Wednesday, February 5, 2014

| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৫ : বেদান্তের অনুবন্ধ |

.
| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৫ : বেদান্তের অনুবন্ধ |
রণদীপম বসু

১.৪ : বেদান্তের অনুবন্ধ :
.
বেদান্ত মতে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ভিন্ন মুক্তি হয় না। কিন্তু ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ব্রহ্মবিচার সাপেক্ষ। এই ব্রহ্মবিচার মননাত্মক। ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের জন্যই বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মবিচার প্রদর্শিত হয়েছে। তাই বেদান্তদর্শনের অপর নাম ব্রহ্মবিচারশাস্ত্র। তবে বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকেরা কিছু পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, যা অবগত থাকা আবশ্যক। বেদান্ত আলোচনার এই পূর্ব-প্রস্তুতির পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবন্ধ’।


‘অনুবন্ধ’ শব্দের অর্থ হলো নিমিত্ত। যে নিমিত্তে কোন শাস্ত্রেও আলোচনা করা হয়, সেই নিমিত্তই ঐ শাস্ত্রের অনুবন্ধ। বেদান্তে এই অনুবন্ধ চারপ্রকার- অধিকারী, বিষয়, সম্বন্ধ ও প্রয়োজন। এই চারপ্রকার অনুবন্ধ একসঙ্গে ‘অনুবন্ধ চতুষ্টয়’ নামে পরিচিত।


যে ব্যক্তি বেদান্তশাস্ত্র আলোচনা করার যোগ্যতা ও ক্ষমতাবিশিষ্ট, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু হলো এই শাস্ত্রের বিষয়। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বস্তুর সঙ্গে এই শাস্ত্রের সম্পর্ক বা যোগসূত্র হলো সম্বন্ধ। সবশেষে বেদান্তশাস্ত্র আলোচনার উদ্দেশ্য ও ফল হলো এই শাস্ত্রের প্রয়োজন। বলা হয়, এই চারপ্রকার পূর্ব-প্রস্তুতির অভাবে বেদান্তশাস্ত্রের আলোচনা নিরর্থক। তাই বেদান্তশাস্ত্রের এই চারটি পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকা আবশ্যক।
অধিকারী : ‘অধিকারী’ বলতে এখানে বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনের অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যিনি বেদান্তশাস্ত্রের বিষয় বুঝতে, শাস্ত্রের নির্দেশ যত্নসহকারে পালন করতে এবং সদা সৎকর্মে ব্যাপৃত থাকতে সক্ষম, তিনিই বেদান্ত দর্শনের মর্মকথা অনুধাবনের অধিকারী। এজন্যেই অধিকারীকে প্রথমত ব্রহ্মচর্যাদির অনুষ্ঠানপূর্বক শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং ছন্দঃশাস্ত্র, এই ছয়টি অঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন করবে। এভাবে বেদ অধীত হলে আপাতত বেদার্থের অবগতি হবে। কাম্যকর্ম ও নিষিদ্ধকর্মের অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভোগের জন্য শরীর-পরিগ্রহ বা জন্ম অবশ্যম্ভাবী। শরীরপরিগ্রহ এবং কর্মফলভোগ, উভয়ই বন্ধনের হেতু বা বন্ধন। বন্ধনাবস্থায় মুক্তি অসম্ভব। কারণ, বন্ধন ও মুক্তি পরস্পরবিরুদ্ধ। অতএব কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করবে। এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করবে। তাই ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি বিধিপূর্বক বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করে তার মূলমর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইহজন্মে বা জন্মান্তরে কাম্য কর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগপূর্বক কেবল নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হয়েছেন, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তের অধিকারী সাধন-চতুষ্টয়ের অনুসরণ করে থাকেন। এই সাধন-চতুষ্টয় হলো- (১) বিবেক, (২) বৈরাগ্য, (৩) সাধন-সম্পত্তি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব।
‘বিবেক’ বলতে বোঝায় নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক। অর্থাৎ কোন্ বস্তু নিত্য, কোন্ বস্তু অনিত্য, নিত্য ও অনিত্য বস্তুর ভেদ কী প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানই হলো বিবেকজ্ঞান। এই জ্ঞানের দ্বারাই কোন্ বস্তু গ্রহণীয় এবং কোন্ বস্তু বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। ‘বৈরাগ্য’ বলতে বোঝায় ঐহিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার সুখের প্রতি বিরাগ। ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। ‘মুমুক্ষুত্ব’ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি তথা মোক্ষলাভের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা।

এখানে উল্লেখ্য, আত্মসাক্ষাৎকারের উপযোগী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং তার অনুকুল বিষয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয় থেকে অন্তঃকরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহের নাম শম, এবং এসব বিষয় থেকে বাহ্যকরণ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহকে দম বলা হয়। উপরতি হলো সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণপূর্বক শাস্ত্রবিহিত কার্যকলাপ পরিত্যাগ। তিতিক্ষা হলো শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান ইত্যাদি পরস্পরবিরুদ্ধ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও কষ্টসহিষ্ণু থাকা। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি এবং তার অনুকুল বিষয়ে মনের সমাধি বা একাগ্রতা অর্থাৎ তৎপরতার নাম সমাধান। আর গুরুবাক্য এবং বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয়।
বিষয় : প্রতিটি শাস্ত্রেরই প্রতিপাদ্য বিষয় আছে। শাস্ত্রের কোন বিষয় না থাকলে তা পাঠ করা নিষ্প্রয়োজন। বেদান্তশাস্ত্রের বিষয়কে তাই বেদান্তের দ্বিতীয় অনুবন্ধ বলা হয়েছে। বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় বিভিন্ন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্ত-সম্প্রদায়ের মতে বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান।
সম্বন্ধ : প্রতিপাদক শাস্ত্র বা শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে প্রতিপাদ্য বিষয়ের সম্বন্ধই হলো বেদান্তশাস্ত্রের তৃতীয় অনুবন্ধ। এই সম্বন্ধের স্বরূপ হলো প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক বা বোধ্য-বোধক ভাবরূপ।
প্রয়োজন : বেদান্ত শাস্ত্রের প্রয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণভাবে শাশ্বত মুক্তিই বেদান্তশাস্ত্রের প্রয়োজন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্তমতে অবিদ্যার সমূলনিবৃত্তি এবং আনন্দময় ব্রহ্মস্বরূপপ্রাপ্তিই হলো বেদান্তশাস্ত্র পাঠের ফলস্বরূপ প্রয়োজন।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা] [*] [পরের পর্ব : বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ]

No comments: