‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
Saturday, March 1, 2008
# চারুপাঠের মগ্নকিশোর (সাহিত্য)
চারুপাঠের মগ্ন-কিশোর
ও আমাদের কিশোর কবিতা
- রণদীপম বসু
এটা কোন ভূমিকা নয়
বাংলা সাহিত্যে কিশোর কবিতা নামে প্রচলিত কবিতা ধারাটি কবে থেকে কিশোর কবিতা হয়ে ওঠলো তা নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা থেকেই যায়। তবে তা যে কবিতা ঘরানারই কিছু, তা তো এর নামকরণ থেকেই বুঝা যাচ্ছে। এই কিশোর কবিতার জন্মকোষ্ঠী খোঁজার আগে আমরা বরং আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিই।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেেত্র অনেকগুলো দায় থেকে যায়। কাকে কিভাবে কেন এবং কখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে তা নির্ণয়ের েেত্র সম্ভাব্য বিপর্যয় আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তার উপরে ‘মালার্মের’ ‘শব্দই কবিতা’ নামের তত্ত্বীয় বিভ্রান্তির চড়টি যখন নিরীহ গালে এসে পড়ে তখন নড়েচড়ে বসবো কি, আরো বেশি অনিশ্চয়তার কূহকে জড়িয়ে পড়তে হয়। এক্ষেেত্র কিছুটা দিশা দেখতে পাই ইংরেজ কবি ‘কোলরিজের’ কথার মধ্যে- কবিতা হচ্ছে ‘শ্রেষ্ঠ শব্দের শ্রেষ্ঠ ব্যুহ’।
এতে আবার পাণ্ডিত্যের ভারে বিধ্বস্ত হয়ে যাবার আশংকাও প্রবল হয়ে ওঠে। শ্রেষ্ঠ শব্দ নির্বাচন করবে কে? এটাই কি কবি’র কাজ? এবং সেই শব্দ দিয়ে জটিল দূর্গ বানাবার দায় কেনই বা কবি নিতে যাবেন?
বরং কবি ও পাঠকের কাছে ‘দান্তে’র কথাটাই আপন মনে হয়- ‘সুরে বসানো কথাই হলো কবিতা’। মূলত কবিতার জন্ম তো প্রথমত গানেই। গীত হবার জন্য জনভাষ্যের প্রিয়তম শব্দ ও কথাগুলো যখন সুরে সুরে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তো, সেই গীতল কথা আর গীতিময়তাই ছিলো এর প্রাণ। তখনো তাকে কবিতা বলে কেউ চিহ্নিত করেনি বা এর প্রয়োজনও হয় নি।
চর্যার দোহাকাররা বিনোদন বা আরাধনার প্রয়োজনে যে সব দোহা সুরে সুরে গেয়ে ভাবজগতের তৃষ্ণা নিবারণ করে যেতেন সেগুলোই বাংলা সাহিত্যে আমাদের প্রাচীনতম নিদর্শন। বিনা বিতর্কে তাকেই আমরা গান বলি, ছড়া বলি, পদ্য বলি, বা যাই বলি না কেন উৎস সন্ধানে এর পেছনে যাওয়ার আর কোন তথ্য নিদর্শন আমাদের হাতে নেই। যেহেতু সেখানে সুরে সুরে গাওয়ার বিষয়টাই মুখ্য, ফলে দোল বা তাল নামের অনিবার্য যে প্রকরণটিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় থাকে না, তার নাম ‘ছন্দ’। আর এই ছন্দই হয়ে গেলো কবিতার মায়াবী জগতের চিরায়ত শব্দসঙ্গিনী, বহুবিচিত্র ছলাকলার মধ্য দিয়ে হাজার বছরের পথ চলায় যা শব্দকে করে তুলেছে বহুমাত্রিক অভিসারে মোহাচ্ছন্ন।
ছন্দের শাসন
রোম সম্রাজ্ঞী ‘কিওপেট্রা’ দৈহিক বা অবয়বগত সৌন্দর্য্যে কতোটা শিখরস্পর্শী ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত থাকলেও কিওপেট্রার চলনে বলনে বা জীবনাচারে এমন কি মৃত্যুতেও যে অভূতপূর্ব ঝলসানো চমক দিয়ে পরিপার্শ্বকে মোহাবিষ্ট করায় তাঁর জুড়িহীন ক্ষমতার উৎকর্ষতা ছিলো, তাতেই কিওপেট্রা চিরকালের কিংবদন্তী হয়ে সৌন্দর্য-দেবীর আসনে অধিষ্টিত। অন্যদিকে গ্রীক সুন্দরী ‘হেলেন’? অন্ধ চারণকবি হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড এর গীতল ব্যঞ্জনায় তৈরি এক কবিতা শরীরী নায়িকা। শ্র“তিকাব্যের গীতধর্মী ছন্দের দোলে মানুষের ভাবালু মনে তাই অনায়াসে জায়গা পেয়ে যায় সেই হেলেন অব ট্রয় সুন্দরীশ্রেষ্ঠার মোহর পরে।
এই যে ভাবালুতা, মানুষের মনোজগতের এক ব্যাখ্যাতীত সৌন্দর্য পিয়াস, তাকে আবার বীরত্বের প্রতিঅবস্থান বিবেচনায় এনে দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন ওই গ্রিসেরই বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো। তিনি তাঁর নগররাষ্ট্রের ধারণায় কবিদেরকে কোনো স্থানই দিলেন না। কিন্তু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে নিটোল ছন্দই কেবল ধারণ করতে পারে বলে প্লেটোর নগররাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবে রূপ না পেলেও মানুষের চিরায়ত মনোজগতে গীতিময় ছন্দ তার সব বৈভব নিয়েই স্থান পেয়ে গেছে ঠিকই। একইভাবে বহু শতাব্দী বহু সভ্যতা পেরিয়েও আমাদের চর্যার দোহা আজকের আধুনিক কবির চোখেও হরপ্পার চাঁদ হয়ে ফিরে আসে।
আমাদের সাহিত্যের লৌকিক বাংলায় ছন্দের প্রথম দোলাটা প্রথম কাকে কখন কোথায় কীভাবে দিয়েছিলো তা জানার সুযোগ না হলেও ‘খনা’ নামের আড়ালে মূলত লোকায়ত জনভাষ্যগুলোই যে মৃত্তিকালগ্ন জীবনলগ্ন হয়ে বহুকাল যাবৎ আমাদের জনরুচিকে চটুল নৃত্যে দুলিয়ে এসেছে তা সহজেই অনুমেয়। উঠতে বসতে বিবাহে যাপনে ফসলে বুননে হাসিতে আড্ডায় দুঃখে কষ্টে এক কথায় বাঙালি জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে শিক্ষণীয়, নিন্দনীয়, বিদ্রƒপ কটাক্ষ বা নির্দোষ মজা করার যে শ্লোকগুলো এখনো ভেসে বেড়ায় গ্রামবাংলার লৌকিক জনপদে মুখে মুখে, এগুলোর রচয়িতার নাম কেউ না জানলেও এতে ছন্দের চমৎকারিত্ব, বুদ্ধির ঝিলিক আর জীবনঘনিষ্ট শব্দের আশ্চর্য শক্তিমত্তায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ‘কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। অথবা ষোল চাষে মুলা/ তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান’ (খনার বচন)। আমাদেরই পূর্বপুরুষদের এই সৃষ্টিশীল উজ্জ্বলতাগুলো নিজস্ব ক্ষমতাশৈলীর জোরেই স্বমহিমায় টিকে আছে এখনো। শাসন করছে লোকায়ত মনোভূমিকে। এগুলোই বচন, শোলক বা ছড়া নামে সমধিক পরিচিত হয়ে আসছে।
খুবই লক্ষণীয় যে, প্রায় সব ছড়াতেই আমাদের লৌকিক কবিরা স্বরবৃত্তের হালকা চটুল ছন্দ ব্যবহার করেছেন। স্বরের স্বতঃস্ফূর্ত গতিদোলার সাথে স্বাভাবিক শ্বাসাঘাতের অনুরণনের মাধমে ছন্দশীল কথাগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এগিয়ে যায় বলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ছন্দকে প্রাকৃতিক বা লৌকিক ছন্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হালকা চালের এই ছড়াগুলোতে সমকালীন লোকজীবনের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকেও লোকায়ত জীবনধারার সাথে মিশিয়ে আশ্চর্য নিপুনতায় প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?/ ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কি?/ আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি।’
কিশোরকবিতা’র কোষ্ঠীবিচার করতে হলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত লৌকিক কবিদের এই লোকায়ত ধারাটিকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া চলবে না আমাদের।
ছড়া নাকি শিশুসাহিত্য
যোগীন্দ্রনাথ সরকার শিশুসাহিত্যে আমাদের এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম। লৌকিক বাংলায় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকায়ত বিশাল ছড়াভাণ্ডার থেকে নিটোল কিছু ছড়া সংগৃহীত হয়ে তাঁরই সম্পাদনায় যখন ‘খুকুমনির ছড়া’ নামে এক সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হলো, একই সাথে সাহিত্যের জলাঙ্গীতে শিশুসাহিত্য নামের এক নতুন কোমল জলক্ষত্রেও চিহ্নিত হয়ে গেলো। যদিও আমাদের সেই লৌকিক কবিরা হয়তো সুনির্দিষ্টভাবে শিশুদের জন্যেই লিখে যাননি তা, সেসব লোকায়ত ছড়া সবার জন্যেই রচিত ছিল, তা সবার ছড়া। তবু তা ছেঁকে ছেঁকে যোগীন্দ্রনাথ যা করলেন, তাতে করে ফলনযোগ্য যে চাষের বীজতলাটা দেখিয়ে দিলেন তিনি, মেধাবীজনের দৃষ্টি তা এড়িয়ে যায়নি। শিশুসাহিত্যের বিখ্যাত রায় পরিবারের সাহিত্যচাষীদের হাতে ওই ক্ষত্রেটাই নতুন চরের মাটি পেয়ে দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠতে লাগলো। বিশেষ করে উপেন্দ্রকিশোরের সুযোগ্য সন্তান সুকুমার রায় একে এমন রূপ দিলেন যে, শিশুসাহিত্যের জগতে সুকুমার ঘরানা বলে একটি নতুন ঘরানার জন্ম হলো।
পাশাপাশি তৎকালীন ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে সেই রেনেসাঁস সময়পর্বে বাংলাসাহিত্যের যে ধারাটি মধ্যযুগীয় সাহিত্যধারা ভেঙে আধুনিক সাহিত্যের বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করছিল, যা কালে কালে বাংলাসাহিত্যের অভিন্ন প্রধান ধারায় বিস্তার লাভ করে, এর ধারক-বাহক রথীমহারথীরা কিন্তু এই অর্বাচীন শিশুসাহিত্য নামের ত্রেটিকে ব্রাত্যজনের বালখিল্য প্রয়াস হিসেবে বরাবরই এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। সহজ কথায় পাত্তাই দেননি, যতদিন না বাংলাসাহিত্যের প্রাণপুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহের ছোঁয়া পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল এর। রবীন্দ্রনাথই এক লহমায় একে ব্রাত্যজনের দুর্নাম ঘুচিয়ে কুলীনসমাজে উঠিয়ে আনলেন। আর যায় কোথায়। সাহিত্যের সেকালের বাঘা বাঘা সব নমস্য ব্যক্তিই এরপর উঠেপড়ে লেগে গেলেন নতুন নতুন কর্ষণে। আর এভাবেই তাঁরা ত্রেটিকে উর্বর থেকে উর্বরতর করে স্বকীয় মহিমায় নিজেদেরকেও উজ্জ্বল করে তুললেন চিরকালের জন্য।
১. আয় আয় চাঁদ মামা/ টিপ দিয়ে যা/ চাঁদের কপালে চাঁদ/ টিপ দিয়ে যা/...
২. আয়রে আয় টিয়ে/ নায়ে ভরা দিয়ে/ না’ নিয়ে গেল বোয়াল মাছে/ তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে/...
৩. নোটন নোটন পায়রাগুলি/ ঝোটন বেঁধেছে/ ওপারেতে ছেলেমেয়ে/ নাইতে নেমেছে।/...
৪. বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান,/ শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো তিন কন্যা দান।/ এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন এক কন্যা খান,/ এক কন্যা গোস্বা করে বাপের বাড়ি যান। এবং
৫. ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়াল বর্গী এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?/...।ব্রাত্যজনের উল্লিখিত এই পাঁচটি ছড়া কিন্তু সেকালের সাহিত্যকুলীনদের হেলাফেলার ময়লা সরিয়ে শেষ পর্যন্ত একালে এসে আমাদের শিশুকিশোরদের স্কুলের পাঠ্য হয়ে চিরায়ত লোকছড়ার মর্যাদা পেয়েছে। পাশাপাশি ব্রাত্য আর কুলীনের ভেদ মুছে সে সময়কার প্রধান প্রধান সব কবিদের অনেক রচনাই আগেপরে স্কুলপাঠ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে চিরায়ত শিশুকিশোর চিত্তকে নিরন্তর কলধ্বনিতে ভরিয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- নানান্ দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা/ পুরে কি আশা? (স্বদেশী ভাষা/ রামনিধি গুপ্ত); বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়/ সর্ব জীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়... (কে?/ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত); সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।... (আমার পণ/ মদনমোহন তর্কালঙ্কার); রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে/ শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে... (রসাল ও স্বর্ণলতিকা/ মাইকেল মধুসূদন দত্ত); চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে?... (বুঝিবে সে কিসে/ কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার); পারিব না একথাটি বলিও না আর/ কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার... (পারিব না/ কালীপ্রসন্ন ঘোষ); তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে/ মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়/ একেবারে উড়ে যায়/ কোথা পাবে পাখা সে?... (তালগাছ/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
এভাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নন্দলাল, ধনধান্য পুষ্পভরা, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের কাজের ছেলে, মজার দেশ, অতুল প্রসাদ সেনের মোদের গরব মোদের আশা, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কাজলা দিদি, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মানুষ জাতি, ছিন্নমুকুল, সুকুমার রায়ের ষোল আনাই মিছে, বাবুরাম সাপুড়ে, গোলাম মোস্তফার বনভোজন, শিশুর মন, কাজী নজরুল ইসলামের খুকি ও কাঠবেড়ালী, সংকল্প, জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে, জসীমউদ্দীনের মামার বাড়ি ইত্যাদি। এ তালিকা অনেক লম্বা এবং অধিকাংশেরই একাধিক কবিতা পাঠ্য বইয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
এই দীর্ঘ তালিকায় পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, একই সাথে ছড়া, পদ্য ও কবিতাগুলো কীভাবে পাশাপাশি স্থান পেয়ে গেছে। এগুলো যে আমারই ইচ্ছাকৃত ক্রমবিন্যাস বা সংযোজন, তা কিন্তু নয়। সে সময়কালে ছড়া পদ্য কবিতায় এমন কোন বিভেদ ছিল না। বিভেদগুলো তৈরি হয়েছে পরে।
বিশ্বসাহিত্যের বোদ্ধা পাঠকমাত্রই জানেন যে, যে কোন ভাষার সাহিত্যই তার হয়ে উঠা’র প্রাথমিক পর্বে একটা সমন্বিত রূপ নিয়েই যাত্রা শুরু করে। তারপর কালে কালে তা হওয়া না হওয়ার বিস্তৃততর দ্বন্দ্বমুখরতায় এসে বিভিন্ন সঙ্ঘে ভাগ হয়ে একদল আরেকদলের বিরুদ্ধে এতোটাই উচ্চকিত হয়ে উঠেন যে যুক্তি পাল্টা যুক্তির খণ্ডনে বিখণ্ডনে শেষ পর্যন্ত নানা সাহিত্যতত্ত্বের জন্মঘটনায় উপনীত হয়। সাহিত্যের মননশীল চলিষ্ণুতায় এটাকে খাটো করে দেখার কোন উপায়ও নেই। নতুন নতুন চিন্তা নতুন নতুন ভাবনা এবং নতুন ধারণাগুলো এভাবেই সবকালে সবদেশের সাহিত্যস্রোতকেই বেগবান করে এসেছে। উত্তরোত্তর আধুনিকায়ন ঘটিয়েছে, সাহিত্যে সমকালীনতার জন্ম দিয়েছে।
বর্তমান আলোচনায় খুব একটা প্রাসঙ্গিক না হলেও এটা জেনে রাখা দরকার যে বিশ্বসাহিত্যে বিরাট সময়কাল নিয়ে পরিবর্তিত প্রেেিক্ষত সাহিত্যতত্ত্ব বা সাহিত্যদর্শনের েেত্র উদ্ভুত এসব নতুন নতুন তত্ত্ব যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে পরবর্তীতে। আধুনিকতা বা মডার্নিজম, কাঠামোবাদ বা স্ট্রাকচারালিজম, মনোসমীক্ষণবাদ বা সাইকোএনালাইসিজম, দাদাবাদ/ পরাবাস্তববাদ বা দাদাইজম/ সুররিয়্যালিজম, অস্তিত্ববাদ বা এক্সিস্ট্যান্সিয়ালিজম, মার্কসবাদ বা মার্ক্সিজম, উত্তর কাঠামোবাদ/ বিনির্মাণ বা পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম/ ডিকনস্ট্রাকশন, উত্তর-আধুনিকতা বা পোস্ট মডার্নিজম, উত্তর-উপনিবেশবাদ বা পোস্ট কোলোনিয়ালিজম ইত্যাদি।
আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেেত্র ইদানিং তত্ত্বের ঢেউগুলো এসে উল্টোপাল্টা দোলাধাক্কা দিতে শুরু করলেও কিশোরকবিতার সমকালীন সাহিত্যে এ ধরনের কোন সমালোচনামূলক তত্ত্বসাহিত্য গড়ে উঠার অবকাশ এখনো তৈরি হয়নি বা এ নিয়ে ভাবার চেষ্টাও কেউ কখনো করেননি। আর করেননি বলেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিশুতোষ ছড়াকে সেই যে টোলপণ্ডিতের একচালা থেকে কিশোরকবিতার পাঠশালায় বসিয়ে দিয়ে গেছেন, সেই থেকে কে কয় কাশ ডিঙাতে পারলাম কি পারলাম না বা ফেল মারলাম তার হাজিরা ভুলে কোন্ পণ্ডিতের টিকি কতটুকু লম্বা বা কারটা কাটা গেল কি গেল না এই তর্কে তর্কে তর্কালঙ্কার সাজবার খেলায় মত্ত রয়ে গেছি আমরা এখনো। সুযোগ পেলে তা অন্য সময় অন্য পরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে।
কিশোরকবিতা না কি সবার কবিতা
শিশুসাহিত্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথের তরুণ মন ও পরিণত মনের একটি যোগসূত্র রচিত হয়েছে। ছোটদের জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রথম লিখতে আরম্ভ করেন বাংলা ১২৯২ সালে, বালক পত্রিকায়। এর অনেকগুলো কবিতাই ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, সোনার তরী, ইত্যাদিতে ছড়িয়ে আছে। মাতৃহারা নিজ শিশুদের সান্ত্বনা দেবার জন্য পরে আরো কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন তিনি যা পরবর্তীতে শিশু নামে বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৩১০ সালে।
তাঁর এই কবিতাগুলোর মধ্যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। বই আকারে বাল্যজীবনের স্মৃতি, মাতার বাৎসল্যের স্নেহধারা, পিতার হৃদয়ের প্রতিফলন, মাতার কোমল-সুন্দর অভিব্যক্তি- এসবই বারবার রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে। সেসব কবিতা ভাবে ব্যঞ্জনায় একাধারে বড়দের এবং ছোটদের। এজন্য রবীন্দ্রনাথের ছোটদের কবিতাকে শুধু ছোটদের বললে খণ্ডিত করা হবে- এই সব কবিতা প্রকৃত অর্থে চিরকালের কবিতা, সকলের কবিতা। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ সেরা কিশোর কবিতা/ আমীরুল ইসলাম)।
চিরায়ত কবিতা হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের যে কিশোরকবিতা বা গানটি দেশাত্মবোধের এক উৎকর্ষ সঙ্গীত হিসেবে গীত হয়ে থাকে এবং স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কবিতা হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে- ধনধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা/ ও যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা...। এটি কি শুধুই কিশোরকবিতা? বড়দের নয়?
করিতে পারি না কাজ/ সদা ভয় সদা লাজ/ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে/ পাছে লোকে কিছু বলে...(পাছে লোকে কিছু বলে/ কামিনী রায়)। এটা কি বড়দের কবিতা নয়?
অথবা অতুলপ্রসাদ সেনের- মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা/ তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা... এটাকে কোন্ দলে ফেলবো? এটা কি সবার নয়?
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?... পাঠের সাথে সাথে কি আমাদের বড়দের চিরকেলে কিশোর মনে হারিয়ে যাওয়া দিদিটার জন্য প্রাণটা কেঁদে উঠে না?
অথবা, এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে... পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের কবর নামের বুকভাঙা যন্ত্রণার এই কবিতা কি শুধুই কিশোরকবিতা?
বাংলা কাব্যে রবীন্দ্র বলয়ের প্রভাবমুক্ত হতে কবিতায় পশ্চিমা আধুনিক ভাবধারার সংযোজন করে যাঁরা বাংলা কবিতায় আধুনিকতার অগ্রপুরুষ বলে বিবেচিত, ত্রিশের দশকের সেই পঞ্চপাণ্ডবদের সবচেয়ে অগ্রবর্তী কবি জীবনানন্দ দাশ। মৃত্যুর পর প্রকাশিত রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি বাংলাসাহিত্যের তথা বাংলাকাব্যের অমূল্য সম্পদ। অথচ কী আশ্চর্য, আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়- হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে... কবিতাটি পাঠ করার পর যদি কেউ জেনে যান ওটা কিশোর কবিতা- তাইলে বড় হয়ে যাবার আক্ষেেপ কার না মন চাইবে আবার কিশোর হয়ে কবিতাটি বুকে মেখে নিতে!
এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি টানা যাবে যেগুলো পাঠে নিবিষ্ট পাঠক কোন বিভাজন রেখা টানতে পারবেন না যে এটা বড়দের জন্য লিখিত নয় বা ছোটদের জন্য নয় কিংবা সবার জন্য বা চিরায়ত নয়।
কবিতার যে চরণ ছোটবড় নির্বিশেষে সবার মনে দোলা দিতে থাকে, যে শব্দ তার মায়াবী পর্দা দিয়ে ছোটবড় সবাইকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, হাসায়, কাঁদায়, আমাদের ভেতরে অন্য এক আমি-কে কোথায় যেন নাড়া দিয়ে যায়- সেটা যদি সবাইকে নিজের নিজের মতো করে স্পন্দনে অনুরণিত করে, তবে সে-ই তো কবিতা, সবার জন্যে কবিতা।
আমাদের প্রত্যেকের বুকের গভীরে একটা করে শিশু বা কিশোরমন খুব সংগোপনে চুপটি মেরে থাকে কোন বিশেষ মুহূর্তে উতলা হয়ে উঠার জন্য। আমরা প্রত্যেকেই যে এক একজন কিশোর। বিশ্বখ্যাত মনঃসমীক্ষণবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে ব্যক্তির চলনবলন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তথা গোটা ব্যক্তিত্বটিই নির্ধারিত হয় তাঁর কিশোর সত্ত্বার অবদমিত ইচ্ছা অনিচ্ছার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে ভিত্তি করে। এই কিশোর সত্ত্বাটিকে যিনি সযতœ লালনের মাধ্যমে তৃপ্ত পরিতৃপ্ত ও বিকশিত করে তুলতে জানেন তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আর যে কবি এই চিরায়ত কিশোরটির জন্য লিখে ফেলেন কোন অমর পঙক্তি সেটিই তো হয়ে যায় সবার জন্য কবিতা। সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের কবিরা এই অন্তর্লীন মনোরাজ্যের ওপরই জোর দিয়েছিলেন। কিশোরকবিতার মূল সুরটিও সেখানেই নিহিত। এজন্যেই সেই কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে হয়, সার্থক কবিতা এবং সবার জন্য কবিতা।
আধুনিকতা বা অন্য কোন তাত্ত্বিক নামে কবিতায় দুর্বোধ্যতা বা অবোধ্যতার পরিচর্যা করে যারা বিরাট কিছু সাজতে চান, তারা সাজুন। যেমন খুশি তেমন সাজার মৌলিক অধিকার সবারই রয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত আঁতলেমী দেখিয়ে যখন কেউ কিশোরকবিতা বা চিরায়ত কবিতার এই ধারাটিকে নাবালকের সাহিত্য বা অপরিণত সাহিত্য বলে টিটকারী করেন, তাঁদেরকে নিশ্চয়ই এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া অনুচিত হবে না যে- জনমানুষের সহজ সাধারণ বোধের ঘরে নাড়া না দিয়ে কোন সাহিত্যই কখনো টিকে থাকতে পারে না। তত্ত্ব ভারাক্রান্ত আঁতেলসাহিত্য ক’জন আঁতেলের সাময়িক ভোগবিলাসের মাধ্যম হয়ে শেষে যে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবার নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তাকে কোন্ জনরুচি ফিরিয়ে আনবে! এতো যে বিদগ্ধ গম্ভীর আর সীসার মতো ভার নিয়েও কুলীনসর্বস্ব সেই দেবনাগরী সংস্কৃতভাষা এখন আরিক অর্থেই মৃত, সেটা কেন? ব্রাত্যজনের প্রাকৃত ভাষা কালে কালে পুষ্ট পরিপুষ্ট হয়ে আজ যে এই সতত সঞ্চারিনী আ-মরি বাংলা ভাষা হয়ে আমাদের বুকের ভেতরে বাঁশি বাজায়, সে তো সত্যিকার জনভাষ্যকে ধারণ করেছে বলেই। তাই, কী থাকবে আর কী থাকবে না তা কাল-নির্ধারিত হলেও আমজনতার হৃদয়জ স্পন্দনই যে কালান্তরের সঞ্জীবনী রস তা না বুঝলে বা অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকবে না।
তবে হ্যাঁ, কবিতা তখনই, যখন সে কবিতা হয়ে উঠে। এই হয়ে উঠার সুলুকসন্ধানে কবিকে প্রতিনিয়ত পঠনপাঠন আর শ্রমনিষ্ঠ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিরন্তর নবায়নযোগ্য হয়ে উঠতে হয়। নিজেকে মুহূর্তে মুহূর্তে নির্মাণ করেই যেতে হয়। সময়ের স্পন্দনকে বুকে ধারণ করতে হয়। মুই কী হনুরে হয়ে আত্মসুখে যে কবি তৃপ্তমুর্খতায় থেমে যান বা নিজেকে নবায়নের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন স্রোত তাকে ফেলেই চলে যাবে। রিটায়ার্ড সাঁতারু হিসেবে জলেক্ষেত্রর অধিকার তার ত্যাগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। নইলে বর্তমানের বর্জ্য প্রসবদোষ তাঁকে দুষণকারী হিসেবেই কালের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। কেউ যদি ভেবে থাকেন চিরকালের কিশোররা তো কিশোরই অর্থাৎ ছোটই থাকবে, তাই সত্যযুগের আলুভর্তা দিয়ে আরেকটা শতাব্দী চালিয়ে দেয়া যাবে, তাঁরাই ভুল করলেন। আলুটা ঠিক থাকলেও আলুর আরো বিচিত্ররসের ব্যঞ্জন তৈরিটাও শিখে নেয়া উচিৎ। অন্তত ভর্তাটার রসাস্বাদনের রুচিটাকে আরো উন্নত করে নেয়া অত্যন্ত জরুরি। আগামীকালের তৃষ্ণার্ত জিহ্বা কি গতকালের বাসি খাবারের আস্বাদনে রাজি হবে?
কিশোরকবিতার হয়ে উঠা
রবীন্দ্রনাথই কিশোরের পদ্যে প্রথম কিশোরকবিতার ঝংকার আনলেন। পদ্যের গৎ ভেঙে কথার চমক, বিষয়বৈচিত্র্যের চমৎকারিত্ব, শব্দের দ্যোতনা, ভাবের ব্যঞ্জনা, কিশোর মনের কল্লোলিত কল্পনার উড্ডয়নধর্মীতা, কষ্ট, আবেগ, আর প্রকরণ কৌশলের অভিনিবেশ ঘটিয়ে কিশোরকবিতায় যে পাখনা এটে দিয়েছেন তাতে স্বতন্ত্র মহিমায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো কিশোরকবিতার জগৎ। প্রাণপুরুষ হিসেবে সাহিত্যের আরো বহু বহু েেত্রর মতো কিশোরকবিতাকেও প্রাণদান করে সম্ভাবনার বহুবর্ণিল আকাশে একে ডানা মেলিয়ে ছেড়ে দিলেন কবি।
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে... এরকম বিবরণধর্মী পদ্যনদী পেরিয়ে তিনি যখন কিশোরকে কবিতার পালকিতে এভাবে বসিয়ে দেন- মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/ তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা চড়ে... তখন কিশোরমন আর গণ্ডিবাঁধা দেশের সীমায় আবদ্ধ থাকে না। সেও বীরপুরুষ হয়ে যায়। অনেক উঁচু লম্বা হয়ে যায়। তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে/ মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়/ একেবারে উড়ে যায়/ কোথা পাবে পাখা সে? কিন্তু মনে যে পাখা জুড়ে দেন তিনি, সেই পাখায় ঠিকই উড়াল দিতে শিখে যায় সে।
এভাবে উচ্ছল কলকাকলিতে ভরে উঠতে লাগলো কবিতার আকাশ। সমসাময়িক এবং তারপরের কতো কবিতাপাখির আগমনে মুখর হতে লাগলো কিশোরকবিতার স্বচ্ছ নীল জগৎ। শিশুমনের চঞ্চল অভিব্যক্তির দূরন্ত প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কাঠবেড়ালি হয়ে যায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বিষয় ও প্রকরণের চমৎকার নমুনা- কাঠবেড়ালি কাঠবেড়ালি পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়মুড়ি খাও? দুধভাত খাও? বাতাবী নেবু? লাউ?/ বিড়াল বাচ্চা কুকুর ছানা? তাও... কী অদ্ভুত আধুনিকতা চলে আসতে লাগলো কিশোরকবিতায়! প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বোন হারানো চিরায়ত কষ্টের কান্নাটাকে এমন আবেগ দিয়ে আর কে আঁকবেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছাড়া?- বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই? অথবা মাইকেলীয় উচ্চারণে যখন ঘনিয়ে উঠে- রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে/ শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে/ নিদারুণ তিনি অতি/ নাহি দয়া তব প্রতি/ তেঁই ুদ্র- কায়া করি সৃজিলা তোমারে। অথবা সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে... তখন কিশোরকবিতার সরল জলেও ছলকে উঠে অচেনা ঢেউ আর সনেটের ঝংকার! আর সুনির্মল বসু তো ভেতরের চির কিশোর মনটাকে নিয়ে কবিতার পাঠশালায় একেবারে সবার ছাত্র হয়ে উঠেন- বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর/ সবার আমি ছাত্র/ নানানভাবে নতুন জিনিস/ শিখছি দিবারাত্র।
রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ প্রশ্রয় নিয়ে সাহিত্যের মূল ধারার সব কবিই এই যে কাব্যের পাঠশালা খুলে বসলেন, সেখানে তাঁরাই শিক্ষক তাঁরাই ছাত্র। বড়দের জন্য অতিমননশীল কিছু সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সবার জন্য ব্যাপকভাবে চিরায়ত সাহিত্য বা কাব্য করতে গিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা আর নতুনত্বের আস্বাদন চাখতে চাখতে কখন যে এক বিরাট কাব্যভাণ্ডার গড়ে তুললেন এঁরা, যা নাকি পাঠাস্বাদনে আপামর সবাই সক্ষম ছিলেন। এবং এটাই যে সাহিত্যের একটি বিশাল ধারায় পরিণত হয়ে উঠলো, ফুলে ফুলে বিকশিত হয়ে উঠলো, সঙ্ঘতত্ত্বের ছুরি-কাঁচিগুলো তখনো বাংলাসাহিত্যে হয়তো দূরের অচেনা অতিথি হয়েই ছিলো বলে আলাদা কোন ভেদরেখা স্পষ্টভাবে নিরূপিত হয়নি তখনো। এঁরা যা করেছেন সবার জন্যেই করেছেন। ছন্দ, প্রকরণ, শব্দবিন্যাস, নন্দনরস ও বিষয়বৈচিত্রের মশলায় তৈরি ব্যঞ্জন চেখে নেয়ার অধিকার সবার জন্যেই রেখেছিলেন উন্মুক্ত করে। চিরায়ত জনরুচিকে সমন্বিত করে পঙক্তিভোজনের এই যে উৎসব, তাই সাহিত্যের চিরায়ত ধারা। যদি কবিতার কথা বলি, একে নির্মাণে বিনির্মাণে রুচিবান করে গড়ে তুলেছেন এঁরাই। বাংলা কাব্যে রাজত্ব করে যাওয়া বিশ শতকের এই সব প্রধান অপ্রধান কবিদেরই প্রাপ্য এই স্বীকৃতি। কবিতার তর্ক নিয়ে তখনো হুলুস্থূল বাঁধাননি এরা। মনন মেধা আবেগ দিয়ে অনর্গল লিখে গেছেন পঙক্তির পর পঙক্তি। কোনটা পদ্য, কোনটা ছড়া এবং এগুলো থেকে কখনো বা ঝলসে উঠেছে কবিতার তরুণ রশ্মি। কিন্তু কোন্ ধারাটা কার চেয়ে ছোট বা বড়, কোন্টা বেশি সম্মানের বা কম সম্মানের এসব বিভেদ বাহুল্যবোধে আক্রান্ত হয়েছি আমরা অনেক পরে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজচিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং নাগরিক চেতনায় গতিময়তা, পাশ্চাত্য দর্শনভাবনা, জাতীয়তাবোধের নতুন নতুন উন্মেষ এই সব টানাপোড়েনের ছোটবড় ঢেউগুলো যখন আধুনিক জীবনবোধের বেলাভূমিতে একের পর এক ভেঙে পড়তে লাগলো, অনিবার্যভাবে এর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াগুলো ভীষণভাবে প্রভাবিত করতে লাগলো আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির গতিপথকে। যদিও আগেও এর কিছু কিছু প্রভাব প্রচ্ছন্নভাবে হলেও চিহ্নায়িত হয়েছিলো, কিন্তু আজকের তীব্র বিভাজন যে যাপিত জীবনে যন্ত্র আর নগরসভ্যতার পরিপূরক হয়ে চেপে বসেছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
দেশ বিভাগ, ভাষার লড়াই, স্বাধিকার, স্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদ এইসব দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রোপট জীবনবোধের সাথে সাহিত্যবোধটাকেও ওলটপালট করে দিয়েছে। তাই এর ব্যাখ্যার ধারাও পাল্টে গেছে একইভাবে। জীবনটারও বিভাজন ঘটে গেছে শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের কালখণ্ডনের মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি আধুনিক শিা ও সমকালীন চেতনাবোধও বিরাট প্রভাবক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের সামগ্রিকতার ফাঁকে ফাঁকে খণ্ডায়নের প্রতীক হয়ে।
কিশোরকবিতা যে এখনো সবার জন্য কবিতা, এটা মননজীবীদের মধ্যে এখন আর কেউ মানতে নারাজ। সময়ের প্রেেিক্ষত প্রেক্ষতিও বদলে গেছে। দূরবীক্ষণ আর আনুবীক্ষণিক দৃষ্টি এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী। বিভিন্ন তত্ত্ব এখন আর দূরের বিষয় নয়; মননজীবীতার একান্ত নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। তাই স্বাধীনতা উত্তরকালের কবিতার প্রোক্ষপটটাকে সমকালীনতার দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিশ্লেষণ করতে হয়। নইলে যে কিশোরকবিতার চারুপাঠ সম্পন্ন করা বা ভিন্নার্থে শুরুটাই হয়ে উঠবে না।
তার আগে ‘কবিতা’ কেন?
কবিতা কেন, এই প্রশ্নের বিপত্তিটা এড়িয়ে যদি প্রশ্ন হয়, কেন কবিতা নয়? বিপত্তি থেকেই যায়। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে যুগে যুগে বহু কবিকে বহুভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে সদুত্তরের আশায়। এক কথাতে এর বেরিয়ে আসেনি। বহু সন্দর্ভ রচনা হয়ে গেছে, কবিতা খুঁজতে গিয়ে আরো বহু কবিতার জন্ম হয়ে গেছে। কিন্তু মীমাংসাটা অধরাই থেকে গেছে। প্রশ্নের পিছে আরো প্রশ্নই জমা হয়েছে- যাকে কাব্য রসিকজন নাম দিয়েছেন ‘কাব্যের নন্দনতত্ত্ব’।
নন্দনতত্ত্ব আমাদের এখনকার আলোচনার বিষয় নয়। তবে কবিতা কী, এটার একটা ধারণা পাওয়া আমাদের আবশ্যক, কবিতা বুঝার জন্যেই। রসজ্ঞরা বলে থাকেন, ভাব থেকেই কবিতার জন্ম; কিন্তু নিছক ভাবালুতা কবিতা নয়। অর্থাৎ ভাবালুতা ও কবিতা পরস্পরবিরোধী দু’টো চিহ্নক। অন্যদিকে ভাব এবং কবিতা পরস্পর পরিপূরক। ভাবের চেহারাটা কেমন? জানি না। কবিতার চেহারা? কতকগুলো শব্দের সংগঠন। অর্থাৎ শব্দের পর শব্দ সাজিয়েই কবিতা। যেখানে ভাব থাকবে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যাওয়াতেই কবিতা নয়; ভাবের উপস্থিতি আবশ্যক। প্রশ্ন এসে যায়, সেই ভাবটিকে কীভাবে প্রকাশ করবো? ভাব তো কোন আকার নয়। কবি প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য থেকেই তাঁর কবিতার রসদ সংগ্রহ করেন। চেনা দৃশ্যটা কি কবিতা? তাও নয়। এই চেনার মধ্যে অচেনার মিশেল দিয়ে শব্দে শব্দে এক আলো-আাঁধারির জগৎ রচনা করেন তিনি। ফলে বদলে যায় অর্থবোধকতা। যেহেতু সোজাসাপ্টা কথা নয়, আলো-আঁধারির মায়াবি রহস্যে এর অর্থগুলো পাঠক থেকে পাঠকে পরিবর্তন হতে থাকে। সেই অচেনা মিশেলটাই কবিতা। তাই বুঝি ম্যাকলিশের বিখ্যাত পঙক্তি- কবিতা কিছু বোঝায় না/ কবিতা হয়ে উঠে। বোঝাতে গেলে বাহুল্যদোষে সেটা আর কবিতা থাকে না। অর্থাৎ কবিতা শব্দে শব্দে অক্ষরে অক্ষরে অংকিত কোনো চিত্র নয়, চিত্রকল্প। জীবনানন্দ যাকে বলেন: উপমাই কবিত্ব। এই চিত্রকল্পকেই তিনি উপমা বলেছেন। ফলে চিত্রকল্পের ব্যবহারে কবিতা এক প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠে। এর সাথে প্রকাশ প্রকরণ ও বিষয় প্রকরণ কবিতাকে দেয় চমৎকারিত্ব। তারপরেও কবিতা কেন কবিতা- সব সময় তার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়; উপলব্ধিজাত তুরীয় অভিজ্ঞতা দিয়েই তা বুঝে নিতে হয়।
ইচ্ছে করলেই কবিতা হয় না বা লেখা যায় না। কবিতা অবশ্যই একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনা। কিন্তু কবিতায় উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো যদি কবি মাথায় না রাখেন বা এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ও নিরন্তর সাধনা না থাকে কবিতার নাগাল পাওয়া কঠিন। এজন্যেই বলা হয়, কবিতাতেই কবির পরিচয়।
কিশোরকবিতার ক্ষেেত্র আবার ভাবালুতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কবিতার বৈশিষ্ট্যকে প্রচ্ছন্নভাবে নিয়ে আবেগের মিশেলে কিশোরের ভাবনাজগতের মনস্তাত্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াগুলো যদি প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করা না যায় তবে তা কিশোরকবিতা হবে না। আধুনিক কবিতায় ছন্দপ্রকরণের বিষয়টি ঐচ্ছিক হলেও কিশোরকবিতা এখনো তা থেকে মুক্ত নয়। এখন পর্যন্ত তা শুদ্ধভাবে মান্য হয়ে এলেও তা যে বাধ্যগত তাও কিন্তু নয়। অন্তর্গত ছন্দটাই কিশোরকবিতার প্রাণ।
এসব কিছু বিবেচনা করলে কিশোরকবিতা রচনা সবচেয়ে কঠিন ও সংবেদনশীল একটা নির্মাণকাজ। আর তাই বোধ করি কিশোরকবিতার সেই কবিগুরুর হাত ধরে তার জন্মলগ্ন থেকেই এ যাবৎকাল যত উৎকর্ষ সাধন, চমৎকারিত্বে নৈপূণ্য প্রদর্শন, পরীক্ষানিরীক্ষায় নতুন ভাবনার প্রয়োগ ও ইতিবাচক রূপায়ন ঘটেছে, তার প্রতিটা বাঁকে সবটুকুর জন্যেই সে মূলধারার কবিদের কাছেই ঋণী। কিশোরকবিতাকর্মীদের অবদান এেেত্র নাই বললেই চলে। কিশোর সন্তানকে শাসনে আদরে সজ্জায় ওই কবিরাই সময়ে সময়ে পথ দেখিয়েছেন, চালিত করেছেন এবং এখনো ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে স্নেহসঞ্চারিনী হাত বাড়িয়ে পরিপুষ্টতায় সহায়তা করে যাচ্ছেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কিশোরকবিতার নতুন পাঠ
সেই যোগীন্দ্রনাথ সরকার থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের হাত ঘুরে আমাদের স্বাধীনতাপূর্বকাল পর্যন্ত ছড়া কবিতা নাম দিয়ে প্রায় শত বছরের প্রত্য চর্চিত ছন্দ মাধ্যম হিসেবে এতোদিনকার নির্মিত ছড়া পদ্য কবিতা এক কাতারে এক পঙক্তিতে বসে আড্ডায় মেতে পাঠক রুচিকে তৃপ্ত করে গেছে নির্বিরোধ; বহুদিন। তাতে কোন সমস্যা হয়নি, প্রশ্নও উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক বিনির্মাণপর্বে নতুন জল হাওয়া মাটিতে শিশুকিশোরসাহিত্যে নতুন জোয়ার দেখা দেয়ার সাথে সাথে যে বিতর্কটিও দানা বাঁধলো, ছড়া ও কবিতার চারিত্র্য নির্ধারণ করা। বিভাজনটা স্পষ্ট হয়ে গেলো ছড়ার চরিত্র ও কবিতার বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা আরোপ করে। একই সাথে শিশুতোষ ছড়া ও কিশোরকবিতার পার্থক্যও সূচিত হয়ে গেলো। এসবের নির্মাণকর্মীদের মধ্যেও একইভাবে দু’টো স্বতন্ত্র ধারা তৈরি হয়ে নির্মাণচর্চা অব্যাহত থাকলো।
ছড়ায় চৌকস শব্দের চটুল ছান্দিক ব্যবহারে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ, হাসি-কৌতুক ইত্যাদি তো থাকবেই, উদ্ভট কল্পনার অদ্ভুত চিত্রনির্মাণও থাকবে। এতে সামাজিক অসঙ্গতির পাশাপাশি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্যারিকেচারও থাকতে পারে। কিন্তু কবিতাকে তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সংহত থাকতে হবে।
সুকুমার রায়ের ননসেন্স বা ফান ছড়া এবং অন্নদাশঙ্কর রায়ের রাজনৈতিক সামাজিক ছড়াকে প্রতিকল্প করে রোকনুজ্জামান খান, আবদার রশীদ, ফয়েজ আহমদ, সুকুমার বড়–য়ার মতো প্রসিদ্ধ ও ব্যতিক্রমী ছড়াকারদের পাশাপাশি এবং পরবর্তীতে বহু মেধাবী ছড়াকর্মী এ অঙ্গনকে পরিপুষ্ট করে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যকে উত্তরোত্তর উজ্জ্বল করেছেন। এেেত্র পরবর্তীতে যারা যুক্ত হয়ে প্রসিদ্ধ হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন এখ্লাস উদ্দীন আহ্মদ, আবু সালেহ, ফারুক নওয়াজ, লুৎফর রহমান রিটন প্রমুখ। এছাড়া কবি শামসুর রাহমানেরও প্রচুর অবদান রয়েছে এখানে। আরো অনেকেই রয়েছেন, কিন্তু এখানে কোন তালিকা বিন্যাস এ রচনার উদ্দেশ্য নয়।
কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালের আধুনিক কিশোরকবিতা নির্মাণের প্রথম পর্বে এগিয়ে এলেন আবারো সেই স্বনামখ্যাত কবিরাই যাঁরা মূলস্রোতের কাব্যভাবনাকেও নিয়ন্ত্রণ করছেন তখন। এেেত্র প্রথমেই যাঁর নাম চলে আসে, তিনি কবি আহসান হাবীব। কী প্রকরণে, কী ছন্দে, কী শব্দের ব্যবহারে সবকিছুতেই এমন আধুনিকমনস্কতা ও নতুনত্ব নিয়ে এলেন যে, চমকে যেতে হয়। তাঁর তিনটিমাত্র কিশোরকবিতার বই- ছুটির দিন দুপুরে, বিষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর ও পাখিরা ফিরে আসে, কিশোরকবিতা-সাহিত্যের অনবদ্য মাস্টারপিস্। তার কয়েকটি উজ্জ্বল উদাহরণ-
ভয়েতে বুক চেপে/ ঝাউয়ের শাখা পাখির পাখা/ উঠছে কেঁপে কেঁপে/ তখন একটি দুটি তিনটি করে এসে/ একশো দুশো তিনশো করে/ ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে।... (জোনাকীরা/ আহসান হাবীব)
আলোর পাখি নাম জোনাকি/ জাগি রাতের বেলা/ নিজকে জ্বেলে এই আমাদের/ ভালোবাসার খেলা!... (জোনাকীরা/ আহসান হাবীব)
ঘরের ছেলে হাজার ছেলে বাইরে এসে বলে/ তোমার চোখে জ্বলে কি ভাই/ হীরে মানিক জ্বলে?/ হীরে মানিক কোথায় পাবো?/ তার চেয়েও আলো/ আমার চোখে জ্বেলেছি ভাই ভালোবাসার আলো।... (খেলা/ আহসান হাবীব)
ফুল লিখলাম/ পাখি লিখলাম/ আকাশ এঁকেছিলাম/ তারই মধ্যে/ মনের কথা/ টাঙিয়ে রেখেছিলাম।... (কথার ছবি কথার মালা/ আহসান হাবীব)
আহসান হাবীবের এরকম আরো বহু পঙক্তি পাঠ করে পাঠক অনায়াসে আধুনিক মননে তৈরি নতুন বিন্যাসে সেই জগৎটার ঝলমলে উপস্থিতি টের পেয়ে যাবেন।
কবি আল মাহমুদ বাংলাকাব্যসাহিত্যে এক অনিবার্য নাম। তাঁর কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিন বাংলার মৃত্তিকাবর্তী লোকমানসের একান্ত নিজের ভাষায় মাখানো বাংলাকাব্যের চিরকালীন দলিল। তাঁরই ছড়া-কবিতার সংকলন পাখির কাছে ফুলের কাছে কিশোরকবিতার আরেক মহার্ঘ দলিল। আমরা এটিকে কিশোরকবিতা বা ছড়া বলে টানাটানি করলেও আল মাহমুদের ভাষ্যে তিনি এগুলোকে কবিতা হিসেবেই রচনা করেছেন।
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/ হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।... (নোলক/ আল মাহমুদ)
দরগাতলা পার হয়ে যেই মোড় ফিরেছি বাঁয়/ কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিলো আয় আয়/ পাহাড়টাকে হাত বুলিযে লাল দিঘিটার পার/ এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার/... .../দিঘির কথায় উঠলো হেসে ফুল পাখিরা সব/ কাব্য হবে, কাব্য হবে- জুড়লো কলরব/ কি আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই/ পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।... (পাখির কাছে ফুলের কাছে/ আল মাহমুদ)
বুকের ভেতরের কথাগুলোর কী চমৎকার উপস্থাপন! উদাহরণ আরো আছে-
কান্না থেকে কাব্য লেখার/ চাও কি কোনো মওকা!/ দুঃখী লোকের চরের কাছে/ ভিড়াও তবে নৌকা...। বা ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/ দুয়োর বেঁধে রাখ/ কেন বাঁধবো দোর জানালা/ তুলবো কেন খিল/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল।...(ঊনসত্তরের ছড়া-১)। এগুলোকে ছড়া নামে আখ্যায়িত করতে চাইলেও ওগুলো ছড়া নয়, অনায়াসে কবিতায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
একইভাবে আরেক কবি আসাদ চৌধুরী অসামান্য ছড়ার তালে কী অদ্ভুত কবিতাই না রচনা করে ফেলেনÑ
ট্রেন যায় হিশ-হিশ/ বায়ু যায় ফিশ ফিশ/ চোর যায় চুপ-চাপ/ ট্রাক যায় ধুপ ধাপ/ গরিবের দিন যায়/ কী করে/ কী করে/ কী করে/ জানবার সাধ হলে/ হাত দাও শিকড়ে/ শিকড়ে/ শিকড়ে।
যাঁদের অবদানে এই স্বাধীনতাউত্তর কিশোরকবিতার ধারা আধুনিক মনস্কতার নতুন বাঁক নিলো, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কবি আহসান হাবীব ও কিছুটা নিরীক্ষাধর্মী আল মাহমুদের মধ্যে এটার উজ্জ্বলতা স্পষ্ট হলেও সমকালীন আরো অনেকের অবদানকেও খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। তাঁরা হলেন কবি শামসুর রাহমান, মহাদেব সাহা, মো মনিরুজ্জামান, শামসুল ইসলাম, আখতার হুসেন, অসীম সাহা প্রমুখ। অবশ্য সত্তর দশকের কিশোরকবিতার বাঁক পরির্তনে তাঁদের প্রভাব ততটা উজ্জ্বল নয়।
এর পরেই আশির দশকে আবারো এক ঝাঁক কবি ও কিশোরকবিতাকর্মী এসে এ ভুবনটাকে ভীষণভাবে নাড়া দিলেন। হুমায়ুন আজাদ, নাসির আহমেদ, ফারুক নওয়াজ, রোকেয়া খাতুন রুবী, আবু হাসান শাহরিয়ার, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, খালেদ হোসাইন, প্রণব চৌধুরী, মাহবুবুল হাসান, সুজন বড়–য়া, হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী, ফারুক হোসেন, সৈয়দ আল ফারুক, মাসুদ আনোয়ার, মিহির মুসাকী, সিকদার নাজমুল হক, রহিম শাহ, রাশেদ রউফ সহ আরো কিছু নিবেদিতপ্রাণ কবিতাকর্মী। সবাইকে আমরা যুগের কণ্ঠস্বর হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না। আবার কেউ কেউ চিরায়ত স্বরদ্যোতনার মর্যাদাও পেয়ে যান।
আজীবন প্রতিবাদী প্রয়াত কবি হুমায়ুন আজাদ, যিনি প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে খ্যাতিমান, কিশোর কবিতায় তাঁর উজ্জ্বল অবদান কোন অংশে কম নয়।
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো/ ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো/ ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা/ ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা/ ভালো থেকো চর, ছোটো কুঁড়েঘর, ভালো থেকো।... (শুভেচ্ছা/ হুমায়ুন আজাদ)
কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি/ ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি/ পাখির ডানায় আঁকা বনের ছবি/ চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি/ আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে/ বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।... (কখনো আমি/ হুমায়ুন আজাদ)
আমি শুধুই ভয়ে মরি/ যদি আমি ঘুমিয়ে পড়ি/ স্বপ্নদের কী হবে/ যদি কোন দস্যু এসে/ ভাঙে আমার স্বপ্নকে সে/ বাঁচবো কেমন করে?/ এ পৃথিবী এতো মধুর/ আর গলাতে এতো যে সুর/ শুনি এ-বুক ভরি/ তাইতো আমি রাত্রি ও দিন/ জেগে থেকে নিদ্রাবিহীন/ স্বপ্ন রাক্ষ করি।... (ফাগুন মাস/ হুমায়ুন আজাদ)
এসব অমর পঙক্তি ভুলে যাওয়ার মতো বালখিল্য অকৃতজ্ঞতা আশা করি কিশোরকবিতার কখনো হবে না। হুমায়ুন আজাদের ইঁদুরের লেজ-এর মতো মধ্যমিলের কিশোরকবিতা ক’টি লেখা হয়েছে এই সাহিত্যে?- বিলেত থেকে একটি ইঁদুর ঠোঁটে মাখা মিষ্টি সিঁদুর, বললো এসে/ মুচকি হেসে চুলের ফাঁকে আস্তে কেশে,/ আমাকে কি চিনতে পারো?/ চিনতে আমি পারি তারে, দেখে/ ছিলাম লেকের পারে, মুখখানা তার/ শুক্রবারে, পা-দুখানা রোববারে।...
নবায়নপ্রিয় মেধাবী কবি আবু হাসান শাহরিয়ারও কিশোরকবিতার পাতে ক’ফোটা অমেয় পঙক্তি দিতে ভুল করেননি: আয়রে আমার ছেলেবেলা/ আয়রে ফিরে আয়/ টাপুরটুপুর বর্ষা নুপূর/ পরিয়ে দেবো পায়...(আয়ের আমার ছেলেবেলা)- এর মতো অনন্য সংযোজন আরো রয়েছে তাঁর এবং এই সৃজনশীল মেধাবী কবির সক্ষমতা এখনো প্রশ্নাতীত। তাঁর উজ্জ্বলতা যে কিশোরকবিতাকে আরো সমৃদ্ধ করবে, এমন মন্ময় আশা আমরা করতেই পারি।
এভাবেই নাসির আহমেদ, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল বা খালেদ হোসাইনের মতো আগে পরে সব কবিদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অমূলক নয় যে, তাঁদের কবি স্বভাবের খেয়ালী প্রকৃতির ফাঁকে ফাঁকে পরিযায়ী পাখির মতোই এখানে এসে তাঁরা এই কিশোরকবিতাকে ফুলে ফুলে পরিপুষ্ট করে যাবেন প্রতিনিয়ত। কেননা সেই নির্মাণপর্ব থেকেই কবিদের পরিচর্যায়ই এখনো পল্লবিত হয়ে আসছে আমাদের কিশোরকবিতা।
কবিরা খুব সংগত কারণে শুধু এই সীমাবদ্ধ ক্ষত্রেটাকে আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারে না বলে এ অঙ্গনটা বরাবরই সার্বক্ষণিক নেতৃত্বহীন অবস্থায়ই থেকে গেছে। সুযোগ্য মালি না থাকার কারণে এবং অকারণে আগাছা জন্মানোর বিস্তর সুযোগ থেকে যাওয়ায় এই আশির দশকের পর্বে যখন একগুচ্ছ নতুন ও সম্ভাবনাময় মুখ কেবল কিশোর সাহিত্যে কবিতাচর্চায় আত্মনিয়োগের মহতি ইচ্ছা নিয়ে মাঠে নামলেনÑ পাঠকও নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হলেন খুব। চমৎকার চমৎকার আবেগময় পঙক্তিবিন্যাসে পাঠকের মনে আশা জাগিয়ে তুললো গুটিকয় নামÑ ফারুন নওয়াজ, সুজন বড়–য়া, রাশেদ রউফ প্রমুখ। কিশোরকবিতার অন্তর্গত বোধ ও ছন্দ ভুলে কবিতার নামে পদ্যের বর্জ্য ঠেলে ঠেলে ও ব্যতিক্রমী কারো কারো দোলা দেয়া কিছু পঙক্তি পাঠকের নজর এড়ায় না। আগামীর কাণ্ডারি হিসেবে তাঁদেরকে পাঠক কল্পনাও করেন।
মন ভালো নেই পুষ্পরে তোর জানি/ বিলাস না তুই গন্ধ আগের মতো/ মন ভালো নেই, মন ভালো নেই মেঘের/ মন ভালো নেই আকাশ পাড়ের চাঁদের/ শুকতারাটি যখন নীরব, বধির/ তখন বুঝি মন ভালো নেই তারও ... (মন ভালো নেই/ ফারুক নওয়াজ)
পাখির জন্যে আমি যে হন্যে খুঁজে খুঁজে হই সারা/ বুকের ভেতরে চিন্ চিন্ করে বেদনার নীল ধারা/ চোখের ভেতরে টলমল করে শান্ত হলুদ নদী/ সব সেরে যাবে পেয়ে যাই সেই সোনালি পাখিকে যদি। ... (সোনালি ডানায় পাখি/ ফারুক নওয়াজ)
কৃষ্ণচূড়া তোমার এ নাম কে দিয়েছে, কে/ মিশকালো না হয়ে যদি লাল হয়ে ফুটবে/ আলতা রঙে এমন যদি সাজবেই বারবার/ তোমার কেন কৃষ্ণচূড়া নাম হয়েছে আর?/... ... .../ বর্ণমালার স্বর্ণমালা গাঁথতে গেলো সেই/ রফিক সালাম কেউ আসেনি, বাড়িতে কেউ নেই/ নিঝাপ পাড়া মেঘলা দুপুর একলা আমার মা/ কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে আর কষ্ট দিয়ো না। (কৃষ্ণচূড়ার কাছে/ সুজন বড়–য়া)
হাট চিরে মাঠ চিরে/ বালিয়াড়ি নদী তীরে/ কুয়াশার জাল ছিঁড়ে/ ছিপ নৌকায়/ আয়/ আয়/ আয়।/ ধোঁয়া ধোঁয়া গ্রামগুলো/ কাশফুল তুলো তুলো/ মনভুলো মেঠো ধুলো/ সুদূরে মিলায়/ আয়/ আয়/ আয়/... (যেতে যেতে/ সুজন বড়–য়া)
শান্ত মায়ের করুণ বুকে তীব্র দহন নাচে/ কত যে মুখ হারিয়ে গেছে নাম, ঠিকানা আছে।/ ইতিহাসের পাতায় পাতায় নতুন ইতিহাস/ সব জানে তার গাছের পাতা, সব জানে তার ঘাস।/... (আমার আছে স্বাধীনতা/ রোকেয়া খাতুন রুবী)
আমি তখন ঘাস হয়ে যাই অথবা হই নদী/ কেউ দেখে না ঢেউ খেলে ঠিক ছুটছি নিরবধি।... (দুরন্ত সম্রাট/ রাশেদ রউফ)
সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টিতে দশকপর্বের বিভাজনটা উনকবিদের জন্য নিশান টাঙিয়ে হাজিরা জাহিরের একটা উপায় হলেও প্রকৃত কবিদের জন্য এটা খুবই অবমাননাকর বিষয়। কেননা কবি নিজেকে নবায়ন করে করে প্রতিনিয়ত সমকালীন করে তোলে চলিষ্ণু থাকতে জানেন। উনকবি এদোজলের বদ্ধস্রোতে আটকে পরে গরহাজির সমকালীনে এসে দশকের চিৎকার জুড়ে নিজেকে জাহির করার ভাঁড়ামোতে লিপ্ত হন। তবুও দশকের হাজিরা খাতাটা প্রয়োজন পড়ে ফেল করে হারানো ছাত্রটা কোন্ সনের পরীক্ষার্থী ছিলো সেটুকু জানার সুবিধার্থে।
আশির দশকে কিশোরকবিতায় আত্মনিবেদিত কর্মী হিসেবে যে ক’জনকে খুবই সম্ভাবনাময় কবি হিসেবে ঝলসে উঠার প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ করি তাদের মধ্যে ঈর্ষণীয় ক্ষমতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও ফারুক নওয়াজ ছড়াসাহিত্যের দিকে সফলভাবে ঝুঁকে পড়ে কিশোরকবিতা অঙ্গনকে বঞ্চিত করলেন। তবুও এ অঙ্গন এখনো আশাবাদী তাঁকে ফিরে পাওয়ার। আর সুজন বড়–য়া, যিনি বাড়ির সাথে আড়ি ও আজ সারাদিন আমরা স্বাধীন নামের দুটো অনন্য সাধারণ কিশোরকাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়ে কিশোরকবিতার ইতিহাসের সাথে নিজের নামটাকে গেঁথে নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি করলেন, দু’যুগের ব্যবধানে এসে তিনিও কেন যেন নামের প্রতি আর সুবিচার করলেন না।
উন্নত সৃষ্টির মাধ্যমে নিজকে নবায়ন করতে না পারলেও নিম্নমানের বর্জ্য উৎপাদন করে বাজারী সাহিত্যপাতা দখল করে রাখাটা যে নিজেকেই অসম্মান করা, কিছু কিছু সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদকদের পাশাপাশি আজকাল আমাদের অনেক কবিসাহিত্যিকেরও এই বোধজ্ঞান লোপ পেয়ে গেছে। হাতে ধরে আমাদের শিশু কিশোর পাঠকদের সামনে তুলে দেয়া তেমন একটি উদাহরণ-
‘দু’দিনের ছুটি হাতে পেয়ে ছুটি গোপালগঞ্জ বেড়াতে/ বন্ধু আলম তালুকদারের দাওয়াত পারিনি এড়াতে/ সঙ্গী ছিলাম আমরা দু’জন, আমার সঙ্গে বিপ্রদা/ বৃষ্টির দিন মেঘের দাপটে গাড়ির নেই সে প্রিতা/ আকাশের মেঘ মাঠে নেমে যেন গরুদের মতো চরছে/ বাতাসে বাদলে জেলে খালে-বিলে কী মাছ ভেসালে ধরছে/... (গোপালগঞ্জ/ পতাকা আমার আয়না/ সুজন বড়–য়া)।
যাদের ভাণ্ডে যৎকিঞ্চিৎ উজ্জ্বল অহংকার থাকা সত্ত্বেও শুধু আদর্শিক দায়বদ্ধতা না থাকার কারণে পরবর্তিতে শিল্প-ব্যাকরণ হারিয়ে অথৈ অন্ধকারের টানে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়, তার ট্রাজিক উদাহরণ বোধ করি এরকমই হয়।
কবি শামসুর রাহমানের ‘যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’র মতো সবার লেখার খাতাটিই সার্বভৌম। তাই বলে নিজের সাথে মানায় না এমন যা ইচ্ছে তাই ছাপার অক্ষরে গ্রন্থিত করে হাটে ছেড়ে দেয়ার আগে গ্রন্থকারের পুনর্বার ভেবে নেয়াটা জরুরি যে, সকল রচনাই পাঠকের বা ভোক্তার হাতে যাওয়ামাত্রই ওটা আর কারো একার সম্পত্তি থাকে না, সবার হয়ে যায়। একে গ্রহণ বর্জন আর মূল্যায়নের অধিকার পাঠকের আয়ত্তে এসে যায়। রচনাকার তখন নিজেকে সংশোধন বা নবায়ন করার সুযোগ হয়তো পেতে পারেন, কিন্তু অস্বীকারের কোন উপায় তাঁর হাতে থাকে না। পাঠক যাঁকে নির্ভর করেন, যাঁর প্রতি শুভ ইচ্ছা পোষণ করে আশাবাদী হবার প্রেরণা পান, তাঁর অবনমনে সেই পাঠকই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যান সবচেয়ে বেশি।
হাতির বর্জ্যরে নীচে চাপা পড়ে চিত্রল হরিণ
আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত সেই উক্তিটি আমরা সবাই জানি, আবার জানিও নাÑ “সব মানুষকে তুমি কিছু সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো; আবার, কিছু মানুষকে তুমি সব সময়ের জন্যেও বোকা বানাতে পারো; কিন্তু সব মানুষকে তুমি সব সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো না।” পাঠককে বুদ্ধু ভাবা যে গ্রন্থকারের কতো বড় নির্বুদ্ধিতা তা যিনি না বুঝেন তাকে কি বলা যায়? এই একবিংশ শতাব্দির তুমুল সময়ে এসেও নির্বাচিত কিশোর কবিতা বা কিশোর কবিতা সমগ্র নাম দিয়ে যদি কতকগুলো পদ্যবোঝাই কাগজের মলাটবন্দি ভাণ্ড পাঠকের হাতে ধরিয়ে দেয়ার তুঘলকীকাণ্ড ঘটিয়ে কেউ বাহ্বা নেয়ার পায়তারি করেন, তাঁরা পাঠককে অবমূল্যায়নই করলেন! নির্বাচিত পদ্য সংকলন নাম দিলে বরং পাঠক সেখানে পদ্যের মধ্যে কোথাও কোথাও কবিতার ঝিলিক ও আস্বাদ পেয়ে গেলে গ্রন্থকারকে তাঁর সাফল্যে হাত খুলে অভিনন্দন জানানোর মওকা পেয়ে যেতেন।
ফেব্র“য়ারি ২০০৪-এ শৈলী প্রকাশন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রাশেদ রউফ-এর নির্বাচিত কিশোর কবিতা নামের গ্রন্থটি কি এ থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে? গোটা গ্রন্থে দু-একটা লেখা কবিতা হয়ে ওঠার খুব কাছাকাছি চলে এলেও বাকিগুলো নিরেট পদ্য মাত্র। কবিতার অনিবার্য বৈশিষ্ট্য চিত্রকল্প নির্মাণ যে শুধুই কিছু শব্দসমষ্টি দিয়ে তৈরি কল্পচিত্র নয়Ñ শ্রমনিষ্ঠ এই বোধটাকে আয়ত্বে না এনেই শব্দের ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারিতার (না কি আনাড়িপনা?) কারণে, অন্তত গুটিকয় যে লেখাগুলো বিষয়-বৈচিত্র মেনে কবিতা হয়ে ওঠতে পারতো, তা হয় নি; বিকলাংগ হয়ে গেছে।
‘যখন আকাশে গোলাপের মতো সোনালি সূর্য ওঠে/ ডিমের হলুদ কুসুমের মতো ঘোলাটে বিকেল আসে/ শিশির মাখানো চাঁদের আলোতে রজনীগন্ধা ফোটে/ তখন কেবল আব্বুর ছবি আমার দু-চোখে ভাসে/... (আব্বুকে মনে পড়ে/ নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রাশেদ রউফ)।
‘আব্বুকে মনে পড়ে’ শিরোনামের বেয়াল্লিশ চরণের দীর্ঘ রচনাটি পড়তে গিয়ে আবারো ‘ম্যাকলিশের’ সেই বিখ্যাত পঙক্তিটি পাঠককে স্মরণে আনতে বলি- ‘কবিতা কিছু বোঝায় না/ কবিতা হয়ে উঠে।’ বোঝাতে যাওয়ার বাহুল্যদোষে আক্রান্ত হয়ে পড়া রচনাটিতে লেখক শব্দে শব্দে অক্ষরে অক্ষরে বর্ণনাধর্মী কাহিনীচিত্র এঁকে এটাকে একটা পদ্যই বানিয়েছেন। চিত্রকল্পের প্রতীকী ব্যঞ্জনা দিয়ে গোটা লেখাটিকে কবিতায় উত্তীর্ণ করতে আরাধ্য আবেগের যে সংহতি ও পাঠককে কল্পনা বিস্তারের সুযোগ করে দিতে হয়, লেখকের বর্ণনাপ্রবণ মেড়মেড়ে মোহের কবলে পড়ে পুরোটাই ফানুস হয়ে গেছে। পাঠককে উক্ত রচনাটি একবার পড়ে দেখার অনুরোধ করি। লেখকের আক্ষরিক বর্ণনার বাইরে মায়াবী দ্যোতনার কোন সফল প্রয়াস কি চোখে পড়ে?
চিত্রকল্পের ভুল ব্যবহার বা প্রয়োগে কবিতা কীভাবে মার খেয়ে যায় তার একটা নমূনা উদাহরণ-
‘শ্বেত কপোতের ডিমের মতো মিষ্টি চাঁদের আলো-/ ঝরছিল যেই, এই মনে হয়- বিশ্বটা জমকালো,/ আকাশ তখন আকাশ তো নয়, ফুটফুটে নীল শাড়ি/ চোখ জুড়ানো মন জুড়ানো মোহন মনোহারী।’... (চাঁদের হাসি ফুলের হাসি/ নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রাশেদ রউফ)।
‘শ্বেত কপোতের ডিমের মতো মিষ্টি চাঁদের আলো’- চাঁদনি রাতের কী অদ্ভুত সুন্দর এক চিত্রকল্পময় ব্যঞ্জনা! সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু কবি যখন রাতের আকাশটাকে ‘ফুটফুটে নীল শাড়ির’ হটকারী রূপক দিয়ে পাঠকের চোখ ফুটো করে দিলেন, তখন সত্যিই প্রশ্ন জাগে, হতে গিয়েও কবিতা হয়ে না ওঠার আক্ষপেটা কি পাঠককে এভাবে ভারাক্রান্ত করতো, যদি লেখক অন্তত একটিবার কবির দৃষ্টি দিয়ে রাতের আকাশটাকে আগ্রহভরে দেখতেন! রাতের আকাশ কি নীল হয়?
শব্দের ব্যবহারও যে কী ভয়াবহ হতে পারে রাশেদ রউফের লেখা থেকে আরেকটি নমূনা না টানলে শেষপর্যন্ত পাঠককেই বঞ্চিত করা হবে। ‘কোথাও যাবো না আমি’- একটি ভালো লেখা হতে পারতো। রচনাটিতে প্রচলিত কিশোরকাব্য প্রকরণের ভাঙচুরকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। এখানে তিনি বৈচিত্র সৃষ্টির প্রয়াস করেছেন। কিন্তু একটি সম্ভাবনার মাথায় বজ্রপাত ঘটে রচনাটির সর্বশেষ পঙক্তিতে এসে-
‘কোথাও যাবো না আমি, এ ঘরে নীরবে/ শুধু ঘুমাবো,/ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব লাল-শাদা-নীল/ স্বপ্ন খাবো।’
যেখানে শেষ করলেন তিনি, সেই ভয়ঙ্কর ‘খাবো’ শব্দটি খেয়াল করুন। তাঁর শিল্পুধা বুঝি এতোই প্রবল হলো যে, ঘাড় ধরে অন্ত্যমিল করতে গিয়ে তিনি ‘স্বপ্ন’ তো খেলেনই, একই সাথে কবিতাটাকেই খেয়ে ফেললেন!
আরো খারাপ অবস্থা বইপড়া প্রকাশনী থেকে বইমেলা ২০০৪-এ প্রকাশিত রহীম শাহ’র ‘নির্বাচিত কিশোর কবিতা’ নামের গ্রন্থটির েেত্র। কবিতা হয়ে ওঠার মতো একটি লেখাও যে চোখে পড়ে নি, তা কি শুধু চালশে-চোখা পাঠক হিসেবে চারুময় চোখের অভাব, না কি অন্য কিছু?
‘শীতের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে/ শীতের পাখিরা হাওড়ের জলে ভাসছে/ সরালি লেন্জা লালশির নীলশির/ চখাচখি ভূতি দীঘরেরা করে ভিড়/ ’... (শীতের অতিথি/ নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রহীম শাহ)।
এ জাতীয় পদ্য লেখা দোষের কিছু নয়; ওটাও একটা সাহিত্য মাধ্যম বৈ কী। তবে পাঠককে ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে নয় নিশ্চয়ই। ইদানিং বুঝে না বুঝে অনেকেই এই স্থূল প্রবণতায় যে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন, তাও কিন্তু পাঠকের চোখ এড়ায় না।
শিশুকিশোর সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় কিশোরকবিতার চর্চাতে মেধামননের ব্যবহার তুলনামূলক বেশি করতে হয় বলে সবাই এখানে শেরপা হতে পারেন না। কবিতা নির্মাণে সাফল্য অর্জনকারীর সংখ্যা তাই নিতান্তই সীমিত। স্বীয় অঙ্গনে যথেষ্ট প্রতিপত্তি সম্মান ও কদর পেয়ে এঁরা সামনের কাতারে চলে এসে প্রতিষ্ঠানমুখীনতার যে সুবিধাগুলো ভোগ করেন, শ্রমনিষ্ঠ সাধনার অভাবে যাঁরা নিজেদের নবায়নযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন, বাজার বাণিজ্যের এ যুগে সুযোগ ও সুবিধাগুলো তখন কুক্ষগিত রাখার মোহটাকে ছাড়তে পারেন না। এবং মিডিয়া-বাণিজ্যের লুলোপতাও তাঁদেরকে তা ছাড়তে দেয় না। এই গড্ডালিকা প্রবাহের ফাঁদে পড়ে অন্য আরো অনেক সম্ভাবনাময় মেধাগুলো পাঠকের পাতে নিজেকে বিছিয়ে দেবার সুযোগবঞ্চিত হয়ে মুল্যায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, কেউ তা ভাবেন না বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে ভাবতে চান না। এভাবেই হাতির বর্জ্যরে নিচে চাপা পড়ে যায় আমাদের কতো চিত্রল হরিণেরা। তবু সময় বড় নির্মম। প্রতিনিধিত্বের আসনে যাঁরা একবার নিজেদেরকে বসিয়ে অনড় হতে চাইবেন, কালের চুক্ষ তাঁদেরকে তাড়া করবেই। আজকের আলোচনাটাও এরই প্রতীকী ব্যঞ্জনামাত্র।
নব্বই দশকে এসে এই কবিতাচাষে যেসব মেধাবী ও নিবেদিতমনা সাহিত্যকর্মীরা মনোযোগী হলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’জন হলেন কবি টোকন ঠাকুর, রমজান আলী মামুন, নাসির উদ্দিন তুসী, জাকির আবু জাফর, আকতার হোসাইন, ধ্র“ব এষ ও জুলফিকার শাহাদাৎ প্রমুখ। কিশোরকবিতায় কবিদের অবদানের সেই ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার বয়ে আনলেন কবি টোকন ঠাকুর। সাহিত্যচর্চার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে তিনি একে পরিপুষ্ট করার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছেন। অন্যদিকে ইদানীংকালের তুমুল জনপ্রিয় তরুণ প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্র“ব এষ-এর কবিতাচর্চর চমৎকারিত্বের সাথে তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ শৈলীও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একটা ফড়িং/ যাচ্ছে উড়ে/ যাচ্ছে উড়েরে/ তুই কি ফড়িং হবি?/-না/ তুই কি পাখি হবি?/ -না/ ফড়িং হয়ে পাখি হয়ে কোথাও যাবো না/ আজ না, না, না/ কোথাও যাবো না। (ধ্র“ব এষ)।
এ পর্বে উজ্জ্বল ও মেধাবী মনে হয়েছে জুলফিকার শাহাদাৎ এর রচনাকে। নতুন স্বর নতুন দ্যোতনা এবং প্রচলিত শৈলী ভেঙে ছন্দভাণ্ডারে এক ছন্দময় খেলার বুনন দেখা যায় তার কবিতাগুলোতে। বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে/ মেঘলা মেয়ের একলা দু’চোখ/ উপুড় করে/ বৃষ্টি পড়ে।/ বৃষ্টি পড়ে/ শব্দ করে/ শব্দ কিসের?/ শব্দতো নয়/ দুঃখ ব্যথা/ কান্না হাসির/ লিরিক ঝরে/ বৃষ্টি পড়ে।... (বৃষ্টি যদি দৃষ্টি পেতো/ জুলফিকার শাহাদাৎ)।
কিশোরের মনোরাজ্যে জুলফিকার শাহাদাৎ-এর সুররিয়ালিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি কিশোর কবিতায় আধুনিকতার নতুন এক জগতে টেনে নিয়ে যায় আমাদেরকে:... আমার এ চোখ মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ফসল ফলাবে বলে/ লাঙল ফলাতে মেহেদীর রঙ এঁকে যায় কৌশলে/ আমার এ চোখ রংধনু মাখা নতুন পৃথিবী চায়/ জোনাক আলোয় ধুয়ে দেবে মাটি বিষাদের কান্নায়।... (আমার এ চোখ/ জুলফিকার শাহাদাৎ)
নতুন শতাব্দীর জন্মলগ্নের নতুন দেখার নতুন এ চোখ বুঝি চেয়ে আছে সেসব মুখের দিকেÑ শূন্য দশকের আনোয়ার মোস্তাফা, জিয়াউল আশরাফ, সাইফ মেহেদী, নাফে নজরুল, শাকিল ফারুক, শাকিল মাহমুদ, জিয়া হক, সাজ্জাদ হোসাইন, কামাল হোসাইন, নরেন্দ্র সুসন্ধ্যা, মুহিব নেছার ও রহমান তাওহীদের মতো আরো ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসতে থাকা কবিতার নতুন জোনাকিদের দিকে।
প্রবহমান নদীর কোন উপসংহার থাকে না
আলোচনাটি হঠাৎ করে এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু কালের কলসে আরো কিছু জল জমুক না হয়। অসম্পূর্ণ এ আলোচনা পেশাদার প্রবন্ধচিন্তাপ্রসূত কোন গবেষণাধর্মী আলোকসম্পাতও নয়, বরং পাঠকের সাথে পাঠকভাবনাকে মিলিয়ে দেখার অভিজ্ঞতাজাত বিনিময় প্রয়াসমাত্র। তাই অনিচ্ছায় অজান্তে চারুসৈকতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দেখা ও জানার অগোচরে থেকে যাওয়া আরো যে সব মুক্তোরাজি ভাবনাকথায় অনিবার্য উঠে আসার কথা ছিল, রচনাকারের সীমাবদ্ধতার কারণে তা হয়নি। মুক্তোকে নুড়ি ভাবার ঝুঁকিময়তার সাথে নুড়িকে মুক্তো ভাবার বাহুল্য আবেগবিভ্রম ঘটে গেছে মনে হলে তা পাঠক থেকে পাঠকে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ও রস অভিজ্ঞতার ভিন্নতা কেবল, পাঠক নিশ্চয় বিষয়টি উপলব্ধি করবেন।
সে ক্ষেেত্র পৃথিবীর সমস্ত রচনাই বা কোন রচনাই চূড়ান্ত বিচারে সম্পূর্ণ নয়। ##
গ্রন্থসূত্র
১. কবিতার বীজতলা/ আবু হাসান শাহরিয়ার/ সাহিত্য বিকাশ/ ফেব্র“. ২০০৫/ ঢাকা।
২. কবিতা অকবিতা অল্পকবিতা/ আবু হাসান শাহরিয়ার/ সাহিত্য বিকাশ/ ফেব্র“. ২০০৪/ ঢাকা।
৩. ছন্দের বারান্দা/ শঙ্খ ঘোষ/ অরুণা প্রকাশনী/ ১৩৭৮/ কলিকাতা।
৪. কবিতার কথা/ জীবনানন্দ দাশ/ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র/ জানু. ২০০২/ ঢাকা।
৫. শব্দের সম্ভাবনা/ মঈন চৌধুরী/ সংবেদ/ ফেব্র“. ২০০৭/ ঢাকা।
৬. ছুটির দিন দুপুরে/ আহসান হাবীব/ বাংলাদেশ শিশু একাডেমী/ অক্টো. ১৯৭৮/ ঢাকা।
৭. কবিতা সমগ্র/ আল মাহমুদ/ অনন্যা/ বইমেলা ২০০২/ ঢাকা।
৮. কাব্য সমগ্র/ হুমায়ুন আজাদ/ আগামী প্রকাশনী/ ফেব্র“.২০০৫/ ঢাকা।
৯. সেরা কিশোর কবিতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ সম্পাদনা-আমীরুল ইসলাম/ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র/ নভে.১৯৯৭/ ঢাকা।
১০. বাংলা ছন্দের রূপরেখা/ মাহবুবুল আলম/ খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি/ মে ২০০৪/ ঢাকা।
১১. বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য, নানামুখি আলোকপাত/ চন্দ্রাবতী একাডেমী/ আগস্ট ২০০৬/ ঢাকা।
১২. নবারুণ/ সচিত্র কিশোর মাসিক পত্রিকা/ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর/ ফেব্র“. ২০০৭/ ঢাকা।
১৩. ছড়াসমগ্র/ ফারুক নওয়াজ/ বর্ণতরু/ ঢাকা বইমেলা ২০০৪/ ঢাকা।
১৪. কিশোর কবিতাসমগ্র/ সুজন বড়–য়া/ বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি/ আগস্ট ২০০৭/ চট্টগ্রাম।
১৫. নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রাশেদ রউফ/ শৈলী প্রকাশন/ ফেব্র“.২০০৪/ চট্টগ্রাম।
১৬. নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রহীম শাহ/ বই পড়া/ বইমেলা ২০০৪/ ঢাকা।
১৭. আকাশকে খোলা চিঠি/ জুলফিকার শাহাদাৎ/ ছোটদের মেলা/ অমর একুশে ২০০৭/ ঢাকা।
রণদীপম বসু , ঢাকা, বাংলাদেশ।
# নির্বাচিত অংশ: ‘ছড়াপত্রিকা’, ত্রয়োদশ সংখ্যা, ফেব্র“য়ারি ২০০৮ #
web published:
Mukto-mona
Satrong
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment