|বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবেদান্ত-০৫ : অদ্বৈতমতে মায়া বা অবিদ্যা|
রণদীপম বসু
…
২.৩ : অদ্বৈতমতে মায়া বা অবিদ্যা
অদ্বৈত-বেদান্ত
মতবাদের অন্যতম স্তম্ভ হলো মায়াবাদ। তবে মায়াবাদ একটি প্রাচীনতম ধারণা।
বেদ এবং উপনিষদের মধ্যেই প্রথম মায়াবাদের ধারণা পরিলক্ষিত হয়। ঋগ্বেদে দুটি
অর্থে ‘মায়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘প্রথমত, যে শক্তি বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি
করতে পারে তা-ই মায়া। দ্বিতীয়ত, যে শক্তি সত্যকে আবৃত করে রাখে তা-ই
মায়া।’- (নীলিমা মণ্ডল, ভারতীয় দর্শন পরিচয়, পৃষ্ঠা-১৮৯)। আবার শ্বেতাশ্বতর
উপনিষদে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরের মায়াশক্তি থেকেই জগতের উৎপত্তি হয়েছে।
যেমন-
‘য একো জালবান্ ঈশত ঈশনীভিঃ সর্বান্ লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ।
ঐ এবৈক উদ্ভবে সম্ভবে চ য এতৎ বিদুঃ অমৃতাস্তে ভবন্তি’।। (শ্বেতাশ্বতর-৩/১)
‘ছন্দাংসি যজ্ঞাঃ ক্রতবো ব্রতানি ভূতং ভব্যং যচ্চ বেদা বদন্তি।
অস্মান্ মায়ী সৃজতে বিশ্বমেতৎ অস্মিন্ চ অন্যো মায়য়া সন্নিরুদ্ধঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৯)
‘মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ।
তস্য অবয়বভূতৈঃ তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)
অর্থাৎ :
সেই পরমাত্মা যিনি মায়াবী (জালবান), যিনি নিজের মায়াশক্তিতে সকল জগৎ শাসন করেন, সেই একই শক্তিতে যিনি এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি অথবা বিনাশের কারণ, তিনি অদ্বিতীয়। যাঁরা এই সত্য জানেন, তাঁরা অমর হন (শ্বেতাশ্বতর-৩/১)। চারটি বেদ, বৈদিক যাগযজ্ঞ, সবরকমের উপাসনা এবং ধর্মীয় সাধনা, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ- সংক্ষেপে বেদে যা যা বলা হয়েছে তার সবকিছুই ব্রহ্ম থেকে এসেছে। নিজের মায়াশক্তি দিয়ে ব্রহ্ম এই জগৎ-সংসার সৃষ্টি করেন। আবার সেই একই শক্তির প্রভাবে জীবাত্মা মায়াময় জগৎ-সংসারে বাঁধা পড়ে (শ্বেতাশ্বতর-৪/৯)। প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বরকে (তথা ব্রহ্মকে) মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ (অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্বজীবে বিরাজিত) (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।
শঙ্করাচার্য ও তাঁর অনুগামী দার্শনিকরা বেদ এবং উপনিষদের এই মায়াবাদকে যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। অঘটন-ঘটনপটীয়সী যে শক্তি ব্রহ্মকে আবৃত করে তার উপর জগৎ-প্রপঞ্চকে আরোপ করে, অদ্বৈতবেদান্তে তাকে অজ্ঞান, অবিদ্যা বা মায়া বলা হয়েছে। এই অবিদ্যা, অজ্ঞান বা মায়ার দ্বারা উপহিত হয়েই স্বরূপত নির্গুণ ব্রহ্ম কল্যাণগুণাধার হয়ে সগুণ ঈশ্বর বা জগৎ-কারণ হন। মায়া নিজের ক্রিয়া ব্রহ্মে আরোপ করে বলেই মায়াকে ব্রহ্মের উপাধি বলা হয়েছে। মায়া-উপহিত এই চৈতন্যসত্তা জগৎপ্রপঞ্চের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ।
অদ্বৈতমতে উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। আর সব কিছুই- এই বিচিত্র জগৎ মিথ্যা- শুধু আপাত প্রতীয়মান সত্তামাত্র। জীব এবং ব্রহ্ম অভিন্ন, এক এবং অদ্বিতীয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে- সত্য যদি একই হন, তাহলে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা এই নানাত্ব অনুভব করি কেন ? সত্য তো অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এজন্যেই শঙ্কর সত্য এবং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে অদ্বৈতমতে আপাত বিরোধের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, জগতের এই নানাত্ব হলো মায়া। যখনই আমাদের ব্রহ্ম সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান জন্মে তখনই নানাত্ব থাকে না- সুতরাং তার কোন সত্যতা নেই। অন্ধকারে রজ্জুতে সর্প দর্শনের ন্যায় তা একটি ভ্রম। অবিদ্যার জন্যেই এই ভ্রান্তি। এই অবিদ্যা অনাদি। এই অবিদ্যাই যাবতীয় নানাত্ব দর্শনের কারণ- এজন্যই ব্রহ্মকে জগৎ বলে ভ্রম হয়। এই অবিদ্যার কারণেই জীবাত্মা নিজেকে উপাধিযুক্ত অর্থাৎ দেহ, ইন্দ্রিয়াদি যুক্ত বলে মনে করে। উপাধিগুলি জীবের উপর আরোপিত মাত্র। উপাধির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যই জীব নিজেকে কর্তা ভোক্তা ইত্যাদি মনে করে। যদিও যথার্থত জীবাত্মার সঙ্গে উপাধির কোন সম্পর্কই নেই- তবু তা মায়াবলে সংসারাবদ্ধ হয়ে নিজেকে জন্ম, মৃত্যু, সুখ দুঃখাদির অধীন বলে মনে করে।
এখানে উল্লেখ্য, আচার্য শঙ্কর তাঁর শারীরকভাষ্যে যদিও ‘মায়া’ ও ‘অবিদ্যা’ শব্দদ্বয়কে সমার্থকরূপে ব্যবহার করেছেন, তথাপি ভামতী সম্প্রদায়ের বাচস্পতিমিশ্রের মতো কোন কোন অদ্বৈতবেদান্তী এই শব্দদ্বয়ের পৃথক প্রয়োগ করেছেন। তাঁদের মতে জগৎ বিক্ষেপকারী, ঈশ্বরের উপাধি, সমষ্টিগত অজ্ঞান, মূলাবিদ্যাই হলো মায়া; আর জীবের উপাধি, আবরণকারী, ব্যক্তিগত অজ্ঞান, তুলাবিদ্যাই হলো অবিদ্যা। সে যাক্, এখন প্রশ্ন হলো- এই উপাধি বা মায়ার স্বরূপ কী ?
মায়ার স্বরূপ :
অদ্বৈতবেদান্তে মায়ার স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘সদসদভ্যাম, অনির্বচনীয়ম্, ত্রিগুণাত্মকম্, জ্ঞানবিরোধী, ভাবরূপম্, যৎকিঞ্চিৎ’।
সদসদভ্যাম : বেদান্তমতে ব্রহ্মের অতিরিক্ত কোন সৎ বস্তু নেই। যা সৎ, তা নিত্য। অজ্ঞান পরমসত্তার জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়। কারণ, মায়া বা অজ্ঞান ব্রহ্মের মতো অবাধিত বা পারমার্থিক সত্তা নয়। সৎ বস্তু কখনো বাধিত বা বিনাশ হয় না। কিন্তু অজ্ঞান জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয়। যেমন রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। কিন্তু পরে আমরা জানি যে ঐ সর্প মিথ্যা। অতএব আমার অজ্ঞান ধ্বংস হয়। সুতরাং অজ্ঞানকে সৎ বলা যায় না।
আবার দৃশ্যমান জগতের বিক্ষেপক অজ্ঞানকে অসৎও বলা যায় না যেহেতু সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। অজ্ঞানের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব প্রমাণ। রজ্জুতে সর্পভ্রম প্রভৃতি অজ্ঞানের বিষয় প্রত্যক্ষীভূত ঘটনা। এইজন্য ঐ সর্পটি আকাশ-কুসুমের মতো সম্পূর্ণ অসৎ বা অলীক নয়। অলীক কখনো প্রত্যক্ষ হয় না। আবার অজ্ঞানকে একইসঙ্গে সৎ ও অসৎ অর্থাৎ সদসৎও বলা যায় না। কারণ একই বস্তুতে সত্তা ও সত্তার অভাবরূপ পরস্পর বিরোধী ধর্ম একসঙ্গে থাকতে পারে না। সৎ ও অসৎ পরস্পর বিরুদ্ধ, এবং বিরুদ্ধভাবের অভিন্ন আশ্রয় অসম্ভব। তাই অজ্ঞান বা মায়াকে সদসৎও বলা যায় না।
অনির্বচনীয়ম্ : যেহেতু অজ্ঞান সৎ, অসৎ ও সদসৎ নয়, সেহেতু অদ্বৈতমতে অজ্ঞান সদসৎ ভিন্ন বা অনির্বচনীয়। যাকে সৎ, অসৎ ও সদসৎ- কোন রূপেই নির্দেশ করা যায় না, তা-ই অনির্বচনীয়। এই অর্থে কোন বস্তু হয় সৎ অথবা অসৎ হবে, এমন কোন কথা নেই। এমন বস্তুও থাকতে পারে, যা সৎও নয়, আবার অসৎও নয়। মায়া বা অজ্ঞান এরূপ সদসদবিলক্ষণ। সদসদবিলক্ষণকেই অদ্বৈতমতে অনির্বচনীয় বলা হয়। তাই বেদান্তসার গ্রন্থে মায়াকে বলা হয়েছে-
‘সদসদভ্যাম অনির্বচনীয়ম্’। অর্থাৎ, মায়া সৎরূপে, অথবা অসৎরূপে অথবা সদসৎরূপে বচনীয় নয়।
ত্রিগুণাত্মকম্ : অদ্বৈতমতে মায়া হলো ত্রিগুণাত্মক। অর্থাৎ, সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ- এই তিনটি গুণ দিয়ে মায়া গঠিত। যেহেতু মায়ার দ্বারা সৃষ্ট এই জগতের বস্তুগুলির মধ্যে সত্ত্ব, রজো এবং তমো গুণগুলি দেখা যায়, সেহেতু এই জগতের কারণ মায়াকে ত্রিগুণাত্মক বলা হয়েছে। সত্ত্ব প্রভৃতি গুণগুলির কার্য আমরা আমাদের সুখ, দুঃখ ও অবসাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করি। মায়া সম্পূর্ণরূপে অবোধ্য নয় যেহেতু মায়ার ত্রিগুণাত্মক ধর্মটি আছে। অজ্ঞানজন্য যাবতীয় পদার্থেই এই ত্রিবিধ গুণ পরিলক্ষিত হয়।
জ্ঞানবিরোধী : মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানবিরোধী। জ্ঞানের উদয়ে মায়া বা অজ্ঞান বাধিত বা অন্তর্হিত হয়। জ্ঞান ও অজ্ঞান পরস্পরবিরোধী। একটা বিশেষ অধিষ্ঠানে অজ্ঞান থাকলে তা বিষয়কে আবৃত করে। সেই একই অধিষ্ঠানে একই বিষয়ের অভ্রান্ত জ্ঞান হলে অজ্ঞানটি বাধিত হয়। রজ্জুর সম্যগ্জ্ঞানে রজ্জুতে আভাসিত সর্প যেমন বিলুপ্ত হয়, সেরূপ জ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান দূর হয়। এ কারণে মায়া বা অজ্ঞানকে জ্ঞানবিরোধী বলা হয়েছে।
ভাবরূপম্ : মায়া বা অজ্ঞানকে ভাবরূপ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানের অভাব নয়, এটি ভাবরূপ বা ভাব পদার্থের মতো। কিন্তু মায়া যেহেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সেহেতু এটি সম্পূর্ণ ভাব পদার্থ নয়। মায়া ভাবপদার্থ এ কারণে যে, মায়া বন্ধ্যাপুত্র বা আকাশকুসুমের মতো অলীক নয়। মায়া যদি আকাশকুসুমের মতো অভাবপদার্থ হতো, তাহলে তার অভিজ্ঞতা আমাদের কখনোই হতো না। আবার অজ্ঞান কেবল বস্তুর স্বরূপ আচ্ছাদন করে না, এক বস্তুতে অন্য বস্তুর প্রতিভাসের সৃষ্টি করে। বিক্ষেপকর্ম সব সময় ভাবাত্মক। তাই অজ্ঞান শুধু জ্ঞানের অভাব নয়, মিথ্যাজ্ঞানও বটে। অবশ্য অজ্ঞানের এই ভাবরূপ চিৎ আত্মার ভাবরূপ থেকে পৃথক। চিৎ আত্মার ভাবরূপ নিত্য, অজ্ঞানের ভাবরূপ অনিত্য। অজ্ঞান ভাবরূপ হলেও তা ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ নয়। ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ হলে অজ্ঞানের বিনাশ সম্ভব হতো না, কিন্তু আমরা জানি যে, প্রকৃতজ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে যে, মায়া বহু বিচিত্র বিশ্ব সংস্কারের ভিত্তি। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ’। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)
অর্থাৎ : মায়াপ্রকৃতি (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ) নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল, কেউ বা সাদা আবার কেউ কালো (অর্থাৎ, তারা আগুন, জল আর মাটি দিয়ে তৈরি)।
অজা অর্থ হলো মায়া যার জন্ম নেই অর্থাৎ অনাদি। লোহিত বা লাল রজো গুণ, শুক্ল বা সাদা সত্ত্ব গুণ এবং কৃষ্ণ বা কালো তমো গুণকে নির্দেশ করে। মায়া ঐ তিনটি গুণস্বরূপ। সুতরাং, মায়া যেহেতু ভাব পদার্থের ভিত্তি সেহেতু মায়া কখনোই অভাব পদার্থ নয়।
যৎকিঞ্চিৎ : মায়াকে বলা হয়েছে ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’। অর্থাৎ, মায়ার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারি না। মায়া অস্থির ও অনির্বচনীয় কিছু। ব্রহ্মের থেকে মায়া সম্পূর্ণ পৃথক নয়। শ্রুতিতে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৩/১, ৪/৯) মায়াকে ব্রহ্মের শক্তি বলা হয়েছে। মায়া ব্রহ্মের থেকে অপৃথকও নয়। কারণ চৈতন্য ও জড়ের অভেদ সম্ভব নয়। ভেদ ও অভেদ পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক বলে একই পদার্থে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ থাকতে পারে না। আবার মায়া নিরবয়ব বা অংশহীন নয়। যেহেতু কোন নিরংশ পদার্থ কোন কিছুর কারণ হতে পারে না। অথচ মায়া জগতের কারণ। আবার মায়ার অংশ আছে- একথাও বলা যায় না। কারণ তাহলে মায়া একটি উৎপন্ন দ্রব্যে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে যেহেতু উৎপন্ন দ্রব্য মাত্রেরই আরম্ভ আছে, সেহেতু মায়ার আরম্ভকে স্বীকার করতে হবে। তাহলে মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্মও সাদি অর্থাৎ, সীমিত হয়ে পড়বে। এই কারণে মায়াকে অনির্বচনীয় বলা হয়েছে এবং ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’ রূপে মায়াকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
মায়ার শক্তিদ্বয় :
শঙ্করাচার্যের মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন। জীবের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা অবিদ্যা, ব্রহ্মের দিক থেকে তাই মায়া। অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে মায়া হলো অবিদ্যা। অবিদ্যার দুটি শক্তি- একটি আবরণশক্তি এবং অপরটি বিক্ষেপশক্তি। আবরণ শক্তির দ্বারা অবিদ্যা প্রথমে তার অধিষ্ঠানকে আবৃত করে। বিক্ষেপ শক্তি দ্বারা অবিদ্যা সেই অধিষ্ঠানে অন্য এক মিথ্যা বস্তুকে আরোপ করে। যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। এই অধ্যাস বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রথমে রজ্জুর যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ঘটে এবং পরে রজ্জুতে মিথ্যা সর্পকে আরোপ করা হয়। ঠিক একইভাবে অবিদ্যাবশত নির্গুণ ব্রহ্মে জগৎ বা ঈশ্বর ভ্রম হয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মের মায়াশক্তির বলে ‘এক’ ব্রহ্মের স্থলে বহু বস্তু দৃষ্ট হয়। সুতরাং, জগৎ মিথ্যা। এক্ষেত্রে ‘জগৎ মিথ্যা’ অর্থ হলো ‘বহু মিথ্যা’ বা ‘ভেদ মিথ্যা’।
আবরণশক্তির কাজ সত্যকে আচ্ছাদন করে রাখা। অজ্ঞানের এই আবরণশক্তি আত্মার যথার্থ স্বরূপকে আবৃত করে রাখে। বিক্ষেপশক্তির কাজ মিথ্যাকে প্রকাশ করা। অজ্ঞানবশত রজ্জু যেমন সর্পেরূপে প্রকাশিত হয়, সেরূপ অজ্ঞানবশতই পরমাত্মায় কর্তৃত্ব, ভোক্তৃত্ব ইত্যাদি প্রকাশ পায়। কোন বস্তু আবরণশক্তি দ্বারা বাধিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তার মিথ্যারূপ প্রকাশ পায়। অদ্বৈতমতে বিক্ষেপশক্তি হলো সৃষ্টিশক্তি। অজ্ঞানের এই বিক্ষেপশক্তি অনিত্য জগৎ সৃষ্টিকারী। অদ্বৈতমতে অজ্ঞানের আবরণশক্তি ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপশক্তি ব্রহ্মকে জগৎরূপে প্রকাশ করে।
মায়া ও অবিদ্যায় ভেদ-অভেদ :
শঙ্করাচার্য এবং কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (বিবরণ সম্প্রদায়) মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন হলেও অন্য কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (ভামতী সম্প্রদায়) মতে মায়া এবং অবিদ্যা এক নয়। তাঁদের মতে মায়া সদর্থক এবং ভাবরূপ, যদিও সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল এবং ব্রহ্ম থেকে অবিচ্ছেদ্য। অপরপক্ষে অবিদ্যা সম্পূর্ণ নঞর্থক ও অভাবরূপ। কারণ অবিদ্যার অর্থ হলো বাস্তব সত্তার জ্ঞানের অভাব।
দ্বিতীয়ত, মায়া ঈশ্বরকে সীমিত করে। কিন্তু ঈশ্বর অবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত বা আচ্ছন্ন হন না। অবিদ্যা হলো ব্যক্তির জ্ঞানের অভাব। অবিদ্যা জীবকে অবচ্ছিন্ন বা সীমিত করে। মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে ঈশ্বর এবং অবিদ্যায় প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে জীব। তাই জ্ঞানের দ্বারা ব্যক্তির অবিদ্যা দূর হয়। কিন্তু মায়া ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত শক্তি বলে ব্যক্তির জ্ঞানের দ্বারা মায়া অপসারিত হয় না।
তৃতীয়ত, মায়া প্রধানত সত্ত্ব গুণসম্পন্ন। কিন্তু অবিদ্যা সত্ত্ব, রজো ও তমো গুণের দ্বারা গঠিত।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উক্ত দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ অদ্বৈতবেদান্তের মূল তত্ত্বগুলি উভয়পক্ষই গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া উভয়পক্ষই স্বীকার করেন যে, ঈশ্বর অজ্ঞানের নঞর্থক দিকের দ্বারা প্রভাবিত হন না। এবং তাঁর মধ্যে সত্ত্ব গুণেরই প্রাধান্য আছে। সুতরাং, আবরণকে তুলাবিদ্যা বলা হলে এবং বিক্ষেপকে মায়া বা মূলাবিদ্যা বলা হলেও প্রকৃত তত্ত্বটি অবিকৃত থেকে যায়।
অজ্ঞানের অস্তিত্ব প্রমাণ :
অজ্ঞানের অস্তিত্ববিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব ও শ্রুতি হলো প্রমাণ। আমরা প্রত্যেকেই ‘আমি অজ্ঞ’ এইরূপ অবস্থা সরাসরি উপলব্ধি করি। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- ‘দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্’।
প্রশ্ন হতে পারে যে, মায়া বা অজ্ঞান এক না বহু ? বেদান্তসারের বক্তব্য অনুসারে মায়াকে এক এবং বহু, উভয়রূপেই চিন্তা করা সম্ভব। সমগ্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অজ্ঞান হলো এক। আবার প্রতিটি জীবকে পৃথকভাবে চিন্তা করলে অজ্ঞান বহু। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, অজ্ঞান দু’ধরনের- সমষ্টি অজ্ঞান ও ব্যষ্টি অজ্ঞান।
বন বললেই যেমন বিশেষ বিশেষ বৃক্ষের সমষ্টি সমস্ত গাছের একযোগে প্রতীতি হয়, জলাশয় যেমন জলবিন্দুর সমষ্টি, অনুরূপভাবে অন্তঃকরণ উপাধিভেদে জীবগত অজ্ঞান বহু হয়েও সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক। আবার সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক হলেও বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ হিসেবে বৃক্ষ যেমন বহু, বিন্দু বিন্দু জলকণা হিসেবে জল যেমন বহু, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন জীবের অজ্ঞান হিসেবে ব্যষ্টিরূপে অজ্ঞান বা মায়া হলো বহু।
অদ্বৈতমতে সমষ্টি অজ্ঞান ঈশ্বরের উপাধি। ব্যষ্টি অজ্ঞান অজ্ঞ জীবের উপাধি। ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞান বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণপ্রধান। অর্থাৎ ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ বেশি পরিমাণে বর্তমান থাকে। ব্যষ্টি জীবের উপাধিরূপে, অজ্ঞান মলিনসত্ত্বপ্রধান। অর্থাৎ অজ্ঞ জীবের উপাধি হিসেবে ব্যষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে থাকে। ব্যষ্টি অজ্ঞানে রজঃ ও তমঃ গুণ মিশ্রিত থাকায় জীবের প্রকাশশক্তি কম। এজন্য জীবকে প্রাজ্ঞ বলা হয়। ঈশ্বর হলেন সর্বজ্ঞ।
অন্যভাবে সমষ্টি অজ্ঞানকে মূলাবিদ্যা এবং ব্যষ্টি অজ্ঞানকে তুলাবিদ্যা বলা হয়। অজ্ঞানের এই যে সমষ্টি ও ব্যষ্টি বিভাগ, তা কল্পিত বিভাগমাত্র। বন ও বৃক্ষ যেমন বস্তুত এক, জল ও জলাশয় যেমন বস্তুত এক, তেমনি সমষ্টি ও ব্যষ্টি অজ্ঞান বস্তুত এক ও অভিন্ন। একই মায়াশক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী নামের এই ভিন্নতা। অদ্বৈতবেদান্তী এই উভয়প্রকার উপহিত চৈতন্যের উর্ধ্বে এক ও অদ্বিতীয় তুরীয়চৈতন্যবাদী। সেই তুরীয়চৈতন্যই পরমাত্মা বা ব্রহ্ম। অঘটন-ঘঁটন-পটীয়সী জগৎ বিক্ষেপকারী অনাদি মায়া যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ব্রহ্মের অতিরিক্ত তার কোন সত্তা নেই। এই অবিদ্যাতত্ত্ব, মায়াতত্ত্ব বা বিবর্ততত্ত্ব যে কেবলাদ্বৈতবাদীর জগৎ ব্যাখ্যার পক্ষে এক অপরিহার্য তত্ত্ব, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মায়ার সাথে ব্রহ্ম ও জগতের সম্বন্ধ :
মায়ার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্বন্ধ কী ? শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম মায়া শক্তির প্রভাবে জগৎরূপে প্রতিভাত হয়। মায়া ব্রহ্মেরই শক্তি। আগুনের দাহিকা শক্তিকে যেমন আগুন থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়, তেমনি ব্রহ্মের মায়াশক্তিকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক করা যায় না। বস্তুত মায়ার আশ্রয় এবং বিষয় উভয়ই ব্রহ্ম। তবে ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হন না। এই প্রেক্ষিতে শ্বেতাশ্বতর-এ একটি উপমাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়-
যাদুকর ইন্দ্রজাল রচনা করেন। যাঁরা অজ্ঞ ব্যক্তি তাঁরাই যাদুকরের ঐন্দ্রজালিক ঘটনাগুলিকে সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু যাদুকর তাঁর ইন্দ্রজালের দ্বারা অপরকে প্রভাবিত করলেও নিজে প্রভাবিত হন না। সুতরাং, মায়া এবং ব্রহ্ম দুটি পৃথক সত্তা নয়।
মায়ার সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ কী ? অদ্বৈতবেদান্ত অনুসারে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা। মায়া সগুণ ব্রহ্মের শক্তিরূপে তাঁর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং, মায়া এই জগতের কারণ। জগৎ হলো মায়ার পরিণাম।
অদ্বৈতমতে সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ অনুসারে অদ্বৈত সত্তাকে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করা হয়। যথা- পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাতিভাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। ব্রহ্মজ্ঞান হলে যাকে একমাত্র সৎ বলে প্রতীয়মান হয় তার সত্তা হলো পারমার্থিক সত্তা। এই অর্থে ব্রহ্ম হলেন পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কিন্তু যতক্ষণ আমিই ব্রহ্ম- এরূপ উপলব্ধি না হয়, ততক্ষণ যে সব পদার্থ সৎরূপে প্রতীয়মান হয়, সেগুলি হলো ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। এই কারণে অদ্বৈতমতে জগতের ব্যবহারিক সত্তা স্বীকার করা হয়েছে। জগতের যেহেতু ব্যবহারিক সত্তা আছে, জগতের কারণ মায়াও ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি সমান হয় তাহলে কার্যটি হয় কারণের পরিণাম। সুতরাং, জগৎ হলো মায়ার পরিণাম। কিন্তু উপাদান কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি ভিন্ন হয় তাহলে কার্যটি হলো কারণের বিবর্ত। সুতরাং, জগৎ হলো ব্রহ্মের বিবর্ত।
বস্তুত মায়ার আশ্রয়রূপে সগুণ ব্রহ্ম জগতের অপরিবর্তনশীল উপাদান কারণ বা বিবর্ত উপাদান কারণ। কারণ, যদি ব্রহ্মকে উপাদান কারণ বলে গণ্য করা না হয়, তাহলে কয়েকটি শ্রুতিবাক্যের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। যেমন ‘এক বিজ্ঞানেন সর্ববিজ্ঞানম্’ বা ‘এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়’, ‘ব্রহ্মৈবেদম্ অসর্বম্’ ‘আত্মৈবেদম্ অসর্বম্’- এই বাক্যগুলিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। আবার মায়ারূপ উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিফলিত হলে তাঁর ঈক্ষণবৃত্তির উদয় হয়। ঈক্ষণবৃত্তি হলো জগৎ সৃষ্টির সংকল্প। এই কারণে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মকে জগতের নিমিত্ত কারণও বলেছেন।
তাঁর মতে ব্রহ্মকে উপাদান ও নিমিত্ত- এই দ্বিবিধ কারণ বলা উচিত। কারণ তাহলে শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের বিরোধ হয় না। শ্রুতিতে এরকম প্রতিজ্ঞা আছে- এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা হয়েছে- ঘট প্রভৃতির উপাদান কারণস্বরূপ এক মৃৎপিণ্ডকে জানলে যেমন সমস্ত মৃন্ময় বস্তুরই জ্ঞান হয় ইত্যাদি। উপাদান কারণের জ্ঞান না থাকলে এক বিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান হয় না। অতএব জগতের অন্য অধিষ্ঠাতা না থাকায় আত্মাই অধিষ্ঠাতা বা নিমিত্তকারণ এবং অন্য উপাদান না থাকায় আত্মাই জগতের উপাদান কারণ।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : অদ্বৈতমতে জগৎ] [*] [পরের পর্ব : অদ্বৈতমতে জীব বা আত্মা]
…
No comments:
Post a Comment