Tuesday, October 10, 2017

বাক্যের অখণ্ডতা, শব্দার্থবোধ, প্রেম ও তার সমাজ চেতনা


| বাক্যের অখণ্ডতা, শব্দার্থবোধ, প্রেম ও তার সমাজ চেতনা |
রণদীপম বসু

(১)
‘সই, কেমনে ধরিব হিয়া, আমার বধুয়া আনবাড়ি যায় আমার আঙিনা দিয়া।’ চতুর্দশ শতকের বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের (আনুমানিক ১৪১৭-১৪৭৭ খ্রি) এই পঙক্তিবদ্ধ আকুতির সাথে উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের (মতান্তরে তিন-এর দশকের) কবি জীবনানন্দ দাশের ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে’-(আকাশলীনা) পঙক্তির আকুতির মধ্যে খুব একটা ভিন্নতা কি চোখে পড়ে? কিংবা ‘বৈষ্ণব কবিতা’য় বিদ্যাপতির (১৩৮০-১৪৬০) ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর, এ ভরা ভাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’-এর সাথে বহুকাল পর আমাদের পল্লীকবি জসীমউদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) ‘প্রতিদান’ কবিতায় ‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।’–পঙক্তির হাহাকারের মধ্যেও যে চিরায়ত মানবিক বোধের অভিন্নতা, তা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। এই আকুতি, এই হাহাকার, এই যে বোধ, একে অনেক অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন বিভিন্ন জনে। কিন্তু ওই সব বিশেষ বিশেষ বিশেষণের সমন্বিত যে অনুভব, যাকে বিশ্লিষ্ট করলে শাশ্বত মানব-মনের বহু-বিচিত্র উপলব্ধির যে অবিমিশ্র ক্ষরণটিকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় থাকে না, তারই নাম হয়তো প্রেম। বস্তুত যার কোনো সংজ্ঞাই হয়তো যথাযথ হয় না।


খুব সংকীর্ণ অর্থে প্রেম বলতে এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা বোঝায়, মানব-মানবীর পরস্পর মিলনাকাঙ্ক্ষা। স্থূল অর্থে আসলে তা-ই। বিজ্ঞানের জটিল প্রক্রিয়ায় না গিয়েও বলা যায়, সহজাত প্রজননধর্মী পরস্পর বিপরীত লিঙ্গের দুটি এক জাতীয় প্রাণীর মধ্যে মিলন-পূর্ব যে প্রণোদনা তাদেরকে মিলিত হতে বাধ্য করে তাকে কি প্রেম বলবো, না কি জৈব প্রবৃত্তি বলবো? কিন্তু এই প্রণোদনা কেবল মানুষ কেন, সকল প্রাণীর জন্যই তো সমভাবে প্রযোজ্য। সৃষ্টির আদিকাল থেকে আদিম এ প্রাকৃতিক ঘরানার মাধ্যমে প্রাণীর বংশ-বিস্তৃতির পরম্পরা ধারণ করে আছে তা। কিন্তু প্রাণিজগতের যে বিস্ময়কর ধারাটি অন্য সকল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব ভাব-বিনিময়ের উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে ভাষা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে একটি মানব-সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে ফেলেছিলো, তার প্রণোদনা প্রকাশের সাথে অন্য সব ভাষাহীন প্রাণীর আদিম প্রণোদনা এক থাকার কথা নয়। কামনার বস্তুকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে সে ভাষার মাধ্যমে, প্রিয় সঙ্গিকে আহ্বান করেছে ভাষার মাধ্যমে, মিলনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ভাষায়, কিংবা মিলনের ব্যর্থতা বা বিচ্ছেদের যাতনাও প্রকাশ করেছে তার নিজস্ব ভাষায়। অতএব, ভাষাবান আর ভাষাহীনের মধ্যে প্রণোদনা প্রকাশের স্বভাব ও প্রকৃতিতেও থাকবে বিস্তর তফাৎ। এটাই স্বাভাবিক এবং নিশ্চয়ই হয়েছেও তাই।

ভাব প্রকাশে মানুষের ভাষার সক্ষমতা অর্জনের পর যখনও পারঙ্গম লিপি তৈরি হয়নি তখনও মানুষ তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে ভাষায়। কিন্তু যখনই মানুষ তার সভ্যতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উত্তরণে প্রয়োজনীয় লিপি বানিয়ে ফেললো, ধীরে ধীরে ভাষায় যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে যাত্রা করলো তাতেই মনোজাগতিক পরিবর্তনে নিয়ে এলো বিস্ময়কর সামাজিক উত্থান। ভাষা ধারণ করতে শুরু করলো তার  এতোকালের অব্যক্ত অভিব্যক্তিগুলিও। সামাজিক বিকাশে এটাকেই আমরা সভ্য মানুষের সাহিত্যযাত্রা বলে চিহ্নিত করতে পারি হয়তো। কিন্তু কখন কোথায় কে কিভাবে প্রথম মৌখিক সাহিত্য রচনা করে মানব সমাজে অব্যক্ত ভাব প্রকাশের বিকল্প সূচনাটুকু করেছিলো তা নিশ্চয় করে বলার উপায় নেই। লোকব্যবহারে মানুষ তার ভাষার স্বাভাবিক আদিমতা দিয়ে হয়তো কাজ চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু কথা হলো, বুকের ভেতরের সেই সব অব্যক্ত কথামালা যা নাকি অনুভূত হয় কিন্তু ব্যক্ত করা যায় না, তার কী হবে? অব্যক্ত মানেই তো যা ব্যক্ত হয় না। এই অব্যক্তকে ব্যক্ত করা না গেলে মানবমনের সেই বিচিত্র প্রকাশ ঘটবে কী করে! প্রকাশের এই তাড়না থেকেই হয়তো অপ্রকাশকে প্রকাশ করার বৈচিত্র্যময় কৌশলটুকুও রপ্ত করে নিয়েছে মানুষ প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। এটাকেই আমরা সাহিত্যের উন্মেষ বলে ধরে নিতে পারি। এটা যে কোন নিয়ম মেনে ছক কাটা পথে অগ্রসর হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে ভাষার মৌখিক রূপ থেকে পর্যায়ক্রমে যেমন লেখ্যরূপ এসেছে, সাহিত্যেও এই ধারাক্রম অস্বীকার করার জো নেই।

আমাদের বর্তমান আলেখ্য মূলত সাহিত্যকেন্দ্রিক হলেও সাহিত্যের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রবেশের আগে তার অনিবার্য মাধ্যম যে ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব, সেই ভাষার সুলুকসন্ধানে অতি সামান্য কিছু দার্শনিক পরিক্রমা কি  সেরে আসা যায়? বিষয়টা খুব মন্দ হবে না বলেই মনে হয়। কেননা ভাষার ব্যাকরণ ও তার গঠন-সম্পর্কিত যে প্রচলিত ধারণায় আমরা অভ্যস্ত সেখানে বেশ মজার ও কৌতুহলোদ্দীপক ঝাঁকি খেয়ে আমাদেরকে নড়েচড়ে বসতে হয় বৈ কি! কীভাবে?

(২)
আমরা জানি যে, আমাদের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ মূলত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ থেকে আহুত। সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতিনীতিই বাংলা ব্যাকরণের প্রধানতম ভরসা। সে যাক্, ব্যাকরণের নিয়মানুযায়ী আমরা সেই শৈশবেই স্কুলপাঠ্যে মুখস্থ করে ফেলেছি– কয়েকটি বর্ণ মিলে একটি পদ বা শব্দ হয়, কয়েকটি অর্থবহ শব্দ বা পদ মিলে একটি বাক্য হয়। এটাই তো আমরা মোটামুটি স্বতসিদ্ধ বলেই জানি। কিন্তু এটি ক’জন জানি যে, এই ধারণাটির পক্ষে-বিপক্ষে সেই মধ্য-প্রাচীনকাল থেকেই ভাষা বা ব্যাকরণ দার্শনিকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে এ নিয়ে দুটো ভাগ সেই প্রাচীন দার্শনিক জগতে রীতিমতো প্রসিদ্ধ। এক পক্ষ এই ধারণার অনুকূলে, অন্যদিকে আরেক পক্ষ এই মতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের ব্যাকরণ-অভ্যস্ততার প্রচলিত সাক্ষ্য থাকায় পক্ষের মতামত আর নাই আনলাম। কিন্তু বিপক্ষের মতামতটা যে কতোটা প্রাণবন্ত আর যৌক্তিকতায় চমৎকারিত্ব প্রকাশ করেছে তা দেখলে রীতিমতো শিহরিত হতে হয়!

প্রচলিত ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব পড়ে স্বাভাবিকভাবেই একটা ধারণা জন্মে যে, বর্ণগুলি যোগ করে শব্দগুলি তৈরি হয়েছে, যেমন– আম = আ + ম্ + অ, কিংবা বক = ব্ + অ + ক্ + অ, ইত্যাদি। কিন্তু বিপক্ষবাদীরা বলছেন,  এ ধারণা ভ্রান্ত। শব্দের মূল যদি বর্ণ হয়, বর্ণ থেকেই যদি অর্থবহ শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকে, তাহলে এর তাৎপর্য দাঁড়াচ্ছে– মানুষের ভাষার এমন একটা আদিম অবস্থা ছিল যখন মানুষ জাগতিক বস্তু বোঝাবার জন্য বা মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য শুধু অ, আ, ক, খ জাতীয় পৃথক পৃথক বর্ণগুলিই ব্যবহার করত, এই বর্ণগুলির প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র অর্থ ছিল এবং কালক্রমে এই বর্ণগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে বিভিন্ন অর্থবহ শব্দ সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ অর্থবহ শব্দের আদিমতম রূপ হল এক একটি স্বতন্ত্র বর্ণ। যে কোন ভাষার শব্দসম্পদের তুলনায় বর্ণসম্পদ অতি সীমিত। তাহলে আদিম মানুষকে একটি বর্ণের দ্বারা অসংখ্য বস্তু বুঝতে ও বোঝাতে হত। কিন্তু ভাষার আদিমতম ইতিহাসে অর্থবহ শব্দরূপে কেবল এক একটি স্বতন্ত্র বর্ণমাত্র ব্যবহার করা হত, সমগ্র একটি শব্দের ব্যবহার হত না, এহেন বিচিত্র কল্পনা খুবই কষ্টকর নয় কি?

দার্শনিক জগতের পরম বিস্ময় ‘বাক্যপদীয়’ গ্রন্থের প্রণেতা প্রাচীন ব্যাকরণ-দর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রামাণিক প্রবক্তা মহাবৈয়াকরণ ভর্ত্তৃহরি বলেন যে, মানুষ চিরদিন অর্থ বোঝাতে একটা গোটা শব্দই ব্যবহার করতো, শব্দ থেকে বিশ্লিষ্টরূপে এক একটা বর্ণমাত্র ব্যবহার করতো না। এই মতকে মীমাংসক ও নৈয়ায়িকরাও স্বীকার করেন। তাহলে এর তাৎপর্য দাঁড়াচ্ছে, মানুষের ব্যবহারসিদ্ধ শব্দরূপের উপস্থিতির পূর্বে শব্দের অবয়বরূপে পরিকল্পিত বর্ণগুলির কোনদিন বাস্তব উপস্থিতি ছিলো না। অর্থাৎ প্রাকসিদ্ধ স্বতন্ত্র বর্ণগুলির যোগ-বিয়োগ বা ক্রম পরিবর্তন করে ব্যবহারযোগ্য অর্থবোধক শব্দরাশি সৃষ্টি করা হয়নি। কাজেই আম = আ + ম্ + অ নয়, কিংবা বক = ব্ + অ + ক্ + অ নয়। তার মানে, পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিক বৈয়াকরণ ও শিক্ষাকারগণ ভাষায় ব্যবহৃত মূল শব্দ থেকে বিশ্লেষণী বুদ্ধির দ্বারা বর্ণগুলিকে পৃথক করে বোঝার চেষ্টা করেছেন– এভাবে এক একটি ভাষার ‘বর্ণমালা’ সৃষ্ট হয়েছে। সুতরাং শব্দ থেকেই বর্ণের উৎপত্তি হয়েছে। বর্ণ থেকে শব্দের উৎপত্তি হয়নি। অর্থ বোঝাবার জন্য মানুষ যদি চিরকাল ধরে একটা সমগ্র শব্দই ব্যবহার করে এসে থাকে, কোনদিন স্বতন্ত্রভাবে পৃথক পৃথক এক একটি বর্ণ ব্যবহার না-করে থাকে, তাহলে ভর্ত্তৃহরির এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে উপায় নেই যে– ‘শব্দ অখণ্ড’। তাই শব্দ একটি পূর্ণরূপ যার বৌদ্ধিক বিশ্লেষণের দ্বারা বৈয়াকরণ ও শিক্ষাকারগণ অংশাকারে বর্ণগুলি কল্পনা করেছে। পূর্ণই বাস্তব, পূর্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন অংশ বুদ্ধি-পরিকল্পিত।

এ-বিষয়টি নিয়ে মহামহোপাধ্যায় হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা দর্শন’ গ্রন্থে চমৎকার আলোচনা করেছেন। এখানে আমাদের সেই বিস্তৃত আলোচনায় যাওয়ার সুযোগ নেই। তবু অবাধ্য পাঠক-কৌতুহল নিবৃত্ত করতে তার সামান্য কিছু আলোচনা ও উদ্ধৃতি ব্যবহার বর্তমান প্রসঙ্গে সহায়ক হবে মনে করি।
‘বৌদ্ধ বিশ্লেষণের দ্বারা সমগ্র থেকে অংশকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র বস্তুরূপে কল্পনা করাকে ভর্ত্তৃহরি বলেছেন ‘অপোদ্ধার’। ভর্ত্তৃহরির অপোদ্ধার-তত্ত্ব ব্যাকরণ দর্শনের একটি মূল স্তম্ভ। ভর্ত্তৃহরি বিভিন্ন আলোচনা প্রসঙ্গে ঘুরেফিরে বারবার এই তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন। যে সমগ্র শব্দরূপের বৌদ্ধবিশ্লেষণের দ্বারা আমরা কাল্পনিক অংশে উপনীত হই ভর্ত্তৃহরি সেই সমগ্রকে বলেছেন ‘অন্বাখ্যেয়’ শব্দ (অনু-আখ্যেয় = পরে যাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাগ করে ব্যাখ্যা করা হয়)। ভর্ত্তৃহরি অপোদ্ধার তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে অন্বাখ্যেয় শব্দের উদাহরণ দিয়েছেন– ‘ভবতি’। আমরা শিখে এসেছি ভূ ধাতুর সঙ্গে তি (তিপ্) প্রত্যয় (তিঙ্ বিভক্তি) যোগ করে ‘ভবতি’ ক্রিয়াপদটি গঠিত হয়েছে। তি বিভক্তির অব্যবহিত পূর্বে একটি অতিরিক্ত ‘অ’-কার এসেছে। ভূ-ধাতুর দীর্ঘ ‘ঊ’টি ‘ও’-কারে পরিণত হয়েছে। ‘ও’-কারটির ‘অব্’ এ পরিণত হয়েছে। এত কাণ্ডের পর ‘ভূ’ ও ‘তি’ মিলে ‘ভবতি’ হয়েছে। (ভূ-তি > ভূ-অ-তি > ভো-অ-তি > ভ্-অব্-অ-তি > ভবতি)। বাস্তবে এ জাতীয় কোনোকিছুই ঘটেনি। কারণ, সংস্কৃত ভাষাভাষী আদিপুরুষরাও প্রথম থেকে ‘ভবতি’ পদটিই বলে এসেছে। মানুষ যা বলে তাই তো ভাষা। ভাষায় কোনোদিন শুধু ‘ভূ’ বা শুধু ‘তি’ বলে কিছু ছিল না। কাজেই ওদের প্রথম মিলন বলে কোনোকিছু ঘটেনি, ওরা চিরদিন মিলিতই ছিল। কেবল ‘ভূ’ বা কেবল ‘তি’ এর কোনো অর্থ নেই। ‘ভূ’ মানে হওয়া, আর ‘তি’ মানে কর্তৃকারক একবচন ও প্রথম পুরুষ, এসব কথা বৈয়াকরণের বৈঠকখানায় পরিশীলিত বিশ্লেষণী বুদ্ধির বস্তুহীন নিপুণ কল্পনা।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়/ বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১২৫)।

এ প্রসঙ্গে অর্থবোধকতা সম্পর্কে প্রখ্যাত মীমাংসক-দার্শনিক কুমারিল ভট্টের একটি সর্ববাদীসম্মত বিখ্যাত সাধারণ নীতিবাক্য রয়েছে–
‘প্রকৃতিপ্রত্যয়ৌ সহার্থং ব্রূতঃ।’
অর্থাৎ : প্রকৃতি এবং প্রত্যয় মিলিতভাবে অর্থ প্রকাশ করে, স্বতন্ত্র বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ করে না।

এ প্রেক্ষিতে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন যে, এরই অনুষঙ্গ হিসেবে আরেকটি নীতিও এসে যায়, তা হলো– শুধু প্রকৃতি বা শুধু প্রত্যয় ভাষায় ব্যবহৃত হয় না। শব্দ ও শব্দার্থের নিরিখ হলো ভাষাগত সামাজিক ব্যবহার। তাহলে মেনে নেয়া হচ্ছে– মানুষের ভাষায় ‘ভূ’ এবং ‘তি’ কোনোদিন পৃথক সত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়নি, পৃথক অর্থও কোনোদিন প্রকাশ করেনি। তাহলে এটাও মেনে নিতে হচ্ছে– ‘ভূ’ এবং ‘তি’ জোড়া লেগে ‘ভবতি’-রূপে পরিণত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ভাষার ইতিহাসে কোনোদিন ঘটেনি, মানুষের ব্যবহারিক বুদ্ধিগ্রাহ্য কোন পৃথক অর্থও এদের কোনোদিন ছিলো না। সুতরাং ‘ভবতি’ এই সমগ্র রূপটি এবং এর সমগ্র অর্থটি ব্যবহারসিদ্ধ অখণ্ড সামাজিক সত্য। তাই মহাবৈয়াকরণ ভর্ত্তৃহরি তাঁর বাক্যপদীয় গ্রন্থে বলেন–
‘অপোদ্ধারপদার্থা যে যে চার্থঃ স্থিতলক্ষণাঃ।
অন্বাখ্যেয়াশ্চ যে শব্দা যে চাপি প্রতিপাদকাঃ।।’- (বাক্যপদীয়-১/২৪)
অর্থাৎ :
অকল্পিত সমগ্র শব্দরূপটি হলো ‘অন্বাখ্যেয়’; শাস্ত্রকারদের দ্বারা কল্পিত খণ্ডিত শব্দাংশ হলো ‘প্রতিপাদক’। সমগ্র শব্দের সমগ্র অর্থ হলো ‘স্থিতলক্ষণ’ (বস্তুত যা অবিভক্ত রূপে স্থিত, স্বরূপ থেকে অপ্রচ্যুত, লোকব্যবহারসিদ্ধ); কল্পিত খণ্ডিত অর্থাংশ হলো ‘অপোদ্ধার’।

অপোদ্ধার শব্দের সাধারণ অর্থ কল্পিত বিভাগ। সমগ্র থেকে কল্পনায় খণ্ডিত করে যে অংশকে বের করে দেখানো হয় তাকেও অপোদ্ধার বলে; এখানে অপোদ্ধার মানে অপোদ্ধৃত। বস্তুত শব্দাংশ ও অর্থাংশ উভয়ই অপোদ্ধৃত। তাই ভর্ত্তৃহরির মতে ‘ভবতি’ হলো শব্দের ব্যবহারানুগত বাস্তব রূপ (অন্বাখ্যেয়)। ভূ-তি প্রভৃতি খণ্ডিত রূপ হলো কল্পিত, ‘প্রতিপাদক’। তেমনি ‘ভবতি’ শব্দের সামগ্রিক অর্থটিই সত্য (স্থিতলক্ষণ)। ‘ভূ’-ধাতু মানে ‘হওয়া’, তি মানে ‘কর্তৃবাচ্যে প্রথম পুরুষ একবচন’ এরূপ বিভক্ত অর্থ অসত্য, কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় প্রয়োজনে শাস্ত্রকারদের দ্বারা পরিকল্পিত (অপোদ্ধার)। তাই ভর্ত্তৃহরির স্পষ্ট ঘোষণা–
‘শাস্ত্রেষু প্রক্রিয়াভেদৈরবিদ্যৈবোপবর্ণ্যতে।
অনাগমবিকল্পৌ তু স্বয়ং বিদ্যোপবর্ততে।।’- (বাক্যপদীয়-২/২৩৩)
‘উপায়াঃ শিক্ষমাণানাং বালানামপলাপনাঃ।
অসত্যে বর্ত্মনি স্থিত্বা ততঃসত্যং সমীহতে।।’- (বাক্যপদীয়-২/২৩৮)
‘তথা পূর্বপদার্থ উত্তরপদার্থোৎ্যন্যপদার্থঃ প্রতিপাদিকার্থো ধাত্বর্থঃ প্রত্যয়ার্থ ইত্যেক-পদবাচ্যোৎ্যপ্যনিয়ত অবর্ধিহুধা প্রবিভজ্য কৈশ্চিত্ কথঞ্চিদ্ অপোদ্ধ্রিয়তে।’- (বাক্যপদীয়-১/২৪-ভর্তৃহরির নিজস্ব ব্যাখ্যা)
সারার্থ :
ব্যাকরণ শাস্ত্রের প্রক্রিয়াগুলি অসত্য কাল্পনিক। পূর্বপদ, উত্তরপদ, প্রতিপদিক, ধাতু, প্রত্যয় এবং এদের প্রত্যেকের পৃথক পৃথক অর্থ– এ জাতীয় বহুপ্রকার বিভাগগুলি অসত্য, শাস্ত্রকারদের বিকল্পবুদ্ধিপ্রসূত অপোদ্ধার মাত্র। এজাতীয় বিভাগপ্রক্রিয়ার প্রদর্শন এক ধরনের প্রতারণা। তবু এ-জাতীয় মিথ্যা উপায়ের মাধ্যমেই ভাষাশিক্ষার্থী বালক উপেয় সত্যে উপনীত হয়।- (তর্জমা : হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-১২৭)

অসত্য কাল্পনিক উপায়ে সত্যে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রকৃষ্ট নিদর্শন হলো গাণিতিক চিহ্ন ও গানের স্বরলিপি। ১ ২ ৩ প্রভৃতি রেখাচিহ্নগুলি সংখ্যা নয়, সংখ্যার সঙ্গে চিহ্নগুলির সম্পর্ক অবাস্তব ও কাল্পনিক। কিন্তু ঐ রেখাচিহ্নগুলি ব্যবহার করে আমরা গণিত শিখে থাকি। গানের স্বরলিপি যেমন স্বর নয়, সুর নয়, তাল নয়; কিছু কাল্পনিক চিহ্নমাত্র। তবু ওগুলির মাধ্যমে গানের শুদ্ধ ধারণা জন্মে। তেমনি কোন ভাষা সম্পর্কে ধারণা করার জন্য বর্ণমালা, প্রকৃতি, প্রত্যয় প্রভৃতি কাল্পনিক বিভাগের সাহায্য নিতে হয়। ব্যাকরণ শাস্ত্র এই সাহায্যটুকু করে থাকে।

ভর্ত্তৃহরি কেবলমাত্র পদ ও পদার্থের অখণ্ডতার মধ্যেই তাঁর দার্শনিক সিদ্ধান্ত সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি আরও অগ্রসর হয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করেছেন– বাক্য ও বাক্যার্থের অখণ্ডতা। এ সিদ্ধান্তেরও প্রধান ভিত্তি হলো সামাজিক ব্যবহার। ভাষা মানুষের সামাজিক আত্মপ্রকাশ, যেখানে ব্যক্তির সামাজিক সত্তা সমাজের কাছে প্রকাশিত হয়, প্রমাণিত হয়। সমাজ-মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন নিছক বিশুদ্ধ ব্যক্তিসত্তা কোনদিন ছিলো না, আজও নেই। অনুরূপভাবে শব্দেরও একটা ‘সমাজ’ আছে। মানুষের পারিবারিক সমাজের মতো শব্দের প্রাথমিক সমাজ হলো বাক্য। বাক্যের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া কোন শব্দের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। বাক্যার্থের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া স্বতন্ত্র অর্থও নেই। কারণ, মানুষের ভাষাগত সামাজিক ব্যবহার বাক্যের দ্বারা সম্পন্ন হয়, স্বতন্ত্র শব্দের দ্বারা নয়। তাই বাক্যসত্তার অতিরিক্ত শব্দসত্তা নেই। একথাই ভর্ত্তৃহরি একটি প্রসিদ্ধ শ্লোকের মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন–
‘পদে ন বর্ণা বিদ্যন্তে, বর্ণেষ্ববয়বা ন চ।
বাক্যাত্ পদানামত্যন্তং প্রধিবেকো ন কশ্চন।।’- (বাক্যপদীয়-১/৭৩)
অর্থাৎ : পদের মধ্যে কোন (পৃথক) বর্ণ নেই; বর্ণের কোন অবয়ব (অংশ) নেই; বাক্য থেকে পদগুলির কোন ঐকান্তিক ভেদ নেই।

বাক্যের মতো বাক্যার্থও অখণ্ড। বাক্যার্থের অন্তর্গত পদার্থসমূহকে ভর্ত্তৃহরি বলেছেন ‘অত্যন্তসংসৃষ্ট’ (পরস্পর সর্বদাই অবিভক্ত)। লোকব্যবহারের দিকে সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি নিবদ্ধ করেই বাক্যার্থের মৌলিক চরিত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে ভর্ত্তৃহরি যে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ উক্তিটি করেন, তা হলো–
‘বিশিষ্ট একঃ ক্রিয়াত্মা।’- (স্বোপজ্ঞ বৃত্তি, বাক্যপদীয়-১/২৬)
অর্থাৎ : ক্রিয়াই হলো বাক্যার্থের আত্মা। ক্রিয়াই বাক্যার্থের ঐক্য ও বৈশিষ্ট্যের ধারক।

এ পর্যায়ে এসে বিচক্ষণ পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করছেন যে, আমরা যে বাক্য বা শব্দসমষ্টি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করি সেই বাক্য বস্তুত ক্রিয়াকেন্দ্রিক! তার মানে কোন একটি ক্রিয়া বা কাজের ভাবকে প্রকাশ করতেই আমরা বাক্যের ব্যবহার করি। অর্থাৎ বাক্যের অর্থটা আসলে একটা কাজের শব্দময় প্রতীকী প্রকাশ। আর কাজটাকে প্রকাশ করতে গিয়েই মূলত বাক্যের মধ্যস্থিত শব্দগুলো কর্মসংশ্লিষ্টতায় অর্থময় হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে মহাজন-মত কী বলে? প্রখ্যাত মীমাংসক-দার্শনিক প্রভাকর মিশ্রের মতে, শব্দগুলি কোন-না-কোন বাক্যের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে অন্বিত বা সম্বন্ধ হয়েই নিজ নিজ অর্থ প্রকাশ করতে পারে, অসম্বন্ধ বা অনন্বিত অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে কোন অর্থ প্রকাশ করতে পারে না। অর্থাৎ, পদার্থের জ্ঞানের জন্য পদকে পদের ক্রিয়ার সঙ্গে আগে অন্বিত হতে হয়। অন্বিত শব্দেরই শক্তিগ্রহ হয়। প্রথমে পদসমূহের দ্বারা পদার্থসমূহের পৃথক পৃথক অন্বয় হয়। এভাবে পদার্থের (পদের অর্থের) জ্ঞান হয়। পদার্থের জ্ঞান তাই অন্বয়সাপেক্ষ।

অন্বিত পদার্থের দ্বারাই প্রাথমিক শব্দার্থজ্ঞান হয়ে থাকে। একটি পদের অর্থমাত্রের দ্বারা লোকব্যবহার নিষ্পন্ন হয় না। বাক্যস্থিত পদসমূহের অর্থ সর্বদাই অপর পদার্থে অন্বিত। কিন্তু প্রচলিত মতবাদীরা, এবং সাধারণভাবে আমাদেরও মনে হয় যে, শিশুকাল থেকে আমরা এক একটি বিচ্ছিন্ন শব্দের ‘বিশুদ্ধ’ বিচ্ছিন্ন অর্থ শিখি, যেমন একে গাছ বলে, একে ফুল বলে ইত্যাদি, তারপর এগুলি মিশিয়ে বাক্যরচনা শিখি। দু-চারটি শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্বন্ধ এভাবে শিশু শেখে বটে। কিন্তু শিশুকাল থেকে আমরা যে শত শত শব্দের শত শত অর্থ শিখি তার কটা এভাবে শেখানো সম্ভব? অথচ আমাদের অজান্তে শিশু যে কয়েক ডজন শব্দ কখন ব্যবহার করতে শিখলো, তা ভেবে আমরা অবাক হয়ে যাই। অথচ শিশু কিন্তু এসব শিখে পরিবার-পরিজনের কথাবার্তা শুনে, বিশেষত বড়োদের বাক্যাকারে কথাবার্তার সঙ্গে কোনো-না-কোনো কাজের যোগাযোগ লক্ষ্য করে। প্রভাকরপন্থী মীমাংসকরা এ ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন প্রাচীন লোকায়ত কৃষিসমাজের উপযোগী কোন প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের দ্যোতক কার্যকলাপ থেকে। যেমন–
ধরা যাক্, বাবা বড়ো ছেলেকে বললেন– ‘গরুটাকে নিয়ে এস’। পাশের ছোটো খোকা দেখল বাক্যটি বলার সঙ্গে সঙ্গে দাদা একটা শিংওয়ালা চারপেয়ে প্রাণী নিয়ে এল। শিশু সম্পূর্ণ বাক্যটির একটা সম্পূর্ণ কাজের সঙ্গে সম্পর্ক আন্দাজ করল। বাক্যের অন্তর্গত শব্দগুলির পৃথক অর্থ এখনও সে বোঝেনি, অর্থাৎ ‘গরুটাকে’ এবং ‘নিয়ে এসো’ এরকম ধারণা তার এখনও হল না। এখন ধরা যাক্ বাবা বললেন– ‘গরুটাকে বেঁধে রাখো’, ‘ঘোড়াটাকে নিয়ে এসো’। বড়ো ছেলে বাবার আদেশ পালন করলো। কয়েকবার এরকম কথা ও কাজের পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে শিশু লক্ষ করল বাক্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দাদার কাজের পরিবর্তন ঘটছে, আরও লক্ষ করল, প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যের মধ্যে ‘গরুটাকে’ শব্দটি একই থাকছে, কিন্তু ‘নিয়ে এসো’-এর স্থানে ‘বেঁধে রাখো’ এসে যাচ্ছে, একই বস্তুর (প্রাণীর) সম্বন্ধে দুরকম কাজ হচ্ছে। আবার তৃতীয় বাক্যটিতে ‘গরুটাকে’-এর স্থানে ‘ঘোড়াটাকে’ এসে যাচ্ছে, দ্বিতীয় বাক্যের ‘বেঁধে রাখো’ চলে যাচ্ছে, তার জায়গায় প্রথম বাক্যের ‘নিয়ে এসো’ আবার ফিরে আসছে, তৃতীয় কাজটা প্রথম কাজের অনুরূপ হচ্ছে। এভাবে বাক্যের অন্তর্গত শব্দের যোগবিয়োগ (আবাপ-উদ্বাপ) এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কাজের পরিবর্তন বার বার লক্ষ করে পাশের শিশুটি ‘গরু, ঘোড়া, নিয়ে এসো, বেঁধে রাখো’ প্রভৃতি পদের পৃথক অর্থ বুদ্ধির দ্বারা বিশ্লিষ্ট করে একরকম আন্দাজ করে নিল, পরে নিজেও অনুরূপ পরিস্থিতিতে অনুরূপ বাক্য ব্যবহার করতে শিখল– ‘দাদা, গরুটাকে নিয়ে এসো, গরুটাকে বেঁধে রাখো, ঘোড়াটাকে নিয়ে এসো।’ বলা বাহুল্য, শিশুর এই বিশ্লেষণী বুদ্ধি ন্যায়শাস্ত্র পাঠ করে হয়নি। শিশুর এটা ‘স্বভাব ন্যায়’ বা instructive logic। কিন্তু শাস্ত্রকাররা শিশুর এ জাতীয় বুদ্ধিবিকাশ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন ভাষা প্রয়োগ করেন যাতে মনে হতে পারে শিশুও বোধ হয় বড়োদের মতো ‘অনুমান’ করছে, যেন সচেতনভাবে ন্যায়বুদ্ধির প্রয়োগ করছে।

এখানে আরেকটা বিষয়ও লক্ষ্য করতে হয়, শিশু যখন এরূপ ‘বৃদ্ধব্যবহার’ শোনে বা দেখে, তখন কিন্তু বাক্যবিযুক্ত বা শব্দান্তরের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি ‘বিশুদ্ধ’ ‘গরু’-শব্দ এবং তার অর্থরূপে অন্য বস্তু বা ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কশূন্য একটি বিশুদ্ধ ‘গরু’, যে গরু শোয় না, বসে না, হাঁটে না, দৌড়ায় না, খায় না, যে গরু কেবল নিছক গরু মাত্র, এমন একটি নিঃসঙ্গ গরু-শব্দ এবং নিঃসঙ্গ গরু-পদার্থ শিশু কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। বরং শিশুর মনে স্বাভাবিকভাবে এ ধারণাই জন্মে যে কোনো শব্দ অন্য কোনো শব্দের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েই আত্মপ্রকাশ করে এবং শব্দার্থও অন্য কোনো শব্দার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়েই প্রকাশিত হয়– এক কথায়, পরস্পরসম্বন্ধ শব্দ পরস্পরসম্বন্ধ অর্থ প্রকাশ করে। জগতের বস্তুসমূহ পরস্পর-সম্বন্ধ বলেই মানুষের ভাষাতেও শব্দগুলি পরস্পরসম্বন্ধভাবে বাক্যাকারে উচ্চারিত হয়। এখনকার শিশুরাও এভাবেই শেখে। পরিবার পরিজনের মধ্যে শিশু অনবরত কথার সঙ্গে কাজের সম্বন্ধ লক্ষ্য করে, শব্দ-পরিবর্তনের আনুষঙ্গিকরূপে কার্যপরিবর্তন লক্ষ্য করে। এভাবে কার্যান্বিতরূপে শব্দার্থের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে।

এই লোকব্যবহারের সাথে অন্বিতাভিধানবাদী প্রভাকর-মতের সংগতি পরিলক্ষিত হয়। লোকব্যবহারে কোন শব্দার্থ যেহেতু বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞানে প্রতিভাসিত হয় না, অন্য কোন শব্দার্থের সঙ্গে অন্বিত রূপেই প্রতিভাসিত হয়, সেহেতু পরস্পরসম্বন্ধ শব্দার্থসমূহই বাক্য, তৎ-অতিরিক্ত বাক্য বলে কিছু নেই। অর্থাৎ মানুষের ভাব কোন-না-কোনভাবে কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এবং কাজ-ব্যতিরিক্ত কোন বাক্য নেই। অতএব ভাষার একক হলো বাক্য, আর বাক্যাংশই হলো পদ, যা পরবর্তীতে বাক্য থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে একেকটি কার্য-সংশ্লিষ্ট অর্থময় শব্দের জন্ম হয়েছে। পরবর্তীকালের ব্যাকরণ শাস্ত্রকাররা এসব শব্দরূপের বর্ণধ্বনি থেকে বিভিন্ন একক বর্ণ বা অক্ষরের সৃষ্টি করেছে। তার মানে, বাক্যের মধ্য দিয়ে যে-পথে ভাষার জন্ম হয়েছে এবং শব্দরূপ ও বর্ণরূপে বিশ্লিষ্ট হয়েছে, প্রচলিত শাস্ত্র-ব্যাকরণের বর্ণনা ঠিক তার উল্টোপথে হেঁটে বর্ণরূপ থেকে ভাষায় গিয়ে পৌঁছেছে! বিষয়টা আগ্রহোদ্দীপক নিশ্চয়ই!

ভাষা ও বাক্যের সাথে ভাবের আধান কার্যরূপের এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটি মাথায় রেখেই যদি এবার আমরা কল্পনাশ্রয়ী সাহিত্যসৃষ্টি ও এতৎবিষয়ক ধারণাকে দর্শনাকাঙ্ক্ষার ফল্গুধারায় জারিত করে নিতে পারি, তাহলে সাহিত্যের প্রচলিত ব্যাখ্যার মধ্যেও কি আপাত অব্যক্ত বা অনির্বচনীয় অভিব্যক্তির এক ভিন্ন মাধুর্যের সুলুক-সন্ধান করতে পারি না? পারা যায় বৈ কি! তবে আর অযথা ব্যাকরণ-দর্শন নিয়ে টানা-হেঁচড়া না-করে বরং অন্তর্গত দর্শনোপলব্ধিকে অব্যক্ত রেখেই আমরা এবার কাঙ্ক্ষিত সাহিত্য-রসে অবগাহন করতে পারি। কল্পনাশ্রয়ী ভাব প্রকাশের এক তূরীয় মাধ্যম হিসেবে যদি সাহিত্যকে ভাষারূপে কল্পনা করি, তাহলে তার কার্য-অনুভবটাকে কি আমরা প্রেম হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি? যে প্রেম মানে কোন অলস শব্দরূপ নয়, এই প্রেম হচ্ছে সমকালীন সমাজ-সত্তার কার্যরূপ চেতনা-প্রবাহ!

(৩)
গোষ্ঠিগত সমাজ বিবর্তনের ক্রমানুযায়ী পৃথিবীতে একেক ভাষার সাহিত্যের উন্মেষ একেক সময়ে ঘটেছে তা ধারণা করা যায়। সেই ক্রমে বাংলা সাহিত্যের উন্মেষকাল ঠিক কবে এসেছিলো তা নিশ্চয় করে বলার উপায় নেই। তবে লিখিত নমুনা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের এ যাবৎ আবিষ্কৃত প্রাচীনতম নমুনা চর্যাপদই বাংলা সাহিত্যের এখন পর্যন্ত আদি নিদর্শন। যেমন–
‘টালত মোর ঘর নাহি পরবেসী, হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী…’ অর্থাৎ, বস্তিতে আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই, হাঁড়িতে ভাত নেই (অথচ) প্রেমিক (ভিড় করে)।- (চর্যাপদ-৩৩, ঢেণ্ডণপাদানাম)

এখন প্রশ্ন, নিজের ভাব প্রকাশের জন্য যে ভাষার সৃষ্টি এবং আপাত অব্যক্ত বা অনির্বচনীয় অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম যে সাহিত্য তাতে ব্যক্তিক প্রেমের অবদান কতটুকু? সঙ্গত কারণেই তখন আরেকটি প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে, ব্যক্তি কি সমাজ চেতনার বাইরের কিছু? অবশ্যই না। তাহলে তার প্রেমও সমাজ চেতনার বাইরের কিছু নয়। আর ভাষা বা সাহিত্য তো সেই সমাজ চেতনারই দলিল। কেননা উপরিউক্ত চর্যার দোহার আড়ালে এর অন্তর্নিহিত ভাব যাই হোক, হাজার বছর আগের আমাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক অবস্থাটা যে এখানে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় স্পষ্টই আঁকা হয়ে আছে তা আমাদেরকে বুঝে নিতে খুব বেগ পেতে হয় না। আর এই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রেমের ভিড়-বাট্টায়ও কমতি নেই। এটা সত্য যে, সাহিত্য হচ্ছে মানুষের এক ধরনের কল্পনাও। কেন? তার উত্তর রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধ থেকেই খুঁজে নিতে পারি–
‘শেক্সপিয়র বলিয়া গেছেন– গোলাপকে যে কোনো নাম দেওয়া যাক তাহার মাধুর্যের তারতম্য হয় না। গোলাপ সম্বন্ধে হয়তো তাহা খাটিতেও পারে, কারণ গোলাপের মাধুর্য সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ। তাহা কেবল গুটিকতক সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষগম্য গুণের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষের মাধুর্য এমন সর্বাংশে সুগোচর নহে, তাহার মধ্যে অনেকগুলি সূক্ষ্ম সুকুমার সমাবেশে অনির্বচনীয়তার উদ্রেক করে; তাহাকে আমরা কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারা পাই না, কল্পনা দ্বারা সৃষ্টি করি।’

কিন্তু এই সৌন্দর্য সৃষ্টি করার মধ্যেও কল্পনার সংযতভাব থাকতে হয়। নইলে তা আর সাহিত্য হয় না। তাই একই প্রবন্ধে অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন–
‘সৌন্দর্য সৃষ্টি করাও অসংযত কল্পনাবৃত্তির কর্ম নহে। সমস্ত ঘরে আগুন লাগাইয়া দিয়া কেহ সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায় না। একটুতেই আগুন হাতের বাহির হইয়া যায় বলিয়াই ঘর আলো করিতে আগুনের উপরে দখল রাখা চাই। প্রবৃত্তি সম্বন্ধেও সে কথা খাটে। প্রবৃত্তিকে যদি একেবারে পুরামাত্রায় জ্বলিয়া উঠিতে দিই তবে যে সৌন্দর্যকে কেবল রাঙাইয়া তুলিবার জন্য তাহার প্রয়োজন তাহাকে জ্বালাইয়া ছাই করিয়া তবে সে ছাড়ে; ফুলকে তুলিতে গিয়া তাহাকে ছিঁড়িয়া ধুলায় লুটাইয়া দেয়।’- (কাব্যে উপেক্ষিতা)

মোটকথা, সাহিত্য হচ্ছে মানুষের অন্তর্জগতের সাথে বহির্জগতের সমন্বয়কৃত এক সৃষ্টিশীল দলিল। অন্তর্জগতকে বাঙ্ময় করে তোলে বহির্জগতের গ্রাহ্যমান রূপক-উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে। তার সাথে রয়েছে সামাজিক পরিমণ্ডলের ঘাত-প্রতিঘাতের সমকালীন চিত্রময়তা। যেখানে মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিক জগতের মধ্যে টানপোড়েন নেই, জীবনের গূঢ় বাস্তবতার দর্শনগত রেখাচিত্র নেই, সমকালীনতা নেই, তা কী করে সাহিত্য হবে? সাহিত্য মানেই তো জীবনের রেখাচিত্র। আর জীবনের এই রেখাচিত্রে ব্যক্তির আকুতিই সমাজের দ্বন্দ্বমুখর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয় বলে ব্যক্তিক অনুভূতিই সময়ের দলিল হিসেবে সাহিত্যমাত্রা পায়। দুঃখ, কষ্ট, যাতনা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ক্ষোভ এসব তো প্রেমময় শব্দমালারই প্রতিভাষিক রূপ। তাই বৈচিত্র্যময় প্রেমানুভূতি বাদ দিয়ে ব্যক্তিক অনুভূতিও আসলে অর্থহীন।

ব্যক্তি তার সমাজ চেতনার মধ্যে থেকেই প্রকাশের আগ পর্যন্ত যে অভিব্যক্তি ধারণ করে তা তাঁর নিজস্ব হলেও প্রকাশের পরই তা আর একান্ত নিজের থাকে না, হয়ে উঠে সংশ্লিষ্ট সমাজ ও প্রকৃতিরই একটি প্রতিবিম্ব। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য মনে করি। তিনি তাঁর ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ নামক প্রবন্ধে বলছেন–
‘সাহিত্যে লেখক যাহার কাছে নিজের লেখাটি ধরিতেছে, মনে মনে নিজের অজ্ঞাতসারেও, তাহার প্রকৃতির সঙ্গে নিজের লেখাটি মিলাইয়া লইতেছে। দাশু রায়ের পাঁচালি দাশরথির ঠিক একলার নহে; যে সমাজ সেই পাঁচালি শুনিতেছে, তাহার সঙ্গে যোগে এই পাঁচালি রচিত। এইজন্য এই পাঁচালিতে কেবল দাশরথির একলার মনের কথা পাওয়া যায় না; ইহাতে একটি বিশেষ কালের বিশেষ মণ্ডলীর অনুরাগ-বিরাগ শ্রদ্ধা-বিশ্বাস রুচি আপনি প্রকাশ পাইয়াছে।
এমনি করিয়া লেখকদের মধ্যে কেহ বা বন্ধুকে, কেহ বা সম্প্রদায়কে, কেহ বা সমাজকে, কেহ বা সর্বকালের মানবকে আপনার কথা শুনাইতে চাহিয়াছেন। যাহারা কৃতকার্য হইয়াছেন তাহাদের লেখার মধ্যে বিশেষভাবে সেই বন্ধুর, সম্প্রদায়ের, সমাজের বা বিশ্বমানবের কিছু-না-কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। এমনি করিয়া সাহিত্য কেবল লেখকের নহে, যাহাদের জন্য লিখিত তাহাদেরও পরিচয় বহন করে।’

এ হলো সাহিত্যের সামাজিক রূপ। এর সাথে ব্যক্তিক প্রেমের বন্ধনটিও যে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যক্তির প্রেম হচ্ছে সেই বোধ যার সাথে সমাজের সমস্ত সম্পর্কই সক্রিয় থাকে, আবেশিত হয়, সামাজিক পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির মনোজগতে নতুন নতুন উপলব্ধি জন্ম দেয়। তারই সমকালীন প্রকাশ ঘটে সফল সাহিত্যে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার নান্নুর গ্রামের স্থানীয় বাশুলী দেবীর মন্দিরের বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ পুরোহিত চণ্ডীদাসের যে ব্যক্তিক প্রেম সামাজিকভাবে নিম্নবর্গীয় অন্ত্যজ রজকিনী রামী’র প্রতি ধাবিত হয়, চতুর্দশ শতকের বর্ণবিভাজিত সমাজ তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলো না। তখন সমাজে মনুর বিধানই যে অপ্রতিহত–
‘চণ্ডালশ্বপচানাং তু বহির্গ্রামাৎ প্রতিশ্রয়ঃ।
অপপাত্রাশ্চ কর্তব্যা ধনমেষাং শ্বগর্দভম্।।’
অর্থাৎ : চণ্ডাল, শ্বপচ প্রভৃতি অন্ত্যজ জাতির বাসস্থান হবে গ্রামের বাইরে। এইসব জাতিকে ‘অপপাত্র’ করে দিতে হয়; কুকুর এবং গাধা (রজক বা ধোবাদের বাহন) হবে তাদের ধনস্বরূপ। (অপপাত্র হলো যে পাত্রে ভোজন করলে তা আর সংস্কার দ্বারা শুদ্ধ করা চলবে না, তা পরিত্যাগই করতে হবে। অথবা তারা যে পাত্র স্পর্শ করে থাকবে তাতে অন্ন-শক্তু প্রভৃতি দেয়া চলবে না; কিন্তু পাত্রটি মাটির উপর রেখে দিলে কিংবা অন্য কোনও লোক তা হাতে করে ধরে থাকলে তার উপর ভাত-ছাতু প্রভৃতি দিয়ে মাটির উপর রেখে দিলে তারা ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে। অন্য অর্থে ভাঙা পাত্রকে অপপাত্র বলে)। (মনুসংহিতা : ১০/৫১)।

কিন্তু প্রেম তো আর জাত-পাত মানে না। চণ্ডীদাসের জন্মেরও প্রায় দুশো বছর আগের কবি জয়দেব তার সুবিখ্যাত ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনীশক্তি হিসেবে স্বরূপিনী ব্রজ গোপিকাকে যে রাধাকল্পনা করেছেন, বৈষ্ণব চণ্ডীদাসও রামী’র মধ্যে সেই রাধা কল্পনা করলেন। বেরিয়ে এলো তাঁর মানবমনের সেই শাশ্বত আকুতি– ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে মন ভোর, প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।’

কিন্তু এখানেই তিনি থেমে গেলেন না। ‘ব্রাহ্মণ চণ্ডীদাস এক নিবর্গীয় কন্যাকে মর্যাদা দিলেন, পুরোহিত পদ পরিত্যাগ করে কবি হলেন; সমাজের নিরাপদ উচ্চকোটির আসন থেকে রজকিনীর হাত ধরে ধুলোমাটির পথে নেমে এলেন, চিরন্তন প্রেমের মধুর অভিঘাতে আপন জীবনের পুনর্জাগরণ ঘটালেন।’ (কবি চণ্ডীদাস ও মানবতাবাদ/ ইমন জুবায়ের)। ফলে বেরিয়ে এলো তাঁর সেই অমর পঙক্তি- ‘চন্ডীদাস কহে শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।’

অতএব, ব্যক্তিক প্রেম-চেতনাই যে শেষতক সাহিত্যের সমাজ-চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তা অস্বীকার করার জো নেই। সমাজকে ভালোবাসা, দেশকে ভালোবাসা, জাতিকে ভালোবাসা মূলত মানুষকেই ভালোবাসা। আর এই প্রেম বা ভালোবাসার ফল্গুরূপটি হলো ব্যক্তির একান্তই এক অব্যক্ত প্রেমচেতনা। মনের গহীনে অদৃশ্য ভ্রমরের মতো গুনগুন করে যাওয়া এই বোধ আসলে সমস্ত অপ্রেমের বিরুদ্ধ অবস্থানে থাকা এক মানবিক বোধ। যা বাঙ্ময় হয়ে উঠে মানুষের সকল কর্মকাণ্ডে, দ্রোহে আর ভালোবাসায়। এটাই মানুষের কল্যাণময় শুভবোধ, যা সকল অন্যায় অবিচারকে প্রতিহত করতে এগিয়ে যায় মানবিক ঐশ্বর্য্য নিয়ে। এই মানবিক ঐশ্বর্য্য-মণ্ডিত যে সাহিত্যরূপ, যুগে যুগে রচিত সেই সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি তা মূলত মানুষের চিরায়ত এই শুভবোধেরই নান্দনিক উৎসারণ। এ ছাড়া সাহিত্য অচল। তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেন–
‘মানুষের জীবনে যেখানে প্রেমের শক্তি, ত্যাগের শক্তি সচেষ্ট সেখানেই সে সার্থক; নইলে সে আপন নিত্যরূপ পায় না, পদে পদে ছিন্নবিচ্ছিন্ন জীর্ণ হয়ে পড়ে। যেখানে সমাজের কেন্দ্রস্থল থেকে সেই প্রেম নানা কর্মে সেবায় আপনাকে প্রকাশ করে সেখানেই মানুষের সমাজ কল্যাণে শক্তিতে সুন্দর; যেখানে প্রেমের অভাব সেখানেই বিনাশ।’- (কালান্তর)

এই প্রেম ও কল্যাণকেই ধারণ করে সাহিত্য। এই কল্যাণব্রত নিয়েই সাহিত্য সমাজের অসুন্দরকেও তুলে ধরে তার অযথার্থতা আরোপ করতেই। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখার প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই এই কল্যাণময় প্রেমবোধই ব্যক্তিক চাওয়া-পাওয়া অতিক্রম করে এক শুভ সামাজিক চাওয়ার আর্তিকেই ধারণ করে আছে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন ফর্মায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আগামীর সাহিত্যের মর্মবাণীও হতে হবে তা-ই। কেননা, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–
‘মানুষ কেবল ক্ষুধাতৃষ্ণার দাস নয়, এখনো মানুষ চলছে; এখনো তার মহত্ত্বের উৎস শুকায়নি। মানুষের ইতিহাসের অন্তরে যদি মহতের কোনো স্থান না থাকত তবে মানুষের ইতিহাস এত অত্যাচার সহ্য করেও প্রাণশীল থাকত না। আজকের দিনে এই গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে এই-ই মানুষের আশ্বাসবাণী। সমস্ত সংঘাতের মধ্যেও কল্যাণের রূপ প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে– সমস্ত দুঃখের মধ্যে সমস্ত পাপের মধ্যে পুণ্যের আবির্ভাব এই আমাদের আশা।’- (কালান্তর)

অতএব, কোন সুনির্দিষ্ট কাল বা সাহিত্যবিশেষকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন না-করে এক-বাক্যেই এটা বলে দেয়া সম্ভব যে, ব্যক্তিক প্রেমবোধকে বাদ দিয়ে সাহিত্যে মানবিক অভিব্যক্তির সামাজিক প্রকাশ আদৌ সম্ভব নয় কখনো। যেভাবে আত্মারূপ ক্রিয়াটিকে বাদ দিয়ে বাক্যের অস্তিত্বকে কল্পনা করা অসম্ভব।  ভেতরের অবিমিশ্র তৈলটাকে বাদ দিয়ে দিলে তিলের আর থাকেটাই বা কী! সাহিত্য যেহেতু চূড়ান্ত বিবেচনায় ভাবপ্রকাশক ভাষারূপই, বাঙলা সাহিত্যও তো এর বাইরের কিছু নয়। আর এই সাহিত্য বলতে কেবল গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটককেই বোঝায় না, তার প্রাণভোমরা তো আসলে চিরায়ত দর্শন ও বিজ্ঞানই!

(১১-০৫-২০১৩)
(পরিবর্ধিত ০২-০৪-২০১৫)

No comments: