.
মীমাংসাদর্শনে প্রাভাকর-সম্প্রদায় অখ্যাতিবাদ প্রস্তাব করেন এবং ভাট্ট-সম্প্রদায় ন্যায়-বৈশেষিকদের মতো অন্যথাখ্যাতিবাদ স্বীকার করেন, যদিও নৈয়ায়িকদের সাথে ভাট্টমতের ব্যাখ্যায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বলাবাহুল্য, ভারতীয় দর্শনে ‘খ্যাতি’ শব্দের অর্থ হলো ভ্রমজ্ঞান।
এই মতে, ভ্রমের কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যার ফলেই ব্রহ্মে জগৎভ্রম, শুক্তিতে রজতভ্রম। যে-অবিদ্যার ফলে ব্রহ্মে জগৎভ্রম তার নাম মূলাবিদ্যা, যে-অবিদ্যার ফলে শুক্তিতে রজতভ্রম তার নাম তুলাবিদ্যা। মূলাবিদ্যা অনাদি এবং সমগ্র লোকব্যবহার এই মূলাবিদ্যামূলক। ব্রহ্মজ্ঞান বা পারমার্থিক জ্ঞানের উদয় পর্যন্ত তা বিনষ্ট হয় না। তুলাবিদ্যা সাদি অর্থাৎ যার শুরু আছে, এবং সংসার দশাতেই তার বিনাশ হয়। অবিদ্যার দুটি কাজ- আবরণ ও বিক্ষেপ। প্রথমত, অবিদ্যার ফলে ভ্রমের অধিষ্ঠান আবৃত হয়- অর্থাৎ ব্রহ্মে জগৎভ্রমের দৃষ্টান্তে ব্রহ্মের স্বরূপ আবৃত হয়, শুক্তিতে রজতভ্রমের দৃষ্টান্তে রজতের স্বরূপ আবৃত হয়। দ্বিতীয়ত, অবিদ্যার ফলে মিথ্যা পদার্থ সৃষ্টি হয় এবং আবৃত অধিষ্ঠানটির উপর তা বিক্ষিপ্ত হয়- অর্থাৎ ব্রহ্মে জগৎজ্ঞানের দৃষ্টান্তে মিথ্য জগৎ সৃষ্ট হয় এবং তা ব্রহ্মের উপর বিক্ষিপ্ত হয়, শুক্তিতে রজতজ্ঞানের দৃষ্টান্তে মিথ্যা রজত সৃষ্ট হয় এবং তা শুক্তির উপর বিক্ষিপ্ত হয়। মূলাবিদ্যা উৎপন্ন যে মিথ্যা পদার্থ তাকে বলা হয়েছে ব্যবহারিক, কেননা, সমস্ত লোকব্যবহারের বিষয় এই মিথ্যা পদার্থ। তুলাবিদ্যা উৎপন্ন যে মিথ্যা তাকে বলা হয়েছে প্রাতিভাসিক, কেননা, তা লোকব্যবহারের বিষয় হতে পারে না অতএব তা ব্যবহারিক নয়, তবুও তা প্রতিভাত হয় অতএব তা প্রাতিভাসিক। ব্রহ্মে জগৎভ্রম ব্যবহারিক, শুক্তিতে রজতভ্রম প্রাতিভাসিক। অদ্বৈতমতে, উভয় দৃষ্টান্তেই অজ্ঞান বা অবিদ্যা-উৎপন্ন মিথ্যা পদার্থটি অনির্বচনীয়, কেননা তাকে না বলা যায় সৎ, না অসৎ। শুক্তিতে রজতভ্রমের দৃষ্টান্তে সাময়িক প্রাতিভাসিক রজত উৎপন্ন ও জ্ঞাত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই রজত তিনকালেই থাকে না, তাই তা সৎ নয়। তবুও বন্ধ্যাপুত্রের মতো তাকে অলীক বা অসৎ বলা যায় না, কেননা যা অলীক বা অসৎ তা প্রতিভাত হতে পারে না, অথচ প্রতিভাসিক জগত প্রতিভাত হয়। সৎও নয়, অসৎও নয়, অতএব অনির্বচনীয়।
শুক্তিতে রজতভ্রমের স্থলে অজ্ঞানবশত সেই শুক্তিতে মিথ্যা রজতের সৃষ্টি হয়। মিথ্যা বলতে অনির্বচনীয়। অর্থাৎ ঐ রজতকে সৎও বলা যায় না অসৎও বলা যায় না, সৎ বা অসৎ বলে তার নির্বাচন করা যায় না; সুতরাং তা অনির্বচনীয় বা মিথ্যা। এই স্থলে সেই অনির্বচনীয় রজতেরই ভ্রম হয়। এরই নাম ‘অনির্বচনীয়খ্যাতি’। এভাবে তাঁদের মতে সর্বত্রই ভ্রমস্থলে অনির্বচনীয় বিষয়েরই উৎপত্তি ও ভ্রম হয়। সুতরাং তাঁদের মতে সর্বত্র ভ্রমের নাম ‘অনির্বচনীয়খ্যাতি’। এ প্রেক্ষিতে তাঁদের মূল যুক্তি এই যে, শুক্তিতে রজতভ্রম ও রজ্জুতে সর্পভ্রম প্রভৃতি স্থলে রজত ও সর্প প্রভৃতি সে স্থানে একেবারে অসৎ হলে তার ভ্রম হতে পারে না। বিশেষত বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ ব্যতীত প্রত্যক্ষ জন্মে না। শুক্তিতে রজতভ্রম প্রভৃতি প্রত্যক্ষাত্মক ভ্রম। সুতরাং তাতে রজতাদি বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষ অবশ্যই আবশ্যক। অতএব এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে, ঐ স্থলে রজতাদি মিথ্যা বিষয়ের উৎপত্তি হয়। তার সাথেই ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ জন্য ঐরূপ ভ্রমাত্মক প্রত্যক্ষ জন্মে।
এইভাবে ভাববাদীরা দাবি করেছেন, আমাদের দৈনন্দিন ভ্রমজ্ঞানের দৃষ্টান্তে দেখা যায়, যা মিথ্যা তারই প্রতীতি হচ্ছে। তাহলে মিথ্যা বিষয়ের প্রতীতি ঘটে। এবং এ থেকেই ভাববাদীরা সরাসরি প্রমাণ করতে চান, অতএব সমস্ত প্রতীতিই মিথ্যা বিষয়ের প্রতীতি- বহির্জগৎ হিসেবে জগতের প্রতীতিও মিথ্যা বিষয়ের প্রতীতি, পরিদৃশ্যমান বহির্জগৎ মিথ্যা।
শুক্তিতে ‘ইদং রজতং’ বা ‘ইহা রজত’- এ জাতীয় তথাকথিত ভ্রমের দৃষ্টান্তে সম্মুখস্থ শুক্তির ‘ইদং’ বা ‘ইহা’ অর্থে প্রত্যক্ষজ্ঞান হয়। পরে, তার সঙ্গে রজতের সাদৃশ্যজন্য পূর্বদৃষ্ট রজতের স্মরণাত্মক জ্ঞান হয়। প্রত্যক্ষমূলক ‘ইদং’ জ্ঞানটি সামান্যজ্ঞান, স্মরণমূলক ‘রজত’ জ্ঞানটি বিশেষ জ্ঞান। এই গ্রহণাত্মক ও স্মরণাত্মক দ্বিবিধ জ্ঞানের কোনোটির বিষয়ই মিথ্যা নয়। তবুও শুক্তিতে ‘ইহা রজত’ বা ‘ইদং রজতং’ জ্ঞানকে যে ভ্রম বলা হয় তার কারণ উক্ত দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যমূলক জ্ঞানের অভাব। অর্থাৎ, ভ্রমকে মিথ্যাবিষয়ক কোনো জ্ঞান বলা যায় না; ভ্রম জ্ঞানই নয়, বরং তার বদলে দ্বিবিধ যথার্থবিষয়ক জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যজ্ঞানের অভাব। সম্মুখস্থ শুক্তিকে ‘ইদং’ বা ‘ইহা’ বলে যে প্রত্যক্ষজ্ঞান তার বিষয় অবশ্যই মিথ্যা নয়, এবং পূর্বদৃষ্ট রজতের যে স্মরণাত্মক জ্ঞান তাও মিথ্যা বিষয়ক নয়। এই জ্ঞানদ্বয়ই যথার্থ। সুতরাং ঐ স্থলে ভ্রমজ্ঞান জন্মে না। অবশ্য ‘ইদং’ পদার্থকেই রজত বলে প্রত্যক্ষ হলে এরূপ একটি বিশিষ্ট জ্ঞানকে ভ্রম বলে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু প্রাভাকরমতে, উক্ত স্থলে ঐরূপ একটি বিশিষ্ট জ্ঞান জন্মেই না। এভাবে সর্বত্রই ঐরূপ স্থলে উক্তরূপ জ্ঞানদ্বয়ই জন্মে। সুতরাং জগতে ভ্রমজ্ঞান নাই। তাহলে শুক্তিতে ‘ইদং রজতং’-এর প্রকৃত ব্যাখ্যা কী ? ইদং-পদার্থ শুক্তির প্রত্যক্ষ এবং পূর্বদৃষ্ট পদার্থ রজতের স্মরণ- উভয়ের মধ্যে ভেদের অজ্ঞান। অর্থাৎ শুক্তিরজতের জ্ঞানে ‘ইহা রজত নয়’ এই জ্ঞানের দ্বারা রজতের বোধ হয় না। এই যে ভেদজ্ঞানের অভাব, তা থেকে বোঝা যায় উক্ত দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে ভেদটি ‘খ্যাত’ ছিলো না বলেই ভ্রম। তাই ভ্রমের নাম ‘অখ্যাতি’।
কিন্তু, বিরুদ্ধবাদীদের মতে, প্রভাকরের এ-যুক্তি স্পষ্টতই কষ্টকল্পনার পরিচায়ক। দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে ভেদের অজ্ঞান কীভাবে প্রবৃত্তির জনক হতে পারে ? বস্তুত, একমাত্র বিশিষ্ট জ্ঞানই প্রবৃত্তির কারণ হতে পারে। শুক্তিতে রজতভ্রম হলে কোনো ব্যক্তি যদি ঐ রজতগ্রহণে প্রবৃত্ত হয় তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তার ‘ইহা রজত’ বলে একটি বিশিষ্ট জ্ঞানই ঘটেছিলো। এ-কথা অস্বীকার করে প্রাভাকররা যে ভাবে ভ্রমকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন তা শুধু তাঁদের অভিনব কল্পনাবলেরই পরিচায়ক।
অবশ্যই বিশিষ্ট জ্ঞান হিসেবে ভ্রমকে অস্বীকার করে প্রভাকর বাহ্যবস্তুবাদী হিসেবে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এটা ঠিক যে, প্রভাকরমতে এই তথাকথিত ভ্রমের মূলে দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে একটিও মিথ্যাবিষয়ক নয়- শুক্তিতে ‘ইদং রজতং’-জ্ঞানে প্রত্যক্ষমূলক সামান্যজ্ঞান ‘ইদং’ও মিথ্যা নয়, স্মরণমূলক বিশেষজ্ঞান ‘রজত’ও মিথ্যা বিষয়ক নয়। উভয় বিষয়ই সৎপদার্থ এবং বাহ্যপদার্থ। কিন্তু প্রভাকর এই দুটি সৎপদার্থের জ্ঞানকে একই বা বিশিষ্ট ভ্রমজ্ঞানের দ্বিবিধ উপাদান বলে স্বীকার করেন নি; তার পরিবর্তে দুটি সৎপদার্থের জ্ঞানকে দুটি পৃথক জ্ঞান প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন এবং সে-দুটি জ্ঞানের ভেদমূলক জ্ঞানের অভাবকেই ভ্রম আখ্যা দিয়ে ভ্রমকেই অস্বীকার করবার আয়োজন করেছেন।
অতএব নৈয়ায়িকদের পক্ষে অসৎখ্যাতিবাদ বা আত্মখ্যাতিবাদ মানবার প্রশ্ন ওঠে না; কেননা তত্ত্ব ও প্রধানের কোনোটিই না অসৎ না বিজ্ঞান। এবং বৈদান্তিকদের সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার করা যায় না যে, শুক্তিরজতের দৃষ্টান্তে সাময়িকভাবে কোনো এক অনির্বচনীয় মিথ্যা রজত উৎপন্ন হয়। কারণ, মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের মতে- ‘ঐ স্থলে রজতের উপাদান-কারণাদি না থাকায় মিথ্যা রজতের উৎপত্তি হইতে পারে না। অদ্বৈতবাদী বৈদান্তিক সম্প্রদায় যে মিথ্যা অজ্ঞানকে ঐ স্থলে রজতের উপাদান-কারণ বলিয়াছেন, উহা চক্ষুরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য রজতের সজাতীয় দ্রব্যপদার্থ না হওয়ায় রজতের উপাদান-কারণ হইতে পারে না। পরন্তু ঐরূপ অজ্ঞান বিষয়ে কোনো প্রমাণও নাই, ইহাই ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়ের চরম বক্তব্য।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৩)
অর্থাৎ, সামনে শুক্তি আছে। সেই শুক্তির প্রত্যক্ষ হলো, কিন্তু শুক্তি হিসেবে নয়, শুধু ‘ইদং’ হিসেবে তার সামান্য জ্ঞান হলো। এবং দেশান্তরে ও কালান্তরে রজত আছে, যথা হট্টস্থ রজত। শুক্তিতে শুক্তি হিসেবে না দেখে সেই শুক্তিতে ঐ হট্টস্থ রজত দৃষ্ট হলো- শুক্তি ‘ইদং’রূপ জ্ঞান এবং হট্টস্থ রজতের জ্ঞান দুই মিলে একটি বিশিষ্ট জ্ঞান হয়ে দাঁড়ালো, ইদং-রজতের প্রতীতি ঘটলো।
এর উত্তরে প্রাচীন ন্যায়-বৈশেষিকদের পক্ষে এর সুস্পষ্ট জবাব না থাকলেও নব্যনৈয়ায়িক গঙ্গেশ উক্ত প্রশ্নের একটি সুস্পষ্ট উত্তর দেয়ার প্রয়াস করেছেন। নব্যন্যায়মতে, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষ দ্বিবিধ হতে পারে। অতএব প্রত্যক্ষও দ্বিবিধ- লৌকিক বা সাধারণ প্রত্যক্ষ এবং অলৌকিক বা অসাধারণ প্রত্যক্ষ। লৌকিক সন্নিকর্ষের ফলে লৌকিক প্রত্যক্ষ এবং অলৌকিক সন্নিকর্ষের ফলে অলৌকিক প্রত্যক্ষ। অলৌকিক সন্নিকর্ষ আবার ত্রিবিধ হতে পারে- (১) সামান্যলক্ষণ, (২) জ্ঞানলক্ষণ এবং (৩) যোগজ। এর মধ্যে দ্বিতীয়টির- অর্থাৎ জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষের সাহায্যে সম্মুখস্থ শুক্তিতে হট্টস্থ রজতের প্রত্যক্ষ হয়, অর্থাৎ ভ্রমপ্রত্যক্ষ হয়। এ জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ কী ? অতীতে একটি বিষয়ের জ্ঞান হয়েছিলো; বর্তমানে তার স্মরণাত্মক জ্ঞান ঘটছে এবং এই স্মরণাত্মক জ্ঞানই বর্তমানে উক্ত অতীতে জ্ঞাত বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষের কারণ হয়। যেমন, সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষের জন্য পূর্বানুভূত রজতের স্মরণাত্মক জ্ঞান উদ্বুদ্ধ হলো এবং এই স্মরণাত্মক জ্ঞানই বর্তমানে সেই রজতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের কোনো এক অসাধারণ বা অলৌকিক সন্নিকর্ষ বা যোগাযোগ সাধন করলো। এর ব্যাখ্যায় মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ বলেন-
‘ঐ স্থলে শুক্তিতে রজতের যে ভ্রমাত্মক প্রত্যক্ষ জন্মে, উহা একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ। সাদৃশ্যাদি জ্ঞানবশত ঐ স্থলে প্রথমে পূর্বানুভূত রজতের স্মরণাত্মক যে জ্ঞান জন্মে, উহাই ঐ প্রত্যক্ষের কারণ অলৌকিক সন্নিকর্ষ। ঐ সন্নিকর্ষের নামই জ্ঞানলক্ষণা প্রত্যাসত্তি। উহা স্বীকার না করিলে কুত্রাপি ঐরূপ ভ্রমপ্রত্যক্ষের উপপত্তি হয় না। কারণ, ভ্রমপ্রত্যক্ষস্থলে সর্বত্রই সেই বিষয়টি সেখানে বিদ্যমান না থাকায় সেই বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়ের কোনো লৌকিক সন্নিকর্ষ সম্ভব হয় না।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৩)
প্রভাকর বলেছিলেন, সকল জ্ঞানই প্রমা এবং বস্তুত ভ্রম বলে কিছু নেই; ভ্রম হলো ভেদাগ্রহের অনুপলব্ধি। কিন্তু কুমারিলের মতে সকল জ্ঞানকে প্রমা বলা হলে সর্বানুভবসিদ্ধ সত্যেরই অপলাপ করা হয়। ভ্রমজ্ঞান আমাদের হয়। এই জ্ঞান একপ্রকার বিশিষ্টজ্ঞান, যা আমাদের প্রবৃত্তিরও কারণ হয়; দৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে স্মৃত বস্তুর অভেদাগ্রহের ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ হলো ভ্রম।
| মীমাংসা দর্শন-১১ : ভ্রম জ্ঞান |
রণদীপম বসু
…
৩.৪ : ভ্রম-জ্ঞান
…
ভ্রম হলো ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ অর্থাৎ একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করা। যেমন শুক্তিতে রজত দর্শন, রজ্জুতে সর্প দর্শন ইত্যাদি। কিন্তু কেন এই ভ্রান্ত প্রত্যক্ষ ঘটে তা নিয়ে ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন ভ্রম-বিচার হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ভ্রম-বিচারের গুরুত্ব অত্যন্ত মৌলিক। প্রায় প্রতিটি সম্প্রদায়েরই মূল তত্ত্ব অন্তত বহুলাংশে এই ভ্রম-ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। এর সাথে ভাববাদ বনাম বাহ্যবস্তুবাদ দ্বন্দ্ব তো রয়েছেই। তাই মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ ন্যায়সূত্রের বাৎসায়ণভাষ্যের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘ন্যায়দর্শন’-এ বলেছেন-
‘এই ভ্রমজ্ঞান সম্বন্ধে প্রাচীন কাল হইতেই ভারতীয় দার্শনিক সমাজে নানারূপ সূক্ষ্ম বিচারের ফলে সম্প্রদায়ভেদে নানা মতবাদ হইয়াছিল এবং এই সমস্ত মতভেদই সম্প্রদায়ভেদে বিভিন্ন মত স্থাপনের মূল ভিত্তি হইয়াছিল।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭১)
রণদীপম বসু
…
৩.৪ : ভ্রম-জ্ঞান
…
ভ্রম হলো ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ অর্থাৎ একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করা। যেমন শুক্তিতে রজত দর্শন, রজ্জুতে সর্প দর্শন ইত্যাদি। কিন্তু কেন এই ভ্রান্ত প্রত্যক্ষ ঘটে তা নিয়ে ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন ভ্রম-বিচার হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ভ্রম-বিচারের গুরুত্ব অত্যন্ত মৌলিক। প্রায় প্রতিটি সম্প্রদায়েরই মূল তত্ত্ব অন্তত বহুলাংশে এই ভ্রম-ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। এর সাথে ভাববাদ বনাম বাহ্যবস্তুবাদ দ্বন্দ্ব তো রয়েছেই। তাই মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ ন্যায়সূত্রের বাৎসায়ণভাষ্যের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘ন্যায়দর্শন’-এ বলেছেন-
‘এই ভ্রমজ্ঞান সম্বন্ধে প্রাচীন কাল হইতেই ভারতীয় দার্শনিক সমাজে নানারূপ সূক্ষ্ম বিচারের ফলে সম্প্রদায়ভেদে নানা মতবাদ হইয়াছিল এবং এই সমস্ত মতভেদই সম্প্রদায়ভেদে বিভিন্ন মত স্থাপনের মূল ভিত্তি হইয়াছিল।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭১)
ভারতীয়
দর্শনে ভ্রম-বিচারে প্রধানতম মত বলতে পাঁচটি। তিনটি মত ভাববাদীদের পক্ষ
থেকে প্রস্তাবিত এবং দুটি মত প্রস্তাবিত বাহ্যবস্তুবাদীদের পক্ষ থেকে।
ভাববাদী মত তিনটি- (১) অসৎখ্যাতিবাদ, (২) অনির্বচনীয়খ্যাতিবাদ এবং (৩)
আত্মখ্যাতিবাদ। আর বাহ্যবস্তুবাদী মত দুটি হলো- (১) অখ্যাতিবাদ এবং (২)
অন্যথাখ্যাতিবাদ বা বিপরীতখ্যাতিবাদ।
মীমাংসাদর্শনে প্রাভাকর-সম্প্রদায় অখ্যাতিবাদ প্রস্তাব করেন এবং ভাট্ট-সম্প্রদায় ন্যায়-বৈশেষিকদের মতো অন্যথাখ্যাতিবাদ স্বীকার করেন, যদিও নৈয়ায়িকদের সাথে ভাট্টমতের ব্যাখ্যায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বলাবাহুল্য, ভারতীয় দর্শনে ‘খ্যাতি’ শব্দের অর্থ হলো ভ্রমজ্ঞান।
অসৎখ্যাতিবাদ
: সাধারণত শূন্যবাদী মাধ্যমিক বৌদ্ধমতকেই অসৎখ্যাতিবাদী বলা হয়। অবশ্য
কারো কারো মতে এই মতবাদটি প্রকৃতপক্ষে কোনো সুপ্রাচীন (বুদ্ধপূর্ব)
সর্বশূন্যতাবাদী বা সর্বাসত্ত্ববাদী সম্প্রদায়ের মত। এই মতে সমস্ত পদার্থই
অসৎ, সর্বত্র অসতের উপরই অসতের আরোপ হচ্ছে। সুতরাং তাঁরা সর্বত্র
সর্বাংশেই অসতের ভ্রম স্বীকার করায় ‘অসৎখ্যাতিবাদী’। তাঁরা গগনকুসুমাদি
অলীক পদার্থেরও প্রত্যক্ষাত্মক ভ্রম স্বীকার করেছেন। অসতের ভ্রমই
‘অসৎখ্যাতি’। প্রকৃত অসৎখ্যাতিবাদ অনুসারে শুক্তিরজত রজ্জুসর্প প্রভৃতির
ব্যাখ্যা হলো- শুক্তিও নেই, রজতও নেই; শুক্তিও অসৎ, রজতৎ অসৎ। অতএব,
শুক্তিতে রজতভ্রম মানে অসতে অসৎ ভ্রম। তেমনি, রজ্জুসর্প দৃষ্টান্তে
ভ্রমজ্ঞানের বিষয় সর্পও অসৎ এবং ভ্রমজ্ঞানের অধিষ্ঠান রজ্জুও অসৎ।
অনির্বচনীয়খ্যাতিবাদ
: অন্যদিকে অদ্বৈত-বেদান্ত মত হলো অনির্বচনীয়খ্যাতিবাদ। অদ্বৈতমতে বলা হয়-
‘জ্ঞেয় বিষয় বা জগৎপ্রপঞ্চ সৎও নয়, অসৎও নয়, সৎ অথবা অসৎ বলে তার নির্বাচন
বা নিরূপণ করা যায় না। সুতরাং তা অনির্বচনীয়। অনাদি অবিদ্যার প্রভাবে
সনাতন ব্রহ্মে এই অনির্বচনীয় জগতের ভ্রম হচ্ছে। ঐ ভ্রমের নাম
অনির্বচনীয়খ্যাতি। শুক্তিতে যে রজতভ্রম হয় তাও অনির্বচনীয়খ্যাতি। ঐ স্থলে
বাহ্যশুক্তি অসৎ নয়, তা ব্যবহারিক সত্য। ওখানে অনির্বচনীয় রজতের উৎপত্তি ও
ভ্রম হচ্ছে।’
এই মতে, ভ্রমের কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যার ফলেই ব্রহ্মে জগৎভ্রম, শুক্তিতে রজতভ্রম। যে-অবিদ্যার ফলে ব্রহ্মে জগৎভ্রম তার নাম মূলাবিদ্যা, যে-অবিদ্যার ফলে শুক্তিতে রজতভ্রম তার নাম তুলাবিদ্যা। মূলাবিদ্যা অনাদি এবং সমগ্র লোকব্যবহার এই মূলাবিদ্যামূলক। ব্রহ্মজ্ঞান বা পারমার্থিক জ্ঞানের উদয় পর্যন্ত তা বিনষ্ট হয় না। তুলাবিদ্যা সাদি অর্থাৎ যার শুরু আছে, এবং সংসার দশাতেই তার বিনাশ হয়। অবিদ্যার দুটি কাজ- আবরণ ও বিক্ষেপ। প্রথমত, অবিদ্যার ফলে ভ্রমের অধিষ্ঠান আবৃত হয়- অর্থাৎ ব্রহ্মে জগৎভ্রমের দৃষ্টান্তে ব্রহ্মের স্বরূপ আবৃত হয়, শুক্তিতে রজতভ্রমের দৃষ্টান্তে রজতের স্বরূপ আবৃত হয়। দ্বিতীয়ত, অবিদ্যার ফলে মিথ্যা পদার্থ সৃষ্টি হয় এবং আবৃত অধিষ্ঠানটির উপর তা বিক্ষিপ্ত হয়- অর্থাৎ ব্রহ্মে জগৎজ্ঞানের দৃষ্টান্তে মিথ্য জগৎ সৃষ্ট হয় এবং তা ব্রহ্মের উপর বিক্ষিপ্ত হয়, শুক্তিতে রজতজ্ঞানের দৃষ্টান্তে মিথ্যা রজত সৃষ্ট হয় এবং তা শুক্তির উপর বিক্ষিপ্ত হয়। মূলাবিদ্যা উৎপন্ন যে মিথ্যা পদার্থ তাকে বলা হয়েছে ব্যবহারিক, কেননা, সমস্ত লোকব্যবহারের বিষয় এই মিথ্যা পদার্থ। তুলাবিদ্যা উৎপন্ন যে মিথ্যা তাকে বলা হয়েছে প্রাতিভাসিক, কেননা, তা লোকব্যবহারের বিষয় হতে পারে না অতএব তা ব্যবহারিক নয়, তবুও তা প্রতিভাত হয় অতএব তা প্রাতিভাসিক। ব্রহ্মে জগৎভ্রম ব্যবহারিক, শুক্তিতে রজতভ্রম প্রাতিভাসিক। অদ্বৈতমতে, উভয় দৃষ্টান্তেই অজ্ঞান বা অবিদ্যা-উৎপন্ন মিথ্যা পদার্থটি অনির্বচনীয়, কেননা তাকে না বলা যায় সৎ, না অসৎ। শুক্তিতে রজতভ্রমের দৃষ্টান্তে সাময়িক প্রাতিভাসিক রজত উৎপন্ন ও জ্ঞাত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই রজত তিনকালেই থাকে না, তাই তা সৎ নয়। তবুও বন্ধ্যাপুত্রের মতো তাকে অলীক বা অসৎ বলা যায় না, কেননা যা অলীক বা অসৎ তা প্রতিভাত হতে পারে না, অথচ প্রতিভাসিক জগত প্রতিভাত হয়। সৎও নয়, অসৎও নয়, অতএব অনির্বচনীয়।
শুক্তিতে রজতভ্রমের স্থলে অজ্ঞানবশত সেই শুক্তিতে মিথ্যা রজতের সৃষ্টি হয়। মিথ্যা বলতে অনির্বচনীয়। অর্থাৎ ঐ রজতকে সৎও বলা যায় না অসৎও বলা যায় না, সৎ বা অসৎ বলে তার নির্বাচন করা যায় না; সুতরাং তা অনির্বচনীয় বা মিথ্যা। এই স্থলে সেই অনির্বচনীয় রজতেরই ভ্রম হয়। এরই নাম ‘অনির্বচনীয়খ্যাতি’। এভাবে তাঁদের মতে সর্বত্রই ভ্রমস্থলে অনির্বচনীয় বিষয়েরই উৎপত্তি ও ভ্রম হয়। সুতরাং তাঁদের মতে সর্বত্র ভ্রমের নাম ‘অনির্বচনীয়খ্যাতি’। এ প্রেক্ষিতে তাঁদের মূল যুক্তি এই যে, শুক্তিতে রজতভ্রম ও রজ্জুতে সর্পভ্রম প্রভৃতি স্থলে রজত ও সর্প প্রভৃতি সে স্থানে একেবারে অসৎ হলে তার ভ্রম হতে পারে না। বিশেষত বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ ব্যতীত প্রত্যক্ষ জন্মে না। শুক্তিতে রজতভ্রম প্রভৃতি প্রত্যক্ষাত্মক ভ্রম। সুতরাং তাতে রজতাদি বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষ অবশ্যই আবশ্যক। অতএব এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে, ঐ স্থলে রজতাদি মিথ্যা বিষয়ের উৎপত্তি হয়। তার সাথেই ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ জন্য ঐরূপ ভ্রমাত্মক প্রত্যক্ষ জন্মে।
আত্মখ্যাতিবাদ
: ভাববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্রমের যে তৃতীয় ব্যাখ্যা প্রস্তাবিত হয়েছে তা
হলো বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধমতের আত্মখ্যাতিবাদ। বিজ্ঞানবাদী মতে- ‘জ্ঞান ব্যতীত
কোনো বিষয়েরই সত্তা কেহ সমর্থন করতে পারেন না। কারণ, জ্ঞানে আরোহণ না করলে
কোনো বিষয়েরই প্রকাশ হয় না। সুতরাং বুঝা যায় যে, জ্ঞানই বস্তুত জ্ঞেয়।
অন্তর্জ্ঞেয় এই জ্ঞানই বাহ্য আকারে প্রকাশিত হয়। অন্তর্জ্ঞেয় ঐ জ্ঞান বা
বুদ্ধিই আত্মা। সুতরাং সর্বত্র কল্পিত বাহ্য পদার্থে বস্তুত আত্মারই ভ্রম
হয়। তাই ঐ ভ্রমকে আত্মখ্যাতি বলা হয়েছে। যেমন শুক্তিতে রজতভ্রম স্থলে
শুক্তি কল্পিত বাহ্য পদার্থ। তাতে আন্তর অর্থাৎ অন্তর্জ্ঞেয় রজতেরই ভ্রম
হয়। কারণ ঐ রজত জ্ঞানেরই আকারবিশেষ, অর্থাৎ জ্ঞান থেকে অভিন্ন পদার্থ।
সুতরাং জ্ঞানস্বরূপ বলে তা আত্মা বা আত্মধর্ম। সুতরাং তা আন্তর বা
অন্তর্জ্ঞেয় বস্তু। বাহ্য না হলেও বাহ্যবৎ প্রকাশিত হওয়ায় তা বাহ্যপদার্থ
বলে কল্পিত ও কথিত হয়ে থাকে। বস্তুত সর্বত্র অন্তর্জ্ঞেয় বিজ্ঞানেরই জ্ঞান
হওয়ায় তদ্ভিন্ন কোনো জ্ঞেয় নাই। মোটকথা সর্বত্র অন্তর্জ্ঞেয় আত্মস্বরূপ
বিজ্ঞানেরই বস্তুত ভ্রম হওয়ায় তাকে ‘আত্মখ্যাতি’ বলা হয়েছে। এই মতে কোনো
জ্ঞানই যথার্থ না হওয়ায় প্রমাণেরও সত্তা নেই। সুতরাং প্রমাণ-প্রমেয়ভাবও
কাল্পনিক, তা বাস্তব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের সত্তা স্বীকার্য। কারণ তা
স্বতঃপ্রকাশ। অনাদি সংস্কারের বৈচিত্র্যবশতই অনাদিকাল থেকে অসংখ্য বিচিত্র
বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়ে চলেছে।
ভাববাদী
দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্রমের এই যে ত্রিবিধ ব্যাখ্যা- অসৎখ্যাতি,
অনির্বচনীয়খ্যাতি এবং আত্মখ্যাতি, এদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে পার্থক্য যাই
হোক না কেন, তিনটির মধ্যে একটি মূল সাদৃশ্যও রয়েছে। ত্রিবিধমতেই শুধু যে
শুক্তিতে রজতজ্ঞান বা রজ্জুতে সর্পজ্ঞানই ভ্রম তাই নয়, সামগ্রিকভাবে
জগৎ-জ্ঞানও ভ্রমই। অসৎখ্যাতিবাদ অনুসারী শূন্যবাদীদের মতে এই ভ্রমের
অধিষ্ঠান ‘শূন্য’, অনির্বচনীয়খ্যাতিবাদ অনুসারী অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম এবং
আত্মখ্যাতিবাদ অনুসারী বিজ্ঞানবাদীদের মতে অলয়বিজ্ঞান। বস্তুত সমগ্রভাবে
জগৎ-জ্ঞানের ভ্রমত্ব প্রতিপাদন করবার উৎসাহেই ভাববাদীর ভ্রমের এই ত্রিবিধ
ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করেছেন। স্বভাবতই এই ত্রিবিধ ব্যাখ্যা অনুসারে ভ্রমের
বিষয়টি মিথ্যা- এবং শুক্তিরজত, রজ্জুসর্প প্রভৃতি ভ্রমের সুপরিচিত
দৃষ্টান্তগুলি বিশ্লেষণ করে তাঁরা মূলত এই কথাটিই প্রতিপন্ন করবার প্রয়াস
করেছেন। রজ্জুসর্পের দৃষ্টান্তে ভ্রমের বিষয় সর্প। অসৎখ্যাতিবাদ অনুসারে এই
সর্প অসৎ বা অলীক, অতএব ভ্রমজ্ঞান অসতেরই জ্ঞান। অনির্বচনীয়খ্যাতিবাদ
অনুসারে এই সর্প না সৎ না অসৎ, অতএব অনির্বচনীয় অর্থে মিথ্যা; ভ্রমজ্ঞান
মানে অজ্ঞানোৎপন্ন এই মিথ্যা পদার্থেরই জ্ঞান। আত্মখ্যাতিবাদ অনুসারে
এ-সর্প আলয়বিজ্ঞান উৎপন্ন প্রবৃত্তিবিজ্ঞান তরঙ্গের অন্তর্গত ক্ষণিক
বিজ্ঞানমাত্র, অতএব বাহ্যবস্তু হিসেবে মিথ্যাই।
এইভাবে ভাববাদীরা দাবি করেছেন, আমাদের দৈনন্দিন ভ্রমজ্ঞানের দৃষ্টান্তে দেখা যায়, যা মিথ্যা তারই প্রতীতি হচ্ছে। তাহলে মিথ্যা বিষয়ের প্রতীতি ঘটে। এবং এ থেকেই ভাববাদীরা সরাসরি প্রমাণ করতে চান, অতএব সমস্ত প্রতীতিই মিথ্যা বিষয়ের প্রতীতি- বহির্জগৎ হিসেবে জগতের প্রতীতিও মিথ্যা বিষয়ের প্রতীতি, পরিদৃশ্যমান বহির্জগৎ মিথ্যা।
উপরিউক্ত
যুক্তির উত্তরে ভাববাদ খন্ডনে বাহ্যবস্তুবাদীরা ভ্রম-বিচারে যে মূল কথা
প্রতিষ্ঠা করতে চান তা হলো, এমনকি ভ্রমজ্ঞানও মিথ্যাবিষয়ক নয়; ভ্রমজ্ঞানের
বিষয়ও বাস্তব সত্য। এই কথা প্রমাণ করবার প্রয়াসে প্রাভাকর-মীমাংসকরা
প্রস্তাব করেছেন অখ্যাতিবাদ, অপরদিকে ন্যায়-বৈশেষিক ও ভাট্ট-মীমাংসকরা
প্রস্তাব করেছেন অন্যথাখ্যাতিবাদ।
অখ্যাতিবাদ
: অখ্যাতিবাদ অনুসারে, ভ্রম বলে আসলে কিছুই নেই। স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের
সঙ্গে চূড়ান্ত সঙ্গতি রেখে প্রভাকর দেখাতে চান, সমস্ত জ্ঞানই যথার্থজ্ঞান।
প্রাভাকর-মতে অনুভূতি মাত্রই প্রমা। দুটি প্রমা ও তাদের বিষয়ের ভেদকে যখন
আমরা অনুধাবন করি না, তখনই তাকে ভ্রম বলা হয়। শুক্তিরজত বা রজ্জুসর্পের
যে-সব দৃষ্টান্তকে সাধারণত ভ্রমজ্ঞানের দৃষ্টান্ত বলে গ্রহণ করা হয় তার
কোনোটিই আসলে এক বিশিষ্ট জ্ঞান নয়। তার বদলে এ-জাতীয় দৃষ্টান্তে দুটি
স্বতন্ত্র জ্ঞান উৎপন্ন হয়- একটি গ্রহণাত্মক, অপরটি স্মরণাত্মক। তাঁদের
মতে, রজ্জুতে সর্পত্ব প্রকার কখনো অনুভূত হতে পারে না। রজ্জুতে সর্বদা
রজ্জুত্ব প্রকারের এবং সর্পে সর্বদা সর্পত্ব প্রকারেরই জ্ঞান হয়। কিন্তু
ভ্রমজ্ঞান আমরা তখনই বলি, যখন দুটি ভিন্ন জ্ঞানের মধ্যে আমরা অভেদ করি।
রজ্জু বলে কোন কিছুকে প্রত্যক্ষ করে যখন সর্পত্বের স্মরণ করি, তখন তাকে
আমরা ভ্রম বলি। এক্ষেত্রে একটি জ্ঞান প্রত্যক্ষ এবং একটি জ্ঞান স্মৃতি।
এদের ভেদের অভাবকেই বলা হয় ভ্রম।
শুক্তিতে ‘ইদং রজতং’ বা ‘ইহা রজত’- এ জাতীয় তথাকথিত ভ্রমের দৃষ্টান্তে সম্মুখস্থ শুক্তির ‘ইদং’ বা ‘ইহা’ অর্থে প্রত্যক্ষজ্ঞান হয়। পরে, তার সঙ্গে রজতের সাদৃশ্যজন্য পূর্বদৃষ্ট রজতের স্মরণাত্মক জ্ঞান হয়। প্রত্যক্ষমূলক ‘ইদং’ জ্ঞানটি সামান্যজ্ঞান, স্মরণমূলক ‘রজত’ জ্ঞানটি বিশেষ জ্ঞান। এই গ্রহণাত্মক ও স্মরণাত্মক দ্বিবিধ জ্ঞানের কোনোটির বিষয়ই মিথ্যা নয়। তবুও শুক্তিতে ‘ইহা রজত’ বা ‘ইদং রজতং’ জ্ঞানকে যে ভ্রম বলা হয় তার কারণ উক্ত দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যমূলক জ্ঞানের অভাব। অর্থাৎ, ভ্রমকে মিথ্যাবিষয়ক কোনো জ্ঞান বলা যায় না; ভ্রম জ্ঞানই নয়, বরং তার বদলে দ্বিবিধ যথার্থবিষয়ক জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যজ্ঞানের অভাব। সম্মুখস্থ শুক্তিকে ‘ইদং’ বা ‘ইহা’ বলে যে প্রত্যক্ষজ্ঞান তার বিষয় অবশ্যই মিথ্যা নয়, এবং পূর্বদৃষ্ট রজতের যে স্মরণাত্মক জ্ঞান তাও মিথ্যা বিষয়ক নয়। এই জ্ঞানদ্বয়ই যথার্থ। সুতরাং ঐ স্থলে ভ্রমজ্ঞান জন্মে না। অবশ্য ‘ইদং’ পদার্থকেই রজত বলে প্রত্যক্ষ হলে এরূপ একটি বিশিষ্ট জ্ঞানকে ভ্রম বলে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু প্রাভাকরমতে, উক্ত স্থলে ঐরূপ একটি বিশিষ্ট জ্ঞান জন্মেই না। এভাবে সর্বত্রই ঐরূপ স্থলে উক্তরূপ জ্ঞানদ্বয়ই জন্মে। সুতরাং জগতে ভ্রমজ্ঞান নাই। তাহলে শুক্তিতে ‘ইদং রজতং’-এর প্রকৃত ব্যাখ্যা কী ? ইদং-পদার্থ শুক্তির প্রত্যক্ষ এবং পূর্বদৃষ্ট পদার্থ রজতের স্মরণ- উভয়ের মধ্যে ভেদের অজ্ঞান। অর্থাৎ শুক্তিরজতের জ্ঞানে ‘ইহা রজত নয়’ এই জ্ঞানের দ্বারা রজতের বোধ হয় না। এই যে ভেদজ্ঞানের অভাব, তা থেকে বোঝা যায় উক্ত দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে ভেদটি ‘খ্যাত’ ছিলো না বলেই ভ্রম। তাই ভ্রমের নাম ‘অখ্যাতি’।
এই
মতের বিরুদ্ধে প্রধানতম আপত্তি হলো, শুক্তিকে রজতজ্ঞান করেই অনেক সময়
ভ্রান্ত ব্যক্তি রজতগ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। এই প্রবৃত্তির ব্যাখ্যা করতে হলে
স্বীকার করতে হবে উক্ত ব্যক্তির ‘ইহা রজত’ বলে বিশিষ্ট জ্ঞানই হয়েছিলো।
কারণ, ঐ স্থলে ঐরূপ বিভিন্ন দুটি জ্ঞান জন্মালে সে ব্যক্তি তো শুক্তিকে রজত
বলে বুঝে না। সুতরাং সেই দ্রব্যকে রজত বলে গ্রহণ করতে তার প্রবৃত্তি হবে
কেন ?
এর উত্তরে প্রভাকর বলেন যে, উক্ত স্থলে যে কারও রজত গ্রহণে প্রবৃত্তি হয়, এটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু সেখানে কোনো একটি বিশিষ্ট জ্ঞান ঐ প্রবৃত্তির কারণ নয়। কিন্তু ইদং পদার্থ শুক্তি এবং পূর্বদৃষ্ট সেই রজতের ভেদের অজ্ঞানই ঐ প্রবৃত্তির কারণ।
এর উত্তরে প্রভাকর বলেন যে, উক্ত স্থলে যে কারও রজত গ্রহণে প্রবৃত্তি হয়, এটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু সেখানে কোনো একটি বিশিষ্ট জ্ঞান ঐ প্রবৃত্তির কারণ নয়। কিন্তু ইদং পদার্থ শুক্তি এবং পূর্বদৃষ্ট সেই রজতের ভেদের অজ্ঞানই ঐ প্রবৃত্তির কারণ।
কিন্তু, বিরুদ্ধবাদীদের মতে, প্রভাকরের এ-যুক্তি স্পষ্টতই কষ্টকল্পনার পরিচায়ক। দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে ভেদের অজ্ঞান কীভাবে প্রবৃত্তির জনক হতে পারে ? বস্তুত, একমাত্র বিশিষ্ট জ্ঞানই প্রবৃত্তির কারণ হতে পারে। শুক্তিতে রজতভ্রম হলে কোনো ব্যক্তি যদি ঐ রজতগ্রহণে প্রবৃত্ত হয় তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তার ‘ইহা রজত’ বলে একটি বিশিষ্ট জ্ঞানই ঘটেছিলো। এ-কথা অস্বীকার করে প্রাভাকররা যে ভাবে ভ্রমকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন তা শুধু তাঁদের অভিনব কল্পনাবলেরই পরিচায়ক।
বস্তুত,
স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের অনুসিদ্ধান্তমূলক এই অখ্যাতিবাদও
স্বতঃ-প্রামাণ্যবাদের মূল দুর্বলতা-দোষদুষ্ট বলে অন্যান্য বাহ্যবস্তুবাদী
বিদ্বানদের অভিমত। কেননা, ভাববাদীরা লোকব্যবহারিক সিদ্ধ প্রমা ও ভ্রমের
মধ্যে পার্থক্য অগ্রাহ্য করে জ্ঞানমাত্রকেই ভ্রম প্রতিপন্ন করবার প্রয়াস
করতে পারেন; কিন্তু বাহ্যবস্তুবাদীও যদি লোকব্যবহারসিদ্ধ উক্ত পার্থক্য
অগ্রাহ্য করে সমস্ত জ্ঞানকেই যথার্থজ্ঞান প্রতিপন্ন করতে চান তাহলে তাঁর
আত্মপক্ষ দুর্বলতাই প্রকাশিত হয়। কারণ, লোকব্যবহারসিদ্ধ অভিজ্ঞতাই ভাববাদের
মূল প্রতিবন্ধ এবং বাহ্যবস্তুবাদের প্রকৃত ভিত্তি। অতএব, বাহ্যবস্তুবাদীর
দায়িত্ব লোকব্যবহারসিদ্ধ এই ভ্রমের বাহ্যবস্তুবাদ সঙ্গত ব্যাখ্যা দেয়া; তার
বদলে ভ্রমকেই উড়িয়ে দেয়া বা অস্বীকার করা নয়। বাহ্যবস্তুবাদী
প্রাভাকর-মীমাংসকরা প্রকৃতপক্ষে এই দুর্বলতাই প্রকাশ করেছেন।
এখানে
খেয়াল রাখা দরকার যে, ভাববাদের পক্ষ থেকে অসৎখ্যাতিবাদ, আত্মখ্যাতিবাদ এবং
অনির্বচনীয়খ্যাতিবাদ প্রস্তাব করে শুধু যে ভ্রমজ্ঞান সিদ্ধির প্রয়াসই
হয়েছে তাই নয়, প্রমাণ করার প্রচেষ্টা হয়েছে যে, ভ্রমজ্ঞানের বিষয় অবশ্যই
মিথ্যা এবং সামগ্রিকভাবে জগৎজ্ঞানও এই ভ্রমজ্ঞানেরই সমতুল্য অতএব মিথ্যা
বিষয়েরই জ্ঞান। তাই প্রভাকরের অখ্যাতিবাদের সমস্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও এ-কথা
অবশ্য স্বীকার্য যে ভাববাদের মৌলিক প্রতিবাদ হিসেবেই মতটি প্রস্তাবিত
হয়েছিলো।
অবশ্যই বিশিষ্ট জ্ঞান হিসেবে ভ্রমকে অস্বীকার করে প্রভাকর বাহ্যবস্তুবাদী হিসেবে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এটা ঠিক যে, প্রভাকরমতে এই তথাকথিত ভ্রমের মূলে দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে একটিও মিথ্যাবিষয়ক নয়- শুক্তিতে ‘ইদং রজতং’-জ্ঞানে প্রত্যক্ষমূলক সামান্যজ্ঞান ‘ইদং’ও মিথ্যা নয়, স্মরণমূলক বিশেষজ্ঞান ‘রজত’ও মিথ্যা বিষয়ক নয়। উভয় বিষয়ই সৎপদার্থ এবং বাহ্যপদার্থ। কিন্তু প্রভাকর এই দুটি সৎপদার্থের জ্ঞানকে একই বা বিশিষ্ট ভ্রমজ্ঞানের দ্বিবিধ উপাদান বলে স্বীকার করেন নি; তার পরিবর্তে দুটি সৎপদার্থের জ্ঞানকে দুটি পৃথক জ্ঞান প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন এবং সে-দুটি জ্ঞানের ভেদমূলক জ্ঞানের অভাবকেই ভ্রম আখ্যা দিয়ে ভ্রমকেই অস্বীকার করবার আয়োজন করেছেন।
পক্ষান্তরে
বাহ্যবস্তুবাদী ন্যায়-বৈশেষিক এবং বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসক কুমারিল ভট্ট
উক্ত দ্বিবিধ সৎপদার্থকেই এক বা বিশিষ্ট জ্ঞানের বিষয় বলে গ্রহণ করেই
ভ্রমের ব্যাখ্যা প্রস্তাব করেছেন। ফলে তাঁদের পক্ষে ভাববাদের আশঙ্কায়
লোকব্যবহার-সিদ্ধ ভ্রমকেই উড়িয়ে দেয়ার বা অগ্রাহ্য করবার প্রয়োজন হয়নি।
তাঁদের মতবাদটির নাম অন্যথাখ্যাতিবাদ বা বিপরীতখ্যাতিবাদ। অন্যথাখ্যাতিবাদ
যদিও কুমারিল-স্বীকৃত তবুও তা মূলত ন্যায়-বৈশেষিকদেরই অবদান। তবে
অন্যথাখ্যাতিবাদের ব্যাখ্যায় কুমারিল ও ন্যায়-বৈশেষিকদের মধ্যে গৌণবিষয়ে
কিছুটা প্রভেদ রয়েছে।
অন্যথাখ্যাতিবাদ বা বিপরীতখ্যাতিবাদ
: অন্যথাখ্যাতিবাদ অনুসারে ভ্রমজ্ঞান একটি বিশিষ্ট জ্ঞান, তবে ভ্রমজ্ঞানের
বিষয়পদার্থ দ্বিবিধ। ন্যায়-বৈশেষিকেরা এই দুটি বিষয়পদার্থের নাম দেন
‘তত্ত্ব’ ও ‘প্রধান’। যথা, স্থাণুতে পুরুষভ্রম স্থলে ভ্রমজ্ঞানের
বিষয়পদার্থ স্থাণু এবং পুরুষ। তার মধ্যে স্থাণুকে ‘তত্ত্ব’ বলা হবে; কেননা
স্থাণু বস্তুত পুরুষ নয়, তত্ত্বত স্থাণুই। এবং পুরুষকে ‘প্রধান’ বলা হবে,
কেননা স্থাণুতে পুরুষেরই আরোপ হওয়ায় এই আরোপের প্রধান বিষয় পুরুষই। অর্থাৎ,
মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের ভাষ্যে- ‘ভ্রমজ্ঞান স্থলে যে-ধর্মীতে অপর
পদার্থের আরোপ বা ভ্রম হয়, সেই ধর্মীর নাম ‘তত্ত্ব’ এবং সেই আরোপ্য
পদার্থটির নাম ‘প্রধান’।- (ন্যায়দর্শন: ৫/১৪৩)। রজ্জুসর্পের দৃষ্টান্তে
রজ্জু তত্ত্ব বা ধর্মী, সর্প প্রধান; শুক্তিরজতের দৃষ্টান্তে শুক্তি তত্ত্ব
বা ধর্মী, রজত প্রধান।
এখানে
স্থাণুপুরুষ বা শুক্তিরজত এ-জাতীয় সর্বসম্মত প্রসিদ্ধ ভ্রমজ্ঞানকেও
সর্বাংশে ভ্রম বলা যায় না। কেননা, ধর্মী-অংশে বা তত্ত্ব-অংশে তা
যথার্থজ্ঞানই, শুধুমাত্র প্রধানাংশেই ভ্রম। বস্তুত স্থাণুতে ‘ইহা পুরুষ’
এবং শুক্তিতে ‘ইহা রজত’ এরূপ ভ্রমজ্ঞান জন্মালে সেখানে অগ্রবর্তী স্থাণু ও
শুক্তিতে স্থাণুত্ব ও শুক্তিত্ব ধর্মের জ্ঞান না হলেও তাতে ‘ইদন্ত¦’ ধর্মের
জ্ঞান হওয়ায় তা ঐ অংশে যথার্থই হয়। কারণ, অগ্রবর্তী সেই স্থাণু প্রভৃতি
পদার্থে ‘ইদন্ত¦’ ধর্মের সত্তা অবশ্য স্বীকার্য। ‘ইহা পুরুষ নহে’, ‘ইহা রজত
নহে’, এভাবে শেষে স্থাণুতে পুরুষের এবং শুক্তিতে রজতের বাধনিশ্চয় হলেও
‘ইদন্ত¦’ ধর্মের বাধনিশ্চয় হয় না। সুতরাং ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞানের ইদং-অংশের
অর্থাৎ ‘ইদন্ত¦’ ধর্মের আশ্রয় তত্ত্বাংশে সেটি যে যথার্থ, তা স্বীকার্য।
তাই মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ বলেন- ‘নৈয়ায়িক সম্প্রদায়ের মতে
প্রমাত্ব ও ভ্রমত্ব বিরুদ্ধ ধর্ম নহে। একই জ্ঞানে অংশবিশেষে উহা থাকিতে
পারে।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৫৪)
নৈয়ায়িকদের
মতে, এই ভ্রমজ্ঞানের নজির থেকে ভাববাদীদের সিদ্ধান্ত কিছুতেই প্রমাণিত হতে
পারে না। কেননা, উক্ত তত্ত্ব ও প্রধান উভয়ই বাহবস্তু অর্থে সৎ; অর্থাৎ
ভ্রমজ্ঞানের বিষয় নির্বস্তু নয়। এক্ষেত্রে মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ বলেন-
‘ভ্রমজ্ঞানের বিষয় বলিয়া সমস্ত পদার্থই যে অসৎ, ইহা কিছুতেই বলা যায় না।
কারণ, তত্ত্ব ও প্রধান পদার্থের সত্তামূলক ভেদবশতই ভ্রমজ্ঞান
পূর্বোক্তরূপে (গ্রহণাত্মক ও স্মরণাত্মক রূপে) দ্বিবিধ হয়। নচেৎ ঐরূপ ভ্রম
জন্মিতেই পারে না। অলীক বিষয়েই ভ্রমজ্ঞান জন্মে, ইহা স্বীকার করিলে
সর্বত্র সর্বাংশেই সমান ভ্রম স্বীকার করিতে হয় এবং তাহা হইলে ‘ইহা পুরুষ
নহে’, ‘ইহা রজত নহে’, ইত্যাদি প্রকারে বাধনিশ্চয়কালে ‘ইদন্ত¦’ ধর্মেরও
বাধনিশ্চয় স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু তাহা সর্বানুভব-বিরুদ্ধ। কারণ, ঐ স্থলে
বাধনিশ্চয়কালে ‘ইহা ইহা নহে’, অগ্রবর্তী এই স্থাণুতে ‘ইদন্ত¦’ ধর্মও নাই,
ইহা তখন কেহই বুঝে না। সুতরাং ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞান যে বিশেষ্য অংশে যথার্থ,
ইহা স্বীকার্য হইলে পূর্বোক্ত তত্ত্ব ও প্রধানের সত্তাও অবশ্য
স্বীকার্য।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৫৪-৫)
অতএব নৈয়ায়িকদের পক্ষে অসৎখ্যাতিবাদ বা আত্মখ্যাতিবাদ মানবার প্রশ্ন ওঠে না; কেননা তত্ত্ব ও প্রধানের কোনোটিই না অসৎ না বিজ্ঞান। এবং বৈদান্তিকদের সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার করা যায় না যে, শুক্তিরজতের দৃষ্টান্তে সাময়িকভাবে কোনো এক অনির্বচনীয় মিথ্যা রজত উৎপন্ন হয়। কারণ, মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের মতে- ‘ঐ স্থলে রজতের উপাদান-কারণাদি না থাকায় মিথ্যা রজতের উৎপত্তি হইতে পারে না। অদ্বৈতবাদী বৈদান্তিক সম্প্রদায় যে মিথ্যা অজ্ঞানকে ঐ স্থলে রজতের উপাদান-কারণ বলিয়াছেন, উহা চক্ষুরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য রজতের সজাতীয় দ্রব্যপদার্থ না হওয়ায় রজতের উপাদান-কারণ হইতে পারে না। পরন্তু ঐরূপ অজ্ঞান বিষয়ে কোনো প্রমাণও নাই, ইহাই ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়ের চরম বক্তব্য।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৩)
এখন
প্রশ্ন, শুক্তিরজতাদি ভ্রমজ্ঞানের প্রসিদ্ধ দৃষ্টান্তে দ্বিবিধ
বিষয়পদার্থই- তত্ত্ব ও প্রধান উভয়েই- যদি সৎ পদার্থ হয় এবং ‘তত্ত্ব’ অংশে
ভ্রমজ্ঞান যদি যথার্থই হয় তাহলে ভ্রমের প্রকৃত ব্যাখ্যা কী ?
মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের মতে- ‘অন্যথাখ্যাতিবাদী ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত এই যে, শুক্তিতে রজতভ্রম স্থলে শুক্তি ও রজত, এই উভয়ই সৎপদার্থ। শুক্তি সেখানেই বিদ্যমান থাকে। রজত অন্যত্র বিদ্যমান থাকে। শুক্তিতে অন্যত্র বিদ্যমান সেই রজতেরই ভ্রম হয়। অর্থাৎ, উক্ত স্থলে শুক্তি শুক্তিরূপে প্রতিভাত না হইয়া ‘অন্যথা’ অর্থাৎ রজতপ্রকারে বা রজতরূপে প্রতিভাত হয়। তাই ঐ ভ্রমজ্ঞানকে ‘অন্যথাখ্যাতি’ বলা হয়।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৩)
মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের মতে- ‘অন্যথাখ্যাতিবাদী ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত এই যে, শুক্তিতে রজতভ্রম স্থলে শুক্তি ও রজত, এই উভয়ই সৎপদার্থ। শুক্তি সেখানেই বিদ্যমান থাকে। রজত অন্যত্র বিদ্যমান থাকে। শুক্তিতে অন্যত্র বিদ্যমান সেই রজতেরই ভ্রম হয়। অর্থাৎ, উক্ত স্থলে শুক্তি শুক্তিরূপে প্রতিভাত না হইয়া ‘অন্যথা’ অর্থাৎ রজতপ্রকারে বা রজতরূপে প্রতিভাত হয়। তাই ঐ ভ্রমজ্ঞানকে ‘অন্যথাখ্যাতি’ বলা হয়।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৩)
অর্থাৎ, সামনে শুক্তি আছে। সেই শুক্তির প্রত্যক্ষ হলো, কিন্তু শুক্তি হিসেবে নয়, শুধু ‘ইদং’ হিসেবে তার সামান্য জ্ঞান হলো। এবং দেশান্তরে ও কালান্তরে রজত আছে, যথা হট্টস্থ রজত। শুক্তিতে শুক্তি হিসেবে না দেখে সেই শুক্তিতে ঐ হট্টস্থ রজত দৃষ্ট হলো- শুক্তি ‘ইদং’রূপ জ্ঞান এবং হট্টস্থ রজতের জ্ঞান দুই মিলে একটি বিশিষ্ট জ্ঞান হয়ে দাঁড়ালো, ইদং-রজতের প্রতীতি ঘটলো।
এখানে
আবারো প্রশ্ন ওঠে, রজত যদি দেশান্তরে ও কালান্তরেই অবস্থিত হয় তাহলে
সম্মুখস্থ শুক্তিতে সেই অন্যত্র রজতের জ্ঞান হয় কী করে ? এবং অন্যত্র তো
বহুবিধ পদার্থই বর্তমান; শুক্তিতে সেগুলির প্রত্যক্ষ না হয়ে শুধুমাত্র
রজতেরই প্রত্যক্ষ হয় কেন ?
উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, শুক্তিতে যে রজতেরই জ্ঞান হয় বা স্থাণুতে যে পুরুষেরই জ্ঞান হয়- শুক্তিতে পুরুষের জ্ঞান হয় না এবং স্থাণুতে রজতের জ্ঞান হয় না- তার কারণ সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ। ন্যায়মতে এই সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষর নিয়মে বলা হয়েছে- ‘স্থাণুতে পুরুষের সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য পুরুষ বলিয়া ভ্রম জন্মে। এবং দূর হইতে শ্বেতবর্ণ পতাকা দেখিলে তাহাতে ‘বলাকার’ সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য ‘বলাকা’ (বকপঙক্তি) বলিয়া ভ্রম জন্মে, এবং দূর হইতে শ্যামবর্ণ কপোতাকার লোষ্ট্র দেখিলে তাহাতে কপোতের সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য কপোত বলিয়া ভ্রম জন্মে। কিন্তু একই বিষয়ে সমস্ত ভ্রমজ্ঞানের সমাবেশ বা সম্মেলন হয় না। অর্থাৎ স্থাণুতে পুরুষ ভ্রমের ন্যায় বলাকাভ্রম, কপোতভ্রম প্রভৃতি সমস্ত ভ্রম জন্মে না।… কারণ, সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষের নিয়ম আছে। অর্থাৎ যে পদার্থ যাহার সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ হয়, সেই পদার্থেই তাহার ভ্রম জন্মে, এইরূপ নিয়ম ফলানুসারেই স্বীকৃত হইয়াছে। সুতরাং স্থাণুতে, পুরুষেরই সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ হওয়ায় পুরুষেরই ভ্রম জন্মে।… কিন্তু যাঁহার মতে সমস্তই নিঃস্ব রূপ অলীক, তাঁহার মতে এই পদার্থে সমস্ত ভ্রমজ্ঞানের সমাবেশ হইতে পারে। অর্থাৎ তাঁহার মতে একই স্থাণুতে পুরুষভ্রম, বলাকাভ্রম, কপোতভ্রম প্রভৃতি সমস্ত ভ্রমই জন্মিতে পারে। কারণ, অলীক পদার্থে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষের পূর্বোক্তরূপ নিয়ম হইতে পারে না।… কারণ, অলীকত্বরূপে সকল পদার্থই সমান বা সদৃশ। ফলকথা, অসৎ পদার্থে অসৎ পদার্থেরই ভ্রম (অসৎখ্যাতি) স্বীকার করিলে সকল পদার্থেই সকল পদার্থের ভ্রম হইতে পারে। কিন্তু তাহা যখন হয় না, যখন স্থাণুতে পুরুষভ্রমের ন্যায় বলাকা প্রভৃতির ভ্রম হয় না, তখন ভ্রমজ্ঞান হলে পূর্বোক্ত ‘তত্ত্ব’ পদার্থ ও ‘প্রধান’ পদার্থের সত্তা ও ভেদ অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৫৫)
উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, শুক্তিতে যে রজতেরই জ্ঞান হয় বা স্থাণুতে যে পুরুষেরই জ্ঞান হয়- শুক্তিতে পুরুষের জ্ঞান হয় না এবং স্থাণুতে রজতের জ্ঞান হয় না- তার কারণ সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ। ন্যায়মতে এই সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষর নিয়মে বলা হয়েছে- ‘স্থাণুতে পুরুষের সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য পুরুষ বলিয়া ভ্রম জন্মে। এবং দূর হইতে শ্বেতবর্ণ পতাকা দেখিলে তাহাতে ‘বলাকার’ সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য ‘বলাকা’ (বকপঙক্তি) বলিয়া ভ্রম জন্মে, এবং দূর হইতে শ্যামবর্ণ কপোতাকার লোষ্ট্র দেখিলে তাহাতে কপোতের সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য কপোত বলিয়া ভ্রম জন্মে। কিন্তু একই বিষয়ে সমস্ত ভ্রমজ্ঞানের সমাবেশ বা সম্মেলন হয় না। অর্থাৎ স্থাণুতে পুরুষ ভ্রমের ন্যায় বলাকাভ্রম, কপোতভ্রম প্রভৃতি সমস্ত ভ্রম জন্মে না।… কারণ, সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষের নিয়ম আছে। অর্থাৎ যে পদার্থ যাহার সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ হয়, সেই পদার্থেই তাহার ভ্রম জন্মে, এইরূপ নিয়ম ফলানুসারেই স্বীকৃত হইয়াছে। সুতরাং স্থাণুতে, পুরুষেরই সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ হওয়ায় পুরুষেরই ভ্রম জন্মে।… কিন্তু যাঁহার মতে সমস্তই নিঃস্ব রূপ অলীক, তাঁহার মতে এই পদার্থে সমস্ত ভ্রমজ্ঞানের সমাবেশ হইতে পারে। অর্থাৎ তাঁহার মতে একই স্থাণুতে পুরুষভ্রম, বলাকাভ্রম, কপোতভ্রম প্রভৃতি সমস্ত ভ্রমই জন্মিতে পারে। কারণ, অলীক পদার্থে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষের পূর্বোক্তরূপ নিয়ম হইতে পারে না।… কারণ, অলীকত্বরূপে সকল পদার্থই সমান বা সদৃশ। ফলকথা, অসৎ পদার্থে অসৎ পদার্থেরই ভ্রম (অসৎখ্যাতি) স্বীকার করিলে সকল পদার্থেই সকল পদার্থের ভ্রম হইতে পারে। কিন্তু তাহা যখন হয় না, যখন স্থাণুতে পুরুষভ্রমের ন্যায় বলাকা প্রভৃতির ভ্রম হয় না, তখন ভ্রমজ্ঞান হলে পূর্বোক্ত ‘তত্ত্ব’ পদার্থ ও ‘প্রধান’ পদার্থের সত্তা ও ভেদ অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৫৫)
অতএব,
স্থাণুতে পুরুষবুদ্ধি, শুক্তিতে রজতবুদ্ধি প্রভৃতি ভ্রমের প্রসিদ্ধ
দৃষ্টান্তে ‘তত্ত্ব’ ও ‘প্রধান’ এই দ্বিবিধ পদার্থের আবশ্যকতা স্বীকার্য
এবং তাছাড়া ভ্রমের জনক বিশেষ কারণ হিসেবে ‘সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ’ স্বীকার্য। এই
সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষকে ‘দোষ’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, অন্যথাখ্যাতিবাদীদের মতে
ভ্রমের প্রকৃত কারণ ‘দোষ’। তবে এই ‘দোষ’ নানাবিধ হতে পারে, তাই দোষবিশেষের
জন্য ভ্রমও নানাবিধ এবং প্রসিদ্ধ ভ্রমের দৃষ্টান্তে দোষ বলতে
সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ হলেও অন্যান্য দৃষ্টান্তে দোষ অন্যান্য। কিন্তু দোষ যদি
না থাকে তাহলে ভ্রম হয় না। যেমন, গন্ধে যখন গন্ধবুদ্ধি হয় তখন
বিষয়-পদার্থের মধ্যে ‘তত্ত্ব’ ও ‘প্রধানের’ পার্থক্যও থাকে না, অতএব
সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ নামের দোষও থাকে না, এবং অন্যান্য কোনো প্রকার দোষও থাকে
না; তাই গন্ধে গন্ধবুদ্ধি যথার্থজ্ঞান, ভ্রম নয়। এ কারণেই মহামহোপাধ্যায়
ফণিভূষণ বলেন-
‘স্থাণু প্রভৃতি পদার্থে পুরুষাদি পদার্থের ভ্রম স্থলে যেমন ‘তত্ত্ব’ ও ‘প্রধান’ পদার্থ এবং কারণরূপে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ থাকে, গন্ধাদি প্রমেয় বিষয়ে গন্ধাদিবুদ্ধিতে উহা না থাকায় ঐ সমস্ত প্রমেয়জ্ঞানকে ভ্রমজ্ঞান বলা যায় না। কারণ, ভ্রমজ্ঞানের ঐ বিশেষ কারণ ঐ স্থলে নাই।… তাই ভাষ্যকার বলিয়াছেন,- ‘সামান্যগ্রহণস্য চাভাবাৎ’। ভাষ্যকারের পূর্বোক্ত স্থাণু প্রভৃতিতে পুরুষাদি ভ্রমস্থলে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ বিশেষ কারণ, অর্থাৎ ভ্রমজনক ‘দোষ’। গন্ধাদি প্রমেয়বিষয়ে গন্ধাদিবুদ্ধি স্থলে ঐ দোষ নাই, অন্য কোনো দোষও নাই, ইহাই এখানে ভাষ্যকারের তাৎপর্য বুঝিতে হইবে। অর্থাৎ ভাষ্যকারোক্ত ‘সামান্যগ্রহণ’ শব্দটি ভ্রমজনক-দোষমাত্রের উপলক্ষণ। কারণ, সর্বত্রই যে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ ভ্রমের বিশেষ কারণ বা ভ্রমজনক দোষ, ইহা বলা যায় না। সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ ব্যতীতও অন্যান্য অনেকরূপ দোষবশতও অনেকরূপ ভ্রম জন্মে। পিত্তদোষজন্য পান্ডুর বর্ণ শঙ্খে পীতবুদ্ধি, দূরত্বদোষজন্য চন্দ্র-সূর্যে স্বল্পপরিমাণবুদ্ধি প্রভৃতি বহু ভ্রম আছে, যাহা সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য নহে। জ্ঞানের সাধারণ কারণ সত্ত্বে যে অতিরিক্ত কারণবিশেষজন্য ভ্রম জন্মে, তাহাকেই ‘দোষ’ বলা হইয়াছে। ঐ দোষ নানাবিধ। ‘পিত্তদরত্বাদিরূপো দোষা নানাবিধঃ স্মৃতঃ।’ (ভাষাপরিচ্ছেদ)। সুতরাং দোষবিশেষজন্য ভ্রমও নানবিধ।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৫৭-৮)
‘স্থাণু প্রভৃতি পদার্থে পুরুষাদি পদার্থের ভ্রম স্থলে যেমন ‘তত্ত্ব’ ও ‘প্রধান’ পদার্থ এবং কারণরূপে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ থাকে, গন্ধাদি প্রমেয় বিষয়ে গন্ধাদিবুদ্ধিতে উহা না থাকায় ঐ সমস্ত প্রমেয়জ্ঞানকে ভ্রমজ্ঞান বলা যায় না। কারণ, ভ্রমজ্ঞানের ঐ বিশেষ কারণ ঐ স্থলে নাই।… তাই ভাষ্যকার বলিয়াছেন,- ‘সামান্যগ্রহণস্য চাভাবাৎ’। ভাষ্যকারের পূর্বোক্ত স্থাণু প্রভৃতিতে পুরুষাদি ভ্রমস্থলে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ বিশেষ কারণ, অর্থাৎ ভ্রমজনক ‘দোষ’। গন্ধাদি প্রমেয়বিষয়ে গন্ধাদিবুদ্ধি স্থলে ঐ দোষ নাই, অন্য কোনো দোষও নাই, ইহাই এখানে ভাষ্যকারের তাৎপর্য বুঝিতে হইবে। অর্থাৎ ভাষ্যকারোক্ত ‘সামান্যগ্রহণ’ শব্দটি ভ্রমজনক-দোষমাত্রের উপলক্ষণ। কারণ, সর্বত্রই যে সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ ভ্রমের বিশেষ কারণ বা ভ্রমজনক দোষ, ইহা বলা যায় না। সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ ব্যতীতও অন্যান্য অনেকরূপ দোষবশতও অনেকরূপ ভ্রম জন্মে। পিত্তদোষজন্য পান্ডুর বর্ণ শঙ্খে পীতবুদ্ধি, দূরত্বদোষজন্য চন্দ্র-সূর্যে স্বল্পপরিমাণবুদ্ধি প্রভৃতি বহু ভ্রম আছে, যাহা সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষজন্য নহে। জ্ঞানের সাধারণ কারণ সত্ত্বে যে অতিরিক্ত কারণবিশেষজন্য ভ্রম জন্মে, তাহাকেই ‘দোষ’ বলা হইয়াছে। ঐ দোষ নানাবিধ। ‘পিত্তদরত্বাদিরূপো দোষা নানাবিধঃ স্মৃতঃ।’ (ভাষাপরিচ্ছেদ)। সুতরাং দোষবিশেষজন্য ভ্রমও নানবিধ।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৫৭-৮)
কিন্তু
এখানে শুক্তিরজতাদি প্রসিদ্ধ ভ্রমের বিষয়ে এবার আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন ওঠে।
সম্মুখে শুক্তি আছে, হাটে রজত আছে; সম্মুখস্থ রজতকে শুধু ইদং বলে জানলাম
আর তাতে হট্টস্থরজতের সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষ ঘটলো; ফলে ‘ইহা রজত’ বলে বিশিষ্ট
জ্ঞানের উদ্ভব হলো। কিন্তু কী করে উদ্ভব হলো ? কেননা নৈয়ায়িকদের মতে
শুক্তিরজতের দৃষ্টান্তে রজতের প্রত্যক্ষজ্ঞানই ঘটে। কিন্তু হট্টস্থ রজতের
প্রত্যক্ষ হবে কী করে ? প্রত্যক্ষের জন্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের
সন্নিকর্ষ প্রয়োজন; কিন্তু যে রজত দেশান্তরে ও কালান্তরে বর্তমান তার সঙ্গে
ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ হবে কী করে ?
এর উত্তরে প্রাচীন ন্যায়-বৈশেষিকদের পক্ষে এর সুস্পষ্ট জবাব না থাকলেও নব্যনৈয়ায়িক গঙ্গেশ উক্ত প্রশ্নের একটি সুস্পষ্ট উত্তর দেয়ার প্রয়াস করেছেন। নব্যন্যায়মতে, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষ দ্বিবিধ হতে পারে। অতএব প্রত্যক্ষও দ্বিবিধ- লৌকিক বা সাধারণ প্রত্যক্ষ এবং অলৌকিক বা অসাধারণ প্রত্যক্ষ। লৌকিক সন্নিকর্ষের ফলে লৌকিক প্রত্যক্ষ এবং অলৌকিক সন্নিকর্ষের ফলে অলৌকিক প্রত্যক্ষ। অলৌকিক সন্নিকর্ষ আবার ত্রিবিধ হতে পারে- (১) সামান্যলক্ষণ, (২) জ্ঞানলক্ষণ এবং (৩) যোগজ। এর মধ্যে দ্বিতীয়টির- অর্থাৎ জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষের সাহায্যে সম্মুখস্থ শুক্তিতে হট্টস্থ রজতের প্রত্যক্ষ হয়, অর্থাৎ ভ্রমপ্রত্যক্ষ হয়। এ জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ কী ? অতীতে একটি বিষয়ের জ্ঞান হয়েছিলো; বর্তমানে তার স্মরণাত্মক জ্ঞান ঘটছে এবং এই স্মরণাত্মক জ্ঞানই বর্তমানে উক্ত অতীতে জ্ঞাত বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষের কারণ হয়। যেমন, সাদৃশ্যপ্রত্যক্ষের জন্য পূর্বানুভূত রজতের স্মরণাত্মক জ্ঞান উদ্বুদ্ধ হলো এবং এই স্মরণাত্মক জ্ঞানই বর্তমানে সেই রজতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের কোনো এক অসাধারণ বা অলৌকিক সন্নিকর্ষ বা যোগাযোগ সাধন করলো। এর ব্যাখ্যায় মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ বলেন-
‘ঐ স্থলে শুক্তিতে রজতের যে ভ্রমাত্মক প্রত্যক্ষ জন্মে, উহা একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ। সাদৃশ্যাদি জ্ঞানবশত ঐ স্থলে প্রথমে পূর্বানুভূত রজতের স্মরণাত্মক যে জ্ঞান জন্মে, উহাই ঐ প্রত্যক্ষের কারণ অলৌকিক সন্নিকর্ষ। ঐ সন্নিকর্ষের নামই জ্ঞানলক্ষণা প্রত্যাসত্তি। উহা স্বীকার না করিলে কুত্রাপি ঐরূপ ভ্রমপ্রত্যক্ষের উপপত্তি হয় না। কারণ, ভ্রমপ্রত্যক্ষস্থলে সর্বত্রই সেই বিষয়টি সেখানে বিদ্যমান না থাকায় সেই বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়ের কোনো লৌকিক সন্নিকর্ষ সম্ভব হয় না।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৩)
ন্যায়-বৈশেষিকদের
মতো মীমাংসক কুমারিলভট্টও প্রভাকরমিশ্রের অখ্যাতিবাদ প্রত্যাখ্যান করে
অন্যথাখ্যাতিবাদই গ্রহণ করেছেন। তবে কুমারিল ভ্রমের ব্যাখ্যায় অলৌকিক
প্রত্যক্ষ স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, ভ্রমজ্ঞানের দ্বিতীয় উপাদানটি
স্মৃতিবিশেষ। শুক্তিরজতের ভ্রমজ্ঞানে সম্মুখস্থ শুক্তির ‘ইদং’ রূপ
প্রত্যক্ষ এবং পূর্বানুভূত হট্টস্থ রজতের স্মৃতি, উভয়ের একটি ভ্রান্ত
সংশ্লেষণই শুক্তিরজতের ভ্রমজ্ঞান। অর্থাৎ এ-ক্ষেত্রে রজতজ্ঞান
প্রত্যক্ষজ্ঞান নয়; অতএব পূর্বানুভূত রজতের স্মরণাত্মক জ্ঞানের মাধ্যমে
ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে দেশান্তরের ও কালান্তরের রজতের কোনো অলৌকিক সন্নিকর্ষ
স্বীকার করবার প্রশ্ন ওঠে না।
প্রভাকর বলেছিলেন, সকল জ্ঞানই প্রমা এবং বস্তুত ভ্রম বলে কিছু নেই; ভ্রম হলো ভেদাগ্রহের অনুপলব্ধি। কিন্তু কুমারিলের মতে সকল জ্ঞানকে প্রমা বলা হলে সর্বানুভবসিদ্ধ সত্যেরই অপলাপ করা হয়। ভ্রমজ্ঞান আমাদের হয়। এই জ্ঞান একপ্রকার বিশিষ্টজ্ঞান, যা আমাদের প্রবৃত্তিরও কারণ হয়; দৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে স্মৃত বস্তুর অভেদাগ্রহের ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ হলো ভ্রম।
পরিশেষে
উল্লেখ্য, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় দর্শনে ভ্রমের যে গভীর ও সূক্ষ্ম
বিচার হয়েছে তাতে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ভ্রমের সমস্যা নিয়ে ভাববাদ ও
বাহ্যবস্তুবাদ এই দুটি মূল দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আলোচনা বিস্তৃত
হয়েছে। ভ্রমজ্ঞানকে দৃষ্টান্ত করে একদিকে ভাববাদীরা জগৎপ্রতীতিকেই
ভ্রমপ্রতীতি বলে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করেছেন; অপরদিকে বাহ্যবস্তুবাদীরা
ভ্রমকে বিচার করে দেখাতে চেয়েছেন যে, ভ্রমের বিষয় অলীকও নয়, বিজ্ঞানও নয়,
কোনো তথাকথিত অনির্বচনীয় মিথ্যাও নয়- তার বদলে বাহ্যবস্তু অর্থেই সৎ
পদার্থ। বলা বাহুল্য, ভাববাদ বনাম বাহ্যবস্তুবাদের এই সংঘর্ষ ভারতীয়
দার্শনিক চিন্তাধারার বিশেষভাবে সমৃদ্ধিসাধন করেছে।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : জ্ঞানের প্রামাণ্য] [*] [পরের পর্ব : প্রমেয় পদার্থ]
…
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : জ্ঞানের প্রামাণ্য] [*] [পরের পর্ব : প্রমেয় পদার্থ]
…
No comments:
Post a Comment