Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০৪ : রামানুজের মতে জীবের ধারণা



|বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০৪ : রামানুজের মতে জীবের ধারণা|
রণদীপম বসু

৪.০ : রামানুজের মতে জীবের ধারণা
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবর্তক রামানুজ তাঁর মতবাদে তিনটি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এই তিনটি তত্ত্ব হলো- ঈশ্বর, চিৎ এবং অচিৎ। রামানুজের মতে এই তিনটি তত্ত্বই সৎ বা পদার্থ। চিৎ হলো আত্মা বা জীবাত্মা। তাঁর মতে দেহবিশিষ্ট আত্মাই জীব। জীবের আত্মা ব্রহ্মের চিৎ-অংশ এবং জীবের দেহ ব্রহ্মের অচিৎ-অংশজাত। জড়দেহ অনিত্য, কিন্তু চিৎ আত্মা নিত্য। তবে আত্মা নিত্য হলেও এই মতে আত্মা অসীম নয়। আত্মা নিত্য, সসীম ও সংখ্যায় বহু। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপ। ন্যায়মতে চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণ বা বহিরাগত ধর্ম। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপও নয়, আবার চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণও নয়, চৈতন্য আত্মার নিত্যগুণ।

আচার্য রামানুজকৃত মহর্ষি বাদরায়ণের বেদান্তসূত্র বা ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যায় বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ভাষ্যগ্রন্থ ‘শ্রীভাষ্যে’ জীব বা আত্মার স্বরূপ ও লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। এগুলোই জীব সম্বন্ধে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ধারণা প্রকাশ করে। যেমন-

জীবাত্মা নিত্য, সসীম ও স্বতন্ত্র :
রামানুজের মতে জীবাত্মা ঈশ্বরের একটি অংশ বা প্রকাররূপে তাঁর শরীরের উপাদানস্বরূপ। তবে প্রকার বা অংশ হলেও জীবাত্মা একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য এবং নিত্য। আত্মার সৃষ্টি এবং বিনাশ নেই। প্রলয়ের সময় জীবাত্মায় যে কর্ম নিহিত থাকে, সেই কর্ম অনুসারে পরবর্তী জন্মে সে অন্য শরীর পরিগ্রহ করে। প্রলয় ও সৃষ্টির মধ্যবর্তী কালে জীবাত্মা বিভিন্ন শরীর ধারণ করে পূর্বজন্মে কৃত কর্মের ফল ভোগ করে থাকে। রামানুজের মতে জীবাত্মার সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক অনাদি। একমাত্র জীবাত্মা মোক্ষলাভ করলেই কর্ম তার জ্যোতিকে ম্লান ও আচ্ছন্ন করতে পারে না। কারণ মোক্ষলাভ করলে আত্মা পৃথিবীতে অবতরণ করে শরীর গ্রহণ করে না।


রামানুজ বলেছেন যে, জীবাত্মা যদিও নিত্য ও সত্য, তবুও সীমিত। কারণ জীবাত্মা ঈশ্বরের অংশ বা প্রকার। সুতরাং আত্মা অণুপরিমাণ। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-


‘নায়ং সর্ব্বগতঃ, অপিতু অণুরেবায়মাত্মা; কুতঃ? উৎক্রান্তিগত্যাগতীনাং শ্রুতেঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)
অর্থাৎ : এই জীবাত্মা সর্বগত অর্থাৎ সর্বব্যাপী নয়; বরং এই আত্মা অণুপরিমাণই (সূক্ষ্মই) বটে; কারণ? যেহেতু তার উৎক্রান্তি, গতি ও আগতি (আগমন) বিষয়ে শ্রুতি রয়েছে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।

তবে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আত্মাকে জানা যায় না। জ্ঞানই আত্মাকে প্রকাশ করে। আত্মা সকলপ্রকার জ্ঞানের সাক্ষী। যদিও আত্মা অণুপরিমাণ, কিন্তু আত্মার জ্ঞান বিভুপরিমাণ। এই কারণে জ্ঞান আত্মার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। জ্ঞান একাধারে আত্মার ধর্ম ও স্বরূপ। অতএব, আত্মা প্রত্যক্ষগোচর নয় এবং তার কোন পরিবর্তনও হয় না। পৃথিবীতে অবস্থানের সময় দেহযুক্ত আত্মা অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। তবে ঐ যন্ত্রণা আত্মার স্বরূপকে স্পর্শ করতে পারে না।

রামানুজের মতে আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। প্রাণবায়ু ও জ্ঞান থেকেও আত্মা পৃথক। সংসারে অবস্থানকালে আত্মা অবিদ্যা ও কর্মের বশীভূত হয়ে ভুলবশত নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনরূপে গণ্য করে। যেমন, শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন-

‘সংসার-বন্ধনাদ্বিমুক্তা এব হি বিধূতপুণ্য-পাপা নিরঞ্জনা নাম-রূপাভ্যাং বিনির্মুক্তাশ্চ। পুণ্য-পাপনিবন্ধন অচিৎসংসর্গপ্রযুক্ত-নামরূপভাক্ত্বমেব হি সংসারঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২)
অর্থাৎ :
যারা সংসার-বন্ধন থেকে বিমুক্ত হন, তারাই পুণ্য-পাপ পরিত্যাগপূর্বক নিরঞ্জন হন, এবং নাম-রূপ থেকেও বিমুক্ত হন। পুণ্য-পাপ নিবন্ধন যে জড়পদার্থের সাথে সংসর্গ, অর্থাৎ ‘ইহা আমার’ এসব অভিমান, সেই জড়সংসর্গ বশত যে নাম ও রূপে আসক্তি, তাই জীবের সংসার, (তার অতিরিক্ত নয়) (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২)।

দেহ-যুক্ত আত্মার এইরকম জ্ঞান হলো ‘আমি রোগার্ত’, ‘আমি শোকার্ত’, ‘আমি বধির’ ইত্যাদি। এখানে ‘আমি’ শব্দটি আত্মাকে নির্দেশ করে। রোগ শরীরের একটি অবস্থা, শোক একটি মানসিক অবস্থা এবং বধিরতা একটি ইন্দ্রিয়ের বৈকল্য। সংসারে অবস্থানের সময় আত্মা নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনরূপে গণ্য করে। তাই দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের বৈকল্য তাকে দুঃখ দেয়। রামানুজ বলেন- অবিদ্যা ও কর্মের প্রভাবেই আত্মার এরকম ভ্রান্ত অভেদ বোধ জন্মায়।

জীবাত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা :
জ্ঞাতারূপেই আত্মার পরিচয়। শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন-

‘জ্ঞ এব- অয়মাত্মা জ্ঞাতৃত্বস্বরূপ এব, ন জ্ঞানমাত্রম্, নাপি জড়স্বরূপঃ; কুতঃ? অতএব- শ্রুতেরেবেত্যর্থঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)
অর্থাৎ : এই আত্মা (জীব) নিশ্চয়ই জ্ঞ, অর্থাৎ স্বরূপত জ্ঞাতাই বটে, কিন্তু কেবলই জ্ঞানস্বরূপ নয়, এবং জড়স্বরূপও নয়। কারণ? শ্রুতিপ্রমাণই কারণ (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)।

তাই জ্ঞান কেবলমাত্র আত্মার গুণ নয়, স্বরূপও বটে। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ আত্মাকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তারূপে গণ্য করেছেন। তাঁর মতে ক্রিয়া ও ভোগ হলো আত্মার দুটি পৃথক জ্ঞানের অবস্থা। জ্ঞান আত্মার সারভূত। আত্মা একাধারে স্বয়ং ভাস্বর দ্রব্য এবং আত্মসচেতন বিষয়ী বা জ্ঞানের কর্তা। আত্মাতে যে ধর্মভূতজ্ঞান থাকে, তা প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। আত্মা তার জ্ঞানের মাধ্যমেই বিষয়সমূহে জানে। ঐ জ্ঞান নিজেকে এবং আত্মার জ্ঞেয় বিষয়গুলিকে প্রকাশ করে। আত্মার জন্যই জ্ঞানের অস্তিত্ব। জ্ঞান যদিও নিজেকে ও তার বিষয়গুলিকে প্রকাশ করে, তবুও ঐ দুটির কোনটিকেই জ্ঞান জানতে পারে না। একমাত্র আত্মাই জ্ঞান ও তার বিষয়কে জানতে পারে অর্থাৎ জ্ঞাতা। সুতরাং জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার সারভূত ধর্ম, আগন্তুক বা বহিরাগত ধর্ম নয়। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘তদ্গুণসারত্বাৎ- বিজ্ঞানগুণসারত্বাৎ আত্মনো বিজ্ঞানমিতি ব্যপদেশঃ। বিজ্ঞানমেবাস্য সারভূতো গুণঃ, যথা প্রাজ্ঞস্যানন্দঃ সারভূতো গুণঃ, ইতি প্রাজ্ঞ আনন্দ-শব্দেন ব্যপদিশ্যতে’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-৩/২/২৯)।
অর্থাৎ :
তদ্গুণসারত্ব অর্থ- যেহেতু বিজ্ঞানই আত্মার সারভূত গুণ, সেহেতু ‘বিজ্ঞান’ শব্দে আত্মার ব্যবহার হয়ে থাকে। বস্তুত বিজ্ঞানই তার সারভূত গুণ; আনন্দ যেমন প্রাজ্ঞ পরমাত্মার সারভূত গুণ বলে ঐ আনন্দ-শব্দে প্রাজ্ঞ আত্মা অভিহিত হয়ে থাকেন (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-৩/২/২৯)।

রামানুজের মতে আত্মা হলো জ্ঞানের আধার। দ্রব্যরূপ আত্মাতে জ্ঞান অবিচ্ছেদ্য ধর্মরূপে অবস্থান করে। এমনকি সুষুপ্তিতে এবং মোক্ষলাভ করার পরেও আত্মায় জ্ঞান থাকে। কিন্তু সুষুপ্তিতে জ্ঞান প্রকাশিত হয় না, কারণ তখন কোন বিষয় থাকে না। জ্ঞান অনন্ত ও সর্বব্যাপক। সংসারে বদ্ধ অবস্থায় আত্মার জ্ঞান কর্মের দ্বারা আচ্ছন্ন ও সীমিত থাকে। আত্মা মোক্ষলাভ করলে কর্ম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং কর্মজনিত বাধা অপসারিত হয় বলে আত্মার জ্ঞান সর্বব্যাপক হয়ে যায়। তাই মুক্ত অবস্থায় আত্মা সর্বজ্ঞ হয়। কেননা রামানুজের মতে আত্মা অণুপরিমাণ হলেও তার জ্ঞান অনন্ত।
আবার রামানুজ বলেছেন যে, আনন্দও আত্মার সারভূত অর্থাৎ আত্মা আনন্দরূপ। সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণা আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। মোক্ষলাভ করলে আত্মা অনন্ত জ্ঞান ও নিত্য আনন্দের অধিকারী হয়।

এই মতে আত্মা হলো বিশুদ্ধ অহং বা আত্মসচেতন অহং। সংসারে বদ্ধ অবস্থায় যে আমি বা অহংবোধ থাকে, তা ব্যবহারিক। কর্ম ও অবিদ্যার প্রভাবে সংসারে বদ্ধ আত্মা নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে এক ও অভিন্ন বোধ করে। এই ব্যবহারিক আমি-বোধ বা অহং বোধকে অহঙ্কার বলা হয়। তাই রামানুজের মতে জীব কর্তা ও ভোক্তা। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘বাগাদিকরণসম্পন্নোহপ্যাত্মা যদা ইচ্ছতি, তদা করোতি, যদা তু নেচ্ছতি, তদা ন করোতি।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।
অর্থাৎ : আত্মা বাগাদি ইন্দ্রিয়সম্পন্ন থেকেও, যখন ইচ্ছা করে তখনই কার্য করে, আবার যখন ইচ্ছা না করে, তখন করে না (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।
তবে এটাও ঠিক যে-

‘পরমাত্মানুমতিমন্তরেণাস্য প্রবৃত্তির্নোপপদ্যত ইত্যর্থঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪১)
অর্থাৎ : পরমাত্মার অনুমতি বা অনুকুল ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোন কার্যেই জীবের প্রবৃত্তি সম্ভব হয় না (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪১)।

রামানুজের মতে জীব কর্তাই। জীব অকর্তা হলে জীবের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবার জীব সংসার-দশায় নিজ নিজ কর্মানুসারে ফলভোগ করে থাকে। সুতরাং জীব ভোক্তা। রামানুজের মতে জ্ঞাতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব আত্মার স্বাভাবিক গুণ। তাই বদ্ধজীবের ন্যায় মুক্তজীবও জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা।

জীবাত্মা ঈশ্বরাধীন ও বহু :
রামানুজের মতে আত্মা একটি বাস্তব সত্তা হলেও এর সত্যতা ও বাস্তবতা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। আত্মা সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের অধীন। ঈশ্বর আত্মার আত্মা। আর আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা ঈশ্বরের শরীর। ঈশ্বর জীবাত্মার নিয়ন্তা। রামানুজ বলেন, জীবাত্মা ঈশ্বরেরই প্রকার বা অংশ এবং ঈশ্বর প্রকারী বা অংশী। আবার জীবাত্মা হলো শরীর এবং ঈশ্বর শরীরী। তবে জীবাত্মা ঈশ্বরের অধীন ও ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হলেও তার ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে।

বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জীবাত্মা এক নয়, কিন্তু বহু। তবে সকল জীবাত্মার প্রকৃতি ও স্বরূপ একই। যদিও রামানুজ অসংখ্য জীবাত্মা স্বীকার করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবাত্মাগুলির গুণগত বা প্রকৃতিগত ঐক্যও স্বীকার করেছেন। রামানুজের মতে জীবাত্মা তিনপ্রকার- নিত্য-মুক্ত, মুক্ত ও বদ্ধ আত্মা।

প্রথমপ্রকার নিত্য-মুক্ত আত্মা কখনোই বদ্ধ হয়নি। কারণ তাঁরা কর্ম ও প্রকৃতির অধীন কখনও হননি এবং হবেনও না। সকল প্রকার কর্ম-বন্ধনমুক্ত বৈকুণ্ঠ-নিবাসী নিত্য-মুক্ত আত্মারা নিরন্তর ঈশ্বরের সেবা করেন। শেষনাগ, গড়ুর প্রভৃতি এরূপ নিত্য-মুক্ত আত্মার দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয়প্রকার আত্মা হলো মুক্ত-আত্মা। যাঁরা একসময় বদ্ধ ছিলেন, কিন্তু জ্ঞান, কর্ম এবং ভক্তির দ্বারা মোক্ষলাভ করেছেন, তাঁরা হলেন মুক্ত-আত্মা। অর্থাৎ, মুক্তজীব জ্ঞান ও ভক্তির বলে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত।
তৃতীয়প্রকার আত্মা হলো বদ্ধ-আত্মা। বদ্ধ আত্মাগুলি কর্ম ও অবিদ্যাবশত বারবার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। কর্মবন্ধনে আবদ্ধ থেকে বদ্ধজীব সংসারচক্রে আবর্তিত হতে থাকে। বদ্ধজীব চারধরনের হয়- অতিমানব, মানব, পশু ও স্থাবর। এবং রামানুজের মতে বদ্ধজীব জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, মূর্ছা ও মরণ- এই পাঁচটি অবস্থা ভোগ করে। সুষুপ্তি আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য হলো মৃত্যু মানে জীবাত্মার দেহাশ্রয় ত্যাগ, অন্যদিকে সুষুপ্তি হলো দেহত্যাগ না করেই জীবাত্মার স্বরূপাবস্থায় অবস্থান, যেখান থেকে ফের জাগ্রৎ অবস্থায় জীবের প্রত্যাবর্তন ঘটে। এ প্রেক্ষিতে শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন-

