Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১২ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মা অণু-স্বরূপ



| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১২ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মা অণু-স্বরূপ |
রণদীপম বসু
(ক) আত্মা অণু-স্বরূপ :
শ্রুতিতে পরমাত্মা ব্রক্ষকে অদ্বিতীয় সর্বব্যাপী ঘোষণা করে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে তাঁর যে স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে তা হলো-


‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।
কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৬/১১)।।
অর্থাৎ : তিনি অদ্বিতীয়, তবু তিনি সর্বভূতে নিহিত। তিনি সর্বব্যাপী, সকলের অন্তরাত্মা। তিনিই সকল কর্মের ফলদাতা, তিনিই সকলকে পালন করছেন, তিনিই চৈতন্যদায়ক, নিরুপাধিক এবং নির্গুণ ও মুক্ত (শ্বেতাশ্বতর-৬/১১)।
আবার দেহত্যাগ করে জীবাত্মার লোকান্তরে গমন বিষয়ে অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘তে যে এবমেতদ্ বিদুর্ষে চামী অরণ্যে শ্রদ্ধাং সত্যমুপাসতে তেহর্চিরভিসংভবন্তি অর্চিষোহহরহ্ন আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্যান ষণ্মাসানূদঙ্ঙাদিত্য এতি মাসেভ্যো দেবলোকং দেবলোকদাদিত্যম্ আদিত্যাৎ বৈদ্যুতং, তান্ বৈদ্যুতান্ পুরুষো মানস এত্য ব্রহ্মলোকান্ গময়তি। তে তেষু ব্রহ্মলোকেষু পরাঃ পরাবতো বসন্তি। তেষাং ন পুনরাবৃত্তি’।। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।।
অর্থাৎ : পঞ্চাগ্নিবিদ্যায় যাঁরা বিদ্বান এবং এই জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর পূত হয়ে প্রথমে অর্চিলোকে যান। ক্রমে অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয়মাসে। তারপর সেখান থেকে দেবলোকে, দেবলোক থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে বিদ্যুৎলোকে যান। সেখানে আসেন এক মনোময় পুরুষ, তাঁকে নিয়ে যান ব্রহ্মলোকে। পরমলোক সেই ব্রহ্মলোকে তিনি থেকেই যান। আর শুক্র-শোণিতে ফিরে আসতে হয় না (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।
এটিকে বলা হয় দেবযান পথ। প্রায় অনুরূপ শ্রুতি ছান্দোগ্য (ছাঃ-৫/১০/১-২) উপনিষদেও রয়েছে। জীবাত্মাকে পরমাত্মার সাথে অভেদ মানলে এই দুটি শ্রুতির মধ্যে একটা বিরোধ দৃষ্ট হয়। কেননা, আত্মা অখণ্ড ও সর্বব্যাপী হলে জীবাত্মা একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমনের বিষয়টাই বিভ্রান্তিকর হয়। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে গিয়ে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘উৎক্রান্তিগত্যাগতীনাম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)।।
‘স্বাত্মনা চোত্তরয়োঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।।
ভাবার্থ :
জীবাত্মার উৎক্রান্তি-গতি, এবং পুনরাগমনের কথা শ্রুতিতে থাকায়- তা ব্রহ্মের ন্যায় বিভু বা সর্বব্যাপী হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)।   গতি এবং অগতি কর্তার সাথেই সম্বন্ধবিশিষ্ট। আত্মার সম্পর্কে-ই জীবের গতি-অগতি বিচার করা যায়। তাই জীবাত্মা সীমিত পরিমাণ (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।
এই সীমিত পরিমাণ মানে কতটুকু ? এক্ষেত্রেও শ্রুতির প্রমাণই সাক্ষ্য। যেমন-
‘এষঃ অণুঃ আত্মা চেতসা বেদিতব্যো যস্মিন্ প্রাণঃ পঞ্চধা সংবিবেশ।
প্রাণৈশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং যস্মিন্ বিশুদ্ধে বিভবত্যেষ আত্মা’।। (মুণ্ডকোপনিষদ-৩/১/৯)।।
অর্থাৎ : প্রাণবায়ু পাঁচভাগে ভাগ হয়ে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একই দেহে অণু পরিমাণ আত্মাও রয়েছেন যা শুদ্ধ জ্ঞান বা বুদ্ধির গোচর। সকল বস্তু ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও চৈতন্যরূপ শুদ্ধ আত্মা বিরাজ করেন। চিত্তশুদ্ধি হলে আত্মা তখন নিজেকে প্রকাশ করেন (মুণ্ডক-৩/১/৯)।

‘বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায়কল্পতে’।। (শ্বেতাশ্বতর-৫/৯)।।
অর্থাৎ : একটি কেশাগ্রকে শতভাগে বিভক্ত করে তার প্রতি ভাগকে আবার শতভাগে ভাগ করলে যে এক একটি ভাগ হয়, জীবাত্মা তারই ন্যায় অতি ক্ষুদ্র অণুপরিমাণবিশিষ্ট। আবার এই জীবাত্মাই অনন্ত (শ্বেতাশ্বতর-৫/৯)।
এ থেকেই প্রমাণ হয় যে, জীবাত্মা আকারে ক্ষুদ্রতম থেকেও ক্ষুদ্র অণুপরিমাণ-ই। তাই সূত্রকার সিদ্ধান্ত করেন-
‘স্বশব্দোন্মানাভ্যাং চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২২)।।
ভাবার্থ : অণুবোধক এবং অণুপরিমাণবাচক স্পষ্ট শ্রুতিবাক্য থাকাতে বুঝতে পারা যায় যে, জীব অণুপরিমাণই (ব্রঃ-২/৩/২২)।
এখানে আপত্তি আসে যে, জীবাত্মা অণুপরিমাণ হওয়ায় দেহের অতিক্ষুদ্র একাংশে তার অবস্থিতি, ফলে সম্পূর্ণ দেহের উপর বিস্তীর্ণ সুখ-দুঃখাদি উপভোগ করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। এই আপত্তির উত্তরে সূত্রকার বলেন-
‘গুণাদ্বা লোকবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৫)।।
‘ব্যতিরেকো গন্ধবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৬)।।
‘তথা চ দর্শয়তি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৭)।।
ভাবার্থ :
নিজ গুণের দ্বারা ক্ষুদ্র একটি দীপ যেমন বৃহৎ একটি ঘরকে আলোকিত করে, সেইভাবে বিজ্ঞানাদি গুণের দ্বারা ক্ষুদ্র আত্মা একস্থানে অবস্থান করেও সমগ্র দেহে কার্য করতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৫)।   পুষ্পের গন্ধ যেমন পুষ্পে অবস্থিত হয়েও তাকে অতিক্রম করে দূরবর্তী স্থানকেও আমোদিত করে, জীবাত্মাও তেমনি একাংশে থেকেও সর্বদেহে কার্যকর হতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৬)।  শ্রুতিশাস্ত্রেও তার সমর্থন রয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৭)।
যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রে এর সমর্থন দেখা যায় কৌষীতকি উপনিষদে-
‘তদ্ যথা ক্ষুরঃ ক্ষুরধানে অবহিতঃ স্যাৎ। বিশ্বম্ভরো বা বিশ্বম্ভরকুলায় এবমেবৈষ প্রাজ্ঞ আত্মেদং শরীরমাত্মানম্ অনুপ্রবিষ্টঃ। আ লোমভ্য আ নখেভ্যঃ’।। (কৌষীতকি-৪/১৯)।।
অর্থাৎ : যেমন ক্ষুর থাকে ক্ষুরের খাপের মধ্যে অথবা আগুন থাকে কাঠের মধ্যে তেমনি ঐ বিজ্ঞানময় বা প্রাজ্ঞ চেতন আত্মা এই দেহে প্রবিষ্ট হয়ে কেশ থেকে নখাগ্র পর্যন্ত সর্বত্র সঞ্চারিত হয়ে অবস্থান করছেন (কৌষীতকি-৪/১৯)।
গন্ধ যেমন নিজের দ্রব্য পৃথিবীর গুণ হয়েও তা থেকে ভিন্ন, জ্ঞানও তেমনি আত্মা থেকে ভিন্ন। যদিও কোথাও কোথাও আত্মাকে জ্ঞান বা বিজ্ঞান বলা হয়েছে, কিন্তু তা এজন্যেই বলা হয়েছে যে জ্ঞান আত্মার সার থেকে জাত গুণ, এবং সেইজন্যও যেখানে যেখানে আত্মা আছে, সেখানে সেখানে জ্ঞান অবশ্যই থাকবে। যেমন, কৌষীতকি উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন বাচং বিজিজ্ঞাসীত। বক্তারং বিদ্যাৎ। ন গন্ধং বিজিজ্ঞাসীত। ঘ্রাতারং বিদ্যাৎ। ন রূপং বিজিজ্ঞাসীত। রূপবিদ্যং বিদ্যাৎ। ন শব্দং বিজিজ্ঞাসীত। শ্রোতারং বিদ্যাৎ। নান্নারসং বিজিজ্ঞাসীত। অন্নরসস্য বিজ্ঞাতারং বিদ্যাৎ। ন কর্ম বিজিজ্ঞাসীত। কর্তারং বিদ্যাৎ। ন সুখ-দুঃখে বিজিজ্ঞাসীত। সুখদুঃখয়োর্বিজ্ঞাতারং বিদ্যাৎ। নানন্দং ন রতিং ন প্রজাপতিং বিজিজ্ঞাসীত। আনন্দস্য রতেঃ প্রজাতের্বিজ্ঞাতারং বিদ্যাৎ। নেত্যাং বিজিজ্ঞাসীত এতারং বিদ্যাৎ। ন মনো বিজিজ্ঞাসীত। মন্তারং বিদ্যাৎ’।। (কৌষীতকি-৩/৬)।।
অর্থাৎ : বাক্ বা বক্তব্যকে জানার চেষ্টা করবে না। বক্তাকে জানবে। গন্ধ বা গন্ধবস্তুকে জানার চেষ্টা করবে না। যিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয় হয়ে আঘ্রাণ দিচ্ছেন তাঁকে জানবে। রূপকে জানতে চেষ্টা করবে না, দ্রষ্টাকে জানবে। শব্দকে জানতে চেষ্টা করবে না, শ্রোতাকে জানবে। অন্নরসকে জানতে চেষ্টা করবে না। তাকে যিনি জানেন, তাঁকে জানবে। কর্মকে জানতে ইচ্ছুক হবে না, কর্তাকে জানবে। সুখ-দুঃখকে জানতে চেষ্টা না করে, তার যে বিজ্ঞাতা, তাঁকে জানতে আগ্রহী হবে। আনন্দ, রতি, সন্তান-সন্ততির উপভোগ জানতে উৎসুক না হয়ে, এসবের বিজ্ঞাতাকে জানবে। গতিকে জানার জন্য আগ্রহী না হয়ে, গমনকারীকে জানবে। মনকে জানতে উদ্গ্রীব না হয়ে যিনি মনন করছেন তাঁকে জানার চেষ্টা করবে। কে সেই বক্তা, দ্রষ্টা, শ্রোতা, কর্তা, বিজ্ঞাতা ? তিনি হলে প্রজ্ঞা, চৈতন্যময় আনন্দস্বরূপ, অমৃতময় আত্মা।
তাই বলে প্রতর্দন, এমন কথা কখনো ভেবো না যে দুটি ভিন্ন। আপাতদৃষ্টিতে দুটি পৃথক হলেও আসলে কিন্তু পৃথক নয়। যেমন গাছের সঙ্গে ফুল-ফলের সম্পর্ক, এখানেও তাই (কৌষীতকি-৩/৬)।
.
‘তা বা এতা দশৈব ভূতমাত্রা অধিপ্রজ্ঞম্, দশ প্রজ্ঞামাত্রা অধিভূতম্ । যদা ভূতমাত্রা ন স্যুর্ন প্রজ্ঞামাত্রাঃ স্যুঃ। ন হি অন্যতরো তো রূপং কিঞ্চন সিধ্যেৎ। নো এতন্নানা। তদ্ যথা রথস্যারেষু নেমিরর্পিতো নাভাবরা অর্পিতাঃ। এবমেবৈতা ভূতমাত্রাঃ প্রজ্ঞামাত্রাসু অর্পিতাঃ, প্রজ্ঞামাত্রাঃ প্রাণে অর্পিতাঃ স এষ প্রাণ এব প্রজাত্মানন্দোজরোহমৃতঃ’।। (কৌষীতকি-৩/৭)।।
অর্থাৎ : দশটি ভূতমাত্রা, নাম থেকে মন পর্যন্ত প্রজ্ঞাকে আশ্রয় করে আছে। তাই এদের বলা হয় ‘অধিপ্রজ্ঞ’। আবার দশটি প্রজ্ঞামাত্রা ঐ ভূতমাত্রাকে অবলম্বন করে আছে। তাই তারা হলো ‘অধিভূত’। স্বতন্ত্র হয়েও কেউ নিরপেক্ষ নয়। যদি নাম, দৃশ্য, গন্ধ ইত্যাদি ভূতমাত্রা অর্থাৎ বিষয় জগতের উপাদান না থাকতো, তাহলে মুখ, চোখ, ঘ্রাণ ইত্যাদি প্রজ্ঞামাত্রা অর্থাৎ বিষয়ীরাও থাকতো না। আবার বাক্, চোখ ইত্যাদি প্রজ্ঞামাত্রা ইন্দ্রিয়রা যদি না থাকতো তাহলে কথা, রূপ, গন্ধ এসব ভূতমাত্রা বিষয়ও থাকতো না। ইন্দ্রিয় আর বিষয় কেউ কারো সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত নয়। ইন্দ্রিয় না থাকলে বিষয়কে জানা যেতো না। আবার বিষয় না থাকলে ইন্দ্রিয়ও অর্থহীন হতো। তাই- আলাদা হলেও আসলে কিন্তু এক।
যেমন রথের চাকা। গোলাকার কাঠের বেড় বা পরিধি। মাঝে একটা ‘অর’ নাভি, চলতি কথায় যাকে বলে ‘মাদল’। এই মাদলে আছে বেশ কয়েকটা গর্ত। সেই গর্ত থেকে এক-একটা কাঠের শলাকা বেরিয়ে পরিধি বা নেমির শরীর ফুটো করে তাকে ধরে রেখেছে এমনভাবে যে, নেমির সাধ্য নেই খসে আলাদা হয়ে যায়। কাঠের শলাকাগুলো হলো ইন্দ্রিয় আর নেমি হলো নামাদি বিষয়। এই প্রাণই হলো প্রজ্ঞা বা চেতন-আত্মা। আনন্দস্বরূপ, অৎর, অমৃত (কৌষীতকি-৩/৭)।
এইসব শ্রুতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রজ্ঞা (বিজ্ঞান) দেহ থেকে পৃথক- এদের মধ্যে করণ-কর্তা সম্পর্ক বর্তমান এবং এই বিশেষ গুণ সহায়েই আত্মা সর্বদেহব্যাপী হয়ে বর্তমান। তাই সূত্রকার বলেন-
‘পৃথগুপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৮)।।
‘ত˜গুণসারত্বাৎ তু তদ্ব্যপদেশঃ প্রাজ্ঞবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৯)।।
‘যাবদাত্মভাবিত্বাচ্চ ন দোষঃ, তদ্দর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩০)।।
ভাবার্থ :
শ্রুতিতে জ্ঞান হতে জীবাত্মার পৃথকত্ব উপদেশ করা হয়েছে। অতএব বিজ্ঞানময়তায় জীব মহৎ হলেও জীব আসলে অণুই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৮)।   প্রাজ্ঞ পরমাত্মার বৃহৎগুণ থাকায় যেমন তাঁকে ব্রহ্ম বলা হয়, তেমনি জীবাত্মার গুণেও বিভুত্ব থাকায় কোন কোন শ্রুতি জীবকেও বিভু বলেছেন। কিন্তু জীবাত্মা অণুই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৯)।   গুণে জীবাত্মাকে বিভু বলা দোষযুক্ত নয়। কারণ আত্মা যতদিন থাকবে তার গুণও ততদিন থাকবে। আত্মা নিত্যহেতু তার গুণও নিত্য (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩০)।
তদুপরি বাদরায়ণ বলেন, এই জ্ঞান যদি দৃষ্টিগোচর না হয় তবে তাকে তুলনা করতে হবে বাল্যাবস্থায় শিশুর অপ্রকটিত পৌরুষের সঙ্গে। জ্ঞান শরীরের মধ্যেই অবস্থিত, এতেও প্রমাণিত হয় যে জীবাত্মা অণু। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘পুংস্ত্বাদিবৎ ত্বস্য সতোহভিব্যক্তিযোগাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩১)।।
ভাবার্থ : পুরুষের ধর্ম যেমন বাল্যে প্রকাশিত হয় না, তেমনি জীবের জ্ঞানও সুষুপ্তি অথবা প্রলয়ে অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু জাগ্রৎ-কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায় (ব্রঃ-২/৩/৩১)।
কারণ, সুষুপ্তি অবস্থায় জ্ঞান যে অপ্রকাশিত থাকে তা শ্রুতিতেই বলা হয়েছে-
‘…যত্রৈতং পুরুষঃ স্বপিতি নাম সতা সোম্য তদা সম্পন্নো ভবতি স্বমপীতো ভবতি তস্মাদেনং স্বপিতীত্যাচক্ষতে স্বং হ্যপীতো ভবতি’।। (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।।
অর্থাৎ : …যখন কাউকে বলা হয় ‘ইনি ঘুমোচ্ছেন’, তখন হে সোম্য, তিনি সৎ-এর সঙ্গে একীভূত হন এবং স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হন। সেইজন্য লোকে একে ‘সুষুপ্ত’ (স্বপিতি) বলেন, কারণ তখন তিনি স্ব-স্বরূপে থাকেন (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।
অর্থাৎ সুষুপ্তিকালে বুদ্ধির সঙ্গে আত্মার এই সংযোগ খুব সূক্ষ্ম এবং সম্ভাবনাপূর্ণ অবস্থায় বর্তমান থাকে। তা না হলে জাগ্রৎ অবস্থায় তা বিকশিত হয়ে উঠতে পারতো না। পুরুষত্ব শক্তিটি যৌবনে বিকশিত হয়, যদিও মাত্র তা সম্ভাবনাময় অবস্থায় শৈশবে বর্তমান থাকে। সুতরাং এই সংযোগটি বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থাকে যে-পর্যন্ত ব্যাষ্টি সত্তার (জীবরূপে) অবস্থাটি বর্তমান থাকে।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : জীব বা আত্মা] [*] [পরের পর্ব : আত্মা কর্তা]

No comments: