Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবেদান্ত-০১ : ভূমিকা- গৌড়পাদ ও শঙ্করাচার্য



| বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবেদান্ত-০১ : ভূমিকা- গৌড়পাদ ও শঙ্করাচার্য |
রণদীপম বসু

১.০ : ভূমিকা
অদ্বৈতবাদকে উপনিষদীয় চিন্তাধারার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি বলে মনে করা হয়। যদিও এই মতবাদের সূত্রপাত শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) আবির্ভাবের পূর্বকালেই ঘটেছিলো, তবুও এই মতবাদ শঙ্করাচার্যের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। শঙ্করাচার্যের গুরু ছিলেন আচার্য গোবিন্দ। গোবিন্দের গুরু গৌড়পাদ। গৌড়পাদই প্রথম উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও গীতার প্রতিপাদ্য বিষয়কে অবলম্বন করে একটি যুক্তিসঙ্গত অদ্বৈত মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর বিখ্যাত গৌড়পাদকারিকা রচনা করেন, যা অদ্বৈতকারিকা বা মাণ্ডুক্যকারিকা নামে প্রসিদ্ধ। শঙ্করাচার্য বারবার গৌড়পাদ ও তাঁর কারিকার কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। তাই আচার্য গোবিন্দ শঙ্করাচার্যের দীক্ষাগুরু হলেও শিক্ষাগুরু ছিলেন গৌড়পাদই।
তবে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ কেবলমাত্র তাঁর পূর্বসূরীর পুনরাবৃত্তি ছিলো না মোটেও। অসাধারণ প্রতিভাবান তিনি বেদ, উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র, গীতা ও গৌড়পাদকারিকাকে ভিত্তি করে এক অনবদ্য, সুসংহত ও যুক্তিপ্রয়াসের মাধ্যমে অদ্বৈত দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। এই দর্শনই তাঁর অসামান্য মৌলিক দার্শনিক প্রতিভা ও অধ্যাত্মবোধের প্রতিফলন। আচার্য শঙ্কর অদ্বৈতবাদ তথা সমগ্র বেদান্ত দর্শনকে এমন এক যুক্তিভিত্তিক ও মর্যাদাপূর্ণ ভাববাদীয় স্তরে উন্নীত করেছেন যে, বেদান্তের আলোচনা বলতে প্রথমেই তাঁর মতবাদের আলোচনাই মনে পড়ে। তবে অদ্বৈতবাদের ধারণা যেহেতু শঙ্করপূর্বকালের, তাই শঙ্করের দর্শনের উৎস অনুসন্ধানের জন্য তাঁর পূর্বসূরী গৌড়পাদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখা আবশ্যক মনে হয়।


১.১ : গৌড়পাদ (৫০০খ্রিঃ)
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীকে গৌড়পাদের সময়কাল বলে ধারণা করা হয়, এবং তিনি ছিলেন নর্মদাতীরস্থ স্থানের অধিবাসী। নর্মদা নদী ভারতের মধ্যপ্রদেশ, মালব ও গুজরাট পর্যন্ত বহমান হলেও ঠিক কোন জায়গায় গৌড়পাদের নিবাস ছিলো তা নিশ্চিত করা যায়নি।

গৌড়পাদ মাণ্ডুক্য উপনিষদকে ভিত্তি করে বিখ্যাত আগমশাস্ত্র বা মান্ডুক্যকারিকা রচনা করেন। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার ওপরেও গৌড়পাদের একটি ক্ষুদ্র টীকা আছে বলে জানা যায়। তবে তাঁর মহান কৃতি হলো আগমশাস্ত্র বা মাণ্ডুক্য-কারিকা। মাণ্ডুক্য-কারিকার চারটি অধ্যায় যার প্রথম অধ্যায়টিই শুধু মাণ্ডুক্য উপনিষদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, আর বাকি তিনটি অধ্যায়ের মাধ্যমে গৌড়পাদ স্বীয় দার্শনিক মত প্রকাশ করেছেন। মাণ্ডুক্য উপনিষদটি একটি অতি ক্ষুদ্র বারোটি মন্ত্রে পঁচিশ পঙক্তির উপনিষদ। গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য-কারিকার প্রথম অধ্যায় আগম প্রকরণে মাণ্ডুক্য উপনিষদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায় বৈতথ্য প্রকরণে জগতের মিথ্যাত্বের প্রমাণ রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায় অদ্বৈত প্রকরণে জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য সম্পর্কীয় আলোচনা রয়েছে। আর চতুর্থ অধ্যায় অলাতশান্তি প্রকরণে মায়ার কারণে যে জগৎ সত্য বলে প্রতিভাত হয় তারই আলোচনা রয়েছে।

পন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ‘গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য উপনিষদের ওপর কারিকা রচনা প্রমাণ করে যে তিনি উপনিষদকে তাঁর দর্শনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত মনে করতেন কিন্তু সেই সঙ্গে বুদ্ধও যে তাঁর নিকট সমান মর্যাদা ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন এ কথা তিনি গোপন করতে চাননি।’ অর্থাৎ এখানে বৌদ্ধ প্রভাব স্পষ্ট। কিভাবে ? রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেন-
‘চতুর্থ অধ্যায়ের (“আলাতশান্তি-প্রকরণ” যা কি-না বস্তুত বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের এক স্বতন্ত্র গ্রন্থ) প্রারম্ভিক কারিকাতেই তিনি বলেছেন : “আমি দ্বিপদাম্বরকে (=মনুষ্যশ্রেষ্ঠ) প্রণাম করি, যিনি তাঁর আকাশ-সদৃশ বিস্তৃত জ্ঞানের দ্বারা জেনেছেন (সম্বুদ্ধ করেছেন) যে, সকল ধর্মই (= ভাব, বস্তুসমূহ) আকাশসম শূন্য।” এই প্রকরণের ১৯তম কারিকায় পুনরায় বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে (“সর্বথা বুদ্ধৈরজাতিঃ পরিদীপিতা।”) এ ছাড়াও তিনি বুদ্ধের উপদেশের কথা দ্বিতীয় কারিকায় (৪/২) আলোচনা করেছেন। ৪২তম কারিকায় (৪/৪২) তিনি আবার বুদ্ধ এবং ৯০তম কারিকায় অগ্রযানের (=মহাযান) নাম গ্রহণ করেছেন। ৯৮ ও ৯৯তম কারিকায় (নাগার্জুনের ন্যায়) বুদ্ধের নাম করে বলেছেন যে বস্তুসমূহ স্বভাবত শুদ্ধ ও অনাবৃত; বুদ্ধ তাকে অধিক স্পষ্টভাবে জানেন। অন্তিম কারিকায় (৪/১০০) আবার তিনি পর্যায়ক্রমে বুদ্ধের বন্দনা করে গ্রন্থ সমাপ্ত করেছেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-২৫৫)।

তবে এখানে উল্লেখ্য যে, রাহুল সাংকৃত্যায়ন উদ্ধৃত ‘বুদ্ধ’ শব্দটিকে কারিকার তর্জমা বা ব্যাখ্যায় বেদান্তবাদীরা কিন্তু প্রাজ্ঞ বা জ্ঞানী অর্থেই ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ যেমন, অন্তিম কারিকাটি হলো-


‘দুর্দর্শমতিগম্ভীরমজং সাম্যং বিশারদম্ ।
বুদধ্বা পদমনানাত্বং নমস্কুর্মো যথাবলম্ ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/১০০)
অর্থাৎ :
এই তত্ত্ব ধারণা করা কঠিন। এই তত্ত্ব সুগভীর, অনাদি, সদা অপরিবর্তনীয়, শুদ্ধ এবং অদ্বৈত। আমি এই তত্ত্বকে বোঝার (বুদধ্বা) জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছি। আমি তাঁকে নমস্কার করি। (আগমশাস্ত্র-৪/১০০)।।

কারিকা রচনার জন্য মাণ্ডুক্য উপনিষদকেই নির্বাচন করার পেছনে গৌড়পাদের কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য ছিলো বলে মনে করা হয়; যেমন- প্রথমত, মাণ্ডুক্য একটি অতি ক্ষুদ্র বারো মন্ত্রে পঁচিশ পঙক্তির উপনিষদ হওয়ায় সেখানে তাঁর নিজের মতকে অধিক স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করা সহজসাধ্য ছিলো।
দ্বিতীয়ত, মাণ্ডুক্যে মাত্র ‘ওম্’ এবং তার চারটি অক্ষর দ্বারা আত্মার (=জীবের) জাগ্রতাদি চার অবস্থার (=চতুর্বর্গ) বর্ণনা করা হয়েছে, এটা এমনই একটা বিষয়, যাতে তাঁর মাধ্যমিক-যোগাচারী বৌদ্ধমত বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। যেমন, মাণ্ডুক্য-উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘ওম্ ইত্যেদক্ষরমিদং সর্বম্ । তস্যোপব্যাখ্যানং- ভূতং ভবদ্ ভবিষ্যদিতি সর্বমোঙ্কার এব যৎ চ অন্যৎ ত্রিকালতীতং তৎ অপি ওঙ্কার এব’। (মান্ডুক্য-১)।।  সর্বম্ হোতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম, সঃ অয়মাত্মা চতুষ্পাৎ’। (মাণ্ডুক্য-২)।।
অর্থাৎ :
সবকিছুই ‘ওম্’ অক্ষরাত্মক। এই যে সমুদয় জগৎ, যা আমাদের ইন্দ্রিয় চোখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, আবার ইন্দ্রিয়ের অগোচরেও যে জগৎ রয়েছে, সবই ‘ওম্’ এই অক্ষরের স্বরূপ। ‘ওম্’ এই অক্ষরের মধ্যে যে রূপ আছে, এইসব জগতের মধ্যেও সেই একই রূপ। এখানে তারই ব্যাখ্যা। এই জগৎ তিনটি কালের অধীন- অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। এই তিন কালই ওঙ্কার। আবার এই তিন কালের বাইরে যে অনন্ত কাল আছে, তাও ওঙ্কার। ওঙ্কারই সব। (‘ওম্’- পরমাত্মা বা ব্রহ্ম-ও প্রতীক শব্দ) (মাণ্ডুক্য-১)।।  তিনি পরিসীমার মধ্যেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি বৃহৎ। তাই তিনি ব্রহ্ম। এই আত্মা ব্রহ্ম। সবই ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি অংশ জীবদেহে অবস্থান করে তাকে চালনা করছেন। সেই চারটি অংশকে বলা হয়েছে চতুষ্পাদ। (মাণ্ডুক্য-২)।।

সেই চারটি অংশ বা অবস্থা কী কী ? জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তূরীয়। আত্মা জীবের এই চার অবস্থার মধ্যে থেকে কী কী কাজ করছেন ? মাণ্ডুক্য-উপনিষদে তার বর্ণনায় বলা হয়েছে-

‘জাগরিতস্থানো বহিঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ। একোনবিংশতিমুখঃ স্থূলভূগ্বৈশ্বানরঃ প্রথম পাদঃ’। (মাণ্ডুক্য-৩)।।  ‘স্বপ্নস্থানঃ অন্তঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ। একোনবিংশতিমুখঃ প্রবিবিক্তভুক্ তৈজসো দ্বিতীয় পাদঃ’। (মাণ্ডুক্য-৪)।।  ‘যত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে, ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি, তৎ সুষুপ্তম্ । সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন এবানন্দময়ো হ্যানন্দভুক্ চেতোমুখঃ প্রাজ্ঞস্তৃতীয় পাদঃ’। (মাণ্ডুক্য-৫)।।  ‘এষ সর্বেশ্বও এষ সর্বজ্ঞ এষঃ অন্তর্যামী এষ যোনিঃ সর্বস্য, প্রভবাপ্যয়ে ভূতানাম্’। (মাণ্ডুক্য-৬)।।  নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং ন উভয়তঃ প্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্ । অদৃশ্যম্ অব্যবহার্যম্ অগ্রাহ্যম্ অলক্ষণম্ অচিন্ত্যম্ অব্যপদেশ্যম্ একাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে। স আত্মা। স বিজ্ঞেয়ঃ’। (মাণ্ডুক্য-৭)।।
অর্থাৎ :
জীবের যখন জাগ্রত অবস্থা, সব ইন্দ্রিয় সজাগ অর্থাৎ অতন্দ্র, আত্মা তখন বাইরের বিষয়-জ্ঞানে মত্ত। বাইরের বিষয় হলো- শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ। জীব তা থেকেই জ্ঞানসঞ্চয় করে। জ্ঞানই হলো আত্মার খাদ্য। আত্মা তখন সাতটি অঙ্গ, আর উনিশটি মুখ দিয়ে বিশ্বের যাবতীয় স্থূল পদার্থ অনুভব করেন, ভোগ করেন। সাতটি অঙ্গ আর উনিশটি মুখ কী কী ? মাথা, দুই চোখ, প্রাণ, মূত্রাশয় আর দুই পা। পরমপুরুষ আত্মার মাথা হলো দ্যুলোক (স্বর্গলোক), সূর্য-চন্দ্র দুই চোখ, বায়ু প্রাণ, জলাশয় মূত্রাশয়, আর পৃথিবী দুই পা। উনিশটি মুখ হলো- দশটি ইন্দ্রিয় (পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়), পাঁচটি প্রাণ আর বাকি চারটি হলো মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে, কোনটাই এর বাইরে নয়। তাই জীব যখন জাগ্রত অবস্থায় থাকে তখন প্রতিটি বস্তুর জ্ঞান নিয়ে আত্মা হন বৈশ্বানর। সর্বব্যাপী আত্মার এটি হলো প্রথম পাদ বা অবস্থা। (মাণ্ডুক্য-৩)।।  আত্মার দ্বিতীয় পাদ বা স্বপ্নময় অবস্থাটি হলো তৈজস। বাইরের জগৎ তখন তাঁর পুষ্টিসাধন করে না, খোরাক যোগায় অন্তর্জগৎ। তাই তৈজস আত্মাকে বলা হয় প্রবিবিক্তভুক অর্থাৎ সূক্ষ্মবস্তুকে আশ্রয় করে আত্মা তখন অন্তরে থেকে অন্তরপ্রজ্ঞ- অন্তর জগতের জ্ঞানে জ্ঞানী। মানুষ কতো না কামনা-ধারণা-বাসনা-কল্পনা নিয়ে দিন কাটায়। যার হয়তো অনেক কিছুই সে প্রত্যক্ষ ভোগ করতে পারে না। ঘুমন্ত অবস্থায় সেগুলো স্বপ্নজগতে ভেসে ওঠে। আর এই সাত অঙ্গ, উনিশ মুখ বাইরে যদিও ঘুমোচ্ছে, ভেতরে কিন্তু সক্রিয়ভাবে থেকে সেগুলি উপভোগ করছে। (মাণ্ডুক্য-৪)।।  মানুষ যখন কোন কামনা না নিয়ে ঘুমোয়, ঘুমন্ত অবস্থায় কোন স্বপ্ন না দেখে বেশ একটি পরিচ্ছন্ন ঘুমের মধ্যে ডুবে থাকে, তখন তার সেই ঘুমন্ত অবস্থাকে বলে সুষুপ্ত অবস্থা। এই সুষুপ্তির মধ্যে এখানে কোন বিচ্ছেদ নেই, সব বিষয়ের সব জ্ঞান একসঙ্গে মিশে গিয়ে ঘন এক হয়ে যায়, আনন্দঘন- জ্ঞান এবং আনন্দকে উপভোগ করে আত্মা এখানে প্রাজ্ঞ হয়ে যান। এই প্রাজ্ঞ আত্মাই হলো তাঁর তৃতীয় পাদ বা অবস্থা। আত্মার তৃতীয় অবস্থা হলো প্রাজ্ঞ, চেতোমুখ। আনন্দই তাঁর খাদ্য। জ্ঞানমুখ। সুষুপ্তিকালে প্রাজ্ঞ আত্মা এই আনন্দকে আশ্রয় করে আনন্দময় হয়ে থাকেন। (মাণ্ডুক্য-৫)।।  তৃতীয় ক্ষেত্রে এই যে প্রাজ্ঞ-আত্মা, ইনিই হলেন সর্বেশ্বর- সকলের প্রভু, স্রষ্টা, নিয়ন্তা- সর্বশক্তিমান। ইনিই সর্বজ্ঞ- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কিছু নেই, যা এর অগোচর। ইনিই অন্তর্যামী- যেমন বাইরের জগতে ইনি আছেন, তেমনি দেহ-জগতের ভেতরে থেকে আমাদের পরিচালনা করছেন। যাবতীয় বস্তুর ইনিই যেমন উৎপত্তিস্থল, তেমনি আবার লয়স্থান। (মাণ্ডুক্য-৬)।।  (মানুষের ক্ষেত্রে যে অবস্থা মৃত্যুর নামান্তর, সাধকের কাছে সে অবস্থা হলো তুরীয় অবস্থা।) এই চতুর্থ পাদে তুরীয় অবস্থাতেই সাধকের সমাধি। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনে জীব শিব- শান্ত, অদ্বৈত- এক। এখানে আর কোন ভেদাভেদ নেই। ‘আমি’-‘তুমি’-‘সে’- এসবের বালাই নেই। সাধকের এখানে একটাই অনুভূতি, একটাই পরিচয়- ‘আমিই পরমাত্মা, পরমাত্মাই আমি’। কিন্তু এই যে অদ্বৈত-আত্মা, বিশাল অখণ্ড সত্তা, এর স্বরূপ কী ? আত্মার আগের যে রূপ- অন্তঃপ্রজ্ঞ, বহিঃপ্রজ্ঞ, প্রজ্ঞানঘন প্রজ্ঞ- এসবের কোন মাত্রাই সেখানে নেই। তাঁকে দেখা যায় না- অদৃশ্য, ব্যবহার করা যায় না- অব্যবহার্য, কোনভাবে তাঁকে চিহ্নিত করা যায় না- অচিন্তনীয়, অকল্পনীয়। কোন বিশেষণ তাঁর নেই, কোন গুণও নেই- নির্গুণ। (মাণ্ডুক্য-৭)।।

তার মানে হলো, যখন তিনি মাত্রাযুক্ত অর্থাৎ উপাধি নিয়ে, গুণ নিয়ে তখন তিনি সগুণ, সবিশেষ। আবার যখন মাত্রাহীন, উপাধিহীন, গুণহীন, তখন তিনি নির্গুণ বা নির্বিশেষ ব্রহ্ম। রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করেন, মাণ্ডুক্য-উপনিষদে আত্মার প্রতি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে (নির্গুণ ব্রহ্মে) যে সমস্ত বিশেষণ, যেমন- অ-দৃষ্ট, অ-ব্যবহার্য, অ-গ্রাহ্য, অ-লক্ষণ, অ-চিন্তা- প্রভৃতি আসে, তা নাগার্জুনের তত্ত্বের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারিকা রচনায় গৌড়পাদের চেষ্টা ছিলো বৌদ্ধদর্শনের প্রাধান্য বজায় রেখে তাকে উপনিষদের সঙ্গে সংযুক্ত করা। শূন্যবাদের মধ্যে পড়ে ক্ষণিকতা-অক্ষণিকতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন তাঁর ছিলো না। তাই গৌড়পাদের কারিকা রচনার জন্য মাণ্ডুক্য-উপনিষদই বেছে নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ‘শঙ্করও বৌদ্ধদার্শনিক মতকে পুরোপুরি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তা তিনি সম্পূর্ণত উপনিষদীয় বস্তুতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আবার একই সঙ্গে তাকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে চেয়েছেন, এইজন্য তাঁকে যোগাচারের বিজ্ঞানবাদকে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞান (=চিত্ত)-তত্ত্বের ঘোষণা করতে গিয়ে তাঁকে ক্ষণিকতা-অ-ক্ষণিকতার মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়েছিল; শঙ্কর অ-ক্ষণিক (=নিত্য) চিত্ত-তত্ত্বকে স্বীকার করে নিজেকে শুদ্ধ ব্রাহ্মণ দার্শনিকরূপে প্রমাণিত করার প্রযত্ন করেছিলেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-২৫৬)।

গৌড়পাদের দার্শনিক মত :
গৌড়পাদ মনে করতেন, একটি অদ্বয় (বিজ্ঞান) আছে, জগৎ মায়া এবং ভ্রম মাত্র, এবং আত্মা অস্তিত্বহীন, কেউই জন্ম-মৃত্যু-কর্মফল ভোগ করে না। মাণ্ডুক্য-কারিকায় গৌড়পাদ বলেছেন-

‘ঋজুবক্রাদিকাভাসম্ অলাতস্পন্দিতং যথা।
গ্রহণগ্রাহকাভাসং বিজ্ঞানস্পন্দিতং তথা।। (আগমশাস্ত্র-৪/৪৭)
অর্থাৎ : একটি জ্বলন্ত মশালকে ঘোরালে তার আলোর রেখা কখনো সোজা, কখনো বাঁকা আবার কখনো বা অন্য কিছু বলে মনে হয় (যদিও প্রকৃতপক্ষে আলোকরশ্মি সবসময় সোজা)। ঠিক একইভাবে চৈতন্যের পরিবর্তনও প্রতিভাত হয়- একই চৈতন্য (=বিজ্ঞান) কখনো জ্ঞাতা, কখনো জ্ঞেয়, কখনো কারণ, কখনো কার্য (যদিও চৈতন্য সতত অপরিবর্তিত)।- (আগমশাস্ত্র-৪/৪৭)।

‘ঘূর্ণায়মান বস্তুকে যেমন সোজা ও বক্র দুইভাবেই দেখা যায় তেমনি বিজ্ঞানও (=ভাব) ঐ রকম দ্রষ্টা এবং দৃশ্যকে দেখে।’- গৌড়পাদের এই অদ্বয় মত যে শঙ্করের ব্রহ্ম অপেক্ষা নাগার্জুনের বৌদ্ধ শূন্যবাদেরই অধিক নিকটবর্তী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও গৌড়পাদের যে দার্শনিক মতকে ভিত্তি করে মূলত শঙ্করাচার্য তাঁর দর্শনের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন, সংক্ষেপে সেই মত নিম্নরূপ। যেমন-

জগৎ মিথ্যা : গৌড়পাদ জগৎকে মূলত মিথ্যা বলেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে-

‘স্বপ্নজাগরিতস্থানে হ্যেকমাহুর্মনীষিণঃ।
ভেদানাং হি সমত্বেন প্রসিদ্ধেনৈব হেতুনা।।’ (আগমশাস্ত্র-২/৫)
‘স্বতো বা পরতো বা অপি ন কিঞ্চিদ্বস্তু জায়তে।
সৎ অসৎ সদসৎ বা অপি ন কিঞ্চিদ্বস্তু জায়তে।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/২২)
‘আদ্যবন্তে চ যন্নাস্তি বর্তমানে অপি তৎ তথা।
বিতথৈঃ সদৃশাঃ সন্তঃ অবিতথাঃ ইব লক্ষিতাঃ’।। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)
অর্থাৎ :
স্বপ্ন ও জাগ্রৎ এই উভয় অবস্থাতেই জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কটি একই থাকে। এই দুই অবস্থায় যেসব বস্তুর অভিজ্ঞতা হয় সেই বস্তুগুলি অভিন্ন। এই কারণেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থার বস্তুকেই মিথ্যা বলে মনে করেন। (আগমশাস্ত্র-২/৫)।।  স্বতন্ত্রভাবেই হোক বা কারও মাধ্যমেই হোক, কোন কিছুরই জন্ম হয় না। কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকুক বা নাই থাকুক, অথবা যার অস্তিত্ব আছেও বটে আবার নেইও বটে- যাই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই কোন বস্তুর জন্ম হয় না। (আগমশাস্ত্র-৪/২২)।।  যদি এমন বস্তু থেকে থাকে, যা শুরুর আগেও ছিলো না, আবার শেষ হয়ে গেলেও থাকবে না, তবে তাকে মিথ্যা বলেই ধরে নিতে হবে। মরীচিকার মতোই এও এক দৃষ্টিভ্রম- মনে হয় সত্য, কিন্তু আসলে সত্য নয়। যা সত্য তা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ- এই তিনকালেই সত্য। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)।।
অতএব, যে বস্তু আদিতে নেই, অন্তেও নেই, তার বর্তমান অবস্থাও তথৈবচ, মিথ্যারূপী হয়ে তাকে মিথ্যা বলেই দেখা যায়। গৌড়পাদের দৃষ্টিতে জগৎ তাই।

সকলই মায়া : এই জগৎ বা সবকিছুই যে দৃষ্টিবিভ্রম বা মায়াই কেবল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে-

‘যথা স্বপ্নে দ্বয়াভাসং চিত্তং চলতি মায়য়া।
তথা জাগ্রৎ দ্বয়াভাসং চিত্তং চলতি মায়য়া।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬১)
‘অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং চিত্তং স্বপ্নে ন সংশয়ঃ।
অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং তথা জাগ্রন্ন সংশয়ঃ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬২)
অর্থাৎ :
স্বপ্নে আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তবু মন দুই (দ্রষ্টা ও দৃশ্য) দেখে ও সেই অনুরূপ কাজ করে। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও মন অবিদ্যার প্রভাবে দুই দেখে ও সেই অনুযায়ী চিন্তা ও কাজ করে। (বস্তুত দুই নেই, এক। অজ্ঞানতার ফলেই এই ভুল হয়।) (আগমশাস্ত্র-৪/৬১)।।  স্বপ্নকালে মন নিঃসঙ্গ থাকে, তবু দুয়ের (জ্ঞাতা-জ্ঞেয়) অভিজ্ঞতা হয়। সেইভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও মনের দ্বৈতভূমিকা থাকে, এবং জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ধারণা সৃষ্টি করে। এর ফলে বহু দেখা যায়। আর এই বহুর অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্রষ্টার মনে সংশয়মাত্র থাকে না। কিন্তু স্বপ্ন ও জাগ্রত- এই দুই অবস্থার অভিজ্ঞতাই দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬২)।।

এখানে গৌড়পাদের বক্তব্য হলো, বস্তুসমূহের মধ্যে যাদের উৎপন্ন বলা হয় তা কি বস্তুত ভ্রম থেকে নয় ? তাদের জন্ম মায়ারূপী এবং মায়ার কোন সত্তা নেই। যেমন স্বপ্নের মধ্যে চিত্ত মায়াবশত দুটি রূপ (দ্রষ্টা ও দৃশ্য) গ্রহণ করে, জাগ্রত অবস্থাতেও চিত্ত মায়াবশত ঐ রকম করে। অতএব এই জগৎ এবং এর সবকিছুই মায়া মাত্র।

আত্মা (=জীব) নেই : জীবাত্মা সম্বন্ধে গৌড়পাদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক মনে হয়। মাণ্ডুক্য-কারিকায় তিনি বলেন-

‘যথা স্বপ্নময়ো জীবো জায়তে ম্রিয়তে অপি চ।
তথা জীবা অমী সর্বে ভবন্তি ন ভবন্তি চ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬৮)
‘যথা মায়াময়ো জীবো জায়তে ম্রিয়তে অপি চ।
তথা জীবা অমী সর্বে ভবন্তি ন ভবন্তি চ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬৯)
‘নাজেষু সর্বধর্মেষু শাশ্বতাশাশ্বতাভিধা।
যত্র বর্ণা ন বর্তন্তে বিবেকস্তত্র নোচ্যতে।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬০)
অর্থাৎ :
স্বপ্নে কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। একইভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও সকল প্রাণীর জন্ম বা মৃত্যু দেখা যায়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬৮)।।  মায়ার মধ্যে বা জাদুখেলায় অনেক সময় কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও এইসব প্রাণীকে জন্মগ্রহণ বা মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬৯)।।  জীবাত্মার জন্ম হয় না। সুতরাং সেক্ষেত্রে অমর বা মরণশীল এই শব্দগুলি প্রযোজ্য নয়। যা বর্ণনা করা যায় না তাকে শাশ্বত বা অশাশ্বত কিভাবে বলবো ? (আগমশাস্ত্র-৪/৬০)।।

গৌড়পাদ হয়তো বলতে চেয়েছেন যে, স্বপ্নময় বা মায়াময় আত্মাকে যেমন জন্মাতে ও মরতে দেখা যায় তেমনভাবে এই আত্মাসমূহ আছে আবার নেই-ও বটে। জীবাত্মা সম্বন্ধে তাঁর এই অবর্ণনীয় সংশয়কে হয়তো শেষতক নেতিবাচক বলেই বর্ণনা করা চলে। প্রকৃতপক্ষে গৌড়পাদ হয়তো জীবাত্মার স্থলে বিজ্ঞান বা চৈতন্যকেই স্বীকার করেন বলে মনে হয়। যেমন, মাণ্ডুক্য-কারিকাতে বলা হয়েছে-

‘ঘটাদিষু প্রলীনেষু ঘটাকাশাদয়ো যথা।
আকাশে সংপ্রলীয়ন্তে তদ্বজ্জীবা ইহাত্মনি।।’ (আগমশাস্ত্র-৩/৪)
‘নাকাশস্য ঘটাকাশো বিকারাবয়বৌ যথা।
নৈবাত্মনঃ সদা জীবো বিকারাবয়বৌ তথা।।’ (আগমশাস্ত্র-৩/৭)
অর্থাৎ :
ঘট যখন ভেঙে যায় তখন ঘটের ভিতরের আকাশ বাইরের আকাশে মিশে যায়। সেইভাবে যে দেহের সঙ্গে জীবাত্মা যুক্ত সেই দেহের যখন নাশ হয় তখন জীবাত্মা (চৈতন্য) পরমাত্মাতে (চৈতন্যে) লয় হয়। (আগমশাস্ত্র-৩/৪)।।  ঘটাকাশ অনন্ত আকাশের অংশ বা বিকার নয়। বস্তুত ঘটাকাশ অখণ্ড আকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। একইভাবে, জীবাত্মা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ নয়, আবার বিকারও নয়। (আগমশাস্ত্র-৩/৭)।।

পরমতত্ত্ব : গৌড়পাদ যে এক অদ্বয় সত্তা বা অদ্বৈত পরমসত্তায় বিশ্বাস করেছেন তা অদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারীদের সমালোচনার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। কেননা, মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে-

‘অস্তি নাস্ত্যস্তি নাস্তীতি নাস্তি নাস্তীতি বা পুনঃ।
চল-স্থির-উভয়-অভাবৈঃ আবৃণোতি এব বালিশঃ’।। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৩)
‘কোট্যশ্চতস্র এতাস্তু গ্রহৈর্যাসাং সদা আবৃতঃ।
ভগবানাভিঃ অস্পৃষ্টো যেন দৃষ্টঃ স সর্বদৃক্’।। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৪)
অর্থাৎ :
নির্বোধ ব্যক্তি কখনো মনে করে তিনি (=পরমসত্তা) আছেন, কখনো মনে করে নেই, আবার কখনো মনে করে আছেনও বটে নেইও বটে। আর কখনো বা মনে করে আছেও নেইও তাও নয়, এইভাবে চার কোটিতে কখনো স্থির, কখনো চঞ্চল, কখনো দুই-ই, কখনো তাও নয়, ইত্যাদি ভেবে নির্বোধ ব্যক্তি পরমতত্ত্বকে আবৃত করে রাখে। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৩)।।   এই চারটি গোষ্ঠির কাছে ভগবান (=পরমসত্তা) সর্বদাই নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। এর কারণ নিজ নিজ মতের প্রতি এঁরা মোহমুগ্ধ। কিন্তু এই চার মতবাদের উর্ধ্বে গিয়ে যে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি জ্যোতির্ময় সত্তার দর্শন লাভ করেন তিনি প্রকৃতই সর্বজ্ঞ। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৪)।।

গৌড়পাদ এখানে অদ্বৈতবিরোধী চারটি প্রধান দার্শনিক মতকে চিহ্নিত করেছেন। এদের মধ্যে বৈশেষিকরা বলেন, আত্মার অস্তিত্ব আছে কিন্তু আত্মার পরিবর্তন হয়। আত্মা কখনো সুখী কখনো দুঃখী। যদিও তাঁদের মতে আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র। আর এক বিরোধী দার্শনিক মত হলো বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদর্শন। তাঁরা বিশ্বাস করেন বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী। এই মত অনুসারে আত্মা বা পরমসত্তা বলে কিছু নেই। আবার অন্য মতগোষ্ঠি দিগম্বর জৈনরা বলেন, আত্মা আছেও বটে, নেইও বটে। যতক্ষণ দেহের অস্তিত্ব আছে ততক্ষণই আত্মার অস্তিত্ব। দেহের মৃত্যুর সঙ্গেই আত্মারও মৃত্যু হয়। আবার দেহ বড় বা ছোট হলে আত্মাও বড় বা ছোট হয়। বৌদ্ধদের আরেকটি শাখা যা মাধ্যমিক শূণ্যবাদী বলে পরিচিত, তাঁদের মতে আত্মা বলে কিছু নেই। পরম সত্য হলো শূন্য। এঁদের বলা হয় নিহিলিস্ট বা নাস্তিবাদী।
গৌড়পাদের মতে এইসব তর্কবিচার নিরর্থক। এতো বাগবিতণ্ডায় তাঁদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। এঁদের আত্মজ্ঞান লাভের আশা সুদূরপরাহত। তাঁর মতে, যিনি বুঝেছেন তা বিতর্কের বিষয় নয় তিনি এই পরমসত্তাকে জানেন। তিনি যথার্থই প্রাজ্ঞ।

গৌড়পাদের এই দার্শনিক মত শঙ্করাচার্যের ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মস্বরূপ’- এই মতের সঙ্গে যথেষ্ট ব্যবধান বজায় রাখলেও শঙ্করের মায়াবাদের সমস্ত মৌলিক সামগ্রীই এর মধ্যে নিহিত আছে বলে মনে করা হয়।

১.২ : শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রিঃ)
অষ্টম শতকে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম উপকূলে মালাবার অঞ্চলে তথা কেরলের এক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ পরিবারে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৈশাখী শুক্লপঞ্চমী তিথিতে শঙ্করের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম বৈশিষ্টা। মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই তাঁর পিতার দেহান্ত হয়, ফলে তাঁর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার গুরু দায়িত্ব তাঁর মাতাকেই বহন করতে হয়। শঙ্করের প্রতিভা ছিলো অতুলনীয় এবং অসাধারণ কর্মদক্ষতার অধিকারী ছিলেন তিনি। মাত্র আট বৎসর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ বেদ অধ্যয়ন করেন বলে জানা যায় এবং এই বয়সেই তিনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। গৃহত্যাগ করে নর্মদা নদীর তীরে বৈদুর্যমণি পর্বতের গুহায় গোবিন্দপাদ নামক একজন বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর কাছে অদ্বৈততত্ত্ব আয়ত্ত করেন। এই গোবিন্দ ছিলেন আগমশাস্ত্র বা মাণ্ডুক্য-কারিকাকার গৌড়পাদের শিষ্য। তাই শঙ্করের দীক্ষাগুরু গোবিন্দ হলেও শিক্ষাগুরু ছিলেন গৌড়পাদ। সেখান থেকে তিনি কাশী এবং পরে বদরিকাশ্রমে যান। এই বদরিকাশ্রমে থেকে বারো বছর বয়সেই শঙ্করাচার্য বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের উপর তাঁর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ শারীরকভাষ্য রচনা করেন বলে কথিত আছে। শঙ্কর যে কতোটা মেধাবী ছিলেন, মাত্র বত্রিশ বছর আয়ুকালের মধ্যেই ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র, ভগবদ্গীতা এবং ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয় ও শ্বেতাশ্বতর এই দশটি প্রধান উপনিষদের ওপর বিদগ্ধ ভাষ্যরচনাই তাঁর প্রতিভার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

শঙ্করের আবির্ভাবকালে তখন বৌদ্ধ ও জৈনমতের প্রবল প্রতাপ। ফলে বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি লোকের শ্রদ্ধাও কমে যাচ্ছিলো। দাক্ষিণাত্যে জৈন ধর্মের প্রসার লাভ করেছিলো। শৈব আদিয়াব ও বৈষ্ণব আলোয়ারগণ ভক্তিধর্ম প্রচার করছিলেন। মীমাংসকগণ বৈদিক যাগযজ্ঞ প্রচারের চেষ্টা করেন। অপরদিকে কুমারিল ও মণ্ডনমিশ্র সন্ন্যাসের তুলনায় গার্হস্থ্য ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বলা যায়, এটা ছিলো সেই সময় যখন বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, জৈন সকল ধর্মই মানুষকে সাধুতে পরিণত করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলো। প্রকৃত ব্যাখ্যাতার অভাবে হিন্দুমত তখন শাস্ত্রের বিরোধ এবং আচার-অনুষ্ঠানের কুসংস্কারে আবদ্ধ ছিলো। হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত এবং শাস্ত্রের আপাতবিরোধ দূর করাকে প্রাথমিক দায়িত্ব মনে করে শঙ্কর নানা শাস্ত্রের মূলতত্ত্বকে মানুষের কাছে তুলে ধরে দেখান যে, শাস্ত্রের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই। বিভিন্ন উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করে অদ্বৈতবাদকে সুদৃঢ়ভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি দেখান যে, বিভিন্ন শাস্ত্র বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই পরমতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। এই পরমতত্ত্ব এক অনির্বচনীয় পরমসত্তা। বেদান্ত দর্শনে এই পরমসত্তাকে বলা হয় ব্রহ্ম।

বেদান্তের শাঙ্করভাষ্য অনুযায়ী, অজ্ঞানবশতই জীব সখণ্ডকে সত্য বলে মনে করে এবং পরমসত্তার কথা কখনও চিন্তা করে না। সখণ্ড প্রতিভাত জগৎ না সত্য, না অলীক। অখণ্ড পরমসত্তাই যেহেতু একমাত্র সত্য, সেহেতু প্রতিভাত সখণ্ড জগৎ সত্য নয়। আবার জগৎ শশশৃঙ্গের ন্যায় অলীকও নয়। জগৎ অনির্বচনীয়। জগতের এই অনির্বচনীয়তারই পারিভাষিক নাম হলো ‘মায়া’। জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ। প্রকৃত জ্ঞানের উদয়ে জীব এই সকল সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

শঙ্করাচার্য উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র এবং গীতা এই প্রস্থানত্রয়েরই ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর রচিত প্রধান ‘দশটি উপনিষদের ভাষ্য’, ব্রহ্মসূত্রের ‘শারীরকভাষ্য’ এবং ভগবদ্গীতার ‘গীতাভাষ্য’ বেদান্ত দর্শনের অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও তিনি অনেক স্বতন্ত্র গ্রন্থ ও স্তোত্র রচনা করেন। পরবর্তীকালে বহু মনীষী শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের উপর টীকা রচনা করেন। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যের উপর বাচস্পতি মিশ্রের লেখা ‘ভামতী’ টীকা প্রসিদ্ধ। এছাড়া শঙ্করের সাক্ষাৎ শিষ্য পদ্মপাদাচার্য ‘পঞ্চপাদিকা’ বা ‘বিবরণ’ নামে শঙ্করভাষ্যের উপর একটি মনোরম টীকা রচনা করেন। কিন্তু শঙ্করের শারীরকভাষ্যের উপর টীকাকারদের মতপার্থক্যহেতু পরবর্তীকালে অদ্বৈতমতের সমর্থকরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে (বেদান্তের উপ-উপসম্প্রদায়) বিভক্ত হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে পদ্মপাদাচার্যের ‘বিবরণ সম্প্রদায়’ এবং শ্রীবাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী সম্প্রদায়’ প্রধান। বিবরণ সম্প্রদায় ‘পঞ্চপাদিকা’ টীকার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং ভামতী সম্প্রদায় ‘ভামতী’ টীকার উপর প্রতিষ্ঠিত।

পদ্মপাদাচার্যের ‘পঞ্চপাদিকা’, প্রকাশাত্মযতি রচিত ‘পঞ্চপাদিকা-বিবরণ’ এবং বিদ্যারণ্য’র ‘বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ’ বিবরণ সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী’, অমলানন্দ’র ‘ভামতী-কল্পতরু’ ও ‘শাস্ত্রদর্পণ’ এবং অপ্পয়দীক্ষিত-এর ‘কল্পতরুপরিমল’ ভামতী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। অদ্বৈত চিন্তাধারায় শাঙ্করভাষ্যের উপর আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তার মধ্যে সুরেশ্বর আচার্যের ‘তৈত্তিরীয়ভাষ্যবার্ত্তিক’, শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্’, চিৎসুখাচার্য’র ‘চিৎসুখী’, মধুসূদন সরস্বতীর ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’, ব্রহ্মানন্দ’র ‘লঘুচন্দ্রিকা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সদানন্দ যোগীন্দ্রের ‘বেদান্তসার’ ও ধর্ম্মরাজাধবরীন্দ্রের ‘বেদান্ত পরিভাষা’ যথাক্রমে বেদান্ততত্ত্ব ও বেদান্তজ্ঞানতত্ত্বের উপর বহুলপ্রচলিত দুখানি উল্লেখযোগ্য প্রকরণগ্রন্থ।

শঙ্করের দার্শনিক মত : শঙ্কর তাঁর সকল গ্রন্থেই তাঁর মৌলিক চিন্তা তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর শারীরকভাষ্যে বাদরায়ণের বেদান্তসূত্রের প্রথম চারটি সূত্রের ভাষ্যের মধ্যে তিনি অধিক মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, বৌদ্ধের সংবৃত্তি-সত্য এবং পরম-সত্যকে উপজীব্য করে ব্রহ্মকেই একমাত্র সৎ (অদ্বৈত) পদার্থ বলে মানতে গিয়ে তিনি ব্যবহারিক সত্যের পটভূমিতে বুদ্ধি-এবং-অবুদ্ধিগম্য সব ব্রাহ্মণ-সিদ্ধান্ত স্বীকার করে নিয়েছেন। এই সবকিছু মিলিয়ে তাই বর্তমানে শঙ্করের দার্শনিক মত বলতে তাঁর শারীরকভাষ্যে প্রস্তাবিত অদ্বৈতবাদকেই বোঝানো হয়, যার অন্য দার্শনিক নাম অদ্বৈত-বেদান্ত।

(চলবে…)

[*] [পরের পর্ব : শঙ্করের অদ্বৈতবাদ]

No comments: