Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০২ : রামানুজের মতে ব্রহ্মের ধারণা



|বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০২ : রামানুজের মতে ব্রহ্মের ধারণা|
রণদীপম বসু

২.০ : রামানুজের মতে ব্রহ্মের ধারণা
আচার্য শঙ্করের ন্যায় রামানুজও ব্রহ্মকেই চরম ও পরম সত্তা বা সত্যরূপে গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁর মতে ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব, কিন্তু একমাত্র তত্ত্ব নন। ঈশ্বরের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। জগৎ ব্রহ্মের অচিৎ অংশ এবং জীবাত্মা ব্রহ্মের চিৎ অংশ। চিৎ এবং অচিৎ ঈশ্বরের মতোই সত্য, তবে তারা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। শরীর যেমন আত্মার উপর নির্ভর করে, তেমনি জড় ও আত্মা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে থাকে। বিশ্বের সব কিছুই ঈশ্বরের শরীর এবং ঈশ্বর হলেন অজৈব প্রকৃতি ও সকল জীবের আত্মা। চিৎ বা অচিৎ, ব্রহ্মের কোন অংশই মিথ্যা নয়। উভয় অংশই ব্রহ্মে বিধৃত। চিৎ ও অচিৎ-এর দ্বারা বিশিষ্ট বলেই রামানুজের ব্রহ্ম বিশিষ্টব্রহ্ম। অতএব, দার্শনিক বিচারে বলতে গেলে বলতে হয়, রামানুজ তিনটি তত্ত্ব স্বীকার করেছেন। রামানুজের দর্শনে ব্রহ্ম, চিৎ ও অচিৎ এই ত্রিতত্ত্ব স্বীকৃত, তবে এই ত্রিতত্ত্ব সমন্বিত হয়ে এক পরমতত্ত্বে পর্যবসিত। এই পরমতত্ত্বই বিশিষ্ট অদ্বৈত ব্রহ্ম বা সগুণ ব্রহ্ম।

আচার্য রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্যের মঙ্গলাচরণেই বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের মূলতত্ত্বকে অতি সংক্ষেপে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন-


‘অখিল জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় যাঁহার লীলা, শরণাগত বিবিধ জীবের রক্ষাই যাঁহার একমাত্র ব্রত এবং যিনি বেদান্তশাস্ত্রে বিশেষভাবে প্রতিপাদিত, সেই পরব্রহ্ম শ্রীনিবাস নারায়ণে আমার ভক্তিরূপা বুদ্ধি উৎপন্ন হউক।’- (যতীন্দ্র রামানুজাচার্যের তর্জমায়)।

অর্থাৎ এই মঙ্গলাচরণে একথাই প্রতিপাদিত হয় যে, রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ, জগৎ-কারণ, রক্ষাকর্তা, ধ্বংসকর্তা ও ভক্তের পরমকরুণাময় ভগবান। এই পরমতত্ত্ব ভক্তির দ্বারাই বোধগম্য। তাই ভক্তিই তত্ত্বজ্ঞানলাভের উপায়।
তাহলে রামানুজের ব্রহ্মের স্বরূপ কী ?

২.১ : ব্রহ্মের স্বরূপ
রামানুজের মতে ভেদের দিক থেকে তত্ত্ব তিনটি- চিৎ, অচিৎ ও ব্রহ্ম। কিন্তু অভেদের দিক থেকে তত্ত্ব কেবলমাত্র একটি এবং তা হলো- চিৎ-অচিৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই পরম সত্তা এবং চিৎ ও অচিৎ হলো ব্রহ্মের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রহ্মের চিৎ অংশ থেকে জীব এবং অচিৎ অংশ থেকে জড় বস্তুর সৃষ্টি। সুতরাং ব্রহ্ম অংশী বা বিশেষ্য এবং চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের অংশ বা বিশেষণ। অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ, তা হলো বিশিষ্ট অভেদ- আত্যন্তিক অভেদ নয়। এই কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম স্বগত ভেদযুক্ত কিন্তু অপৃথকসিদ্ধ, সগুণ ও সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ব্রহ্মই জগতের কর্তা এবং পরিণামস্বরূপ। তিনি নিত্যতৃপ্ত, বিকারহীন ও অনন্ত-কল্যাণময়। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেন-

‘অতঃ সর্ব্বজ্ঞঃ সর্ব্বশক্তিঃ সর্ব্বেশ্বরো নিরস্ত-সমস্তদোষগন্ধো অনবধিকঃ অতিশয়াসংখ্যেয় কল্যাণগুণগণ্যেঘমহার্ণবঃ পুরুষোত্তমো নারায়ণ এব নিখিলজগদেককারণং জিজ্ঞাস্যং ব্রহ্মেতি চ স্থিতম্’। ১।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)
অর্থাৎ :
অতএব, এটাই স্থির হলো যে, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তি, সর্বপ্রকার দোষস্পর্শশূন্য, নিরবধি নিরতিশয় এবং অসংখ্য কল্যাণকর গুণের মহাসমুদ্রস্বরূপ সেই পুরুষোত্তম নারায়ণই সমস্ত জগতের কারণস্বরূপ জিজ্ঞাস্য (জিজ্ঞাসার বিষয়ীভূত) ব্রহ্ম (শ্রীভাষ্য-১-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

ব্রহ্ম স্বগত-ভেদযুক্ত
রামানুজের নিকট ব্রহ্ম কোন অভেদতত্ত্ব নন। শঙ্করাচার্যের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে একমত যে, ব্রহ্মের কোন স্বজাতীয় বা বিজাতীয় ভেদ নেই। একই জাতির অন্তর্গত দুটি ব্যক্তির ভেদকে বলা হয় স্বজাতীয়ভেদ; যেমন- দুটি মানুষের পারস্পরিক ভেদ। অপরদিকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতির অন্তর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বলা হয় বিজাতীয়ভেদ; যেমন- একটি গরু সঙ্গে একটি অশ্বের ভেদ। এই দু’প্রকার ভেদ ছাড়াও তৃতীয় যে ভেদ প্রসিদ্ধ তা হলো স্বগতভেদ। একই বস্তু বা ব্যক্তির বিভিন্ন অংশ বা অঙ্গের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বলা হয় স্বগত ভেদ; যেমন- একই মানুষের হাত ও পায়ের ভেদ। একমাত্র ব্রহ্মই সত্য হওয়ায় বা ব্রহ্মের বাইরে কিছু না থাকায় ব্রহ্মের স্বজাতীয় বা বিজাতীয় ভেদ সম্ভব নয়। ব্রহ্মের স্বজাতীয় ভেদ নেই, কারণ ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। আবার ব্রহ্মের বিজাতীয় ভেদ নেই, যেহেতু ব্রহ্মের অসদৃশ কিছুই নেই। তবে রামানুজের মতে ব্রহ্মের স্বগত ভেদ বর্তমান। একই ব্রহ্মে বিধৃত চিৎ ও অচিৎ অংশের ভেদই হলো ব্রহ্মের স্বগত ভেদ। তাই ব্রহ্ম সবিশেষ বা বিশিষ্ট।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ব্রহ্মের অন্তর্গত চিৎ ও অচিৎ-এর ভেদ রামানুজ-মতে এমন দুটি অংশের ভেদ, যারা ভিন্ন হলেও তাদের সম্পূর্ণ পৃথক বা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। রামানুজ ব্রহ্মের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর সম্বন্ধকে অপৃথকসিদ্ধি বলে উল্লেখ করেছেন।

ব্রহ্ম অপৃথকসিদ্ধ
ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর বিশেষ নির্ভরতার সম্বন্ধকে ব্যাখ্যা করার জন্য রামানুজ ‘অপৃথকসিদ্ধি’ নামে একটি পৃথক সম্বন্ধ স্বীকার করেছেন।


‘অপৃথকসিদ্ধি’ কথাটির অর্থ হলো ‘অবিচ্ছেদ্যতা’। রামানুজের মতে এই সম্বন্ধ দ্রব্য ও গুণের মধ্যে, কিংবা একটি দ্রব্য ও অন্য একটি দ্রব্যের মধ্যে থাকতে পারে। অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধ ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়-স্বীকৃত সমবায় সম্বন্ধের সদৃশ। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা অবিচ্ছেদ্য বিষয়সমূহের সম্বন্ধকে ‘সমবায় সম্বন্ধ’ বলেছেন। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতবাদিরা সমবায় সম্বন্ধকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। তাঁদের মতে অবিচ্ছেদ্যতাই হলো দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতি।  তাই অপৃথকসিদ্ধিকে ঠিক সম্বন্ধ বলা যায় না; যদিও এটি সম্বন্ধরূপে অভিহিত হয়। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকদের সমবায় সম্বন্ধ এবং রামানুজের অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধ- এই দুটির মধ্যে সাদৃশ্য হলো, উভয় সম্বন্ধই স্বতন্ত্র ও বাস্তব বিষয়সমূহে সম্বন্ধযুক্ত করে। তবে অপৃথকসিদ্ধি হলো আভ্যন্তরীণ সম্বন্ধ, কিন্তু সমবায় সম্বন্ধ তা নয়।

রামানুজের মতে অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত হলো- দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধ আবার দ্রব্য ও গুণের মধ্যে, কিংবা একটি দ্রব্যের ও অন্য একটি দ্রব্যের মধ্যে থাকতে পারে। রামানুজ দেহের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘যাকে আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, যা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে এবং যাকে আত্মা আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য কাজে লাগায়।’ এক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্যতাই হলো দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতি। এই অপৃথকসিদ্ধির ধারণাটিকে রামানুজের দার্শনিক মতের কেন্দ্রভূমিরূপে গণ্য করা হয়।

চিৎ ও অচিৎ- উভয়ই হলো ঈশ্বরের শরীর। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং উভয়েই ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য বিদ্যমান। চিৎ, অচিৎ এবং ঈশ্বরের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। এই তিনটি বিষয় একই ঐক্যে আবদ্ধ। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রাণাধীন। রামানুজের পরমতত্ত্ব বা ব্রহ্ম হলেন এই ঈশ্বর। জীবের আত্মার সঙ্গে শরীরের যে সম্বন্ধ থাকে, ঈশ্বরের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর সেই সম্বন্ধ আছে। একটি প্রাণীদেহে যেমন আত্মাই প্রাধান্য লাভ করে, তেমনি চিৎ ও অচিৎ-এর সঙ্গে ঈশ্বরের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ থাকলেও ঈশ্বরই প্রাধান্য লাভ করেন এবং চিৎ ও অচিৎকে নিয়ন্ত্রিত করেন। চিৎ ও অচিৎ- এই দুটি অধীন বিষয়কে বিশেষণরূপে এবং ঈশ্বরকে বিশেষ্যরূপে গণ্য করা হয়েছে। যেহেতু কোন বিশেষণ বিশেষ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না, সেহেতু যে সমগ্রের তারা অন্তর্ভুক্ত সেই সমগ্রটিকে অদ্বৈত বা এক বলা হয়েছে। চিৎ ও অচিৎ- এই বিশেষণের দ্বারা ঐ এক বা অদ্বৈত বিশিষ্ট হয় বলে রামানুজের দার্শনিক মতকে বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তদর্শন বলা হয়।

বিশিষ্টাদ্বৈতের ধারণাটিকে একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে পরিস্ফুট করা যায়। যেমন, একটি লাল গোলাপের লাল রংটি হলো গুণ, গোলাপটি দ্রব্য। দ্রব্য ও গুণ এক নয়। তাই লাল রংটি গোলাপটি থেকে স্বতন্ত্র। আবার লাল রংটি গোলাপের গুণ হবার জন্য গোলাপটি থেকে স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে না। রংটির অস্তিত্ব গোলাপ ফুলটির উপর নির্ভর করে। সেজন্য রংটি যে গোলাপের বাইরে আছে, তা বলা যায় না। রং ও অন্যান্য বিশেষণ নিয়ে গোলাপটি একটি সমগ্র এবং গুণগুলি ঐ সমগ্রের অন্তর্ভুক্ত। রামানুজ লাল রং ও গোলাপের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করেছেন। তিনি দ্রব্য ও গুণের এই পার্থক্যকে বলেছেন স্বগত ভেদ। রামানুজ ‘নীলোৎপল’ বা নীলপদ্মের উদাহরণ টেনেও বিষয়টির বিশ্লেষণ করে বলেছেন-

‘যথা ‘নীলমুৎপলম্’ ইতি পদদ্বয়স্য বিশেষ্যৈকত্ব-প্রতিপাদনপরত্বেন নীলত্বোৎপলত্বরূপ-বিশেষণদ্বয়ং ন বিবক্ষ্যতে। তদ্বিবক্ষায়াং হি নীলত্ববিশিষ্টাকারেণ উৎপলত্ববিশিষ্টাকারস্যৈকত্ব প্রতিপাদনং প্রসজ্যেত; তত্তু ন সম্ভবতি, নহি নৈল্যবিশিষ্টাকারেণ তদ্বস্তু উৎপলপদেন বিশিষ্যতে, জাতি-গুণয়োরন্যোন্যসমবায়প্রসঙ্গাৎ। অতো নীলত্বোৎপলত্ব উপলক্ষিত-বস্ত্বৈক্যমাত্রং সামানাধিকরণ্যেন প্রতিপাদ্যতে।’ ১২।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)
অর্থাৎ :
‘নীলবর্ণ উৎপল’ বললে এস্থলে বিশেষণ ও বিশেষ্য, উভয় পদেরই একমাত্র বিশেষ্য-বোধনে তাৎপর্য থাকায় ‘নীলত্ব’ ও ‘উৎপলত্ব’ এই দুটি বিশেষণ আর পৃথকভাবে বক্তার অভিপ্রেত হয় না। আর যদি নীলত্ব ও উৎপলত্বের পৃথক প্রতীতিই হতো, তাহলে নিশ্চয়ই উৎপলত্ব ধর্মবিশিষ্ট পদার্থটির (উৎপলের) নীলত্ব ধর্মবিশিষ্টরূপে অভেদ প্রতীতি অপরিহার্য হতো; অথচ তা সম্ভব হয় না; কারণ, উৎপল পদার্থটি কখনোই উৎপল পদ দ্বারা নীলত্ববিশিষ্টরূপে বিশেষিত হয় না; কেননা, তাহলে জাতি ও গুণের মধ্যে পরস্পর সমবায় সম্বন্ধের সম্ভাবনা হয়ে পড়ে। অতএব, বুঝতে হবে যে, নীলত্ব ও উৎপলত্ব ধর্মদ্বয়বিশিষ্ট বস্তুর কেবল একত্বই উক্ত সামানাধিকরণ্য দ্বারা প্রতিপাদিত হয় (শ্রীভাষ্য-১২-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

ব্রহ্ম সগুণ ও সচ্চিদানন্দস্বরূপ
রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ। তিনিই ঈশ্বর। ঈশ্বর নির্বিশেষ বা নির্গুণ ব্রহ্ম নন। কারণ চিৎ ও অচিৎ তাঁর বিশেষণ। চিৎ ও অচিৎ তাঁর শরীর, তিনি তাদের আত্মা। রামানুজ চিৎ ও অচিৎ-এর সত্তা স্বীকার করেছেন, তবে তিনি তাদের স্ব-নির্ভর সত্তা স্বীকার করেননি। কারণ চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মাধীন এবং ব্রহ্ম-নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং ব্রহ্মই পরম তত্ত্ব এবং তিনটি মাত্রাত্মক অদ্বৈতসত্তা। রামানুজের মতে উপনিষদে যে নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, তার প্রকৃত অর্থ হলো ব্রহ্মের অজ্ঞতা, জড়তা, ক্ষুদ্রতা প্রভৃতি হেয় গুণগুলি নেই। রামানুজ অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের নির্গুণ বা নির্বিশেষ ব্রহ্মের অসিদ্ধি প্রতিপাদন করতে গিয়ে বলেন-

‘অত এব নির্ব্বিশেষ-চিন্মাত্রব্রহ্মবাদঃ অপি সূত্রকারেণ আভিঃ শ্রুতিভির্নিরস্তো বেদিতব্যঃ। পারমার্থিক-মুখ্যেক্ষণাদিগুণযোগি জিজ্ঞাস্যং ব্রহ্মেতি স্থাপনাৎ। নির্ব্বিশেষবাদে হি সাক্ষিত্বমপ্যপারমার্থিকম্, বেদান্ত-বেদ্যং ব্রহ্ম জিজ্ঞাস্যতয়া প্রতিজ্ঞাতম্ । তচ্চ চেতনমিতি ‘ঈক্ষতের্নাশব্দম্’ ইত্যাদিভিঃ সূত্রৈঃ প্রতিপাদ্যতে। চেতনত্বং নাম চৈতন্য-গুণযোগঃ। অত ঈক্ষণগুণবিরহিণঃ প্রধানতুল্যত্বমেব।’ ২।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।
অর্থাৎ :
অতএব, জিজ্ঞাস্য ব্রহ্মে পারমার্থিক (প্রকৃত সত্য) মুখ্য ঈক্ষণ (আলোচনা) প্রভৃতি গুণসম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ায় এটাও বুঝতে হবে যে, (ব্রহ্মসূত্রের) সূত্রকার (বাদরায়ণ) কর্তৃক উক্ত শ্রুতিসমূহ দ্বারা নির্বিশেষ চিন্মাত্র ব্রহ্মবাদও (শঙ্করমতও) প্রত্যাক্ষাত হয়েছে। কেননা, নির্বিশেষবাদে ঈশ্বরের সাক্ষিত্ব ধর্মও অপারমার্থিক বা অসত্য ; (সুতরাং গৌণ)। বেদান্ত-বেদ্য ব্রহ্মই এখানে জিজ্ঞাস্যরূপে প্রতিজ্ঞাত হয়েছেন ; সেই ব্রহ্ম যে চেতন বস্তু, তা-ই ‘ঈক্ষতেঃ নাশব্দম্’ এসব শব্দ দ্বারা প্রতিপাদিত হয়েছে। চেতনত্ব অর্থই চৈতন্যগুণের যোগ বা সম্বন্ধ ; অতএব, ঈক্ষণ-গুণহীন পদার্থ (ব্রহ্ম) তো সাংখ্যোক্ত প্রধানেরই সমান (শ্রীভাষ্য-২-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।
অতঃপর রামানুজ আরো বলেন-

‘কিঞ্চ নির্ব্বিশেষ-প্রকাশমাত্র-ব্রহ্মবাদে তস্য প্রকাশত্বমপি দুরুপপাদম্ । প্রকাশো হি নাম স্বস্য পরস্য চ ব্যবহারযোগ্যতামাপাদয়ন্ বস্তুবিশেষঃ। নির্ব্বিশেষস্য বস্তুনস্তদুভয়রূপত্বাভাবাৎ ঘটাদিবদচিত্বমেব। তদুভয়রূপত্বাভাবেহপি তৎক্ষমত্বমস্তীতি চেৎ; তন্ন, তৎক্ষমত্বং হি তৎসামর্থ্যমেব। সামর্থ্য-গুণযোগে হি নির্ব্বিশেষবাদঃ পরিত্যক্তঃ স্যাৎ।’ ৩।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)
অর্থাৎ :
আরও এক কথা, ব্রহ্মকে নির্বিশেষ প্রকাশমাত্রস্বরূপ বললে, তাঁর ‘প্রকাশত্ব’ই উপপাদন বা সমর্থন করা যায় না; কারণ, (অন্যের নিকট) নিজের ও অপরের ব্যবহার-যোগ্যতা সম্পাদক বস্তুবিশেষই প্রকাশ পদবাচ্য; নির্বিশেষ বস্তুতে সেই উভয়ই অসম্ভব; সুতরাং ঘটাদি পদার্থের ন্যায় তার অচিদ্রূপতাই (জড়তা) সিদ্ধ হতে পারে। যদি বলো, স্ব-পর ব্যবহার্যতারূপ এই অবস্থাদ্বয় না থাকলেও নিশ্চয়ই এ-বিষয়ে তার ক্ষমতা আছে। না- তা হয় না; কারণ, এ-বিষয়ে ক্ষমতা অর্থ- এ-বিষয়ে সামর্থ্য; ব্রহ্মে এই সামর্থ্যরূপ গুণের সম্বন্ধ স্বীকার করলে তো নির্বিশেষবাদ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে (শ্রীভাষ্য-৩-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ব্রহ্ম অনন্ত গুণের অধিকারী। এই অনন্তগুণের মধ্যে সত্তা, চৈতন্য ও আনন্দ ব্রহ্মের একাধারে স্বরূপ ও গুণ। তাই ব্রহ্ম শুধু সৎ নন, সত্তাবানও বটে; শুধু জ্ঞান নন, জ্ঞানবান; আবার শুধু আনন্দ নন, আনন্দময়। চিৎ ও অচিৎ তাঁর অংশ। চিৎশক্তির বিক্ষেপের দ্বারা জীবের এবং অচিৎশক্তির বিক্ষেপের দ্বারা জগতের সৃষ্টি হয়েছে। তাই তিনি জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয়ই।

ব্রহ্ম সনাতন কর্তা ও পরিণামরূপ জগৎ-কারণ
রামানুজ সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী। তাঁর মতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত নয়, পরিণাম। ব্রহ্মই জীব ও জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে দুভাবে চিন্তা করা যায়- কারণরূপে ও কার্যরূপে। প্রলয়কালে জগৎ যখন ধ্বংস হয়, তখন জীব ও জড়, ব্রহ্মের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় অবস্থান করে। তখন ঈশ্বর কারণরূপে বিদ্যমান থাকেন এবং সূক্ষ্ম অচিৎ ও বিদেহ আত্মাগুলি ঈশ্বরের শরীররূপে থাকে। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় কারণ-ব্রহ্ম। সমগ্র বিশ্বসংসার এই সময় ব্রহ্মে লীন হয়ে থাকে। সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ ও অচিৎ অংশ যথাক্রমে জীবজগৎ ও জড়জগতে ব্যক্ত হয়, তখন ব্রহ্মকে বলা হয় কার্য-ব্রহ্ম। সংক্ষেপে বললে, কারণ-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের অব্যক্ত অবস্থা এবং কার্য-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের ব্যক্ত অবস্থা। প্রমাণস্বরূপ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ শ্রুতিতেও বলা হয়েছে-

‘যো যোনিং যোনিম্ অধিতিষ্ঠতি একঃ যস্মিন্ ইদং সং চ বি চৈতি সর্বম্ ।
তমীশানং বরদং দেবমীড্যং নিচায্যেমাং শান্তিম্ অত্যন্তম্ এতি’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)
অর্থাৎ :
ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সবকিছুর মূল। জগৎ প্রকাশিত হলে সেই জগৎকে তিনিই পালন করেন। আবার প্রলয়কালে জগৎ তাঁর কাছেই ফিরে যায়। তিনি সবকিছুর নিয়ন্তা। একমাত্র তিনিই ভক্তদের বর দেন। তিনিই একমাত্র আরাধ্য। এই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হলে শাশ্বত শান্তি লাভ করা যায় (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জগতের অন্তর্বর্তী এবং অতিবর্তী উভয়ই। তিনি জীব-জগতে উপাদান কারণ হিসেবে সংসারে অনুস্যুত থেকে জড় প্রকৃতি ও আত্মাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কার্য-ব্রহ্ম হিসেবে এই বিশ্বসংসারের সব কিছুই ব্রহ্মাত্মক। আবার ঈশ্বর জগতের অতিবর্তীও। কারণ এই সসীম জগতে ঈশ্বরের সম্পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব নয়। বস্তুত ঈশ্বর হলেন একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তা। তিনি অপ্রাকৃত দেহ-বিশিষ্ট। রামানুজের মতে দেহ বন্ধনের কারণ নয়, কর্মই বন্ধনের কারণ। তাই ঈশ্বর দেহবিশিষ্ট হয়েও বদ্ধ নন। তিনি কর্মের অধ্যক্ষ ও নিয়ন্তা।

ব্রহ্ম নিত্য-তৃপ্ত ও বিকারহীন
ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের কোন পরিবর্তন হয় না। পরিণামবাদী রামানুজ ব্রহ্মের কোন বিকার স্বীকার করেন নি। ঈশ্বরের চিৎ ও অচিৎ অংশ নিত্য। তাই চিৎ ও অচিৎ-এর পরিণামের জন্য ঈশ্বরের কোন প্রকার বিকার হয় না। তিনি নিজে অপরিবর্তিত দ্রব্যরূপে অবস্থান করে বিশ্বসংসারের পরিবর্তন ঘটান। অপরপক্ষে ঈশ্বরের প্রকারগুলির অর্থাৎ আত্মা ও জড় পদার্থের বিভিন্ন রূপের পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে রামানুজ গুণ ও প্রকারের পার্থক্য করেননি। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের গুণ বা প্রকার। যেমন- একজন ব্যক্তির বাল্য যৌবন এভাবে দেহ ও মনের পরিবর্তন হলেও তার ব্যক্তিত্বের ঐক্য ও অভিন্নতা অক্ষুণ্ন থাকে, তেমনি চিৎ ও অচিৎ পরিবর্তিত হলেও ঈশ্বরের কোন পরিবর্তন হয় না। তাই অচিৎ বা জড়ের প্রকৃতিগত সীমাতে তিনি আবদ্ধ নন এবং জীবাত্মাগুলির দুঃখযন্ত্রণা তাঁকে প্রভাবিত করতে পারে না। শ্রীভাষ্যে তাই রামানুজ বলেছেন-

‘এবঞ্চ সতি পরমাত্মানং প্রতি জীবস্য শরীরতয়া অন্বয়াৎ জীবগতা ধর্ম্মাঃ পরমাত্মানং ন স্পৃশন্তি যথা স্বশরীরগতা বালত্বযুবত্বাদয়ো ধর্ম্মা জীবং ন স্পৃশন্তি।’ ১৯।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)
অর্থাৎ :
এইরূপে জীবাত্মা পরমাত্মার শরীরস্থানীয় হওয়ায় স্বীয় শরীরগত বালত্ব, যুবত্ব প্রভৃতি ধর্ম যেমন জীবকে স্পর্শ করে না, তেমনি জীবগত ধর্মসমূহও পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না (শ্রীভাষ্য-১৯-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)।

রামানুজের মতে, ব্রহ্ম নির্বিকার হলেও নিষ্ক্রিয় নন। তিনি জীবের কর্মানুসারে জীবকে পরিচালনা করেন এবং জীবের সাধনায় বা উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে মুক্তি দান করেন। তবে জগতের সৃষ্টি বা পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর কোন প্রয়োজন সাধিত হয় না। জীবের প্রয়োজনেই তাঁর জগৎ-পরিচালনা। তিনি নিত্য-তৃপ্ত এবং তাঁর দিক থেকে জগৎসৃষ্টি লীলা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি জগতে অন্তর্লীন হয়েও জগতের অতিরিক্ত। তাই শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘এবং পরমাত্মচিদচিৎ-সঙ্ঘাতরূপজগদাকারপরিণামে পরমাত্ম-শরীরভূতচিদংশগতাঃ সর্ব্ব এবাপুরুষার্থঃ; তথাভূতাচিদংশগতাশ্চ সর্ব্বে বিকারাঃ; পরমাত্মনি কার্য্যত্বম্; তদবস্থয়োস্তয়োর্নিয়ন্তৃত্বেনাত্মত্বম্; পরমাত্মা তু তয়োঃ শরীরভূতয়োর্নিযন্তৃ তয়াত্মভূতস্তদ্গতাপুরুষার্থৈর্ব্বিকারৈশ্চ ন স্পৃশ্যতে; অপরিচ্ছিন্নজ্ঞানানন্দময়ঃ সর্ব্বদৈকরূপ এব জগৎপরিবর্ত্তনলীলয়াবতিষ্ঠতে। তদেতদাহ- ‘সত্যং চানৃতং চ সত্যমভবৎ’-(তৈত্তিরীয়-৬/২) ইতি। বিচিত্র চিদচিদ্রূপেণ বিক্রিয়মাণমপি ব্রহ্ম সত্যমেবাভবৎ- নিরস্তনিখিলদোষগন্ধমপরিচ্ছিন্ন-জ্ঞানানন্দমেকরূপম্ এব ভবদিত্যর্থঃ। সর্ব্বাণি চিদচিদ্বস্তূনি সূক্ষ্মাদশাপন্নানি স্থূলদশাপন্নানি চ পরস্য ব্রহ্মণো লীলোপকরণানি; সৃষ্ট্যাদয়শ্চ লীলেতি ভগবদ্দ্বৈপায়ন-পরাশরাদিভিরুক্তম্ ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৭)।
অর্থাৎ :
পরমাত্মার যে চেতনাচেতনসমষ্টিরূপ জগদাকারে পরিণাম, তাতে পরমাত্মার শরীরস্থানীয় চেতনাংশগত সমস্তই অপুরুষার্থ, অর্থাৎ জীবের প্রকৃত মঙ্গলকর নয়; এবং পরমাত্মার শরীরভূত অচেতনপদার্থগত সমস্ত বিকার (পরিণাম), পরমাত্মগত কার্য্যত্ব এবং সেই অবস্থায় যে চেতন ও অচেতনের নিয়ামকরূপে আত্মত্ব; স্বশরীরভূত সেই চেতনাচেতনের নিয়ামকরূপে আত্মস্বরূপ পরমাত্মা কিন্তু স্বশরীরগত উক্ত অনর্থরাশি ও বিকার দ্বারা স্পৃষ্ট হন না; বরং অপরিচ্ছিন্ন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ তিনি সর্বদা একরূপ থেকে জগতের পরিবর্তনরূপ লীলা সম্পাদনকারী হিসেবে অবস্থান করেন। এ কথাই ‘সেই সত্যরূপ পরমাত্মা সত্য ও অসত্যরূপ হলেন’-(তৈত্তিরীয়-৬/২) বাক্যে অভিহিত হয়েছে। (অভিপ্রায় এই যে,) ব্রহ্ম চেতনাচেতনরূপে বিকারপ্রাপ্ত হয়েও স্বয়ং সত্যই ছিলেন, অর্থাৎ সবধরনের দোষসম্বন্ধশূন্য ও অপরিচ্ছিন্ন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপে একরূপই ছিলেন। সূক্ষ্মাবস্থাপন্নই হোক, আর স্থূলাবস্থাপন্নই হোক, চেতনাচেতন সমস্তই পরব্রহ্মের লীলোপকরণ। সৃষ্টি প্রভৃতি কার্য যে ভগবানেরই লীলা, তা ভগবন দ্বৈপায়ন এবং পরাশর প্রভৃতি মুনি বিভিন্ন স্মৃতিতেও বলেছেন (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৭)।

তাই ব্রহ্মসূত্রেও (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩) বলা হয়েছে- ‘লোকবত্তু লীলা-কৈবল্যম্’ অর্থাৎ, ‘লোকব্যবহারের ন্যায় সৃষ্টি কেবল ঈশ্বরের লীলা মাত্র’।

ব্রহ্ম পুরুষোত্তম ও অনন্ত-কল্যাণময়
রামানুজের মতে ব্রহ্ম পুরুষোত্তম বা পুরুষশ্রেষ্ঠ, কল্যাণগুণাধার, উপাস্য ভগবান। এই মতে ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও জগৎকর্তা একই সত্তার নামান্তরমাত্র। যেহেতু ঈশ্বর পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাই তাঁর কোন দোষ-ত্রুটি নেই। তিনি পুণ্য ও ধর্মের আশ্রয়স্থল। তাঁর জ্ঞান ও আনন্দ অনন্ত। তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। ঈশ্বরের জ্ঞান, শক্তি ও করুণা অনন্ত, নিত্য, অসীম ও অনুপম। তিনি অজ্ঞানের জ্ঞান, শক্তিহীনের শক্তি, ভক্তের ভগবান, অনাথের নাথ, অপরাধীর কাছে ক্ষমা, পীড়িতের কাছে করুণা, অশুচি ও অপবিত্র জনের কাছে স্নেহময় পিতা ও সকলের প্রতি সদয়। শ্রদ্ধা, প্রীতি ও ভক্তির মাধ্যমে এই পুরুষশ্রেষ্ঠকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর কৃপা বা করুণাতেই আমরা দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হই।

রামানুজ বলেন যে, ঈশ্বর যদিও স্বয়ং এক ও অদ্বৈত, তবুও তিনি ভক্তদের সাহায্য করার জন্য নিজেকে পঞ্চরূপে প্রকাশ করেন। তাঁর এই পাঁচটি রূপ হলো- প্রথমত, তিনি জগতের ও জীবাত্মাসমূহের আত্মা বা অন্তর্যামীরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। তাঁর দ্বিতীয় রূপটি হলো জগতের অতিবর্তী বৈকুণ্ঠবাসী নারায়ণ। তিনি হলেন পরম পুরুষ। ঈশ্বর তাঁর তৃতীয় রূপটি আবার চারপ্রকার ব্যূহের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
প্রথম ব্যূহরূপটি হলো বাসুদেব, যিনি জগতের কর্তা। দ্বিতীয় ব্যূহরূপটি হলো সংকর্ষণ। এই রূপে তিনি জীবের বুদ্ধির কর্তৃত্ব করেন এবং জগতের সংহার করেন। তৃতীয় ব্যূহরূপটি হলো প্রদ্যুম্ন। এই রূপে তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন এবং জীবসমূহের আবেগের কর্তৃত্ব করেন। চতুর্থ ব্যূহরূপটি হলো অনিরুদ্ধ। এই রূপে তিনি জগৎ পালন করেন এবং জীবদের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। চারটি ব্যূহরূপ হলো এককভাবে পরমেশ্বরের আংশিক প্রকাশ। যখন ঈশ্বর মানুষের বা পশুর শরীর ধারণ করে জগতে অবতরণ করেন, তখন তাঁকে বিভব বা অবতার বলা হয়। এটিই তাঁর চতুর্থ রূপ।

রামানুজের মতবাদের সাথে ভগবদ্গীতার শিক্ষার প্রচুর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, অবতার বিষয়ে শ্রীগীতায় উদ্ধৃত হয়েছে-

‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্’।। (গীতা-৪/৭)
‘পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’।। (গীতা-৪/৮)
অর্থাৎ :
হে ভারত, যখন প্রাণিগণের অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়সের কারণ বর্ণাশ্রমাদি ধর্মের অধঃপতন ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি স্বীয় মায়াবলে যেন দেহবান হই, যেন জাত হই (গীতা-৪/৭)।  সাধুদিগের রক্ষার জন্য, দুষ্টদিগের বিনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নবাদিরূপে অবতীর্ণ হই (গীতা-৪/৮)।

আচার্য রামানুজও যেন তারই পুনরুক্তি করে বলেন, সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মের পুনঃস্থাপনের জন্য ঈশ্বর অবতার হন। অবতার দু’প্রকারের- মুখ্য ও গৌণ অবতার। ঈশ্বর যখন স্বয়ং অবতীর্ণ হন, তখন তাঁকে মুখ্য অবতার বলা হয়। যেমন শ্রীকৃষ্ণ। কয়েকটি আত্মা যখন ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত হন, তখন তাঁদের ঈশ্বরের গৌণ অবতার বলা হয়। যেমন শিব, বুদ্ধ ইত্যাদি। পরমকারুণিক ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের সেবার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য তাঁর পঞ্চম রূপটি ধারণ করেন। এই রূপটিকে বলা হয় অর্চাবতার। রামানুজের মতে ঈশ্বর মূর্তিকে আশ্রয় করে মন্দিরে অবস্থান করেন যাতে ভক্তগণ তাঁর সেবার প্রত্যক্ষ সুযোগ পায়।

আচার্য রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্যের সমন্বয়-অধিকরণের আলোচনান্তে বলেছেন- ‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে’ প্রভৃতি বেদান্তবাক্য একথাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, সকলপ্রকার দোষরহিত, অনন্ত কল্যাণ-গুণের আকর, নিরবধিক, নিরতিশয় ও আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মই জগতের একমাত্র কারণ।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : ভূমিকা- রামানুজ] [*] [পরের পর্ব : রামানুজের মতে জগৎ]

No comments: