Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০১ : ভূমিকা- রামানুজ



|বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০১ : ভূমিকা- রামানুজ|
রণদীপম বসু

১.০ : ভূমিকা
ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় বেদান্তের প্রভাব সহজেই পরিলক্ষিত হয়। তাদের নিকট সত্য বহুমুখী। বেদান্তীরা এই বহুমুখী সত্যকে বহুরূপে উপলব্ধির কথা ঘোষণা করেছেন। তাই বেদান্ত চিন্তা বহুমুখী। উপনিষদীয় ভাবধারায় পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তগুলিকে প্রয়োজনীয় মীমাংসার মাধ্যমে মহর্ষি বাদরায়ণ যেমন ব্রহ্মসূত্র রচনা করে অভিন্ন লক্ষ্যাভিমুখী করার উদ্যোগ নিয়ে একটি পরমতত্ত্বের মধ্যে সমন্বয়কৃত  ব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন, আবার এই ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা ও ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বেদান্তী দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু পরবর্তীকালে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন মতবাদেরও সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে আচার্য শঙ্কর প্রবর্তিত অদ্বয় পরমব্রহ্মের ভাবনাপ্রসূত বিশুদ্ধাদ্বৈতবাদ যেমন অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি এই ব্রহ্মসূত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যা-ভাষ্যে জ্ঞানকাণ্ড-প্রধান অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিক্রিয়ারূপে উদ্ভূত হয়েছে রামানুজাচার্য-প্রবর্তিত ভক্তিপ্রধান বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ।


শঙ্করের অদ্বৈতবাদ ও রামনুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এই উভয় বেদান্ত-চিন্তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরস্পর-নিরপেক্ষ। অদ্বৈতবেদান্তের জ্ঞানপ্রধান, নির্বিশেষ, বিমূর্তচিন্তা দার্শনিক বিচারে অতি উচ্চস্তরের হলেও এইমত সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক-তৃপ্তি সাধনে সক্ষম হয়নি। এই অক্ষমতাই হয়তো ভক্তিবাদী রামানুজাচার্যকে ভক্তিমার্গ অনুসরণ করে ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ নামে একটি স্বতন্ত্র বেদান্তমত প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছে। রামানুজের মতবাদও অদ্বৈত মতবাদ, তবে তা নির্বিশেষ নয়। আচার্য শঙ্কর তাঁর অদ্বৈতমতে এক অদ্বয় পরমব্রহ্ম ছাড়া পরমার্থত আর দ্বিতীয় কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। কিন্তু আচার্য রামানুজ বহুর অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে নির্গুণ ব্রহ্মবাদের সঙ্গে ঈশ্বরবাদের সমন্বয়ের প্রচেষ্টারূপে গণ্য করা যায়।

বলা বাহুল্য যে, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা ভারতীয় চিন্তাধারায় কোন অভিনব বা নতুন সংযোজন নয়। নির্গুণ ব্রহ্মবাদ ও ঈশ্বরবাদ বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিলো। রামানুজাচার্যের বহুপূর্বে ভাগবতের ঈশ্বরবাদে, উপনিষদের সপ্রপঞ্চ-ব্রহ্মবাদে, মহাভারতের নারায়ণীয় অধ্যায়ে, ভগবদ্গীতায় ও বিষ্ণুপুরাণে এই চিন্তাধারার আভাস পাওয়া যায়। প্রাচীন বৈষ্ণব তামিল-কবি আলবারদের নানা গাথা ও গ্রন্থ, ভাস্কর, যাদবপ্রকাশ ও যমুনাচার্য’র চিন্তাধারা, ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত, ভাগবত ও মহাভারতের বৈষ্ণবপাদ রামানুজের চিন্তাধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করা হয়। বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদ যে তাঁর পূর্বেকার লেখক যথা বোধায়ন, টঙ্ক, কপরদিন, ভারুচী প্রমুখের মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, বেদান্তসূত্রভাষ্য ‘শ্রীভাষ্য’-এ রামানুজ তা স্বীকার করেছেন।

দর্শনের পরমব্রহ্মকে ভক্তের ভগবানরূপে কল্পনা করে রামানুজ বেদান্ত দর্শনে ভক্তিবাদের অপূর্ব সমাবেশ করেছেন। বাস্তবভাব সমন্বয়ের দ্বারা একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করা এবং ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য  মানুষের যে প্রবল বাসনা তার প্রতিষ্ঠা করাই রামানুজের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষার সঙ্গে রামানুজের মতে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই রামানুজ প্রচারিত দার্শনিক ভাবনা ও ধর্মমত সাধারণ মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলো।

রামানুজ (১০১৭-১১৩৭ খ্রিঃ)
আচার্য রামানুজ ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের শ্রীপেরম্বুদুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ ১২০ বছর জীবনধারণ করে ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বাল্য নাম লক্ষ্মণ। পিতার নাম কেশব ভট্ট এবং মাতার নাম কান্তিমতি। শৈশবে তিনি পিতৃহীন হন। যমুনাচার্য তাঁর মাতামহ এবং মহাপূর্ণ তাঁর মাতুল। বাল্যকালে তিনি কাঞ্চিপুরীতে আচার্য যাদবপ্রকাশের কাছে বেদান্ত অধ্যয়ন শুরু করেন, কিন্তু পরে মতবিরোধ-হেতু তিনি গুরু কর্তৃক বিতাড়িত হন। তারপর তিনি মাতামহ যমুনাচার্যের কাছে বেদান্তের পাঠ গ্রহণ করেন এবং শঙ্কর, ভাস্কর ও যাদবপ্রকাশের মতবাদ খণ্ডন করে বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদ প্রচার করেন।

আচার্য রামানুজ ছিলেন অতীব ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তাঁর পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। মহর্ষি বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের উপর তিনি যে ব্রহ্মসূত্রভাষ্য রচনা করেন তা ‘শ্রীভাষ্য’ নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়াও তিনি ‘গীতাভাষ্য’, ‘বেদান্তদীপ’, ‘বেদান্তসংগ্রহ’, ‘শরণাগতিগদ্য’, ‘শ্রীরঙ্গগদ্য’, ‘আগমপ্রামাণ্য’, ‘সিদ্ধিত্রয়’, ‘মহাপুরুষনির্ণয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।

রামানুজের পরেও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের সমর্থনে বহু গ্রন্থ রচিত হয়। রামানুজের পরবর্তীকালের রামানুজ-শিষ্য সুদর্শন সূরি’র শ্রীভাষ্যের ‘শ্রুতপ্রকাশিকাটীকা’, বেঙ্কটনাথ-এর ‘শতদূষণী’, ‘ন্যায়পরিশুদ্ধি’, ‘তত্ত্বটীকা’, মেঘনাদারির ‘ন্যায়দ্যুমণি’, আচার্য শ্রীনিবাস-এর ‘যতীন্দ্রমতদীপিকা’, লোকাচার্য’র ‘তত্ত্বত্রয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের উপর অতি মূল্যবান গ্রন্থ।

রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের এক অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। পরম সদ্ববস্তুই পরম কল্যাণ এবং পরম অন্বিষ্ট সত্তা, কল্যাণ এবং পুরুষার্থ আত্যন্তিক অর্থে সমন্বিত, এই সত্যটিকে বিশিষ্টাদ্বৈত মতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। রামানুজের মতে ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। তবে-
বিশিষ্টাদ্বৈত মতে যদিও ব্রহ্মই চূড়ান্ত সত্য, তবুও ব্রহ্মকে নির্গুণ আখ্যা দেয়া ভুল। বরং ব্রহ্মকে অনন্ত-কল্যাণগুণের আধার মনে করতে হবে। তিনিই ঈশ্বর; উপাসনা সৎকর্মের সাহায্যে তাঁর করুণার উদ্রেক করতে পারলেই জীবের মুক্তি। পরিদৃশ্যমান জড়জগৎ এবং জীবাত্মার স্বাতন্ত্র্য মিথ্যা নয়। কেননা, ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের মধ্যেই চিৎ এবং অচিৎ- চেতনা এবং জড়- উভয় বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। চিৎ বৈশিষ্ট্য থেকেই জীবাত্মার সৃষ্টি, অচিৎ থেকে জড়জগতের। ব্রহ্ম চিৎ-অচিৎবিশিষ্ট। জীবাত্মার সঙ্গে জড়দেহের সম্পর্কই বন্ধনের স্বরূপ এবং তার মূলে রয়েছে জন্মজন্মান্তরের কৃতকর্মজনিত অজ্ঞান। ঈশ্বরের করুণায় জীবাত্মা এই অজ্ঞান কাটিয়ে মুক্তিলাভ করবে।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭)

ঈশ্বর, চিৎ-শক্তি এবং অচিৎ-শক্তি এই ত্রিতত্ত্বে রামানুজ বিশ্বাস করেন। তার মতে ঈশ্বরই পরমতত্ত্ব। ঈশ্বর বিশেষ্য, চিৎ ও অচিৎ তার বিশেষণ। প্রমাণ ও প্রমেয় বিচারে রামানুজের মতে বিশিষ্ট ব্রহ্মই একমাত্র জ্ঞেয় বস্তু। প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ জ্ঞানের ত্রিবিধ উপায়। তবে আচার্য রামানুজও শাস্ত্র বা শব্দপ্রমাণকেই প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন। যেমন, ব্রহ্মবাদী বাদরায়ণের সূত্রগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন- 


‘যস্মিন্ শব্দ এব প্রমাণং ন ভবতি, তৎ ‘অশব্দম্’, আনুমানিকং…’। ৪।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)
অর্থাৎ : যে বিষয়ে শব্দ বা আগম প্রমাণের অভাব, তা-ই অশব্দ- আনুমানিক (শ্রীভাষ্য-৪-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।

আবার অন্যত্র প্রত্যক্ষ-প্রমাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন-

‘…শ্রুতিভিশ্চ ব্রহ্মব্যতিরিক্তস্য মিথ্যাত্বমবগম্যতে। নচাগমাবগতার্থস্য প্রত্যক্ষবিরোধঃ শঙ্কনীয়ঃ, যথোক্তপ্রকারেণ কার্যস্য মিথ্যাত্বাবগমাৎ, প্রত্যক্ষস্য সম্মাত্রবিষয়ত্বাচ্চ। বিরোধে সত্যপ্যসম্ভাবিতদোষস্য চরমভাবিনঃ স্বরূপসম্ভাবাদৌ প্রত্যক্ষাদ্যপেক্ষত্বেহপি প্রমিতৌ নিরাকাঙ্ক্ষস্য নিরবকাশস্য শাস্ত্রস্য বলীয়স্ত্বাৎ ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)
অর্থাৎ :
শ্রুতি দ্বারা ব্রহ্মাতিরিক্ত বস্তুমাত্রেরই মিথ্যাত্ব জানা যায়। শাস্ত্র (শ্রুতি) দ্বারা নির্ধারিত বিষয়ে কখনোই প্রত্যক্ষের বিরোধ সম্ভাবিত হতে পারে না। কারণ পূর্বোক্ত প্রণালীতে সমস্ত জন্যপদার্থের (জগৎকার্যের) মিথ্যাত্ব নির্ধারিত হয়, আর প্রত্যক্ষ দ্বারা কেবল বস্তু-সত্তা মাত্র সিদ্ধ হয়। স্বভাবত নির্দোষ শাস্ত্র প্রত্যক্ষের পরভাবী, সুতরাং শাস্ত্রের অর্থ বুঝতে হলে প্রত্যক্ষের কথঞ্চিৎ অপেক্ষা থাকলেও কিন্তু শাস্ত্র-লব্ধ জ্ঞানে প্রত্যক্ষের কিছুমাত্র অপেক্ষা নাই; সুতরাং সে-অবস্থায় শাস্ত্র প্রত্যক্ষ-নিরপেক্ষ; নিরপেক্ষ বলেই সেই অংশে প্রত্যক্ষ অপেক্ষাও শাস্ত্রের বলবত্তা অধিক (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)।

(চলবে…)

[*] [পরের পর্ব : রামানুজের মতে ব্রহ্মের ধারণা]

No comments: