.
০১. প্রধান নয়, ব্রহ্মই প্রথম ও মূল কারণ :
সাংখ্যবাদীরা প্রকৃতি বা প্রধানকে জগতের মূল কারণ বলে স্বীকার করেন। ব্রহ্মসূত্রের ৫-১১ সূত্রগুলিতে সাংখ্যবাদীদের মতকে খণ্ডন করে ব্রহ্মকেই প্রথম কারণ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানকার আলোচনাটি প্রধানত ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়কে অবলম্বন করেই করা হয়েছে। ছান্দোগ্যে ঋষি উদ্দালক আরুণি তাঁর পুত্রকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করতে গিয়ে বলেছেন- ‘ইহা প্রথম ছিলো এক অদ্বিতীয় সৎ রূপ।… তিনি কামনা করলেন বহু হবো।’- (ছান্দোগ্য-৬/২/১)। এখানে যে সৎ এক অদ্বিতীয় অস্তিত্বকে সৃষ্টির মূল বলে আরুণি স্বীকার করেছেন, তা হয়তো সাংখ্যসূত্রকার কপিল-প্রতিপাদিত প্রধানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু কোথাও ব্রহ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি, কোথাও বা প্রধান থেকে, এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী মতও আছে। এই বিরোধকে দূর করতে গিয়ে বাদরায়ণ বলেছেন-
অচেতন প্রধানকে আদি কারণ বলে স্বীকার করা না হলেও উপনিষদে (যেমন তৈত্তিরীয় উপনিষদে-২/২/১) উল্লিখিত আত্মা থেকে যে আকাশাদির উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে আত্মাকে কি মূল কারণ বলে মনে করা যেতে পারে ? এই তৈত্তিরীয় উপনিষদের দ্বিতীয় খন্ড ব্রহ্মানন্দবল্লীতেই দেখা যায়-
উপনিষদে ‘অন্তন’, ‘আকাশ’, ‘প্রাণ’, ‘জ্যোতি’ প্রভৃতি এমন কিছু প্রকৃতিবাচক শব্দ রয়েছে যাকে সৃষ্টিকর্তার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হলেও প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক পদার্থের ভ্রম হতে পারে। যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদে দেখা যায়-
বিভিন্ন উপনিষদের মতোই যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে-
| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৭ : উপনিষদের বিরোধ নিষ্পত্তি |
রণদীপম বসু
…
২.১ : উপনিষদের বিরোধ নিষ্পত্তি
উপনিষদের ঋষিরা সৃষ্টির মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সকলেই এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। প্রথমকালের উপনিষদে কেউ কেউ জলকে মূল কারণ বলে মেনেছেন, আবার পরবর্তীকালে উপনিষদে কেউ কেউ সাংখ্যসূত্রকার কপিলের মতের সাথে মিল রেখে প্রধান বা প্রকৃতিকে মূল কারণ বলে মেনেছেন। সেই জন্য বাদরায়ণের নিকট এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যকে দূর করা প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। তাই তিনি ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাদের পঞ্চম সূত্র থেকেই যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তি শুরু করেছিলেন। যেমন-
রণদীপম বসু
…
২.১ : উপনিষদের বিরোধ নিষ্পত্তি
উপনিষদের ঋষিরা সৃষ্টির মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সকলেই এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। প্রথমকালের উপনিষদে কেউ কেউ জলকে মূল কারণ বলে মেনেছেন, আবার পরবর্তীকালে উপনিষদে কেউ কেউ সাংখ্যসূত্রকার কপিলের মতের সাথে মিল রেখে প্রধান বা প্রকৃতিকে মূল কারণ বলে মেনেছেন। সেই জন্য বাদরায়ণের নিকট এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যকে দূর করা প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। তাই তিনি ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাদের পঞ্চম সূত্র থেকেই যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তি শুরু করেছিলেন। যেমন-
০১. প্রধান নয়, ব্রহ্মই প্রথম ও মূল কারণ :
সাংখ্যবাদীরা প্রকৃতি বা প্রধানকে জগতের মূল কারণ বলে স্বীকার করেন। ব্রহ্মসূত্রের ৫-১১ সূত্রগুলিতে সাংখ্যবাদীদের মতকে খণ্ডন করে ব্রহ্মকেই প্রথম কারণ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানকার আলোচনাটি প্রধানত ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়কে অবলম্বন করেই করা হয়েছে। ছান্দোগ্যে ঋষি উদ্দালক আরুণি তাঁর পুত্রকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করতে গিয়ে বলেছেন- ‘ইহা প্রথম ছিলো এক অদ্বিতীয় সৎ রূপ।… তিনি কামনা করলেন বহু হবো।’- (ছান্দোগ্য-৬/২/১)। এখানে যে সৎ এক অদ্বিতীয় অস্তিত্বকে সৃষ্টির মূল বলে আরুণি স্বীকার করেছেন, তা হয়তো সাংখ্যসূত্রকার কপিল-প্রতিপাদিত প্রধানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু কোথাও ব্রহ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি, কোথাও বা প্রধান থেকে, এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী মতও আছে। এই বিরোধকে দূর করতে গিয়ে বাদরায়ণ বলেছেন-
‘ঈক্ষ্ণতের্ন, অশব্দম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।।
ভাবার্থ : জগতের আদি কারণের ঈক্ষণ অর্থাৎ চিন্তা, দর্শন ইত্যাদির কথা শাস্ত্রে আছে। কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত অচেতন প্রধানের কথা শাস্ত্রে নেই বলে প্রধানকে প্রথম কারণ বললে তা অ-শব্দ বা অশাস্ত্রীয় উক্তি হবে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।
এখানে
বিরুদ্ধ যুক্তি উত্থাপিত হতে পারে যে, মূল শ্রুতিতে সৎ-কর্তৃক ঈক্ষণাদি
কার্য যা বর্ণিত হয়েছে তাতে শব্দের প্রয়োগ মুখ্যভাবে নয়, গৌণ করা হয়েছে।
যেমন- ‘সেই তেজ (অগ্নি) ঈক্ষণ করলেন ‘আমি বহু হবো, আমি জাত হয়ে প্রকট হবো’।
তেজ জল সৃষ্টি করলেন; জল ইচ্ছা করলেন…। তা থেকে ক্ষিতি (মৃত্তিকা) সৃষ্ট
হলো।’- (ছান্দোগ্য-৬/২/৩-৪)। এভাবেই পরবর্তী বক্তব্যকে আলঙ্কারিক ভাষায়
ঋষিরা ‘ঈক্ষণ করেছেন’ বলেছেন। এই যুক্তি খণ্ডন করতে বাদরায়ণ বলেন-
‘গৌণশ্চেৎ, ন, আত্মশব্দাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৬)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি গৌণ অর্থে ‘ঈক্ষণ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন বললে তা যুক্তিসিদ্ধ হবে না, কারণ শ্রুতি অবশেষে জগতের আদি কারণ সম্বন্ধে আত্ম শব্দের ব্যবহার করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৬)।
এখানেও
প্রশ্ন আসে। যেমন, ছান্দোগ্যে বর্ণিত হয়েছে- ‘তিনি (সৎস্বরূপ সত্তা)
সঙ্কল্প করলেন, ‘এখন আমি এই তিন দেবতায় (পূর্বোক্ত অগ্নি, জল ও ক্ষিতিতে)
জীবাত্মারূপে প্রবেশ করে নাম ও রূপে প্রকাশিত হবো’ (সেয়ং দেবতৈক্ষত
হন্তাহমিমাস্তিস্রো দেবতা অনেন জীবেনাত্মনাহনুপ্রবিশ্য নামরূপে
ব্যাকরবাণীতি)।’- (ছান্দোগ্য-৬/৩/২)। সাংখ্যবাদিরা এই দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে
চান যে, ‘আত্মা’ শব্দটি চেতন অচেতন উভয় প্রকার বস্তু বুঝাতেই ব্যবহৃত
হয়েছে, যেমন এটি ভূতাত্মা, ইন্দ্রিয়াত্মা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং তা প্রধান প্রসঙ্গেও ব্যবহৃত হতে পারে। এর উত্তরে যুক্তি খণ্ডন করে
বাদরায়ণ বলেন-
‘তন্নিষ্ঠস্য মোক্ষোপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৭)।।
‘হেয়ত্বাবচনাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৮)।।
ভাবার্থ : আত্মনিষ্ঠ ব্যক্তি মুক্ত হন, শাস্ত্রে এরূপ উপদেশ থাকায় অচেতন প্রকৃতিতে (প্রধানে) ‘সৎ’ ও ‘আত্মা’ শব্দ প্রযুক্ত হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৭)। যদি অচেতন প্রধান শ্রুতির দ্বারা সৎ প্রভৃতি শব্দের বাচ্য হতেন, তাহলে শ্রুতি এই সকলকে হেয় (ত্যাজ্য) বলে অবশ্যই উপদেশ করতেন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৮)।
বাদরায়ণের
মতে প্রধান যথার্থ আত্মা নন। এবং আলোচ্য শ্রুতিশাস্ত্রে প্রধানকে আত্মা
হিসেবে গণ্য করে এ জাতীয় কোন উক্তিরও উল্লেখ নেই। বরং বিপরীতক্রমে
ছান্দোগ্য উপনিষদের যে অধ্যায়ে এই শ্রুতি আছে তার সর্বত্রই আত্মাকে সৎ
ব্যতীত আর কিছুই বলা হয়নি। উপরন্তু এই অধ্যায়টির সূচনা হয়েছে এই প্রশ্ন
দ্বারা- ‘সেই বস্তুটি কী, যাঁকে জানলে সবই জ্ঞাত হওয়া যায় ?’-
‘যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবত্যমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতমিতি কথং নু ভগবঃ স আদেশো ভবভীতি।। (ছান্দোগ্য-৬/১/৩)।। যথা সোম্যৈকেন মৃৎপিন্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্ বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্’।। (ছান্দোগ্য-৬/১/৪)।।
অর্থাৎ :
যার দ্বারা অশ্রুতবিষয় শোনা যায়, অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়- ভগবন্, কী সেই বিষয় (ছান্দোগ্য-৬/১/৩) ? হে সৌম্য, যেমন একখন্ড মাটিকে জানলেই মাটির তৈরি সব জিনিসকে জানা যায় (তেমনি আত্মাকে জানলেই সবকিছুকেই জানা যায়)। জিনিসগুলি নামে আলাদা, কেবলমাত্র মাটিই সত্য (ছান্দোগ্য-৬/১/৪)।
বাদরায়ণের
মতে, যদি প্রধানই প্রথম কারণ হতেন তাহলে প্রধানকে জানলেই সব জানা হয়ে
যেতো। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তা হয় না। ভোক্তা (পুরুষ) তা থেকে ভিন্ন। পুরুষ
ভোগ্যবস্তুর ন্যায় প্রধান হতে উৎপন্ন নন। সুতরাং প্রধানকে জানলে পুরুষকে
জানা সম্ভব নয়। তাই শাস্ত্র ‘যাঁকে জানলে সব জানা হয়’ বলেছেন সেই প্রথম
কারণ প্রধান বা প্রকৃতি নন। আবার ছান্দোগ্য উপনিষদে দেখা যায়-
‘উদ্দালকঃ হ আরুণিঃ শ্বেতকেতুং পুত্রমুবাচ স্বপ্নান্তং মে সোম্য বিজানীহীতি যত্রৈতৎ পুরুষঃ স্বপিতি নাম সতা সোম্য তদা সম্পন্নো ভবতি স্বমপীতো ভবতি তস্মাদেনং স্বপীতীত্যাচক্ষতে স্বং হ্যপীতো ভবতি’।। (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।।
অর্থাৎ : উদ্দালক আরুণি পুত্র শ্বেতকেতুকে বললেন- সোম্য, আমার কাছ থেকে সুষুপ্তি-তত্ত্ব জানো। যখন কাউকে বলা হয় ‘ইনি ঘুমোচ্ছেন’, তখন হে সোম্য, তিনি সৎ-এর সঙ্গে একীভূত হন এবং স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হন। সেইজন্য লোকে একে ‘সুষুপ্ত’ (স্বপিতি) বলেন, কারণ তখন তিনি স্ব-স্বরূপে থাকেন (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।
এখানে
উপদেশ করা হয়েছে যে, জীবাত্মা সৎ-এর সঙ্গে মিশে এক হয়ে যান। যেহেতু
চৈতন্যবান আত্মার পক্ষে অচেতন প্রধানের মধ্যে বিলীন হওয়া অসম্ভব, সেজন্যই
শাস্ত্র যাঁকে সৎ শব্দ দ্বারা নির্দেশ করেছেন সেই প্রথম কারণ কিছুতেই অচেতন
প্রধান হতে পারেন না। তাই বাদরায়ণ বলেন-
‘স্বাপ্যয়াৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৯)।।
ভাবার্থ : ‘সুষুপ্তিকালে জীব সৎ-এ অর্থাৎ আত্মাতে লীন হয়’- এরূপ শ্রুতি থাকায় প্রধান জগতের কারণ হতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৯)।
প্রধান যদি জগৎ-কারণ না-ই হন, তাহলে জগতের প্রথম কারণ কে ? বাদরায়ণ বলেন-
‘গতিসামান্যাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।।
ভাবার্থ : সমস্ত শ্রুতিবাক্যের তাৎপর্য হতে ব্রহ্মের জগৎকারণত্ব অবগত হওয়া যায়। সুতরাং অচেতন প্রধানকে জগৎকারণ বলা যায় না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।
বাদরায়ণের এ সূত্রের অনুকুলে বিভিন্ন শ্রুতিশাস্ত্রের তাৎপর্য দেখা যেতে পারে। যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘তস্য হ বা এতস্যৈবং পশ্যত এবং মন্বানস্যৈবং বিজানত আত্মতঃ প্রাণ আত্মত আশাত্মতঃ স্মও আত্মত আকাশ আত্মতন্তেজ আত্মত আপ আত্মত আবির্ভাবতিরোভাবৌ আত্মতো অন্নমাত্মতো বলমাত্মতো বিজ্ঞানমাত্মতো ধ্যানম্ আত্মত চিত্তমাত্মতঃ সংকল্প আত্মতো মন আত্মতো বাগাত্মতো নামাত্মতো মন্ত্রা আত্মতঃ কর্মাণ্যাত্মত এবেদং সর্বমিতি’।। (ছান্দোগ্য-৭/২৬/১)।।
অর্থাৎ : এই প্রকার (ব্রহ্মজ্ঞানী) দ্রষ্টা, মননকারী ও বিজ্ঞাতার নিকট এ জগতের সবকিছুই আত্মা থেকে এসেছে। প্রাণ, আশা, স্মৃতি, আকাশ, তেজ, জল, আবির্ভাব-তিরোভাব, অন্ন, বল, বিজ্ঞান, ধ্যান, চিত্ত, সংকল্প, মন, বাক্, নাম, মন্ত্র এবং কর্মসমূহ- এ সবকিছুর উৎস হলো আত্মা (ছান্দোগ্য-৭/২৬/১)।
তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ওঁ ব্রহ্মবিদাপ্নোতি পরম্ । তদেষাহভ্যুক্তা। সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম। যো বেদ নিহিতং গুহায়াং পরমে ব্যোমন্ । সোহশ্নুতে সর্বান্ কামান্ সহ। ব্রহ্মণা বিপশ্চিতেতি।
তস্মাদ্বা এতশ্মাদাত্মন আকাশঃ সংভূতঃ। আকাশাদ্বায়ুঃ। বায়োরগ্নিঃ। অগ্নেরাপঃ। অদ্ভ্যঃ পৃথিবী। পৃথিব্যা ওষধয়ঃ। ওষধীভ্যোহন্নম্ । অন্নাৎপুরুষঃ। স বা এষ পুরুষো অন্নরসময়ঃ…’।। (তৈত্তিরীয়-২/১/১)।।
অর্থাৎ : যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি বস্তুত পরব্রহ্মকে জানেন। এই বিষয়ে একটি মন্ত্র আছে ‘সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তম্ ব্রহ্ম’ অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত। আমাদের গুহারূপ হৃদয়াকাশে (অর্থাৎ বুদ্ধিতে) তাঁর অধিষ্ঠান। যিনি হৃদয়ে এই আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তিনি যে শুধু সর্বজ্ঞ ব্রহ্মকেই উপলব্ধি করেন তা নয়, তিনি যা কামনা করেন তাই লাভ করেন।
এই আত্মা থেকে আসে আকাশ। আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী, পৃথিবী থেকে উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম, উদ্ভিদাদি থেকে খাদ্য এবং খাদ্য থেকে আসে মানুষ। বস্তুত মনুষ্যদেহ খাদ্য থেকেই উৎপন্ন (তৈত্তিরীয়-২/১/১)।
প্রশ্ন উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘আত্মন এষ প্রাণো জায়তে যথৈষা পুরুষে ছায়া এতস্মিন্ এতৎ আততং মনোকৃতেন আয়াত্যস্মিন্ শরীরে’।। (প্রশ্নোপনিষদ-৩/৩)।।
অর্থাৎ : প্রাণ আত্মা থেকে আসেন। দেহকে আশ্রয় করে যেমন ছায়া থাকে তেমনি আত্মায় প্রাণ নিহিত রয়েছেন। ইচ্ছা হলে এই প্রাণ স্থূল শরীর ধারণ করেন (প্রশ্ন-৩/৩)।
কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘যস্য ব্রহ্ম চ ক্ষত্রং চ উভে ভবত ওদনঃ।
মৃত্যুর্যস্যোপসেচনং ক ইত্থা বেদ যত্র সঃ’।। (কঠোপনিষদ-১/২/২৫)।।
অর্থাৎ : মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ; কিন্তু তাঁরাও আত্মার কাছে খাদ্যের সমান। মৃত্যুর কাছে সকলেই পরাস্ত; কিন্তু সেই মৃত্যুও আত্মার কাছে মুখরোচক খাদ্য মাত্র। আত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ। সাধারণ মানুষ তার সীমিত শক্তি দিয়ে আত্মার মহিমা বর্ণনা করতে পারে না, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরা পারেন (কঠ-১/২/২৫)।
এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন তস্য কশ্চিৎ পতিরস্তি লোকে
ন চেশিতা নৈব চ তস্য লিঙ্গম্ ।
স কারণং করণাধিপাধিপো
ন চাস্য কশ্চিজ্জনিতা ন চাধিপঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৬/৯)।।
অর্থাৎ : এই জগতে তাঁর প্রভু বলে কেউ নেই, তাঁকে শাসন করতে পারে এমন কেউ নেই, আবার এমন কোন রূপ বা চিহ্ন নেই যা দিয়ে তাঁকে চিহ্নিত করা যায়। তিনিই সবকিছুর কারণ। যে জীবাত্মা সকল ইন্দ্রিয়ের প্রভু, তিনি (ব্রহ্ম) সেই জীবাত্মারও প্রভু। তাঁর কোনও স্রষ্টা বা নিয়ন্তা নেই (শ্বেতাশ্বতর-৬/৯)।
মহর্ষি বাদরায়ণের কাছে এই আত্মা বা পরম চৈতন্যময় সত্তা ব্রহ্মই জগতের আদি কারণ। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত হলো-
‘শ্রুতত্বাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১১)।।
ভাবার্থ : ব্রহ্মই যে জগৎ-কারণ তা সমস্ত বেদই (শ্রুতি শাস্ত্রই) স্পষ্টরূপে বলেছেন। সুতরাং প্রধানের জগৎকারণত্ব সিদ্ধ হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১১)।
এবং
যুক্তিশাস্ত্রের কার্য-কারণ সম্পর্ক অনুযায়ী আদি-কারণ হিসেবে সৎ বস্তু
ব্রহ্ম যে নিজে কোন কার্য হতে পারেন না, অর্থাৎ তাঁর উৎপত্তি হতে পারে না
এর যুক্তি দেখিয়ে বাদরায়ণ বলেন-
‘অসম্ভবস্তু সতঃ, অনুপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৯)।।
ভাবার্থ : সৎবস্তু ব্রহ্মের উৎপত্তি সম্ভব নয়। কারণ সৎ-এর উৎপত্তি স্বীকার করলে- তার উৎপত্তি- তার পূর্ববর্তীর উৎপত্তি- ইত্যাদিভাবে ‘অনবস্থা’ দোষ ঘটে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৯)।
এর
মধ্য দিয়ে বাদরায়ণ এটাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান
ব্রহ্মই হলেন জগতের আদি কারণ, অচেতন প্রধান বা অন্য কিছুই আদি কারণ নন।
০২. জীবাত্মাও মূল কারণ নয় :অচেতন প্রধানকে আদি কারণ বলে স্বীকার করা না হলেও উপনিষদে (যেমন তৈত্তিরীয় উপনিষদে-২/২/১) উল্লিখিত আত্মা থেকে যে আকাশাদির উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে আত্মাকে কি মূল কারণ বলে মনে করা যেতে পারে ? এই তৈত্তিরীয় উপনিষদের দ্বিতীয় খন্ড ব্রহ্মানন্দবল্লীতেই দেখা যায়-
‘…তস্যৈষ এব শারীর আত্মা। যঃ পূর্বস্য। তস্মাদ্বা এতস্মাদ্বিজ্ঞানময়াৎ। অন্যোহন্তর আত্মাহহনন্দময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ। স বা এষ পুরুষবিধ এব। তস্য পুরুষবিধতাম্ । অন্বয়ং পুরুষবিধঃ। তস্য প্রিয়মেব শিরঃ। মোদো দক্ষিণঃ পক্ষঃ। প্রমোদ উত্তরঃ পক্ষঃ। আনন্দ আত্মা। ব্রহ্ম পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা। তদপ্যেষ শ্লোকো ভবতি’।। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ-২/৫/১)।।
অর্থাৎ :
বুদ্ধিরূপে ব্রহ্মই বিজ্ঞানময় আত্মা। এই কোষ পূর্বোক্ত মনোময় কোষের আত্মা। বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন। এই কোষের অভ্যন্তরে আনন্দময় কোষ এবং তার মধ্যে আনন্দময় আত্মা আছেন। বিজ্ঞানময় কোষ এই আনন্দময় কোষ দ্বারা পূর্ণ। আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহের অনুরূপ। বিজ্ঞানময় কোষের আকৃতি যেরকম মানুষের মতো, অনুরূপভাবে আনন্দময় কোষও মানুষের মতো। প্রিয় জিনিস দেখার যে আনন্দ তা যেন (পাখির) মাথা, প্রিয়বস্তু লাভ করার আনন্দ এর ডান দিকের ডানা, প্রিয়বস্তু ভোগ করার আনন্দ এর বাঁ দিকের ডানা, আর বিশুদ্ধ আনন্দ যেন আত্মা (দেহের মধ্যভাগ)। অদ্বয় ব্রহ্ম হলেন এর পুচ্ছ- যা এই দেহকে ধারণ করে রাখে। এই সম্পর্কে (ব্রাহ্মণে) একটি শ্লোক আছে (তৈত্তিরীয়-২/৫/১)।
এই
শ্রুতিতে মূল কারণ আত্মার ক্ষেত্রে ‘আনন্দময়’, ‘কায়যুক্ত’ ধারণা প্রযুক্ত
হওয়া থেকে বোঝা যেতে পারে যে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্ম নয় জীবাত্মা। এর উত্তরে
বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে যে, আনন্দময় এখানে জীবাত্মা নয় ব্রহ্ম, কারণ
তৈত্তিরীয় উপনিষদের এই প্রকরণ- ব্রহ্মানন্দবলীতে আনন্দ শব্দটিকে ব্রহ্মের
ক্ষেত্রেই বারংবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বাদরায়ণ বলেন-
‘আনন্দময়োহভ্যাসাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।।
‘বিকারশব্দান্নেতি চেৎ, ন, প্রাচুর্যাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)।।
‘তদ্ধেতুব্যপদেশাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৪)।।
‘মান্ত্রবর্ণিকমেব চ গীয়তে’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৫)।।
‘নেতরোহনুপপত্তে’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৬)।।
‘ভেদব্যপদেশাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৭)।।
‘কামাচ্চ নানুমানাপেক্ষা’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৮)।।
‘অস্মিন্নস্য চ তদ্যোগং শাস্তি’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৯)।।
ভাবার্থ :
ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ, এটাই শাস্ত্রসম্মত সিদ্ধান্ত এবং শাস্ত্রে পুনঃ পুনঃ এই কথাই বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)। ময় প্রত্যয় যে শুধু বিকার (যেমন, স্বর্ণ থেকে স্বর্ণালঙ্কার) বাচক নয়, তা প্রাচুর্য বা আধিক্যের জন্যেও ব্যবহৃত হয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)। ব্রহ্মই জীবের আনন্দের হেতু- শাস্ত্রে (ঐ তৈত্তিরীয়তেও) এরূপ উল্লেখ থাকায় ‘আনন্দময়’ শব্দের বাচ্য ব্রহ্মই, অংশ বা জীব নন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৪)। যে ব্রহ্মকে শাস্ত্রের মন্ত্র অংশে উল্লেখ করা হয়েছে সেই ব্রহ্মকেই এই ব্রাহ্মণ অংশে পুচ্ছ বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৫)। শ্রুতি ‘আনন্দময়’কে লক্ষ্য করে যেসব বৈশিষ্ট্যের (সর্বশক্তিমত্তা এবং সর্বজ্ঞাতা) কথা বলেছেন তা একমাত্র ব্রহ্মেই থাকা সম্ভব, জীবে বা অন্য কিছুতে নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৬)। যেহেতু ‘আনন্দময়’ ব্রহ্ম এবং জীবাত্মার ভেদ সম্পর্কে উপদেশ আছে তাই ‘আনন্দময়’ অর্থ ব্রহ্মই, জীব নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৭)। …‘তিনি কামনা করেছেন’- এখানে যে কামনার কথা আসে তা অন্য নিরপেক্ষ ব্রহ্মের স্বীয় ইচ্ছাই কারণ- শ্রুতিতে এরকমই উক্ত হওয়ায় অনুমানকল্পিত প্রধান আনন্দময় শব্দবাচ্য হতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৮)। আনন্দময়ের সংযোগে জীবও আনন্দময়ত্ব লাভ করে; শ্রুতি এরকমই বলেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৯)।
এভাবেই
আত্মা শব্দ থেকে এখানে যেমন জীবকে তার কারণ বলে মানা যায় না, তেমনি ‘ময়’
প্রত্যয়ের বিকারবাচক অর্থকে নিয়ে সাংখ্য শাস্ত্রোক্ত প্রধানকেও গ্রহণ করা
যায় না। এইভাবে উপনিষদ ব্রহ্মকেই বিশ্বসৃষ্টির আদি কর্তা মেনেছে, এটা খুবই
স্পষ্ট।
০৩. ব্রহ্মবোধক প্রাকৃতিক শব্দ :উপনিষদে ‘অন্তন’, ‘আকাশ’, ‘প্রাণ’, ‘জ্যোতি’ প্রভৃতি এমন কিছু প্রকৃতিবাচক শব্দ রয়েছে যাকে সৃষ্টিকর্তার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হলেও প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক পদার্থের ভ্রম হতে পারে। যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদে দেখা যায়-
‘অস্য লোকস্য কা গতিরিত্যাকাশ ইতি হোবাচ সর্বাণি হ বা ইমানি ভ’তান্যাকাশাদেব সমুৎপদ্যন্ত আকাশং প্রত্যন্তং যন্ত্যাকাশো হ্যেবৈভ্যো জ্যায়ানাকাশঃ পরায়ণম্’।। (ছান্দোগ্য-১/৯/১)।।
‘স এষ পরোবরীয়ানুদ্গীথঃ স এষোহনন্তঃ পরোবরীয়ো হাস্য ভবতি পরোবরীয়সো হ লোকাঞ্জয়তি য এতদেবং বিদ্বান্ পরোবরীয়াংসমুদ্গীথম্ উপাস্তে’।। (ছান্দোগ্য-১/৯/২)।।
অর্থাৎ :
শিলক শালাবত্য প্রবাহণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই পৃথিবীর আশ্রয় কী?’ প্রবাহণ বললেন, ‘আকাশ। এই সমস্ত ভূতবর্গ আকাশ থেকে উৎপন্ন হয় এবং আকাশেই লয় হয়। আকাশ এই সব কিছুর থেকে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আকাশই পরমা গতি (ছান্দোগ্য-১/৯/১)। পূর্বে উদ্গীথকে শ্রেষ্ঠ এবং অনন্ত বলা হয়েছে। যিনি উদ্গীথকে এইভাবে জেনে উপাসনা করেন, তিনি উত্তরোত্তর উচ্চতর লোকসমূহ লাভ করেন এবং মানুষ হিসেবেও ক্রমে উন্নততর হন (ছান্দোগ্য-১/৯/২)।
কিন্তু
সৃষ্টির উৎপত্তি ও প্রলয়ে বিলয়স্থল হিসেবে যে বিশেষণ আকাশের ক্ষেত্রে
প্রযুক্ত হয়েছে তা যে প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মেরই গুণ সেই ভ্রম দূর করতে বাদরায়ণ
বলেন-
‘আকাশস্তল্লিঙ্গাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২২)।।
ভাবার্থ : আকাশ অর্থ পরমাত্মা বা ব্রহ্মই। কারণ উল্লিখিত গুণগুলি ব্রহ্মেরই গুণ- অন্য কারও নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২২)।
কেননা আকাশ শব্দটি যে ব্রহ্মকেই বোঝানো হয়েছে তা অন্য শ্রুতিতেও হয়েছে, যেমন-
‘আকাশো বৈ নাম নামরূপয়োর্নির্বহিতা তে যদন্তরা তদ্ ব্রহ্ম তদমৃতং স আত্মা প্রজাপতেঃ…’।। (ছান্দোগ্য-৮/১৪/১)।।
অর্থাৎ : যিনি আকাশ এই নামে প্রসিদ্ধ তিনিই নাম ও রূপকে প্রকাশ করেন। যিনি এই নাম ও রূপের অভ্যন্তরে আছেন তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই আত্মা (ছান্দোগ্য-৮/১৪/১)।
আবার, ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রাণের মাহাত্ম্য বর্ণনার আখ্যানভাগে দেখা যায়-
‘অথ হৈনং প্রস্তোতোপসসাদ প্রস্তোতর্যা দেবতা প্রস্তাবমন্বায়ত্তা তাঞ্চেদবিদ্বান্ প্রস্তোষ্যসি মূর্ধা তে বিপতিষ্যতীতি মা ভগবানবোচৎ কতমা সা দেবতেতি’।। (ছান্দোগ্য-১/১১/৪)।।
‘প্রাণ ইতি হোবাচ সর্বাণি হ বা ইমানি ভূতানি প্রাণমেবাভিসংবিশন্তি প্রাণমভ্যুজ্জিহতে সৈষা দেবতা প্রস্তাবমন্বায়ত্তা তাঞ্চেদবিদ্বান্ প্রস্তোষ্যো মূর্ধা তে ব্যপতিষ্যৎ তথোক্তস্য ময়েতি’।। (ছান্দোগ্য-১/১১/৫)।।
অর্থাৎ :
প্রস্তোতা তখন তাঁর (উষস্তির) কাছে এসে বললেন ‘হে দেব, আপনি আমাকে বলেছিলেন, “হে প্রস্তোতা, প্রস্তাবের উদ্দিষ্ট দেবতা সম্পর্কে কিছুই না জেনে যদি তুমি তাঁর সম্বন্ধে সামগান করো তাহলে তোমার মুন্ডপাত হবে।” অনুগ্রহ করে বলুন সেই দেবতা কে?’- (ছান্দোগ্য-১/১১/৪)। উষস্তি বললেন, ‘তিনি প্রাণ। আমাদের চারপাশে (স্থাবর-জঙ্গম) যা কিছু আছে, সবই (প্রলয়কালে) সম্পূর্ণভাবে প্রাণে বিলীন হয় এবং (প্রকাশের সময়) তারা প্রাণ থেকেই উদ্গত হয়। প্রাণ দেবতার উদ্দেশ্যেই প্রস্তাব গান নিবেদিত। আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে, প্রস্তাবের উদ্দিষ্ট দেবতাকে না জেনে যদি তুমি স্তুতি করতে, তাহলে অবশ্যই তোমার মুন্ডপাত হতো (ছান্দোগ্য-১/১১/৫)।
এই
উপনিষদে প্রাণ বলতে কি জীবনীশক্তিকে বোঝানো হয়েছে, না কি ব্রহ্মকেই বোঝানো
হয়েছে ? ‘তিনিই প্রাণের প্রাণ’-(বৃহদারণ্যক-৪/৪/১৮) বা ‘…ব্রহ্ম থেকে
বিবিধ বস্তুর উদ্ভব হয়, এবং সেগুলি আবার ব্রহ্মেই লোপ
পায়’-(মুন্ডকোপনিষদ-২/১/১) জাতীয় শ্রুতিগুলি যেহেতু ব্রহ্মেরই লক্ষণ বোঝায়,
তাই এখানে প্রাণ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে এই বিরোধ নিষ্পত্তি করতে মহর্ষি
বাদরায়ণ বলেন-
‘অত এব প্রাণঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৩)।।
ভাবার্থ : প্রাণ শব্দও ব্রহ্মবাচকই, কারণ ঐসব লক্ষণ ব্রহ্মেরই, প্রাণবায়ুর হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৩)।
একইভাবে ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্যত্র দেখা যায়-
‘অথ যদতঃ পরো দিবো জ্যোতির্দীপ্যতে বিশ্বতঃ পৃষ্ঠেষু সর্বতঃ পৃষ্ঠেষ্বনুত্তমেষূত্তমেষু লোকেষ্বিদং বাব তদ্যদিদমস্মিন্নন্তঃ পুরুষে জ্যোতিঃ’।। (ছান্দোগ্য-৩/১৩/৭)।।
অর্থাৎ : অতঃপর এই দ্যুলোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, বিশ্বের উপরে, সব কিছুর উপরে, সর্বোত্তম লোকে, যেই লোকের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোন লোক নেই, সেখানে যে জ্যোতি দীপ্তি পায়, সেই একই জ্যোতি মানুষের দেহের অভ্যন্তরেও দীপ্যমান (ছান্দোগ্য-৩/১৩/৭)।
ছান্দোগ্যে
সাধক পুরুষকে সেই জ্যোতির ধ্যান করার কথা বলা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন আসে, এই
জ্যোতি কি সাধারণ আলোক ? এই বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বাদরায়ণ বলেন-
‘জ্যোতিশ্চরণাভিধানাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৪)।।
ভাবার্থ : জ্যোতি শব্দও ব্রহ্মবোধক, কারণ পরে চরণ বা পাদ শব্দের উল্লেখ রয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৪)।
অর্থাৎ,
এই জ্যোতি মানুষের দৃষ্টির সহায়ক প্রাকৃত আলোক নয়, এই জ্যোতি বলতে
ব্রহ্মকেই বোঝানো হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তী কোন শ্রুতিতে চরণ (পাদ) শব্দের
উল্লেখ আছে, যেমন-
‘সৈষা চতুষ্পদা ষড়বিধা গায়ত্রী তদেতদৃচাভ্যনূক্তম্’।। (ছান্দোগ্য-৩/১২/৫)।।
‘তাবানস্য মহিমা ততো জ্যায়াংশ্চ পুরুষঃ।
পাদোহস্য সর্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি ইতি’।। (ছান্দোগ্য-৩/১২/৬)।।
অর্থাৎ :
এই গায়ত্রী চারপাদ বিশিষ্ট (ভূত, পৃথিবী, শরীর ও হৃদয়) ও প্রতিটি পাদ ছয় প্রকার (বাক্, সর্বভূত, পৃথিবী, শরীর, হৃদয় ও প্রাণ)। ঋকমন্ত্রেও একথা বলা হয়েছে (ছান্দোগ্য-৩/১২/৫)। এই গায়ত্রী-ব্রহ্মের মহিমা যে পরিমাণ, সর্বব্যাপী পূর্ণব্রহ্ম পুরুষের মহিমা এর থেকেও ব্যাপক ও মহত্তর। সর্বভূত এই পুরুষের এক পাদ মাত্র। অবশিষ্ট তিন পাদ স্বর্গে অমৃতরূপে প্রতিষ্ঠিত (ছান্দোগ্য-৩/১২/৬)।
বাদরায়ণের
মতে মূল কথা হলো, শ্রুতির যে অংশে (ছান্দোগ্য-৩/১৩) এই ব্রহ্মবোধক জ্যোতির
কথা বলা হয়েছে, তাঁকেই এই শ্রুতির প্রথমাংশেও স্বীকার করা হয়েছে। সেখানেও
যে জ্যোতির কথা বলা হয়েছে সেই জ্যোতিও স্বর্গের সঙ্গে যুক্ত। ব্রহ্ম যে
শুধু পূর্বোক্ত শ্রুতিরই বিষয়বস্তু তা-ই নয়, পরবর্তী শ্রুতিতেও ব্রহ্মেরই
বিষয় আলোচিত হয়েছে। কেননা আলোচ্য অংশের অব্যবহিত পরের (ছান্দোগ্য-৩/১৪)
শ্রুতিতেও ব্রহ্মই হলেন মুখ্য বিষয়। যেমন-
‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি শান্ত উপাসীত। অথ খলু ক্রতুময়ঃ পুরুষো যথাক্রতুরস্মিঁল্লোকে পুরুষো ভবতি তথেতঃ প্রেত্য ভবতি স ক্রতুং কুর্বীত’।। (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১)।।
অর্থাৎ : জগতে যা কিছু আছে সবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম থেকেই সব আসে, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। সবকিছু ব্রহ্মকেই আশ্রয় করে আছে। অতএব, শান্তভাবে ব্রহ্মকে ধ্যান করা উচিত। প্রতিটি মানুষের মন স্বতন্ত্র। ইহজগতে যার যা ভাব, মৃত্যুর পরে মানুষ তাই হয়ে যায়। একথা মনে রেখে তদনুসারে ধ্যান করবে (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১)।
বাদরায়ণ
মতে, জ্যোতি শব্দটি ব্রহ্মের দ্যোতক হিসেবেই ব্যবহার করা যায়, কারণ ব্রহ্ম
যেমন জগৎকে প্রকাশ করেছেন জ্যোতিও তেমনি সমস্ত বস্তুকে প্রকাশ করে থাকে।
‘জ্যোতি’ এই সসীম বিশেষণকে ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে শুধুমাত্র
উপাসনার জন্য। তাই বাদরায়ণ বলেন-
‘ছন্দোহভিধানান্নেতি চেৎ, ন তথা চেতোহর্পণনিগদাৎ, তথা হি দর্শনম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৫)।।
‘ভূতাদিপাদব্যপদেশোপপত্তেশ্চৈবম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৬)।।
‘উপদেশভেদান্নেতি চেৎ, ন, উভয়স্মিন্নপ্যবিরোধাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৭)।।
অর্থাৎ :
গায়ত্রী ছন্দের উল্লেখ থাকায় জ্যোতিঃশব্দ ব্রহ্মবোধক নয় এরূপ আশঙ্কার কোন কারণ নেই। কারণ তাতে মনোনিবেশের যে কথা আছে তার অর্থ হলো গায়ত্রী ছন্দের দ্বারা ব্রহ্মে মনোনিবেশ করতে হবে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৫)। কেবল চিত্ত সমাধানের কথা আছে বলেই নয়; এই গায়ত্রীকে ভূত, পৃথিবী, শরীর এবং হৃদয় এরূপ চারপাদসম্পন্ন বলাতেও গায়ত্রীর অর্থ এখানে ব্রহ্মই (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৬)। উপদেশের ভিন্নতাহেতু তা ব্রহ্ম নয় এমন আশঙ্কার কোন কারণ নেই। কারণ ঐ দ্বিবিধ উপদেশের অর্থ প্রকৃতপক্ষে একই (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৭)।
অতএব, জ্যোতি শব্দটিকে ব্রহ্ম অর্থেই বুঝতে হবে।
০৪. উপনিষদে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট জীববাচী শব্দও ব্রহ্মকে বোঝায় :বিভিন্ন উপনিষদের মতোই যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে-
মনোময়ঃ প্রাণশরীরো ভারূপঃ সত্যসঙ্কল্প আকাশাত্মা সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ সর্বমিদম্ অভ্যত্তঃ অবাক্যনাদরঃ।। (ছান্দোগ্য-৩/১৪/২)।।
অর্থাৎ : মনই তাঁর সকল কর্মের নিয়ন্তা। সূক্ষ্মশরীর তাঁর দেহ, জ্যোতির্ময় তাঁর রূপ। তাঁর সঙ্কল্প কখনও ব্যর্থ হয় না। আকাশের মতো সর্বব্যাপী ও নিষ্কলঙ্ক তাঁর আত্মা। এই সমুদয় জগৎ তাঁরই সৃষ্টি। জগতে যতো বাসনা আছে সব বাসনার উৎস তিনি। তিনিই আবার সকল প্রকার গন্ধ ও সর্বরসের আধার। সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত করে তিনি রয়েছেন। তিনি সব ইন্দ্রিয়বর্জিত ও সকল বাসনামুক্ত (ছান্দোগ্য-৩/১৪/২)।
বাদরায়ণের
মতে, এরকম বিভিন্ন শ্রুতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, উপনিষদের ঋষিরা
ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য কিছু আত্মাবাচক শব্দ প্রয়োগ করেছেন। এসব শব্দের জন্য
উপনিষদ আত্মাকেই জন্মাদির কারণ তথা উপাস্য বলে মানে এমন ভ্রম যেন না হয়।
এগুলির মধ্যে কিছু শব্দ স্পষ্টত জীব (আত্মা) বাচক শব্দ নয়। মনোময়, অত্তা
(ভক্ষক), অন্তর (ভিন্ন), অন্তর্যামী, অদৃশ্য, বৈশানর এরকম ব্যবহৃত শব্দ
যেগুলি কয়েকবারই আত্মাকে বোঝাতে প্রযুক্ত হলেও এমন স্থানও আছে যেখানে
সেগুলি ব্রহ্মের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে, এজন্য বিরোধ ঘটেছে বলে ভ্রম
না হওয়াই উচিত বলে বাদরায়ণ মনে করেন। তাই সূত্রকার বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের
প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে এই অস্পষ্ট জীববাচক শব্দ নিয়ে আলোচনার মধ্যে
এই ছয়টি শব্দকে ব্রহ্মবাচী বলে দাবি করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ব্রহ্মসূত্রের
কিছু নমুনা দেখা যেতে পারে-
‘সর্বত্র প্রসিদ্ধোপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১)।।
‘বিবক্ষিতগুণোপপত্তেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২)।।
‘অনুপপত্তেস্তু ন শারীরঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/৩)।।
‘অত্তা চরাচরগ্রহণাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/৯)।।
‘প্রকরণাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১০)।।
‘অন্তর্যামী, অধিদৈবাদিষু তদ্ধর্মব্যপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১৮)।।
‘বৈশ্বানরঃ সাধারণশব্দবিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২৪)।।
‘অদৃশ্যত্বাদিগুণকো ধর্মোক্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২১)।।
ভাবার্থ :
ব্রহ্মের যেসব লক্ষণ (মনোময়ত্ব, কারণত্ব ইত্যাদি) শ্রুতিতে সর্বত্র আছে, এখানেও তারই উপদেশ রয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১)। উপাস্যের যেসব গুণ থাকা শাস্ত্রোপদিষ্ট এবং বাঞ্ছিত, এখানেও সেসব গুণের কথাই বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২)। পূর্বোক্ত গুণসকল শারীর জীবাত্মায় সম্ভব নয় বলেও এখানে ব্রহ্মই উপদিষ্ট হয়েছেন বুঝতে হবে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/৩)। শ্রুতিতে যে তাঁকে অত্তা (ভোক্তা) বলা হয়েছে- তা কর্মফল ভোক্তা নয়- তিনি চরাচর জগতের সংহার কর্তা, এই অর্থে তাঁকে অত্তা বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/৯)। শ্রুতির যে প্রকরণে ‘অত্তা’ শব্দ উল্লিখিত হয়েছে তা ব্রহ্মপ্রকরণ; সুতরাং ‘অত্তা’ অর্থ ব্রহ্মই, জীব নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১০)। ‘অধিদৈবত’- ‘অধিলোক’ ইত্যাদি শ্রুতিতে যিনি ‘অন্তর্যামী’ বলে বর্ণিত, তিনি পরমাত্মাই, কারণ পরমাত্মার গুণসমূহই তাতে বর্ণিত হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১৮)। বৈশ্বানর শব্দও পরমাত্মাবাচক, কারণ সাধারণ অর্থ ব্যতীত এখানে তার বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২৪)। মুণ্ডক উপনিষদে যাঁকে অদৃশ্য, অগ্রাহ্য ইত্যাদি গুণবিশিষ্ট বলা হয়েছে তিনি ব্রহ্ম, কারণ শ্রুতি তাঁকে সর্বজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২১)।
উল্লেখ্য, মুণ্ডক উপনিষদে ব্রহ্ম সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য শ্রুতিটি হচ্ছে-
‘যত্তৎ অদ্রেশ্যম্ অগ্রাহ্যম্ অগোত্রম্ অবর্ণম্ অচক্ষুঃশ্রোত্রং তৎ অপাণিপাদম্ ।
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ’।। (মুণ্ডক-১/১/৬)।।
‘যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ।
তস্মাদেতদ্ ব্রহ্ম নাম রূপমন্নং চ জায়তে’।। (মুণ্ডক-১/১/৯)।।
অর্থাৎ :
যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), স্বয়ম্ভূ, অরূপ, সকল ইন্দ্রিয়ের উর্ধ্বে অবিনাশী এবং সর্বব্যাপী এবং যিনি সূক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির উৎস- সেই ব্রহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন (মুণ্ডক-১/১/৬)। যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে (মুণ্ডক-১/১/৯)।
বাদরায়ণের
ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে বলা হয়েছে যে, উপনিষদে স্পষ্ট
জীববাচক শব্দও ব্রহ্ম অর্থে প্রযুক্ত। দ্যুলোক ও ভূলোকে অধিষ্ঠিত ভূমা
(অনেক), অন্তর ও ইক্ষণকারী, ক্ষুদ্র অঙ্গুষ্ঠমাত্র, দেবগণের মধু, অঙ্গুষ্ঠ,
আকাশ প্রভৃতির ন্যায় জীবাত্মা-বাচক বেশ কয়েকটি শব্দই উপনিষদে এসেছে এবং
তাতেও ‘জন্মাদিকর্তা’র মতো বিশেষণ আছে, তৃতীয় পাদে একেই ব্রহ্মবাচক বলে
সিদ্ধ করে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। যেমন-
‘দ্যুভ্বাদ্যায়তনং স্ব-শব্দাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১)।।
‘ভূমা সংপ্রসাদাদধ্যুপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৮)।।
‘ধর্মোপপত্তেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৯)।।
‘অক্ষরমম্বরান্তধৃতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১০)।।
‘ঈক্ষতিকর্মব্যপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১৩)।।
‘দহর উত্তরেভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১৪)।।
‘ভাবং তু বাদরায়ণঃ, অস্তি হি’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)।।
‘শব্দাদেব প্রমিতঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৪)।।
‘হৃদ্যপেক্ষয়া তু মনুষ্যাধিকারত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৫)।।
অর্থাৎ :
স্বর্গলোক, পৃথিবী প্রভৃতির আধার বলে শ্রুতি যাঁকে বর্ণনা করেছেন তিনিই ব্রহ্ম। কারণ ব্রহ্মবাচক ‘আত্মা’ শব্দ ঐ শ্রুতি তাঁর সম্বন্ধে প্রয়োগ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১)। ভূমা শব্দের বাচ্য প্রাণ নয়- ব্রহ্ম। কারণ শ্রুতি প্রাণের উপরে এই ভূমার স্থিতি উপদেশ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৮)। ভূমার যেসব গুণ ও ধর্ম উল্লিখিত হয়েছে তা একমাত্র পরমাত্মাতেই সম্ভব, তাই ভূমা অর্থ এখানে পরমাত্মা-ই (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৯)। অক্ষর অর্থ ব্রহ্ম, কারণ আকাশ পর্যন্ত সমস্ত পদার্থকেই তিনি ধারণ করে আছেন- শ্রুতিতে এরূপ উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১০)। ঈক্ষণ অর্থাৎ দর্শনক্রিয়ার কর্মরূপে যে ধ্যেয় পুরুষের কথা বলা হয়েছে, তিনি কার্য ব্রহ্ম নন, তিনি পরব্রহ্ম (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১৩)। ছান্দোগ্য উপনিষদে যে দহরাকাশের কথা আছে, তা ব্রহ্মই- কারণ পরবর্তী শ্রুতিতে এমনই উপদেশ করা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১৪)। ঋষি বাদরায়ণ বলেন যে, সূর্যাদি দেবতারও মধুবিদ্যায় অধিকার আছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)। শ্রুতিশাস্ত্রেও শব্দ থেকেই জানা যায় যে, তিনি ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্র’-পরিমিত পুরুষ (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৪)। শাস্ত্রপাঠে এবং উপাসনায় একমাত্র মানুষেরই অধিকার, তাই সকল মানুষের হৃদয়ের পরিমাণ অনুসারে উপাসনার নিমিত্ত তাঁকে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৫)।
উল্লেখ্য, অঙ্গুষ্ঠমাত্র-পরিমিত পুরুষ সম্পর্কিত কঠোপনিষদের সেই উল্লেখযোগ্য শ্রুতিটি হলো-
‘অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি।
ঈশানো ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে। এতদ্বৈ তৎ’।। (কঠ-২/১/১২)।।
অর্থাৎ : অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ পুরুষরূপে যিনি শরীর মধ্যে অবস্থিত তিনিই ত্রিকালের নিয়ন্তা। সাধক যখন ব্রহ্মকে জানেন তখন তিনি নিজেকে আর গোপন করেন না। তিনিই সেই আত্মা (কঠ-২/১/১২)।
এইভাবে
ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম তিন পাদে ব্রহ্মই জিজ্ঞাস্য তথা
জ্ঞাতব্য, এবং উপনিষদে একে বলা হয়েছে জন্ম-স্থিতি-প্রলয়ের কারক, তা সমর্থন
করে সূত্রকার বাদরায়ণ পারস্পরিক বিরোধ দূর করেছেন। বেদান্তসূত্রে উপনিষদের
যেসব শ্রুতির ওপর অধিক বিতর্ক করা হয়েছে, তা হলো- কঠ, মুণ্ডক, তৈত্তিরীয়,
ঐতরেয়, প্রশ্ন, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, কৌষীতকি। যার মধ্যে ছান্দোগ্যের
উক্তিই অধিকতর বিতর্কের বিষয় হয়েছে।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ] [*] [পরের পর্ব : বাদরায়ণের দার্শনিক মত]
…
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ] [*] [পরের পর্ব : বাদরায়ণের দার্শনিক মত]
…
No comments:
Post a Comment