Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২৬: অ-ঋষিপ্রোক্ত নিরীশ্বরবাদী দর্শন-মত খণ্ডন



|বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২৬: অ-ঋষিপ্রোক্ত নিরীশ্বরবাদী দর্শন-মত খণ্ডন|
রণদীপম বসু

(খ) নিরীশ্বরবাদী দর্শন খণ্ডন :
নিরীশ্বরবাদী দর্শনের মধ্যে বৈশেষিক, বৌদ্ধ এবং জৈনদর্শনের বিরুদ্ধেই বাদরায়ণ তাঁদের মত খণ্ডনে মনোযোগী হয়েছিলেন। তাঁর সময়ে হয়তোবা চার্বাক দর্শনের বিরোধিতা ক্ষীণ হয়ে আসায় সে বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, বৈশেষিকসূত্রকার কণাদকে যদিও পরে কপিলের মতো ঋষি বলে মেনে নেয়া হয়েছিলো, তবুও বাদরায়ণের যুগে হয়তো এমন অবস্থা ছিলো না যাতে তাঁকে ঋষি-শ্রেণীভুক্ত করা যেতো।


(১) বৈশেষিক দর্শন-মত খণ্ডন :
কণাদের বৈশেষিক মতে জগতের চরম অবস্থা হলো অণুময়ত্ব- এই জগতের সব বস্তুই বিভিন্ন প্রকার অণুর সমবায় মাত্র। এই অণু বা পরমাণু হলো সনাতন এবং জগতের মৌলিক কারণ। এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমান সমকালীন বিজ্ঞান-জ্ঞানস্তরে অণু ও পরমাণুর সংজ্ঞা ভিন্ন হলেও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনজগতের বৈশেষিক দর্শনে অণু ও পরমাণু শব্দদ্বয়কে অভিন্ন অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। পরমাণুকে কণাদ ছয়টি পার্শ্বযুক্ত গোলাকৃতি কণা বলে মানতেন এবং বলেছিলেন যে, এই ছয়টি পার্শ্বযুক্ত দুটি পরমাণু যুক্ত হয়ে ছোট ছোট দ্ব্যণুক সৃষ্টি করে। পুনরায় তিনটি দ্ব্যণুক একত্র মিলিত হয়ে একটি ত্র্যণুকের (ত্রসরেণুর) সৃষ্টি করে, এবং চারটি দ্ব্যণুক একটি চতুরণুর সৃষ্টি করে এভাবে স্থূল অবয়ববিশিষ্ট বস্তুর সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পদার্থের স্ব-স্ব অণু-দ্ব্যণু হতে অনুরূপভাবে স্থূল আকারের সৃষ্টি হয়। এইসব ক্ষুদ্র গোলকাকৃতির অণু যুক্ত হয়ে বৃহৎ ও দীর্ঘ পরিমাণযুক্ত বস্তুর উৎপত্তি হয় তথা বিশ্ব সৃষ্টি হয়।

এই দার্শনিক মতবাদানুসারে একটি পরমাণু হলো অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম সত্তা, একটি দ্ব্যণুক হলো খুব সূক্ষ্ম এবং হ্রস্ব, এবং ত্র্যণুক হতে শুরু করে পরবর্তী সংমিশ্রিত বস্তুগুলি হলো মহৎ এবং দীর্ঘ। এখানে আপত্তি হলো- যদি অণু দুটি গোলাকারবৎ হয় এবং তারা যদি একটি দ্ব্যণুকের সৃষ্টি করে সেই দ্ব্যণুকটি হবে সূক্ষ্ম এবং হ্রস্ব, তাতে আর সেই অণুর গোলত্ব উৎপাদিত হবে না। অথবা যদি চারটি সূক্ষ্ম ও হ্রস্ব দ্ব্যণুক একটি চতুরণু পদার্থ সৃষ্টি করে যা মহৎ এবং দীর্ঘ- সেক্ষেত্রে নতুন সৃষ্ট এই বস্তুতে দ্ব্যণুকের সূক্ষ্মত্ব এবং হ্রস্বত্ব সঞ্চারিত হবে না। তা হতেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কারণের সবগুলি গুণই কার্যে সঞ্জাত হয় না। তাই বাদরায়ণ বলেন, কারণের গুণ অনুসারে কার্যের গুণের উৎপত্তিকে বৈশেষিকেরা মানেন, কিন্তু অবয়বহীন পরমাণু থেকে সাবয়ব হ্রস্ব দ্ব্যণুকের উৎপত্তি অসম্ভব এবং (দীর্ঘ পরিমাণরহিত) হ্রস্ব পরিমণ্ডল (দ্ব্যণুক কণা) দ্বারা বৃহৎ, দীর্ঘ (পরিমাণ) যুক্ত পদার্থের উৎপত্তিও সম্ভব নয়।

জড় পরমাণুর মধ্যে যখন ক্রিয়া বা গতি থাকে তখনই সে বস্তুর উৎপাদনে সক্ষম হয়। কণাদের বৈশেষিক মতে জগৎ-সৃষ্টির জন্য অদৃষ্টের প্রেরণায় পরমাণুর মধ্যে ক্রিয়া উৎপন্ন হয়, যা দুটি পরমাণুকে পরস্পর সংযুক্ত করে দ্ব্যণুক নির্মাণ করে তা তার মধ্যে স্বীয় কর্মও প্রয়োগ করে; এই সংক্রমণ অগ্রসর হতে হতে জগৎ সৃষ্টি করে। এখন প্রশ্ন ওঠে- পরমাণুতে যে আদিম ক্রিয়া উৎপন্ন হচ্ছে, তা কি পরমাণুর (জড়ের) নিজের ভিতরকার অদৃষ্ট থেকে উৎপন্ন হয়, না কি চেতনার (আত্মার) অভ্যন্তর থেকে ? তাই বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করেন-


‘উভয়থাপি ন কর্মাতস্তদভাবঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১২)।।
ভাবার্থ : ‘অদৃষ্ট’ অণুর মধ্যে অথবা জীবের মধ্যে যেখানেই অবস্থান করেন বলে ধরে নেয়া হোক না কেন- এই উভয় ক্ষেত্রেই অণুর পক্ষে কোন কার্য করা সম্ভব নয়। সুতরাং অণু জগৎ সৃষ্টি করতে পারে না (ব্রঃ-২/২/১২)।

অর্থাৎ, বৈশেষিক মতে যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রচেষ্টাই হতে পারে না। যেহেতু সৃষ্টির পূর্বে কোন স্থূল দেহ বা মন উভয়ই অবর্তমান, সুতরাং সেখানে কোন কর্মপ্রচেষ্টা থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে কোন প্রতিক্রিয়াও হতে পারে না। যদি ‘অদৃষ্ট’ই কারণ হন, তাহলে বাদরায়ণের মতে, ‘অদৃষ্টে’র অবস্থান আত্মায় অথবা অণুতে যেখানেই থাকুক না কেন, এই উভয় ক্ষেত্রেই ‘অদৃষ্ট’ অণুর প্রথম কর্ম প্রেরণার কারণ হতে পারেন না। কারণ, পূর্বজন্মের কর্মফল এই অদৃষ্ট হলেন অচেতন, এবং সেজন্য তিনি স্বয়ং কোন কার্য করতে পারেন না। যদি বলা যায় যে, এই আত্মায় অবস্থান করেন- তাহলে আত্মা নিজে তখন অচেতন বলে তার মধ্যে অদৃষ্টকে পরিচালনা করার মতো কোন বুদ্ধি (চেতনা) নাই। সুতরাং আত্মার ক্ষেত্রে কর্মের অদৃষ্ট পরমাণুর মধ্যে কেমন করে প্রবিষ্ট হবে ? অণুর মধ্যে কর্ম হতে পারে না।

