.
| রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি |
রণদীপম বসু
…
১.০ : বুদ্ধিবৃত্তি বনাম বুদ্ধিবেশ্যামী
যারা
বলে রাষ্ট্রের সমস্যার মূল হচ্ছে রাজনীতিকরা, ব্যক্তিগত পর্যালোচনায় মনে
হয়, তারা হয় মূর্খ নয় মিথ্যুক ! কেননা রাষ্ট্রের রাজনীতিক কিংবা রাজনীতির
চালিকাশক্তিটি নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসস্থল থেকে।
যাদেরকে আমরা চরিত্রভেদে বলে থাকি বুদ্ধিজীবী কিংবা বুদ্ধিবেশ্যা।
মেধাবী
বুদ্ধিজীবীদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে একটা যোগ্য গণমুখি রাজনৈতিক আন্দোলন যে
একটা জাতির স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপায়ন করে দিতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ
হলো আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সৃষ্ট বাঙালির একাত্তর। আর কোন রাজনীতি যদি
চরিত্রহীন বুদ্ধিবেশ্যাদের কবলে পড়ে যায়, তখনই বিএনপি-জামায়াতের মতো
প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির মাধ্যমে তৈরি হয়ে যায় একটা গণবিচ্ছিন্ন নৈরাজ্যকর
পরিস্থিতি, যার নিকৃষ্ট নমুনা হলো এই দু’হাজার তের !
অতএব
আপনি মানুন কি না-মানুন, বলা যেতেই পারে, রাষ্ট্রের স্বস্তি ও সুস্থতা
নিশ্চিত হয় কল্যাণকামী বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাজগৎ তথা মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের
সমূর্ত যোগ্যতায়, যারা পথ দেখায়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেয় না।
আর রাষ্ট্রের অকল্যাণ ও নৈরাজ্যকর নিরাপত্তাহীনতা চেপে বসে চতুর
বুদ্ধিবেশ্যাদের ধূর্ত ভণ্ডামির সক্রিয়তায় ! মুখোশধারী এরা নিরপেক্ষতার
আড়ালে বস্তুত নিজেরাই ক্ষমতা বিলাসী ! এবং একটা রাজনৈতিক দলের যোগ্যতাও
নির্ধারিত হয় এই সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তিক চারিত্র্য-সাপেক্ষেই। ফলে, কল্যাণ আর
অকল্যাণের মাঝখানে নিরপেক্ষ অবস্থান বলতে আদৌ কিছু থাকে কি ?
.
২.০ : রাজনীতিক বনাম বুদ্ধিব্যাপারী
যে
যাই বলুন না কেন, রাজনীতিকরা কিন্তু শেষপর্যন্ত একটা দায়বদ্ধ শ্রেণীই,
যাঁদেরকে রেলের মতো একটা লাইন ধরেই এগুতে হয়। ভিন্নপথ কিংবা নতুন পথ ধরতে
হলেও, যদি তা ভুল পথও হয়, তাঁদেরকে আগেভাগে আরেকটা নির্দিষ্ট লাইন তৈরি
করেই সেদিকে যেতে হয় এই দায়বদ্ধতায় আটকে থাকার কারণেই। সে বিচারে
বুদ্ধিব্যাপারীরা কিন্তু একেবারেই দায়বদ্ধহীন স্বাধীন। স্বাধীনতাও এক ধরনের
দায়বদ্ধতা। কিন্তু রাজনীতিকদের মতো ধাপে ধাপে নিজের দায়বদ্ধতাকে স্বীকার ও
প্রমাণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে হয় না বলে এই হঠাৎ আবির্ভূত
বুদ্ধিব্যাপারীরা কিন্তু প্রকারান্তরে স্বেচ্ছাচারীও হয়ে যেতে পারেন। কেননা
তারা তো কারো কাছেই দায়বদ্ধ নন ! ফলে এই বুদ্ধিব্যাপারীদের স্বেচ্ছাচারী
বালখিল্যতায় রাষ্ট্রে কোন একটা অঘটন ঘটে গেলেও দায়বদ্ধহীনতার কারণে এরা
ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান, আর সব দায় গিয়ে পড়ে সেই দায়বদ্ধ রাজনীতিকদের
ঘাড়েই ! জবাবদিহি করতে হয় রাজনীতিকদেরকেই। কারণ তাঁরা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের
কাছে দায়বদ্ধ মেনেই রাজনীতিক হয়েছেন।
বস্তুত
রাজনীতি একটা পেশা, যার জন্য দায়বদ্ধতামূলক জবাবদিহিতা আবশ্যক। কিন্তু
বুদ্ধিব্যবসা চূড়ান্ত বিচারে একটা ব্যবসাই, যার সাথে অনিবার্যভাবেই মুনাফা
জড়িত। আর যেখানে মুনাফা থাকে সেখানে এই মুনাফার স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রাসিতাই
তাদেরকে ক্ষমতালোভী করে তোলে। এটাই মুনাফার ধর্ম। ফলে নাগরিকদের কাছে
প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণে বৈধ ক্ষমতাকেন্দ্রী দায়বদ্ধ রাজনীতিক না হওয়ায়
ক্ষমতালাভের উদগ্র ইচ্ছায় এসব বুদ্ধিব্যাপারীদেরকে তখন কোন-না-কোন বিকল্প
উপায় খুঁজতে হয়। রাজনীতিকদের দূর্বলতাগুলো খুঁজে খুঁজে একটা অস্থিরতার ঘোট
পাকাতে হয়।
বুদ্ধিজীবীদের
সাথে বুদ্ধিব্যাপারীদের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটাও এখানে যে, বুদ্ধিজীবীরা
রাজনীতিক বা রাষ্ট্রনীতিকদের দূর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধনের উপায়
বাৎলে দেন যেন তাঁরা নিজেরাই তা ঠিক করে নেয়। আর বুদ্ধিব্যাপারীরা এই
দূর্বলতাকে যেনতেন প্রকারে নিজেদের ক্ষমতালাভের একটা উপায় হিসেবে গ্রহণ
করতে আগ্রহী হন মুনাফাকামিতার কারণে। অথচ তারা কিন্তু নাগরিকদের কাছে
দায়বদ্ধ নন। দৃশ্যমান পণ্য তৈরি ও ব্যবসায়ও একটা নীতি ও আইন মেনে চলতে হয়।
কিন্তু এই বিমূর্ত বুদ্ধিপণ্য তার বিমূর্ততার কারণেই সমস্ত নিয়ম-নীতির
উর্ধ্বে থেকে যেতে পারে। ফলে অন্যের অধিকার ও সম্পদে হামলে পড়তে পারে।
তাঁরা মনে রাখতে চান না যে, রাষ্ট্রপরিচালনা বস্তুতই দায়বদ্ধ রাজনীতিকদেরই
বৈধ অধিকার।
অতএব,
আপনি একমত হোন বা না-হোন, তবু নিজে নিজে একটু ভেবে দেখুন তো,
রাষ্ট্রপরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক মানে কী ? রাষ্ট্র কি আদৌ দায়বদ্ধহীন হতে
পারে ?
1 comment:
ধন্যবাদ , রাজনীতি একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন করার জন্য রাজনীতিক মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের অবদান অনেক।
Post a Comment