‘সুষুপ্তিকালেহপি হি নাম-রূপে বিহায় সতা সম্পরিষ্বক্তঃ পুনরপি জাগ্রদ্দশায়াং নাম-রূপে পরিষ্বজ্য তত্তন্নামরূপো।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।
অর্থাৎ :
জীবগণ সুষুপ্তিকালে যে নাম ও রূপ পরিত্যাগ করে সৎ-সম্মিলিত হয়, জাগ্রৎ-অবস্থায় আবার নাম ও রূপের সাথে সম্বন্ধ লাভ করে পুনশ্চ সেই-সেই নাম ও রূপভাগী হয়ে থাকে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।

৪.১ : জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব, কিন্তু একমাত্র তত্ত্ব নয়। ঈশ্বরের দুটি অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের মতোই সত্য, কিন্তু চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। শরীর যেমন আত্মার উপর নির্ভর করে, তেমনি জড় ও আত্মা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে থাকে। এই বিশেষ নির্ভরতার সম্বন্ধকে ব্যাখ্যা করার জন্য রামানুজ ‘অপৃথকসিদ্ধি’ নামে এক স্বতন্ত্র অবিচ্ছেদ্যতার সম্বন্ধ স্বীকার করেছেন। এই সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত হলো দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ। কেননা দেহ বলতে রামানুজ বুঝিয়েছেন- ‘যাকে আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, যা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে এবং যাকে আত্মা আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য কাজে লাগায়।

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ প্রকাশ করতে গিয়ে রামানুজ অংশ-অংশী, দেহ-দেহী, অবয়ব-অবয়বী, কার্য-কারণ, বিশেষণ-বিশেষ্য প্রভৃতি সম্পর্কের কথা বলেছেন। রামানুজের দর্শনে ব্রহ্ম হলেন সগুণ এবং তিনিই ঈশ্বর। রামানুজ ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ স্বীকার না করলেও ব্রহ্মের স্বগতভেদ স্বীকার করে চিৎ ও অচিৎকে ব্রহ্মেরই অংশরূপে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ব্রহ্ম হলেন অংশী এবং জীব ও জড়জগৎ ব্রহ্মের অংশ বলে এদের মধ্যে যে সম্বন্ধ তা হলো বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ। এই বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ আসলে অপৃথকসিদ্ধির সম্বন্ধ। অংশ অর্থাৎ বিশেষণ কখনোই অংশী অর্থাৎ বিশেষ্য (ব্রহ্ম) থেকে পৃথকভাবে থাকতে পারে না। বস্তুত অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ তা হলো বিশিষ্ট অভেদ, আত্যন্তিক অভেদ নয়। এই কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

বৃক্ষের সঙ্গে তার শাখা-প্রশাখার, আত্মার সঙ্গে তার দেহের, বা দ্রব্য উৎপলের সঙ্গে তার গুণ নীলরূপের যে সম্বন্ধ, ব্রহ্মের সঙ্গে জীব তথা জগতেরও সেই সম্বন্ধ। রামানুজ জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে সামানাধিকরণ্য স্বীকার করে বলেছেন যে, ব্রহ্ম ও জীব ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়ই।
জীব ও জগৎ ব্রহ্মেরই দুটি অংশ হওয়ায় উপাদানস্বরূপ জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। আবার কার্য-কারণ সম্বন্ধেও জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। কেননা সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী রামানুজের মতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত নয় পরিণাম হওয়ায় ব্রহ্মই জীব ও জগতের উপাদান ও নিমিত্তকারণ। এক্ষেত্রে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে দুভাবে চিন্তা করা হয়- কারণরূপে এবং কার্যরূপে। প্রলয়কালে জগৎ যখন ধ্বংস হয়, তখন জীব ও জড় ব্রহ্মের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। তখন ঈশ্বর কারণরূপে বিদ্যমান থাকেন এবং সূক্ষ্ম অচিৎ ও বিদেহ আত্মাগুলি ঈশ্বরের শরীর রূপে থাকে। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় কারণ-ব্রহ্ম। সমগ্র বিশ্বসংসার এই সময় ব্রহ্মে লীন হয়ে থাকে। অপরপক্ষে সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ ও অচিৎ অংশ যথাক্রমে জীবজগৎ ও জড়জগতে ব্যক্ত হয়, তখন ব্রহ্মকে বলা হয় কার্য-ব্রহ্ম। অর্থাৎ, কারণ-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের অব্যক্ত অবস্থা এবং কার্য-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের ব্যক্ত অবস্থা। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘অনেন কল্পনোপদেশেনাস্যাঃ প্রকৃতেঃ কার্য্যকারণরূপেণ অবস্থাদ্বয়ান্বয়ঃ অবগম্যতে। সা হি প্রলয়বেলায়াং ব্রহ্মতাপন্না অবিভক্তনামরূপা সূক্ষ্মরূপেণাবতিষ্ঠতে; সৃষ্টিবেলায়ান্তু উদ্ভূতসত্ত্বাদিগুণা বিভক্তনামরূপা অব্যক্তাদিশব্দবাচ্যা তেজোহবন্নাদিরূপেণ চ পরিণতা লোহিত-শুক্ল-কৃষ্ণকারা চাবতিষ্ঠতে। অতঃ কারণাবস্থা অজা, কার্য্যাবস্থা চ জ্যোতিরূপক্রমা, ইতি ন বিরোধঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১০)
অর্থাৎ :
(শ্রুতির) সৃষ্টিবাক্য হতে জানা যায় যে, এই প্রকৃতি দুই প্রকার অবস্থায় অবস্থিত; তার একটি অবস্থা কার্যস্বরূপ, আর একটি অবস্থা কারণস্বরূপ; প্রকৃতি সেই উভয় অবস্থাতেই অনুগত। প্রলয়কালে ব্রহ্মে বিলীন সেই প্রকৃতিই নাম ও রূপ-বিনির্মুক্ত হয়ে সূক্ষ্মরূপে অবস্থান করে; সৃষ্টিসময়ে আবার সত্ত্বাদি গুণরূপে উদ্ভূত বা অভিব্যক্ত হওয়ায় এবং নাম ও রূপ তা থেকে পৃথক হওয়ায় অব্যক্ত প্রভৃতি শব্দবাচ্য সেই প্রকৃতিই তেজ, জল ও পৃথিবী ইত্যাদিরূপে পরিণত হয়ে লোহিত (রজঃ), শুক্ল (সত্ত্ব) ও কৃষ্ণরূপে (তমোগুণরূপে) অবস্থান করে। অতএব, কারণাবস্থায় অজা (প্রকৃতি), আর কার্যাবস্থায় জ্যোতিরূপক্রমা (ব্রহ্মোৎপন্না); (সুতরাং একই প্রকৃতির উভয়াবস্থা স্বীকারে) কোন বিরোধ নেই (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১০)।

অন্যদিক থেকে জীব ও ব্রহ্ম ভিন্ন, কারণ জীব সীমিত বা অণুপরিমাণ ও সৃষ্টিশক্তিহীন। কিন্তু ব্রহ্ম বিভুপরিমাণ ও স্রষ্টা। এ প্রেক্ষিতে শ্রীভাষ্যে রামানুজের যে বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য-

‘তদেতৎ চেতনাচেতনাত্মক-কৃৎস্নবস্ত্বাধারত্বং জীবাৎ অর্থান্তরভূতেঃ অস্মিন্ পরমাত্মন্য এব উপপদ্যত ইত্যর্থঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩০)।
অর্থাৎ : এই যে চেতন-অচেতন সর্বপদার্থের আশ্রয়ত্ব (ধারকতা), তা জীব হতে পৃথক পদার্থ পরমাত্মাতেই সম্ভব হয়, (জীবে হয় না) (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩০)।

এইভাবেই জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে ভেদ ও অভেদ সম্বন্ধের বিশিষ্টতা উপস্থাপন করে রামানুজ উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘তত্ত্বমসি’-এর অর্থ নির্ণয় করেছেন। তাঁর মতে, ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের দ্বারা জীব যে ব্রহ্মে থেকে ভিন্ন হয়েও অভিন্ন, একথাই বোঝানো হয়। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য জহৎ-অজহৎ লক্ষণার দ্বারা বিরুদ্ধধর্মের পরিত্যাগপূর্বক ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের অদ্বয় তাৎপর্য নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু রামানুজের মতে উক্ত মহাবাক্যের তাৎপর্য নির্ধারণের জন্য লক্ষণা করার কোন প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে ‘তৎ’ ও ‘ত্বম্’ পদদ্বয়ের বিশেষ্য-বিশেষণভাবজনিত সামানাধিকরণ্যের দ্বারাই ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের তাৎপর্য প্রতিপাদিত হতে পারে।
পুত্র শ্বেতকেতুকে তাঁর পিতা উদ্দালকের উপদেশ হিসেবে ছান্দোগ্য উপনিষদের একাধিক শ্লোকে আছে-

‘তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতু।’- (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)
অর্থাৎ : সেই সৎ পদার্থই সত্য, সেই পদার্থই আত্মা। হে শ্বেতকেতু তুমি হও সেই অর্থাৎ সেই সৎ পদার্থ ও আত্মা (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)।

রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্যে ছান্দোগ্য-উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘ব্রহ্ম থেকে জীব স্বরূপতঃ অভিন্ন।’ তত্ত্বমসি বাক্যটির অর্থ হলো ‘তিনিই তুমি’ অর্থাৎ জীবাত্মাই ঈশ্বর। জীব ঈশ্বর থেকে ধর্মতঃ পৃথক হলেও স্বরূপতঃ এক ও অভিন্ন।
রামানুজ বলেন যে, ‘তৎ’ এবং ‘ত্বম্’-এর মধ্যে ঐক্য থাকলেও উভয়ের বিশিষ্টতা আছে। ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটিতে ‘ত্বম্’ শব্দটি জীবকে নির্দেশ করে এবং ঈশ্বরকেও নির্দেশ করে। কারণ ঈশ্বর জীবের অন্তর্যামী। জীব ও তার শরীর ঈশ্বরের প্রকার। ‘তৎ’ শব্দটিও জীব সমন্বিত জগতের কারণরূপে ঈশ্বরকে নির্দেশ করে। ‘ত্বম্’ অন্তর্যামীরূপে ঈশ্বরকে এবং ‘তৎ’ শব্দটি জগতের কারণরূপে ঈশ্বরকে বোধিত করছে। সুতরাং ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটির প্রকৃত তাৎপর্য হলো- যদিও জীব এবং জগৎ দুটি স্বতন্ত্র ও সত্য, তবুও তারা যে পরম সত্তার অন্তর্ভুক্ত তা এক ও অদ্বৈত। বস্তুত জীব ও জগৎ ঈশ্বরের শরীররূপে নিত্য।

উল্লেখ্য, রামানুজ কখনো ব্রহ্ম ও জীবের ভেদের উপর, আবার কখনো উভয়ের অভেদের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শ্রীভাষ্যে তিনি ব্রহ্ম ও জীবকে স্বরূপত পৃথক বলেও উল্লেখ করে বলেছেন-

‘নাপি চিৎ-অচিৎ-ঈশ্বরাণাং স্বরূপভেদনিষেধঃ।’- (শ্রীভাষ্য-৯৫)
অর্থাৎ: চিৎ ও অচিৎ- ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও ব্রহ্ম (ঈশ্বর) ও জীব স্বরূপত অভিন্ন নয়। (মুক্ত তর্জমা)

বস্তুত, রামানুজের মতে ব্রহ্ম ভেদের দ্বারা বিশেষিত রূপেই সৎ। ভেদ-নিরপেক্ষ অভেদ বা অভেদ-নিরপেক্ষ ভেদ সম্ভব নয়। এজন্যই এই মতবাদ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : রামানুজের মতে জগৎ] [*] [পরের পর্ব : রামানুজের মতে জীবের বন্ধন ও মোক্ষ]

No comments: