল্য। জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়া এই প্রবৃত্তি অসামর্থ্য নামের বাড়তি কারণটির ফলেই অপ্রমার জ্ঞপ্তি। যেমন, মরীচিকায় যে জল দর্শন হয় তা তৃষ্ণা-নিবারণে অসামর্থ্য। এই অসামর্থ্য থেকেই জানা যায় জ্ঞানটি অপ্রমা বা অযথার্থ।
(১) উৎপত্তৌ প্রামাণ্যঃ স্বতঃ। অর্থাৎ, উৎপত্তির দিক থেকে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। কেননা, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রিই প্রমার কারণ-সামগ্রি। যে-কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞান উৎপন্ন হয় সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই প্রমাও উৎপন্ন হয়।
(২) উৎপত্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, উৎপত্তির দিক থেকে অপ্রামাণ্য জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। কেননা, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রির সাথে কোনো দোষ যুক্ত থেকে অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি। অর্থাৎ, অপ্রামাণ্যের উৎসে এই ‘দোষ’ বলে বাড়তি কারণ বর্তমান। অতএব, জ্ঞান-কারণ-বাহ্য কারণে অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি। যেমন, প্রত্যক্ষজ্ঞানের কারণ-সামগ্রি বলতে ইন্দ্রিয়াদি। কিন্তু তাতে যদি কোন দোষ থাকে তাহলে জ্ঞানটি অপ্রমা হয়। উদাহরণস্বরূপ, পিত্তদোষ থাকলে শ্বেত শঙ্খ পীত বলে প্রতীত হয়, চক্ষুদোষ থাকলে একই চন্দ্র দ্বিচন্দ্র বলে প্রতীত হয়। অতএব, অপ্রামাণ্য এই দোষ-জনিত। জ্ঞান-কারণ-সামগ্রিজনিত নয়। সুতরাং উৎপত্তৌ অপ্রামাণ্য পরতঃ।
(৩) জ্ঞপ্তৌ প্রামাণ্যঃ স্বতঃ। অর্থাৎ, জ্ঞপ্তির দিক থেকে প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। কেননা, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রিই প্রমাণ-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি। অর্থাৎ, যে কারণ-সামগ্রির ফলে জ্ঞানের জ্ঞপ্তি হয় তারই ফলে প্রমারও জ্ঞপ্তি হয়।
(৪) জ্ঞপ্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, অপ্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়াও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। কেননা, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রির সাথে প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য যুক্ত থেকে অপ্রমার জ্ঞপ্তি হয়। প্রবৃত্তি অসামর্থ্য মানে প্রয়োগক্ষেত্রে অসাফল্য। জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়া এই প্রবৃত্তি অসামর্থ্য নামের বাড়তি কারণটির ফলেই অপ্রমার জ্ঞপ্তি। যেমন, মরীচিকায় যে জল দর্শন হয় তা তৃষ্ণা-নিবারণে অসামর্থ্য। এই অসামর্থ্য থেকেই জানা যায় জ্ঞানটি অপ্রমা বা অযথার্থ।
অন্যদিকে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি প্রসঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিক মত হলো-
(১) উৎপত্তৌ প্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, যথার্থ জ্ঞান বা প্রমার উৎপত্তির মূলে জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া স্বতন্ত্র কারণ বর্তমান। কেননা, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রির সাথে প্রয়োজনীয় গুণ যুক্ত থেকে প্রমার উৎপত্তি হয়। এই গুণ একটি বাড়তি কারণ। অতএব, প্রামাণ্যের উৎপত্তির কারণ জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছু। যেমন, শব্দ-জ্ঞানের বেলায় শব্দ-জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়াও বক্তার বিশ্বাসযোগ্যতা নামের অতিরিক্ত গুণটির দরুনই শব্দজ্ঞান প্রমা হয়, শব্দজ্ঞানের প্রামাণ্য উৎপন্ন হয়। অতএব, প্রামাণ্যের উৎপত্তি নির্ভর করছে জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়াও গুণ নামের একটি বাড়তি কারণের উপর।
(২) উৎপত্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, উৎপত্তির দিক থেকে অপ্রামাণ্য জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। এই মত ভাট্ট-মীমাংসক মতের অনুরূপ। অর্থাৎ, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রির সাথে কোনো দোষ যুক্ত থেকে অপ্রমার উৎপত্তি।
(৩) জ্ঞপ্তৌ প্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছুর ফলে প্রমার জ্ঞপ্তি। কেননা, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রির সাথে প্রবৃত্তি-সামর্থ্য যুক্ত থেকে প্রমার জ্ঞপ্তি হয়। প্রবৃত্তি-সামর্থ্য মানে প্রয়োগক্ষেত্রে সাফল্যদানের ক্ষমতা। অর্থাৎ, একটি জ্ঞান প্রমা কিনা তা জানা যায় কী করে ? জ্ঞানটির প্রবৃত্তি-সামর্থ্য আছে কিনা তাই থেকে। জ্ঞানটি সফল-প্রবৃত্তির জনক হলেই তার প্রামাণ্য নিশ্চয় সম্ভব হয়। যেমন, জলে যে-জল দর্শন সেই জ্ঞানকে অবলম্বন করে বাস্তবিকই তৃষ্ণা নিবারণ সম্ভব হয় অর্থাৎ, এই জ্ঞান তৃষ্ণা-নিবারণ নামের সফল-প্রবৃত্তির জনক হয় এবং সেই কারণেই তা যথার্থ বলে জ্ঞাত হয়। তাই প্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়াও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল।
(৪) জ্ঞপ্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, অপ্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়াও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। এই মতও ভাট্টমতের অনুরূপ। অর্থাৎ, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়া প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য নামক বাড়তি কারণের ফলে অপ্রমার জ্ঞপ্তি হয়, জানা যায় জ্ঞানটি অযথার্থ।
(১) উৎপত্তৌ প্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, যথার্থ জ্ঞান বা প্রমার উৎপত্তির মূলে জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া স্বতন্ত্র কারণ বর্তমান। কেননা, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রির সাথে প্রয়োজনীয় গুণ যুক্ত থেকে প্রমার উৎপত্তি হয়। এই গুণ একটি বাড়তি কারণ। অতএব, প্রামাণ্যের উৎপত্তির কারণ জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছু। যেমন, শব্দ-জ্ঞানের বেলায় শব্দ-জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়াও বক্তার বিশ্বাসযোগ্যতা নামের অতিরিক্ত গুণটির দরুনই শব্দজ্ঞান প্রমা হয়, শব্দজ্ঞানের প্রামাণ্য উৎপন্ন হয়। অতএব, প্রামাণ্যের উৎপত্তি নির্ভর করছে জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়াও গুণ নামের একটি বাড়তি কারণের উপর।
(২) উৎপত্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, উৎপত্তির দিক থেকে অপ্রামাণ্য জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। এই মত ভাট্ট-মীমাংসক মতের অনুরূপ। অর্থাৎ, জ্ঞানের কারণ-সামগ্রির সাথে কোনো দোষ যুক্ত থেকে অপ্রমার উৎপত্তি।
(৩) জ্ঞপ্তৌ প্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছুর ফলে প্রমার জ্ঞপ্তি। কেননা, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রির সাথে প্রবৃত্তি-সামর্থ্য যুক্ত থেকে প্রমার জ্ঞপ্তি হয়। প্রবৃত্তি-সামর্থ্য মানে প্রয়োগক্ষেত্রে সাফল্যদানের ক্ষমতা। অর্থাৎ, একটি জ্ঞান প্রমা কিনা তা জানা যায় কী করে ? জ্ঞানটির প্রবৃত্তি-সামর্থ্য আছে কিনা তাই থেকে। জ্ঞানটি সফল-প্রবৃত্তির জনক হলেই তার প্রামাণ্য নিশ্চয় সম্ভব হয়। যেমন, জলে যে-জল দর্শন সেই জ্ঞানকে অবলম্বন করে বাস্তবিকই তৃষ্ণা নিবারণ সম্ভব হয় অর্থাৎ, এই জ্ঞান তৃষ্ণা-নিবারণ নামের সফল-প্রবৃত্তির জনক হয় এবং সেই কারণেই তা যথার্থ বলে জ্ঞাত হয়। তাই প্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়াও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল।
(৪) জ্ঞপ্তৌ অপ্রামাণ্যঃ পরতঃ। অর্থাৎ, অপ্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়াও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। এই মতও ভাট্টমতের অনুরূপ। অর্থাৎ, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়া প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য নামক বাড়তি কারণের ফলে অপ্রমার জ্ঞপ্তি হয়, জানা যায় জ্ঞানটি অযথার্থ।
অতএব
দেখা যায় যে, ভারতীয় দর্শনে ভাববাদী স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদের বিরুদ্ধে দুটি
মত প্রস্তাবিত হয়েছে। এই দুটির মধ্যে মূল পার্থক্য বলতে প্রামাণ্য বিষয়ে
মীমাংসকদের স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ এবং ন্যায়-বৈশেষিকদের পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ।
অন্যদিকে অপ্রামাণ্য বিষয়ে বাহ্যবস্তুবাদী উভয় সম্প্রদায়ই একমত ভাববাদী
দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যুত্তরে। এক্ষেত্রে উভয়ই পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদী।
ভাববাদ অনুসারে অপ্রামাণ্যই স্বতঃসিদ্ধ। তার উত্তরে বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসক এবং ন্যায়-বৈশেষিক উভয়েই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে উৎপত্তি বা জ্ঞপ্তি কোনো দিক থেকেই জ্ঞানকে স্বতঃসিদ্ধভাবে অপ্রমা বলা যায় না। কেননা, তাঁদের মতে, যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয় তার থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি হতে পারে না, তার বদলে ‘দোষ’ নামের একটি বাড়তি কারণ থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি। এবং যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞান-জ্ঞপ্তি ঘটে তা থেকেই অপ্রমা-জ্ঞপ্তি ঘটে না, তার পরিবর্তে ‘প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য’ বলে স্বতন্ত্র কারণ থেকে অপ্রমার জ্ঞপ্তি হয়। তাই এরা পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদী।
কিন্তু
প্রামাণ্য বিচারে বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসক ও ন্যায়-বৈশেষিকের মধ্যে
পার্থক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে মীমাংসকরা স্বতঃ-প্রামান্যবাদী, অন্যদিকে
ন্যায়-বৈশেষিকরা পরতঃ-প্রামাণ্যবাদী। কেন এ পার্থক্য ? এক্ষেত্রে প্রথমে
মীমাংসকদের স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ আলোচনা করা যেতে পারে।
‘এই মতবাদ ভাববাদী স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী। স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ অনুসারে জ্ঞান-মাত্রেই স্বতঃসিদ্ধভাবে মিথ্যা, কিন্তু স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ অনুসারে জ্ঞান-মাত্রেই স্বতঃসিদ্ধভাবে সত্য। যে কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই যদি প্রমার উৎপত্তি হয় তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে জ্ঞান মাত্রই প্রমা, সমস্ত জ্ঞানই যথার্থ। শুধু তাই নয়, যে-কারণ-সামগ্রি থেকে জ্ঞানের জ্ঞপ্তি বা অবগতি হয় সেই কারণ-সামগ্রি থেকেই যদি প্রমারও জ্ঞপ্তি হয় তাহলে আরো স্বীকার করতে হবে, জ্ঞানমাত্রই যথার্থ বলে জ্ঞাত। অর্থাৎ সংক্ষেপে, সমস্ত জ্ঞানই জ্ঞান হিসেবে যথার্থ এবং যথার্থ বলেই জ্ঞাত। এ-কথা দাবি করলে অবশ্যই অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা, জ্ঞানমাত্রই যদি প্রমা হয় তাহলে অপ্রমা বলে কিছুই সম্ভব হতে পারে না; অথচ শুক্তিরজত, রজ্জুসর্প, মায়া-মরীচিকা প্রভৃতির জ্ঞানকে কি অপ্রমা বলা হবে না ? মীমাংসকেরা কি প্রমা ও অপ্রমার মধ্যে কোনো পার্থক্য স্বীকার করবেন না ? তাঁরা নিজেরাই যে পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ প্রস্তাব করেছেন সেখানে অপ্রামাণ্যের প্রকৃত তাৎপর্য কী ?’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: ভারতীয় দর্শন, পৃ-৩০৬)
এবার দেখা যাক, মীমাংসকরা কীভাবে স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চান।
এক্ষেত্রে
প্রাভাকর মীমাংসকরা বলেন, প্রমা মানেই বিষয়ের অনুভূতি এবং জ্ঞান হলো অথচ
বিষয়ের অনুভূতি হলো না এ-কথা অসম্ভব বলেই স্বীকার করতে হবে। তাই তাঁরা
বলেন, জ্ঞান মানেই অর্থ প্রকাশ বা বিষয় প্রকাশ; অতএব বিষয়-প্রকাশক বলেই
জ্ঞান স্বভাবতই প্রমা, নিজগুণেই প্রমা। অতএব স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ।
নৈয়ায়িকদের পরতঃ-প্রামাণ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মীমাংসকরা দাবি করেন, স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ পরিহার করলে প্রমার আর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। ন্যায়-মতে প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য উভয়ই পরতঃ, যদি তাই হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে, জ্ঞান এক পদার্থ এবং প্রমা বা অপ্রমা স্বতন্ত্র পদার্থ। অতএব জ্ঞান স্বকীয়ভাবে প্রমাও নয় অপ্রমাও নয়- প্রমা-অপ্রমা নিরপেক্ষ তৃতীয় কিছু। কিন্তু প্রমা-অপ্রমা নিরপেক্ষ জ্ঞান নামের কোনো তৃতীয় পদার্থ সম্ভবই নয়। জ্ঞানকে হয় প্রমা বলতে হবে আর না-হয়তো অপ্রমা বলতে হবে; কিন্তু প্রমাও নয় অপ্রমাও নয়, অথচ জ্ঞান- এ জাতীয় কথা একান্তই অসম্ভব। অথচ প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য উভয়ই পরতঃ বা জ্ঞান-বাহ্য বিবেচিত হলে এ-জাতীয় অসম্ভব কল্পনাই অনিবার্য।
নৈয়ায়িকদের পরতঃ-প্রামাণ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মীমাংসকরা দাবি করেন, স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ পরিহার করলে প্রমার আর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। ন্যায়-মতে প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য উভয়ই পরতঃ, যদি তাই হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে, জ্ঞান এক পদার্থ এবং প্রমা বা অপ্রমা স্বতন্ত্র পদার্থ। অতএব জ্ঞান স্বকীয়ভাবে প্রমাও নয় অপ্রমাও নয়- প্রমা-অপ্রমা নিরপেক্ষ তৃতীয় কিছু। কিন্তু প্রমা-অপ্রমা নিরপেক্ষ জ্ঞান নামের কোনো তৃতীয় পদার্থ সম্ভবই নয়। জ্ঞানকে হয় প্রমা বলতে হবে আর না-হয়তো অপ্রমা বলতে হবে; কিন্তু প্রমাও নয় অপ্রমাও নয়, অথচ জ্ঞান- এ জাতীয় কথা একান্তই অসম্ভব। অথচ প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য উভয়ই পরতঃ বা জ্ঞান-বাহ্য বিবেচিত হলে এ-জাতীয় অসম্ভব কল্পনাই অনিবার্য।
নৈয়ায়িকদের
ইঙ্গিত করে মীমাংসক কুমারিল ভট্ট বলেন, যদি বলা হয় জ্ঞানের কারণ-সামগ্রি
থেকেই প্রমা উৎপন্ন হয় না, তাছাড়া গুণ নামের একটি অতিরিক্ত কারণ থেকে
প্রমার উৎপত্তি- তাহলে জ্ঞানের প্রামাণ্য কখনোই নিশ্চিত হবে না এবং
স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদের আশঙ্কা ঘটবে। কেননা তাহলে একটি জ্ঞান উৎপন্ন হবার পর
গুণ নামের ঐ কারণটির জ্ঞান যথার্থ হলো কিনা তা জানবার জন্য অপেক্ষা করতে
হবে- এইভাবে অনবস্থা-দোষ ঘটবে, আলোচ্য জ্ঞানের যাথার্থ্য কখনোই নিশ্চিত হবে
না।
বস্তুত, পরতঃ-প্রামাণ্যবাদের বিরুদ্ধে মীমাংসকদের অন্যতম প্রধান যুক্তি বলতে এই অনবস্থা-দোষের আশঙ্কা। তাঁদের মতে, স্বতঃ-প্রামাণ্য অস্বীকার করলে বলতে হবে, যে জ্ঞান-কারণ-সামগ্রির জন্য জ্ঞান উৎপন্ন হলো তা-ব্যতীত স্বতন্ত্র কোনো কারণের জন্য জ্ঞানের প্রামাণ্য উৎপন্ন হলো। কিন্তু এই স্বতন্ত্র কারণটির যদি নিজস্ব প্রামাণ্য না থাকে তাহলে তা আলোচ্য জ্ঞানের মথ্যে প্রামাণ্য উৎপাদন করতে পারবে না। কিন্তু এই স্বতন্ত্র কারণটির প্রামাণ্যের ব্যাখ্যা কী হতে পারে ? হয় বলতে হবে তা স্বতঃ-প্রমাণ, আর না হয় তো বলতে হবে অপর কোনো তৃতীয় কারণের ফলে তার প্রামাণ্য উৎপন্ন হয়। যদি তাকে স্বতঃ-প্রমাণ বলে স্বীকার করা হয় তাহলে তো স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদই মানা হলো। আর যদি বলা হয়, অপর কোনো তৃতীয় কারণের ফলে তার প্রামাণ্য উৎপন্ন হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে এই তৃতীয় কারণটির প্রামাণ্য উৎপন্ন হয় কীভাবে ? তৃতীয় কারণটির প্রামাণ্য উৎপাদনের জন্য চতুর্থ কারণ স্বীকার করতে হবে, চতুর্থ কারণের প্রামাণ্য উৎপাদনের জন্য পঞ্চম কারণ স্বীকার করতে হবে- এভাবে কোথাও বিশ্রামের সম্ভাবনা থাকবে না, অর্থাৎ অনবস্থা দোষ ঘটবে।
প্রামাণ্যের
জ্ঞপ্তি প্রসঙ্গেও একই কথা। পরতঃ-প্রামাণ্যবাদী ন্যায়-বৈশেষিকরা বলেন,
একটি জ্ঞান উৎপন্ন হবার পর তার ‘প্রবৃত্তি সামর্থ’র সাহায্যে- অর্থাৎ, তার
সফল-প্রবৃত্তির জনকত্বমূলক অনুমানের সাহায্যে প্রতিপন্ন হয় জ্ঞানটি প্রমা
কিনা। কিন্তু সফল-প্রবৃত্তির জনকত্ব সংক্রান্ত অনুমানটি নিজে প্রমা না হলে
কীভাবে তা আলোচ্য জ্ঞানকে প্রমা প্রতিপন্ন করবে- আলোচ্য জ্ঞানের প্রমাত্ব
অনুমানের হেতু হবে ? অতএব প্রশ্ন ওঠে, এই জ্ঞানটি যে প্রমা তা জানা যাবে
কীভাবে ? তার জ্ঞপ্তি বা প্রতিপত্তির জন্য কোনো তৃতীয় জ্ঞানের আবশ্যক হবে,
আবার ওই তৃতীয় জ্ঞানের প্রমাত্ব প্রতিপত্তির জন্য চতুর্থ জ্ঞানের প্রয়োজন
হবে, এবং এভাবে ঘটবে অনবস্থা-দোষ।
অতএব, মীমাংসকরা দাবি করেন, স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ ছাড়া প্রামাণ্যের উৎপত্তি বা জ্ঞপ্তি কোনো কিছুরই ব্যাখ্যা হয় না। তাই স্বীকার করতেই হবে যে, জ্ঞানমাত্রই স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাণ।
অতএব, মীমাংসকরা দাবি করেন, স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ ছাড়া প্রামাণ্যের উৎপত্তি বা জ্ঞপ্তি কোনো কিছুরই ব্যাখ্যা হয় না। তাই স্বীকার করতেই হবে যে, জ্ঞানমাত্রই স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাণ।
কিন্তু
এখানে যে গুরুতর প্রশ্নটি উঠে, মীমাংসকদের এই স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের
যুক্তির আলোকে তাহলে তাঁদের পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ কী করে গ্রহণ করা যায় ?
বাহ্যবস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়-বৈশেষিকরা ব্যবহারমূলক বা
প্রবৃত্তি-সামর্থ্য-অসামর্থ্যমূলক মান-কে অবলম্বন করেই প্রমা-অপ্রমা
নির্ণয়ের যে আয়োজন করেছেন তাতে দেখা যায়, প্রয়োগ-জীবনে যে জ্ঞানত সফল তাই-ই
প্রমা বলে জ্ঞাত হয়, প্রয়োগ-জীবনে যে জ্ঞান অসফল তাই-ই অপ্রমা বলে জ্ঞাত
হয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় অবশ্যই এ-কথা স্বীকৃত যে, কোনো কোনো জ্ঞান অভ্রান্ত
এবং কোনো কোনো জ্ঞান ভ্রান্ত; অর্থাৎ জ্ঞান দ্বিবিধ- যথার্থ ও অযথার্থ বা
প্রমা ও অপ্রমা। অভিজ্ঞতালব্ধ এই মূল বিষয়টিকে মীমাংসকরা সম্পূর্ণভাবে
অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। তাই, জ্ঞান হিসেবে সমস্ত জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধভাবে
সত্য- এ-কথা প্রমাণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁরা অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমার
একটি ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করতে বাধ্য হয়েছেন, এবং আমরা আগেই দেখেছি, এই
ব্যাখ্যার দিক থেকে তাঁদের সঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের পার্থক্য নেই।
অর্থাৎ, জ্ঞান-কারণ-সামগ্রি অতিরিক্ত দোষ নামের কোনো স্বতন্ত্র কারণ থেকেই
অপ্রমার উৎপত্তি এবং প্রবৃত্তি অসামর্থমূলক বাধ-প্রত্যয়ের সাহায্যেই
অপ্রমার জ্ঞপ্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ন্যায়-বৈশেষিকদের পক্ষে এ-মত পোষণ
করায় কোনো বাধা না থাকলেও স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদী মীমাংসকরা সত্যিই কী অর্থে
তা গ্রহণ করতে পারেন ? জ্ঞান হিসেবে যদি সমস্ত জ্ঞানই স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমা
হয় তাহলে ঐ দোষ-উৎপন্ন এবং প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য প্রতিপন্ন অপ্রমার প্রসঙ্গ
একান্তই কীভাবে সম্ভব হতে পারে ? তার মনে কি এই যে, জ্ঞানমাত্রেই বিষয়ের
প্রকাশ হিসেবে স্বতঃসিদ্ধভাবে সত্য হলেও কোনো কোনো জ্ঞানকে ব্যবহারিক
দৃষ্টিকোণ থেকে এবং তথাকথিত অর্থে অযথার্থ বিবেচনা করা হয় ?
এখানে
খেয়াল রাখতে হবে, ভাববাদীরা যেমন সমস্ত জ্ঞানকেই স্বতঃসিদ্ধভাবে অপ্রমা
বিবেচনা করলেও তথাকথিত অর্থে এবং ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কোনো
জ্ঞানকে যথার্থ বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। মীমাংসকরাও কি সেইভাবেই এবং
সেই অর্থেই অযথার্থ জ্ঞানের ব্যাখ্যা দেবেন ? মনে রাখা দরকার, এই
ব্যবহারিক সত্তার স্বীকৃতি এবং ব্যবহারিক অর্থে তথাকথিত প্রমার স্বীকৃতি
ভাববাদের মূল দুর্বলতারই পরিচায়ক। বাহ্যবস্তু অস্বীকার করলেও এবং
বাহ্যবস্তুর প্রতীতি হিসেবে সমস্ত জ্ঞানকে অপ্রমা বিবেচনা করলেও ভাববাদীরা
এ-কথা হৃদয়ঙ্গম করতে বাধ্য হন যে, ব্যবহারিক জীবন বা বাস্তব কর্মজীবনের
সংঘাতে তাঁদের উক্ত দাবিগুলি অবধারিতভাবেই খন্ডিত হবার আশঙ্কা থাকে; অতএব
তাঁরা ব্যবহারিক সত্তা বা সংবৃত্তি সত্তা বলে কোনো এক প্রকল্পের সাহায্যে
তাঁদের দার্শনিক তত্ত্বকে বিচারমূলক তত্ত্ব হিসেবে ব্যবহারিক কর্মজীবন থেকে
বিচ্ছিন্ন করে রাখবার প্রয়াস করেন। ভাববাদীদের ঐ সংবৃতি সত্তামূলক মতবাদকে
স্বয়ং কুমারিলই বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসকের দৃষ্টিকোণ থেকে কঠোর সমালোচনা
করেছেন। প্রকৃত বাহ্যবস্তুবাদীর পক্ষে এ সমালোচনা অবশ্যই যুক্তিমূলক।
কেননা, ব্যবহারিক জীবন বা বাস্তব প্রয়োগ-জীবনের সাক্ষ্যই ভাববাদের চরম
প্রতিষেধক।
বাহ্যবস্তুকে
অবলম্বন করেই বাস্তব প্রয়োগ-জীবন এবং প্রয়োগ-জীবনের সমস্ত প্রতীতি। অতএব
ভাববাদ বা নিরালম্বনবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারমূলক প্রতীতির সাক্ষ্যই চরম
সাক্ষ্য। ফলে ভাববাদীর পক্ষে এই সাক্ষ্যেও কোনো না কোনো ব্যাখ্যা উদ্ভাবনের
প্রয়োজন হয়; অর্থাৎ একে শুধুমাত্র মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে যাওয়া অত্যন্ত
প্রকটভাবে অসম্ভব বলেই ভাববাদীরা বলেন ব্যবহারসিদ্ধ জগতের প্রকৃত সত্তা না
থাকলেও ব্যবহারিক সত্তা বা সংবৃত্তি সত্তা বর্তমান। কিন্তু মীমাংসক কুমারিল
বলেছেন, এ-কথা প্রতারণামূলক ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি তোমাদের মতে তার প্রকৃত
সত্তা না থাকে তাহলে সরাসরি বলো যে তা মিথ্যাই; কিন্তু ‘লালা’ না বলে
‘বকত্রাসব’ বলার মতো যাকে তোমরা আসলে মিথ্যা বলতে চাও তারই সংবৃত্তি সত্য
নাম দেওয়া প্রতারণা-প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ভাববাদীদের পক্ষে
এ-জাতীয় একটি কৌশল অপরিহার্য। না হলে প্রকট অসম্ভাবনার সম্মুখীন হতে হবে।
তাই
একইভাবে বাহ্যবস্তুবাদী হয়েও মীমাংসকরা নৈয়ায়িকদের পরতঃ-অপ্রামাণ্যবাদ
স্বীকার করেও স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ বলে যে বিকল্প মতবাদ প্রস্তাব করেছেন তাও
প্রকৃতপক্ষে ভাববাদী দুর্বলতারই পরিচায়ক। কেননা এই স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ
ব্যবহারিক জীবনের একটি মূল সাক্ষ্যকে অস্বীকার করেই অগ্রসর হতে চায়-
অস্বীকার করতে চায় ব্যবহারসিদ্ধ প্রমা ও অপ্রমার মধ্যে বাস্তব ও প্রকট
পার্থক্য। ব্যবহারিক জীবনের সাক্ষ্য অবশ্যই এই যে, জলে জলজ্ঞান প্রমা বা
যথার্থ-জ্ঞান বলে প্রতিপন্ন, কেননা তা বাস্তব তৃষ্ণা নিবারণের জনক; কিন্তু
মরীচিকায় জল-জ্ঞান অপ্রমা বা অযথার্থ-জ্ঞান, কেননা তা বাস্তব
তৃষ্ণানিবারণের জনক হতে পারে না। ব্যবহারসিদ্ধ এই পার্থক্য অস্বীকার করে
মীমাংসকরা দাবি করেছেন জ্ঞানমাত্রেই প্রমা, কেননা প্রমাত্বই স্বতঃসিদ্ধ।
তাহলে ব্যবহারসিদ্ধ অপ্রমার কী ব্যাখ্যা হবে ? মীমাংসকরা এ-কথা অস্বীকার
করতে পারেন নি যে প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য থেকেই জানা যায় মরীচিকায় জলজ্ঞান
অবশ্যই অপ্রমা; তবুও স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের খাতিরে তাঁরা বলতে বাধ্য হয়েছেন
যে, এই অপ্রমা আসলে তথাকথিত অর্থে অপ্রমা, জ্ঞান হিসেবে অপ্রমা নয়, কেননা
জ্ঞান হিসেবে সমস্ত জ্ঞানই প্রমা, কিন্তু তবুও নেহাত ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ
থেকে অপ্রমা। ভাববাদীরা যেমন জ্ঞানমাত্রকেই স্বতঃসিদ্ধভাবে অপ্রমা বিবেচনা
করলেও নেহাত ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথাকথিত অর্থে
প্রবৃত্তি-সামর্থ্যদায়ক জ্ঞানকে প্রমা বলে গ্রহণ করতে চান। অর্থাৎ
স্বতঃ-অপ্রামাণ্যবাদী ভাববাদ যে অর্থে খুঁজেছেন প্রমার ব্যাখ্যা,
স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদী মীমাংসকরা অনুরূপ অর্থে খুঁজেছেন অপ্রমার ব্যাখ্যা।
প্রশ্ন
হলো, বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসকদের ভাববাদ-বিরোধী অবস্থান থেকে এই
স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের ব্যাখ্যা কতোটা গ্রহণযোগ্য ? অনুমান হয় ভাববাদ
বিরোধিতা ছাড়াও মীমাংসকদের এই স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের পেছনে অন্য কিছুর তাগিদ
রয়েছে। কিসের তাগিদ ? বাহ্যবস্তুবাদী হয়েও মীমাংসকরা কেন ন্যায়-বৈশেষিকদের
মতো প্রকৃত বাহ্যবস্তুবাদ-সঙ্গত পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ গ্রহণ করতে সম্মত না
হয়ে এর বিরোধিতা করেছেন ? দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে-
‘এ-প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মীমাংসার মূল প্রতিক্রিয়াশীল দিকটির মধ্যেই। পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ গ্রহণ করলে বেদের প্রামাণ্য ক্ষুণ্ন হবার আশঙ্কা থাকে; অতএব তাঁদের স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ। মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা যেমন বলছেন, মীমাংসকেরা এই স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের উপর যে এতোখানি গুরুত্ব আরোপ করেন তার কারণ তা না হলে বেদ-জ্ঞান প্রামাণ্য হবে না; শব্দজ্ঞান যদি স্বতঃ-প্রমাণ না হয় তাহলে তার প্রামাণ্য বক্তার নির্ভরযোগ্যতার উপর নির্ভরশীল হবে এবং মীমাংসা-মতে বেদের কোনো বক্তা বা স্রষ্টা নেই বলেই এই বেদজ্ঞান প্রামাণ্য হবে না।
প্রমার পরতঃ উৎপত্তি সংক্রান্ত ন্যায়-বৈশেষিকমতটি বিচার করলে মীমাংসকদের এই আশঙ্কার তাৎপর্য বোঝা যাবে। ন্যায়বৈশেষিকেরা বলেন, জ্ঞান-কারণ-সামগ্রী ছাড়াও গুণ বলে অতিরিক্ত কারণ থেকে প্রমার উৎপত্তি। দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা বিশেষত শব্দজ্ঞানের কথাই উল্লেখ করেন। শব্দজ্ঞান উৎপত্তির কারণ-সামগ্রী ছাড়াও বক্তার নির্ভরযোগ্যতা গুণ বলে অতিরিক্ত কারণ থেকেই শব্দ-প্রমার উৎপত্তি। মীমাংসকদের পক্ষে একথা মানা অসম্ভব। কেননা প্রকৃত শব্দ-জ্ঞান বলতে বেদ-জ্ঞান। তার প্রামাণ্য-উৎপত্তির মূলে বক্তার নির্ভরযোগ্যতা নামক অতিরিক্ত কারণ স্বীকার করতে হলে শুধু যে বেদ পৌরুষেয় হয় তাহাই নয়, বেদের প্রামাণ্যও শেষ পর্যন্ত বেদ-রচনাকারীর উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য। অতএব বেদের অপৌরুষেয়ত্ব এবং অভ্রান্তত্ব ক্ষুণ্ন হয়। পক্ষান্তরে স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের দিক থেকে এ আশঙ্কার সম্ভাবনা নেই। কেননা শব্দ জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রমার উৎপত্তি বক্তার নির্ভরযোগ্যতা নামক অতিরিক্ত কোনো কারণের উপর নির্ভরশীল হয় না।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃ-৩১১)
‘এ-প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মীমাংসার মূল প্রতিক্রিয়াশীল দিকটির মধ্যেই। পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ গ্রহণ করলে বেদের প্রামাণ্য ক্ষুণ্ন হবার আশঙ্কা থাকে; অতএব তাঁদের স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ। মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা যেমন বলছেন, মীমাংসকেরা এই স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের উপর যে এতোখানি গুরুত্ব আরোপ করেন তার কারণ তা না হলে বেদ-জ্ঞান প্রামাণ্য হবে না; শব্দজ্ঞান যদি স্বতঃ-প্রমাণ না হয় তাহলে তার প্রামাণ্য বক্তার নির্ভরযোগ্যতার উপর নির্ভরশীল হবে এবং মীমাংসা-মতে বেদের কোনো বক্তা বা স্রষ্টা নেই বলেই এই বেদজ্ঞান প্রামাণ্য হবে না।
প্রমার পরতঃ উৎপত্তি সংক্রান্ত ন্যায়-বৈশেষিকমতটি বিচার করলে মীমাংসকদের এই আশঙ্কার তাৎপর্য বোঝা যাবে। ন্যায়বৈশেষিকেরা বলেন, জ্ঞান-কারণ-সামগ্রী ছাড়াও গুণ বলে অতিরিক্ত কারণ থেকে প্রমার উৎপত্তি। দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা বিশেষত শব্দজ্ঞানের কথাই উল্লেখ করেন। শব্দজ্ঞান উৎপত্তির কারণ-সামগ্রী ছাড়াও বক্তার নির্ভরযোগ্যতা গুণ বলে অতিরিক্ত কারণ থেকেই শব্দ-প্রমার উৎপত্তি। মীমাংসকদের পক্ষে একথা মানা অসম্ভব। কেননা প্রকৃত শব্দ-জ্ঞান বলতে বেদ-জ্ঞান। তার প্রামাণ্য-উৎপত্তির মূলে বক্তার নির্ভরযোগ্যতা নামক অতিরিক্ত কারণ স্বীকার করতে হলে শুধু যে বেদ পৌরুষেয় হয় তাহাই নয়, বেদের প্রামাণ্যও শেষ পর্যন্ত বেদ-রচনাকারীর উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য। অতএব বেদের অপৌরুষেয়ত্ব এবং অভ্রান্তত্ব ক্ষুণ্ন হয়। পক্ষান্তরে স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের দিক থেকে এ আশঙ্কার সম্ভাবনা নেই। কেননা শব্দ জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রমার উৎপত্তি বক্তার নির্ভরযোগ্যতা নামক অতিরিক্ত কোনো কারণের উপর নির্ভরশীল হয় না।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃ-৩১১)
অতএব
দেখা যায়, মীমাংসকেরা যে সাধারণভাবে সমস্ত জ্ঞানকেই স্বতঃ-প্রমাণ বলে
প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন তার একটি মূল কারণ হলো বেদের প্রামাণ্য সংরক্ষণের
উদ্দেশ্য।
কিন্তু এখানে যে অন্য প্রশ্নটি ওঠে তা হলো, পরতঃ-প্রামাণ্যবাদী ন্যায়-বৈশেষিকরা শব্দজ্ঞানের নজির থেকে যে প্রমাণ করতে চান, সাধারণভাবে সমস্ত প্রকার প্রমাণের ক্ষেত্রেই প্রমা-উৎপত্তির মূলে জ্ঞান-কারণ-সামগ্রি ছাড়াও ‘গুণ’ নামের কোনো এক অতিরিক্ত কারণ বর্তমান- এ-কথাই বা কতখানি যুক্তিসঙ্গত হতে পারে ? শব্দজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বাক্যকে গুণ হিসেবে যুক্ত করে’ কথাটি যতো সহজে প্রতিপন্ন করা যায় প্রত্যক্ষ-অনুমানাদি অন্যান্য জ্ঞানের দৃষ্টান্তে তা সম্ভব নয়। যেমন, প্রত্যক্ষজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়াদি জ্ঞান-কারণ-সামগ্রি ছাড়াও স্বতন্ত্র কোন্ ‘গুণ’ থেকে প্রমার উৎপত্তি ব্যাখ্যাত হতে পারে ? উত্তরে ইন্দ্রিয়াদির দোষাভাবকে উক্ত ‘গুণ’ বললে সমস্যার সমাধান হয় না। কেননা, দোষাভাব অভাব-পদার্থ; অভাবপদার্থ থেকে প্রমা নামের ভাবপদার্থের উৎপত্তি কী করে সম্ভব হবে ? অতএব দেখা যায়, উৎপত্তির দিক থেকে সামগ্রিকভাবে- অর্থাৎ, সমস্ত জ্ঞানের দৃষ্টান্তে ন্যায়-বৈশেষিকেরা যেভাবে পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ প্রস্তাব করেছেন সে-সম্বন্ধে সংশয় হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, জ্ঞপ্তির দিক থেকেও তাঁদের পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ সংশয়-সাপেক্ষ। বস্তুত, প্রবৃত্তি-সামর্থ্যকে প্রমা জ্ঞপ্তির কারণ নির্ণয় করে ন্যায়-বৈশেষিকরা ভাববাদ-বিরোধী ঐতিহ্যে অবদান রেখেছেন।
মজার
বিষয় হলো, উৎপত্তির দিক থেকে পরতঃ-প্রামাণ্যবাদী ন্যায়-বৈশেষিকদের
উপরিউক্ত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রামাণ্য প্রতিপন্নে দৃষ্টান্তহীনতার উদ্ভূত
দুর্বলতার বিরুদ্ধে মীমাংসকরা এমন কোনো আপত্তি তোলেননি যে শব্দজ্ঞানের
দৃষ্টান্তে প্রমার উৎপত্তি পরতঃ হলেও সামগ্রিকভাবে সমস্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে
তা সম্ভব নয়। কেননা, অন্তত শব্দজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রমার উৎপত্তি পরতঃ হতে
পারে- এ জাতীয় কোনো সম্ভাবনা স্বীকার করাই মীমাংসকদের পক্ষে একান্ত অসম্ভব।
এই সম্ভাবনা অনুসারে বেদের প্রামাণ্য ক্ষুণ্ন হবে। বস্তুত বেদ অর্থে
শব্দ-জ্ঞানের প্রামাণ্য সম্পূর্ণ সংশয়াতীত করবার উৎসাহেই তাঁরা
সামগ্রিকভাবে সমস্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রেই স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে
চেয়েছেন। আর এ কারণেই মীমাংসকরা সামগ্রিকভাবে ন্যায়-বৈশেষিক প্রতিপাদ্য
পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ খন্ডন করবার আয়োজন করেছেন। তাঁদের এই খন্ডনের- বিশেষত
জ্ঞপ্তির দিক থেকে পরতঃ-প্রামাণ্যবাদ খন্ডনের মুল যুক্তি বলতে পূর্বোক্ত
অনবস্থা-দোষের আশঙ্কা। এটি হলো অনুমান-প্রমাণমূলক যুক্তি।
মীমাংসকদের এই যুক্তি হলো, প্রবৃত্তি-সামর্থমূলক কোনো একটি দ্বিতীয় জ্ঞান যদি প্রথম জ্ঞানের প্রামাণ্য-জ্ঞপ্তির কারণ হয় তাহলে এই দ্বিতীয় জ্ঞানটির প্রামাণ্য-জ্ঞপ্তির কারণ হিসেবে অপর কোনো তৃতীয় জ্ঞানের কথা কল্পনা করতে হবে, এবং তৃতীয় জ্ঞানটির প্রামাণ্য-জ্ঞপ্তির কারণ হিসেবে একটি চতুর্থ জ্ঞানের কথা কল্পনা করতে হবে- এবং এইভাবে কোনোই বিশ্রামের সম্ভাবনা থাকবে না, অনবস্থা-দোষ ঘটবে।
কিন্তু
পরতঃ-প্রামাণ্যবাদী ন্যায়-বৈশেষিকদের পক্ষ থেকে এ যুক্তির উত্তর খুব একটা
কঠিন নয়। তাঁরা বলেন, সমস্ত জ্ঞানেরই প্রমাত্ব প্রতিপত্তির প্রয়োজন হয় একথা
স্বীকারযোগ্য নয়। কোনো একটি জ্ঞানের সম্বন্ধে সংশয় জাগলে পরই সেই জ্ঞানটির
প্রমাত্ব নির্ণয় করবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে-জ্ঞান সম্বন্ধে সংশয় জাগেনি-
অর্থাৎ যে-জ্ঞানের সংশয়াভাব বর্তমান- তার প্রমাত্ব প্রতিপন্ন করবারই
প্রয়োজন হয় না, অতএব তার প্রমাত্ব প্রতিপন্ন করবার জন্য আরো একটি জ্ঞানের
প্রয়োজন হয় না। জল-দর্শনের পর যদি জল-জ্ঞান সংক্রান্ত সংশয় জাগে তাহলেই
প্রবৃত্তি-সামর্থ্যমূলক আরেকটি জ্ঞানের সাহায্যে এই প্রমাত্ব অনুমান করবার
প্রশ্ন ওঠে; স্পর্শ করে বা পান করে দেখা দরকার হয় জল-জ্ঞানটি প্রমা কিনা।
কিন্তু স্পর্শ করে বা পান করে যদি জানা যায় প্রকৃত জলেই জল-জ্ঞান হয়েছে,
তাহলে এই প্রবৃত্তি-সামর্থ্যমূলক জ্ঞানটির প্রমাত্ব প্রতিপন্ন করবার প্রশ্ন
ওঠে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ যদি এই প্রবৃত্তি সামর্থ্যমূলক জ্ঞানটি
সম্বন্ধেও সংশয় প্রকাশ করেন তাহলে বলা হবে এ জাতীয় সংশয় অর্থহীন, অতএব
পরিত্যজ্য। বস্তুত, লোকব্যবহারমূলক বহু জ্ঞানেরই সংশয়াভাব বর্তমান; অতএব
সেগুলির প্রমাত্ব প্রতিপত্তির জন্য স্বতন্ত্র জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, আর তাই
অনবস্থার আশঙ্কাও নেই।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : অনুপলব্ধি প্রমাণ] [*] [পরের পর্ব : ভ্রম-জ্ঞান]
…
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : অনুপলব্ধি প্রমাণ] [*] [পরের পর্ব : ভ্রম-জ্ঞান]
…
No comments:
Post a Comment