আবার যদি বলা যায় যে, সর্বদা সহবাসরত পদার্থের মধ্যে যে সমবায় সম্বন্ধ নিত্য ঘটে, তা থেকেই মানতে হবে যে পরমাণুতেই অদৃষ্ট নিহিত; তবে সমবায়ের স্বীকৃতি থেকেও সেই কথাই এসে পড়ে যে, সমবায় সম্বন্ধ সেখানেই বা কেন ? বৈশেষিকেরা সাতটি পদার্থ স্বীকার করেন। তার মধ্যে একটি হলো সমবায় বা নিত্যসম্বন্ধ। তাদের মতে, একই সমবায়ই দ্ব্যণুককে তার অঙ্গীভূত দুটি অণুর সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়। কারণ দ্ব্যণুক এবং অণু হলো পৃথক গুণসম্পন্ন দুইটি বস্তু। সেক্ষেত্রে এই সমবায়ও স্বয়ং সংযুক্ত এই দ্ব্যণুক এবং অণু থেকে ভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের সঙ্গে সমবায়কে যুক্ত করার জন্য অপর একটি সমবায় কারণের প্রয়োজন হবে, আবার এই সমবায়কে প্রথম সমবায়ের সাথে যুক্ত করার জন্য অপর একটি সমবায় কারণের প্রয়োজন হবে- এবং এভাবে অনন্ত সমবায়ের প্রয়োজন হবে। এভাবে অনবস্থা দোষ ঘটবে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-

‘সমবায়াভ্যুপগমাৎ চ সাম্যাৎ অনবস্থিতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৩)।।
ভাবার্থ : সমবায় সম্বন্ধকে স্বীকার করার জন্য কার্য-কারণের মধ্যে একটা ‘অনবস্থা’ দোষ দেখা যায় বলে বৈশেষিক মতবাদ গ্রহণীয় নয় (ব্রঃ-২/২/১৩)।

আবার এমন নয় যে সমবায় সম্বন্ধ নিত্য, তাই পরমাণু এবং তার অদৃষ্ট উভয়েই নিত্য থাকবে। কেননা, যদি অদৃষ্ট অণুর মধ্যেই নিত্য অবস্থান করে বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে তা সর্বদা বর্তমান বলে তার প্রলয়াবস্থা সম্ভবপর হতে পারে না। এতে করে জগতের নিত্য থাকাই প্রমাণিত হবে এবং জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়কে যাঁরা মানেন তাঁদের পক্ষেও তা স্বীকার করা সম্ভব হবে না। তাই বাদরায়ণ বলেন-

‘নিত্যমেব চ ভাবাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৪)।।
ভাবার্থ : পরমাণুগুলি যদি নিত্য প্রবৃত্তি-প্রবণ হয়, তাহলে সৃষ্টি অনন্তকালই চলতে থাকবে, প্রলয় কখনও হবে না। আর তাদের মধ্যে নিত্য নিবৃত্তিগুণ কল্পনা করলে কখনও সৃষ্টি সম্ভব হবে না (ব্রঃ-২/২/১৪)।

অর্থাৎ, যদি অণুগুলি স্বভাবতই ক্রিয়াশীল হয়, তাহলে সৃষ্টি হবে চিরস্থায়ী, কারণ সেক্ষেত্রে প্রলয়ের অর্থ হবে অণুগুলির স্বভাবের পরিবর্তন মেনে নেয়া, যা অসম্ভব। পক্ষান্তরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, অণুগুলি স্বভাবত নিষ্ক্রিয়, তাহলে প্রলয়াবস্থাকেই চিরন্তন বলে মেনে নিতে হয় এবং সেজন্য আর সৃষ্টিও হবে না। কিন্তু অণুগুলি পরস্পর বিরুদ্ধ গুণসম্পন্ন সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় উভয়ই হতে পারে না। যদি তারা এই উভয়ের একটা গুণসম্পন্নও না হয়, তাহলে তাদের সক্রিয়-নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপারটি অদৃষ্টের ন্যায় অন্য কোন নিমিত্ত কারণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে,- যেহেতু অদৃষ্ট সর্বদাই অণুগুলির সাথে সংযুক্ত সেজন্য সর্বদাই তারা ক্রিয়াশীল থাকবে এবং সৃষ্টিও চিরস্থায়ী হয়ে পড়বে। অপরপক্ষে, যদি আবার সেখানে কোন নিমিত্ত-কারণ না থাকে, তাহলে অণুগুলির কোন ক্রিয়াশীলতাও থাকে না এবং ক্রিয়াশীলতার অভাবে সৃষ্টিও থাকবে না। ফলে বৈশেষিকের এই পরমাণুবাদ পুনরায় অগ্রাহ্য বলে গণ্য হয়।

বাদরায়ণ বৈশেষিক মতকে বিভিন্ন কৌণিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। যেমন আরেকটি যুক্তি হলো, বৈশেষিকমতে একদিকে পরমাণুকে নিত্য, সূক্ষ্ম, অবয়বহীন বলে মানা হয়েছে, অন্যদিকে কারণের গুণানুযায় কার্যগুণ উৎপন্ন হয় বলে স্বীকার করা হয়। অর্থাৎ অণুগুলির রূপ ইত্যাদি আছে বলে ধরা হয়, কারণ, তা না হলে কার্যগুলিতে অণুর সেই সকল গুণ পাওয়া যেতো না- যেহেতু কারণের গুণগুলিই কার্যে দৃষ্ট হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বাদরায়ণের মতে, অণুগুলি অণুগুণসম্পন্ন (ক্ষুদ্র) এবং স্থায়ী হবে না। কারণ যা রূপ-বিশিষ্ট তা-ই স্থূল হয়- সূক্ষ্ম নয় এবং তা তার কারণের তুলনায় অস্থায়ী। সেহেতু রূপাদিবিশিষ্ট অণুও স্থূল এবং অস্থায়ী হয়ে পড়ে। কাজেই বৈশেষিক দর্শন মতে অণুর ক্ষুদ্রত্ব এবং স্থায়িত্ব তার দ্বারা বাধিত হয় বলে তা স্ববিরোধী। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘রূপাদিমত্ত্বাৎ চ বিপর্যয়ো, দর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৫)।।
ভাবার্থ : বৈশেষিক মতে পরমাণুর রূপাদি গুণ আছে। সুতরাং তা সূক্ষ্ম এবং নিত্য হতে পারে না। স্ববিরোধী বলে অণু জগতের কারণ নয় (ব্রঃ-২/২/১৫)।

আবার এই দার্শনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং বায়ু এই চারটি স্থূলভূত অণু থেকে উৎপন্ন হয়। গুণগত বিচারে এই চারটি পদার্থ ভিন্ন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়- ক্ষিতির মধ্যে স্পর্শ, রস, গন্ধ এবং রূপ এই চারটি গুণ বর্তমান, অপরপক্ষে অপ বা জলের আছে মাত্র তিনটি গুণ, তেজ বা অগ্নিতে আছে দুটি এবং বায়ুতে একটি। যদি ধরে নেয়া হয় যে, পদার্থগুলির নিজ নিজ অণুর মধ্যেও পদার্থের গুণগুলি বর্তমান, তাহলে বায়ুর অণুতে থাকবে একটি গুণ এবং ক্ষিতির অণুতে থাকবে চারটি গুণ। চারটি গুণের সমবায়ে ক্ষিতির অণুটি আকারে অন্য পদার্থের অণু থেকে বৃহত্তর হবে- কারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাওয়া যায় যে, গুণের বৃদ্ধি হলে আয়তনের বৃদ্ধি না হয়েই পারে না, এবং এই আয়তন বৃদ্ধির ফলে অণু আর অণু থাকতে পারে না। অপরপক্ষে যদি ধরে নেয়া হয় যে, প্রত্যেক পদার্থের অণুরই সমসংখ্যক গুণ আছে, তাহলে অণুগুলির সৃষ্ট পদার্থের গুণগুলির মধ্যেও কোন পার্থক্য থাকবে না- কারণ বৈশেষিক তত্ত্বটি হলো এই যে, কারণের গুণগুলিই কার্যের মধ্যে সঞ্জাত হয়ে বর্তায়। এই উভয় ক্ষেত্রেই বৈশেষিক মতবাদ ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়। তাই বাদরায়ণ বলেন-

‘উভয়থা চ দোষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৬)।।
ভাবার্থ : অণুর রূপাদি গুণের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি উভয়ই দোষযুক্ত। সেজন্য পরমাণু কারণবাদ অগ্রাহ্য (ব্রঃ-২/২/১৬)।

তর্কযুক্তি দ্বারা কণাদের পরমাণুবাদকে আক্রমণ করাই বাদরায়ণের যথেষ্ট বলে মনে হয়নি, তাই শেষ পর্যন্ত বাদরায়ণ স্বরূপ ধারণ করে বলছেন-

‘অপরিগ্রহাৎ চ অত্যন্তম্ অনপেক্ষা’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৭)।।
ভাবার্থ : মনু প্রমুখ স্মৃতিকার মুনিগণ অণু-বাদকে স্বীকার করেন নাই। সুতরাং বেদমতাবলম্বীদের পক্ষে এই মতবাদ সর্বতোভাবে বর্জনীয় (ব্রঃ-২/২/১৭)।

এইভাবে, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভাষ্যে- ‘ইউরোপের যান্ত্রিক বস্তুবাদের মতো গুণাত্মক পরিবর্তনের মাধ্যমে কারণ থেকে কার্য সৃষ্টিকে না মানার ফলে পরমাণুবাদের মধ্যে যে দুর্বলতা ছিল বাদরায়ণ তাকে খণ্ডন করেছেন।’

(২) জৈন দর্শন-মত খন্ডন :
জৈনদর্শনের দুটি মুখ্য সিদ্ধান্ত- স্যাৎবাদ এবং আত্মার (পুদ্গল) শরীর অনুসারে ছোট-বড় হওয়া। এই দুটি সিদ্ধান্তের উপরই বাদরায়ণ আক্রমণ করে জৈনমত খণ্ডনে প্রয়াসী হয়েছেন।

জৈনরা সাতটি পদার্থকে স্বীকার করেন, যেগুলিকে আত্মা ও অনাত্মা হিসেবে দুই ভাগ করা যায়। আবার সাতটি পদার্থের সত্যতা সম্পর্কে পৃথক সাতটি মত পোষণ করেন। জৈনমতে প্রত্যেকটি বস্তুই সৎ, অসৎ, সদসৎ উভয়, সদসৎ উভয় থেকে ভিন্ন, অবর্ণনীয় (অসংজ্ঞেয়)- এবং এরূপ অনেক কিছুই হতে পারে। অর্থাৎ একই বস্তু সম্পর্কে এই যে ‘হয়তো আছে’, ‘হয়তো নেই’, ‘হয়তো আছেও, নেইও’, ‘হয়তো আছেও, নেইও, তাও নয়’, ‘অবক্তব্য’ এরকম সাতটি পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব বা সম্ভাবনা মানা হয়েছে, জৈনদের এই তত্ত্বকে বলা হয় স্যাদবাদ বা সপ্তভঙ্গিনয়। এই স্যাদবাদকে আক্রমণ করেই বাদরায়ণ বলেন যে, পদার্থ সম্পর্কে এই মতবাদ গ্রহণীয় হতে পারে না, কারণ এটা চিন্তা করা অবাস্তব যে, একই বস্তু ‘আছেও নেইও’ এরকম সত্য-মিথ্যাদি বিপরীত গুণযুক্ত হতে পারে। ফলে জৈন মতানুসারে আমরা কোন সুনির্দিষ্ট জ্ঞানে উপনীত হতে পারি না- এবং সেজন্যই এই জগৎ, স্বর্গ এবং এমনকি মুক্তি পর্যন্ত সন্দেহের বস্তু হয়ে যাবে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘নৈকস্মিন্, অসম্ভবাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৩)।।
ভাবার্থ : একই সময়ে একই বস্তুতে বিরুদ্ধ ধর্মের সমাবেশ সম্ভব নয়। তাই পরস্পরবিরোধী উক্তিসম্পন্ন জৈনমত যথার্থ নয় (ব্রঃ-২/২/৩৩)।

জৈনমতে বলা হয়, আত্মা (পুদ্গল) শরীরেরই সমান আয়তন-বিশিষ্ট। অর্থাৎ আত্মার আকার অনিশ্চিত, যখন ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ শরীরে প্রবিষ্ট হয় তখন সেইরূপ আকৃতিই ধারণ করে। এই মতের খণ্ডন করতে গিয়ে বলা হয়-  জৈনদের মতানুসারে যদি মানতে হয় যে, আত্মা শরীরের সমান আয়তনবিশিষ্ট, তাহলে আত্মা হবে সসীম এবং সাংশ বা অংশ-সম্বলিত- এবং এজন্যই তা চিরন্তন (অবিনাশী) হতে পারবে না। তাছাড়া আরো একটি অসুবিধা হবে যে, যদি কোন পিপীলিকার আত্মা অতীত কর্মফলহেতু গজত্ব-লাভ করে, তাহলে এই পিপীলিকাদেহ দ্বারা গজদেহের পরিমাণকে পূর্ণ করা সম্ভব হবে না; এবং বিপরীতক্রমে একটি গজ বা হাতী যদি পিপীলিকাত্ব প্রাপ্ত হয় তাহলে গজ দেহটাকে পিপীলিকার দেহে সন্নিবিষ্ট করা যাবে না। কোন ব্যক্তিবিশেষের একই দেহে বাল্য, যৌবন, বার্ধক্য ইত্যাদি অবস্থা সম্পর্কেও একই সমস্যা দেখা দেবে।  তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেছেন-

‘এবং চ আত্ম-অকার্ৎস্ন্যম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৪)।।
ভাবার্থ : জৈনগণ আত্মাকে যে দেহ পরিমাণ বলেন তাতে আত্মা (ক্ষুদ্র) অসর্বজনীন হয়ে যাবেন (ব্রঃ-২/২/৩৪)।

আবার, যদি মানা হয় যে, আত্মা গৃহীত শরীরের পরিমাণ ধারণ করে- তাহলে এটাও মানতে হবে যে, আত্মার অংশ বিভাগ আছে এবং পর্যায়ক্রমে তার হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। সেক্ষেত্রে আরেকটি বাধা দেখা দেয়- তা হলে বলতে হবে যে, আত্মার বিকার আছে এবং সেজন্যই আত্মা অচিরস্থায়ী। যদি আত্মা অশাশ্বত এবং সদা পরিবর্তনশীল হন, তাহলে আত্মার বিষয়ে বন্ধন বা মুক্তি কিছুই অনুমান করা যায় না। তাই বাদরায়ণ বলেছেন-

‘ন চ পর্যায়াৎ অপি অবিরোধঃ বিকারাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৫)।।
ভাবার্থ : অবস্থাবিশেষে পর্যায়ক্রমে আত্মার হ্রাস বৃদ্ধি আছে ধরে নিলেও আত্মার অনিত্যাদি দোষ থেকেই যায় (ব্রঃ-২/২/৩৫)।

অন্যদিকে, মুক্তির সময় আত্মার আকার অপরিবর্তনীয় থাকে বলে জৈনরা মনে করেন। সেক্ষেত্রে, যদি এই আকার নিত্যই হয়, তাহলে আত্মা কোন সৃষ্ট পদার্থ হতে পারে না- কারণ যা কিছু সৃষ্ট, তা-ই অনন্তকাল স্থায়ী হয় না। আর এটি যদি সৃষ্ট পদার্থ না হয় তাহলে তা সৃষ্টির আদিতে এবং মধ্যেও অবশ্যই বর্তমান ছিলো। অন্যভাবে বলা যায়, আত্মার আকারটি সর্বদাই একরূপ ছিলো- তা ক্ষুদ্রই হোক বা বৃহৎ-ই হোক। তাই বাদরায়ণের বক্তব্য হলো-

‘অন্ত্যাবস্থিতেঃ চ উভয়নিত্যাত্বাৎ অবিশেষঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৬)।।
ভাবার্থ : মোক্ষ অবস্থায় প্রাপ্ত দেহের পরিমাণ যখন অপরিবর্তনীয় বলে জানা যায়, তখন আদি বা মধ্য কোন অবস্থাতেই আত্মার আকারের পরিবর্তন হয় না- তা স্বীকার করতেই হয় (ব্রঃ-২/২/৩৬)।

সুতরাং শরীরের আকার অনুযায়ী আত্মার আকারের পরিবর্তন হয়- জৈনদের এই মতবাদ যুক্তিসিদ্ধ নয় বলে জৈনমত অগ্রহণযোগ্য।

(৩) বৌদ্ধ দর্শন-মত খণ্ডন :
বৌদ্ধদর্শনের চারটি শাখা- (ক) সর্বাস্তিবাদী বৈভাষিক, যাঁরা বাহ্য এবং আন্তর উভয় জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন- বাহ্যবস্তুর সমবায়ে বাহ্য-জগৎ এবং চিত্ত ও চিত্তের বিভিন্ন অবস্থা বা চিত্তবৃত্তি নিয়ে অন্তর্জগৎ; (খ) বাহ্যার্থবাদী সৌত্রান্তিক, যাঁরা বাহ্যবস্তুর ক্ষণিক অস্তিত্বকে স্বীকার করেন; (গ) (চিত্ত-চৈত্তিক) বিজ্ঞানবাদী যোগাচার, যাঁরা বিজ্ঞপ্তি চিত্ত বা বিজ্ঞান-প্রবাহকেই একমাত্র সত্য বলে স্বীকার করেন; (ঘ) শূন্যবাদী মাধ্যমিক, যাঁরা মনে করেন বাহ্য ও আন্তর সবকিছুই শূন্য এবং অসৎ। তবে এই মতবাদগুলির সবকটিই বুদ্ধের মৌলিক সিদ্ধান্ত অনিত্যতা ও ক্ষণিকতার তত্ত্ব মেনে বিশ্বাস করে যে, জগতের সব কিছুই ক্ষণিক- কিছুই এক মুহূর্তের অধিক স্থায়ী নয়।
বাদরায়ণ বৌদ্ধদর্শনের এই চারটি শাখার নিজস্ব মতকেই খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তা খণ্ডনের জন্য প্রথমে বৈভাষিক দর্শনকে নিয়ে এরপর সমগ্র বৌদ্ধদর্শন শাখার সিদ্ধান্তগুলি আলোচনা করেছেন। পরে, ভিন্ন ভিন্ন সমান দর্শন শাখার, বিশেষ বিশেষ সিদ্ধান্তগুলি খণ্ডন করেছেন।

(ক) বৈভাষিক বৌদ্ধমত খণ্ডন : বৈভাষিকে বাহ্যবস্তুর সমন্বয়ে বাহ্যিক জগৎ এবং আভ্যন্তরীণ বস্তুর অর্থাৎ চিত্ত ও চিত্তের বিভিন্ন অবস্থানসমূহের সমন্বয়ে অন্তর্জগতের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। ভেতরের এবং বাইরের সব পদার্থের সর্ব-অস্তিত্বকে স্বীকার করার জন্য এর প্রাচীন সর্বাস্তিবাদী নামও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এছাড়াও প্রাচীন সাহিত্যে এটি বস্তুবাদী বা প্রপঞ্চবাদী বৌদ্ধদর্শন নামেও খ্যাত। কিন্তু সকলের অস্তিত্বকেই বৈভাষিকে বুদ্ধের মৌলিক সিদ্ধান্ত অনিত্যতা- ক্ষণিকতার- সঙ্গে মানা হয়েছে। অর্থাৎ সবকিছুই ক্ষণিক- কিছুই এক মুহূর্তের অধিক স্থায়ী নয়। বাদরায়ণ মূলত এই ক্ষণিকতাবাদের ওপরেই আঘাত করেছেন।

বৌদ্ধদর্শনের ক্ষণিকবাদ অনুযায়ী জাগতিক বস্তু প্রতিক্ষণে পরিবর্তিত হয় এবং কোন বস্তুই একক্ষণের অধিককাল স্থায়ী হয় না। একটি বস্তু যে ক্ষণে উৎপন্ন হয় তার পরক্ষণেই বিনষ্ট হয়। বস্তুর বিনাশক্ষণেই ঐ বস্তুর সদৃশ অপর একটি বস্তু উৎপন্ন হয়। আমরা বস্তুর এই উৎপত্তি ও বিনাশক্ষণের রহস্য জানি না বলেই বস্তুকে স্থির ও অচঞ্চল বলে মনে করি।

বৈভাষিক বৌদ্ধরা দুটি ‘সমুদায়’কে স্বীকার করেন- বাহ্য বস্তুজগৎ (ভূত-ভৌতিক) এবং আন্তর মনোজগৎ (চিত্ত-চৈত্তিক)- এই উভয়ের সমন্বয়ে বিশ্বজগৎ। বাহ্য জগৎ অবিভাজ্য পরমাণু সমুদয় নিয়ে গঠিত। এই পরমাণু চার প্রকার- পার্থিব পরমাণু যা কঠিন, জলীয় পরমাণু যা তরল, তেজঃ পরমাণু যা উষ্ণ এবং বায়বীয় পরমাণু যা সদা গতিময়।
আর অন্তর্জগতের উপাদান হলো পঞ্চ স্কন্ধ। এই পঞ্চ স্কন্ধ হলো- (১) রূপ স্কন্ধ- যা ইন্দ্রিয় এবং তার বিষয় নিয়ে গঠিত; (২) বিজ্ঞান স্কন্ধ- যা অহংবোধের জন্ম দেয় এমন কতকগুলি ধারাবাহিক প্রত্যক্ষ জ্ঞান দ্বারা গঠিত; (৩) বেদনা স্কন্ধ- যা সুখ-দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতি দ্বারা গঠিত; (৪) সংজ্ঞা স্কন্ধ- সে একজন মানুষ ইত্যাদি নাম রূপের জ্ঞানসমবায়ে গঠিত এবং (৫) সংস্কার স্কন্ধ- যা আকর্ষণ-বিকর্ষণ, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি বোধের দ্বারা গঠিত। এই স্কন্ধগুলির সমবায়ে আন্তর সমুদায় বা মনোজগতের সৃষ্টি।

এখানে বাদরায়ণের প্রশ্ন হলো, কিভাবে এই দুটি সমুদায়ের উৎপত্তি হলো ? এই সমুদায়ীকরণের পশ্চাতে কি কোন চৈতন্যময় কারণরূপী পরিচালক সত্তা আছেন ? অথবা তা কি স্বতই উৎপন্ন হয়েছে ? যদি তা স্থিতিশীল হয়, তাহলে বৌদ্ধদের ক্ষণিকত্ববাদের বিরোধিতা করা হয়। আর যদি তাকে ক্ষণিক মনে করা হয়, তাহলে আমরা বলতে পারি না যে, তা প্রথমে উৎপন্ন হয়ে পরে পরমাণুগুলিকে একত্র সংহত করলো। কেননা তাহলে বুঝতে হবে যে, কারণ এক মুহূর্তের অধিককালই স্থায়ী। আর যদি এই সমুদায়ের পেছনে কোন চৈতন্যময় সত্তা নিয়ন্তারূপে না থাকেন, তাহলে কিভাবে এই অচেতন এবং স্কন্ধগুলি এমন সুশৃঙ্খলভাবে সংহত হয়ে সমুদায় সৃষ্টি করতে পারে ? তাছাড়া, এই ক্রিয়াশীলতা হতো চিরন্তন এবং সেক্ষেত্রে কোন ধ্বংস বা প্রলয় থাকতো না। এসব কারণেই এই সমুদায় সৃষ্টির কোন কারণ নির্ণয় করা যায় না এবং তা করতে না পারার জন্যই জাগতিক অস্তিত্বের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহও বর্তমান থাকতে পারে না। ফলে বৌদ্ধদের এই মতবাদটি গ্রাহ্য হতে পারে না। তাই বাদরায়ণ বলেন-

‘সমুদায় উভয়হেতুকে অপি তৎ-অপ্রাপ্তিঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৮)।।
ভাবার্থ : বৌদ্ধমতে অণুহেতু বাহ্য প্রপঞ্চ এবং চিত্তহেতু আন্তর প্রপঞ্চ- এই উভয়ের মিলনে ‘সমুদায়’ ব্যাপারটি নিষ্পন্ন হয়। এই মতও অগ্রাহ্য- কারণ, তাদের মতে ঐ সকলের মিলন হতে পারে না (ব্রঃ-২/২/১৮)।

বৈভাষিক দর্শনের পরিভাষায় ‘সমুদয়’ শব্দটির মানে হলো কার্য এবং ‘প্রত্যয়’ হলো কারণ, এবং এরা অবশ্যই পরস্পর সম্পর্কিত। সেক্ষেত্রে কোন ঘটনার মধ্যে যেটি ঘটবার পর অপরটি ঘটে সেই প্রথমটি দ্বিতীয়টির প্রত্যয় বা কারণ। আর দ্বিতীয়টি হলো প্রথমটির সমুদায়।
সেক্ষেত্রে বৌদ্ধদর্শনে কার্য-কারণ তত্ত্ব হিসেবে প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতিতে যে দ্বাদশাঙ্গের শৃঙ্খল পরম্পরাটি রয়েছে, যথা- অবিদ্যা, সংস্কার (আকর্ষণ, বিকর্ষণ ইত্যাদি), বিজ্ঞান (আত্ম-সচেতনতা), নামরূপ (ক্ষিতি, জল প্রভৃতি স্থূল শরীরের সূক্ষ্ম উপাদানসমূহ), ষড়ায়তন (দেহ এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়), স্পর্শ (বিষয় সংযোগ), বেদনা (সুখ-দুঃখাদি বিষয় সংবেদন), তৃষ্ণা (বিষয় কামনা), উপাদান (বিষয়াসক্তি), ভব (পুনর্জন্ম গ্রহণের প্রবণতা), জাতি (পুনর্জন্ম) ও জরা-মরণ (বিবিধ দুঃখ), এই শৃঙ্খলা পরম্পরায় অব্যবাহিত পূর্ববর্তীটি হলো পরবর্তীটির (সমুদায়ের) কারণ। অতএব, কোন সমুদয়-সম্পাদক চৈতন্যময় সত্তা ছাড়াই এই সমুদায়গুলি সৃষ্টি করে একটি অপ্রতিহত কার্য-কারণ শৃঙ্খল, যা অবিরতভাবে চক্রাকারে ঘুরছে বলে বৈভাষিকরা মনে করেন। এবং এই চক্রে একটি ‘সমুদায়’ না থাকলে তা সংঘটিত হতে পারে না। সুতরাং ‘সমুদায়’ হলো একটি বাস্তব সত্তা।

কিন্তু বৈভাষিকদের এই যুক্তি খণ্ডন করতে বাদরায়ণ বলেন, যদিও এই শৃঙ্খলে পূর্ব-পূর্ববর্তীটি পর-পরবর্তীটির কারণ, তবুও সমগ্র সমুদায়ের কারণ বলে কিছু বর্তমান নাই। তাছাড়া বৌদ্ধমতের ক্ষণিকত্ববাদ যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে যে জীবাত্মার ভোগ ইত্যাদির জন্য দেহ-সমুদায় ইত্যাদির প্রয়োজন- সেই জীবাত্মাও ক্ষণিক এবং ক্ষণিকত্বের জন্য জীবও ভোক্তা হতে পারে না। জীবাত্মা যদি ক্ষণিকই হলো, তাহলে এই মুক্তির প্রয়োজনই বা কার জন্য ? সুতরাং এই প্রতীত্য-সমুৎপাদ শৃঙ্খল যদিও পরস্পর কার্যকারণ সম্বন্ধে সম্বন্ধ- তবুও তা সমুদায়ের কারণ হতে পারে না, এবং যেহেতু স্থায়ী কোন ভোক্তা নেই, সেহেতু এই সমুদায় প্রপঞ্চেরও প্রয়োজন নেই। সুতরাং বৌদ্ধদের ক্ষণিকত্ববাদ অসিদ্ধ। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেছেন-

‘ইতরেতর-প্রত্যয়ত্বাদিতি চেৎ, ন, উৎপত্তিমাত্রনিমিত্তত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৯)।।
ভাবার্থ : যদি বলা হয় যে, অবিদ্যা-সংস্কার প্রভৃতি পরস্পর পরস্পরের প্রতি কারণ বলে তাদের সঙ্গতি আছে- তার উত্তরে বলা যায় যে, তা হতে পারে না কারণ তার উৎপত্তির পরক্ষণেই ধ্বংস হয় বলে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না এবং কারণ হলেও তারা নিমিত্ত-কারণ মাত্র (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৯)।

আবার যদি সব কিছুই ক্ষণিক ধরা হয়, তাহলে পূর্ববর্তী জিনিসটি জন্মমুহূর্তের পরক্ষণে আর থাকবে না- তাই তা পরবর্তী কোন বস্তুর কারণ হতে পারবে না। কারণ ততক্ষণে তা অসৎ হয়ে গেছে। যদি তখনও তাকে কারণ বলা হয়, তাহলে ধরে নিতে হয় যে, নাস্তি বা শূন্য থেকে অস্তি (কিছু) উৎপন্ন হয়, যা অসম্ভব। তাই বাদরায়ণ বলেছেন-

‘উত্তরোৎপাদে চ পূর্বনিরোধাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২০)।।
ভাবার্থ : সংস্কার, বিজ্ঞান ইত্যাদি পরপর বস্তুসমূহ যখন উৎপন্ন হয় তখন তার অব্যবহিত পূর্বপূর্ব অবিদ্যাদি পদার্থসমূহ অনস্তিত্বশীল হয়ে যায়। সুতরাং পূর্বপূর্ব অবিদ্যাদি দ্রব্যসমূহ পরপর সংস্কারাদির উৎপাদক কারণ হতে পারে না (ব্রঃ-২/২/২০)।

কিন্তু যদি এই আপত্তিকে পরিহার করতে গিয়ে বৌদ্ধরা বলেন যে, কারণ ছাড়াই কার্য উৎপন্ন হয়, তাহলে তাঁরা নিজেদের প্রতিজ্ঞাকেই ভঙ্গ করবেন যে, প্রতিটি কার্যেরই একটি কারণ আছে। অন্যদিকে, যদি একটি কারণকে স্বীকার করে নেয়া হয, তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, কার্য এবং কারণ একই সময়ে বর্তমান থাকে- পরবর্তী মুহূর্তটিতে- অর্থাৎ কারণ একাধিক মুহূর্তকাল স্থায়ী হয়। এতে করে ক্ষণিকত্ববাদ মতটিই নস্যাৎ হয়ে যায়। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘অসতি প্রতিজ্ঞা-উপরোধঃ যৌগপদ্যম্ অন্যথা’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২১)।।
ভাবার্থ : কার্য উৎপত্তিকালে কারণস্বরূপ পূর্বক্ষণ থাকে না তা স্বীকার করলে বৌদ্ধদের- ‘অন্তর্জগতের চিত্ত-চৈত্য পদার্থসমূহ চার প্রকারে উৎপন্ন হয়’- এই প্রতিজ্ঞাটি ভঙ্গ হয়। আর কারণের বিদ্যমানতা স্বীকার করলে কার্যকারণের একই সময়ে অবস্থিতি মানতে হয়। তাহলে পদার্থমাত্রই ক্ষণিক এই সিদ্ধান্ত গ্রাহ্য হয় না (ব্রঃ-২/২/২১)।

বৌদ্ধমতে চিরকাল যাবৎ একটি সামগ্রিক ধ্বংস (বিনাশ) চলে আসছে; এবং এই ধ্বংস হলো দুই প্রকার- বুদ্ধিপূর্বক (প্রতিসংখ্যা) এবং অবুদ্ধিপূর্বক (অপ্রতিসংখ্যা)। বুদ্ধিপূর্বক বিনাশ হলো যেমন চিন্তাভাবনা করে একটি লোক লাঠি দ্বারা একটি ঘটকে ভাঙলো; আর অবুদ্ধিপূর্বক বিনাশ হলো বস্তুসমূহের স্বাভাবিক বিনষ্টি।

কিন্তু বাদরায়ণের মতে এই উভয় প্রকারের বিনাশই অসম্ভব, কারণ এই ধ্বংসের জন্য হয় এই ক্ষণিক সত্তার একটি ধারাবাহিক অবস্থানের প্রয়োজন অথবা এই সমুদায়ের অন্তত একটিরও প্রয়োজন। এই সমুদয় পরম্পরা সদা প্রবহমান, তাকে কখনও স্তব্ধ করা যাবে না। কেন ?- কারণ এই ধ্বংসের পূর্ববর্তী শেষতম মুহূর্তের অবস্থানকে কল্পনা করতে হবে এভাবে যে, হয় তা কার্য উৎপাদন করে, অথবা কোন কার্য উৎপাদন করে না। যদি তা কার্য উৎপাদন করে- তাহলে এই কার্যকারণ পরম্পরার শৃঙ্খল সৃষ্টি করেই চলতে থাকবে এবং তার বিনাশ হবে না। আর তা যদি কোন কার্য উৎপাদন না করে, তাহলে- শেষতম মুহূর্তের অবস্থানটি মোটেই কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা হবে না- কারণ বৌদ্ধদের মতে সত্তার অর্থ হলো কারণের কার্যকারিতা। আবার শেষতম মুহূর্তের অস্তিত্বের অনস্তিত্ব আমাদেরকে পেছনের দিকে পূর্ব পূর্ববর্তী ক্ষণিক অস্তিত্বের অনস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাবে…। এভাবে এই কার্যকারণ শৃঙ্খলের সব অবস্থানের অনস্তিত্বের দিকেই যাত্রা হবে।

আবার, এই দুই প্রকারের বিনাশ এই সমুদায়ের বিশেষ কোন পদার্থের মধ্যেও দৃষ্ট হয় না। কারণ এই সমুদায়ের প্রত্যেকটি পদার্থই ক্ষণিক হওয়ার জন্য তার বুদ্ধিপূর্বক বিনাশ কখনও সম্ভব নয়। অথবা তার অবুদ্ধিপূর্বক বিনাশও সম্ভব নয়, কারণ তার অন্তর্গত কোন পদার্থ বিশেষেরই সম্পূর্ণ বিনাশ সম্ভব নয়। যেমন একটি ঘট যখন ধ্বংশ হয় তখন তার খণ্ডগুলির মধ্যে আমরা মৃৎপিণ্ডের অস্তিত্বকে দেখতে পাই। এমনকি অন্যক্ষেত্রেও  যেখানে আমরা বস্তুটি অদৃশ্য হয়ে গেল বলে মনে করি, সেখানেও; যেমন যদি উত্তাপের ফলে জলবিন্দুকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখি তা হলেও আমরা ধারণা করতে পারি যে, সেটি অন্যরূপে- বাষ্পরূপে অবস্থান করছে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেছেন-

‘প্রতিসংখ্যা-অপ্রতিসংখ্যা নিরোধ-অপ্রাপ্তিঃ, অবিচ্ছেদাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২২)।।
ভাবার্থ : পরস্পর সম্বন্ধ কার্যকারণ পরম্পরায় বিচ্ছেদ হয় না বলে বুদ্ধিপূর্বক বিনাশ ও অবুদ্ধিপূর্বক বিনাশ উভয়ই অসম্ভব হয় (ব্রঃ-২/২/২২)।

বৌদ্ধমতে অবিদ্যা (মায়া) হলো ক্ষণিক বস্তুতে চিরন্তনত্বের আরোপজনিত ভ্রান্তি বা মিথ্যা দৃষ্টি। বৌদ্ধরা বলেন যে, এই অবিদ্যার বিনাশেই মোক্ষ বা নির্বাণলাভ হয়। বাদরায়ণের মতে, এখন এই অবিদ্যার বিনাশ (বুদ্ধিপূর্বক বা অবুদ্ধিপূর্বক) এই দুই প্রকারের বিনাশের মধ্যে একটির দ্বারা অবশ্যই হবে। যদি এই অবিদ্যার বিনাশ বুদ্ধিপূর্বক কোন ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব চেষ্টা, তপস্যা এবং জ্ঞানের দ্বারা হয়, তাহলে তা বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদের বিরোধী হবে। কারণ, ক্ষণিকত্ববাদের মতে অবিদ্যাও ক্ষণিক, এবং অবিদ্যাও উৎপত্তির এক মুহূর্ত পরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যদি বলা হয় যে, অবিদ্যার বিনাশ স্বতই হয়ে থাকে, তাহলে বৌদ্ধদের নির্বাণলাভের সাধনা অষ্টাঙ্গ মার্গাদির উপদেশ ব্যর্থ হয়। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রেই বৌদ্ধদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এ প্রসঙ্গে বাদরায়ণ বলেন-

‘উভয়থা চ দোষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৩)।।
ভাবার্থ : বুদ্ধিপূর্বক অথবা অ-বুদ্ধিপূর্বক, যেভাবেই অবিদ্যার বিনাশ হোক না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই নানা দোষ থাকায় বৌদ্ধমত অসঙ্গত (ব্রঃ-২/২/২৩)।

আবার, বৌদ্ধ মতানুসারে দুই প্রকার নিরোধ বা বিনাশ ছাড়াও আকাশ হলো তৃতীয় অভাব-বস্তু। এর তাৎপর্য হলো, আকাশের কোন সাধারণ আবরণ অথবা স্থানাধিকারী কোন শরীর নাই। যেহেতু ইতঃপূর্বে দেখানো হয়েছে যে, দুই প্রকারের বিনাশ সম্পূর্ণভাবে অস্তিত্বগুণরহিত নয়, সুতরাং তা অভাব-পদার্থ হতে পারে না। আকাশের ব্যাপারটিও ঠিক অনুরূপ। যেমন ক্ষিতি, বায়ু প্রভৃতিকে তাদের প্রকৃতিগত মৌলিক গুণরাশি গন্ধত্বাদি দ্বারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা হিসেবে উপলব্ধি করা যায়- ঠিক সেভাবেই আকাশকেও শব্দগুণের আশ্রয়স্থল বলে একটি সত্তাত্মক পদার্থ হিসেবে উপলব্ধি করা সঙ্গত হবে। ক্ষিতি প্রভৃতির প্রতীতি হয় তাদের গুণ হতে এবং আকাশের অস্তিত্বও অনুভূত হয় তার শব্দগুণ হতে। সুতরাং কার্যকারণে এটিও অবশ্যই একটি ভাব-পদার্থ। অতএব, বাদরায়ণের বক্তব্য হলো-

‘আকাশে চাবিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৪)।।
ভাবার্থ : বৌদ্ধমতে আকাশ কোনরূপ ভাববস্তু নয়। কিন্তু এই মত ঠিক নয়। কারণ পৃথিব্যাদির ন্যায় তারও উপলব্ধি হয় (ব্রঃ-২/২/২৪)।

বস্তুসমূহের ক্ষণিকত্ববাদের বিরুদ্ধে আরেকটি আপত্তি হলো, যদি সবকিছুই ক্ষণিক হয়, তাহলে সকল অভিজ্ঞতাকারী অথবা কোন কিছুর ভোক্তাও অবশ্যই ক্ষণিক হবে। কিন্তু ভোক্তা যে ক্ষণিক নয় এবং দীর্ঘতর কাল স্থায়ী, তা এ বিষয় থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, মানুষের অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতি পরবর্তী কালেও থাকে। স্মৃতি একমাত্র সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সম্ভব যার এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে- কারণ যা এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতার বিষয় তা অন্য ব্যক্তির স্মৃতির বিষয় হতে পারে না। সুতরাং ভোক্তা এবং স্মর্তা বা স্মরণকারী একই ব্যক্তি হওয়ার জন্য সে অন্ততপক্ষে দুটি মুহূর্তের সঙ্গে যুক্ত থাকে- যা ক্ষণিকত্ববাদকে খণ্ডন করে। তাই বাদরায়ণ বলেন-

‘অনুস্মৃতেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৫)।।
ভাবার্থ : দ্রষ্টার পূর্বদৃষ্ট পদার্থ স্মরণে থাকে। অতএব ক্ষণিকত্ববাদ যুক্তিযুক্ত নয় (ব্রঃ-২/২/২৫)।

(খ) সৌত্রান্তিক বৌদ্ধমত খণ্ডন : সৌত্রান্তিক বৌদ্ধরা বাহ্যার্থবাদী, অর্থাৎ তাঁরা বাহ্যিক বস্তুর ক্ষণিক সত্তার বাস্তবিকতাকে স্বীকার করেন, এবং বিজ্ঞান প্রবাহ তার মধ্যেই নিহিত। বৌদ্ধমতে যা চিরন্তন এবং অপরিবর্তনশীল, তা থেকে কোন কার্য উৎপন্ন হতে পারে না; কারণ যার পরিবর্তন নাই তা কার্য উৎপাদন করতে পারে না। এজন্যই বৌদ্ধরা বলেন যে, কার্য উৎপত্তির পূর্বক্ষণেই কারণটি ধ্বংস হয়ে যায়। যেহেতু বাহ্যবস্তু ক্ষণিক, তাই আমরা যখন কোন বস্তুর অস্তিত্ব টের পাই, তখন কিন্তু তা নষ্ট হয়ে অবিকল সমরূপী বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যেমন একটি ঘড়ার অস্তিত্ব টের পাওয়ার সময় হয়তো তা নষ্ট হয়ে সেই উপাদান তথা মৃত্তিকার দ্বারা সমরূপী আর একটি ঘড়ায় পরিণত হয়েছে। এভাবে এ সময়ে যে ঘড়ার অস্তিত্ব অনুভব করছি তা পূর্বের নিরন্বয় বা বিনষ্ট হয়ে যাওয়া ঘড়ার। এটা কী করে হয়, তার উত্তরে সৌত্রান্তিকেরা বলেন- ঘড়া দৃষ্টিগ্রাহ্য বিজ্ঞানে (=ভাবে) স্ব-আকৃতিকে পরিত্যাগ করে বিনষ্ট হয়েছে, সেই বিজ্ঞানময় আকারকে প্রাপ্ত হয়ে তার দ্বারা ঘড়ার সত্তা অনুমিত হয়।
এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন- বৌদ্ধমতে, বীজটি ধ্বংস হলে পরই অঙ্কুরের উৎপত্তি হয়। অন্যভাবে বললে, তাঁদের মতে অসৎ থেকেই সতের উৎপত্তি হয়। কিন্তু যদি তাই হতো, তাহলে বিশেষ কারণের অনুমান নিরর্থক হতো। সেক্ষেত্রে যা কিছু হতে যে-কোন কিছু উৎপন্ন হতে পারতো, কারণ যেহেতু অবিদ্যমান বস্তুর কোনো আকার নেই, তাই সর্বক্ষেত্রেই অনস্তিত্ব অবস্থাটি একইরূপ। একটি আমের আঁটি এবং একটি আপেলের বীজের অনস্তিত্বের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলে আমরা একটি আমের আঁটি থেকে একটি আপেল গাছের উৎপত্তিকে প্রত্যাশা করতে পারি। আর যদি অনস্তিত্বের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে তাহলে তার ফল হবে এমন যে, একটি আম্র বীজের অনস্তিত্ব একটি আপেলের বীজের অনস্তিত্ব হতে ভিন্ন হবে। সেক্ষেত্রে তারা একটা সুনিশ্চিত নির্দিষ্ট ফলই উৎপন্ন করবে, তাহলে তারা আর অসৎ-বস্তু হবে না- অবশ্যই একটা সদ্-বস্তু হবে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণের আপত্তি হলো-

‘নাসতঃ, অদৃষ্টত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৬)।।
ভাবার্থ : অনস্তিত্বশীল বস্তু হতে ভাববস্তুর উৎপত্তি হয় না। কারণ, এরূপ দৃষ্টান্ত কোথাও নেই (ব্রঃ-২/২/২৬)

আবার বিনষ্ট বা অবিদ্যমান বস্তু থেকে যদি এভাবে বস্তু উৎপন্ন হতে পারে, তাহলে কেবল কর্মহীনতা থেকেও উদ্দেশ্য পূর্ণ হতো- যেহেতু কারণরূপ কর্মপ্রচেষ্টার কোন প্রয়োজনই হতো না। একইভাবে যারা উদাসীন অর্থাৎ কোনো বিষয় জানতে প্রচেষ্টা করে না তারাও সে বিষয়ে জ্ঞাত হবে। এমনকি চরম মুক্তি বা নির্বাণ লাভ পর্যন্ত চেষ্টা ব্যতীত সম্ভব হতো। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-

‘উদাসীনানামপি চৈবং সিদ্ধিঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৭)।।
ভাবার্থ : যদি অভাববস্তু থেকে ভাববস্তুর উৎপত্তি হতো তাহলে নিশ্চেষ্ট ব্যক্তিও কার্যসিদ্ধি করতে পারতো (ব্রঃ-২/২/২৭)।

(গ) যোগাচার বৌদ্ধমত খণ্ডন : বৈভাষিক মতে বাহ্যার্থ ও বিজ্ঞান উভয়কেই মানা হয়েছে। সৌত্রান্তিকেরা বাহ্যার্থকেই মুখ্য বলে মেনেছেন, বিজ্ঞান তার মধ্যেই নিহিত। অন্যদিকে বিজ্ঞানবাদী যোগাচার-মত সৌত্রান্তিকের সম্পূর্ণ বিপরীত। যোগাচার মতে বাহ্য জগতের কোন অস্তিত্বই নাই। ক্ষণিক বিজ্ঞানই বাস্তব পদার্থ; বাহ্য বস্তুসমূহ, জগৎ- তারই বাহ্যিক বিক্ষেপ।

এখানে প্রশ্ন আসে, তবে কি বাহ্য জগৎপ্রপঞ্চ শশশৃঙ্গের ন্যায় সম্পূর্ণ অলীক, অথবা তা কি স্বপ্নদৃষ্ট জগতের ন্যায় মিথ্যা ? যদি শশশৃঙ্গের ন্যায় অলীকই হতো তাহলে আমরা এই জগৎপ্রপঞ্চকে উপলব্ধিই করতে পারতাম না। বাহ্য জগৎকে আমরা ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে উপলব্ধি করে থাকি, সুতরাং তাকে সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন বলতে পারি না। এর উত্তরে যোগাচারী বৌদ্ধরা বলতে পারেন যে, তাঁরা কোন বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন নন একথা নিশ্চিতরূপে বলতে পারেন না, তবে তাঁরা চিত্ত-চেতনায় অন্তরে বিজ্ঞানরূপে যা উপলব্ধি করেন তাই তাঁদের নিকট বাহ্য জগতে বিমূর্তরূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু এই যুক্তি খণ্ডন করে বলা যায়, তাহলে বিজ্ঞানের নিজস্ব লক্ষণটিই প্রমাণ করবে যে, বাহ্য জগতের বস্তুনিচয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণাটি আন্তর জগতের বিজ্ঞান থেকে ভিন্ন। কারণ, মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য বস্তুনিচয়ের সম্পর্কেই সচেতন, কেউই তার শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা সম্পর্কে সচেতন নয়। বৌদ্ধরা যে বলেন চিত্ত-চৈত্তিক অভিজ্ঞাই ‘বাহ্য কোন কিছুর রূপবিশিষ্ট হয়ে’ প্রতীয়মান হয়, তা থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, বাহ্য জগৎটি বাস্তব। যদি বাহ্যজগৎ বাস্তব না হতো, তাহলে ‘বাহ্য কিছুর ন্যায়’- এই তুলনা অর্থহীন হতো। যেমন, কেউই বলে না যে, দেবদত্ত এক বন্ধ্যা-পুত্রের ন্যায়। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-

‘ন অভাবঃ উপলব্ধেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৮)।।
ভাবার্থ : বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদের মতে বিজ্ঞান মাত্রই সত্য, অন্য কিছু নয়। কিন্তু যেহেতু উপলব্ধি হয়, তাই বাহ্য জগৎ অনস্তিত্ব বা অলীক নয় (ব্রঃ-২/২/২৮)।

এক্ষেত্রে যোগাচারী বৌদ্ধরা বলতে পারেন যে, বাহ্য জগতের অভিজ্ঞা স্বপ্নজগতে দৃষ্ট অভিজ্ঞার ন্যায়ই মনে করতে হবে। স্বপ্নে বাহ্যবস্তু থাকে না; তবুও ধারণাগুলি দুটি রূপ ধারণ করে উপস্থিত হয়- একটি জ্ঞাতা এবং অপরটি জ্ঞেয়। বাহ্যজগতের রূপটি একইভাবে বাহ্যবস্তু নিরপেক্ষ। কিন্তু এই যুক্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন যে, জাগ্রৎ-অবস্থা এবং স্বপ্নাবস্থার মধ্যে পার্থক্য আছে। স্বপ্নে যা দেখা যায়, তা জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞতার দ্বারা বাধিত হয়- দেখা যায় তা মিথ্যা। স্বপ্নবস্থা হলো একপ্রকার স্মৃতি, আর জাগ্রৎ অবস্থা হলো বাস্তব অনুভব। সুতরাং তাকে মিথ্যা বলে অগ্রাহ্য করা যায় না। তাছাড়া, অভিজ্ঞতা ব্যতীত জ্ঞানের অস্তিত্বেও আর প্রমাণ কী ? যদি তাই হয়, তাহলে যার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা হলো তাকে অস্তিত্বশীল বলে গ্রহণ করতে আপত্তি কোথায় ? তাই বাদরায়ণ বলেছেন-

‘বৈধর্ম্যাৎ চ স্বপ্নাদিবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৯)।।
ভাবার্থ : জাগ্রৎ এবং স্বপ্নাবস্থার চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে বলে, জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞা স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞার অনুরূপ নয় (ব্রঃ-২/২/২৯)।

যদিও বৌদ্ধমতে বাহ্য বস্তুর নিজের কোন অস্তিত্ব নেই, তবু ঘট-পটাদির বাস্তব বিচিত্র ধারণাগুলির ব্যাখ্যা করা যেতে পারে আমাদের পূর্ব সংস্কার অথবা পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ মানসিক ধারণার (বাসনার) প্রভাবের দ্বারা- যেমন আমাদের জাগ্রৎ অবস্থার ধারণাগুলিই স্বপ্নাবস্থায় বিচিত্ররূপে উপলব্ধ হয়। কিন্তু বাহ্য বস্তুর অভিজ্ঞতা ছাড়া মানসিক ধারণা (সংস্কার) সম্ভব নয়। কিন্তু যোগাচারী বৌদ্ধরা তা অস্বীকার করেন। অথচ অনাদি কার্যকারণ শৃঙ্খলের প্রতীত্য-সমুৎপাদ ধারণার অনুমানকে স্বীকার করলে আমাদেরকে ‘অনবস্থাদোষে’ই উপনীত হতে হবে- এতে সমস্যার কোন সমাধান হবে না। তাই বাদরায়ণ বলেছেন-

‘ন ভাবঃ অনুপলব্ধেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩০)।।
ভাবার্থ : বস্তুর অভাবে তার বিষয়ে উপলব্ধি সম্ভব নয় এবং উপলব্ধির অভাবে বাসনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না (ব্রঃ-২/২/৩০)।

বাসনা বা মনের সংস্কারের অবশ্যই একটা আশ্রয় থাকা প্রয়োজন। আশ্রয় ছাড়া তারা থাকতে পারে না। কিন্তু ক্ষণিকত্ববাদ সবকিছুরই স্থায়িত্বকে অস্বীকার করে। এমনকি, যেহেতু আলয়-বিজ্ঞান বা অহংজ্ঞানও ক্ষণিক, সেজন্য তাও সংস্কারের আশ্রয় হতে পারে না। কেননা, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে স্থায়ী সংযোগ রক্ষাকারী যদি কোন সত্তা বর্তমান না থাকে, তাহলে বিশেষ কোন সময়ে এবং স্থানে উদ্ভূত কোন অভিজ্ঞতার স্মৃতি বা সংস্কার থাকা সম্ভবপর নয়। আবার যদি আলয়-বিজ্ঞানকে স্থায়ী কিছু বলে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা হবে ক্ষণিকত্ববাদের বিরুদ্ধ। তাই বাদরায়ণের বক্তব্য হলো-

‘ক্ষণিকত্বাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩১)।।
ভাবার্থ : বৌদ্ধমতে বাসনা ও সংস্কারের আশ্রয় অহংও ক্ষণিক। তাই তা সংস্কার বা বাসনার আশ্রয় হতে পারে না (ব্রঃ-২/২/৩১)।

(ঘ) মাধ্যমিক বৌদ্ধমত খণ্ডন : বৌদ্ধদর্শনে বৈভাষিকেরা ক্ষণিকত্ববাদকে এক সমান মেনে জড়, অজড় উভয়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন, সৌত্রান্তিকেরা স্বীকার করেছেন শুধু বাহ্য জড় উপাদানের, যোগাচার মেনেছেন মাত্র অভ্যন্তরীণ অ-জড় সত্তাকে; কিন্তু শূন্যবাদী মাধ্যমিক-মতে বাহ্য-অন্তর সমস্ত সত্তার অস্তিত্বজাত জ্ঞান পরস্পর সাপেক্ষ হওয়ায় সবকিছুকেই শূন্য বলে মানা হয়েছে। এজন্য মাধ্যমিক মতবাদকে শূন্যবাদও বলা হয়।

নাগার্জুনের শূন্যবাদী মাধ্যমিক দর্শন খণ্ডনে বাদরায়ণ একটি সূত্রের বেশি লেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। হয়তো তিনি বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদকে খণ্ডনের মাধ্যমেই জবাব দেয়া হয়েছে বলে মনে করেছেন। এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘সর্বথা অনুপপত্তেঃ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩২)।।
ভাবার্থ : বৌদ্ধমত যেমন যুক্তি-বিরুদ্ধ তেমনি শাস্ত্র-বিরুদ্ধও বটে। তাই সর্বথা অসঙ্গত হওয়ায় তা অগ্রাহ্য (ব্রঃ-২/২/৩২)।

এই সূত্রটিকে শূন্যবাদের খণ্ডনকারী হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। সেক্ষেত্রে বাদরায়ণের বক্তব্যটি হবে- বৌদ্ধদের শূন্যবাদ সব কিছুরই বিরোধী। তা শ্রুতি, স্মৃতি, প্রত্যক্ষজ্ঞান, অনুমান অথবা অন্য সর্বপ্রকার যথার্থ জ্ঞানেরই বিরোধী। এবং সেজন্যই যাঁরা আত্মকল্যাণ কামনা করেন তাঁদের সকলের পক্ষেই তা সর্বতোভাবে অশ্রদ্ধেয়।

[আগের পর্ব : অন্যান্য অ-ঋষিপ্রোক্ত ঈশ্বরবাদী দর্শনমত খণ্ডন] [*] [পরের অধ্যায় : শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত-বেদান্ত]

No comments: