Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০৫ : রামানুজের মতে জীবের বন্ধন ও মোক্ষ



|বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০৫ : রামানুজের মতে জীবের বন্ধন ও মোক্ষ|
রণদীপম বসু

৫.০ : রামানুজের মতে জীবের বন্ধন ও মোক্ষ


জীবের বন্ধন :
রামানুজের মতে কর্ম ও অবিদ্যার দ্বারা জীবাত্মা বদ্ধ হয়। জীবাত্মার সঙ্গে কর্ম ও অবিদ্যার যোগ অনাদি যেহেতু সংসার অনাদি। কৃতকর্মের জন্যই আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংসারদশা প্রাপ্ত হয়। এই অবস্থাই হলো আত্মার বন্ধন বা বদ্ধাবস্থা। এই যোগ বা সংশ্লিষ্টতার ফলে জীবের ‘অহং’, ‘মম’ প্রভৃতি বোধ জন্মায়। এ অবস্থায় জীবের স্বরূপ আচ্ছাদিত হয়। বদ্ধজীব তখন ‘অহংবোধ’ ও ‘ক্ষুদ্র-আমিত্বের’ বশবর্তী হয়। দেহ, ইন্দ্রিয়, মনের বিভিন্ন অবস্থা থেকে জীবাত্মা নিজেকে পৃথক করতে পারে না। আর পৃথক করতে না পারার জন্যই জীবাত্মা অবিদ্যার বশীভূত হয়। এই অবিদ্যাজনিত জীবাত্মার জ্ঞান হলো ‘আমি স্থূল’, ‘আমি বধির’, ‘আমি দুঃখিত’ ইত্যাদি।

‘মমত্ববোধ’ও ঐ অবিদ্যা থেকে উৎসারিত হয়। যে বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তি জীবের দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সুখ উৎপাদন করে সেই বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তি জীবাত্মার প্রিয় হয়। এই অবিদ্যাজনিত মমত্ববোধের দৃষ্টান্ত হলো- ‘আমার স্ত্রী’, ‘আমার পুত্র’, ‘আমার বাড়ি’ ইত্যাদি। বস্তুত ‘আমার’ সঙ্গে ঐ বিষয়গুলির কোন যোগ নেই। জীব কর্মের বন্ধনে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে ঐরূপ অবিদ্যার আশ্রয় হয়। তাই প্রিয় বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তির বিয়োগে এবং অপ্রিয় বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তির সংযোগে জীবাত্মা দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। এ প্রেক্ষিতে রামানুজের শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-


‘আমোক্ষাৎ জীবস্য নাম-রূপপরিস্বঙ্গাদেব হি স্বব্যতিরিক্তবিষয়জ্ঞানোদয়ঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।
অর্থাৎ :
বস্তুতই মোক্ষ না হওয়া পর্যন্ত কেবল নাম ও রূপের সাথে সম্বন্ধবশতই জীবের স্ব-ভিন্ন বস্তু-বিষয়ে জ্ঞান সমুৎপন্ন হয়ে থাকে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।

রামানুজ বলেন যে, আত্মা প্রকৃতপক্ষে সর্বজ্ঞ, কর্তা ও ভোক্তা। কিন্তু দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আত্মা বদ্ধ হয়। সকাম কর্মের ফলভোগ করার জন্যই আত্মা দেহের মধ্যে আবদ্ধ হয়। দেহ ও আত্মার এই একত্রীকরণের নাম ‘অহঙ্কার’। এই অহঙ্কারের জন্যই জীবাত্মা পার্থিব সুখের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সকাম কর্ম সম্পাদন করে। আর তার ফলেই জীবাত্মাকে বারবার এই সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয়। রামানুজের মতে এই জন্মই হলো আত্মার ‘বন্ধন’ বা বদ্ধাবস্থা।

মোক্ষ :
জীবের বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তিই হলো মোক্ষ। মোক্ষে জীবের স্বরূপ বিকশিত হয়। রামানুজের মতে মোক্ষ হলো জীবত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। জীব স্বভাবতই জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা। বদ্ধাবস্থায় জীবের জ্ঞান, কর্ম ও ভোগ সীমিত হয়ে পড়ে। মোক্ষাবস্থায় জীব সর্বজ্ঞ, সর্বময়কর্তা ও পূর্ণ আনন্দময় ভোক্তা। সুতরাং জীবত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ হলো জীবের স্বাভাবিক গুণের চরম উৎকর্ষ লাভ।

জীবাত্মা মুক্তিলাভ করলে ব্রহ্ম-সাদৃশ্য লাভ করে অর্থাৎ ঈশ্বরের মতো হয়। তাই মুক্তজীব ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের ন্যায় সচ্চিদানন্দময় হয়। কিন্তু মোক্ষলাভের পর জীবের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হলেও তার জীবত্ব থাকে। তাই রামানুজের মতে মুক্তজীব ব্রহ্মের সদৃশ, কিন্তু ব্রহ্ম-স্বরূপ বা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন নয়। মুক্তজীব ঈশ্বর-সদৃশ হলেও প্রধানতঃ দুটি বিষয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে তার পার্থক্য থাকে। ব্রহ্মের সঙ্গে মুক্তজীবের এই দুটি প্রধান পার্থক্য হলো- (১) মুক্তজীব অণুপরিমাণ, কিন্তু ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বিভুপরিমাণ এবং (২) জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মা বা ঈশ্বর এই জগতের কারণ এবং চিৎ ও অচিৎ-এর নিয়ন্তা, কিন্তু মুক্তজীব এই জগতের কারণ নয় এবং চিৎ ও অচিৎ-এর নিয়ন্তাও নয়। মুক্তজীব ব্রহ্মাশ্রিত, ব্রহ্মশাসিত, ব্রহ্মসেবক, সচ্চিদানন্দময়, কিন্তু ব্রহ্মভিন্ন।

রামানুজের মতে জীবের মুক্তি হলো বিদেহমুক্তি। ভারতীয় দর্শনে সাধারণত দুইপ্রকার মুক্তির কথা বলা হয়- জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। জীবিত অবস্থায় যে মুক্তি, তাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। অপরদিকে দেহের বিনাশের পর যে মুক্তি, তাকে বলা হয় বিদেহমুক্তি। বৌদ্ধ ও অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় যথাক্রমে বুদ্ধ ও শঙ্করাচার্যকে জীবন্মুক্ত পুরুষ বলে মনে করেন। জীবন্মুক্ত পুরুষ লোকহিতার্থে নিষ্কাম কর্মে ব্রতী হন। রামানুজের মতে জীবন্মুক্তি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাঁর মতে যতদিন পর্যন্ত জীব দেহধারণ করে, ততদিন পর্যন্ত জীব বদ্ধ। এই অবস্থায় তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, জরা, বেদনা প্রভৃতির অধীন দেহাদি যতক্ষণ জীবে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে, ততক্ষণ জীব এই সকল অনুভূতি থেকে রক্ষা পেতে পারে না। তাই রামানুজ জীবন্মুক্তিতে বিশ্বাসী নন।

রামানুজের মতে দেহের সঙ্গে আত্মার বিচ্ছেদ হলে মুক্তিলাভ হয়। এই মুক্তিকে সাধারণত বিদেহ মুক্তি বলা হয়। কিন্তু তাঁর মতে মুক্ত জীবেরও দেহ থাকে। সেই দেহ শুদ্ধ সত্ত্বের দ্বারা গঠিত। মোক্ষলাভের পর মুক্ত আত্মা ঐ দেহ ধারণ করে বৈকুণ্ঠে নারায়ণের অর্থাৎ ঈশ্বরের আপন ধামে গমন করে। অতএব রামানুজের মতে জীব কখনোই সম্পূর্ণ বিদেহ বা দেহ-বিযুক্ত হয় না। বৈকুণ্ঠে মুক্ত জীবাত্মা এবং নিত্য-আত্মা পূর্ণ আনন্দ ও শান্তিতে বাস করে। রামানুজ বলেন- মোক্ষ হলো এক বিশুদ্ধ আনন্দের অবস্থা। মোক্ষ অবস্থায় জীব ব্রহ্মসদৃশ হয়, কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায় না। তাই রামানুজ ‘সামীপ্য মুক্তি’তে বিশ্বাসী।

মুক্তির উপায় :
রামানুজ মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়ের উপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। মুক্তির উপায় প্রসঙ্গে রামানুজ বলেছেন, মুক্তি লাভের ইচ্ছাই মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। যে সকল জীব সকাম কর্ম ও তজ্জনিত ভোগে লিপ্ত, মুক্তিলাভের কোনরূপ ইচ্ছা যাদের নেই (বুভুক্ষু), তাদের মুক্তি সম্ভব নয়। সংসার থেকে মুক্তিলাভ করতে হলে জীবাত্মাকে সর্বপ্রথম কর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। মুক্তিকামী জীব (মুমুক্ষু) নিষ্কাম কর্ম প্রতিপালনের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধি করেন এবং জ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে মোক্ষলাভে প্রবৃত্ত হন। রামানুজের মতে বেদ-নির্দেশিত কর্ম এবং যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা আত্মার বন্ধনমুক্তি হয়। বেদবিহিত কর্মের যথাযথ অনুষ্ঠান করলে জীবাত্মা কর্মজনিত মালিন্য দূর করতে পারে। তবে ঐ কর্মের অনুষ্ঠান নিষ্কামভাবে করতে হবে। বস্তুত গীতার নিষ্কাম কর্মবাদকে রামানুজ মোক্ষলাভের সহায়ক উপায়রূপে গ্রহণ করেছেন।

মুমুক্ষু জীব শাস্ত্রোপদিষ্ট নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম ছাড়াও সপ্তবিধ নিষ্কাম কর্ম করে থাকেন। এই সাতরকম নিষ্কাম কর্ম হলো- বিবেক, বিমোক, অভ্যাস, ক্রিয়া, কল্যাণ, অনবসাদ ও অনুর্ধর্ষ।
বিবেক হলো অশুদ্ধ পানাহার বর্জন। বিমোক হচ্ছে আসক্তিহীনতা। অভ্যাস মানে লক্ষ্যসাধনের জন্য বারবার অনুশীলন। ক্রিয়া হলো যজ্ঞানুষ্ঠান। কল্যাণ অর্থ দয়া, দান, অহিংসা, নির্লোভতা। অনবসাদ হলো মানসিক দৈন্য ও দুর্বলতা বর্জন। এবং অনুর্ধর্ষ অর্থ হলো উগ্র আত্মবিশ্বাস বা দাম্ভিকতার অভাব।

কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয়। ভক্তিবাদের সমর্থক রামানুজ কেবলমাত্র জ্ঞানকেও মুক্তিলাভের উপায় বলে মনে করেননি। তাঁর মতে মোক্ষের জন্য জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি বা ধ্যানও প্রয়োজন। সম্যগ্জ্ঞান লাভের পর মুমুক্ষু ধ্যান বা উপাসনায় রত হন এবং উপাসনায় তিনি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেন। ব্রহ্মোপলব্ধির জন্য অবশ্য মুমুক্ষুর উপাসনা ছাড়াও ঈশ্বরের করুণা প্রয়োজন। ঈশ্বরের করুণা ছাড়া কোন জীবের পক্ষেই মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। একমাত্র ভগবৎ কৃপাই জীবকে মুক্তি দিতে সক্ষম। ভক্তি ও উপাসনার দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হলে ভগবানের কৃপালাভ সম্ভব। জ্ঞান ও কর্ম হলো এই ভক্তির সহকারি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মোক্ষলাভের ইচ্ছা, জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয়েই জীবের মুক্তি বা ব্রহ্মসাদৃশ্য লাভ হয়।

মোক্ষলাভের জন্য রামানুজ যে পথ নির্দেশ করেছেন তা হলো, যাঁরা নিষ্কাম কর্মযোগে সাফল্যলাভ করেছেন, কেবলমাত্র তাঁরাই জ্ঞানযোগের আশ্রয় নেবার উপযুক্ত। সমর্থ গুরুর কাছে আত্মার প্রকৃত তত্ত্ব শ্রবণ করে আত্মার স্বরূপ ধ্যান করা জ্ঞানযোগের অন্তর্গত। ঐ ধ্যানের উদ্দেশ্য হলো দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন থেকে আত্মা যে পৃথক ও স্বতন্ত্র, তা উপলব্ধি করা। জ্ঞানযোগে সাফল্য লাভ করলেও ঈশ্বরের সঙ্গে জীবাত্মার কী সম্পর্ক, তা উপলব্ধি করার জন্য ধ্যানের অনুশীলন অব্যাহত রাখা কর্তব্য।
কিন্তু যাঁরা জ্ঞানযোগে সাফল্যলাভ করেছেন কেবলমাত্র তাঁরাই ভক্তিযোগের আশ্রয় নেবার যোগ্য। ভক্তিযোগের ভিত্তি হলো সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রতি যুক্তিসিদ্ধ আস্থা ও বিশ্বাস। ‘ভক্তি’ শব্দের দ্বারা রামানুজ উপনিষদগুলিতে বিবৃত উপাসনা বা ধ্যানকে বুঝিয়েছেন। অবশ্য তাঁর মতে ভক্তি হলো উপনিষদে কথিত ধ্যানের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা বা প্রেমের মিশ্রণ। জীব ঈশ্বরের উপর তার সম্পূর্ণ নির্ভরতা বা শেষত্ব বোধ করে তাঁকে বিশ্বের নিয়ন্তারূপে অনুভব করে তাঁর প্রতি প্রেমে আপ্লুত হয়ে তাঁর স্বরূপ ধ্যান করবে। সুতরাং রামানুজের মতে ভক্তি হলো ঈশ্বরকে পুরুষোত্তমরূপে গণ্য করে প্রেমের সঙ্গে তাঁর স্বরূপ ধ্যান করা। এই ধ্যানে সাফল্য লাভ করলে জীব ঐশী দৃষ্টির অধিকারী হয়।

তবে রামানুজ এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন যে, ভক্তিযোগ আশ্রয় করে সাফল্য লাভ করার পরও বেদ-বিহিত নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান অবশ্য কর্তব্য। কারণ নিত্যকর্মগুলি না করলে জীব আবার পাপগ্রস্ত হবে। রামানুজের মতে কর্মের মাধ্যমেই ভক্তি উৎসারিত হয় এবং ঐ ভক্তি ঈশ্বরের অপরোক্ষ উপলব্ধির কারণ হয়। তবে রামানুজ মুক্তির সহায়ক কারণরূপে কেবল বেদবিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব দেননি। তিনি বৈষ্ণব শাস্ত্র-নির্দেশিত পূজা-উপাসনা-সমন্বিত ক্রিয়াযোগকেও প্রাধান্য দিয়েছেন।

এখানে উল্লেখ্য, রামানুজ মোক্ষলাভের জন্য যে যোগগুলির কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলিতে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনটি উচ্চশ্রেণীর মানুষের অধিকার আছে। নিম্নবর্ণের মানুষের এগুলিতে অধিকার নেই, যেহেতু নিম্নবর্ণের মানুষের বেদবিহিত আচরণের অধিকার নেই। যেমন, শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘ন শূদ্রস্যাধিকারঃ সম্ভবতি; কুতঃ? সামর্থ্যাভাবাৎ; ন হি ব্রহ্মস্বরূপ-তদুপাসনপ্রকারম্ অজানতঃ তদঙ্গভূত বেদানুবচন-যজ্ঞাদিষ্বনধিকৃতস্য উপাসনোপসংহারসামর্থ্যং সম্ভবতি; অসমর্থস্য চার্থিত্বসদ্ভাবেহপি অধিকারো ন সম্ভবতি; অসামর্থ্যং চ বেদাধ্যয়নাভাবাৎ। যথৈব হি ত্রৈবর্ণিকবিষয় অধ্যয়ন বিধিসিদ্ধ-স্বাধ্যায়সম্পাদ্য-জ্ঞানলাভেন কর্ম্মবিধয়ো জ্ঞানতদুপায়াদীন্ অপরান্ ন স্বীকুর্ব্বন্তি, তথা ব্রহ্মোপাসনবিধয়োহপি। অতোহধ্যয়নবিধিসিদ্ধ-স্বাধায়াধিগত-জ্ঞানস্যৈব ব্রহ্মোপাসনোপায়ত্বাৎ শূদ্রস্য ব্রহ্মোপাসনসামর্থ্যাসম্ভবঃ। ইতিহাস-পুরাণে অপি বেদোপবৃংহণং কুর্ব্বতী এব উপায়ভাবমনুভবতঃ, ন স্বাতন্ত্র্যেণ; শূদ্রস্যেতিহাস-পুরাণ শ্রবণানুজ্ঞানং পাপক্ষয়াদিফলার্থম্; নোপাসনার্থম্ ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)।
অর্থাৎ :
(ব্রহ্মবিদ্যায়) শূদ্রের অধিকার-সম্ভব হয় না; কারণ? যেহেতু তার সামর্থ নাই। কেননা, যে লোক ব্রহ্মের স্বরূপ এবং তাঁর উপাসনা-প্রণালী জানে না; সুতরাং তারই অঙ্গস্বরূপ বেদানুবচন (বেদপাঠ) ও যজ্ঞাদি কার্যেও অনধিকৃত তার পক্ষে কখনোই উপাসনার অনুকুল সামর্থ সম্ভবপর হয় না। বেদাধ্যয়নের অভাবই তার সামর্থাভাবের কারণ। ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের সম্বন্ধে বেদাধ্যয়ন বিহিত থাকায় তার-সম্পাদ্য জ্ঞানেও অধিকার প্রাপ্ত হওয়া যায়; এজন্য, কর্মবিধি সমূহ যেরূপ জ্ঞান ও সে-উপযোগী অপরাপর সাধনের অপেক্ষা করে না, ব্রহ্মোপাসনা বিধিগুলিও সেরকম। অতএব অধ্যয়নবিধিলব্ধ বেদাধ্যয়নজনিত জ্ঞানই যখন ব্রহ্মোপাসনার প্রধান উপায়, তখন সেই বৈদিক জ্ঞান না থাকায় শূদ্রের ব্রহ্মোপাসনা-সামর্থ কখনো সম্ভবপর নয়। আর ইতিহাস এবং পুরাণশাস্ত্রও বেদার্থের পরিপোষণ করে বলেই উপায়তা লাভ করে থাকে, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে নয়। শূদ্রের পক্ষে যে ইতিহাস ও পুরাণপাঠে অনুমতি প্রদত্ত হয়েছে, তাও কেবল পাপক্ষয়াদি ফলসিদ্ধির জন্যই, কিন্তু উপাসনার্থে নয় (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)।

বিভিন্ন শাস্ত্রেই শূদ্রের উপনয়নাদি সংস্কার-অযোগ্যতা তথা যজ্ঞকর্মে অধিকারহীনতা প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে, যেমন-

‘ন শূদ্রে পাতকং কিঞ্চিন্ন চ সংস্কারমর্হতি।’- (মনুসংহিতা-১০/১২৬)
‘চতুর্থো বর্ণ একজাতি র্ন চ সংস্কারমর্হতি।’- (গৌতম-সংহিতা-১০/৯)
অর্থাৎ :
শূদ্রে কোন প্রকার পাতক নাই এবং শূদ্র কোনপ্রকার সংস্কারার্হও নয়, কোনও ধর্মে শূদ্রের নিয়ত অধিকার নেই (মনুসংহিতা-১০/১২৬)।
চতুর্থ বর্ণ (শূত্র) একজাতি অর্থাৎ উপনয়নসংস্কার-জনিত দ্বিজত্বধর্ম-রহিত, এবং কোনও সংস্কারার্হও নয় (গৌতম-সংহিতা-১০/৯)।

এইজন্য নিম্নবর্ণের জীবাত্মাদের মুক্তির জন্য রামানুজ দুটি উপায় অবলম্বন করতে বলেছেন। এই উপায় দুটি হলো- প্রপত্তি ও শরণাগতি।
প্রপত্তির অর্থ হলো ঈশ্বরকে একমাত্র আশ্রয় ও অবলম্বনরূপে গণ্য করা। অপরপক্ষে শরণাগতি অর্থ হলো ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। প্রপত্তি ও শরণাগতিকে ভিন্নরূপে যথাক্রমে মর্কটন্যায় ও মার্জারন্যায়ও বলা হয়। মর্কটন্যায়ে মর্কট বা বানর সন্তান যেমন নিজ প্রচেষ্টায় মাতৃক্রোড়ে নিজেকে নিবেদন করে, তেমনি জীব নিজেকে পরমেশ্বরের কাছে নিবেদন করে। আর মার্জারন্যায়ে মার্জার বা বিড়ালশাবক যেমন আত্মপ্রচেষ্টাহীনভাবে মাতার নিকট আত্মনিবেদন করে, জীবও তেমনি পরমেশ্বরের কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে।

অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, রামানুজের মতে কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয়েই যদিও জীবের মুক্তি বা ব্রহ্মসাদৃশ্য লাভ হয়, তবুও শুধুমাত্র ঈশ্বরে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ বা ভক্তির মাধ্যমেও জীবের মুক্তিলাভ হতে পারে। তবে বিশিষ্টাদ্বৈত দার্শনিকরা প্রপত্তি ও শরণাগতিকে ভক্তির থেকে আরো কার্যকরি উপায়রূপে গণ্য করেন। কারণ ভক্তিযোগের জন্য শিক্ষণ ও অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রপত্তি ও শরণাগতির জন্য কোন শিক্ষা বা অনুশীলনের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া রামানুজ ভক্তিযোগের চূড়ান্ত পরিণতির জন্য প্রপত্তি ও শরণাগতিকে অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে করতেন।
বস্তুত রামানুজ যেহেতু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্ণের মানষের মুক্তির জন্য প্রপত্তি ও শরণাগতির সুগম পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাই তাঁর দর্শন ও ধর্মমত জনপ্রিয় হয়েছিলো।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : রামানুজের মতে জীবের ধারণা] [*] [পরের পর্ব : অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের পার্থক্য]

No comments: