Sunday, February 16, 2014

| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৮ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- ব্রহ্মই উপাদান কারণ |

.
| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৮ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- ব্রহ্মই উপাদান কারণ |
রণদীপম বসু

২.২ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত
.
বায়রায়ণ প্রকৃতপক্ষে উপনিষদের বিভিন্ন শ্রুতিকেই অবিসম্বাদিত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উপনিষদের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন এবং উপনিষদের বিভিন্ন ঋষির মতভেদকে দূর করে সর্বসমন্বয় করতে চেয়েছেন। কিন্তু উপনিষদে যেহেতু মতভেদের যথেষ্ট বীজ ছিলো, যার ফলে অনুগামীরা গুরুর সর্বসমন্বয় নীতিকে খণ্ডন করতে উদ্যোগী হওয়ায় বেদান্তের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু শক্তিশালী মতভেদেরও সৃষ্টি হয়েছিলো। তবু বাদরায়ণের সর্বসমন্বয় তত্ত্বের মধ্যেও তাঁর কিছু সুস্পষ্ট মতামত সিদ্ধান্ত আকারে পরিদৃষ্ট হয়, যাকে বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ বলা যায়।

এখানে ব্রহ্ম, জগৎ, আত্মা প্রভৃতি সম্বন্ধে বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত রয়েছে। যেমন-
.
২.২.০১.  ব্রহ্মই উপাদান কারণ :

বেদান্তসূত্রের দ্বিতীয় চতুঃসূত্রীতেই ব্রহ্মের লক্ষণে বলা হয়েছে-
‘জন্মাদ্যস্য যতঃ’- (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২), অর্থাৎ, ‘জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যা থেকে হয় তিনিই ব্রহ্ম’।
এই সূত্রে ব্রহ্মের কর্ম- সৃষ্টির উৎপাদন, ধারণ বা স্থিতি ও বিনাশ-কে ব্যক্ত করা হয়েছে। এবং ব্রহ্ম যে জগতের আদি কারণ এ ব্যাপারে বেদান্তসূত্রে স্পষ্ট উক্তিই রয়েছে-

‘কারণত্বেন চাকাশাদিষু যথাব্যপদিষ্টোক্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১৪)।।
ভাবার্থ : ব্রহ্মই যে আকাশাদি সৃষ্ট পদার্থের একমাত্র আদি কারণ সে বিষয়ে শ্রুতিতে কোন মতভেদ নাই (ব্রঃসূঃ-১/৪/১৪)।
এখানে প্রশ্ন আসে, কার্য-কারণ সম্পর্ক অনুযায়ী যেকোন কার্যের দুটি কারণ থাকে- নিমিত্ত কারণ ও উপাদান কারণ। এক্ষেত্রে ব্রহ্ম কী জাতীয় কারণ হবেন ? প্রাথমিক বিচারে ব্রহ্ম একমাত্র নিমিত্ত-কারণ বলেই মনে হয়, কারণ প্রশ্ন উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘স প্রাণমসৃজত প্রাণাচ্ছ্রদ্ধাং খং বায়ুর্জ্যোতিরাপঃ পৃথিবীন্দ্রিয়ং মনঃ। অন্নমন্নাদ্বীর্যং তপো মন্ত্রাঃ কর্ম লোকা লোকেষু চ নাম চ’।। (প্রশ্নোপনিষদ-৬/৪)।।
অর্থাৎ : তিনি হিরণ্যগর্ভকে (প্রাণাত্মা) সৃষ্টি করলেন। হিরণ্যগর্ভ বা প্রাণ থেকে সৃষ্টি হলো শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা থেকে আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী এবং ইন্দ্রিয় সৃষ্টি হলো। তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন মন এবং অন্ন। অন্ন থেকে ক্রমে বীর্য, বেদসমূহ, কর্ম (যাগযজ্ঞ), স্বর্গ এবং অন্যান্য লোক, এবং লোকসমূহে বিভিন্ন নাম বা পদসমূহ সৃষ্টি হলো (প্রশ্ন-৬/৪)।
কিন্তু বাদরায়ণ এই মতামতকে খণ্ডন করে বলেন ব্রহ্ম জগতের উপাদান-কারণও বটেন। কারণ কার্য থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ব্রহ্ম যদি জগতের উপাদান-কারণ হন তাহলেই কেবল ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা সব কিছুকে জানা সম্ভব। যেমন শ্রুতিতে বলা হয়েছে- ‘ যার দ্বারা অশ্রুতবিষয় শ্রুত হয়, অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়’- (ছান্দোগ্য-৬/১/৩) ইত্যাদি। সূত্রকার এই প্রসঙ্গে ‘হে সৌম্য যেমন একটি মৃত্তিকাপিণ্ডের দ্বারা মৃত্তিকার পরিণাম-ভূত সমস্তই জানা যেতে পারে’- (ছান্দোগ্য-৬/১/৪) ইত্যাদি উপনিষদের বচনের সাহায্যে একথাও বলতে চেয়েছেন যে মৃত্তিকা যেমন কলসীর উপাদান, ব্রহ্মও তেমনি বিশ্বের কারণ। তা নাহলে এই শ্রুতিবচনগুলি অর্থহীন হতো। আবার ‘এই দৃশ্যমান জগৎ প্রকাশের আগে একমাত্র ব্রহ্মই ছিলেন, এক এবং অদ্বিতীয় সৎরূপেই ছিলেন’- (ছান্দোগ্য-৬/২/১) ইত্যাদি শ্রুতিও প্রমাণ করে যে, ব্রহ্ম নিমিত্ত-কারণও বটেন- যেহেতু, যখন আর কিছুই ছিলো না তখন ব্রহ্ম ব্যতীত আর কে এরূপ কারণ হতে পারেন ? তাই সূত্রকার বলেন-
‘প্রকৃতিশ্চ প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৩)।।
ভাবার্থ : ব্রহ্ম জগতের শুধু নিমিত্ত-কারণ নন, উপাদান-কারণও, এরূপ সিদ্ধান্তেই শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সামঞ্জস্য হয় (ব্রঃ-১/৪/২৩)।
ব্রহ্ম যে জগৎ থেকে ভিন্ন নয়, উদ্দালক আরুণির উক্তি- ‘মৃত্তিকাই সত্য, ঘড়া কলসী শুধু কতকগুলি নামমাত্র’- (ছান্দোগ্য-৬/১/৪)- থেকেই তা স্পষ্ট। কেননা মৃত্তিকা থাকাতেই যেমন ঘট পাওয়া যায় তেমনি ব্রহ্ম থেকেই জগৎ সৃষ্টি হয়। আবার কার্যের কারণ হওয়ার জন্য ব্রহ্ম জগৎ থেকে ভিন্ন নয়। যেমন সুতো বস্ত্র থেকে ভিন্ন নয়, তেমনি ব্রহ্ম জগৎ থেকে ভিন্ন নয়। বায়ুকে যেমন- প্রাণ, অপানাদি কয়েকটি রূপে দেখা যায়, ব্রহ্মকে তেমনি জগতের নানারূপে দেখা যায়।
‘তিনি (ব্রহ্ম) ইচ্ছা করলেন, ‘আমি বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে জাত হবো’- (ছান্দোগ্য-৬/২/৩) এই শ্রুতিতে ইচ্ছার কথা উল্লেখ থেকে বুঝা যায় ব্রহ্ম নিমিত্ত-কারণ, এবং পরবর্তী শ্রুতিবচন ‘আমি বহু হবো’- থেকে বুঝা যায় যে ব্রহ্ম নিজেই বহু হয়েছেন। সুতরাং তিনি উপাদান-কারণও বটেন। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘অভিধ্যোপদেশাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৪)।।
ভাবার্থ : ব্রহ্ম নিজেই বহুরূপে সৃষ্ট হবেন, এই বাক্য থেকেও তিনি যে নিমিত্ত এবং উপাদান উভয়বিধ কারণ তা বুঝা যায় (ব্রঃ-১/৪/২৪)।
যা থেকে কোন জিনিস উৎপন্ন হয়ে যাতে পুনরায় বিলীন হয় তা-ই হলো উপাদান-কারণ। সেক্ষেত্রে একটি বস্তুকে তার নিমিত্ত-কারণ থেকে উৎপন্ন বলা যেতে পারে, কিন্তু প্রলয়কালে বস্তুটি তাতে ফিরে যেতে পারে না, যদি না তা উপাদান-কারণও হয়। কার্যের সাথে কারণের এই সম্বন্ধকে বলা হয় সাক্ষাৎ সম্বন্ধ। ব্রহ্মকে জগতের উপাদান-কারণ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সূত্রকার বাদরায়ণ শ্রুতির সাক্ষ্যকেই বিবেচনায় নিয়েছেন তা বলাই যায়। যেমন, ‘এই সমস্ত ভূতবর্গ আকাশ (ব্রহ্ম) থেকেই সমুৎপন্ন হয় এবং আকাশেই লয় হয়। আকাশ এই সব কিছুর থেকে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আকাশই পরমা গতি’- (ছান্দোগ্য-১/৯/১)। এবং তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘…যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে। যেন জাতানি জীবন্তি। যৎ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি। তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব। তদ্ ব্রহ্মেতি।…’।। (তৈত্তিরীয়-৩/১/১)।।
অর্থাৎ : যাঁর থেকে এই অখিল ভূতবর্গ উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হয়ে যাঁর দ্বারা বর্ধিত ও আশ্রিত হয়, এবং বিনাশকালে যাঁর কাছে ফিরে যায় এবং যাঁর মধ্যে বিলীন হয়, তাঁকেই জানতে ইচ্ছুক হও; তিনিই ব্রহ্ম (তৈত্তিরীয়-৩/১/১)।
সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের সাথে ব্রহ্মের এই সাক্ষাৎ সম্বন্ধরূপ এই শ্রুতিবচনগুলিই প্রমাণ করে যে, ব্রহ্ম উপাদান-কারণও বটেন। তা-ই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সাক্ষাচ্চোভয়াস্নানাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৫)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি সাক্ষাৎ সম্বন্ধেই ব্রহ্মের নিমিত্ত ও উপাদান-কারণত্ব উভয়ই উপদেশ করেছেন (ব্রঃ-১/৪/২৫)।
আবার তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে-
অসদ্বা ইদমগ্র আসীৎ। ততো বৈ সদজায়ত। তদাত্মানং স্বয়মকুরুত। তস্মাৎ তৎ সুকৃতমুচ্যতে ইতি।। (তৈত্তিরীয়-২/৭/১)।।
অর্থাৎ : আদিতে জগৎ বলে কিছু ছিলো না। কেবল ব্রহ্ম ছিলেন। এই জগৎ তখন অব্যক্ত ব্রহ্মরূপে ছিলো। তারপর নামরূপের এই দৃশ্যমান জগৎ আত্মপ্রকাশ করলো। ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে এভাবে সৃষ্টি করলেন। তাই তিনি ‘সুকৃত’ (অর্থাৎ ‘সুন্দর সৃষ্টি’ বা ‘স্বয়ংকর্তা’) বলে খ্যাত (তৈত্তিরীয়-২/৭/১)।
এই শ্রুতি থেকে বুঝা যায় যে, স্বয়ং ব্রহ্ম নিজের অভ্যন্তর থেকেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন- এবং এই সৃষ্টি একটি পরিণামের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। শ্রুতির ’স্বয়ম্’ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে, সেখানে অন্য কোন কারণ ক্রিয়াশীল ছিলো না। তাকে ভিত্তি করেই সূত্রকার বাদরায়ণ বলছেন-
‘আত্মকৃতেঃ পরিণামাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৬)।।
ভাবার্থ : ‘ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে জগৎরূপে সৃষ্টি করলেন’- এই বাক্য থেকে ব্রহ্ম যে কর্তা ও কর্ম- নিমিত্ত ও উপাদান-কারণ তা বুঝা যায় (ব্রঃ-১/৪/২৬)।
এবং ব্রহ্মের উপাদান-কারণত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আরেকটি শ্রুতিকে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করে সূত্রকার বলেন-
‘যোনিশ্চ হি গীয়তে’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৭)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি ব্রহ্মকেই জগতের ‘যোনি’ অর্থাৎ মূল কারণ বলেছেন, এজন্যও তার উপাদান-কারণত্বও সিদ্ধ হয় (ব্রঃ-১/৪/২৭)।
উল্লেখযোগ্য সেই শ্রুতিটি হলো-
‘যৎ তৎ অদ্রেশ্যম্ অগ্রাহ্যম্ অগোত্রম্ অবর্ণম্ অচক্ষুঃশ্রোত্রং তৎ অপাণিপাদম্ ।
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং তৎ অব্যয়ং যৎ ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ’।। (মুণ্ডকোপনিষদ-১/১/৬)।।
অর্থাৎ : যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), সর্বব্যাপী (আকাশের মতো) এবং যিনি সূক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির যোনি বা উৎস- সেই (কারণ) ব্রহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন (মুণ্ডক-১/১/৬)।
এই শ্রুতি থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, ব্রহ্ম এই জগতের উপাদান-কারণ। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, যেখানে ব্রহ্ম চেতন, শুদ্ধ, ঈশ্বর, স্বভাবযুক্ত, সেখানেও জগৎ অচেতন, অশুদ্ধ, পরাধীন, অতএব কারণ থেকে কার্য এতো অসম স্বভাবযুক্ত কেন ? অর্থাৎ পূর্বপক্ষীয় যুক্তিটি হলো, অচেতন জগৎ চেতন ব্রহ্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অতএব চেতন ব্রহ্ম অচেতন জগতের উপাদান-কারণ হতে পারেন না। এর সমাধানের জন্য বাদরায়ণ বলেছেন-
‘দৃশ্যতে তু’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৬)।।
ভাবার্থ : চেতন থেকে অচেতন এবং অচেতন থেকে চেতনের উৎপত্তি অবশ্যই দৃষ্ট হয়ে থাকে (ব্রঃ-২/১/৬)।
এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয় যে, বৃশ্চিকাদি চেতনাসম্পন্ন জীব গোময়াদি অচেতন বস্তু থেকে উৎপন্ন হয়। আবার চেতনাসম্পন্ন মাকড়সা থেকে অচেতন তন্তু তার জালের জন্য সৃষ্ট হয়। একইভাবে অচেতন নখ কেশাদি চেতনাসম্পন্ন জীব মানুষ থেকেই উৎপন্ন হয়। সুতরাং তা সম্পূর্ণভাবেই সম্ভব যে, এই জড়জগৎ চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে কারণের সঙ্গে কার্যের অসাম্যের উদাহরণেও বলা হয়, পতঙ্গ বা মক্ষিকা যে কীটের জন্ম দেয় তা সম্পূর্ণ অ-সম, আবার এই কীট থেকে পুনরায় যে পতঙ্গ সৃষ্ট হয় তা তার মাতৃস্থানীয় ডিম্বকোষের বিপরীত। তবে কার্য ও কারণের মধ্যে যতো অ-সম বা বৈশাদৃশ্যই পরিলক্ষিত হোক না কেন, বাদরায়ণ কিন্তু কার্যকে ব্রহ্মের উপাদান-কারণ হিসেবেই কখনোই ভিন্ন বলে মানেন নি। তাই ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়-
‘ভাবে চোপলব্ধেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)।।
‘সত্ত্বাচ্চাবরস্য’।। (২/১/১৬)।।
ভাবার্থ :
কারণ বিদ্যমান থাকে বলেই কার্যের উপলব্ধি হয় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)।  (পরবর্তী) কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে কারণে অবস্থান করে বলেও কার্য-কারণ ভিন্ন নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৬)।
ব্রহ্মই উপাদান-কারণ হিসেবে আরেকটি আপত্তি উত্থাপিত হয় ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি শ্রুতি নিয়ে-
‘অসৎ এবেদমগ্র আসীৎ। তৎ সৎ আসীৎ, তৎ সমভবৎ, তৎ আন্ডং নিরবর্তত, তৎ সংবৎসরস্য মাত্রাম্ অশয়ত, অৎ নিরভিদ্যত, তে আন্ডকপালে রজতং চ সুবর্ণং চাভবতাম্’।। (ছান্দোগ্য-৩/১৯/১)।।
অর্থাৎ : এই জগৎ পূর্বে অসৎ অর্থাৎ নামরূপহীন ছিলো। তা সৎ অর্থাৎ সূক্ষ্ম সত্তাবান হলো, প্রকাশিত হলো এবং ডিম্বাকার রূপ ধারণ করলো। এ অবস্থায় একবছর থাকার পর সেই ডিম্ব দুভাগে বিভক্ত হলো- একভাগ রজতময়, অপরভাগ সুবর্ণময় হলো (ছাঃ-৩/১৯/১)।
সৃষ্টির পূর্বে অসৎ অবস্থা সত্য হলে ব্রহ্মই আদি কারণ বা উপাদান-কারণ অসঙ্গত। তারই প্রতিষেধকল্পে এই শ্রুতির ব্যাখ্যায় বাদরায়ণ বলেন-
‘অসদ্ব্যপদেশান্নেতি চেৎ, ন, ধর্মান্তরেণ বাক্যশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৭)।।
‘যুক্তেঃ শব্দান্তরাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৮)।।
ভাবার্থ :
শ্রুতি বলেন ‘এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অসৎ-ই ছিলো’- এর অর্থ এই নয় যে সৃষ্টির পূর্বে জগৎ ছিলো না। তা ব্রহ্মে সূক্ষ্মরূপে লীন হয়ে ছিলো তা পরবর্তী শ্রুতিবাক্য থেকে জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৭)।  যুক্তি এবং অন্য একটি শ্রুতি বচন থেকে ব্রহ্ম এবং জগতের মধ্যে কার্য কারণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৮)।
অর্থাৎ, ‘অসৎ’ এই শব্দটি সম্পূর্ণ অনস্তিত্বকে বুঝায় না, কিন্তু জগৎ পৃথক কোন সত্তারূপে ছিলো না- তাই বুঝায়। তা অভিন্ন অবস্থাতেই ছিলো- তখন পর্যন্ত কোন নাম-রূপের উদ্ভব হয়নি- এই অর্থে জগৎকে ‘অসৎ’ বলা হয়েছে। তখন তা সূক্ষ্ম অবস্থায় ছিলো এবং সৃষ্টির পর তা স্থূল আকার ধারণ করলো এবং নাম-রূপেরও উদ্ভব হলো। এই শ্রুতির অব্যবহিত পরের অংশে এই অর্থেই তার উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে উল্লেখকৃত অন্য শ্রুতি বচনটি হলো-
‘হে সৌম্য, সৃষ্টির পূর্বে এই জগৎ এক অদ্বিতীয় সৎ-রূপে (বিদ্যমান) ছিলো’- (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।

ব্রহ্মের জগৎ-কারণত্বের বিরুদ্ধে আর একটি নতুন আপত্তি উত্থিত হয় তা হলো, ব্রহ্মকে সৃষ্টি কর্মে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মের বাইরে কোন উপকরণ নেই- কারণ ব্রহ্ম ব্যতিরিক্ত কোন কিছুই নেই। ব্রহ্ম ‘একমেব্যদ্বিতীয়ম্’, এক ও অদ্বিতীয়, সুতরাং সকল বাহ্য এবং আভ্যন্তরীণ ভেদরহিত। ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় বলে তাঁর কোন আনুষঙ্গিক উপকরণ নাই- সুতরাং তিনি সৃষ্টিকর্তা হতে পারেন না। এই আপত্তি খণ্ডন করে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, ব্রহ্ম উপাদান এবং উপকরণরহিত হয়েও জগৎ-কারণ হতে পারেন-

‘উপসংহারদর্শনান্নেতি চেৎ, ন, ক্ষীরবদ্ধি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৪)।।
‘দেবাদিবদপি লোকে’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৫)।।
‘শ্রুতেস্তু, শব্দমূলত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৭)।।
‘সর্বধর্মোপপত্তেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৭)।।
ভাবার্থ :
উপকরণের সাহায্য ভিন্ন কোন কিছুই নির্মাণ করা যায় না, অতএব বাহ্য উপকরণ ছাড়া ব্রহ্ম কিভাবে জগৎ সৃষ্টি করলেন ?- যদি এরূপ আপত্তি হয়, তার উত্তরে আমরা বলবো- দুগ্ধ যেমন দ্রুতই দধিরূপে পরিণত হয়, ব্রহ্মও সেরূপ নিজেই জগৎরূপে পরিণত হয়েছেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৪)।  দেবতা এবং পৃথিবীর বহু সিদ্ধপুরুষও ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সৃষ্টি করতে পারেন। ব্রহ্মও সেরূপ পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৫)।  ব্রহ্ম যে সর্বশক্তিসম্পন্ন তা শ্রুতিসিদ্ধান্ত। অতএব তিনি জগতের অতীত হয়েও জগৎরূপে পরিণত হতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৭)।   জগৎ-কারণ হওয়ার জন্য যে-সব গুণ বা ধর্ম থাকা আবশ্যক তার সবগুলি ব্রহ্মেই বর্তমান। সুতরাং ব্রহ্মই জগৎ-কারণ (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৭)।
এখানে হয়তো আরো অনেক তর্কই উত্থিত হতে পারে যে, ব্রহ্মের সৃষ্টিক্ষমতার প্রমাণ-যুক্তি হিসেবে যে সিদ্ধপুরুষদের উপমা টানা হয়েছে, সত্যি কি সিদ্ধপুরুষেরা ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে যেকোন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন ? কিংবা সিদ্ধপুরুষ বলতেই বা কী বোঝায় ? ইত্যাদি ইত্যাদি তর্কের দ্বারা আদৌ কি কোনো নিশ্চয়তায় পৌঁছা সম্ভব ? বস্তুগ্রাহ্য প্রমাণ ছাড়া কেবল তর্কের দ্বারা আমরা কোনো নিশ্চয়তায় পৌঁছতে পারি না, কেননা তর্ক পরস্পরকে খণ্ডন করে। সেইজন্য পরিশেষে বিনা তর্কে উপনিষদের বচনকে স্বীকার করে ব্রহ্মকেই জগতের উপাদান বলে মেনে নেওয়া যুক্তিযুক্ত বলেই বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত-
‘তর্কাপ্রতিষ্ঠানাদপি, অন্যথানুমেয়মিতি চেৎ, এবমপ্যবিমোক্ষপ্রসঙ্গঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১১)।।
ভাবার্থ : তর্ক অপ্রতিষ্ঠ; অতএব শ্রুতিসিদ্ধ ব্রহ্মের কারণত্ববাদ কেবলমাত্র তর্কের দ্বারা খণ্ডন করা চলে না (ব্রঃ-২/১/১১)।

1 comment:

kaisar ahmed said...

ধন্যবাদ,লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো| আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। আমার মানে হয় এই ছোট তথ্যটি আপনার উপকারে আসতে পারে রুমমেট