Thursday, February 13, 2014

| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৬ : বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ |

.
| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৬ : বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ |
রণদীপম বসু

২.০ : বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ
বেদান্তের ব্রহ্ম বিষয়ক তত্ত্ব ও বিবিধ ধারণার উৎস উপনিষদ হলেও একই বিষয়ে বিভিন্ন উপনিষদগুলির নিজস্ব ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন ঋষির মধ্যে উপলব্ধ সত্য সম্পর্কে পারস্পরিক যে আপাত বিরোধ দেখা দেয়, তা নিরসনকল্পে উপনিষদগুলির মধ্যে নিহিত চিন্তাগুলিকে সমন্বয় করে সুশৃঙ্খলভাবে সংবদ্ধ করার প্রয়োজনে মহর্ষি বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র রচনা করেন। এই ব্রহ্মসূত্রই ব্রহ্মবাদ বা বেদান্তদর্শনের মূল সূত্রগ্রন্থ। ব্রহ্মসূত্রের অতিসংক্ষিপ্ত শ্লোকবিশিষ্ট সূত্রগুলি স্বাভাবিকভাবেই অতি দুর্বোধ্য হওয়ার কারণে পরবর্তীকালে সূত্রগুলির ব্যাখ্যাকল্পে বিভিন্ন আচার্য কর্তৃক যেসব ভাষ্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে তাতে বেদান্ত ভাষ্যকারদের নিজস্ব বিশ্বাস, ধারণা ও মতভেদ অনুযায়ী অধিকারীভেদে বিভিন্ন উপসম্প্রদায়েরও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু উপনিষদগুলি যেহেতু পূর্বাপর কোন একটি বিশেষ মতবাদের শিক্ষা দেয়নি, বরং আধ্যাত্মিক সাধনার বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যক্তির উপযোগী বিভিন্ন প্রকার মতবাদই উপনিষদগুলিতে স্থান পেয়েছে, তাই বিভিন্ন উপনিষদের মধ্যে একটি মূলগত ঐক্য আছে বলে বাদরায়ণ মনে করেন। এই মূলগত ঐক্যই হলো ব্রহ্মবাদ। এই ব্রহ্মবাদকে কেন্দ্র করেই মহর্ষি বাদরায়ণ কয়েকটি মূল সূত্র সংবদ্ধ করেন। এবং এই সূত্রগুলি ঘিরেই তার ব্যাখ্যা-বিস্তৃতি হিসেবে বাকি সব সূত্র-সমন্বয়ে গোটা ব্রহ্মসূত্র রচিত।


সমগ্র ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে প্রথম অধ্যায়ের প্রথম চারটি সূত্র চতুঃসূত্র বা সূত্রচতুষ্টয় নামে পরিচিত। এই চারটি সূত্রকেই ব্রহ্মসূত্রের প্রধান ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সূত্র বলে মনে করা হয়। এমনও বলা হয় যে, চতুঃসূত্রীর সঠিক উপলব্ধি হলেই সমগ্র ব্রহ্মসূত্রের উপলব্ধি হবে। এই চারটি সূত্র হলো-


(১) ‘অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১)।।
ভাবার্থ : যজ্ঞাদি ক্রিয়ার ফল ক্ষণস্থায়ী জানার পর আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজনীয় গুণগুলি অর্জন করে সর্বপ্রকার সংশয় মুক্ত হয়ে ‘অতঃপর এখান থেকে ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’ শুরু হলো।
(২) ‘জন্মাদ্যস্য যতঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২)।।
ভাবার্থ : জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যাঁর থেকে ঘটে, তিনিই ব্রহ্ম।
(৩) ‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩)।।
ভাবার্থ : ব্রহ্ম সম্পর্কিত যথার্থ জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় উপনিষদ শাস্ত্র, কারণ শাস্ত্রই তার প্রমাণ এবং তা সর্বসম্মত।
(৪) ‘তত্ত্ব সমন্বয়াৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৪)।।
ভাবার্থ : কারণ ব্রহ্ম হলেন সেই উপনিষদ শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়।
মহর্ষি বাদরায়ণ তাঁর ব্রহ্মসূত্রে সর্বসমন্বয় প্রমাণ করতে গিয়ে একদিকে যেমন উপনিষদগুলির অভ্যন্তরীণ বিরোধ পরিহার করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ভিন্ন ভিন্ন উপনিষদ-বক্তা যে ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ উপদেশ দিয়েছেন, সেসবই এক ব্রহ্মের বিষয়ে। মোটকথা, ব্রহ্ম, জীব, জগৎ ইত্যাদি সম্বন্ধে নিজ সিদ্ধান্ত কী, এবং বিরোধী দার্শনিক সিদ্ধান্ত যে যুক্তিসঙ্গত নয় এই হলো বেদান্তসূত্রের প্রতিপাদ্য।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : বেদান্তের অনুবন্ধ] [*] [পরের পর্ব : উপনিষদের বিরোধ নিষ্পত্তি]

1 comment:

obaidulla said...

ধন্যবাদ, লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো | আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। আমার মানে হয় এই ছোট তথ্যটি আপনার উপকারে আসতে পারে Rent Houses