Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১৫ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মার সাধন



| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১৫ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মার সাধন |
রণদীপম বসু
(ঘ) আত্মার সাধন :
বলা হয়, বিজ্ঞানময় ব্রহ্মই স্বয়ং উপাধিযুক্ত হয়ে, সসীম দেহ ইত্যাদি যুক্ত হয়ে- জীবরূপ ধারণ করেন। সেইজন্যই বিজ্ঞানময়তা জীবের স্বভাবধর্ম এবং মূর্চ্ছা বা সুষুপ্তি অবস্থায় এই বিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় না। কারণ-

‘জ্ঞঃ অতঃ এব’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৮)।।
ভাবার্থ : (সৃষ্ট হননি বলেই) নিত্য আত্মা স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ (ব্রঃ-২/৩/১৮)।
কিন্তু অণু পরিমাণযুক্ত আত্মার ক্রিয়া ও জ্ঞানের প্রকাশ বা উপায় হলো উপাধিযুক্ত ইন্দ্রিয়াদি। যেমন মাণ্ডূক্য উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘জাগরিতস্থানো বহিষ্প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ স্থূলভূগ্বৈশ্বানরঃ প্রথমঃ পাদঃ’।। (মাণ্ডূক্য-উপ-৩)।।
অর্থাৎ : জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে সচেতন এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা এই জগৎকে উপলব্ধি করি। যাঁর সাতটি অঙ্গ এবং উনিশটি মুখ বা উপলব্ধির দ্বারা জীব হিসেবে তিনিই এই স্থূলদেহ ভোগ করেন। এটিই আত্মার প্রথম প্রকাশ (মাণ্ডূক্য-উপ-৩)।

অধিকাংশ শ্রুতিতে ইন্দ্রিয় ‘প্রাণ’ বলেই আখ্যায়িত হয়। এই ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা কতো ? মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘সপ্ত প্রাণাঃ প্রভবন্তি তস্মাৎ সপ্তার্চিষঃ সমিধঃ সপ্ত হোমাঃ।
সপ্ত ইমে লোকা যেষু চরন্তি প্রাণা গুহাশয়া নিহিতাঃ সপ্ত সপ্ত’।। (মুণ্ডকোপনিষদ-২/১/৮)।।
অর্থাৎ : সেই ব্র্হ্ম থেকেই সাতটি প্রাণ বা ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব। এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি বিষয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসকল, সাত প্রকার বিষয় জ্ঞান, জীবদেহে এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি অধিষ্ঠান- এ সবই ব্রহ্ম থেকে এসেছে। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল আত্মায় বিলীন হয়। আত্মা তখন (যেমন সুষুপ্তিকালে) হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন (মুণ্ডক-২/১/৮)।

আবার কোন কোন শ্রুতিতে আট বা ততোধিক ইন্দ্রিয়ের উল্লেখ আছে। যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদেই বলা হয়েছে-

‘প্রাণো বৈ গ্রহঃ সোহ্পানেনাতিগ্রাহেণ গৃহীতোহ্পানেন হি গন্ধান্ জিঘ্রতি’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/২)।। ‘বাক্ বৈ গ্রহঃ স নাস্নাতিগ্রাহেণ গৃহীতো বাচা হি নামানি অভিবদতি’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/৩)।। ‘জিহ্বা বৈ গ্রহঃ স রসেনাতিগ্রাহেণ গৃহীতো জিহ্বয়া হি রসান্ বিজানাতি’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/৪)।। ‘চক্ষুর্বৈ গ্রহঃ স রূপেণাতিগ্রাহেণ গৃহীতশ্চক্ষুষা হি রূপাণি পশ্যতি’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/৫)।। ‘শ্রোত্রং বৈ গ্রহঃ স শব্দেনাতিগ্রাহেণ গৃহীত শ্রোত্রেণ হি শব্দান্ শৃণোতি’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/৬)।। ‘মনো বৈ গ্রহঃ স কামেনাতিগ্রাহেণ গৃহীতো মনসা হি কামান্ কাময়তে’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/৭)।। ‘হস্তৌ বৈ গ্রহঃ স কর্মণাতিগ্রহেণ গৃহীতো হস্তাভ্যাং হি কর্ম করোতি’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/৮)।। ‘ত্বক্ বৈ গ্রহঃ স স্পর্শেনাতিগ্রাহেণ গৃহীতস্ত¡চা হি স্পর্শান্ বেদয়ত। ইতি এতে অষ্টৌ গ্রহাঃ অষ্টাবতিগ্রহাঃ’। (বৃহদারণ্যক-৩/২/৯)।।
অর্থাৎ :
প্রাণ গ্রহ (ইন্দ্রিয়)। অপানবায়ু অতিগ্রহ। প্রাণবায়ু অর্থাৎ ঘ্রাণেন্দ্রিয় যে আঘ্রাণ নেয়, গন্ধ গ্রহণ করে তা এই অপানবায়ুর সাহায্যে (বৃঃ-৩/২/২)।  বাগিন্দ্রিয় দ্বিতীয় গ্রহ। এই ইন্দ্রিয়ের বিষয়- নাম। বাক্ই নাম উচ্চারণ করে। তাই তার নাম অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৩)।  জিহ্বা তৃতীয় গ্রহ। এই রসনেন্দ্রিয়ের বিষয় হলো রস গ্রহণ করা। তাই রাস তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৪)।  দর্শনেন্দ্রিয় চক্ষু- চতুর্থ গ্রহ। চক্ষুই রূপ দেখে। রূপই তার দেখার বিষয়। তাই রূপ তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৫)।  শ্রোত্রেন্দ্রিয় কর্ণ হলো পঞ্চম গ্রহ। এর বিষয় হলো শব্দ। কানই শব্দ শোনে। তাই শব্দ তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৬)।  মন হলো ষষ্ঠ গ্রহ। মনই কামনা করে। মনই কামনার বশ। তাই কামনা হলো তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৭)।  হাত দুটি হলো সপ্তম গ্রহ। হাতের বিষয় হলো কর্ম। কারণ মানুষ হাত দিয়েই কর্ম করে। তাই কর্ম তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৮)।  আর ত্বক- এটি হলো অষ্টম গ্রহ। ত্বক-ইন্দ্রিয়ের বিষয় হলো স্পর্শ। মানুষ ত্বক দিয়েই যাবতীয় স্পর্শ অনুভব করে। তাই স্পর্শ হলো তার অতিগ্রহ। এই হলো আটটি গ্রহ আর আটটি অতিগ্রহ (বৃহদারণ্যক-৩/২/৯)।

এই শ্রুতিগুলির মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে বিধায় এই বিরোধ পরিহার ও সমন্বয় করে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-

‘হস্তাদয়স্তু, স্থিতেঃ অতঃ নৈবম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৬)।।
ভাবার্থ : অন্য শ্রুতিতে হস্তাদি প্রাণ বা ইন্দ্রিয়সমূহের উল্লেখ থাকায় প্রাণ বা ইন্দ্রিয়সংখ্যা সাতটি মাত্র নয়। একাদশ বলেই এদের সংখ্যা গণনা করা হয় (ব্রঃ-২/৪/৬)।

সুতরাং পূর্ব-উল্লিখিত সাতটির সাথে অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্, বাক্ এবং অন্তঃকরণের সাথে অন্য চারটিও অর্থাৎ হস্ত, পদ, পায়ু এবং উপস্থকে যোগ করে সর্বমোট ইন্দ্রিয় সংখ্যা হলো একাদশ। তবে অন্তরেন্দ্রিয়ের (অন্তঃকরণের) বিভিন্ন রূপান্তরগুলি, যথা- মন, বুদ্ধি, অহং এবং চিত্ত (স্মরণেন্দ্রিয়)-গুলি পৃথক কোন ইন্দ্রিয় নয়, সুতরাং ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা একাদশের বেশি হতে পারে না। তাই একাদশই হলো নির্দিষ্ট সংখ্যা। এগুলি হলো- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসা ও ত্বক ; পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক্য, হস্ত, পদ, পায়ু বা মল-ইন্দ্রিয় ও উপস্থ বা মূত্র-ইন্দ্রিয় ; এবং অন্তঃকরণ। এসকল ইন্দ্রিয় অনিত্য ও একদেশী। বাদরায়ণের মতে ইন্দ্রিয়গুলি আকারে সূক্ষ্ম বা অণুপরিমাণ-
‘অণবশ্চ’।। (২/৪/৭)।।
ভাবার্থ : প্রাণসমূহ (ইন্দ্রিয়সমূহ) সূক্ষ্ম-ই (ব্রঃ-২/৪/৭)।

সূক্ষ্ম বা অণু বলতে পরমাণু পরিমাণ বুঝায় না। আকারে সীমিতই বুঝায়। এবং ইন্দ্রিয়গুলি সূক্ষ্ম বলেই এগুলি দৃষ্টিগোচর হয় না। আমরা যেমন ইন্দ্রিয়সমূহ দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি না যে, বিশ্বের কোথায় কী সংঘটিত হচ্ছে, যদি ইন্দ্রিয়গুলি সর্বব্যাপী হতো তাহলে সেরূপ অনুভব করা যেতো। তাছাড়া ইন্দ্রিয়সমূহ যদি সর্বব্যাপী হতো, তাহলে শ্রুতিতে যে বলা হয়, এরা মৃত্যুর সময় উৎক্রান্ত ও বিগত হয় এবং জন্মের সময় পুনরায় আগত হয়, তা বিরুদ্ধ হতো। সুতরাং ইন্দ্রিয়গুলি সূক্ষ্ম এবং আয়তনে সীমিত।


একাদশ ইন্দ্রিয় ছাড়া মুখ্য প্রাণও আত্মার সাধনের মধ্যে গণ্য করা হয় এবং তাও অনিত্য ও অণু পরিমাণ। শাস্ত্রে এই মুখ্য প্রাণ যে বায়ু এবং ইন্দ্রিয়বৃত্তি থেকে পৃথক তা শ্রুতির বর্ণনায় পৃথকভাবে উল্লেখ করা থেকেই প্রমাণ হয়। যেমন-
‘এতস্মাজ্জায়তে প্রাণো মনঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ।
খং বায়ুর্জ্যোতিরাপঃ পৃথিবী বিশ্বস্য ধারিণী’।। (মুণ্ডকোপনিষদ-২/১/৩)।।
অর্থাৎ : প্রাণ, মন, সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং সর্ববস্তুর আশ্রয় এই পৃথিবী, সব এর থেকেই (অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্ম থেকে) এসেছে (মুণ্ডক-২/১/৩)।

এসব শ্রুতি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, তা কোন প্রাণশক্তি বা ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়া নয়। যদি তা হতো তাহলে তাকে ইন্দ্রিয় থেকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হতো না। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে সিদ্ধান্ত করেন-
‘শ্রেষ্ঠশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৮)।।
‘ন বায়ুক্রিয়ে, পৃথগুপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৯)।।
‘চক্ষুরাদিবত্তু, তৎসহশিষ্ট্যাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১০)।।
‘ত ইন্দ্রিয়াণি, তদ্ব্যপদেশাদন্যত্র শ্রেষ্ঠাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১৭)।।
‘বৈলক্ষণ্যাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১৯)।।
ভাবার্থ :
মুখ্য প্রাণও অন্যান্য প্রাণের মতো ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৮)।   মুখ্যপ্রাণ, বায়ু অথবা ইন্দ্রিয় অথবা ইন্দ্রিয়সমূহের সামান্য বৃত্তিও নয়; কারণ শ্রুতি প্রাণকে বায়ু ও ক্রিয়া থেকে পৃথক বলে নির্দেশ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৯)।   চক্ষু প্রভৃতির সাথে প্রাণের একসঙ্গে উল্লেখ থাকায় প্রাণ জীবের ন্যায় কর্তা-ভোক্তা নয়। ভোগোপকরণ মাত্র (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১০)।   মুখ্যপ্রাণ ছাড়া অন্য সকল প্রাণকেই শাস্ত্রে ইন্দ্রিয় বলেই অভিহিত করা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১৭)।   মুখ্যপ্রাণের ধর্ম এবং ইন্দ্রিয়াদির ধর্ম ভিন্ন বলে এরা এক নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১৯)।

এই মুখ্যপ্রাণকে বেদান্তসূত্রে পঞ্চবৃত্তিবিশিষ্ট বলেও বাদরায়ণ উল্লেখ করেছেন-
‘পঞ্চবৃত্তির্মনেবদ্ব্যপদিশ্যতে’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১২)।।
ভাবার্থ : মন যেমন পঞ্চবৃত্তিবিশিষ্ট, প্রাণও তেমনি পঞ্চবৃত্তিবিশিষ্ট বলে শ্রুতিতে উপদেশ করা হয়েছে (ব্রঃ-২/৪/১২)।

শাস্ত্রানুযায়ী মুখ্যপ্রাণের পঞ্চধা বিভক্ত এই পঞ্চবৃত্তি হলো- প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান এবং সমান। এই প্রত্যেকটিরই একটি নির্দিষ্ট কার্য আছে, যেমন- নিঃশ্বাস, প্রশ্বাস, সর্বদেহের উপর ক্রিয়া ও শক্তির প্রকাশ, আত্মাকে দেহ থেকে নির্গত হতে সহায়ক করা, এবং ভুক্ত খাদ্যকে পরিপাক করে সর্বদেহে তা সঞ্চারিত করা। এই বিভক্ত হওয়ার ব্যাপারে অন্তঃকরণের সাথে প্রাণের সাদৃশ্য আছে। বলা হয়, অন্তঃকরণ একটি হলেও তা চারটি আকারে কার্যকারিতা হয়, যথা- মন, বুদ্ধি, অহং ও চিত্ত (স্মৃতি) রূপে।


এবং প্রাণের সূক্ষ্মতা বিষয়েও বাদরায়ণ তাঁর সিদ্ধান্তে বলেন-
‘অণুশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১৩)।।
ভাবার্থ : মুখ্যপ্রাণও অণুপরিমাণ। সূক্ষ্মভাবেই তা উৎক্রান্ত হয় (ব্রঃ-২/৪/১৩)।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : আত্মা ব্রহ্ম নয়, ব্রহ্মেরই অংশ] [*] [পরের পর্ব : আত্মার অবস্থা]

No comments: