| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১১ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- জীব বা আত্মা |
রণদীপম বসু
…
২.২.০৪. জীব বা আত্মা :
.
বাদরায়ণের মতে ব্রহ্ম থেইে জগৎ সৃষ্ট। জগতের মতো আত্মাও ব্রহ্মের শরীর, ব্রহ্ম উভয়েরই অন্তর্যামী আত্মা- এটিই বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদের ভিত্তি বলে মনে করা হয়। ব্রহ্ম ও জগতের অতিরিক্ত তৃতীয় আর একটি বস্তু আছে, বাদরায়ণ যার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, তা হলো জীবাত্মা। এই জীবাত্মা বহুসংখ্যক। জীবাত্মাতে ব্রহ্ম স্বরূপেই কূটস্থ এবং নিত্য। আর জগৎ স্বরূপে নয়, প্রবাহে অনাদি। একে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সূত্রকার বলেন-
রণদীপম বসু
…
২.২.০৪. জীব বা আত্মা :
.
বাদরায়ণের মতে ব্রহ্ম থেইে জগৎ সৃষ্ট। জগতের মতো আত্মাও ব্রহ্মের শরীর, ব্রহ্ম উভয়েরই অন্তর্যামী আত্মা- এটিই বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদের ভিত্তি বলে মনে করা হয়। ব্রহ্ম ও জগতের অতিরিক্ত তৃতীয় আর একটি বস্তু আছে, বাদরায়ণ যার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, তা হলো জীবাত্মা। এই জীবাত্মা বহুসংখ্যক। জীবাত্মাতে ব্রহ্ম স্বরূপেই কূটস্থ এবং নিত্য। আর জগৎ স্বরূপে নয়, প্রবাহে অনাদি। একে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সূত্রকার বলেন-
‘নাত্মা, অশ্রুতের্নিত্যত্বাচ্চ তাভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭)।।
ভাবার্থ : জীবাত্মা উৎপন্ন হন একথা শ্রুতি বলেননি। বরং আত্মার নিত্যত্ব ও অজত্ব বিষয়ে শ্রুতি বলেছেন (ব্রঃ-২/৩/১৭)।
যেমন, শ্রুতিতে রয়েছে- ‘এই জন্মরহিত মহান আত্মা’ (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২৫)। কিংবা কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’।। (কঠোপনিষদ-১/২/১৮)।।
অর্থাৎ : আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার কোন উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকেও কোন বস্তু উৎপন্ন হয় না। আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। দেহের নাশ হয়, কিন্তু আত্মা অবিনাশী (কঠ-১/২/১৮)।
এখানে
আত্মা অর্থে জীবাত্মাকেই বোঝানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে, এই জন্মরহিত আত্মা
নিত্য বা অবিনাশী হলে তার সাথে জগতের আদি-কারণ পরমাত্মা ব্রহ্মের সম্বন্ধ
বা পার্থক্য কীরূপ ? কেননা, শ্রুতিশাস্ত্র জুড়ে উপনিষদগুলিতে আত্মাকে
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে সার্বিক অর্থে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে করে পরমাত্মা
ও জীবাত্মাকে বোঝাতে গিয়ে যে দ্ব্যর্থবোধক বিভ্রান্তি বা বিরোধ তৈরি হয়েছে
তা নিষ্পত্তিকল্পে সূত্রকার বাদরায়ণকে সেগুলির জন্য বহু ব্যাখ্যাও হাজির
করতে হয়েছে। এবং আত্মা বা জীবাত্মার সঙ্গে সর্বব্যাপী ব্রহ্ম বা পরমাত্মার
ভেদ ও অভেদও চিহ্নিত করতে হয়েছে। যেমন একটি শ্রুতিতে আছে-
‘নিত্যঃ অনিত্যানাং চেতনশ্চেতনানামেকো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্ ।
তমাত্মস্থং যঃ অনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষাম্’।। (কঠোপনিষদ-২/২/১৩)।।
অর্থাৎ : সকল অনিত্যের মধ্যে যিনি নিত্য, সকল চেতন বস্তুর মধ্যে যিনি স্বয়ং চৈতন্য এবং যিনি একমাত্র সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণে সক্ষম, তিনিই পরমাত্মা। যে সব প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি এই পরমাত্মাকে নিজ আত্মারূপে দর্শন করেন, কেবল তাঁরাই মনে অপার শান্তি লাভ করেন। অন্যেরা এই শান্তি থেকে বঞ্চিত হন (কঠ-২/২/১৩)।
পরমাত্মা
স্বয়ং চৈতন্যস্বরূপ। সকল অনিত্য বস্তুর মধ্যে নিত্যবস্তু পরমাত্মাই
নাম-রূপ আরোপিত হয়ে জীবাত্মারূপে প্রতিভাত হন। জীবাত্মার কোন স্বতন্ত্র
অস্তিত্ব নেই। তাই পরমাত্মা ও জীবাত্মা যে অভিন্ন, এই সত্য উপলব্ধির কথাই
আরো বিভিন্ন শ্রুতিতে বলা হয়েছে। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এই অভেদাত্মক
সম্বন্ধ নিশ্চয়ই বেদান্তের কাশকৃৎস্ন শাখায়ও বেদান্ত শ্রুতির দ্বারা
প্রতিষ্ঠিত। তাই সূত্রকার বলেন-
‘অবস্থিতেরিতি কাশকৃৎস্নঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২)।।
ভাবার্থ : কাশকৃৎস্ন মুনি বলেন, পরমাত্মাই দেহ মধ্যে জীবাত্মারূপে অবস্থিত। সুতরাং জীব শব্দে এই স্থলে পরমাত্মাকেই বুঝতে হবে (ব্রঃ-১/৪/২২)।
কিন্তু
জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই উপলব্ধিগত অভেদ সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে যে
যথেষ্ট ভেদ বা পার্থক্যও রয়েছে তা স্বীকার করেই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অধিকং তু, ভেদনির্দেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২২)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি যেমন জীব-ব্রহ্মের অভেদ নির্দেশ করেছেন সেরূপ ভেদের কথাও বলেছেন। তাই ব্রহ্ম জীব থেকে অধিকতর কিছুই (ব্রঃ-২/১/২২)।
যেসব ভেদ বা পার্থক্য জীবাত্মাকে পরমাত্মা থেকে পৃথক করে, সূত্রকার তাও চিহ্নিত করেছেন। সেগুলি নিম্নরূপ-
…
[আগের পর্ব : জগৎ] [*] [পরের পর্ব : আত্মা অণু স্বরূপ]
…
…
[আগের পর্ব : জগৎ] [*] [পরের পর্ব : আত্মা অণু স্বরূপ]
…
No comments:
Post a Comment